তারে আমি চোখে দেখিনি পর্ব-৩০+৩১

0
97

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ৩০
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

গ্রীষ্মের প্রচন্ড উত্তপ্ত তাপদাহের পর বর্ষার শীতল বায়ুর আবির্ভাব ঘটেছে। এর মাঝে কয়েকদিন বৃষ্টিও হয়েছে। জানান দিচ্ছে আগামী দিনে ভারি বর্ষনের। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছে বর্ষার মিষ্টি ভেজা সুবাস। গাছপালা বৃষ্টিস্নান শেষে সতেজ হয়ে উঠেছে যেনো। ভেজা কর্দমাক্ত মাটির ওপর দিয়ে ধীর পায়ে হেটে যাচ্ছে সুপ্তি। এক হাতে ছাতা ধরে অন্য হাতে গাউন ধরে কদম গুনে গুনে হাঁটছে। এই সময় বের হওয়ার জন্য এখন নিজেকেই গালি দিতে ইচ্ছে করছে। চারিদিকে কাঁদা পানিতে রাস্তায় হাঁটা দুস্কর হয়ে পড়েছে। তার ওপরে আকাশের অবস্থা ভালো না, কখন যেনো বৃষ্টি শুরু হয়। ইতিমধ্যে সাদা গাউনের নিচের দিকে কয়েক জায়গায় কাঁদা পানিও লেগে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়ে সুপ্তি। বড় পাপা করে ফেলেছে শপিং করতে এসে। এরচেয়ে অনলাইনে অর্ডার করলে ভালো হতো। বোনের বিয়েতে পড়ার জন্য পোশাক স্বচক্ষে দেখে কেনার ইচ্ছা তাকে বাজে ভাবে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে। রাস্তার ওইপাশেই দোকানগুলো। আর অল্প একটু কষ্ট করলেই মুক্তি। এক হাতের গাউনের নিচের অংশ গুছিয়ে রাস্তা পার হতে উদ্যোক্ত হয়। এমন সময় হঠাৎ করেই ঝড়ের গতিতে একটা গাড়ি সুপ্তির সামনে দিয়ে চলে যায়। কর্দমাক্ত পানি গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে ছিটকে আসে সুপ্তির দিকে। মুহুর্তেই পুরো জামা সহ চোখ মুখ কাঁদায় ভরে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব সুপ্তি। কি থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারছে না। স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকে কয়েক মুহুর্ত। সম্মতি ফিরে পেতেই গাড়ির দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায়।

ইতিমধ্যে গাড়িটা কিছুদূর গিয়ে থেমে গেছে। গাড়িটা অঙ্কন চালাচ্ছিলো। তাড়াহুড়োতে থাকায় অসাবধানতা বসত ঘটনাটা ঘটে গেছে। কিন্তু সুপ্তিকে অঙ্কন খেয়াল করেনি। তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নেয় পেছনে ঘুরে তাকায়। অপরাধী কন্ঠে বলে,

—“আ’ম, সো সরি মিস! একটু তাড়ায় আছি তাই বুঝতে পারিনি।”

সরি বলে এগিয়ে আসতেই কাঁদা মাটি মাখানো সুপ্তিকে দেখে থমকে যায় অঙ্কন। এটা যে সুপ্তি সেটা প্রথমে বুঝতে পারেনি। কাছে এসে ভালো করে তাকানোর পর বুঝতে পেরেছে। সুপ্তিকে এই অবস্থায় দেখে হো হো করে হেঁসে ওঠে অঙ্কন। দুই হাতে মুখ ঢেকে সামনে ঝুঁকে হাসছে। হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার উপক্রম তার।

এদিকে সুপ্তি রাগে ফুঁসছে। অঙ্কনের প্রতি রাগটা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাগ সামলাতে না পেরে চেচিয়ে ওঠে সুপ্তি। উচ্চ কন্ঠে বলে,

—“ইউ, কলিজা কাটা ডাক্তার! আপনি আসলেই একটা অসভ্য। কি করলেন এটা?”

বহু কষ্টে নিজের হাসি থামায় অঙ্কন। নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,

—“সরি! আমি আসলে দেখতে পাইনি। সত্যিই ঘটনাটা অনাকাঙ্ক্ষিত।”

—“আপনি বলবেন আর আমি বিশ্বাস করবো? আপনি ইচ্ছে করে এটা করেছেন। পাবলিকের সামনে আমাকে অপমান করতে এটা করলেন তাই না?”

—“দেখো আমি সত্যি খেয়াল করিনি। বিশ্বাস করো!”

পূর্বের তুলনায় আরো বেশি রেগে যায় সুপ্তি। রাগে দুঃখে কান্না চলে আসে। এগিয়ে এসে অঙ্কনের শার্টের কলার চেপে ধরে। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,

—“বিশ্বাস! তাও আপনাকে। সম্ভব নয়। রাস্তার আওয়ারা মাস্তানদের বিশ্বাস করতে পারি কিন্তু আপনাকে না।”

সুপ্তির কথাটা আত্মসম্মানে আঘাত করে অঙ্কনের। সুপ্তি ওকে এতো ছোটো চোখে দেখে। এতো নিচু মনে করে। রাস্তার গুন্ডা মাস্তানদের থেকেও নিকৃষ্ট ভাবে। কথাটা অঙ্কনেকে বেজায় আঘাত করে। তার ওপর এভাবে পাব্লিক প্লেসে কলার চেপে ধরায় রাগটা আর সামলাতে পারে না। ঝাড়ি মেরে হাত সরিয়ে দেয় সুপ্তির। অঙ্কনের থেকে উচ্চতায় অনেকটা খাটো হওয়ায় পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে দাড়িয়েছিলো সুপ্তি। হঠাৎ ঝটকায় তাল সামলাতে না পেরে খানিকটা পিছিয়ে যায়। পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। অঙ্কন আঙ্গুল তুলে রাগী কন্ঠে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

—“লিসেন! আমার অতো বেহুদা টাইম নেই যে রাস্তা ঘাটে তোমার ওপর ওয়েস্ট করবো। আর রইলো কাঁদা লাগার ঘটনাটা, সেটা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত ছিলো। আমি এতোটাও নিচ নই যে কারো গায়ে ইচ্ছে করে কাঁদা লাগিয়ে দেবো। অবশ্য তোমাকে এসব বলে লাভ নেই। কারণ তুমি একটা চরম লেভেলের বেয়াদব মেয়ে। বেশ হয়েছে গায়ে কাঁদা লেগেছে। তোমার জন্য উপযুক্ত শাস্তি এটা। এবার এই অবস্থাতেই বাড়ি ফেরো।”

দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলেই হনহন করে সেখান থেকে চলে যায় অঙ্কন। সুপ্তি থাক এখানে দাড়িয়ে। যেভাবে খুশি বাড়ি যাক। না হলে না যাক। অঙ্কন ওকে নিয়ে একদম ভাববে না। গাড়িতে বসে সাথে সাথে গাড়ি স্টার্ট দেয়। মুহুর্তেই গাড়িটা দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যায়।

অঙ্কনের চলে যাওয়ার দিকে ছলছল চোখে তাকায় সুপ্তি। কয়েক পল তাকিয়ে থাকতেই টুপটাপ অশ্রু গড়িয়ে পড়ে চোখ থেকে। অভিমান আরো বেশি ঘিরে ধরে। নিজের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। এখন এই অবস্থায় না শপিংয়ে যেতে পারবে, আর না বাসায়। এতোটা রাস্তা যাবে কিভাবে? ভাবতেই কান্নার রেশ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে চোখের পানি বিসর্জন দিতে থাকে।

মিনিট দুয়েক পর সামনে এক জোড়া পা আবিষ্কার করে সুপ্তি। পা জোড়া সুপ্তির থেকে এক হাত দূরে স্থির দাড়িয়ে আছে। তবে কি অঙ্কন এসেছে সুপ্তিকে সাহায্য করতে? আশা ভরা চোখ নিয়ে মাথা তুলে তাকায় সুপ্তি। কিন্তু সামনে একটা অপরিচিত মুখ দেখে চেহারার রঙ পাল্টে যায়। একটা অচেনা ছেলে দাড়িয়ে আছে। সুপ্তির সমবয়সী বা দুই এক বছরের বড় হবে। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছেলেটি বলে,

—“এনি প্রবলেম? আপনার পুরো শরীরে এমন কাঁদা লাগলো কিভাবে?”

সুপ্তি নিরুত্তর। অচেনা ছেলেটাকে দেখে আবার মাথা নিচু করে নিয়েছে। ছেলেটা কিছুক্ষণ সেভাবেই স্থির হয়ে দাড়িয়ে থেকে কোথাও একটা চলে যায়। আড় চোখে তার চলে যাওয়া দেখে সুপ্তি। দুই মিনিটের মাথায় ছেলেটা ফিরে আসে। হাতে একটা বড় পানির বোতল। হাসি মুখে সুপ্তির দিকে সেটা এগিয়ে দিয়ে বলে,

—“বুঝেছি! কোনো গাড়ি আশপাশ দিয়ে যাচ্ছিলো বুঝি। তাই গায়ে কাঁদা লেগে গেছে। এই পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিন। কাঁদা চোখে চলে যাবে।”

ছেলেটার আন্তরিকতা দেখে খুশি হয়ে যায় সুপ্তি। আগে পিছে না ভেবে পানির বোতল হাতে নেয়। প্রথমে মুখটা ধুয়ে নেয়। তারপর একটু একটু করে পানি ঢেলে গায়ের বাকি কাঁদা গুলো ধোয়ার চেষ্টা করে।

কিছুদূর গিয়ে গাড়ি থামিয়ে দেয় অঙ্কন। মাথা ঠান্ডা করতে চোখ বন্ধ করে পেছন দিকে মাথা এলিয়ে দেয়। মিনিট দুয়েক সেভাবেই থাকে। রাগটা কমতেই মনের মধ্যে অপরাধবোধ জেগে ওঠে। সুপ্তির সাথে রাগ দেখানোটা ঠিক হয়নি। মেয়েটা ওই অবস্থায় বাড়ি যাবে কি করে? এভাবে একা ফেলে এসে অমানবিক কাজ করেছে অঙ্কন। ভেতরের অপরাধবোধ অঙ্কনকে শান্তি দিচ্ছে না। মনের সাথে যুদ্ধে হেরে গিয়ে গাড়ি ঘোরায় উল্টো দিকে। সিদ্ধান্ত নেয় সুপ্তিকে নিজ দায়িত্বে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে আসবে। তারপর কাজে যাবে। ভাবনা মোতাবেক গাড়ি পেছনে নিয়ে যায়। খানিকটা দুরত্বে গাড়ি থামিয়ে নেমে আসে বাইরে।

সুপ্তির দিকে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে যায় অঙ্কনের। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সুপ্তি আর তার সামনে দাড়ানো ছেলেটার দিকে। সুপ্তি একটা বোতলের পানি দিয়ে মুখ গলা ধুয়ে কাঁদা ছাড়াচ্ছে। পানির ঝাপটায় জামার সামনের দিকটা ভিজে গেছে। সুতি কাপড় ভিজে শরীরের সাথে আষ্টেপৃষ্টে লেপ্টে আছে। ফলাফল বুকের দিকটা চোখের সামনে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ওড়না গলায় ঝুলিয়ে রাখায় বুকটা স্পষ্ট দৃশ্যমান। ছেলেটার নজর সোজা সুপ্তির দৃশ্যমান বুকের দিকে।

মাথাটা ধপ করে জ্বলে ওঠে অঙ্কনের। কমে যাওয়া রাগ দশগুণ হারে বেড়ে গেছে। রাগের দাপটে শরীর মৃদু কাঁপছে। আগুন লাল চোখে তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যায় অঙ্কন। রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। বড়বড় কদম ফেলে সুপ্তির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাত থেকে বোতলটা টান দিয়ে কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় রাস্তায়।

এদিকে হঠাৎ বোতল কেড়ে নেয়ায় সুপ্তি হতভম্ব। রেগে কিছু বলবে তার আগেই আকাশ কাপিয়ে ধমকে ওঠে অঙ্কন। বাঘের মতো গর্জে উঠে বলে,

—“মাঝ রাস্তায় দাড়িয়ে তামাশা হচ্ছে? গাড়িতে ওঠো।”

অঙ্কনের এমন ভয়ানক আওয়াজের ধমক শুনে কেঁপে ওঠে সুপ্তি। ভয়ে জমে যায় শরীর। অঙ্কনের আগুন লাল চোখ দেখে আর কিছু বলার সাহস পায় না। কিন্তু অভিমানের পাল্লা আরো ভারি হয়। সুপ্তিকে এতো জোরে কেউ কখনো ধমক দেয়নি। মাথা নিচু করে গুটিগুটি পায়ে অঙ্কনের গাড়িতে গিয়ে ওঠে।

ছেলেটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হনহন করে নিজের গাড়ির কাছে চলে যায় অঙ্কন। ড্রাইভিং সিটে বসে ঠাস করে দড়জা লাগিয়ে দেয়। কোনো কথা না বলে গাড়ি স্টার্ট দেয়। রাগে শরীরে আগুন জ্বলছে অঙ্কনের। সবকিছু পুড়িয়ে ভস্ম করে দিতে ইচ্ছে করছে।

পুরো রাস্তা মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কেঁদেছে সুপ্তি। অঙ্কনের সাথে আর কোনো কথা বলেনি। সুপ্তির কান্না অঙ্কনের রাগ আরো বাড়িয়ে দেয়। বাসার সামনে পৌঁছে ধমক দিয়ে বলে,

—“গেট আউট!”

ফের অঙ্কনের ধমকে ভয়ে লাফিয়ে উঠে সুপ্তি। দড়জা খুলে এক দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।

—————————-

সজীবের বাড়ির নিষিদ্ধ সেই ঘর।
ড্রিম লাইটের টিমটিমে আলোয় ঘরটা আবছা অন্ধকার হয়ে আছে। যদিও এখন দিন, কিন্তু ঘরটা অত্যন্ত গুপ্ত ভাবে তৈরি করায় এখানে বাইরের আলো প্রবেশ করে না। একটা জানালা আছে তবে সেটা খোলা নিষেধ। অগত্যাই অন্ধকারে আবৃত করে রাখতে হয় ঘরটা। সোফার ওপর বসে সকালের খাবার খাচ্ছিলো নার্স। একটু পর পর নজর বুলাচ্ছে খাটে শুয়ে থাকা রোগীর দিকে। কষ্ট হয় ছেলেটার জন্য। পুরো দশটা বছর ধরে কোমায় আছে।

হঠাৎ নার্স খেয়াল করে পেসেন্টর হাত নড়ছে। একটু আধটু নয় বরং বেশ ভালোভাবে নড়ছে। চট করে উঠে দাঁড়ায় নার্স। খাবার রেখে তাড়াহুড়ো করে ফোন লাগায় তার ম্যাডামকে। রিসিভ হতেই নার্স তাড়াহুড়ো কন্ঠে বলে,

—“পেসেন্ট রেসপন্স করছে ম্যাডাম।”

ব্যাস এতটুকুই। এর বেশি আর বলার সুযোগ পায়নি নার্স। দুই মিনিটের মাথায় ঝড়ের গতিতে ঘরে প্রবেশ করে রাবেয়া বেগম। পেছন পেছন আসে সজীব। দড়জার আড়ালে এসে দাড়ায় দীপ্তি। সজীবকে সে এখন যতটা সম্ভব চোখে চোখে রাখে। মায়ের ঘরে বসে দুজন কিছু নিয়ে আলোচনা করছিলো। হঠাৎ দুজনকেই দৌড়াতে দেখে দীপ্তিও সাবধানে পিছু নেয়। দড়জার পর্দার আড়ালে দাড়িয়ে চুপচাপ দেখতে থাকে সব।

রাবেয়া বেগম খাটের পাশে বসে ছেলেটার হাত শক্ত করে চেপে ধরেন। হাতটা মৃদু কাপছে। হাতের কম্পন অনুভব করতে পারছেন রাবেয়া বেগম। সজীব বসেছে ছেলেটার মাথার কাছে। গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোগা পাতলা ছেলেটার মুখের দিকে। কয়েক পল অতিবাহিত হতেই ছেলেটা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায়,

—“প…প্রা….প্রাপ্তি! প্রাপ্তি।”

রাবেয়া বেগমের চোখ ছলছল করে ওঠে। সজীবের ঠোঁটে মৃদু হাসি। ছেলেটার ডান গালে হাত রেখে মৃদু স্বরে ডাকে সজীব,

—“ভাই! চোখ খোলা। তাকা আমার দিকে।”

পিটপিট দৃষ্টি ধীরে ধীরে বড় হয়। ঝাপসা চোখ স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় ছেলেটা। হুট করেই উঠে বসে। শরীরটা বেশ দুর্বল। পড়ে যেতে লাগলেই সজীব ধরে ফেলে। কেঁদে ওঠেন রাবেয়া বেগম। চোখে পানি নিয়ে হাসি মুখে বলেন,

—“শান! আমার বাচ্চা।”

এতোক্ষণে রাবেয়া বেগমের দিকে তাকায় শান। অশান্ত কন্ঠে বলে,

—“মা প্রাপ্তি। প্রাপ্তি কোথায়? আমি, আমি পরিক্ষায় পাশ করেছি তাই না? এবার প্রাপ্তি আমার হবে। তাই না ভাইয়া? এবার প্রাপ্তি আমার হবে।”

পাগলের মতো বিলাপ করতে থাকে শান। চেহারায় অস্থিরতা। যেনো তার এই মুহূর্তে প্রাপ্তিকে চাই। তার জগতে প্রাপ্তি ছাড়া আর কিছু নেই। ওকে শান্ত করতে সজীব নিজের দিকে ঘোরায়। দুই হাতের আঁজলায় শানের মুখ ধরে বলে,

—“শান্ত হ শান। একদম পাগলামি করে না। ভাইয়া আছে, তো। আমি তোকে সব এনে দেবো। শান্ত হয়ে যা।”

ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যায় শান। চোখ ঘুরিয়ে ঘরের চারদিকে তাকায়। এই ঘরটা ওর পরিচিত নয়। অচেনা জায়গা। ঘরের চারিদিকে নজর বুলাতে গিয়ে দৃষ্টি গিয়ে থামে দেয়ালে টানানো প্রাপ্তির ছবির দিকে। প্রাপ্তির হাস্যজ্জল ছবির দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে শানের। হঠাৎ করেই নজরে আসে ছবির ওপর লাল কালি দেয়া ক্রস চিহ্নের দিকে। ভ্রু কুঁচকে তাকায় সান। অস্থির চিত্তে উঠে দাঁড়ায়। সোজা হয়ে দাড়াতে পারছে না। পা দুটো টলছে। কোনোমতে দেয়ালে হাত ঠেকিয়ে দাঁড়ায়। ছবির দিকে কাঁপা কাঁপা আঙুল তাক করে বলে,

—“ওর ছবিতে এই চিহ্ন কেনো? কি করেছো তোমরা ওর সাথে?”

—“শাস্তি দিয়েছি।”

রাবেয়া বেগমের কথা শুনে চমকে ওঠে শান। অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

—“মানে?”

—“মানে, এই মেয়ে আমার সংসারের সুখ কেড়ে নিয়েছে। এই মেয়ের জন্য আজ তুই সোজা হয়ে দাড়াতে পর্যন্ত পারছিস না। আমার থেকে আমার ছেলেকে কেড়ে নিতে চেয়েছে। দশটা বছর আমি তোর মুখে মা ডাক শুনতে পারিনি। শুধু মাত্র এই মেয়ের জন্য। তাকে কি এতো সহজে ছেড়ে দেবো ভেবেছিস? তোর মা ওকে ছাড়েনি। ওই মেয়ে তোকে কষ্ট দিয়েছে বিনিময়ে আমি ওকে শাস্তি দিয়েছি।”

শানের চেহারা হঠাৎ করেই পরিবর্তন হয়ে যায়। দৃষ্টি হয় বেসামাল। চেহারা দেখে ভেতরের অবস্থা একদমই বোঝা যাচ্ছে না। শান কোনো মতে জড়ানো কন্ঠে বলে,

—“কি করেছো ওর সাথে?”

রাবেয়া বেগমের ঠোঁটে বাঁকা হাসি। শয়তানি কন্ঠে বলেন,

—“চেয়েছিলাম তো মেরে ফেলতে। কিন্তু ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছে। তবে সুস্থ নয়। তুই যেমন প্রাণে বেঁচে গেলেও এতোগুলা বছর অসুস্থ হয়ে ছিলি। প্রাপ্তিকেও সারাজীবনের জন্য অসুস্থ বানিয়ে দিয়েছি। দৃষ্টি শক্তি কেড়ে নিয়েছি ওর।”

কথাগুলো বলে সামনে তাকাতেই চমকে ওঠেন রাবেয়া বেগম। শান ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে আসে রাবেয়া বেগমের দিকে। চোখ মুখ হিংস্র দেখাচ্ছে। রাবেয়া বেগমের গলা চেপে ধরে গর্জে উঠে বলে,

—“তোমার সাহস কি করে হলো আমার প্রাপ্তির গায়ে হাত দেয়ার। আমাকে বাচিয়ে রেখে তুমি ওকে মারতে চাইছো। এটা মনে হলো না যে আমি তোমাকে মেরে ফেলবো!”

দম বন্ধ হয়ে আসে রাবেয়া বেগমের। শ্বাস আটকে মুখ নীল হয়ে যায়। নার্সটা ভয়ে ঘরের এককোনায় দাড়িয়ে কাঁপছে। সজীব এসে শানকে পেছন থেকে টেনে ধরে। অনেক কষ্টে রাবেয়া বেগমের থেকে দূরে সরায়। কিন্তু শানকে ধরে রাখা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। গর্জে উঠে আক্রমন করতে চাইছে। উপায় না পেয়ে পাশ থেকে নার্সকে কিছু ইশারা করে সজীব। নার্সটা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসে। সিরিঞ্জে একটা ওষুধ তুলে কাঁপা কাঁপা হাতে সজীবের দিকে এগিয়ে দেয়। সিরিঞ্জটা হাতে নিতেই শানের ঘাড়ের পাশে সুচ ফুটিয়ে দেয় সজীব। মুহুর্তেই শান্ত হয়ে যায় শান। ধীরে ধীরে চোখ মুদে আসে। চেতনা হারিয়ে সজীবের হাতেই লুটিয়ে পড়ে। জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত বিড়বিড় করে,

—“প্রাপ্তিকে চাই। আমার প্রাপ্তিকে চাই।”

দুই হাতে নিজের জামার অংশ খামচে ধরে দীপ্তি। শরীর মৃদু কাপছে। সেটা কি ভয়ে? নাকি উত্তেজনায়? জানে না দীপ্তি। শুধু এটুকু জানে, প্রাপ্তির সামনে বিপদ। পরিস্থিতি খুব বাজে একটা মোড় নেবে। অর্পনকে সব জানাতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রাপ্তিকে এখান থেকে সরাতে হবে। শান নামক ছেলেটাকে দীপ্তি একদম ভরসা করতে পারছে না। মানুষ হয়েও অদ্ভুত রকম হিংস্র ছেলেটা। একদম সুবিধার নয়। ব্যাস্ত পায়ে সেখান থেকে চলে যায় দীপ্তি। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন লাগায় অর্পনের নাম্বারে। কিন্তু নাম্বার নট রিচেবল বলছে। বার কয়েক চেষ্টা করে দীপ্তি কিন্তু বরাবরের মতোই ফলাফল শূন্য। চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে যেনো। এবার কি করবে দীপ্তি? কিভাবে জানাবে অর্পনকে? কিভাবে বাঁচাবে প্রাপ্তিকে এই শান নামক হিংস্র প্রাণিটার থেকে?

চলবে?

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ৩১
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

অর্পনের বাড়ি ফেরার কথা ছিলো তিন দিন পর। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন পরে তার ফিরে আসাটা ভাবাচ্ছে সবাইকে। ফিরেই সোজা চলে এসেছে প্রাপ্তিদের বাড়িতে। সদর দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই কিছুটা অবাক হয়ে যায় সবাই। অবাকের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়ে মারুফ সাহেবকে নিয়ে তার ঘরে চলে যায়। বাড়ির বাকি সদস্যদের ঘরে আসতে বারন করে। এতে করে কৌতূহল বেড়ে যায় সবার। কি এমন জরুরি দরকার পড়লো যে এই ভর সন্ধ্যায় অর্পন চলে এসেছে, যেখানে তার ফেরার কথা ছিলো আরও দুইদিন পরে।

ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে পুরো বাড়ির পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করে চলেছে প্রাপ্তি। দেখতে না পারলেও বুঝতে পারছে যে কিছু একটা হয়েছে। এই অসময়ে অর্পনের ফিরে আসা, সেই সাথে মারুফ সাহেবকে নিয়ে একান্তে কথা বলতে যাওয়া ভাবাচ্ছে প্রাপ্তিকে। পাশেই সুপ্তি চুপচাপ বসে আছে। কৌতুহল তার চোখেও বিদ্যমান। কামরুল সাহেব লাঠি হাতে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন। কপালে বেশ কয়েকটা ভাজ পড়েছে বৃদ্ধের। দিলারা বেগম রান্নাঘরে নাস্তা বানাচ্ছেন। বাড়ির হবু জামাই এসেছে। তাকে আপ্যায়ন তো করতে হবে। কিন্তু কাজে মন দিতে পারছেন না তিনি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজের ঘরের দিকে চিন্তিত নজর বুলাচ্ছেন। পুরো বাড়ির পরিবেশ বেশ থমথমে।

সকলের চিন্তা আরেক ধাপ বেড়ে যায় দিদার সাহেবকে আসতে দেখে। তিনি বাড়িতে এসেই সোজা মারুফ সাহেবের ঘরে চলে যান। শুরু হয় তিনজনের গুপ্ত শলা পরামর্শ। প্রায় আধাঘন্টা পর ঘরের দড়জা খুলে যায়। সবার প্রথমে বেরিয়ে আসে অর্পন। মুখটা যথাসম্ভব গম্ভীর। গম্ভীর মুখে ভারি ভারি কদম ফেলে ড্রয়িংরুমে আসে। প্রাপ্তির মুখোমুখি সোফায় কামরুল সাহেবের সামনে বসে পড়ে। পরপর বেরিয়ে আসে মারুফ সাহেব এবং দিদার সাহেব। দিদার সাহেবের মুখটা থমথমে। কিন্তু মারুফ সাহেবের মুখের ধরন ভিন্ন। অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে আছেন। সেই সাথে চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। দুর্বল পায়ে এসে সোফায় বসে পড়েন। ঘর জুরে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। সকল নিরবতা ভেঙে অর্পন প্রাপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“একটু ছাঁদে যাবে প্রাপ্তি? জরুরি দরকার ছিলো।”

চিন্তা মগ্ন প্রাপ্তি চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। উঠে দাড়িয়ে সিঁড়ির দিকে হাটতে থাকে। পা গুনে গুনে ছাদের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যায়। সাথে সাথে যায় অর্পনও। ছাদের ওপর পৌঁছে দড়জাটা চাপিয়ে দেয় অর্পন। প্রাপ্তির এক হাত ধরে ছাঁদের শেষ প্রান্তে নিয়ে আসে। রেলিঙের কাছাকাছি দাড়িয়ে হাতটা আস্তে করে ছেড়ে দেয়। প্রাপ্তির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

—“বিশ্বাস করো আমাকে?”

প্রাপ্তির তৎক্ষনাৎ জবাব,

—“উত্তরটা আপনি জানেন।”

—“তোমার মুখে শুনতে চাই।”

অর্পনের হিম শীতল কন্ঠস্বর শুনে জমে যায় প্রাপ্তি। হৃদপিণ্ড বেগতিক হারে লাফাচ্ছে। অর্পনের কন্ঠস্বর অন্য দিনের মতো স্বাভাবিক নয়। এই কন্ঠে একরাশ চিন্তার মিশ্রণ প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু কোনো? কি নিয়ে চিন্তিত অর্পন? মাথায় হাজারো চিন্তা নিয়ে প্রাপ্তি ধীর স্বরে জবাব দেয়,

—“নিজের চাইতেও বেশি বিশ্বাস করি। এবার বলবেন কি হয়েছে? আমার খুব চিন্তা হচ্ছে!”

প্রাপ্তির কথা শেষ হতেই দু কদম এগিয়ে আসে অর্পন। প্রাপ্তির দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে বলে,

—“এই বিশ্বাসের খাতিরে আমার সব কথা শুনবে। কোনো প্রশ্ন করবে না। আমি বিয়ের ডেট এগিয়ে এনে কালকের তারিখ ঠিক করেছি। নিচে গিয়ে বিনা বাক্যে রাজি হয়ে যাবে। আপাতত কোনো প্রশ্ন নয়।”

প্রাপ্তির মনের কৌতূহল তরতর করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্পনের কন্ঠ অশনি সংকেত দিচ্ছে। মনে হচ্ছে সামনে ঘোর বিপদ। এমন কিছু ঘটতে চলেছে যা কারোর জন্যই শুভ নয়। হাজারো চিন্তা, কৌতুহল মনের ভেতর চেপে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় প্রাপ্তি। সেটা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে অর্পন। আপাতত সবটা সামাল দেয়া দরকার। পরে প্রাপ্তিকে সব বুঝিয়ে বলবে। সত্যিটা জানার পর প্রাপ্তি ঠিক কিভাবে রিএক্ট করবে সেটা ভেবে ভয় পাচ্ছে অর্পন।

———————–

ইতিমধ্যে অর্পনের বাবা, মা আর সাগরের মা এসে হাজির হয়েছে প্রাপ্তিদের বাসায়। তারা আসার একটু পরেই অর্পন আর প্রাপ্তি নিচে নেমে আসে। প্রাপ্তিকে বসিয়ে দিয়ে নিজের বাবার পাশে গিয়ে বসে অর্পন। গলা খাঁকারি দিয়ে অর্পন সবার উদ্দেশ্যে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“আমি চাই বিয়েটা আগামী শুক্রবার না হয়ে আগামীকাল হোক। একটা মিশনে আছি আমি। যে কোনো সময় শহর ছেড়ে যেতে হবে। তাই বিয়েতে কোনো ঝামেলা চাই না। কারোর কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন।”

নিজের কথা শেষ করেই সবার দিকে একনজর তাকায় অর্পন। অর্পন ছাঁদে যাওয়ার পর দিদার সাহেবের কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছে তাই প্রাপ্তির পরিবারের সকল সদস্য নির্বিকার। এদিকে সুভাষ সাহেব বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছেন অর্পনের দিকে। ছেলেটা দিনদিন বেহায়া, নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে। তিনটে দিন অপেক্ষা করতে পারছে না। শেষমেশ বিরক্তিকর কন্ঠে বলেন,

—“তোমার যখন এতোটা তাড়া তাহলে আমরা আর কি বলবো? করো যা খুশি। আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু একদিনের মধ্যে এতো আয়োজন করবে কিভাবে?”

—“সেই চিন্তা তোমাকে করতে হবে না বাবা। আমি অঙ্কন আর ভাইকে সব বলে রেখেছি। ওরা সব ব্যবস্থা করে ফেলবে।”

ছেলের কথায় বেজায় অসন্তুষ্ট হন সুভাষ সাহেব। আত্মীয় স্বজনের সামনে এমন বেহায়াপনা দেখে তিনি ভিষণ বিরক্ত। আর কোনো বাক্য ব্যায় না করে বিরক্তির সহিত সম্মতি জানান। তবে ছেলের ওপর তিনি বেজায় চটে আছেন। বিয়ের জন্য ছেলের এমন অর্থহীন যুক্তিতে তিনি মোটেও সন্তুষ্ট নয়।

————————-

বর্ষার আগমন প্রকৃতিতে ভিন্ন রুপ নিয়ে এসেছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজে উঠেছে চারিপাশ। সময়ে অসময়ে এলোমেলো হাওয়া প্রকৃতিকে উত্তাল করে তুলছে। মুহুর্তেই হচ্ছে তুমুল বর্ষন। সময়ের ব্যবধানে আবার দুর্বল হয়ে থেমে যাচ্ছে বৃষ্টি। এ যেনো প্রকৃতির উথাল-পাতালের অদ্ভুত খেলা।

সন্ধ্যা থেকেই আজ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামছে। বৃষ্টির শীতল স্পর্শে স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে ধরনী। সেই সাথে বয়ে চলেছে হিম শীতল বাতাস। জানালার কাছে দাড়িয়ে এক ধ্যানে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে দীপ্তি। যদিও ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে না। হালকা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি নামছে। তবে বাতাসের বেগটা তুলনামূলক বেশি। প্রবল বায়ুর ঝাপটা জানালার ফাঁক গলিয়ে ঘরে প্রবেশ করছে। ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে দীপ্তির শরীরের অগ্রভাগ। কিন্তু সেদিকে দীপ্তির কোনো হুশ নেই। সে আপন মনে গভীর ধ্যানে মগ্ন। ভাবছে নিজের অতীতের মিষ্টি মুহুর্তের কথা। ভাবছে তার তিক্ত বর্তমানের কথা। ভাবছে তার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা। এই শত্রুতার খেলায় অনেক কিছু হারাতে হয়েছে সবাইকে। জীবন থেকে বেশ কিছু মুল্যবান সময় নষ্ট হয়ে গেছে। চাইলেও সেগুলো ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে ভবিষ্যতের আগত দুর্যোগ মোকাবিলা তো করা সম্ভব। একটু কঠিন হবে কিন্তু অসম্ভব নয়।

আগামীকাল প্রাপ্তির বিয়ে। এই কথা এখনো সজীবকে জানায়নি দীপ্তি। কোনো এক অজানা কারণে মন মানছে না। মনে হচ্ছে সজীবকে জানালে বিপদ হবে। এতোদিন ধরে লুকিয়ে রাখা তার হিংস্র চেহারা বাইরে বেরিয়ে আসবে। সজীবের এই ভিন্ন রুপ সবাই মানবে কিভাবে? সবাই যে তাকে প্রচন্ড বিশ্বাস করে। প্রাপ্তি যে নিজের ভাইয়ের জায়গায় বসিয়েছে এই মানুষটাকে। এতোবড় ধোঁকা প্রাপ্তি কি মেনে নেবে? কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে?

এমন হাজারো আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝে দড়জা খোলার শব্দে পেছন ফিরে তাকায় দীপ্তি। সজীব এসেছে। প্রতিদিন তো বেশ রাত করে বাড়ি ফেরে। তাহলে আজ এতো তাড়াতাড়ি কেনো? ভ্রু কুঁচকে যায় দীপ্তির। সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন করে,

—“আজ এতো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে যে।”

—“কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেছে তাই।”

সজীবের তৎক্ষনাৎ জবাব শুনে চুপ হয়ে যায় দীপ্তি। মনে পড়ে শান নামক ছেলেটার কথা। হয়তো ছোট ভাইয়ের টানে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে। কথাগুলো ভেবেই মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসে দীপ্তি। অন্যের পরিবার ভেঙে, নিজের পরিবার গোছাচ্ছে। বেইমান একটা। পরক্ষনেই কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসে। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সজীবের গলা জড়িয়ে ধরে। সম্মোহনী কন্ঠে বলে,

—“কাজ কাজ করে তো তুমি মহা ব্যস্ততা দেখাও। আজকাল আমাকে সময়ই দাও না। আজ যেহেতু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছো তাহলে রাতের বাকি সময়টুকু আমার চাই।”

কথাগুলো বলেই মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দীপ্তি। সজীবের একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসায়। জোর করে শুইয়ে দিয়ে নিজে সজীবের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। প্রসস্ত বুকে মাথা রেখে নেশাক্ত কন্ঠে বলে,

—“কতোদিন হলো তোমার ভালোবাসা পাই না। একটু ভালোবাসা দেবে সজীব?”

দীপ্তির এমন করুন সুরে আহ্বান শুনে বুকটা ব্যথা করে সজীবের। আজকাল অপরাধবোধ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। দীপ্তির চোখে চোখ রাখতে সংকোচ বোধ করে। নিজের স্বার্থের জন্য এই মেয়েটাকেও ব্যবহার করেছে সজীব। এটা তো দীপ্তির প্রাপ্য ছিলো না। সে তো নির্দোষ। ভালোবাসা হোক বা মায়া কোনো একটা কারণে দীপ্তির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে সজীব। ওকে কষ্ট দিতে এখন নিজেরই বুক কাপে। শক্ত পোক্ত হাতটা দীপ্তির মাথায় রেখে আস্তে আস্তে চুলে আঙুল চালায় সজীব। একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

—“কাজের খুব চাপ দীপ্তি। একটু বোঝার চেষ্টা করো। হাতের কাজগুলো সেরে উঠি, তারপর তোমাকে অনেক সময় দেবো। তবে এখন নয়।”

নিশ্চুপ হয়ে যায় দীপ্তি। গভীর চোখে তাকায় সজীবের দিকে। মানতে কষ্ট হয় এই মানুষটা বিশ্বাস ঘাতক। দীপ্তির পরিবারের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের ক্ষতি করেছে। কিন্তু মন মানতে চায় না। মন বলে এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে। এতোটা নিখুঁত অভিনয় কি কেউ করতে পারে? অপর দিকে মস্তিষ্ক বলে, পুরোটাই তার অভিনয়। সবটা সে জেনে বুঝে স্বজ্ঞানে করেছে। সে অপরাধী। মন মস্তিষ্কের দন্দে ক্লান্ত দীপ্তি। ক্লান্তি মিশ্রিত কন্ঠে বলে,

—“কাল একবার বাড়ি যেতে চাই। এখানে ভালো লাগছে না।”

—“বেশ! ঘুরে এসো। কোনো সমস্যা নেই।”

সজীবের তৎক্ষনাৎ জবাবে ক্ষীন হাসে দীপ্তি। এতো সহজে রাজি হওয়ার কারন একটাই, শান। সজীব ভাবছে দীপ্তি এখানে থাকলে শানের বিষয়ে জেনে যাবে। কিন্তু এই মুহুর্তে শানকে সবার সামনে আনতে চাইছে না সজীব। একটু সময় নিয়ে সবটা গুছিয়ে তারপর দীপ্তির সামনে সত্যিটা প্রকাশ করবে। সজীবের মনের কথা বুঝে যায় দীপ্তি। কিন্তু কোনো প্রতিউত্তর করে না। আগামীকাল যে প্রাপ্তির বিয়ে সেই কথাও সজীবকে জানায় না। আগে বিয়েটা হোক। তারপর সরাসরি সজীবকে প্রশ্ন করবে দীপ্তি। তার আগে নয়।

————————-

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় সজীবের। ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত তিনটা বাজে। আজ সারাদিন শানের সাথে দেখা করা হয়নি। দীপ্তি সেই যে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিলো, তারপর আর সজীবকে উঠতেই দেয়নি।

মাথা ঝুকিয়ে দীপ্তির দিকে তাকায় সজীব। ওর বুকের ওপর মাথা রেখে ঘুমে বিভোর হয়ে আছে দীপ্তি। ঘুমের মাঝেও কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছে। যেনো ঘুমিয়েও কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে। ছোট্ট একটা দম ফেলে আস্তে করে মাথাটা বুক থেকে সরায় সজীব। বালিশে আলতো করে শুইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দড়জা খুলে বের হয়। আবার একইভাবে আস্তে করে দড়জা চাপিয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ায়।

সজীব ঘর থেকে বের হতেই চোখ মেলে তাকায় দীপ্তি। মাথাটা সরানোর সময় ঘুম ভেঙে গেছে। আজকাল দীপ্তির ঘুমটাও আর গভীর হয় না। সজীবের এই লুকোচুরি, বেইমানি খুব বাজে ভাবে প্রভাব ফেলেছে মন মস্তিষ্কে। কে জানে, সামনে আবার কোন অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য বেরিয়ে আসে। ধীর পায়ে বিছানা থেকে নেমে ঘর থেকে বের হয় দীপ্তি। বাইরে কেউ নেই। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ নিঝুম। দীপ্তি জানে সজীব কোথায় যেতে পারে। তাই সময় নষ্ট না করে সেদিকে পা বাড়ায়। শানের ঘরের দড়জার সামনে এসে দাড়ায় দীপ্তি। দেখতে পায় সজীবের রাগী চেহারা। রাগী কন্ঠে রাবেয়া বেগমের সাথে কথা বলছে।

—“ওকে ড্রা*গ*স কে এনে দিয়েছে আম্মা?”

সজীবের রাগী সুরে কথা শুনেও বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখান না রাবেয়া বেগম। গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলেন,

—“পাগলামি করছিলো এটার জন্য। সামলাতে পারছিলাম না। তাই এনে দিয়েছি।”

—“তাই বলে আপনি ড্রা*গ*স এনে দিবেন! দেখেছেন কেমন বেহুশ হয়ে আছে। নিজের সন্তানের ক্ষতি আপনি কিভাবে করতে পারেন?”

এই পর্যায়ে রেগে যান রাবেয়া বেগম। রাগী কন্ঠে চেচিয়ে বলেন,

—“একদম গলা উঁচু করে কথা বলবি না। প্রাপ্তি প্রাপ্তি করে মাথা নষ্ট করে দিচ্ছিলো আমার। তো কি করবো? ড্রা*গ*স পেলে ও যদি প্রাপ্তিকে ভুলে যায় তাহলে তাই হোক।”

—“ড্রা*গ*স নিলে ওকে আর বাঁচানো যাবে না আম্মা। আপনি কি সেটাই চান?”

—“একদম না। আমার সন্তান বেঁচে থাকুক আমি সেটাই চাই। কিন্তু ওই মেয়েটার সাথে নয়। তার জন্য আরো কিছুদিন ওকে ড্রা*গ*সে ডুবিয়ে রাখতে হলে রাখবো। অনেক বছর পর নিয়েছে তাই হুশ নেই। কোনো ব্যপার না। ও আমার ছেলে। পরেরবার থেকে একদম নিজের পায়ে দাড়িয়ে থাকবে।”

রাগে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে সজীবের। তার মায়ের এই উদ্ভট সব কর্মকান্ডে রাগ সামাল দেয়া মুশকিল হয়ে যায়। রেগে পাশের টি-টেবিলে লাথি দিয়ে বলে,

—“যা ইচ্ছা তাই করুন। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন। আপনার ছেলে যেনো আমার পথের বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়। মেয়েগুলোকে ঠিকমতো পার্টির হাতে তুলে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হই। এর পরের অর্ডারটা আমার জন্য ভীষণ জরুরি। মাঝে আমি কোনোরকম ঝামেলা চাই না। আমার ব্যবসার লস আমি একদম মেনে নেবো না আম্মা।”

—“শানকে নিয়ে ভাবতে হবে না তোর। আগামী কয়েকদিন ওকে ঘরেই বন্দী রাখবো। এর মাঝে প্রাপ্তিকে মে*রে ফেলা চাই। ওই মেয়েকে আমি আমার ছেলের পাশে একদম মানবো না।”

রাবেয়া বেগমের কথা শুনে তাচ্ছিল্য হাসে সজীব। বিদ্রুপ সুরে বলে,

—“আপনি তো এমনভাবে বলছেন যেনো এটা বাচ্চাদের হাতের মোয়া। চেষ্টা তো অনেক করলেন। পেরেছেন মা*র*তে?”

—“সেটাই তো চিন্তা। যতবার চেষ্টা করেছি ততবারই ব্যর্থ। কেউ একজন আছে যে প্রাপ্তিকে বাচিয়ে যাচ্ছে। গোপনে রক্ষা করে যাচ্ছে। কিন্তু কে?”

চিন্তায় ডুবে যায় রাবেয়া বেগম। সেই অজ্ঞাত ব্যক্তি কে সেটা জানা জরুরি। সে বারে বারে প্রাপ্তিকে বাচিয়ে দেয়। এদিকে সজীবও চিন্তায় মগ্ন। অন্য মনস্ক ভঙ্গিতে বলে,

—“আমার মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরছে। খবর পেয়েছি অর্পন ফিরে এসেছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, অর্পন গিয়েছিলো কি কাজে? ওর তো বিয়ের আগেরদিন ফেরার কথা ছিলো। তাহলে এতো তাড়াতাড়ি ফিরলো কেনো? কি চলছে অর্পনের মাথায়?”

মা ছেলের পুরো কথপোকথন নিজের ফোনে ভিডিও রেকর্ড করে নেয় দীপ্তি। ভিডিওটা সাথে সাথে অর্পনকে পাঠিয়ে দেয়। একটু একটু করে প্রমান জোগাড় করতে হবে। কিন্তু মনের ভয়টা কমছে না দীপ্তির। প্রাপ্তির জন্য চিন্তা হচ্ছে খুব। এরা প্রাপ্তিকে মে*রে ফেলার চেষ্টা করছে। যদি সেই চেষ্টায় সফল হয়। তখন কি হবে?

চলবে?