#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ১১
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন
প্রাপ্তির পায়ের তালু থেকে কাঁচের টুকরো সরিয়ে সযত্নে ব্যান্ডেজ করে দেয় সাগর। যদিও বিষয়টা আহামরি কিছু না তবুও প্রাপ্তির দেখাশোনা সে নিজ দায়িত্বে করছে। কারণ আগে তো প্রাপ্তি শুধু অর্পনের জন্য বিশেষ কেউ ছিলো, কিন্তু এখন পরিচয়ের পরিসর আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাপ্তি, সুপ্তি ওরা দুজন দীপ্তির বোন। কথাটা সাগর আগে না জানলেও এখন জেনেছে। তাই দীপ্তির প্রতি যতই রাগ থাকুক, মনে যতই অভিমান জমে থাকুক কিন্তু দায়িত্ব এড়াতে পারেনি। দীপ্তির পরিবারকে যে সাগর নিজের পরিবারের জায়গায় বসিয়েছে।
ব্যান্ডেজ শেষ করে উঠে দাঁড়ায় সাগর। প্রাপ্তির পাশে দাড়িয়ে কোমল গলায় বলে,
—“ব্যাথা কি কমেছে প্রাপ্তি?”
প্রাপ্তি উপর নিচ মাথা নেড়ে হ্যা সম্বোধন বোঝায়। প্রাপ্তির উত্তর পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সাগর। তারপর পেছন ঘুরতেই দেখে সবাই তার দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সবার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে সাগর অভয় দিয়ে বলে,
—“চিন্তা করবেন না, সব ঠিক আছে। তবে এরকম চলতে থাকলে বেশিদিন ঠিক থাকবে না। আগের দিনের ক্ষত এখনো ঠিক হয়নি এর মধ্যে আবার। মেয়েটার খেয়াল তো রাখতে পারেন আপনারা।”
দিলারা বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন। ক্রন্দন কন্ঠে বলেন,
—“আর এমন হবে না ডাক্তার সাহেব। আমার মেয়েটাকে সুস্থ করে দিন।”
—“কিছুদিন বেড রেস্টে থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে। একটা দিন এখানেই রাখুন। আগামীকাল বাসায় নিয়ে যেতে পারেন।”
কথাটুকু বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় সাগর। আর এক মুহুর্তও পেছনে ঘুরে তাকায় না। দীপ্তিকে দেখলেই তার মনের পুরনো ঘা আবার জেগে উঠছে। তাই আপাতত একা থাকা বড্ড প্রয়োজন।
সাগর চলে যেতেই সজীব ঘুরে তাকায় সুপ্তির দিকে। রুমের একপাশে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে আছে মেয়েটা। ভয়ে, চিন্তায় মুখটা শুকিয়ে গেছে। সজীবের সাথে চোখে চোখ মিলতেই ছলছল চোখে তাকায় সুপ্তি। প্রাপ্তির এই অবস্থার জন্য সুপ্তি যে নিজেকে দায়ী ভাবছে সেটা বুঝতে সজীবের আর বাকি নেই। সুপ্তিকে সান্ত্বনা দিতে সজীব এগিয়ে যাবে তার আগেই দিলারা বেগম তেড়ে যান সুপ্তির কাছে। একটা হাতের বাহু ধরে ঝাকিয়ে বলেন,
—“তোকে বলেছিলাম না প্রাপ্তির কাছেই থাকতে। এতো কিসের ছটফটানি তোর? তুই ওর কাছেই থাকলে আজ মেয়েটাকে এতো কষ্ট পেতে হতো না। মেয়েটা আমার আঘাতের ওপর আঘাত পেয়ে যাচ্ছে। কোথায় গেছিলি বল?”
মায়ের ধমকে আরো জড়সড় হয়ে দাঁড়ায় সুপ্তি। চোখ দুটো পানিতে টলমল করছে। এগিয়ে আসে সজীব আর দীপ্তি। সুপ্তিকে দিলারা বেগমের থেকে ছাড়িয়ে নিজের পেছনে আড়াল করে নেয় সজীব। সুপ্তির পক্ষ নিয়ে বলে,
—“এভাবে বকছেন কেনো মা? বাচ্চা মেয়ে। ভূল না হয় করেই ফেলেছে। আর করবে না। আপনি প্লিজ ওকে বকবেন না।”
এদিকে সুপ্তিকে বকতে শুনে প্রাপ্তিও অস্থির হয়ে যায়। ওঠার চেষ্টা করে বলে,
—“মা তুমি ছুটকি কে বকছো কেনো? থামবে তুমি? এখানে ওর তো কোনো দোষ নেই।”
সবার প্রতিবাদী আওয়াজে থেমে যান দিলারা বেগম। কিন্তু সুপ্তিকে কাঁদিয়ে ছেড়েছেন। এই মেয়েটা বড্ড ছটফটে। একটুও শান্ত ভাবে কোথাও থাকে না।
————————
এখন বাজে রাত নয়টা। প্রাপ্তির পাশেই টুলের ওপর বসে ওষুধগুলো বের করছে সজীব। ওষুধ খাওয়ানোর সময় হয়ে গেছে। দিলারা বেগম, মারুফ সাহেব আর কামরুল সাহেবকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে সজীব। যদিও কেউ যেতে চাচ্ছিলো না, একপ্রকার জোর করেই সবাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। কামরুল সাহেবের হাই প্রেশার। প্রাপ্তির চিন্তায় তার প্রেশার বেড়ে গেছে। আবার রাত জেগে এখানে থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন। বয়স্ক মানুষ কি আর এতো ধকল সয্য করতে পারে? তাই জোর পূর্বক সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। হসপিটালে আপাতত আছে সজীব, দীপ্তি আর সুপ্তি। সুপ্তিকে হাজার বলেও বাসায় পাঠাতে পারেনি। দিলারা বেগমের বকুনি খাওয়ার পর থেকেই মন খারাপ করে প্রাপ্তিকে ধরে বসে ছিলো। সজীব অনেক বুঝিয়ে মেয়েটাকে স্বাভাবিক করেছে। মন খারাপ দূর করতে সুপ্তির সখকে জাগিয়ে দিয়েছে। আপাতত সে লাইভে তার ফ্যান ফলোয়ারদের সাথে গল্প করছে।
প্রাপ্তিকে ওষুধগুলো দিয়ে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেয় সজীব। ওষুধ গুলো হাতে নিয়ে আশ্চর্য হয়ে যায় প্রাপ্তি। মুখ কাচুমাচু করে বলে,
—“এতো ওষুধ কেনো দাদাভাই? এতো ওষুধ খেতে আমার একদম ভালো লাগে না। আমি খাবো না প্লিজ।”
প্রাপ্তির কথা শুনে ভ্রু কুঁচকায় সজীব। কপাট রাগ দেখিয়ে বলে,
—“ওষুধ খাবো না মানে? ওষুধ না খেলে সুস্থ হবি কিভাবে? শোন প্রাপ্তি, তোকে নিজের পায়ে দাড়াতে হবে। একলা চলা শিখতে হবে। অন্যের ওপর নির্ভর করে চলা আমি তোকে কখনো শেখাইনি। এমনকি অন্যের ওপর নির্ভরশীল তোকে হতেও দেবো না। তাই ওষুধ তো খেতেই হবে।”
—“তাই বলে এতো ওষুধ! আমার হাত ভরে গেছে ওষুধে।”
একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ে সজীব। প্রাপ্তিকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে,
—“এখানে ব্যথার ওষুধের সাথে চোখের ওষুধও আছে প্রাপ্তি। সেগুলো খাওয়ার কথা তো তোর মনেই থাকে না। এমন করলে কি হবে বল? আমি যে তোকে ভালো করতে চাইছি সেটা কি বুঝছিস না? এই সপ্তাহে ডক্টরের কাছে যাওয়ার কথা ছিলো চোখের চেক-আপ করাতে। সেটাও হবে না। অন্তত ওষুধ তো ঠিক মতো খাবি! না হলে আবার চোখের ব্যাথা শুরু হবে।”
আর তর্কে জড়ায় না প্রাপ্তি। সজীবের ওপর ওর পুরো বিশ্বাস আছে। তাই আর কোনো কথা না বলে, চোখ মুখ কুচকে একে একে সব ওষুধ খেয়ে নেয়।
—————————
হসপিটালের বারান্দার শেষ প্রান্তে দাড়িয়ে ফোনের মধ্যে ডুবে আছে সুপ্তি। লাইভে এসে তার ফ্যানদের সাথে দুঃখ বিলাস করছে। বোনের দুর্ঘটনার কথা সবার সাথে শেয়ার করে দুঃখ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে।
একহাতে ফোন ধরে অন্য হাতে সামনের চুল বারেবারে ঠিক করছে সুপ্তি। এর ফাঁকে কমেন্ট গুলো পড়ে তার উত্তর দিচ্ছে। একজন লিখেছে,
—“আপু তুমি দেখতে খুবই মিষ্টি।”
প্রশংসা শুনে খুশিতে আকাশে উড়তে থাকে সুপ্তির মন। পিঠে ডানা থাকলে হয়তো সে সত্যি সত্যি উড়তে শুরু করতো। আনন্দে আপ্লুত হয়ে বলে,
—“প্লিজ এভাবে বলো না, আমার লজ্জা লাগে।”
আর একজন লিখেছে,
—“আপু তুমি এতো ভালো কেনো? আমাদেরকেও শেখাও এতো ভালো হওয়ার রহস্য।”
দ্বিতীয় কমেন্টে সুপ্তির কল্পনার ডানা যেনো দ্বিগুণ বড় হয়ে যায়। মারাত্মক হাসি দিয়ে বলে,
—“আমি জানি আমি অনেক ভালো। কিন্তু কখনো এটা নিয়ে অহংকার করি না। তবে তোমরা চাইলে কিছু টিপস দিতে পারি। এই যেমন ধরে, সবার সাথে ভালো ব্যবহার করা। সবসময় সবার সাথে ভালো ব্যবহার করবে। মিষ্টি করে কথা বলবে। কারো সাথে কখনো কড়া কন্ঠে কথা বলবে না। সে তোমার বড় কোনো শত্রু হলেও না। সব সময় ভদ্রতা বজায় রেখে চলবে। আমিও এসব টিপস ফলো করে চলি। সবসময় সবার সাথে ভালো ব্যবহার করি। ভাষা প্রয়োগে তো আমি ভীষণ সচেতন। এমন আরো অনেক কিছুই আছে।”
নিজের মারাত্মক সব বক্তব্য দিতে দিতে পেছনে হাঁটতে থাকে সুপ্তি। মনোযোগ ফোনের দিকে থাকায় আশেপাশে কি হচ্ছে সেদিকে তার কোনো হেলদোল নেই। এক পর্যায়ে পেছনদিকে হাটতে গিয়ে কারো সাথে ধাক্কা লেগে হুড়মুড়িয়ে ফ্লোরে পড়ে যায় সুপ্তি। হাতের ফোনটা ছিটকে গিয়ে পড়েছে চার পাঁচ হাত দূরে। চোখের চশমা খুলে পাশে পড়ে যায়।
একই অবস্থা অপর পাশের ব্যক্তিরও। সেও ফ্লোরে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়েছে।
এদিকে ধাক্কা খেয়ে মাথা গরম হয়ে গেছে সুপ্তির। পেছনে না ঘুরেই ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,
—“কে রে? কোন কানা হ্যা? চোখে দেখিস না নাকি? ব্যাটা বদ।”
এমন হাই লেভেলের বকা দিতে দিতে পেছনে ঘুরে তাকাতেই থেমে যায় সুপ্তির মুখ। কয়েক সেকেন্ডর জন্য থেমেই জিভে কামর দেয়। অঙ্কন ফ্লোরে বসে রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে সুপ্তির দিকে। চেহারায় তার একরাশ বিরক্তি।
অঙ্কনের এমন লুক দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে যায় সুপ্তি। কিন্তু ভয়টা চেহারায় ফুটে উঠতে দেয় না। কারণ ভয় প্রকাশ করলে লোকটা আরো পেয়ে বসবে। তাই একটা ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করে। তাড়াহুড়ো করে উঠে বুক ভর্তি সাহস নিয়ে আবার ঝগড়া শুরু করে। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,
—“এই আপনার সমস্যা কি বলুন তো? যেখানে সেখানে এমন ধাক্কা মারেন কেনো গরুর মতো?”
অঙ্কন উঠে দাঁড়িয়ে সুপ্তির চেয়ে দ্বিগুণ রাগ নিয়ে বলে,
—“হেই লিসেন চাশমিশ! তোমাকে ধাক্কা দেয়ার আমার কোনো সখ নেই। এমন কি তোমার মুখ দেখতেও আমার বিরক্ত লাগে। আমার কপাল খারাপ তাই বারে বারে তোমার সাথে দেখা হয়ে যায়। না হলে আমার অতো বেহুদা সময় নেই যে তোমার পেছনে তা নষ্ট করবো।”
সুপ্তিও যেনো ঝগড়ার নতুন সুর পেয়ে গেলো। অঙ্কনের কথা শেষ হতেই তালে তাল মিলিয়ে বলে,
—“ও হো…….! আমি তো ভূলেই গেছিলাম আপনি কত নামীদামী ব্যাক্তি। আপনার অতো সময় কোথায়। তবে ভাবার বিষয় হলো আপনি এতো এতো ব্যাস্ততার মধ্যেও আমার সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে ভোলেন না।”
—“তুমি কি আমাকে ইনডিরেক্টলি ঝগরুটে বলছো?”
সুপ্তি একটা মারাত্মক হাসি দিয়ে বলে,
—“ইনডিরেক্টলি নয়। আমি সরাসরি, একদম ডিরেক্টলি আপনাকে ঝগরুটে বলছি।”
রাগে অঙ্কনের চোখ লাল হয়ে গেছে। রাগে ফুঁসে উঠে অঙ্কন বলে,
—“তুমি একটা বেয়াদব। চরম লেভেলের বেয়াদব। বড়দের সম্মান দিতে জানো না?”
—“আপনিও একটা গরু। চোখে কম দেখা গরু। কলিজা কাটা ডাক্তার। মেয়েদের ধাক্কা না দিলে পেটের ভাত হজম হয় না?”
ঝগড়া একদম মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে এমন সময় সেখানে উপস্থিত হয় অর্পন। তাড়াহুড়ো পায়ে অঙ্কনের কাছে এসে বলে,
—“প্রাপ্তি কোথায় অঙ্কন? কি হয়েছে ওর? হসপিটালে কেনো নিয়ে এসেছে?”
অঙ্কন রাগে পুরো আগুন হয়ে রয়েছে। অতিরিক্ত রাগ হওয়ায় আশেপাশের কোনো খেয়াল নেই। এটাও মাথা থেকে হারিয়ে গেছে যে সে এখন হসপিটালে দাড়িয়ে আছে। রাগের বসে চেচিয়ে বলে ওঠে,
—“জাহান্নামে গেছে প্রাপ্তি। আমি কোনো প্রাপ্তির খবর টবর জানি না।”
ভাইয়ের কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকায় অর্পন। তীঘ্ন চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে এখানে আসলে হয়েছে কি। দুজনের রাগে লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে এখানে মারাত্মক লেভেলের ঝগড়া লেগেছে। ব্যাপারটা বুঝতেই চেহারা গম্ভীর করে ফেলে অর্পন। গম্ভীর কন্ঠে বলে,
—“এখানে কি হচ্ছে অঙ্কন?”
এতোক্ষণে হুশ ফেরে অঙ্কনের। ভাইয়ের গম্ভীর কন্ঠ শুনে পাশে ফিরে তাকায়। নিজের ভাইকে পাশে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অঙ্কন। আমতা আমতা করে বলে,
—“ইয়ে মানে ভাইয়া আসলে……।”
হাতের ইশারায় অঙ্কনকে থামিয়ে দেয় অর্পন। কন্ঠ যথাসম্ভব গম্ভীর রেখে বলে,
—“তুই, মানে আমার ভাই! একটা মেয়ের সঙ্গে ঝগড়া করছিস। তাও আবার হসপিটালে দাড়িয়ে। তোর এতো অধঃপতন হলো কিভাবে? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
ভাইয়ের কথায় কন্ঠ নরম হয়ে আসে অঙ্কনের। কন্ঠ নিচে নামিয়ে বলে,
—“আমার কোনো দোষ নেই ভাই। এই মেয়েটা যখনই সামনে আসে কিছু না কিছু গন্ডগোল করে বসে। তাই!”
অঙ্কনের কথায় সুপ্তির গায়ে যেনো জোরে ধাক্কা লাগে। ঝগড়া করার ভঙ্গিতে সুপ্তি বলে,
—“এখন সব দোষ আমার তাই না। নিজে যে বারে বারে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় তার বেলায় কিছুই না। এখন যত দোষ সুপ্তি ঘোষ!”
বিরক্ত লাগে অঙ্কনের। এমনিতে অঙ্কন বেশি কথা বলা পছন্দ করে না। যথা সম্ভব কম কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু যবে থেকে এই মেয়ের সাথে দেখা হয়েছে, অঙ্কন প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি কথা বলছে। বলা যায় অঙ্কন কে সুপ্তি ঝগরুটে বাচাল বানিয়ে দিয়েছে। অঙ্কন আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই ধমকে ওঠে অর্পন। কপাট রাগ দেখিয়ে বলে,
—“আর একটাও কথা নয়। কারো মুখ থেকে আর একটাও কথা বের হলে দুটো কেই জেলে ভরে দেবো। তারপর দুজন আরাম করে ঝগড়া, মারামারি, চুল ছেরা ছিরি করো কেমন।”
অর্পনের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় দুজন। কিন্তু চোখ দিয়ে যেনো একে অপরকে গিলে খাচ্ছে। দুজনকে চুপ হয়ে যেতে দেখে অর্পন বলে,
—“প্রাপ্তি কোথায় আছে অঙ্কন? সেখানে চল।”
আর কোনো কথা না বাড়িয়ে অঙ্কন চুপচাপ এগিয়ে যায় সামনে। পেছন পেছন যায় অর্পন। দুজন সামনে এগোতেই সুপ্তি গিয়ে নিজের ফোনটা তোলে। এখনো লাইভ চলছে। ফোনটা নিয়ে ক্যামেরার সামনে এসে একটা বোকা হাসি দিয়ে বলে,
—“আসলে পাশে দুজন ঝগড়া করছিলো। আমি তাদেরই বোঝাচ্ছিলাম যে ঝগড়া করা ভালো না। মানুষ যে কেনো এতো ঝগড়া করে। ভালো ব্যাবহার ওরা জানেই না। আচ্ছা আবার পরে সবার সাথে আড্ডা দেবো কেমন। বাই।”
বলেই ফোনটা নিয়ে দৌড়ে যায় প্রাপ্তির কাছে।
_____________
বেডের ওপর আধশোয়া হয়ে বসে আছে প্রাপ্তি। পাশেই বসে আছে দীপ্তি। সজীব একটু আগেই বেরিয়েছে কোনো জরুরি কাজে। এক ঘন্টা পর চলে আসবে বলে গেছে। এমন সময় হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢোকে অর্পন আর অঙ্কন। রুমে ঢুকেই অর্পন ব্যাস্ত পায়ে এগিয়ে আসে প্রাপ্তির কাছে। আশেপাশে তাকানোর কথা খেয়ালই নেই। প্রাপ্তির পায়ের কাছে হাটু মুড়ে বসে ব্যাস্ত কন্ঠে বলে,
—“এসব হলো কিভাবে? কি করতে গেছিলে তুমি? আর বাসার সবাই কোথায় গেছিলো? আমি যে সবাইকে বলেছিলাম তোমার খেয়াল রাখতে তাহলে কোথায় ছিলো সবাই? কি হলো কথা বলছো না কেনো?”
পুরো রুম জুড়ে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে। অর্পনের আওয়াজ ছাড়া আর কারো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অর্পনের দিকে। অর্পনের এই অস্থিরতার কারণ কারো মাথায় ঢুকছে না।
সবাইকে চুপ থাকতে দেখে সবার দিকে একনজর তাকায় অর্পন। সুপ্তিকে চোখে পড়তেই ধমকের সুরে বলে,
—“আর তুমি কোথায় ছিলে? সবসময় তো বোনের সাথে আঠার মতো লেগে থাকো। তাহলে এই ঘটনা ঘটলো কিভাবে?”
বলেই উত্তরের আশায় তাকিয়ে থাকে। এতোক্ষণে মুখ খোলে প্রাপ্তি। সন্দিহান কন্ঠে বলে,
—“ব্যাপারটা কি বলুন তো অফিসার? একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না? এক্সিডেন্ট আমার হয়েছে, আপনার না। তাহলে আপনি এতো চেচামেচি করছেন কেনো? যদি আমার কিছু হয়ও, তাতে আপনার কি?”
টনক নড়ে অর্পনের। উত্তেজনায় যে আবেগটা প্রকাশ করে ফেলেছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে। সবার কৌতুহলী চেহারার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় অর্পন। নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে বলে,
—“ভূলে যেও না তুমি একটা কেসের সাথে সরাসরি জড়িত প্রাপ্তি। আর সেই কেসটা হ্যান্ডেল করছি আমি। তাই তোমার কিছু হওয়া মানে আমার বিশাল ক্ষতি। তোমাকে আমার প্রয়োজন প্রাপ্তি। তাই তোমার সুস্থতা আমার জন্য খুবই জরুরি।”
ভ্রু কুঁচকে যায় প্রাপ্তির। অর্পনের কথার ভিন্ন মানে খুঁজে পাচ্ছে প্রাপ্তি। তবে এটা নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামায় না। পারে দেখা যাবে সে বেশি বেশি ভেবে ফেলছে। ফলাফল, চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেবে প্রাপ্তির অক্ষমতা।
বিষয়টা সামাল দিতে পেরেছে বুঝতে পেরেই উঠে দাঁড়ায় অর্পন। অঙ্কনের দিকে তাকিয়ে বলে,
—“ভাই কোথায়? ওর সাথে দেখা করতে হবে।”
—“ভাই ওর কেবিনেই আছে, চলো।”
কথাটা বলেই বেরিয়ে যায় অঙ্কন। সাথে সাথে বেরিয়ে যায় অর্পনও। দড়জার কাছে গিয়ে পা থামিয়ে দেয় অর্পন। পেছন ঘুরে তাকায় প্রাপ্তির দিকে। প্রাপ্তি আধশোয়া হয়ে বসে সামনে তাকিয়ে আছে। সামনে দেখার মতো কিচ্ছু নেই তবুও তার দৃষ্টি সামনে। যদিও বিষয়টা স্বাভাবিক। কারণ প্রাপ্তি তো চোখেই দেখে না। তাই আশেপাশে কি আছে সেটা দেখবে কিভাবে? মনটা খারাপ হয়ে যায় অর্পনের। প্রাপ্তির এই অক্ষমতা অর্পনকে বড্ড কষ্ট দিচ্ছে। এই সত্যিটা কি কোনোদিন বদলাবে না?
________________
ধুলোবালিতে পরিপূর্ণ অন্ধকার একটা ঘরে প্রবেশ করে কেউ। দড়জা থেকে কিছুটা দূরে চেয়ারে হাত পা বেধে রাখা হয়েছে একজন ব্যাক্তিকে। দুই পাশে দুজন লোক লাঠি হাতে দাড়িয়ে। চেয়ারে বাঁধা ব্যাক্তিকে মারতে মারতে হাপিয়ে গেছে দুজন। তবুও সে নির্বিকার। মুখ থেকে একটা আওয়াজও বের হচ্ছে না। একটু পরেই চেয়ারে বাঁধা লোকটার সামনে এসে দাড়ায় কালো পোশাক পরিহিত কেউ। তাকে উদ্দেশ্য করে লাঠি হাতের দুজন লোক বলে,
—“অনেক মেরেছি বস, তবুও মুখ খুলছে না।”
কথাটা শুনতেই রক্ত লাল চোখে তাকায় চেয়ারে বেঁধে রাখা লোকটার দিকে। গালটা চেপে ধরে নিচু করে রাখা মাথাটা উচু করে ধরে। হিংস্র কন্ঠে বলে,
—“এখনো সময় আছে মুখ খোল। বলে দে মেয়ে গুলো কোথায়?”
এতোক্ষণে মুখ খোলে চেয়ারে বাঁধা ব্যক্তি। তার উচ্চ হাসিতে কেঁপে ওঠে পুরো ঘর। হাসতে হাসতে বলে,
—“মেয়েগুলোকে তুই কোনোদিন পাবি না। তোর উদ্দেশ্য কোনোদিন পূরণ হবে না।”
—“তাই? কে আটকাবে আমাকে?”
আবারো উচ্চ স্বরে হেসে ওঠে চেয়ারে বাঁধা ব্যাক্তি। হাসতে হাসতে এক পর্যায়ে হাসি থামিয়ে দেয়। চেহারা শক্ত করে বলে,
—“অর্পন এসে গেছে তোর জন্য। আজ না হোক কাল তোদের কাছে ঠিক পৌঁছে যাবে। তাই বলছি আমাকে মে*রে ফেল। আমি বেঁচে থাকলে তোরা বাঁচবি না। কারণ তোদের পাপের রাজত্ব ধ্বংসের পথে।”
কথাটা বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। পুরো ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে তার হাসির শব্দ।
চলবে?
#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ১২
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন
চেয়ারে বেঁধে রাখা ব্যাক্তির এতো আনন্দময় হাসি সয্য হচ্ছে না তাদের বসের। মুখটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
—“খুব সাহস বেড়ে গেছে তাই না রুহুল? এই… তোর প্রানের ভয় নেই?”
—“বলছি তো মেরে ফেল আমাকে। এখনো বুঝছিস না, প্রানের ভয় আছে কি না!”
—“মরতে তো তোকে হবেই। তবে এতো সহজে তোকে মারবো না। তোকে তো তিলে তিলে মারবো। আমার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করার শাস্তি তোকে তো পেতেই হবে। এতো কষ্ট দেবো যে মরন ভিক্ষা চাইবি আমার কাছে। তবুও মারবো না।”
—“তাহলে তৈরি হয়ে নে। তোর মরন চলে এসেছে।”
রুহুলের এমন নির্ভিক আচরণ দেখে রাগে ফুঁসে ওঠে বস সম্বোধন করা ব্যক্তি। রেগে একটা লাথি মারে রুহুলের বুক বরাবর। চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় থাকায় নিজের ভারসাম্য রাখতে না পেরে চেয়ার সহ পেছনে উল্টে পড়ে যায় রুহুল। ব্যথায় মুখ থেকে বের হয় মৃদু আর্তনাত। অস্ফুটস্বরে গোঙাতে থাকে। একাধারে মারার ফলে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্ত জমে কালচে দাগ হয়ে গেছে। কিছু কিছু অংশ ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। শরীরটা ব্যাথায় নীল রঙ ধারণ করেছে। শত চেষ্টা করেও আর সয্য করতে পারছে না রুহুল। মুখ থেকে হালকা গোঙ্গানির মতো আওয়াজ বের হচ্ছে।
রুহুলের গোঙানির আওয়াজ শুনে বাঁকা হাসে তাদের বস। যেনো রুহুলকে কষ্ট দিতে পেরে মনে পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে। চেয়ার নিয়ে উল্টো হয়ে পড়ে থাকা রুহুলের সামনে দাড়িয়ে ঝুঁকে বলে,
—“বৌয়ের শোক শেষ হয়ে গেছে মনে হয়। তোকে আবার কোনো শোক দিতে হবে। না হলে তুই মুখ খুলবি না।”
আবারো হেঁসে ওঠে রুহুল। হুহা করে হাসতে হাসতে বলে,
—“সব তো কেড়েই নিয়েছিস। আর কিচ্ছু হারানোর নেই আমার। আছে শুধু দেহের এই প্রাণটা। এটাও নিয়ে নে। তাহলে তোর প্রতিশোধ নেয়া হবে।”
আরো একটু ঝুকে আসে বস। রুহুলের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
—“কে বলেছে কিছু নেই। তোর বোনের কথা যে আমি জেনে গেছি রুহুল। আর কিভাবে জেনেছি জানিস? বলতো কিভাবে? আচ্ছা চল আমিই বলি। যে তোদের বাঁচাবে বলে তুই দিবারাত্রি স্বপ্ন দেখছিস তার মাধ্যমেই জেনেছি। হ্যা, অর্পনের মাধ্যমেই জেনেছি। ছেলেটা আসলেই খুব বুদ্ধিমান। যেখানে আমি তোর বংশের একটা পোকার খবরও বের করতে পারলাম না সেখানে তোর বোনের খবর বের করে ফেললো ছেলেটা। তবে আমার বেশ উপকারই হলো। এবার তোর বৌয়ের সাথে যা হয়েছে সেটা যদি তোর বোনের সাথে হয়! কেমন হবে ব্যাপারটা?”
বোনের নাম শুনতেই ভয়ে চমকে ওঠে রুহুল। বকুলের খবর যে ওরা জেনে যাবে সেটা রুহুল কল্পনাও করেনি। বোনের ক্ষতির আশংকা করতেই তেতে ওঠে বোনকে বাঁচাতে। হিংস্র কন্ঠে চেচিয়ে বলে,
—“আমার বোনের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগলে তোকে খু*ন করে ফেলবো কু*ত্তা*র*বা*চ্চা।”
রুহুলের চেচামেচি শুনে পৈশাচিক আনন্দে মেতে ওঠে বস। অট্রহাসিতে ফেটে পড়ে। হেসে ওঠে রুমে উপস্থিত বাকি দুজন চেলাও। সবার শয়তানি হাসিতে ছমছমে করে ওঠে পুরো ঘর। এ যেনো এক ভয়ানক পরিবেশ। হাসি থামিয়ে বস বলে,
—“ভয় লাগছে রুহুল? ভয় লাগছে তাই না? এটাই তো আমি চাই। তুই ভয় পাবি, চেঁচাবি, কাঁদবি, আপনজনকে বাঁচাতে কাকুতি মিনতি করবি। তবুও বাচাতে পারবি না।”
কথাগুলো বলেই উঠে দাঁড়ায় বস। লাঠি হাতে দাড়ানো দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—“ওকে আজ এভাবেই ফেলে রাখ। কাল সকালে খেতে দেয়ার সময় তুলবি। আর মনে রাখিস, ওকে মরতে দেয়া যাবে না। ও মরলে আমার কোটি টাকা লোকসান হবে। তাই একে বাচিয়ে রাখা দরকার। আমি গিয়ে ওর বোনের ব্যবস্থা করি। এবার দেখি ও কিভাবে মুখ না খোলে।”
কথাগুলো বলেই বড় বড় কদম ফেলে বস সেখান থেকে চলে যায়। বাকি দু’জন রুম থেকে বেরিয়ে বাহির থেকে দড়জা আটকে চলে যায়। ভেতর থেকে চিৎকার করতে থাকে রুহুল। বোনের চিন্তায় দম আটকে আসছে তার। এতোদিন বোনকে সবার চোখের আড়াল করে রেখেছিলো। যাতে তার বোনের কোনো বিপদ না হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ওরা তো জেনেই গেলো বকুলের কথা। এখন সে তার বোনকে কিভাবে বাঁচাবে? কি করবে রুহুল? পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
এক পর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে রুহুর। কথায় আছে, পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। কিন্তু ভাগ্যের এই নির্মম পরিণতি দেখে রুহুলের শক্ত পোক্ত পুরুষ স্বত্বাও দুর্বল হয়ে এসেছে। বুক ফেটে বেরিয়ে আসছে হাহাকার। স্ত্রীকে সে বাঁচাতে পারেনি। চোখের সামনে দেখেছে তার নির্মম পরিণতি। নিজের কানে শুনেছে ভালোবাসার মানুষের এক একটা আত্ম চিৎকার। কিন্তু কিচ্ছু করতে পারেনি রুহুল। এখন বোনকেও কি বাঁচাতে পারবে না? কি করবে এখন সে? এক পর্যায়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
—“অর্পন, ভাই আমার! সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আমার বোনকে বাঁচাও ভাই। এই সমাজকে বাঁচাও। তোমার আপনজনদের বাঁচাও। তোমার পেছনে যে বড় শত্রু লেগেছে। অনেক বড় ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ওরা তোমার থেকে সব কেড়ে নেবে, সব। ঠিক আমার মতো। সময় থাকতে শত্রুকে চিনে নাও। সবকিছু বাচিয়ে নাও।”
কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে রুহুল। বন্ধ ঘরের প্রতিটা দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে থাকে রুহুলের এক একটা হাহাকার। মনে হচ্ছে রুহুলের সাথে সাথে ঘরের দেয়ালগুলোও চিৎকার করে কাঁদছে।
______________
সকালে প্রাপ্তিকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। রুমে এনে প্রাপ্তিকে বিছানায় সযত্নে বসিয়ে দেয় সজীব। সারারাত বাড়ি ফেরেনি তাই সকাল সকাল তার মা ফোন দিয়ে বলেছে দীপ্তিকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে। প্রাপ্তিতে ঠিক মতো বাসায় পৌঁছে দিয়ে এবার সজীব শান্তি পেয়েছে। প্রাপ্তির পায়ের নিচে একটা বালিশ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সজীব। পেছনে ঘুরে দীপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
—“চলো! বাসায় ফিরতে হবে। আম্মা ফোন করেছিলেন।”
—“তুমি চলো আমি দু মিনিটে আসছি।”
দীপ্তির কথায় সম্মতি জানিয়ে সজীব নিচে নেমে যায়। সজীব রুম থেকে বের হতেই প্রাপ্তির দিকে তাকায় দীপ্তি। প্রাপ্তি সামনের দিকে একভাবে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে। খুব সাবধানে সুপ্তির হাত ধরে সুপ্তিকে বেলকনিতে নিয়ে যায় দীপ্তি। বোনের আচরণে ভ্রু কুঁচকে তাকায় সুপ্তি। প্রশ্নবোধক কন্ঠে বলে,
—“এখানে কেনো নিয়ে আসলে বড় আপি?”
দীপ্তি একবার চারিদিকে নজর বুলিয়ে নেয়। মূলত দেখছে মারুফ সাহেব আশেপাশে আছে কি না। বাবার কোনো ছায়াও আশেপাশে না দেখে দীপ্তি ফিসফিস করে বলে,
—“হসপিটালে যে ছেলেটা এসেছিলো সেটা কে রে ছুটকি? প্রাপ্তির সাথে তার কি সম্পর্ক?”
বোনের কথা শুনে ভাবনায় পড়ে যায় সুপ্তি। তার বড় আপি ঠিক কার কথা বলছে সেটা ভাবতে থাকে। ভাবনার প্রথমেই তার মাথায় আসে অঙ্কনের কথা। সাথে সাথে মুখ বাকিয়ে সুপ্তি উত্তর দেয়,
—“ওইটা! ওটা তো কলিজা কাটা ডাক্তার। ব্যাটা বদ। সেই লেভেলের অসভ্য একটা লোক। জানো আপি আমি যেখানেই যাই না কেনো, ওই কলিজা কাটা ডাক্তার সেখানে থাকবেই। আর আকাশ থেকে উড়তে উড়তে এসে আমাকে ধাক্কা মারবে। বাজে লোক!”
একদিকে সুপ্তির কথা শুনে বোকার মতো তাকিয়ে আছে দীপ্তি। সুপ্তির সব কথা ওর মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। সুপ্তিকে থামিয়ে দিয়ে সন্দিহান কন্ঠে দীপ্তি বলে,
—“কলিজা কাটা ডাক্তার আবার কি রে? আর তার সাথে প্রাপ্তির কি সম্পর্ক? সে প্রাপ্তিকে নিয়ে এতো চিন্তা করছিলো কেনো?”
এতোক্ষণে বুদ্ধি খোলে সুপ্তির। এবার বুঝতে পারে তার বোন কার কথা বলছে। ভূল সংশোধন করতে জিভে কামর দিয়ে সুপ্তি বলে,
—“ওহো আপি…. তুমি ওই পুলিশ অফিসারের কথা বলছো। আরে উনি তো আমাদের থানার নতুন এস আই। নাম কি যেনো, ও হ্যা অর্পন। উনি কলিজা কাটা ডাক্তার না তবে কলিজা কাটা ডাক্তারের ভাই।”
—“আগে এটা বল, এই কলিজা কাটা ডাক্তার কে?”
হাত দিয়ে কপাল চাপড়ায় সুপ্তি। বোনকে বোঝাতে গিয়ে সে নিজেই সব গুলিয়ে ফেলেছে। হতাশ কন্ঠে সুপ্তি বলে,
—“ওই পুলিশ অফিসারের সাথে একটা ডক্টর ছিলো না? গায়ে এপ্রোণ পড়া। তার কথা বলছি।”
—“আচ্ছা। আর এই পুলিশ অফিসারের সাথে প্রাপ্তির কি সম্পর্ক?”
—“কোনো সম্পর্ক নেই তবে এর আগে আপির যে এক্সিডেন্ট হলো তখন এই পুলিশ অফিসারই আপিকে বাঁচিয়ে ছিলো। তখন থেকে পরিচয়।”
বোঝার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে দীপ্তি। মনে মনে কিছুটা খুশিও হয়। অর্পনের চোখে সে প্রাপ্তির জন্য চিন্তা দেখেছে। প্রাপ্তির অসুস্থতায় অর্পনের চোখে ছিলো অস্থিরতা। যা সবার চোখ এড়ালেও দীপ্তির নজরে ঠিক পড়েছে। এমন একটা ছেলের হাতে বোনকে তুলে দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত হয় দীপ্তি। যে প্রাপ্তির খেয়াল রাখবে, কেয়ার করবে। এমন ছেলেই তো বোনের জন্য চাই।
এরই মাঝে সজীব ডেকে ওঠে দীপ্তিকে। সজীবের ডাক শুনে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে দীপ্তি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বেশ দেরি হয়ে গেছে। সময় মতো বাড়ি না পৌঁছালে শ্বাশুড়ি তার যুদ্ধ লাগিয়ে ছাড়বে। তাই তাড়াহুড়ো পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
_______________
রেস্টুরেন্টের কর্ণারে একটা টেবিলে বসে আছে অর্পন। তার বিপরীত পাশে মুখোমুখি হয়ে বসে আছে এখানকার থানার প্রাক্তন এস আই দিদার সাহেব। বেশ গম্ভীর হয়ে বসে আছেন তিনি। আপাতত দু’জনেই চুপ, কেউ কোনো কথা বলছে না। এরই মাঝে একজন ওয়েটার তাদের কাছে আসে। হাতের ট্রে থেকে দুটো কফির কাপ টেবিলে রেখে সে চলে যায়। ওয়েটার চলে যেতেই একটা কফির কাপ হাতে নেন দিদার সাহেব। গরম গরম কফিতে একটা চুমুক দিয়ে দিদার সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
—“কাজ কতদূর?”
—“এখনো কোনো খবর পাইনি স্যার!”
অর্পনের তাৎক্ষণিক জবাবে নড়েচড়ে বসেন দিদার সাহেব। একটু ঝুকে এগিয়ে এসে সতর্ক কন্ঠে বলেন,
—“তোমার কি মনে হয় অর্পন? কোথায় থাকতে পারে রনি?”
কফির কাপে একটা চুমুক দেয় অর্পন। আশেপাশে একবার সতর্ক দৃষ্টিতে নজর বুলিয়ে বলে,
—“অনেক চেষ্টা করছি স্যার কিন্তু রনির কোনো খবর নেই। ওর ফোন নাম্বার বন্ধ। বাসায় গিয়েছিলাম, সেখানে বহুদিন কেউ থাকে না। যোগাযোগের কোনো মাধ্যম খোলা রাখেনি। জানি না ছেলেটা কোথায় আছে। কি অবস্থায় আছে।”
অর্পনের কথা শুনে চিন্তায় পড়ে যান দিদার সাহেব। চিন্তিত ভঙ্গিতে হাতের আঙুল দিয়ে কপাল স্লাইড করতে থাকেন। অর্পনের মতো রনিও তার পছন্দের একজন পুলিশ অফিসার। তাই রনিকেই প্রথম তিনি এই কেসটা দিয়েছিলেন। রনি নিজের মতো করে কাজ করছিলোও। কিন্তু হঠাৎ করেই ছেলেটা গায়েব হয়ে গেছে। কোথায় গেছে, কি হয়েছে তার সাথে সেটা কেউ জানে না। রনির পর অর্পন হলো দিদার সাহেবের ভরসার জায়গা তাই তিনি অর্পনকে এই কেসের দায়িত্ব দিয়েছেন।
চাকরির বয়স শেষ দিদার সাহেবের। অবসরে গেছেন কয়েকমাস হলো। কিন্তু প্রিয় মানুষগুলোর বিপদ দেখে চুপচাপ বসে থাকতে পারছেন না। হাতে ক্ষমতা না থাকলেও নিজের মতো করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তার কথাতেই রনি ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল অপরাধীদের মধ্যে, তাদের হাতেনাতে ধরার জন্য। এখন চিন্তা হচ্ছে বিষয়টা নিয়ে। ওরা আবার রনিকে চিনে ফেলেনি তো? ছেলেটার কোনো বিপদ হয়নি তো? যদি তাই হয় তাহলে রনির বিপদে পড়ার জন্য দায়ি দিদার সাহেব। তাই চিন্তায় তার ঘুম হারিয়ে গেছে। রনিকে খুজে না পাওয়া পর্যন্ত তিনি শান্তি পাচ্ছেন না।
নিরবতার ভঙ্গ হয় অর্পনের ফোনের আওয়াজে। দুজনের চিন্তার মাঝেই অর্পনের ফোনে একটা ম্যাসেজ নোটিফিকেশন আসে। আনমনে ফোনটা হাতে নিয়ে একনজর দেখে আবার টেবিলে রেখে দেয় অর্পন।
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই চকিত ভঙ্গিতে তাকায় অর্পন। তাড়াহুড়ো করে ফোনটা হাতে নিয়ে ম্যাসেজটা চেক করে। একটা অচেনা নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে।সেখানে লেখা আছে, “বকুলের প্রাণ সংশয় আছে। তাকে বাঁচাও” ব্যাস এটুকুই।
ম্যাসেজটা পড়তেই ভ্রু কুঁচকে যায় অর্পনের। কৌতুহল বসত নাম্বারটাতে ফোন করে। কিন্তু নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। আশ্চর্য হয়ে যায় অর্পন। এই মাত্র ম্যাসেজ দিয়ে সাথে সাথে ফোন বন্ধ করে ফেলেছে। কে হতে পারে এটা। তবে এতোকিছু আপাতত ভাবার সময় নেই। যদি সত্যি বকুলের বিপদ হয়! বাচ্চাটা নিজেকে রক্ষা করবে কিভাবে?
অর্পনের চিন্তত মুখ দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকান দিদার সাহেব। কৌতুহলী কন্ঠে বলেন,
—“সব ঠিক আছে অর্পন? কিছু কি হয়েছে?”
দিদার সাহেবের কথার মাঝেই দাড়িয়ে পড়ে অর্পন। ব্যাস্ত কন্ঠে বলে,
—“স্যার আমাকে এক্ষুনি বেরোতে হবে। রুহুল নামক ছেলেটার বোন বকুল বিপদে আছে। আমার সেখানে যাওয়া জরুরি। আপনার সাথে আবার পরে দেখা করছি।”
এটুকু বলেই দৌড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় অর্পন। অর্পন জানে না কে ম্যাসেজটা দিয়েছে। কথাটা আদৌ সত্যি নাকি মিথ্যে সেটাও জানে না। তবে যদি সত্যি বকুলের বিপদ হয় আর সেটা জেনেও অর্পন তাকে বাঁচাতে না পারে তাহলে অর্পন নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না। তাই সব চিন্তা বাদ দিয়ে ছুটে যায় বকুলকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে।
________________
নিজের ঘরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে হেডফোনে গান শুনছে প্রাপ্তি। পাশেই সুপ্তি বসে ল্যাপটপে মুভি দেখছে। এমন সময় মারুফ সাহেব সেখানে উপস্থিত হন। বাবার উপস্থিতি বুঝতে পেরে চোখ তুলে তাকায় সুপ্তি। সামনে নিজের বাবাকে দেখে ল্যাপটপ থেকে মনোযোগ সরিয়ে বলে,
—“আব্বু তুমি এখানে! কোনো দরকার?”
সুপ্তির মুখে আব্বু ডাক শুনে সোজা হয়ে বসে প্রাপ্তি। কান থেকে হেডফোন খুলে পাশে রেখে দেয়। সামনে হাত বাড়িয়ে নিজের বাবাকে খুজতে খুজতে বলে,
—“কখন এলে আব্বু? বসো।”
প্রাপ্তিকে হাত বাড়িয়ে হাতড়াতে দেখে মেয়ের হাত ধরে ফেলেন মারুফ সাহেব। যেনো হাত ধরে তার উপস্থিতির জানান দিচ্ছেন। মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
—“মাত্রই এসেছি। এখন কেমন আছো আম্মু? পায়ের ব্যথা কমেছে?”
প্রাপ্তি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। প্রাপ্তির সম্মতি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন মারুফ সাহেব। এরপর সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বলেন,
—“সুপ্তি আম্মু, বাবার জন্য এক গ্লাস শরবত বানিয়ে আনো তো। খুব গরম লাগছে।”
বাবার কথা শুনে তখনই সুপ্তি উঠে চলে যায় রান্নাঘরের দিকে। সুপ্তি চলে যেতেই প্রাপ্তির দিকে ঘুরে বসেন মারুফ সাহেব। মেয়ের হাত মুঠো করে ধরে বলেন,
—“একটা কথা বলবো প্রাপ্তি? বাবার কথা রাখবে?”
ভ্রু কুচকে যায় প্রাপ্তির। বাবা ঠিক কি বলতে চাইছে? ভ্রু কুঁচকেই প্রাপ্তি জবাব দেয়,
—“জ্বি বলো আব্বু। তোমার কথা কি আমি কখনো অমান্য করেছি?”
ভরসা পান মারুফ সাহেব। ভনিতা না করে সরাসরি বলেন,
—“সব বাবাই তার সন্তানের ভালো চায়। তার মেয়ের ভালো কোথাও বিয়ে হোক, তার মেয়ে সুখী হোক এটাই চায়। আমিও তার ব্যাতিক্রম নই। আমিও যে আমার মেয়েদের ভালো চাই। তাই সবদিক চিন্তা করে আমি তোমার বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন তোমার মতামত কি আম্মু?”
বিয়ের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় প্রাপ্তি। কয়েক মুহুর্তের জন্য মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলে। তারপর নিজেকে সামলে জবাব দেয়,
—“এসব কি বলছো আব্বু? তাছাড়া, তোমার অন্ধ মেয়েকে কে বিয়ে করবে?”
প্রাপ্তির মুখে অন্ধ নামটা শুনে মন খারাপ হয়ে যায় মারুফ সাহেবের। প্রতিবাদ করে তিনি বলেন,
—“এভাবে আর কক্ষণো বলবে না প্রাপ্তি। আমার মেয়ে সবার সেরা। কোনো কমতি নেই তার মাঝে। আর তারা সব জানে। সবটা জেনেই বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে। তাছাড়া দেখতে আসলেই তো বিয়ে হয়ে যায় না।”
বাবার কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলে প্রাপ্তি। মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসে। ধীর কন্ঠে বলে,
—“তাহলে সব ঠিক করেই ফেলেছো। বেশ! আসতে বলো। দেখে যাক তারা। এ আর এমন কি।”
মেয়ের সম্মতি পেয়ে খুশি হয়ে যান মারুফ সাহেব। হাসি মুখে বলেন,
—“বারে বারে ফোন করে জানতে চাইছিলো তারা আসবে কি না। আমি কোনো জবাব দিতে পারছিলাম না। এখন শান্তি পেলাম।”
এরই মাঝে সেখানে সুপ্তি চলে আসে। সুপ্তির হাত থেকে শরবতের গ্লাসটা নিয়ে মারুফ সাহেব হাসিমুখে চলে যান। এদিকে বাবার হাসিখুশি মুখ দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় সুপ্তির। হঠাৎ তার বাবা এতো খুশি হয়ে গেলো কেনো?
চলবে?