তারে আমি চোখে দেখিনি পর্ব-২৫+২৬

0
92

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ২৫
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

বাড়ি জুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। আনাচে কানাচে বিচরণ করছে চিন্তার দল। ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী রুপ ধারন করে কাঁপিয়ে তুলছে এক এক জনের হৃদয়। স্থির শান্ত বাড়িটাকে মুহুর্তেই অশান্ত করে তুলেছে একটা দুঃসংবাদ। সন্তানের সম্মুখে বিপদ। এই অবস্থায় কি কোনো বাবা মা ঠিক থাকতে পারে? একদম পারে না। মারুফ সাহেব আর দিলারা বেগমও ঠিক নেই। মেয়ের অ*প*হ*র*ণ হওয়ার খবর শোনার পর থেকেই বিচলিত হয়ে পায়চারি করছেন মারুফ সাহেব। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন না। সোফার এক কোণায় বসে আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছেন দিলারা বেগম। নিঃশব্দে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছেন। একই অবস্থা কামরুল সাহেবেরও। নাতনির চিন্তায় বৃদ্ধ নিজেই অসুস্থ বোধ করছেন। এক হাতে লাঠি ধরে চুপচাপ বসে আছেন।

কিছুক্ষণ পর প্রাপ্তির ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন ডক্টর জাহিদ। তার সাথে বেরিয়ে আসেন দিদার সাহেব। সুপ্তির চিন্তায় প্রাপ্তির অবস্থা নাজেহাল হয়ে যায়। বাড়ি এসে শরীরের অবশিষ্ট শক্তিও ফুরিয়ে আসে আপনজনের সান্নিধ্যে পেয়ে। হামলে পড়ে মায়ের বুকে। চিৎকার করে কান্না শুরু করে দেয়। কান্নার দাপটে মুখ থেকে কথাই বের হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে মায়ের বুকেই ঢলে পড়ে।

আকস্মিক প্রাপ্তির এই করুন অবস্থা দেখে চিন্তায় পড়ে যায় সবাই। কনস্টেবল রহিম তখন সবাইকে সবটা খুলে বলে। এক মেয়ে জ্ঞান হারিয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। অরেক মেয়ে কিছু অসৎ লোকের হাতে বন্দী হয়ে গেছে। সবগুলো ঘটনা বাড়ির প্রতিটি সদস্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। দিশেহারা হয়ে পড়েন মারুফ সাহেব। তখন বুদ্ধি করে দিলারা বেগম তার বড় ভাই দিদার সাহেবকে ফোন করে সবটা জানান। ঘটনাটা শুনেই দিদার সাহেব তৎক্ষনাৎ চলে আসেন। ডক্টরকেও তিনিই সাথে করে নিয়ে আসেন।

প্রাপ্তির ঘর থেকে বাহিরে আসতেই নজর পড়ে চিন্তিত মুখে বসে থাকা প্রতিটি সদস্যদের দিকে । মারুফ সাহেব বিচলিত ভঙ্গিতে ডক্টরকে জিজ্ঞেস করে,

—“আমার মেয়ে কেমন আছে ডক্টর?”

—“অতিরিক্ত চিন্তা আর ভয়ে প্যানিক এ্যটাক হয়েছে। তাকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। লম্বা রেস্টের প্রয়োজন। তবে খেয়াল রাখবেন ঘুম ভাঙার পর আবার যেনো উত্তেজিত না হয়ে ওঠে। তাহলে খারাপ কিছু ঘটতে পারে। আমি কিছু ওষুধ লিখে দিয়েছি, এগুলো দিবেন আপাতত। আশা করি এতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

কথাগুলো মারুফ সাহেবকে বুঝিয়ে বলে তার হাতে প্রেস্কিপশন ধরিয়ে দেন ডক্টর। তারপর দিদার সাহেবের সাথে টুকটাক কথা বলে চলে যান সেখান থেকে। ডক্টর যেতেই দিদার সাহেব তাকান কনস্টেবল রহিমের দিকে। সে এক কোণে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। অর্পনের নির্দেশেই সে এখানে আছে। যাওয়ার অনুমতি পায়নি এখনো।

রহিমের দিকে এক পলক তাকিয়ে এগিয়ে আসেন দিদার সাহেব। রহিমের মুখোমুখি দাড়িয়ে বলেন,

—“সুপ্তিকে খুঁজতে পুলিশ ফোর্স গেছে?”

—“জ্বি স্যার! অর্পন স্যার নিজে দায়িত্ব নিয়েছেন। প্রাপ্তি ম্যমকে আমার সাথে পাঠিয়েই বেরিয়ে পড়েছেন।”

মাথা নিচু করে গটগট করে জবাব দেয় রহিম। অর্পন দায়িত্ব নিয়েছে শুনে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করেন দিদার সাহেব। অর্পনের ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বোনের পাশে বসেন। আদুরে ভঙ্গিতে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। ছোট বোনটাকে তিনি নিজের সন্তানের মতো করে মানুষ করেছেন। কখনো কোনো দুঃখ বোনের আশপাশ ঘেষতে দেননি। তবে আজ তার বোনকে দুঃখ ছুয়েই দিলো। বুকটা হাহাকার করে ওঠে দিদার সাহেবের। বোনের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

—“আগে তো ভাই ছাড়া কিছুই বুঝতি না। এখন ভাইয়ের কথা মনেই পড়ে না তাই না? এতো কিছু হয়ে গেলো আর তোরা আমাকে কিচ্ছু জানাসনি। এই দিয়ে দু’বার হামলা হলো বাড়ির মেয়েদের ওপর। অথচ আমি আজ জানতে পারলাম।”

বহু কষ্টে কান্না থামান দিলারা বেগম। ভাইয়ের হাত চেপে ধরে অপরাধী কন্ঠে বলে,

—“তুমি দেশে ছিলে না ভাই। তাই কিছু জানাইনি। তোমার থেকে কিচ্ছু লুকানো আমার উদ্দেশ্য ছিলো না বিশ্বাস করো।”

দীর্ঘ শ্বাস ছাড়েন দিদার সাহেব। সবার দিকে তাকিয়ে আস্বস্ত সুরে বলেন,

—“চিন্তা করো না কেউ। অর্পনের ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস আছে। ছেলেটার ব্যক্তিত্ব আমার বড্ড প্রিয়। ও যখন কথা দিয়েছে তখন ঠিক সুপ্তিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে।”

————————-

দুপুরের মাঝামাঝি সময়। ঘড়ির কাটা বারোর ঘর পেরিয়ে একের ঘর ছুঁই ছুঁই। ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ট পরিবেশ। সূর্য তার পূর্ণ শক্তিতে উত্তাপ ছাড়াতে ব্যস্ত। মায়া হচ্ছে না কারো জন্য। নিজের কড়া উত্তাপে পৃথিবী পুড়িয়ে দিতে চাইছে যেনো।

ভার্সিটির সামনের একটা রেস্টুরেন্টের রিসেপশনে বসে আছে অর্পন। ঘামে ভিজে ইউনিফর্ম গায়ের সাথে আষ্টেপিষ্টে লেপ্টে আছে। রেস্টুরেন্টেটা বেশ নামি-দামি হওয়ায় ভেতর বাহির মিলে বেশ কয়েকটা সি সি ক্যমেরা আছে। রিসেপশনের মনিটরে সকাল এগারোটার সিসিটিভি ফুটেজ চেক করছে অর্পন। সেখানে দেখতে পায় প্রাপ্তি গেটের কাছে দাড়িয়ে আছে। আর সুপ্তি রিকশার জন্য রাস্তার কাছে এগিয়ে এসেছে। আকস্মিক একটা কালো গাড়ি এসে সুপ্তিকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়। গাড়িটা মনিটরে ধরা দিতেই সাথে সাথে ভিডিও পস করে দেয় অর্পন। গাড়ির নাম্বার নোট করে সাথে সাথে ফোন লাগায় কোথাও। রিসিভ হতেই গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“একটা গাড়ির নাম্বার পাঠাচ্ছি। গাড়ির মালিক কে আর আজ সকাল এগারোটায় গাড়িটা কোথায় কোথায় গেছে। কোন কোন সিগন্যাল পার করেছে, সমস্ত ডিটেইলস চাই আমার। হাতে সময় নেই। যা করার দ্রুতো করো। যত লোক লাগে লাগাও। কুইক।”

কথাগুলো বলে কল কেটে দেয় অর্পন। পরপর আরো একটা নাম্বারে ফোন লাগায়। রিসিভ হতেই পূর্বের ন্যায়ে একই ভঙ্গিতে বলে,

—“নাম্বার পাঠাচ্ছি একটা। ইমিডিয়েটলি নাম্বারটার লোকেশন আমার চাই। আপাতত কোনো প্রশ্ন নয়।”

এক নিশ্বাসে কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দেয় অর্পন। কান থেকে ফোন নামিয়ে একটা নাম্বারে গাড়ির নাম্বার আর অন্য নাম্বারে সুপ্তির মোবাইল নাম্বার পাঠিয়ে দেয়। কাজ শেষ করেই মাথা চেপে ধরে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে অর্পন। গরমে মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছে। তার সাথে মাথায় ঘুরছে প্রাপ্তির চিন্তা। রহিম একবার ফোন করে জানিয়েছে প্রাপ্তি উত্তেজনায় প্যানিক এ্যটাক করেছে। জ্ঞানহীন অবস্থা পড়ে আছে ঘরে। কথাটা শুনতেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে অর্পনের। তখন থেকে বুকটা জ্বলছে। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। সুপ্তিকে সুস্থ অবস্থায় না পেলে প্রাপ্তির সামনে দাড়াবে কিভাবে অর্পন? চিন্তায় দম বন্ধ হয়ে আসছে অর্পনের। তার চাকরির জীবনে সে অনেক কঠিন কঠিন কেস সল্ভ করেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। কখনো ভয় পায়নি বা হতাশ হয়নি। তাহলে আজ এতো ভয় কাজ করছে কেনো? সেটা কি প্রাপ্তির মুখোমুখি হতে হবে বলে?

মিনিট দশেক যেতেই অর্পনের ফোন সশব্দে বেজে ওঠে। ফোনটা অর্পন হাতেই রেখেছিলো। বেজে উঠতেই রিসিভ করে অর্পন। ওপার থেকে শোনা যায় কারো ব্যস্ত কন্ঠের আওয়াজ,

—“স্যার, গাড়িটা রাবেয়া নামক কোনো একজন ভদ্র মহিলার। গাড়িটা ভার্সিটির রোড থেকে বেরিয়ে মতিঝিল পর্যন্ত এসেছে। তারপর আর কোনো সিগন্যালে গাড়িটা দেখা যায়নি। এর মানে মতিঝিলের মধ্যেই কোথাও থেমেছে।”

কথাগুলো চুপচাপ শুনে নিঃশব্দে ফোন কেটে দেয় অর্পন। পরপর আবার ফোন বেজে ওঠে অর্পনের। অঙ্কন ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অঙ্কনের ব্যস্ত কন্ঠ শোনা যায়,

—“নাম্বারটা মতিঝিলের কোথাও শো করছে। কিন্তু তুমি এই খবর দিয়ে কি করবে ভাই? আর এটা তো সুপ্তির নাম্বার।”

—“সুপ্তিকে কেউ কি*ড*ন্যা*প করেছে অঙ্কন।”

কথাটা শুনতেই চমকে ওঠে অঙ্কন। নিজের কানকেই যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটাচ্ছে। বিস্মিত কন্ঠে বলে,

—“কি বলছো ভাই? কখন? কিভাবে? আমি কি আসবো? মানে কোনো সাহায্য লাগবে?”

—“আপাতত না। সাহায্যের প্রয়োজন পড়লে আমি নিজেই ডেকে নেবো।”

কথাগুলো বলেই ফোনটা কেটে দেয় অর্পন। ছকটা শুরু থেকে মাথায় আরো একবার কষে নেয়। সন্দেহের তীরটা গিয়ে বেঁধে মতিঝিলের সেই পুরনো বাড়িটায়। যা বুঝার বুঝে গেছে অর্পন। ঝটপট উঠে দাঁড়ায়। রেস্টুরেন্টের ম্যনেজারকে ধন্যবাদ জানিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে যায়। এখান থেকে সবার আগে থানায় যেতে হবে। তারপর সেখান থেকে নিজের ফোর্স নিয়ে সেই বাড়িতে যেতে হবে। অর্পন আগেই আক্রমণ করতে চায়নি। ভালো মতো প্ল্যান বানিয়ে তারপর আক্রমণ করতে চেয়েছিলো। তবে এখন আর দেরি করা যাবে না। সময় এসে গেছে অপরাধীদের মুখোমুখি হওয়ার।

—————————–

আবছা আলো অন্ধকারে আবৃত মাঝারি সাইজের একটি কক্ষ। চার দেয়ালের কোথাও কোনো জানালা নেই। প্রাকৃতিক আলোর ছিটেফোঁটাও নেই এই ঘরে। মাথার ওপর শুধু অল্প পাওয়ারের কমলা আলো জ্বলছে। ঘরে নেই কোনো বাতাসের ব্যবস্থা। মাথার ওপর জ্বলতে থাকা লাইটের আলো চোখে পড়তেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় সুপ্তি। দীর্ঘ সময় পর জ্ঞান ফেরায় লাইটের আলো সুক্ষ তীরের মতো বিঁধছে চোখে। সয্য করতে পারে না সুপ্তি। সাথে সাথে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলে। কয়েক মুহুর্ত হাত দিয়ে চোখ রক্ষা করতেই আলোটা সয়ে আসে চোখে। ধীর গতিতে চোখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে উঠে বসে সুপ্তি। নিজের অবস্থান পর্যবেক্ষন করতে ঘরের চারিদিকে নজর বুলায়। তখনই নিজেকে আবিষ্কার করে একটা স্যাতস্যাতে নোংরা কক্ষে। গা গুলিয়ে ওঠে সুপ্তির। পেটের ভেতর যা আছে সব বেরিয়ে আসতে চাইছে। হঠাৎ মস্তিষ্ক কাজ করতে শুরু করে। মনে পড়ে যায় ভার্সিটির সামনে থেকে তাকে অ*প*হ*র*ন করা হয়েছে। গাড়িতে তুলে মুখে রুমাল চেপে ধরে কেউ। মুহুর্তেই সুপ্তি বোধ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে সুপ্তির। এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকায় নিজের দিকে। নাহ্, পোশাক একদম ঠিক আছে। এর মানে এখনো খারাপ কোনো ঘটনা ঘটেনি তার সাথে।

পুরো ঘরে নজর বুলাতেই চোখে পড়ে বাম পাশে একটা কাঠের দড়জা। দড়জাটা প্রায় ভেঙেই গেছে। সেই ভাঙা দড়জার ছিদ্র দিয়ে সুক্ষ্ম আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। কৌতুহল জাগে সুপ্তির মনে। আলো কেনো জ্বলছে ওই ঘরে? কে আছে সেখানে। অজানা বিষয় জানার কৌতুহল ঘিরে ধরে সুপ্তিকে। সাহস করে উঠে দাঁড়ায় সুপ্তি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। প্রচন্ড ব্যথাও করছে। হাঁটার শক্তিও পাচ্ছে না। বড্ড দুর্বল হয়ে পরেছে শরীর। হয়তো অজ্ঞান হওয়ার ওষুধের প্রভাবে। শরীরে ওপর জোর খাটিয়ে উঠে দাঁড়ায় সুপ্তি। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে চোখ রাখে দড়জার ছিদ্রে। সঙ্গে সঙ্গে বড় বড় চোখে তাকিয়ে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে সুপ্তি। চোখে তার আকাশ সমান বিস্ময়। ওপাশের ঘরে দশ বারো জন মেয়ে আছে। সবগুলো নেশায় উন্মাদ হয়ে একজন আরেকজনের গায়ে ঢলে পড়ে আছে। নড়াচড়া করছে ঠিকই কিন্তু কারোর হুশ নেই।

শুকনো ঢোক গেলে সুপ্তি। ভয়ে অন্তরাত্মা কাপছে। সেই সাথে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে একাধিক প্রশ্ন। কে এই মেয়ে গুলো? তাদের এই অবস্থা কেনো? তবে কি সুপ্তি নারী পাচারকারীর হাতে পড়েছে? বাকি মেয়েগুলোর সাথে সুপ্তিকেও পাচার করে দেবে? সময়ের সাথে সাথে ভয়ের পরিমাণটা বেড়ে যাচ্ছে সুপ্তির। এবার সে বাঁচবে কিভাবে? কে বাঁচাবে ওকে? বাঁচার কথা চিন্তা করতেই মাথায় আসে অর্পনের নাম। তড়িঘড়ি করে নিজের ব্যাগ খুঁজতে থাকে। কিন্তু পুরো রুমের কোথাও নিজের ব্যাগ খুজে পায় না। এর মানে ব্যাগসহ মোবাইল গাড়ির মধ্যেই কোথাও পড়ে আছে। হতাশার নিশ্বাস ছাড়ে সুপ্তি। বাঁচার আশা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। সেই সাথে মনোবলও হারিয়ে ফেলছে।

হঠাৎ করেই দড়জার বাইরে থেকে একাধিক মানুষের গলার আওয়াজ শুনতে পায় সুপ্তি। তড়িঘড়ি করে যেভাবে শুয়ে ছিলো আবার সেভাবেই শুয়ে পড়ে। যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে, ওর জ্ঞান ফিরেছে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করে বাইরের লোকদের বলা কথোপকথন। শুনতে পায় রাগী সুরে কারো গর্জন,

—“এই মেয়েটাকে কোন সাহসে তুলে এনেছিস?”

সজীবের গর্জন শুনে ভয়ে কেঁপে ওঠে সামনে দাড়ানো পাঁচজন ব্যক্তি। ভয়ে রীতিমতো তাদের হাঁটু কাঁপতে শুরু করেছে। মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। সবাইকে চুপ দেখে সজীবের রাগ আরো বেড়ে যায়। দ্বিগুণ বেগে গর্জে উঠতেই একজন গড়গড় করে বলে,

—“ভুল হয়ে গেছে বস। আর এমন ভুল হবে না। আমাদের মাফ করে দিন। ম্যাডাম যেই মেয়ের কথা বলেছিলো আমরা তাকেই তুলতে গেছিলাম। কিন্তু দুজনেই একই রঙের জামা পড়ে ছিলো তাই বুঝতে পারিনি। এমন ভুল আর হবে না বস।”

সজীব রক্ত লাল চোখে তাকিয়ে আছে সবার দিকে। মুখ দিয়ে একটা আওয়াজও করছে না। সজীবকে চুপ থাকতে দেখে ভয়ের মাত্রা বেরে যাচ্ছে সবার। তাদের বস একজন নির্দয়, পাষাণ মানুষ। তার কাছে ভুলের কোনো ক্ষমা নেই। ভুল যখন করেছে তখন শাস্তি তো দেবেই। কিন্তু সজীবকে চুপ থাকতে দেখে তাদের কলিজা কাপছে। না জানি শাস্তি ঠিক কতবড় হবে।

পাঁচজনের মধ্যে থেকে একজন সাহস করে এগিয়ে এসে বলে,

—“বস, অপরাধ নেবেন না। কিন্তু ভুল করেও একটা কাজ তো ভালোই হয়েছে। যেই মেয়েগুলো আমাদের কাছে আছে তাদের মধ্যে একজন আজ সকালে ম*রে গেছে। আপনার মামা এসেছিলো আজ। আজও মে*রে ফেলেছে একজনকে। ওই মেয়ের জায়গায় ভুল করে তুলে আনা মেয়েটাকে দিয়ে দিলেই তো হয়। কষ্ট করে সংখ্যা পূরন করতে আর কাউকে আনতে হবে না। ফায়দা তো আমাদেরই হলো।”

বাকি চারজন সম্মতি জানিয়ে বলে,

—“ঠিকই তো। আপনি তো এই ভয় পাচ্ছেন যে এই মেয়েকে ছেড়ে দিলে আমাদের পর্দা ফাস হয়ে যাবে। তাহলে ওকে ছাড়ার দরকার কি? এই মেয়েটাকেও পা*চা*র করে দেই। তাহলে আমাদের লাভও হবে আবার ধরা পরার ভয়ও থাকবে না।”

সবার দিকে একবার শান্ত চোখে তাকায় সজীব। মুহুর্তেই পরপর পাঁচটা গুলির আওয়াজে কেঁপে ওঠে পুরো বাড়ি। সামনে দাড়িয়ে থাকা পাঁচজন লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। সবার কপাল ছিদ্র হয়ে রক্তধারা বইছে অবিরাম। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে থাকে। এক সময় নিথর হয়ে যায় সবাই। বন্ধ হয়ে যায় নড়াচড়া। রুমের চারিদিকে দাড়িয়ে থাকা বাকি লোকরা দেয়ালের সাথে সিটিয়ে আছে। কেউ মুখ দিয়ে একটা আওয়াজও বের করছে না। তাদের মধ্যে কেউই অকালে প্রাণ হারাতে চায় না।

চলবে?

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ২৬
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

পরপর পাঁচটা গুলির আওয়াজ শুনে ভয়ে কেঁপে ওঠে সুপ্তি। দুচোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। হৃদপিণ্ডের চলাচল যেনো কয়েকশো গুণ বেড়ে গেছে। মন বলছে আর বেশি সময় নেই। যেকোনো মুহুর্তে গুলি এসে ঝাঁঝরা করে দেবে সুপ্তিকে। আর বোধহয় বাঁচা হলো না। চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিজের পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মুখ। অস্ফুট স্বরে বলে,

—“আমার বোধহয় বাড়ি ফেরা হলো না মা। বাবার আদরও আর পাবো না। আপির খেয়াল রাখা এখানেই শেষ। দাদু কি খুব অসুস্থ হয়ে পড়বে? বড় আপিও অনেক কাঁদবে! দাদাভাই তো পাগলই হয়ে যাবে। সবশেষে মনে একটাই আফসোস থেকে গেলো, কলিজা কাটা ডাক্তারের করা অপমানের প্রতিশোধ নিতে পারলাম না। আপির বিয়েতে নাচার সখ আমার সখই থেকে গেলো।”

বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতেই চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে সুপ্তির। শরীরের সব শক্তি ফুরিয়ে গেছে। বাঁচার আশা হারিয়ে ফেলেছে। সে তো প্রাপ্তির মতো শক্ত নয়, বড্ড নরম মনের। তাই তো অল্পতেই হার মেনে নিয়েছে। হঠাৎ খট করে দড়জা খোলার আওয়াজ শুনতে পায় সুপ্তি। কান সজাগ রেখে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে। যাতে কেউ দেখলে ভাবে সুপ্তি এখনো অজ্ঞান। এই মুহুর্তে ওদের সামনে ধরা দিতে চাইছে না সুপ্তি। জ্ঞান ফিরেছে বুঝলে যদি খারাপ কিছু করে। যতক্ষণ শরীরে শক্তি অবশিষ্ট আছে, নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে সে।

এরই মাঝে ঘরে প্রবেশ করে কয়েক জোড়া পা। বন্ধ চোখেই হালকা করে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে সুপ্তি। সামনেই একজন মানুষ দাড়িয়ে আছে। তবে চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। হুডি দিয়ে কপালের অর্ধেক ঢাকা আর মাস্ক দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা। চোখে সানগ্লাস। এজন্য চেহারা দেখা যাচ্ছে না।

লোকটা সুপ্তির সামনে হাঁটু মুড়ে বসে। নাকের কাছে আঙুল ধরে দেখে নিঃশ্বাস চলছে কি না। সুপ্তির গরম নিঃশ্বাস আঙুল স্পর্শ করতেই উঠে দাঁড়ায় সে। কাঠকাঠ কন্ঠে দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“এখানে নিয়ে আসার পর ওর কি জ্ঞান ফিরেছিলো?”

—“না বস, এখনো জ্ঞান ফেরেনি। ওষুধ দেয়া বেশি হয়ে গেছে মনে হয়।”

কথাটা শুনতেই উত্তর দেয়া ব্যক্তির কলার চেপে ধরে সজীব। বাঘের মতো গর্জে উঠে বলে,

—“এতোদিন ধরে এসব শিখিয়েছি তোদের? ওষুধের মাত্রা কম বেশি হয় কি করে? ভুল আমি একদম সয্য করতে পারি না। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নিস।”

সোহেল এতোক্ষণ চুপচাপ সজীবের পাশেই দাড়িয়ে ছিলো। এই পর্যায়ে এসে ভয় ভয় কন্ঠে বলে,

—“ওদের শাস্তি দেয়ার অনেক সময় আছে বস। কিন্তু এখন এই মেয়েটাকে কি করবেন? এতো সময় ধরে অজ্ঞান হয়ে আছে। খারাপ কিছু হয়ে যাবে না তো?”

—“হওয়া চলবে না। যেভাবে ওকে নিয়ে এসেছিস, ঠিক সেভাবেই ফিরিয়ে দিয়ে আসবি।”

কথাটা শুনে চমকে ওঠে সোহেল। অবাক কন্ঠে বলে,

—“কিন্তু বস, এই মেয়েকে ছেড়ে দিলে যদি পুলিশের কাছে যায়? তখন? আমরা তো ধরা পড়ে যাবো।”

সোহেলের দিকে বিরক্ত চোখে তাকায় সজীব। রাগে মাথার রগ টগবগ করছে। এদের বিস্তারিত বোঝাতে গিয়ে রাগটা আরো বেড়ে যাচ্ছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে সজীব বলে,

—“ওকে যখন তুলে আনা হয়েছে তখন সবার মুখে মাস্ক ছিলো। সুতরাং তখন কারো চেহারা ও দেখেনি। এখানে আসার পর জ্ঞান ফেরেনি মানে এই জায়গা সম্পর্কেও ওর স্মৃতিতে কিচ্ছু থাকবে না। তাহলে পুলিশকে বলবে কার কথা? এখন সবই কি আমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে?”

মাথা নত করে দাড়িয়ে থাকে সবাই। কেউ আর কোনো কথা বলার সাহস পায় না। সুপ্তির দিকে একপলক তাকিয়ে বাইরের দিকে হাঁটা দেয় সজীব। যেতে যেতে সোহেল কে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“এই মুহূর্তে একে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কর। শাপলাচত্বরে নামিয়ে দিয়ে চলে আসবি। ভুলেও আশেপাশে কোথাও নামাবি না। আমি আর কোনো ঝামেলা চাই না।”

কথাগুলো বলতে বলতে দড়জার কাছে চলে যায় সজীব। পেছন পেছন আসে বাকি সবাই। যেনো সবাই সজীবকেই অনুসরণ করে হাঁটছে। দড়জার বাহিরে এক পা দিয়েই থেমে যায় সজীব। ঘাড় ঘুরিয়ে সোহেলের দিকে তাকিয়ে বলে,

—“আর হ্যা, অক্ষত অবস্থায় ফেলে আসা চাই। ওর গায়ে একটা আঁচড়ও যেনো না লাগে।”

—“চিন্তা করবেন না বস। কেউ মেয়েটার গায়ে হাত দেয়ার সাহস পাবে না। তাছাড়া আপনার মামা এখন এখানে নেই। তাই এমন কিছু হওয়ার আশঙ্কাও নেই।”

সোহেলের নত মস্তকে বলা কথা শুনে শান্ত চোখে তাকায় সজীব। ফের চলার জন্য পা বাড়ায়। চলতে চলতে রাশভারি গম্ভীর কন্ঠে আদেশ দেয়,

—“এই কাজটা দ্রুত শেষ করা চাই। অতঃপর ফিরে এসে মৃত মেয়েটার লা*শ এখান থেকে সরিয়ে ফেলবি। দু’দিনের মধ্যে আরো একটা মেয়ে তুলে আনা চাই। মিস্টার জেমিনের সাথে কথা হয়েছে আমার। এ মাসের শেষেই মেয়েগুলোকে তার কাছে পাঠিয়ে দেবো। এবার যেনো কোনো ভুল না হয়।”

গম্ভীর কন্ঠে আদেশ দিয়েই গটগট পায়ে বেরিয়ে যায় সজীব। পরিবেশটা মুহুর্তেই শান্ত হয়ে যায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সোহেল। এতোক্ষণ যেনো অদৃশ্য ঝড় বইছিলো এখানে। বিধ্বংসকারী প্রবল ঝড় থেকে যেনো প্রাণে বেঁচে গেছে সবাই। প্রকাশ্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেও মনে মনে একটা প্রশ্ন খুব ভাবাচ্ছে সোহেলকে। তাদের বস প্রচন্ড রাগী, গম্ভীর, নির্দয় পাষাণ একজন ব্যক্তি। সোহেল কখনো তাকে কারোর প্রতি দয়া দেখাতে দেখেনি। সকলের প্রতি বরাবরই নির্দয় ব্যবহার করেছে। তাহলে এই মেয়েটার প্রতি দয়া দেখালো কেনো? তাকে অক্ষত অবস্থায় ছেড়েও দিলো। এটা কি শুধু ধরা পরার ভয়ে, নাকি এর পেছনে আছে অন্য কোনো কারণ?

——————————

শাওয়ারের নিচে বসে একাধারে ভিজে যাচ্ছে দীপ্তি। চোখ জোড়া রক্তবর্ণ রঙ ধারণ করেছে। ফুলে উঠেছে দুটো চোখ। নিঃশব্দে চোখের পানি বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। কতক্ষণ সময় ধরে সে ভিজে যাচ্ছে তার কোনো ঠিক নেই। এক ধ্যানে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন। এতো বছরের চেনা জানা পরিবেশ হঠাৎ করেই অচেনা হয়ে গেছে। আপন মনে করা মানুষ গুলো সব পর হয়ে গেছে। দড়জার সামনে থেকে দাড়িয়ে শোনা কিছু অপ্রিয় সত্যি দীপ্তিকে পুরো ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সজীবের কন্ঠ নালী হতে নিঃসৃত তিক্ত বাণি শোনার সময় মনে হচ্ছিল কেউ দিপ্তির কানে গরম শিশা ঢেলে দিচ্ছে।

দুঃখে কষ্টে মুখটা দুই হাতে চেপে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে দীপ্তি। কলিজাটা যেনো ছিড়ে যাচ্ছে। সজীব আর তার মায়ের সব কথা শুনে ফেলেছে সুপ্তি। সব শুনে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না। সজীব একজন ক্রিমিনাল। সে দীপ্তি দের পরিবারের ক্ষতি করতে চাইছে। তার পুরো পরিবারকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে। প্রাপ্তিকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিলো, কিন্তু ভুল বসত সুপ্তিকে নিয়ে গেছে। কিন্তু কেনো? প্রাপ্তির সাথে কি শত্রুতা সজীবের? সে কেনো প্রাপ্তির ক্ষতি চাইছে? কেনো সবার জীবন নিয়ে খেলছে? সুপ্তির কোনো ক্ষতি করে দেবে না তো?

হঠাৎ করেই মস্তিষ্ক জ্বলে ওঠে দীপ্তির। নিজের স্বামীকে নিজেরই পরিবারের শত্রু রুপে আবিষ্কার করতেই মাথাটা ধপ করে জ্বলে ওঠে। হারিয়ে যায় সকল ভয়। মাথায় জেঁকে বসে এক আকাশ সমান জেদ। শাস্তি পেতে হবে। সজীবকে শাস্তি পেতে হবে। সজীবকে দীপ্তি নিজে পুলিশের হাতে তুলে দেবে।

কথাগুলো ভাবতেই তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায় দীপ্তি। জামা কাপড় পাল্টে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। হঠাৎ করে এই অপ্রিয় সত্যি জানার পর দীপ্তি যেনো হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সজীবকে আজ নিজের সবচেয়ে বড় শত্রু মনে হচ্ছে। ওকে শাস্তি দেয়াই যেনো দিপ্তির জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। পার্সটা হাতে নিয়ে কোথাও বেরোনোর জন্য পা বাড়ায় দীপ্তি। সিঁড়ির কাছে আসতেই চোখে পড়ে তার শ্বাশুড়িকে। তিনি সতর্ক দৃষ্টিতে চারিদিকে নজর বুলিয়ে সেই নিষিদ্ধ ঘরের দিকে যাচ্ছেন। পা জোড়া থেমে যায় দিপ্তির। অচল হয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে সচল হয়। হুশ ফেরে দীপ্তির। বুঝতে পারে সে ঝোঁকের বসে কি করতে যাচ্ছিলো।

সাথে সাথে ঘরে ফিরে যায় দীপ্তি। পার্সটা রেখে আস্তে করে খাটে গিয়ে বসে। তাড়াহুড়ো করলে চলবে না। ওদের এভাবে শাস্তি দেয়া সম্ভব নয়। কারণ দীপ্তির কাছে কোনো প্রমান নেই। তাছাড়া ঝোঁকের বসে কোনো ভুল পদক্ষেপ নিলে তার পরিবারের ওপর ঘোর বিপদ নেমে আসবে। এখনো অনেক সত্য জানা বাকি আছে দীপ্তির। আগে সব সত্য জানতে হবে। সবার বিরুদ্ধে প্রমান জোগাড় করতে হবে। এই বাড়িটা একটা রহস্যপুরি। আগে সব রহস্য সমাধান করতে হবে।

কথাগুলো ভেবে আলমারির দিকে চলে যায় দীপ্তি। ড্রয়ার হাতরে কিছু কাগজ বের করে। মনোযোগ দিয়ে দেখে সেগুলো। হঠাৎ পাশ থেকে ফোনটা তুলে নেয় হাতে। খোঁজাখুঁজি করে একটা নাম্বার বের করে। নাম্বারটা পেতেই সাথে সাথে ডায়াল অপশনে আঙুল রাখে। ধীরে সুস্থে কানে চেপে ধরে ফোন। রিসিভ হতেই দীপ্তি দৃঢ় কন্ঠে বলে,

—“আপনার সাথে দেখা করতে চাই, আজকেই! সময় হবে আপনার?”

সাগরের চোখে বিস্ময়। দীপ্তি তাকে ফোন দিয়েছে বিষয়টা সে কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এতোগুলা বছর পর দীপ্তির নিজে থেকে ফোন করাটা ভাবাচ্ছে সাগরকে। সেই সাথে মনে জাগে কৌতুহল। দীপ্তির কন্ঠ এমন শোনা যাচ্ছে কেনো? কিছু কি হয়েছে? মনে মনে কথাগুলো ভাবে সাগর। এক মিনিট সময় নিয়ে বলে,

—“বিকাল পাঁচটায়। প্রাপ্তির ভার্সিটির সামনের কফিশপে চলে এসো।”

—“আচ্ছা!”

বলেই ফোন কেটে দেয় দীপ্তি। অবাক হয়ে যায় সাগর। কেমন যেনো অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে সাগরের। মন বলছে দীপ্তির কিছু একটা হয়েছে। অবশ্যই হয়েছে।

—————————–

পুরো ফোর্স নিয়ে সেই পুরনো বাড়িটার সামনে এসেছে অর্পন। গাড়ি থেকে নেমে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর বুলায় চারদিকে। বাড়িটার এরিয়া অনেক বড়। না জানি ভেতরের অবস্থা ঠিক কেমন। আপন মনে কিছু একটা ভাবে অর্পন। পরক্ষণেই পেছন ঘুরে সবার দিকে তাকায়। অর্পনের দিকে সবাই এক নজরে তাকিয়ে আছে। যেনো অর্পনের আদেশের অপেক্ষা করছে। ইশারা পেলেই ঝাপিয়ে পড়বে সবাই। কয়েক পা এগিয়ে আসে অর্পন সবার দিকে। চেহারায় পুরো গাম্ভীর্যের ছাপ। মাথাটা হালকা নিচু করে দৃঢ় গম্ভীর কন্ঠে সবাইকে তাদের কাজ বুঝিয়ে দেয়। অর্পনের নির্দেশ পেতেই সবাই যে যায় জায়গায় গিয়ে পজিশন নিয়ে নেয়। যেনো আক্রমণ করতে প্রস্তুত।

হঠাৎ করেই পেছন থেকে কোনো গাড়ির আওয়াজ শুনতে পায় অর্পন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে একটা কালো রঙের গাড়ি যাচ্ছে। গাড়ির নেমপ্লেটের চোখ পড়তেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায় অর্পনের। এটা সেই গাড়ি যেটাতে করে সুপ্তিকে অ*প*হ*র*ন করা হয়েছে। অর্পনের সন্দেহ এবার দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়। হঠাৎ অর্পনের চোখে পড়ে পেছন সিটে বসে ছটফট করতে থাকা একটা মেয়েকে। হাত দিয়ে পেছনের কাঁচে আঘাত করছে। চেহারা হালকা দেখতেই চিনে ফেলে অর্পন। এটা আর কেউ নয়, স্বয়ং সুপ্তি।

তড়িৎ গতিতে নিজের গাড়িতে উঠে পড়ে অর্পন। সাথে সাথে বাকিরাও গাড়িতে উঠে পড়েছে। মিনিটের ব্যবধানে বিষয়টা সবাই ধরতে পেরেছে। ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয় অর্পন। সর্বোচ্চ গতিতে গাড়ি টান দেয়। ওরা নিশ্চয়ই সুপ্তিকে অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলতে চাইছে। তার আগেই গাড়িটা ধরতে হবে।

এদিকে গাড়ির মধ্যে হাত পা অনবরত ছোড়াছুড়ি করছে সুপ্তি। গেট দিয়ে গাড়ি বের হওয়ার সময় সে অর্পনকে দেখে ফেলেছে। তাতেই যেনো দেহে প্রাণ ফিরে পায়। সুক্ষ্ম একটা আশার আলো জেগে ওঠে সুপ্তির মনে। এজন্য ইচ্ছে করে ছোটাছুটি চেচামেচি শুরু করে। যাতে অর্পন তাকে দেখতে পায়। এতে সফলও হয় সুপ্তি।

সুপ্তিকে ছোটাছুটি করতে দেখে পাশের দুজন চেপে ধরে সুপ্তির হাত। তবুও থামাতে পারছে না। পরিচিত মুখ দেখে সুপ্তির শক্তি যেনো দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। সে সমান তালে হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে করতে বলে,

—“কে তোমরা? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? ছেড়ে দাও বলছি। আমি কিন্তু চেঁচাবো। কামরে দেবে কিন্তু!”

বলেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকে। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে পাশের একজন সুপ্তির মুখে রুমাল চেপে ধরে। মুহুর্তেই জ্ঞান হারিয়ে স্থির হয়ে যায় সুপ্তি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে লোকগুলো। হঠাৎ করেই ড্রাইভারের পাশে বসা ছেলেটা সামনের আয়নায় তাকায়। মুহুর্তেই তার চোখ মুখের রঙ বদলে যায়। সুপ্তির সাথে ধস্তাধস্তি করায় সবাই এতোটাই মশগুল ছিলো যে পেছনে কেউ খেয়াল করেনি। নিজেরদের অতি নিকটে অর্পনকে দেখে ভয়ে জমে যায় লোকটা। তাকে অনুসরণ করে পেছনের দুজনও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। পেছনে অর্পনকে দেখে তারাও ভয় পেয়ে যায়। এভাবে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যাবে কেউ ভাবেনি। অর্পনের শক্ত মুখশ্রী দেখে ভয়টা আরো বেড়ে যায়। ড্রাইভারকে বলে আরো জোরে গাড়ি চালাতে। ড্রাইভার গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দেয়।

অর্পনের গাড়ি কিছুটা পেছনে আছে। শা শা করে ছুটে চলছে দুটো গাড়ি। মেইন রোডে এতো গতিতে গাড়ি চালানো বিপদজনক। এতে অন্য মানুষের ক্ষতি হতে পারে। ভাবতে ভাবতে সামনের বক্স থেকে নিজের রি*ভা*ল*বা*র তুলে নেয় অর্পন। বাম হাতে স্টিয়ারিং ধরে ডান হাতে রি*ভা*ল*বা*র নেয়। দক্ষ হাতে নিশানা করে গাড়িটার পেছনের চাকা। ট্রিগার চাপতেই বিকটা শব্দে চাকা ব্লা স্ট হয়ে যায়। বেসামাল হয়ে পড়ে গাড়িটা। চলার গতি কমে চায়। বাম দিকে বেঁকে একটা গাছের সাথে ধাক্কা লাগে। থেমে যায় চলতে থাকা গাড়ি। মুহুর্তেই সবাই সুপ্তিকে রেখেই যার যার মতো নেমে পালানোর চেষ্টা করে। অর্পনের সাথে আসা পুলিশ ফোর্স পিছু ছোটে তাদের। মিনিটের ব্যবধানে ধরেও ফেলে। অর্পন বড়বড় কদম ফেলে এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে।

গাড়ির পেছনের সিটে অচেতন হয়ে পড়ে ছিলো সুপ্তি। সাথে সাথে অর্পন সুপ্তিকে কোলে তুলে নেয়। এর মধ্যে পুলিশ ফোর্স ড্রাইভার সহ চারজনকেই ধরে অর্পনের সামনে হাজির করে। সুপ্তির অচেতন মুখের দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় অর্পনের। না জানি মেয়েটার সাথে কি কি ঘটেছে। সবগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় অর্পন। চোখ দিয়ে যেনো আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে অর্পন বলে,

—“এদের সবগুলোকে থনায় নিয়ে যাও। আমি ফিরে এসে এদের হিসাব ক্লিয়ার করছি। অনেক হিসাব বাকি আছে এদের সাথে। আর এই গাড়িটাও নেয়ার ব্যবস্থা করো।”

কথাগুলো বলেই সুপ্তিকে নিয়ে গাড়িতে বসায়। নিজে গিয়ে পাশে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। হসপিটালের উদ্দেশ্যে গাড়ি ঘোরায় তৎক্ষনাৎ। সবার আগে সুপ্তির জ্ঞান ফেরানো দরকার। তবেই সব জানা যাবে।

চলবে?