তারে আমি চোখে দেখিনি পর্ব-২৮+২৯

0
183

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ২৮
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

সীমাহীন স্নিগ্ধতায় ছেয়ে আছে প্রকৃতি। সারারাত বৃষ্টির পর ধরনী যেনো নতুন রুপে সেজেছে। তীব্র বর্ষনের বারিধারায় ভিজে সিক্ত হয়ে উঠেছে গাছপালা। পেয়েছে নতুন রুপ। চারিদিকে ভেজা মাটির গন্ধ। বাতাসে শীতল ভাব। প্রকৃতি জানান দিচ্ছে বর্ষার আগমনের। এখন প্রায়সই দেখা মিলবে বৃষ্টি কণ্যাদের। ভিজিয়ে সিক্ত করে দিয়ে যাবে সবাইকে। মুছে দিবে মানুষের দুঃখ কষ্ট। ফিরিয়ে দেবে মানব জীবনের সকল উচ্ছ্বাস। প্রবল মন খারাপ নিয়ে খোলা মাঠে দুহাত মেলে দাঁড়ালে, এক পশলা বৃষ্টি সকল মন খারাপ ধুয়ে মুছে দেবে অনায়াসে।

ভার্সিটির সামনের সেই কফিশপের একটা টেবিলে বসে আছে সাগর। মুখোমুখি হয়ে বসে আছে দীপ্তি। সাগরের সকল ধ্যান বাইরের প্রকৃতির দিকে। কফিশপের স্বচ্ছ কাচ গলিয়ে দৃষ্টি রেখেছে দূরের মাঠের দিকে। গত রাতের বৃষ্টিতে প্রকৃতি যেনো ভিন্ন সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয়েছে। খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে আপন মনে প্রকৃতি বিলাসে ব্যস্ত সে। মূলত সে প্রকৃতি বিলাস করছে, নাকি কোনো বিষয়ে গভীর চিন্তা করছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না।

সামনের চেয়ারে চুপচাপ বসে আছে দীপ্তি। সামনে দুই কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম কফি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই সাগরের ম্যসেজ পায় দীপ্তি। সাগর ইমিডিয়েটলি দীপ্তিকে দেখা করতে বলেছে। ম্যসেজটা দেখেই ছুটে চলে এসেছে দীপ্তি। সজীব বাড়িতে না থাকায় কাজটা আরও সহজ হয়ে গেছে। বুকের ভেতর টিপটিপ করছে। এতো সকালে জরুরি তলব কেনো? নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু বলবে সাগর। কিন্তু এখানে এসে সাগরকে নিজের মতো ধ্যান মগ্ন দেখে ধৈর্য হারা হচ্ছে দীপ্তি। এভাবে চুপ করে আছে কেনো সে? ডেকে আনার কারণ না জানা পর্যন্ত দীপ্তি যে শান্তি পাচ্ছে না। হঠাৎ করে এক মুঠো দমকা হাওয়া এসে ছুয়ে দিয়ে যায় দীপ্তির চোখ মুখ। শীতল হাওয়ার স্পর্শে কিছুটা কেঁপে ওঠে দীপ্তি। গায়ের ওড়নাটা হাত পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,

—“হঠাৎ সকাল সকাল আসতে বললেন যে। কিছু কি হয়েছে?”

দীপ্তির গলার আওয়াজ শুনে ধ্যান ভাঙে সাগরের। আপন চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে সোজা সামনে দীপ্তির দিকে দৃষ্টি রাখে। তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ সেভাবেই তাকিয়ে থাকে। অতঃপর কিছু না বলেই নিজের পাশের থাই গ্লাসটা টেনে দেয়। শীতল বাতাসের আগমন থেমে যায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে দীপ্তি।

—“সমস্যা হচ্ছিলো বলোনি কেনো?”

সাগরের ভরাট কন্ঠে গম্ভীর আওয়াজ শুনে চোখ তুলে তাকায় দীপ্তি। মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলে,

—“সমস্যা হচ্ছিল না। আপনি এতো সকালে ডেকেছেন কেনো?”

—“প্রাপ্তির বিষয়ে কিছু কথা আছে। তবে এই মুহূর্তে বলতে পারবো না। একটু অপেক্ষা করো। অর্পন আসছে।”

দীপ্তি আর কিছু বলে না। ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে। নিরবতায় কাটে কয়েক পল। কেউ কোনো কথা বলছে না। দীপ্তি অধির আগ্রহ নিয়ে দড়জার দিকে তাকিয়ে আছে। কখন অর্পন আসবে? সাগর কি বলবে প্রাপ্তির বিষয়ে? কোনো খারাপ কিছু নয় তো? চিন্তায় দম বন্ধ হয়ে আসছে দীপ্তির৷ নিরবতার মাঝে সাগরের ধীর কন্ঠ শোনা যায়,

—“নিজের সমস্যার কথা মুখ ফুটে বলতে শেখো। তোমার আশেপাশে থাকা মানুষগুলোর জাদুকর নয় যে জাদু দিয়ে তোমার না বলা কথা জেনে যাবে।”

সহসা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় দীপ্তি। চোখে মুখে তার প্রশ্নের আভাস। সাগরের কথার মানে সে বুঝতে পারেনি। দীপ্তির চাহনি দেখে চোখ সরিয়ে নেয় সাগর। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলে,

—“প্রাপ্তির মেডিক্যাল ফাইলের মধ্যে তোমার একটা টেস্টের রিপোর্ট ছিলো। রিপোর্ট দেখে যা বুঝলাম, তুমি বেশ কয়েক বছর ধরে বেবি প্ল্যানিং করছো। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। এম আই রাইট?”

সাগরের কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলে দীপ্তি। কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। তার অক্ষমতা এভাবে সাগরের সামনে আসবে সেটা কখনো ভাবেনি দীপ্তি।
সাগর হয়তো বুঝতে পারে দীপ্তি অস্বস্তি বোধ করছে। এই বিষয়ে কথা বলতে সাগরেরও প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। এক সময় যাকে নিয়ে একটা ছোট্ট সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলো, আজ সে অন্য কারো সংসার সাজাচ্ছে। মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসে সাগর। সোজা হয়ে বসে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“এই বিষয়ে আমি কথা বলতাম না। তবে রিপোর্ট যখন চোখে পড়েছে তখন না বলেও পারছি না। এজ এ ডক্টর তোমাকে পরামর্শ দেয়া আমার কর্তব্য। তুমি যে ডক্টরের থেকে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছো তিনি একজন মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট। তোমার সমস্যার সমাধান তার কাছে নেই। ভুল জায়গায় সময় নষ্ট করেছো শুধু।”

সাগরের কথা শেষ হতেই চকিত ভঙ্গিতে মাথা তুলে তাকায় দীপ্তি। চোখে মুখে তার একরাশ বিস্ময়। কি বলছে এসব সাগর? ভুল জায়গায় সময় নষ্ট করেছে মানে? তাহলে কি সজীব এবারেও ধোঁকা দিলো। বিস্ময়ে চোখ মুখে অন্ধকার নেমে এলো দীপ্তির।

দীপ্তির ব্যথিত চেহারা দেখে সাগর ধরেই নিলো দীপ্তি বাচ্চা না হওয়ার জন্য কষ্ট পাচ্ছে। বুকে পাথর চাপা দিয়ে কাঠকাঠ কন্ঠে সাগর বলে,

—“চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি বাচ্চা চাও, সেটাও হবে। সবসময় তোমার চাওয়াই পূরণ হয়েছে। সম্পর্ক তুমিই তৈরি করেছিলে, বিচ্ছেদও তোমার ইচ্ছাতেই হয়েছে। বরাবরের মতো এবারেও তোমার ইচ্ছাই পূরণ হবে। আমি আমার সাধ্য মতো চেষ্টা করবো তোমাকে সাহায্য করার।”

কথাগুলো বলে থামে সাগর। দীপ্তি ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে সাগরের দিকে। কষ্টে বুকটা ভার হয়ে গেছে। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। মনে মনে চিৎকার করছে দীপ্তি। আত্মাটা বেরিয়ে আসতে চাইছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে,
” আমার কোনো ইচ্ছা পূরণ হয়নি সাগর। কোনো ইচ্ছা পূরণ হয়নি। আমি তো এসব চাইনি। আমি তো আপনাকে চেয়েছিলাম। আপনার সাথে ছোট্ট একটা সংসার গড়তে চেয়েছিলাম। আপনার বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চেয়েছিলাম। বৃদ্ধ বয়সে আপনার হাত ধরে বহুদূর হাটতে চেয়েছিলাম। কই! আমার কোনো চাওয়া তো পূরণ হলো না। মনে একজনকে রেখে অন্য কারো সাথে সংসার করছি। এই দহনের জ্বালা কি আপনি বুঝতে পারেন?”
মনে মনে বলা হাজারো কথা, হাজারো আর্তনাদ মনের ভেতরেই দাফন করে দেয় দীপ্তি। কথা বলার জন্য ঠোঁট কাঁপছে কিন্তু গলায় স্বর নেই। ঠোঁট কামরে মাথা নিচু করে চোখের পানি ছেড়ে দেয় দীপ্তি। সয্যের সীমাটা বোধহয় পেরিয়ে যাচ্ছে। এই কষ্ট কেনো কমে না?

মিনিটের ব্যবধানে সেখানে গিয়ে পৌঁছায় অর্পন। হন্তদন্ত পায়ে কফিশপে ঢুকে সাগরকে খুঁজতে থাকে। পেয়েও যায়। তাড়াহুড়ো করে সেদিকে পা বাড়ায়। ব্যস্ত কন্ঠে বলে,

—“সরি ভাই, লেট হয়ে গেলো। আসলে তখন…..

কথার মাঝেই হঠাৎ সামনে দিপ্তিকে দেখে থমকে যায় অর্পন। কন্ঠ স্বর থেমে যায় আপনাআপনি। দীপ্তি এখানে আসবে সেটা অর্পন জানতো না। নিজেকে সামলে ধীরে সুস্থে চেয়ার টেনে বসে।

পাশে কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে নিজেকে সামলে নেয় দীপ্তি। চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে পাশে তাকায়। সাগর এই পর্যায়ে মুখ খোলে। গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“গতকাল দীপ্তি আমাকে কিছু ফাইল আর রিপোর্ট দিয়েছে। সেগুলো প্রাপ্তির মেডিক্যাল রিপোর্ট। সেগুলো নিয়ে আমি আমার পরিচিত একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডক্টরের সাথে আলোচনা করি। আমি কি জানতে পেরেছি সেটা কেউ অনুমানও করতে পারবে না।”

বুকের ভেতর ধুকপুক করছে অর্পনের। প্রাপ্তির বিষয়ে কোনো কথা শুনলে তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বেড়ে যায়। অত্যন্ত সাহসী, কঠোর মনের পুরুষটাও ভয় পায়। প্রাপ্তিকে হারানোর ভয়। সাগরকে থেমে যেতে দেখে অর্পন অধৈর্য হয়ে বলে,

—“এবার পুরোটা বলবে কি? আমার কিন্তু প্রচন্ড চিন্তা হচ্ছে।”

—“প্রাপ্তিকে এতো বছর ধরে ভুল চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ওর ওষুধের প্রেস্কিপশন দেখে আমি ভীষণ আশ্চর্য হয়ে যাই। অর্পন তুই ভাবতে পারছিস! প্রাপ্তিকে প্রতিদিন যে ওষুধ দেয়া হচ্ছে সেগুলোতে সুস্থ মানুষরও দৃষ্টি শক্তি হারানোর চান্স আছে। সেখানে অসুস্থ একটা মানুষের ওপর ঠিক কতটা ইফেক্ট পড়েছে আমি সেটা কল্পনাও করতে পারছি না। মেয়েটা দৃষ্টিহীন নয়। ওকে দৃষ্টিহীন বানিয়ে দেয়া হয়েছে। এই জঘন্য কাজটা কে করেছে আমি জানি না। আর জানতেই এখানে দুজনকেই আসতে বলেছি। তোমার বোনের চিকিৎসার দায়িত্ব কার হাতে ছিলো দীপ্তি?”

শেষের কথাটা সাগর দীপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে। কিন্তু দীপ্তি কোনো উত্তর দেয় না। নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে। যেনো অতিরিক্ত শকে পাথর হয়ে গেছে। চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। বুকের ভেতর কালবৈশাখী ঝড় উঠেছে দীপ্তির। সজীব তাহলে মিথ্যে বলেছে। অভিনয় করেছে এতোগুলা বছর ধরে। প্রাপ্তির চিকিৎসার দায়িত্ব হাতে নিয়ে আরো মেয়েটার ক্ষতি করেছে! কিন্তু কেনো? কিসের শত্রুতা তার প্রাপ্তির সাথে? এতো বড় ধোঁকা কোনো? এতো এতো ধাক্কা একসাথে সামলাবে কিভাবে দীপ্তি? কথাগুলো ভাবতেই বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে ওঠে দীপ্তির। দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে।

হতভম্ব হয়ে যায় সাগর। দীপ্তিকে কাঁদতে দেখে ভড়কে যায় সে। উঠে গিয়ে সান্ত্বনা দেবে, কিন্তু সেটাও পারছে না অর্পনের উপস্থিতির জন্য। বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা অনুভব করে।

অর্পন বুঝতে পারে দীপ্তির অবস্থা। পুরোটা না জানলেও কিছুটা সন্দেহ করেছিলো অর্পন। হঠাৎ করে ধাক্কাটা দীপ্তি মেনে নিতে পারছে না। তাই ভেঙে পড়েছে। দীপ্তিকে সান্ত্বনা দিতে অর্পন কিছু বলবে এমন সময় দীপ্তি চোখ তুলে তাকায়। আশেপাশের টেবিলের সবাই এদিকেই তাকিয়ে আছে। সেদিকে হেলদোল নেই কারোর। দীপ্তি অর্পনের ডান হাত খপ করে ধরে ফেলে। অনুরোধ মিশ্রিত কন্ঠে বলে,

—“তুমি তো প্রাপ্তিকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে। প্লিজ ওকে বিয়ে করে নাও৷ ওর সামনে অনেক বড় বিপদ। আমি আন্দাজ করতে পারছি আসন্ন বিপদের। আমার বোনকে বাচিয়ে নাও ভাই। প্লিজ।”

—“আপনি আগে শান্ত হন মিস। আপনি উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।”

—“আমি ঠিক আছি। তুমি কথা দাও প্রাপ্তিকে বিয়ে করবে। ওর খেয়াল রাখবে। আমার বোনটা চোখে দেখতে পায় না। বিপদ সামনে থাকলেও সে মোকাবিলা করতে পারবে না। ওর একটা ভরসাযোগ্য হাত বিশেষ দরকার। যে ছায়ার মতো ওর পাশে থাকবে। সব বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করবে। তুমি হবে সেই ভরসার হাত?”

অর্পন কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে তো চায় প্রাপ্তিকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে। সব বিপদ থেকে রক্ষা করতে। বুকের মাঝে যত্ন করে আগলে রাখতে। কিন্তু বোকা মেয়েটাই তো রাজি হচ্ছে না। এখানে অর্পন কি করতে পারে? ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে অর্পন বলে,

—“প্রাপ্তিকে আমি সবসময় আগলে রাখবো। আমি তো চাই ওকে নিজের কাছে রাখতে। কিন্তু তার জন্য আপনার বোনকে যে বিয়েতে রাজি হতে হবে। গাধাটা রাজি হচ্ছে না। এখন কি তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে হবে? সে চাইলে আমি তাতেও রাজি।”

সহসা কান্না থেমে যায় দীপ্তির। অর্পনের চোখে প্রাপ্তির প্রতি ভালোবাসা দেখেছে দীপ্তি। এই ছেলে প্রাপ্তিকে সবসময় রক্ষা করবে। বিশ্বাসটা অজান্তেই চলে এসেছে কোনোভাবে। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নেয় দীপ্তি। শক্ত কন্ঠে বলে,

—“আমি জানি প্রাপ্তির ক্ষতি কে করতে চাইছে। এতোদিন বুঝিনি কিন্তু এখন বুঝতে পারছি। তবে কোনো প্রমান নেই আমার হাতে। প্রমান হাতে পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আমার এই বিষয়ে তোমার সাহায্য দরকার অর্পন।”

—“অর্পন সর্বদা প্রস্তুত। আপনি সবার আগে বাড়ি গিয়ে প্রাপ্তির ওষুধগুলো সরিয়ে ফেলুন। সেগুলো যেনো ওকে আর না দেয়া হয়। আর এই ডক্টরের দিকটা আমি দেখে নিচ্ছি।”

অর্পনের কথা শুনে স্বস্তি পায় দীপ্তি। মনে মনে খুশিও হয়। অবশেষে প্রাপ্তির জন্য একজন সঠিক মানুষ পেয়েছে। এর ওপর চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারে দীপ্তি।

————————–

দখিনা বাতাসে দুলছে প্রকৃতি। স্নিগ্ধ শীতল বাতাস ফুরফুরে করে দিচ্ছে মন। প্রচন্ড গরমের পর এক পশলা বৃষ্টি এসে আবহাওয়া শীতল করে দিয়েছে। ছাঁদের শেষ প্রান্তে মাদুর বিছিয়ে বসে আছে প্রাপ্তি। সময় এখন বেলা এগারোটা। অন্যদিন গরমের কারণে এই সময়ে ছাঁদে বসে থাকা দুষ্কর হয়ে যায়। অথচ আজ আবহাওয়া ভীষণ শীতল। সুপ্তিকে ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছে। এই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে ওর বিশ্রামের প্রয়োজন। তাই আর ওকে ডাকেনি প্রাপ্তি। একাই ছাঁদে চলে এসেছে। মাদুরের ওপর পা মেলে বসে হেডফোনে গান শুনছে। চোখ দুটো বন্ধ। সম্পূর্ণ মনোযোগ গানের দিকে।

হাতের লিঠি ভর দিয়ে ধীরে ধীরে ছাঁদে আসেন কামরুল সাহেব। প্রথমেই চোখ পড়ে মাদুরে বসে থাকা প্রাপ্তির দিকে। ধীর পায়ে সেদিকে এগিয়ে যান৷ প্রাপ্তির পাশাপাশি বসে আলতো হাতে হেডফোন খুলে নেন।

চোখ মেলে তাকায় প্রাপ্তি। নিজের কাছে কারো উপস্থিতি অনুভব করে। ভ্রু কুচকে বোঝার চেষ্টা করে কে এসেছে। হাত বাড়াতেই কামরুল সাহেবের লাঠির এক অংশের ছোঁয়া পায় হাতে। প্রাপ্তি বুঝে যায় তার দাদু এসেছে। মুচকি হেসে বলে,

—“এতো ঘনঘন ছাঁদে আসো কেনো দাদু? তোমার না হাঁটুতে ব্যথা।”

—“তোমার সাথে গল্প করতে আসলাম। তুমি ঘরে ছিলে না তাই এখানে আসতে হলে।”

—“তাই! কি গল্প করবে?”

প্রাপ্তির সহজ গলার কথা শুনে নড়েচড়ে বসেন কামরুল সাহেব। এক ভ্রু উঁচু করে প্রশ্ন করেন,

—“তোমার পছন্দ করা ছেলের নাম কি?”

থমকে যায় প্রাপ্তি। কামরুল সাহেব যে এই প্রশ্ন করবেন সেটা প্রাপ্তির ধারণাতে ছিলো না। খুব সূক্ষভাবে অর্পনের বিষয়টা এড়িয়ে চলছিলো এতোদিন। এখন হঠাৎ এই প্রশ্নে একটু বিব্রত বোধ করে। প্রাপ্তিকে চুপ থাকতে দেখে কামরুল সাহেব ফের বলেন,

—“নামটা বলো প্রাপ্তি। আজ সেই ছেলের সম্পূর্ণ ঠিকানা আমাকে দেবে। না হলে যে বিয়েটা নিয়ে বাসায় কথা হচ্ছে, আমি সেখানে সম্মতি দেবো।”

—“এমন কেনো করছো দাদু?”

—“কারণ তুমি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো। লুকনো বিষয়টা কি সেটা আমি জানি। একটু আগে দীপ্তি ফোন করে জানালো। এখন কারনটা তুমি বলবে।”

কামরুল সাহেবের কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলে প্রাপ্তি। একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

—“মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করছে দাদু। তোমরা সবাই জানো আমি আর পাঁচজন মেয়ের মতো স্বাভাবিক নই। অনেক বড় একটা কমতি আছে আমার মধ্যে। আমি চোখে দেখতে পাই না দাদু। একটা অন্ধ মেয়েকে বিয়ে করে ওই মানুষটা কি আদৌ সুখী হবে? অর্পন অনেক ভালো একজন মানুষ। তার অধিকার আছে ভালো ভাবে বাঁচার। আমার অন্ধকার জীবনের সাথে জড়ালে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢেকে যাবে। এটা তো তাকে ঠকানো হলো।”

কামরুল সাহেবের থমথমে আওয়াজ,

—“ছেলেটা তোমাকে অনেক পছন্দ করে প্রাপ্তি। সে নিজের ইচ্ছায় তোমাকে নিজের অর্ধাঙ্গিনি বানাতে চায়। তাছাড়া তুমিও তার প্রতি দুর্বল। ভালোবাসো তাকে। তাহলে এখানে ঠকানোর প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে?”

—“কিন্তু দাদু……..”

—“কোনো কিন্তু নয়। আমি মারুফের সাথে কথা বলছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করছি। ছেলেটা আমার অনেক পছন্দের। আর দেরি করতে চাই না। আমারও তো বয়স হয়েছে। তোমাকে আর সুপ্তিকে নিয়ে আমার চিন্তা বেশি। তোমাদের জীবন গুছিয়ে না দিতে পারলে যে মরেও শান্তি পাবোনা দিদিভাই। এই বুড়ো দাদুর কথাটা একবার ভাবো।”

প্রাপ্তি নিরুত্তর। কোনো কথা বলে না। কামরুল সাহেব একটু সময় নিয়ে বলেন,

—“নিরবতা সম্মতির লক্ষ্মণ। তাহলে কি তোমার নিরবতা সম্মতি হিসেবে ধরে নেবো?”

—“তোমার কথার অবাধ্য কখনো হইনি দাদু। এবারেও হবো না।”

আলতো হাসেন কামরুল সাহেব। প্রাপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে চলে যান। স্তব্ধ হয়ে বসে রয় প্রাপ্তি। মনে জাগে অজানা শিহরণ। অবশেষে কি তার ভাগ্য অর্পনের সাথে জুড়তে যাচ্ছে?

——————————

একটা বড়সড় বিলাসবহুল ঘর। ঘরের মাঝামাঝি টেবিলের কাছে চেয়ারে বসে আছে সজীব। টেবিলের ওপর অসংখ্য কাগজপত্র। কাগজগুলো উল্টে পাল্টে দেখছিলো সে। হঠাৎ টেবিলের ওপরে রাখা ফোনটার ম্যাসেজ টোন বেজে ওঠে। নাম্বারটা দেখেই ঠোকের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে সজীব। তৎক্ষনাৎ ফোনটা হাতে নেয়। ম্যসেজটা পড়ে ঠোঁটের হাসি আরও চওড়া হয়।

গলা উঁচু করে ডাকে সোহেলকে। সজীবের ডাক শুনে হন্তদন্ত পায়ে ছুটে আসে সোহেল। পাশে এসে দাঁড়াতেই সজীব খুশি হয়ে বলে,

—“মেয়েগুলোকে রেডি কর সোহেল। এই শুক্রবার ওদের জায়গা মতো পাঠিয়ে দিতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি একটা বড় অর্ডার পেতে যাচ্ছি। কোনো ভুল করা চলবে না।”

জ্বি বস! কথাটা বলে সেখান থেকে চলে আসে সোহেল। ভয় লাগছে। সেই সাথে হতাশাও চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। এবার কি হবে? কিভাবে বাঁচাবে মেয়েগুলোকে? রনির এতো কষ্ট সয্য, এতো ত্যাগ কি বিফলে যাবে? অর্পন কি পারবে নিরিহ মেয়েগুলোকে বাঁচাতে?

চলবে?

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ২৯
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

কি এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে প্রাপ্তির। দমটা বুঝি আঁটকে যাবে যে কোনো মুহুর্তে। নিজের ঘরের এদিক ওদিক পায়চারি করছে অনবরত। থেকে থেকে শিউরে উঠছে শরীর। অবশেষে অর্পনের সাথে তার বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হলো। সামনের শুক্রবারেই বিয়ে। হাতে আর মাত্র পাঁচটা দিন। ঘরির কাঁটায় টিকটিক করে যত সময় এগোচ্ছে, প্রাপ্তির অস্থিরতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভালোলাগা, খুশি, লজ্জা, ভয় সবকিছু মিলে একটা মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। তবে এই অনুভূতিটা ভীষণ সুন্দর, মনোমুগ্ধকর, হৃদয় ছোঁয়া।

খাটের ওপর বসে ফোনটা হাতে নিয়ে প্রাপ্তির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সুপ্তি। ফোনের ক্যামেরা প্রাপ্তির দিকে তাক করা। ফোনের অপর পাশে আছে অর্পন। সুপ্তির ফোনে ভিডিও কল দিয়ে নিজের কাজ করছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রাপ্তিকে এক নজর করে দেখছে। এই বিষয়ে সুপ্তি বেশ সাহায্য করেছে অর্পনকে। এদিকে প্রাপ্তি ঘনঘন পায়চারি করার ফলে ফোনটা একজায়গায় শান্ত ভাবে রাখতে পারছে না সুপ্তি। বিরক্তিতে “চ” এর মতো উচ্চারণ করে বলে,

—“এমন ঘোড়ার মতো দৌড়াচ্ছো কেনো আপি? একটু শান্ত হয়ে বসবে প্লিজ?”

সুপ্তির কথা শেষ হতেই ধপ করে বসে পড়ে প্রাপ্তি। সেই শব্দে চমকে ওঠে অর্পন। হুট করে ফোনের দিকে তাকায়। প্রাপ্তি খাটের একদম কিনারে বসেছে। দেখতে পায়নি, আন্দাজ করে বসতে গিয়ে এই অবস্থা। আর একটু পিছিয়ে বসলেই সোজা নিচে পড়ে যেতো। রাগে চোয়াল শক্ত করে যায় অর্পনের। ইচ্ছে করছে আকাশ কাঁপিয়ে একটা ধমক দিতে। কিন্তু সেটাও পারছে না। এখন একটা টু শব্দও করলে তার লুকোচুরি ধরা পড়ে যাবে। হাত দুটো শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ সামাল দেয় অর্পন। এই মেয়েটার জন্য সে নিজেকে কত বদলে ফেলেছে। রাগ সামলাতেও শিখে গেছে। ভেবেই অবাক হয়ে যায় অর্পন।

এদিকে প্রাপ্তির ছটফটানি বেড়েই যাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রাপ্তি বলে,

—“এটা কি ঠিক হচ্ছে সুপ্তি?”

ভ্রু কুঁচকে যায় সুপ্তির। প্রাপ্তি ঠিক কিসের কথা বলছে তা বুঝে আসছে না। কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করে,

—“কিসের কথা বলছো তুমি?”

—“এই বিয়ের কথা। আচ্ছা তোর কি মনে হয়? আমি সব সামলে নিতে পারবো?”

—“কেনো পারবে না! অবশ্যই পারবে। আর তাছাড়া জিজু আছে তো, সে বাকিটা সামলে নেবো।”

সুপ্তির মুখে জিজু ডাক শুনে বিষম খায় অর্পন। তড়িঘড়ি করে ফোন মিউট করে পাশের গ্লাস থেকে পানি খেয়ে নেয়। জীবনের প্রথম এমন ডাক শুনছে। বড্ড অদ্ভুত লাগছে অর্পনের কাছে। প্রাপ্তির কথা শুনে সব চিন্তা বাদ দিয়ে সেদিকে তাকায়। প্রাপ্তি উদাসীন কন্ঠে বলে,

—“দাদাভাইকে খুব মিস করেছি রে। জানি না কেনো দাদাভাই বদলে যাচ্ছে। এটা আমার মনের ভুল নাকি বাস্তব সেটাও জানি না। বাসায় আসাও কমিয়ে দিয়েছে। ফোনেও পাওয়া যায় না। কি হয়েছে তার? এখানে আসলে অন্তত সাহস পেতাম। দাদাভাই তার কথার জাদুতে আমার সব ভয় দূর করে দিতো।”

প্রাপ্তির উদাসীন কন্ঠ শুনে শান্ত চোখে তাকায় অর্পন। সুপ্তিও নির্বাক। সত্যি বলতে সজীবের এই পরিবর্তন সুপ্তিকেও বেশ ভাবাচ্ছে। কেনো যেনো মনে হচ্ছে সজীব বদলে গেছে। সে আর আগের মতো নেই। কিন্তু সে কি আসলেই বদলে গেছে নাকি আগে থেকেই এমন ছিলো। হয়তো প্রকাশ করেনি তাই।

নিজের কাজ শেষ করে ফোনটা কেটে দেয় অর্পন। তারপর কল করে প্রাপ্তির নাম্বারে। হাতের ফোনটা বেজে উঠতেই ভ্রু কুঁচকে যায় প্রাপ্তির। এই রাতে আবার কে ফোন করলো? রিসিভ করে কানে ধরতেই শুনতে পায় অর্পনের গম্ভীর গলার আওয়াজ,

—“এতো রাতে ঘুমাওনি কেনো?”

থমকে যায় প্রাপ্তি। সন্দিহান কন্ঠে বলে,

—“আমি ঘুমাইনি সেটা আপনি জানলেন কীভাবে?”

—“ঘুমালে তো আর ফোন রিসিভ করতে না।”

সহসা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়ে প্রাপ্তি। মনের সব সন্দেহ বাতাসের সাথে উবে গেছে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে,

—“এতো রাতে ফোন দিলেন যে। কোনো দরকার?”

—“একটা জরুরি কাজে শহরের বাইরে যাচ্ছি। তিনদিন পর ফিরবো। এর মাঝে ফোন দিতে পারবো না তাই জানিয়ে রাখলাম। সেখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না।”

কথাগুলো বলেই চুপ হয়ে যায় অর্পন। প্রাপ্তিও নিশ্চুপ। কেনো যেনো মনটা খারাপ হয়ে গেলো প্রাপ্তির। সেটা কি অর্পন শহরের বাইরে যাচ্ছে তাই? তিনদিন দুজনের মধ্যে কোনো যোগাযোগ থাকবে না তাই? এই কয়েকদিনে অর্পন যেনো প্রাপ্তির অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। সারাদিনে অন্তত একবার ফোনে কথা হয় দুজনের। তিনটা দিন কোনো কথা হবে না ভাবতেই বুকটা ভারি হয়ে আছে প্রাপ্তির। যেনো এই সামান্য বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারছে না। অর্পন যেনো বুঝতে পারে প্রাপ্তির মনের কথা। হালকা হেসে বলে,

—“মাত্র তিনদিনের জন্য যাচ্ছি। সারাজীবনের জন্য নয়। একটু মানিয়ে নিও। সোজা হলুদ সন্ধ্যায় দেখা হবে। আমি নিজে যাবো তোমার বাড়ি। কথা দিলাম। এখনও কি মন খারাপ করে থাকবে?”

এতটুকুতেই হেঁসে ফেলে প্রাপ্তি। ঠোটের কোণে লাজুক হাসি নিয়ে বলে,

—“সাবধানে যাবেন। কাজ শেষ করে জলদি ফিরে আসবেন। আমি চিন্তায় থাকবো।”

কথাগুলো বলেই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। সাথে সাথে কল কেটে দেয়। আর কথা বলা সম্ভব নয়। বুকের ভেতর টিপটিপ করছে। এতো লজ্জা নিয়ে অর্পনের সামনে দাঁড়াবে কিভাবে?

—“বাব্বাহ্, এতো ভালোবাসা। একদিনে তো উদয় হয়নি। কবে থেকে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছো? তাও আবার আমার থেকে লুকিয়ে।”

সুপ্তির দুষ্টুমি মেশানো কথা শুনে আরো লজ্জা পায় প্রাপ্তি। লজ্জা থেকে মুক্তি পেতে প্রসঙ্গ পালটে ফেলে। সুপ্তির কানটা শক্ত করে ধরে বলে,

—“ওরে দুষ্টু! বড় বোনের সাথে ফাজলামি। বেশি পেকে গেছিস তাই না। তাহলে বাবাকে বলে তোরও ব্যবস্থা করি? আমার কিন্তু দেবর আছে।”

প্রাপ্তির হাত থেকে কান ছাড়িয়ে লাফিয়ে উঠে সুপ্তি। এক লাফে খাট থেকে নামে। আতঙ্কিত কন্ঠে বলে,

—“একদম না। ওই কলিজা কাটা ডাক্তারকে আমি একদম বিয়ে করবো না। বেয়াদব টাকে আমার মোটেও পছন্দ নয়।”

—“বললি তো! দাঁড়া, ওই বেয়াদবের সাথেই তোর বিয়ে দেবো।”

—“আমি করলে তো দিবে। দেখি তুমি কিভাবে আমার বিয়ে দাও।”

কথাগুলো বলেই ধুপধাপ পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সুপ্তি। ওর পায়ের আওয়াজ শুনে শব্দ করে হেসে ফেলে প্রাপ্তি। ছোট বোন যে রেগে গেছে সেটা ওর পায়ে ভারি আওয়াজেই স্পষ্ট। তবে অঙ্কনের সাথে জুটিটা মন্দ নয়। এটা নিয়ে একটু ভাবা দরকার।

————————–

সাগরের সাথে হসপিটালে এসেছে দীপ্তি। সাগর তার কোনো একজন পরিচিত ডক্টরের সাথে আলাপ করিয়ে দিতে চায়। মুলত দীপ্তির বাচ্চা হওয়ার বিষয়টা নিয়ে সেই ডক্টরের সাথে কথা বলেছে সাগর। যদিও দীপ্তি এখন আর বাচ্চার বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না। সজীবের ধোঁকা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে তো আরও না। তবে সাগরের ডাক সে উপেক্ষা করতে পারেনি। ছুটে চলে এসেছে। এই সুযোগে যদি একটু তার কাছাকাছি থাকা যায়, ক্ষতি কি তাতে? আবার পরক্ষনেই মনের মধ্যে অপরাধবোধ জেগে ওঠে। এটা কি ঠিক হচ্ছে? সাগরের সান্নিধ্যে থাকা দীপ্তির জন্য পাপ। কারণ সে বিবাহিত। সাগরও বিবাহিত। বাচ্চাও আছে। এখন অতীত নিয়ে ভাবটা অপরাধ। এতে যে কারো সংসার ভেঙে যাবে। এরকম আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে সাগরের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে যায়। ধ্যান ভাঙে সাগরের আওয়াজে। হাঁটতে হাঁটতে সাগর বলে,

—“আমার ডাক্তারি পড়াটাই ব্যর্থ। কি করলাম ডক্টর হয়ে? যেখানে নিজের কাছের মানুষ গুলোকে সুস্থ করতে পারছি না। না আমি গাইনি বিভাগের ডক্টর আর না চক্ষু বিশেষজ্ঞ। ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে আমার হার্ট সার্জন হওয়ার সিদ্ধান্তটা ভূূল ছিলো।”

একাধারে কথাগুলো বলে যায় সাগর। কিন্তু দীপ্তি নিরুত্তর। চুপচাপ সাগরের প্রতিটা কথা শুনে যাচ্ছে। এরই মাঝে তারা উপস্থিত হয় কাঙ্ক্ষিত ডক্টরের কেবিনে। দড়জা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দীপ্তি দেখতে পায় একজন মহিলা ডক্টর বসে আছে। কিছু একটা লিখছে হয়তো। সামনে কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে মাথা তুলে তাকায়। সাগরকে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে যায়। চোখ মুখে খুশি যেনো উপচে পড়ছে তার। ঠোট ছড়িয়ে হেসে বলে,

—“সাগর তুমি? এই সকাল সকাল!”

পরপরই দীপ্তির দিকে চোখ পড়তেই বিস্ফোরিত চোখে তাকায়। অবাকের রেশ তার চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। যেনো সাগরের সাথে দীপ্তিকে সে মোটেও আশা করেনি। দীপ্তির অবস্থাও একই। সামনের ডক্টরের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।

দীপ্তিকে ইশারায় আসতে বলে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় সাগর। চেয়ার টেনে বসে দীপ্তিকে পাশে বসতে ইশারা করে। দীপ্তি বসতেই সাগর গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

—“অবাক হচ্ছো কেনো স্বর্ণালি? কাল তো তোমার সাথে একটা পেসেন্টের বিষয়ে কথা বললাম। এই হলো তোমার সেই পেসেন্ট।”

দীপ্তির দিকে ইশারা করে কথাটা বলে সাগর। ডক্টর স্বর্ণালি আরো বেশি অবাক হয়ে যায়। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সাগর সাহায্য করছে দীপ্তিকে। তাও আবার বাচ্চার বিষয়ে। বিষয়টা খুবই আশ্চর্যের।

স্বর্ণালির মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের হাতের ঘরির দিকে একবার তাকায় সাগর। দেরি হয়ে যাচ্ছে। ঘরির থেকে চোখ সরিয়ে স্বর্ণালির দিকে তাকিয়ে বলে,

—“একটা সার্জারি আছে আমার। তুমি তোমার পেসেন্টকে সামলে নিও। দুই ঘন্টা পরে এসে দেখা করছি। আমি আসা পর্যন্ত দু’জন এখানেই থাকবে।”

কথাগুলো বলেই উঠে দাঁড়ায় সাগর। ভারি ভারি কদম ফেলে দড়জার দিকে এগিয়ে যায়। সাগর চলে যেতেই ছোট্ট করে দম নেয় দীপ্তি। দরজার থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকায়। স্বর্ণালি সরু চোখে তাকিয়ে আছে দীপ্তির দিকে। এই চাহনি অস্বস্তিতে ফেলে দেয় দীপ্তিকে। দীপ্তির দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে স্বর্ণালি বলে,

—“এতো বছর পর ফিরে এসেছো কেনো? কি উদ্দেশ্য তোমার?”

—“মানে?” — ভ্রু কুঁচকে বলে দীপ্তি।

—“মানেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো। স্বার্থপরের মতো সেদিন সাগরে ছেড়ে চলে গেছিলে। তাহলে আজ কেনো ফিরে এসেছো? ছেলেটাকে আবার ভেঙে ফেলতে?”

অপ্রস্তুত হয়ে যায় দীপ্তি। আমতা আমতা করে বলে,

—“আপনি এসব কেনো বলছেন আপু? তাছাড়া সেই ঘটনার অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। সবাই নিজেদের জীবন গুছিয়ে নিয়েছে। তাহলে পুরনো কথা বলার কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে?”

রেগে যায় স্বর্ণালি। কিছুটা চেচিয়ে বলে,

—“প্রয়োজন আছে। কারণ তুমি একটা স্বার্থপর মেয়ে। নিজের খুশির জন্য তুমি সাগরের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলে। তারপর নিজের স্বার্থে তুমি ওকে ছেড়ে চলে গেছো। একবারও ভেবে দেখেছো যে, সাগরের কি হবে? ও মানতে পারবে কি না? পেছন ফিরে দেখছো একবারও যে, সাগর ভালো আছে কি না?”

স্বর্ণালির কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলে দীপ্তি। ভেতরের অপরাধবোধটা আবারও জেগে ওঠে। চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। দীপ্তির করুন মুখের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসে স্বর্ণালি। আক্রোশ ভরা কন্ঠে বলে,

—“তুমি আসলে মানুষটাই অপয়া। যার জীবনে যাও তার জন্যই দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দাঁড়াও। সাগরের জীবনে এসে ওকে তো মেরেই ফেলেছিলে। একবার খোজ নিলে জানতে পারতে, তোমার দেয়া ধোঁকা সইতে না পেরে সাগর ঠিক কোন জায়গায় পৌঁছে গেছিলো। দু দুবার আ*ত্ন*হ*ত্যাও করতে চেয়েছিলো। পাগলের মতো আচরণ করতো। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলো। নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে। বারবার নিজের ওপরেই আক্রমণ করেছে। কত শত আঘাত করেছে নিজেকে সেই কষ্ট সয্য করতে না পেরে। মানসিক ভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। আন্টি সবসময় কান্নাকাটি করতো নিজের ছেলের এমন করুন অবস্থা দেখে। সামলাতে পারতেন না সাগরকে। ওই সময় অর্পন যদি না থাকতো তাহলে ছেলেটা মরেই যেতো। আমি আর অর্পন মিলে কত কষ্টে সাগরকে স্বাভাবিক করেছি সেটা শুধু আমিই জানি। সত্যি বলতে তুমি তো কখনো সাগরকে ভালোই বাসোনি। যদি বাসতে তাহলে ওকে এতোটা আঘাত দিতে পারতে না। তোমার মতো একটা স্বার্থপর মেয়ের জন্য সাগর আমার ভালোবাসা পায়ে ঠেলে দিয়েছে। কখনো আমার ভালোবাসা বুঝতে চায়নি। আফসোস, যদি আমার ভালোবাসা বুঝতো তাহলে এতোটা কষ্ট ওকে পেতে হতো না।”

এক দমে কথাগুলো বলেই থামে স্বর্ণালি। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে। বহু বছর ধরে জমানো কথা বলতে পেরে মনটা হালকা হয়ে গেছে। কিন্তু রাগ কমলো না। দীপ্তির ফিরে আসাটা মোটেও সয্য করতে পারছে না স্বর্ণালি। এই মেয়ের জন্য সবার জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। সেই কলেজ লাইফ থেকে সাগরকে ভালোবাসে স্বর্ণালি। কিন্তু সাগর কখনো ওকে সেই নজরে দেখতো না। একই ক্লাসে পড়ার সুবাদে ভালো বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিতো। কখনো স্বর্ণালির ভালোবাসাকে পাত্তা দেয়নি। তারপর সাগরের জীবনে আসে দীপ্তি। তাদের সম্পর্ক প্রনয়ের রুপ নেয়। প্রথম প্রথম কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিলো স্বর্ণালি। তার কাছে সবার আগে সাগরের খুশি। পাওয়া না পাওয়া নিয়ে কোনো আফসোস নেই। কিন্তু দীপ্তি যখন সাগরকে ছেড়ে চলে যায় তখন আবারো পুরনো চাওয়া মনে জেগে ওঠে। নিজের সর্বোস্ব দিয়ে সাগরকে সুস্থ করে তোলে। আশায় থাকে এবার সাগর তাকে মেনে নেবে। কিন্তু এবারেও তাকে হতাশ করে সাগর ফিরেয়ে দেয় স্বর্ণালিকে। দীপ্তি ছাড়া যেনো তার পৃথিবীতে আর কোনো নাম নেই। এতোগুলা বছর পর আবার সাগরের পাশে দীপ্তিকে দেখে পুরনো রাগ জেগে উঠেছে।

এদিকে দীপ্তির হাল বেহাল। নিজের করা ভুলের জন্য আর কত পস্তাবে দীপ্তি? এই কষ্টের যেনো কোনো শেষ নেই। চোখের পানি মুছে নিজেকে সামলে নেয় দীপ্তি। থেমে থেমে বলে,

—“আমি মানছি আমি ভুল করেছি। এগুলো এখন অতীত। আমার বিয়ে হয়েছে। সাগরের বিয়ে হয়েছে। তাহলে এখন এসব বলে কি লাভ?”

—“সবাইকে কি নিজের মতো মনে করো? তুমি স্বার্থপরদের মতো নিজের জীবন গুছিয়ে নিলেও সবাই সেটা পারেনি দীপ্তি। তোমার নামে সাগর তার পুরো জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছে।”

সহসা কান্না থেমে যায় দীপ্তির। বিস্মিত কন্ঠে বলে,

—“মানে? সাগর তো বিয়ে করেছে।”

—“করেনি। সাগর আজও অবিবাহিত। তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় সে আজও পথ চেয়ে আছে। অন্য কোনো মেয়েকে তার জীবনে জায়গা দিতে পারেনি। আর না আমি পেরেছি নিজের জীবনে অন্য কাউকে আনতে। তোমার একটা ভুল আমাদের জীবনটাকেও এলোমেলো করে দিয়েছে। তুমি যদি সাগরের জীবনে না আসতে তাহলে আমি আর সাগর সুন্দর একটা সংসার গড়তে পারতাম। তোমার জন্য সেটা সম্ভব হলো না। তুমি সবার জন্য অভিসাপ। অবশ্য পাপের শাস্তি তো পাচ্ছোই। বিয়ের এতোগুলা বছরেও বাচ্চা হয়নি। এটা শাস্তি ছাড়া আর কি?”

দীপ্তি নিরুত্তর। অনুভূতিহীনের মতো বসে আছে। মন মস্তিষ্কে চলছে উথাল পাথাল ঝড়। সাগর ওকে মিথ্যে বলেছে। সে বিয়ে করেনি। কোনো বাচ্চা নেই। আজও দীপ্তির অপেক্ষায় বসে আছে। দীপ্তির জন্য সাগর তার জীবনটাই অর্থহীন করে ফেলেছে। এতবড় অপরাধবোধ নিয়ে বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়েছে যেনো। এই এতো এতো কষ্ট সইবে কিভাবে দীপ্তি?

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নেয় স্বর্ণালি। রাগটা একদম মাথায় চড়ে গেছিলো। সাগর এই বিষয়ে কিছু জানলে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দেবে। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বর্ণালি নিচু স্বরে বলে,

—“তোমার প্রতি আমার রাগটা হয়তো কোনোদিন কমবে না। তবে এই মুহূর্তে তুমি সাগরের অতীত নয়, আমার পেসেন্ট। তাই উচ্চ বাক্য প্রয়োগ করার জন্য স্যরি। এজ এ ডক্টর আমি নিজের দায়িত্ব এড়াতে পারি না। তোমার পুরনো রিপোর্ট গুলো আমাকে দিয়ে যেও আর কিছু টেস্ট করাতে হবে। সেগুলো করে নিও। আমি নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো তোমাকে সাহায্য করার।”

————————-

নিজের ঘরে সোফার ওপর গা এলিয়ে বসে আছে সজীব। একটু আগেই ফিরেছে। এসে দেখছে দীপ্তি ঘরে নেই। বিষয়টা তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দেয়। হঠাৎ করেই তার ফোন বেজে ওঠে। চোখ বন্ধ রেখেই ফোনটা রিসিভ করে সজীব। ওপাশ থেকে কিছু একটা শুনেই তড়াক করে চোখ মেলে তাকায়। চোখ মুখ রাগে শক্ত হয়ে গেছে। পরপরই চেহারায় দেখা যায় ক্রুর হাসি। ফোনটা কেটে ফের সোফায় গা এলিয়ে দেয়। মাথার ওপরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে। হুট করেই সোজা হয়ে বসে। ফোন থেকে প্রাপ্তির একটা হাস্যজ্জল ছবি বের করে চোখের সামনে ধরে। কন্ঠে ক্রোধ মিশিয়ে বলে

—“খুব বিয়ে করার সখ তাই না প্রাপ্তি। সুখের সংসার করবি। অন্যের সুখ কেড়ে নিয়ে নিজে সুখ করবি। সেটা তো হয়না। তোর এই সুখ আমার সয্য হচ্ছে না। কি করবো বল? সয্য না হলে তো কোনো পদক্ষেপ নিতেই হবে। সেই পদক্ষেপ যদি তোর প্রণপ্রিয় অর্পনের বিরুদ্ধে নেই তাহলে কেমন হয় বলতো? খুব ভালো হবে। এবার খেলা জমবে। তোর বিয়ে তো আমি এতো সহজে হতে দেবো না। এই বিয়ে অর্পনের জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াবে। হাতে আর মাত্র পাঁচটা দিন। পারলে বাচিয়ে নিস তোর অর্পনকে।”

কথাগুলো বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সজীব। চোখ মুখে তার ক্রোধ। প্রাপ্তিকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রয়াশ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

চলবে?