তারে আমি চোখে দেখিনি পর্ব-৩৫+৩৬

0
96

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ৩৫
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

নিশুতি রাত! শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে চারিদিকে। মাঝে মাঝে মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে গাছের পাতা। কয়েক পল হেলেদুলে থেমে যাচ্ছে আপনাআপনি। আবারও বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। গগন জুড়ে ছড়িয়ে আছে বেওয়ারিশ মেঘের দল। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। প্রকৃতির গুমোট ভাব জানান দিচ্ছে যে কোনো সময় বৃষ্টি কণ্যাদের আগমন ঘটবে ধরণীতে। হঠাৎ ছুটতে থাকা মেঘের দলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। মেঘের দানবীয় হিংস্র গর্জনে কেঁপে ওঠে ধরণী। বজ্রপাতের তীব্র আলোতে ক্ষনিকের জন্য আলোকিত হয়ে ওঠে চারিদিক। ক্ষনিকের সেই আলোতে স্পষ্ট হয় এক জোড়া শকুন চক্ষু। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে সামনের দিকে। অদূরেই একটা বড় ট্রাক দাড়িয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে তারা কারোর জন্য অপেক্ষা করছে।

অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় মিনিট পাঁচেক পর। একটা বড় মাইক্রো গাড়ি এসে থামে ট্রাকের সামনে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসে মাস্ক পরিহিত চারজন পুরুষ। মাইক্রো থেকে তারা নামতেই ট্রাকের ড্রাইভার সহ আরও দুইজন এগিয়ে আসে তাদের দিকে। চারজনের মধ্যে একজন হাতের ইশারায় ট্রাক ড্রাইভারকে কিছু একটা ইশারা করে। মুহুর্তেই তারা মাইক্রোর দড়জা টান দিয়ে খুলে ফেলে। ডানে বামে সতর্ক নজর বুলিয়ে এক এক করে মাইক্রো থেকে মেয়েদের বের করতে থাকে। মেয়েগুলোর অবস্থা খুবই করুন। কেউই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না। টলমল করে টলছে এক এক জনের পা।

দূরে একটা গাছের আড়ালে দাড়িয়ে সমস্ত ঘটনা পর্যবেক্ষন করছে অর্পন। তার পেছনে আরও তিনজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে। বাকিদের নিরাপদ দূরত্বে থাকতে বলেছে। অর্পন ইশারা দিলেই তারা আক্রমণ করবে। অর্পনকে এভাবে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে দেখে অধৈর্য হয়ে যায় একজন কনস্টেবল। বিচলিত কন্ঠে বলে,

—“স্যার আপনি কোনো এ্যাকশন নিচ্ছেন না কেনো? অপরাধীরা আমাদের চোখের সামনেই। আমাদের এখনই আক্রমণ করা উচিত।”

অর্পন নিরুত্তর। কোনো উত্তর দেয় না। শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজরবন্দী করে রাখছে সামনের দৃশ্য। মাঝে মাঝে তার দক্ষ চক্ষু বিচরণ করছে ট্রাকটার বামদিকে ঝোপঝাড়ে। আরও বেশি অধৈর্য হয়ে যায় অফিসারেরা। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা মিশনে চুপচাপ দাড়িয়ে তামাশা দেখা তাদের পছন্দ হচ্ছে না। তারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সামনে নারী পাচারের চক্র চলছে। তারা তাদের উদ্দেশ্যে সফলের পথে। রহিম পাশ থেকে ধীর কন্ঠে বলে,

—“স্যার আপনি কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন। মেয়েগুলোকে তোলা হয়ে গেলে ওরা চলে যাবে।”

অর্পনের ঠোঁটে বাঁকা হাসি। ক্রুর হেসে বলে,

—“আমি তো সেটাই চাই।”

—“মানে?”

—“ধৈর্য ধরতে শিখুন রহিম সাহেব। আমার চুপচাপ এখানে দাঁড়িয়ে থাকার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। একটু পরেই কারণটা জানতে পারবেন।”

অর্পনের কথার বিরুদ্ধে আর কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে সঠিক সময়ের। মাইক্রো থেকে ট্রাকে মেয়েগুলোকে তোলা শেষ হতেই বিচলিত হয়ে পড়ে অর্পনের পেছনে দাঁড়ানো অফিসারেরা। গাড়ি যে কোনো মুহূর্তে ছেড়ে দিবে। সকলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অর্পনের দিকে। অর্পন নির্বিকার। কানের ব্লুটুথ ডিভাইসে একটা আঙুল রেখে বলে,

—“কাজ শেষ?”

ওপাশ থেকে সতর্ক কন্ঠে কেউ বলে,

—“জ্বি স্যার!”

—“তুমি জানো তো, তোমাকে কি করতে হবে?”

—“হ্যা স্যার।”

—“গুড!”

কথাগুলো বলেই অর্পন অন্য একটা নাম্বারে ডায়াল করে। রিসিভ হতেই গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“আমার ইশারা পাওয়ার পরই তোমরা আসবে। তার আগে নয়। নাইমকে ডেলটা হসপিটালের সামনে চলে যেতে বলো। কুইক।”

কথাগুলো বলেই চারিদিকে সতর্ক নজর বুলায় অর্পন। কাঙ্ক্ষিত সময়ের হিসাব মিলিয়ে রহস্যময়ি হাসি দেয়। দৃষ্টি সামনে রেখে উৎফুল্ল কন্ঠে অর্পন বলে,

—“রহিম সাহেব! এ্যাকশন!”

কথাটা বলেই সামনে দাড়ানো মাইক্রোর পেছনের চাকায় নিশানা লাগিয়ে গুলি ছোড়ে। মুহুর্তেই বিকট আওয়াজে পেছনের চাকা ব্লা স্ট হয়ে যায়। চমকে ওঠে অপরাধীরা। সবাই যার যার মতো ছড়িয়ে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। আড়ালে থেকে নিজেদের আত্মরক্ষা করে। শুরু হয় দুই পক্ষের তুমুল গুলি বর্ষন।

মিনিটের মধ্যেই মেয়েগুলোকে নিয়ে ট্রাকটা চলতে শুরু করে। চোখের পলকে তা দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যায়। পুলিশ অফিসারেরা অপরাধীদের পরাজিত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর অপরাধীরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেদের আত্মরক্ষা করতে। চলতে থাকে দুই পক্ষের সংঘর্ষ।

সজীব লুকিয়েছে একটা বড় গাছের আড়ালে। আত্নরক্ষার কোনো উপযুক্ত জায়গা নেই এখানে। তাই কোনো মতে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। রাগে চোখ লাল হয়ে যায় সজীবের। অর্পনের তো এখানে আসার কথা নয়। তার তো এখন প্রাপ্তির সাথে থাকার কথা। আজ তার বিয়ে ছিলো। সজীব অনেক ভেবে চিন্তে আজকের দিনটাই নির্ধারণ করেছিলো মেয়েগুলোকে পা*চা*র করার জন্য। কারণ সজীবের ধারণা ছিলো অন্তত বিয়ের দিন সে কোথাও বের হতে পারবে না। তাছাড়া তাদের এখানে আশার কথা অর্পন কিভাবে জানলো? কে সেই বিশ্বাস ঘাতক যে অর্পনকে খবর দিয়েছে। চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে সজীবের। তাড়াহুড়ো করে সরতে গিয়ে তার পিন্তলটাও কোথাও পড়ে গেছে। হাজারো চিন্তা আর গোলাগুলির শব্দের মধ্যে সজীব নিজেকে দুর্বল অনুভব করে। গাছের পেছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখে তাদের দলের কয়েকজন আহত হয়ে পড়ে আছে। আর অল্প কিছু লোক বাকি। যে কোনো সময় পুলিশ ওদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরবে। গাড়িটা ইতিমধ্যে অনেকদূর চলে গেছে। এটাই সুযোগ। পালাতে হবে।

কথাগুলো ভেবেই সজীব পেছন দিকে হাটতে শুরু করে। এখন সময় ভোর রাত। ভোরের আকাশে এখনও আলো ফোটেনি। তাই অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে দিব্যি উল্টো পথে হাঁটতে থাকে সজীব। কিছুদূর গিয়েই হঠাৎ থেমে যায় তার পা জোড়া। বিস্ফোরিত চোখে তাকায় সম্মুখ পানে। সামনে অর্পন দাঁড়িয়ে আছে। রিভালবার সোজা সজীবের বুকের দিকে তাক করে রেখেছে। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সজীব। মুখের মাস্কাটা আরো একটু ভালো করে টেনে নেয়। শুধু চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সজীবের সেই চোখের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে অর্পন। ক্রুর কন্ঠে বলে,

—“একি বস! চেহারা ঢাকতে মাস্ক পড়েছো। কিন্তু লাভ হলো কি? আমি যে তোমাকে চিনে ফেলেছি।”

সজীব শয়তানি হেঁসে বলে,

—“আমি জানি তুমি আমাকে চিনে ফেলেছো। এমনকি আমি এটাও জানি, তুমি আমার বিষয়ে সব জেনেও গেছো। তবে চিনে কোনো লাভ নেই। কারণ চিনেও তুমি আমাকে ধরতে পারবে না।”

—“তাই? তোমাকে চারিদিক থেকে পুলিশ ঘিরে ধরেছে।”

—“আমি তবুও পালাবো।”

সজীবের নজর আশেপাশে বিচরণ করছে। এই অন্ধকারেও কিছু একটা খুঁজছে সে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে অর্পন আরও সতর্ক হয়। গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“পালানোর আশা ছেড়ে দাও। আর পুলিশের কাছে আত্নসমর্পণ করো। তোমার সাথে একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছি তাই একটা সুযোগ দিলাম। চালাকি করলে আর কোনো দয়া দেখাবো না।”

সজীবের ঠোঁটে বাঁকা হাসি। ক্রুর হেসে বলে,

—“চালাকি তো করবোই অফিসার। আমি সেই সম্পর্ক মানি না।”

কথাটা বলেই পাশে পড়ে থাকা শুকনো ডাল তুলে অর্পনের দিকে ছুঁড়ে দেয়। সেকেন্ডের জন্য বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে অর্পন। এই সুযোগে পেছন দিকে দৌঁঁড়াতে থাকে সজীব। তবে বেশিদূর আগাতে পারে না। অর্পন দূর থেকে সজীবের ডান পায়ে নিশানা লাগিয়ে গুলি ছোড়ে। সঙ্গে সঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় সজীব। মুখ থেকে বের হয় অস্পষ্ট আর্তনাদ। অর্পন দৌড়ে কাছে চলে আসে। দুইহাত পেছনে দাঁড়িয়ে বলে,

—“অনেক মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিয়েছো। এবার বাকি জীবন জেলে কাটানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও।”

সজীব এখনও উপুড় হয়ে পড়ে আছে। না নড়চড় করছে আর না সোজা হচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপচাপ পড়ে থেকে হঠাৎ করেই অট্রহাসিতে ফেটে পড়ে। পাগলের মতো করে হাসতে থাকে। সজীবের এমন হাসি দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় অর্পন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তড়িৎ গতিতে সামনে ঘুরে ট্রিগার চেপে ধরে সজীব। বিকট শব্দে গুলি এসে লাগে অর্পনের ডান কাঁধে। পরপর আরও একটা গুলি চালায় অর্পনের বাম পায়ে।

মৃদু আর্তনাদ করে বসে পড়ে অর্পন। হাতের পিস্তল ছিটকে দূরে পড়ে যায়। কোনোরকমে উঠে দাঁড়ায় সজীব। হাসতে হাসতে বলে,

—“তুমি আমার কিছুই করতে পারবে না অফিসার। তবে আমি পারবো। তোমার থেকে সবকিছু কেড়ে নেবো। তোমার প্রাপ্তিকেও।”

এদিকে পরপর দু’টো গুলির শব্দ শুনে কনস্টেবল রহিম সহ বাকি পুলিশ অফিসারেরা চলে আসে এদিকে। বিপদ বুঝে পালিয়ে যায় সজীব। অর্পন তার ডান কাঁধ চেপে ধরে সেখানেই পড়ে থাকে। কাঁধ এবং পা থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। মিনিটের ব্যবধানে। সেখানে উপস্থিত হয় রহিম সহ বাকি সবাই। অর্পনকে আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে দৌঁড়ে চলে আসে তারা। রহিম বিচলিত কন্ঠে বলে,

—“স্যার এসব কিভাবে হলো? আপনি একা কেনো এসেছেন?”

সেই মুহুর্তে অর্পনের ফোন বেজে ওঠে। বাম হাতে ফোনটা বের করে অর্পন। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা যায় কারোর উৎফুল্ল কন্ঠ,

—“স্যার কাজ হয়ে গেছে। আমরা নিরাপদ দূরত্বে আছি।”

—“ওয়েল ডান! তোমরা জায়গা মতো চলে যাও। আমি আসছি।”

ফোনটা কেটে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে অর্পন। ঠোঁটে ফুটে ওঠে বিজয়ের হাসি। আহত অবস্থায় অর্পনকে হাসতে দেখে ভড়কে যায় সবাই। তাতে অর্পনের কোনো হেলদোল নেই। একটা বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে অর্পন বলে,

—“আমরা জিতে গেছি রহিম সাহেব। আমরা জিতে গেছি। প্রথম বিজয় আমাদের হয়েছে। দ্বিতীয় বিজয়ও আমাদেরই হবে।”

—“কিন্তু কিভাবে স্যার?”

কথায় মাঝেই আর্তনাদ করে ওঠে অর্পন। ব্যথায় পুরো শরীর বিষিয়ে উঠেছে। ক্লান্তিতে শরীর মুর্ছা যেতে চাইছে। এদিকে সূর্য উদিত হওয়ার পথে। ভোরের আকাশে হালকা আলো ফুটতে শুরু করেছে। ভোরের আবছা আলোয় অর্পনের ব্যথাতুর চেহারা দৃশ্যমান। ব্যথায় মুখটা নীল হয়ে গেছে। বহু কষ্টে অর্পন বলে,

—“ওই ট্রাকের ড্রাইভার আমার লোক ছিলো। মেয়েগুলো এখন পুলিশের হেফাজতে।”

বিস্মিত চোখে তাকায় রহিম। বাকিদেরও একই অবস্থা। রহিম বিস্মিত কন্ঠে বলে,

—“মানে? আপনি এই জন্য দেরি করছিলেন যাতে আপনার লোক মেয়েগুলোকে নিয়ে চলে যায়। তারপর আপনি আক্রমণ করেছেন।”

অর্পন শুধু উপর নিচ মাথা নাড়ে। এরপরই সবার দিকে নজর বুলিয়ে বলে

—“সবাই ধরা পরেছে?”

তৎক্ষনাৎ একজন কনস্টেবল জবাব দেয়,

—“শাহিন সবাইকে থানায় নিয়ে গেছে স্যার। শুধু ওদের বস ধরা পরেনি। সে আপনাকে আহত করে পালিয়ে গেছে।”

—“আমার অফিসারেরা সবাই ঠিক আছে?”

—“কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছে স্যার!”

রহিম মাথা নিচু করে জবাব দেয়। অর্পন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

—‘আপনি হসপিটালে চলে যান রহিম সাহেব। কারোর ট্রিটমেন্টে যেনো কোনো গাফিলতি না হয়। সাগর ভাইয়ের সাথে দেখা করে নিবেন। সে সব সামলে নেবে।”

—“আর আপনি? আপনিও চলুন। আপনার রক্ত পড়া বন্ধ করতে হবে স্যার।”

কনস্টেবল রহিমের কথা শুনে শান্ত চোখে তাকায় অর্পন। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। পরক্ষনেই আবার হেলে পড়ে যেতে লাগে। রহিম সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলে। অর্পন নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

—“আমাকে যেতে হবে রহিম সাহেব।”

—“কিন্তু কোথায় স্যার?”

—“একটা বিশেষ কাজে।”

—“কিন্তু………..”

—“আপনি সোজা হসপিটাল যাবেন রহিম সাহেব। আমি একটু পরেই আসছি। এটা আমার অর্ডার।”

রহিম আর তর্ক করার মতো ভাষা খুঁজে পায় না। গুলি লাগা পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে অর্পনের। তবুও ব্যথাটা হজম করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকে। মেইন রোডের কাছে আসতেই দেখতে পায় কেউ একজন ধীর পায়ে হেঁটে আসছে তার দিকে। অর্পনের থেকে প্রায় পনেরো বিশ হাত দূরে অবস্থান করছে সে। আগত ব্যক্তিকে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে অর্পনের। এটা সেই ব্যক্তি যার কছে অর্পন এখন যেতে চাইছিলো। নিজের আঘাতকেও তুচ্ছ করেছে এই ব্যক্তির জন্য। অস্ফুট স্বরে অর্পন ডাকে,

—“র..রনি স্যার!”

দূর থেকে রনি এগিয়ে আসছে। পুরো শরীরে তার মারের দাগ। এতোগুলা দিন সে ঠিক কতটা অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে সেটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ধীর পায়ে হেঁটে এসে সোজা অর্পনের সামনে এসে দাঁড়ায়। পেছন দিয়ে জিপ ছুটিয়ে চলে যায় বাকি অফিসারেরা। তারা আবছা অন্ধকারে রনিকে চিনতে পারেনি। এজন্য অর্পনের নির্দেশে থানায় ফিরে যায়। থেকে যায় শুধু রহিম। সে অর্পনকে রেখে কোথাও যাবে না। তবে এখানে যে রনির দেখা পাবে সেটা কল্পনাতেও ভাবেনি রহিম। বিস্ফরিত চোখে তাকিয়ে থাকে রনির দিকে।

রানি এগিয়ে এসে সোজা অর্পনের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। ডান হাত কপালে ঠেকিয়ে স্যালুট করে বলে,

—“স্যালুট অফিসার অর্পন। মেয়েগুলোকে আপনি বাঁচিয়েই নিলেন!”

—“সবই আপনার জন্য হয়েছে স্যার। আপনি আমাকে সাহায্য না করলে আমি এটা করতে পারতাম না।”

অর্পনের কথা শুনে হেঁসে ফেলে রনি। দুই হাতে জড়িয়ে ধরে অর্পনকে। হঠাৎ করেই তার কাশি শুরু হয়। দীর্ঘদিন নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া না করে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে রনি। সুস্থ সবল সেই অফিসার আজ রোগাক্রান্ত নির্জিব। কাশতে কাশতে মাঝ রাস্তায় বসে পড়ে রনি। নিস্তব্ধ জায়গায় তার কাশির আওয়াজ দ্বিগুণ জোরে শোনা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে আকাশে আলো ফুটতে শুরু করেছে। পূর্বের তুলনায় চারিপাশ এখন একটু বেশিই পরিস্কার। রাস্তায় নেই কোনো গাড়ির চিহ্ন। এই রাস্তাটা তুলনামূলক একটু বেশিই নির্জন। অপরাধীরা এজন্যই এই রাস্তা বেছে নিয়েছে নির্বিঘ্নে যাওয়ার জন্য।

নির্জন রাস্তায় বসে কাশতে কাশতে হাঁপিয়ে ওঠে রনি। অর্পন পাশে বসে পিঠে হালকা চাপড় দেয়। চিন্তিত তার চাহনি। রনি রহিমকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“একটু পানি হবে?”

কথাটা বলার সাথে সাথেই রহিম দৌড়ে চলে যায় গাড়ির কাছে। গাড়িতে রাখা পানির বোতল নিয়ে আসতে। রহিম ছুটে যেতেই বুকে হাত চেপে নিজেকে সামলায় রনি। অর্পনের দিকে তাকিয়ে থেমে থেমে বলে,

—“আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই অর্পন।”

—“আপনি অসুস্থ স্যার। আগে আমার সাথে হসপিটালে চলুন, তারপর সব শুনবো।”

—“তোমাকে কথাগুলো জানানো জরুরি।”

—“সবার আগে আপনার চিকিৎসা জরুরি।”

দু’জনের তর্কের মধ্যে অতি নিকটে একটা গাড়ির আওয়াজ শুনতে পায় অর্পন। তারা যেখানে বসে আছে সেখানে থেকে পাঁচ ছয় হাত দূরে একটা রাস্তার মোড় আছে। গাড়ির আওয়াজটা সেদিক থেকেই আসছে। সেদিকে তাকাতেই দেখতে পায় কাছাকাছি একটা হলুদ রঙের বড় ট্রাক চলে এসেছে। আহত শরীরে কাছাকাছি ট্রাক দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় অর্পন। পাথর হয়ে জমে যায় রনি। সরে যাওয়ার জন্য উঠতে যাবে ততক্ষণে ট্রাকটা দুজনের অতি নিকটে চলে আসে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিকটা আওয়াজে রাস্তা অতিক্রম করে চলে যায় বড় দানবীয় হলুদ রঙের ট্রাকটা। দুজনের তীব্র আর্তনাদ শুনে চমকে ওঠে রহিম। মুহুর্তেই চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে আসে। ফিরে পায় আবারও সেই চীরচেনা নিরবতা।

চলবে?

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ৩৬
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

পুরো বাড়ি জুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।আপনজনের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে বাড়ির আঙিনা। ছোট বড় সকলের বুক ফাটা আর্তনাদ কান ভেদ করে হৃদপিণ্ডে গিয়ে ঠেকছে। প্রকৃতি ভীষণ অস্থির। ভারি বর্ষনে ভিজে জুবুথুবু হয়ে গেছে চারিপাশ। খান বাড়ির ভেতরের অবস্থা আরও বেশি ভয়ানক। প্রকৃতির ভয়ানক তান্ডবের চেয়েও অধিক উত্তাল খান বাড়ির পরিবেশ। কান্নার আওয়াজ প্রতিটা দেয়ালে আঘাত করে তীব্র রুপ ধারণ করছে। বাড়ির লনে রাখা হয়েছে একটা লা*শ। সাদা কাপছে আপাদমস্তক মুড়ে রাখা। তাকে ঘিরেই সকলের কান্নার আসর বসেছে।

একাধিক মানুষের কান্নার আওয়াজ শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে প্রাপ্তি। বুকের ভেতর বিকট শব্দে দামামা বাজছে। ক্ষনে ক্ষনে হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠছে। জানান দিচ্ছে কোনো অসনি সংকেতের। দুরুদুরু পায়ে হেঁটে লনের সীমানায় এসে দাঁড়ায় প্রাপ্তি। চোখ দুটো তার স্থীর মেঝেতে। কেউ একজন শুয়ে আছে সেখানে। আপাদমস্তক সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখায় মুখটা দেখা যাচ্ছে না। পাশেই সন্ধ্যা বেগম বসে আছেন। হাত পা ছুটে কান্না করছেন তিনি। মুখ থেকে বের হচ্ছে এক একটা ব্যথাতুর আর্তনাদ।

শ্বাশুড়িকে এমন করুন সুরে কান্না করতে দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে প্রাপ্তির। দুই চোখে অশ্রু কণা এসে ভীড় জমায়। যে কোনো মুহুর্তে গড়িয়ে পড়বে কপল বেয়ে। এতোক্ষণে বাড়ির পরিবেশ কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে প্রাপ্তি। ভয়ে কাঁপছে বুক। প্রাপ্তির ভেতরে বয়ে চলা ঝড় প্রকৃতির ঝড়ের সাথে তুমুল আকার ধারণ করেছে। হঠাৎ করেই দমকা হাওয়া বইতে শুরু করে। বাতাসের তীব্র ঝাপটায় ঢেকে রাখা মুখটা সকলের সামনে উন্মুক্ত হয়। ভেসে ওঠে অর্পনের নিথর নিস্প্রাণ মুখ। পায়ের তলায় মাটি কেঁপে ওঠে প্রাপ্তির। আকুল ভরা কন্ঠের তীব্র চিৎকারে কাঁপিয়ে তোলে খান বাড়ির আঙিনা।

ঘুমের মধ্যেই তীব্র চিৎকার করে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে প্রাপ্তি। পুরো শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে। কপাল চুইয়ে চুইয়ে ঘাম ঝরছে। অতিরিক্ত ভয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ে। সবকিছু বুঝে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লাগে প্রাপ্তির। সে এতোক্ষণ ধরে স্বপ্ন দেখেছিলো বুঝতেই দুই হাতে মুখ চেপে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেলে। মুখ থেকে বের হয় অস্পষ্ট আর্তনাদ। ওটা একদমই স্বপ্ন মনে হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল সবকিছু বাস্তব। একদম চোখের সামনে ঘটছে সকল ঘটনা।

অর্পনের প্রতি এক পাহাড় সমান অভিমান জমে প্রাপ্তির বুকে। সে কেনো আজ কাজে গেলো? আজকের জন্য কি ছুটি নেয়া যেতো না? অভিমানেরা তরতর করে বাড়তে থাকে। হঠাৎ করেই কিছু অজানা প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে প্রাপ্তির। অর্পন এখন কোথায়? কোথায় গেছে সে? সুস্থ আছে তো? হঠাৎ এই খারাপ স্বপ্ন কেনো দেখা দিলো? এটা কি কোনো সংকেত ছিলো?

ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে প্রাপ্তির। অভিমানেরা হাওয়ায় মিশে ধূলিসাৎ হয়ে যায় তৎক্ষনাৎ। উপর দিয়ে একরাশ চিন্তা এসে ভর করে মস্তিষ্কে। তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায় প্রাপ্তি। কদম গুনে গুনে বেলকনিতে চলে আসে। বোঝার চেষ্টা করে এখন রাত নাকি সকাল। কিন্তু বুঝতে পারে না। হঠাৎ মনে পড়ে অর্পন এই ঘরটা প্রাপ্তির ঘরের মতো করে সাজিয়েছে। আর প্রাপ্তির ঘরে সময় বোঝার জন্য বড় একটা ঘড়ি আছে। তাহলে এই ঘরেও নিশ্চয়ই এমন কোনো ঘড়ি রেখেছে অর্পন।

কথাগুলো ভেবেই তড়িঘড়ি করে ঘরে ফিরে আছে প্রাপ্তি। ঘরে ফেরার পথে অসাবধানতা বসত সোফার পায়ার সাথে বারি লেগে ডান পায়ের বৃদ্ধ আঙ্গুলে প্রচন্ড ব্যথা পায়। তবে ব্যথার পরোয়া করে না সে। ক্ষিপ্র গতিতে ঘরে প্রবেশ করে ডান দিকের দেয়াল হাতড়াতে থাকে। পেয়েও যায় সেই কাঙ্ক্ষিত ঘড়ি। ঘড়ির কাটা ছুটে প্রাপ্তি বুঝতে পারে ঘড়ির কাটা ছয়টা পঁচিশে বিচরণ করছে। এর মানে সকাল সাড়ে ছয়টা। অর্পন যাওয়ার অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। তাহলে অর্পন এখনো ফিরলো না কেনো?

চিন্তিত প্রাপ্তি তাড়াহুড়ো পায়ে নিচে নেমে আসে। অচেনা বাড়িতে চলাচল করতে বেশ বেগ পেতে হয় প্রাপ্তিকে। কোনো রকম হাতড়ে হাতড়ে নেমে আসে দোতলা থেকে নিচে। প্রাপ্তির কদম বেসামাল। পায়ের গতি তার নিয়ন্ত্রণে নেই। শেষ সিঁড়িতে নেমে কয়েক কদম এগোতেই পাপোসের সাথে পা বেঝে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় ফ্লোরে।

সন্ধ্যা বেগম আর সুভাষ সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে সোফায় বসে ছিলেন। তাদের চোখ মুখের অবস্থা একদম ভালো না। অপর পাশের সোফায় সুপ্তি বসে আছে। চোখ দুটো তার লাল। এমন সময় হঠাৎ কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে সকলেই পিছনে ঘুরে তাকায়। প্রাপ্তিকে ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে ভড়কে যায় সকলেই। সবার আগে ছুটে চলে আসে সুপ্তি। টেনে তুলে দাঁড় করায় প্রাপ্তিকে। পেছন পেছন আসেন সুভাষ সাহেব আর সন্ধ্যা বেগম। সুপ্তির ভাঙা কন্ঠে বলে,

—“আপি… পড়লে কিভাবে? কোথায় লেগেছে দেখাও।”

প্রাপ্তির সেদিকে কোনো হেলদোল নেই। সে বিচলিত কন্ঠে বলে,

—“অফিসার কোথায়? সুপ্তি অফিসার কোথায়? সে বাড়ি ফেরেনি? একটু ফোন কর তো তার নাম্বারে। একবার কথা বলবো আমি।”

সুপ্তি নিরুত্তর। ঝরঝর করে চোখ থেকে অশ্রুকণা ঝড়ে পড়ছে। সুপ্তিকে চুপ থাকতে দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে প্রাপ্তি। চিৎকার করে বলে,

—“আমি তোকে কিছু বলেছি সুপ্তি। কথা শুনছিস না কেনো? ফোন কর তার নাম্বারে। আমি খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। ওনার সাথে কথা না বলা পর্যন্ত শান্তি পাবো না। প্লিজ একবার ফোন কর। শুধু এক মিনিটের জন্য। তার আওয়াজটা শুনেই কেটে দেবো।”

এই পর্যায়ে সন্ধ্যা বেগম হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। আঁচলে মুখ চেপে আপ্রান চেষ্টা করেন কান্না থামানোর। সুভাষ সাহেবের চোখও ছলছল করছে। তিনি স্ত্রীকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিচ্ছেন। এদিকে সকলের এমন অদ্ভুত আচরণে গভীর ভয় জেঁকে বসে প্রাপ্তির মনে। সবাই এভাবে কাঁদছে কেনো? অর্পন ঠিক আছে তো? গলা কাঁপছে প্রাপ্তির। মাথাটাও ঘুরছে। সেটা কি পায়ের ব্যথায় নাকি অজানা আশঙ্কায়, তা জানে না প্রাপ্তি। সুপ্তির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

—“কি হয়েছে সুপ্তি?”

—“অর্পন ভাইয়ার এ*ক্সি*ডে*ন্ট হয়েছে আপি। সে এখন হাসপাতালে। সে কথা বলবে কিভাবে বলো? আমরা এই মাত্র খবর পেয়েছি। আঙ্কেল আন্টি সেখানে যাওয়ার জন্য বসে আছেন। ডক্টর অঙ্কন আসতে সবাইকে নিতে।”

প্রাপ্তি যেনো পাথর হয়ে গেছে। একদম বোধ জ্ঞানহীন মনে হচ্ছে তাকে। বুদ্ধি লোপ পেয়েছে যেনো। সুপ্তির কথা তার মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারছে না। বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব করেছে।

এরই মাঝে সেখানে উপস্থিত হয় অঙ্কন। সুভাষ সাহেব আর সন্ধ্যা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“বাবা মা তাড়াতাড়ি চলো। ভাইকে ইমিডিয়েটলি ব্লাড দিতে হবে। দেরি করা যাবে না।”

এতোক্ষনে টনক নড়ে প্রাপ্তির। তড়িঘড়ি করে বলে,

—“অঙ্কন ভাইয়া, কেমন আছে অফিসার? আমি তার কাছে যাবো। আমাকে নিয়ে চলুন প্লিজ। প্লিজ না করবেন না।”

এই মুহুর্তে প্রাপ্তিকে দেখে কিছুটা ভড়কে যায় অঙ্কন। কি বলবে না বলবে সেটা নিয়ে দোটানায় পড়ে যায়। তবে প্রাপ্তির করুন সুরে আকুতি ফেলতে পারে না কোনোভাবেই। তাই অগত্যাই বাবা মায়ের সাথে প্রাপ্তি আর সুপ্তিকেও নিয়ে যায়।

—————————-

নিজের ঘরে খাটের ওপর আধশোয়া হয়ে বসে আছে সজীব। একজন নার্স তার পায়ের গুলি বের করে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। ব্যথায় চোখ মুখ নীল বর্ণ ধারণ করেছে সজীবের। পাশেই বসে আছেন রাবেয়া বেগম। থেকে থেকে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। সজীব ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকালেই তিনি নার্সকে ধমক দিয়ে বলছেন,

—“আস্তে করো। ব্যথা পাচ্ছে আমার ছেলে।”

সজীবের সেদিকে কোনো হেলদোল নেই। তার মন মস্তিষ্ক পড়ে আছে পাশের ঘরে। সেখান থেকে অনবরত জিনিসপত্র ভাঙচুরের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ভাঙচুরের আওয়াজ যখন মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে চলে যায় তখন সজীব অধৈর্য কন্ঠে বলে,

—“কি তামাশা শুরু হয়েছে আম্মা? আবার কেনো এমন করছে?”

—“প্রাপ্তির বিয়ের কথা শুনেছে কোনোভাবে। তারপর থেকেই এমন ভাঙচুর করছে।”

—“আপনি থামাচ্ছেন না কেনো?”

—“সে কি আমার কথা শোনে?”

রাবেয়া বেগমের কন্ঠে বিরক্তি। ততক্ষণে পায়ের ব্যান্ডেজ করা শেষ হয়ে যায়। উপায় না পেয়ে উঠে দাঁড়ায় সজীব। নার্স মানা করতে যাবে তার আগেই সজীব খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলে যায় ঘর থেকে। পেছন পেছন চিন্তিত ভঙ্গিতে ছুটে যান রাবেয়া বেগম। শানের ঘরের দড়জা খুলতেই একটা কাচের গ্লাস ছুটে আসে দড়জার দিকে। পাশ কাটিয়ে প্রতিরক্ষা করে সজীব। শানকে দুই হাতে জাপ্টে ধরে বলে,

—“শান্ত হ ভাই! পাগলামি কেনো করছিস?”

—“প্রাপ্তির বিয়ে হয়ে গেছে ভাই? কিভাবে হলো? আমার সাথে এতো বড় ধোঁকা? আমি সব শেষ করে দেবো।”

শানের কন্ঠে স্পষ্ট ক্রোধ। ক্রোধ সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে তার জন্য। সজীব আরও শক্ত করে চেপে ধরে শানকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

—“শান্ত হয়ে যা। আমি সব সামলে নেবো। প্রাপ্তি তোরই হবে। পথে যে আসবে আমি তাকেই সরিয়ে দেবো।”

—“তুমি মিথ্যে বলছো ভাই। তুমি এমন কিছুই করবে না, আমি জানি।”

—“অলরেডি করে ফেলেছি। প্রাপ্তির হাসবেন্ডকে বড় ট্রাক দিয়ে পিষে রেখে এসেছি। বাঁচবে কি না সন্দেহ। ও ম*র*লে*ই প্রাপ্তি তোর হবে।”

এই পর্যায়ে থেমে যায় শান। একদম শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। শানকে শান্ত হতে দেখে ছেড়ে দেয় সজীব। দুকদম পিছিয়ে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। শানকে রেখে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। সোজা নিজের ঘরে গিয়ে খাটের ওপর বসে। মাথা নিচু করে রেখে গভীর চিন্তায় ডুবে যায়।

রাবেয়া বেগম আসেন মিনিট পাঁচেক পর। সজীবের পাশে বসে চিন্তিত কন্ঠে বলেন,

—“শানের পাগলামি দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। সামলাই কিভাবে বল তো? ওকে কি এখন পাগল গারদে রেখে আসা উচিত?”

সজীব নিরুত্তর। চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে। দৃষ্টি তার পায়ের কাছের মেঝের দিকে থাকলেও মনোযোগ অন্য কোনো দিকে। শানের বিষয়ে কথা বলার পরও কোনো উত্তর না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকান রাবেয়া বেগম। সজীবের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে নরম কন্ঠে বলেন,

—“কি হয়েছে সজীব? তুই কি অন্য কিছু ভাবছিস?”

—“আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে অর্পন আমাকে ইচ্ছে করে ছেড়ে দিয়েছে।”

অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দেয় সজীব। তার কথায় কুঁচকানো ভ্রুদ্বয় আরও বেশি কুঁচকে যায় রাবেয়া বেগমের। কৌতুহলী কন্ঠে বলেন,

—“মানে?”

—“প্রথমত, অর্পন একা এসেছিলো আমার সাথে লড়তে। যেখানে তার সাথে পুরো পুলিশ ফোর্স ছিলো। তাহলে সে অন্য কাউকে সাথে না এনে একা কেনো আসলো? দ্বিতীয়ত তার হাতে অস্ত্র ছিলো। আমাকে পালাতে দেখে সে আমাকে এক গুলিতে মেরে ফেলতে পারতো। তার নিশানা অনেক ভালো। সোজা মাথায় টার্গেট করে শ্যুট করলেই আমি সেখানেই ম*রে যেতাম। তা না করে সে আমার পায়ে গুলি করে আমার গতি প্রতিরোধ করে। এখানে আমাকে মেরে ফেলা ওর উদ্দেশ্য ছিলো না। তৃতীয়ত এবং শেষ, আমি যখন অর্পনকে গুলি করে পালাই তখনও অর্পন আমাকে মারার মতো কোনো কাজ করেনি। সে তো এতটাও দুর্বল নয় যে সামান্য গুলি তাকে কাবু করবে। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই সবকিছু হয়েছে আমাদের দুজনের মধ্যে। বাকি পুলিশদের কেউই এই দিকে আসেনি। কিন্তু কেনো? কি কারণ আছে এই সবকিছুর পেছনে?”

সজীবের কথাশুনে চিন্তায় মগ্ন হয়ে যান রাবেয়া বেগম। আসলেই তো। অর্পন কেনো সজীবকে ছেড়ে দিলো? যেখানে সজীবের সকল অপকর্ম অর্পনের সামনে প্রকাশ পেয়েছে। সেখানে হাতে নাতে ধরেও কেনো ছেড়ে দিলো? কি কারণ হতে পারে এর পেছনে?

—————————-

হসপিটালের সারি সারি চেয়ারে পাথরের মতো বসে আছে প্রাপ্তি। মাথাটা এলিয়ে দিয়ে রেখেছে পাশে বসা সুপ্তির কাঁধে। সুপ্তি এক হাতে জড়িয়ে রেখেছে প্রাপ্তিকে। সন্ধ্যা বেগম আর সুভাষ সাহেব অপর পাশে বসে আছেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে মারুফ সাহেব, দিলারা বেগম আর দীপ্তি চলে আসে। উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে প্রাপ্তির কাছে এসে হাঁটু মুড়ে বসে দীপ্তি। প্রাপ্তির মুখটা দুই হাতের আঁজলায় নিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,

—“ঠিক আছিস তুই? অর্পন কেমন আছে?”

বোনের আদুরে কন্ঠ শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে প্রাপ্তি। আটকে রাখা কান্নারা আবারও বেরিয়ে আসে। কষ্টে বুকের ভেতর মুচড়ে উঠছে প্রাপ্তির। কিন্তু সে কাউকে দেখাতে পারছে না। চোখের দৃষ্টি শক্তি হারানোর পর থেকে তার পুরো পৃথিবী অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। তার রাজ্য হয়ে উঠে রঙহীন, শুধুই কালো। সেই রঙহীন অন্ধকার জীবনে এক টুকরো আলোর রশ্মি হয়ে আগমন ঘটে অর্পনের। দৃষ্টিহীন প্রাপ্তির দিকে নিজের বিশ্বস্ত ভরসার হাত বাড়িয়ে দেয়। অর্পনের আলোয় নিজের অন্ধকার পৃথিবী আলোকিত করতে চায় প্রাপ্তি। তার হাতে হাত রেখে বহুদূর যেতে চায়। শেষ বয়স পর্যন্ত দু’জন একসাথে কাটাতে চায়। কিন্তু হঠাৎ করে এ কি হলো? প্রাপ্তির জীবন আলোকিত হওয়ার আগেই আবারও অন্ধকারে তলিয়ে গেলো। প্রিয় মানুষের আঘাত নিজের ওপর ঠিক কতটা প্রভাব ফেলে, তা এখন বেশ বুঝতে পারছে প্রাপ্তি। কোনো কথা না বলে শুধু হুহু করে কেঁদে যায় সে।

কিছুক্ষণ পর দিদার সাহেব উপস্থিত হন হসপিটালে। খবরটা শোনামাত্রই তড়িৎ গতিতে ছুটে চলে এসেছেন। তিনি এসে মাত্রই মারুফ সাহেবের পাশে দাঁড়ান। ঠিক সেই মুহুর্তে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে সাগর। তার পেছন পেছন বের হয় অঙ্কন। ওদের দেখে সকলেই উঠে দাঁড়ায়। সুভাষ সাহেব চিন্তিত স্বরে বলেন,

—“অর্পন কেমন আছে সাগর?”

—“এখন বিপদ মুক্ত মামা। তবে পুরোপুরি সুস্থ নয়। পায়ে খুব বাজে ভাবে আঘাত পেয়েছে। পুরো শরীরে আরও অনেক জায়গায় আঘাত পেয়েছে, তবে তা গুরুতর নয়। পায়ের আঘাতটাই সবচেয়ে বেশি। বেশ লম্বা সময় বেড রেস্টে থাকতে হবে।”

সাগরের ঠান্ডা গলায় শান্তনা মূলক বাক্য শুনে সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। যেনো দেহে প্রাণ ফিরে পেলো সকলে। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই দিদার সাহেব বলেন,

—“আর রনি? মানে অর্পনের সাথে যে আরও একটা ছেলে ছিলো তার কি অবস্থা? সে সুস্থ আছে তো?”

এই পর্যায়ে সাগরের চেহারার পরিবর্তন ঘটে। মুখটা হঠাৎ করেই শুকিয়ে যায়। সকলে ততক্ষণে বুঝে যায় কিছু একটা খারাপ হয়েছে। সাগরকে চুপ থাকতে দেখে অঙ্কন বলে,

—“ওনার অবস্থা খুব একটা ভালো নয় স্যার। উনি মাথায় বেশি আঘাত পেয়েছেন। বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে তিনি কোমায় চলে যাবেন। তার বিষয়ে এখনই শিওর দিয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। কেসটা খুবই ক্রিটিক্যাল। সময় লাগবে।”

অঙ্কনের কথা শুনে চেহারায় আধার নেমে আসে দিদার সাহেবের। অর্পনের সুস্থতায় যতটা না খুশি হয়েছেন, তারচেয়ে বেশী রনির জন্য কষ্ট হচ্ছে। তবে কি একজন দক্ষ অফিসারকে চিরতরে হারাতে হবে?

চলবে?