তারে আমি চোখে দেখিনি পর্ব-৩৭+৩৮

0
101

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ৩৭
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

অর্পনের জ্ঞান ফেরে দিন পেরিয়ে সন্ধ্যার পর। চোখ মেলতেই নিজের চারপাশে পরিবারের সকল সদস্যদের দেখতে পায় অর্পন। কয়েক সেকেন্ড সেভাবেই চুপচাপ শুয়ে সবকিছু বোঝার চেষ্টা করে। জ্ঞান হারানোর আগের সকল কথা মনে পড়তেই বিচলিত হয়ে পড়ে অর্পন। চোখের সামনে রনির মুখটা ভেসে ওঠে। রনি কোথায়? সে ঠিক আছে তো? চিন্তায় মন আনচান করে ওঠে অর্পনের।

অর্পনকে বিচলিত হতে দেখে পাশ থেকে তার বাম হাতটা খপ করে ধরে ফেলে অঙ্কন। ক্যানুলা লাগানো হাতটা টান লেগে রক্ত উঠে গেছে। অঙ্কন চিন্তিত স্বরে বলে,

—“ভাই কি করছো? রক্ত চলে আসছে তো। থামো প্লিজ। তুমি অসুস্থ্য।”

অর্পন যেনো শুনেও শুনলো না। আরো বেশি অস্থির হয়ে ওঠে। তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়ে পায়ের ব্যথায় চোখ মুখ খিঁচে ফেলে। ব্যন্ডেজ করা পা নড়াতেই শরীরের শিরা উপশিরা যেনো ব্যথায় চিনচিন করে উঠছে। অঙ্কন ধরে সাবধানে বসিয়ে দেয়। পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে নিজেও পাশে বসে পড়ে। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সয়ে নেয় অর্পন। ধীরে ধীরে লাল হয়ে আসা চোখ মেলে তাকায়। ভাঙা কন্ঠে বলে,

—“আমাকে হসপিটালে কে নিয়ে এসেছে? আর রনি স্যার কোথায়? সে ঠিক আছে তো?”

—“তোমাদের দুজনকে রহিম সাহেব নিয়ে এসেছে ভাই। আর রনি স্যারও এখানেই আছেন। ঠিক আছেন। তুমি শান্ত হও।”

শেষের কথাটা মিথ্যা বলে অঙ্কন। রনির অবস্থার কথা জানিয়ে অর্পনকে আরও বিচলিত করতে চায় না সে। এতে অর্পনের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে।

অঙ্কনের মিথ্যেকে খুব সহজেই বিশ্বাস করে নেয় অর্পন। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে চারপাশে চোখ বুলায়। সবার প্রথমে নজরে আসে নিজের পাশে বসে থাকা সন্ধ্যা বেগম। তিনি অশ্রুশীক্ত নয়নে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। কিন্তু মুখে কিছু বলেন না। অপর পাশে সুভাষ সাহেব শুকনো মুখে দাড়িয়ে আছেন। অর্পনের সাথে চোখ মিলতেই একটা মলিন হাসি উপহার দেন। ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

—“এখন কেমন লাগছে?”

—“ভালো।”

অর্পনের ছোট্ট জবাব। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সুভাষ সাহেবের। ছেলের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে বলেন,

—“কি দরকার এসব ঝুঁকি নেয়ার? নিজের প্রাণের মায়া না থাকলেও আমাদের কথা তো একবার ভাববি। তোর কিছু হয়ে গেলে আমাদের কি হবে?”

অর্পন নিরুত্তর। তার ভারি হয়ে আসা চোখ জোড়া ব্যাকুল দেখাচ্ছে। ব্যাকুল নয়নে আশেপাশে কাউকে খুঁজতে থাকে অর্পন। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে পেয়েও যায়। প্রাপ্তি দুরের ছোট্ট সোফায় চুপচাপ বসে আছে। কান্নার ফলে চোখ দুটো ফুলে গেছে। চুলগুলো এলোমেলো। চেহারা পুরো বিধ্বস্ত হয়ে আছে। প্রিয় মানুষটার এমন বিধ্বংসী চেহারা দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে অর্পনের। শ্বাস নিতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছে করছে দৌড়ে প্রাপ্তির কাছে চলে যেতে। দুই হাতে আগলে বুকে জড়িয়ে নিতে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ভরসা দিতে, “আমি ঠিক আছি প্রাপ্তি। তুমি চিন্তা করো না” পরক্ষনেই নিজের ব্যন্ডেজ করা পায়ের দিকে তাকিয়ে হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়ে অর্পন। চাইলেও তো উঠে দাঁড়াতে পারবে না। এই মুহুর্তে অপারগ সে।

ছেলের ব্যাকুল চোখের চাহনি দেখে সবটা যেনো বুঝে যান সন্ধ্যা বেগম। কাল বিলম্ব না করে তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়ান। সুভাষ সাহেবকে কিছু একটা ইশারা করতেই দু’জনেই নিঃশব্দে সেখান থেকে চলে যান। একে একে সকলে সেখান থেকে প্রস্থান নেয়।

সুপ্তি ছিলো প্রাপ্তির পাশে দাড়িয়ে। সবাইকে চলে যেতে দেখে সে প্রাপ্তির হাতটা আলতো করে ধরে। ধীরে সুস্থে অর্পনের পাশের ছোট টুলে বসিয়ে দেয় প্রাপ্তিকে। কাঠের পুতুলের মতো সুপ্তির সাথে তালে তাল মেলায় প্রাপ্তি। ছোট্ট টুলটাতে বসে মাথা নিচু করে ফেলে। পায়ের শব্দে বুঝতে পারে সুপ্তি চলে গেছে। তবে মাথা তুলে তাকায় না সে।

পুরো কক্ষ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে পিনপতন নীরবতা। কারোর মুখেই কোনো কথা নেই। দুজনের শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। সন্ধ্যার শীতল হাওয়া জানালার পর্দা ভেদ করে কক্ষে এসে ছড়িয়ে পড়ছে। শীতলতায় ডুবে যায় কক্ষ। নিরবতা ভেঙে অর্পন ভাঙা কন্ঠে বলে,

—“অ…অভিমান হয়েছে? আমি তো বলেছিলাম ফিরে আসবো। ক্ষত বা অক্ষত, যে-কোনো অবস্থায় ফিরে আসবো। আমি তো কথা রেখেছি। তাহলে এতো অভিমান কিসের?”

প্রাপ্তি নিরুত্তর। মাথা পূর্বের তুলনায় আরও বেশি নিচু করে ফেলে। নিঃশ্বাসের বেগ হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। হাতের ওপর টুপটাপ অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়ে। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। গলাটা কেউ যেনো শক্ত করে চেপে ধরেছে। ধরা গলায় বহু কষ্টে থেমে থেমে বলে,

—“কিন্তু এভাবে ফিরে আসুন সেটা তো চাইনি অফিসার। যেমন সুস্থ অবস্থায় গেছিলেন, তেমন সুস্থ অবস্থায় ফেরত চেয়েছিলাম।”

—“ফিরে তো এসেছি।”

—“কিন্তু অসুস্থ হয়ে।”

প্রাপ্তির কান্নারত মলিন চেহারা দেখে অর্পনের বুকটা ধ্বক করে ওঠে। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। প্রাপ্তিকে সান্তনা দিতে কিছু বলবে এমন সময় নজর যায় প্রাপ্তির পায়ের দিকে। ডান পায়ের বৃদ্ধ আঙুলের নখ উপড়ে আছে। রক্ত জমাট বেঁধে আঙুল সহ পায়ের কিছু কিছু জায়গা লাল হয়ে গেছে। এই মুহুর্তে এহেন ঘটনার জন্য অর্পন একদমই প্রস্তুত ছিলো না। কিছুক্ষণের জন্য থ মেরে বসে থাকে। ঘটনাটা মস্তিষ্কে বোধগম্য হতেই চেঁচিয়ে ওঠে অর্পন। বিচলিত কন্ঠে বলে,

—“পায়ে কি হয়েছে তোমার? নখ উপড়ে গেছে কিভাবে? প্রাপ্তি জবাব দাও।”

অর্পনের মুখে হঠাৎ এহেন প্রশ্ন শুনে ভড়কে যায় প্রাপ্তি। প্রশ্নের অর্থ বুঝতে বেশ কিছুটা সময় লাগে তার। পায়ের কথা খেয়াল হতেই মনে পড়ে বেলকনি থেকে রুমে আসার সময় সোফায় পায়ার সাথে আঘাত লাগার কথা। অর্পনের চিন্তায় ব্যথা বেমালুম ভুলে গেছিলো প্রাপ্তি। এতোক্ষণে ব্যথাটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সেই সাথে বাম হাতের কনুই তেও জ্বালাপোড়া অনুভব করে। তবে অর্পনকে তা বুঝতে দেয় না। তড়িঘড়ি করে বলে,

—“অফিসার আপনি শান্ত হন। আমি ঠিক আছি।”

—“এটাকে ঠিক থাকা বলে? কিভাবে হলো এসব?”

—“ভুল বসত লেগে গেছে। তেমন কিছু হয়নি।”

—“নখ উপড়ে গেছে প্রাপ্তি! তবুও বলছো কিছু হয়নি। অঙ্কন এদিকে আয় তো।”

হঠাৎ করেই অর্পনের উচ্চ কন্ঠের ডাক শুনে রুমে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে অঙ্কন। পেছন পেছন আসে রুবিয়া। অঙ্কন আসতেই অর্পন বিচলিত কন্ঠে বলে,

—“ওর পায়ে আঘাত লাগলো কিভাবে? একটু দেখ তো অঙ্কন।”

অঙ্কন ভ্রু কুঁচকে তাকায় প্রাপ্তির দিকে। প্রাপ্তি এতোক্ষণ ধরে এখানে আছে, অথচ কেউ এটা খেয়ালই করেনি। হাঁটু ভাজ করে বসে প্রাপ্তির পা আলতো করে তুলে দেখে অঙ্কন। বেশ ভালোই আঘাত পেয়েছে। তবুও একটু টু শব্দও করেনি। মেয়ে মানুষ এতোটা শক্ত হয় কিভাবে? ভেবে পায় না অঙ্কন। প্রাপ্তির পা টা নেড়ে চেড়ে দেখে চিন্তিত স্বরে বলে,

—“আমাকে আগে জানাও নি কেনো ভাবি? একটা নখ উপড়ে গেছে। একটুও কি কষ্ট হচ্ছে না? এভাবে ক্ষত জায়গা আলগা রাখলে ইনফেকশন হতে পারে। আর কোথাও লেগেছে কি? দেখি, আমার সাথে চলো।”

অনিচ্ছার স্বত্বেও অঙ্কনের সাথে যেতে হয় প্রাপ্তিকে। তবে মন পড়ে থাকে অর্পনের কাছে। এতো বড় দুর্ঘটনার পর এখন আর অর্পনকে একা ছাড়তে মন সায় দিচ্ছে না। ভয় কাজ করছে। যদি অর্পন আবার কোথাও যায়! আবার যদি কোনো বিপদ হয়! ভাবতেই গা শিউরে ওঠে প্রাপ্তির। অনিচ্ছা নিয়েই উসখুস করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

অর্পন ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে আছে দড়জার দিকে। নিজের আঘাতেও এতোটা ব্যথা লাগেনি যতটা প্রাপ্তির আঘাতে অর্পন অনুভব করছে। এই ছোট্ট আঘাতটাও অর্পনের কাছে পাহাড় সমান মনে হচ্ছে। হয়তো একেই বলে ভালোবাসা। এটাই বুঝি আত্মার টান।

প্রাপ্তি চলে যেতেই পাশ থেকে অর্পনের কান টেনে ধরে রুবিয়া। রাগী কন্ঠে বলে,

—“বাদর ছেলে। তুই আর ভালো হবি না তাই না? আগেও বাদর ছিলি, এখনও তাই আছিস।”

কানে টান লাগায় চোখ বন্ধ করে ফেলে অর্পন। তড়িঘড়ি করে বলে,

—“পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিলো কি, কাকি?”

এই পর্যায়ে কানটা আরও জোরে টেনে ধরে রুবিয়া। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

—“অবশ্যই পরিবর্তন হওয়ার কথা ছিলো। আগে একা ছিলি, বেপরোয়া আচরণ করতি। তাই বিয়ে করিয়ে দিলাম, যাতে বৌয়ের টানে ঘরমুখো হোস। তবুও তোর উন্নতি দেখি না।”

—“বৌয়ের কাছে যাওয়ার সুযোগ পেলাম কই, যে টান অনুভব হবে।”

—“তুই একটা অসভ্য!”

চোখ মুখ কুঁচকে কথাটা বলেই কান ছেড়ে দেয় রুবিয়া। তার অপ্রস্তুত মুখের দিকে তাকিয়ে হেঁসে ফেলে অর্পন। রোগাক্রান্ত শুকনো মুখে প্রণোচ্ছল হাসি। অর্পনকে হাসতে দেখে রাগ লাগে রুবিয়ার। দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

—“এমন হাসছিস কেনো শুনি? বিশ্ব জয় করে এসেছিস? যে হাসি থামছে না।”

—“কোনো সন্দেহ আছে?”

—“অবশ্যই আছে। তোর মতে যেটাকে বিশ্ব জয় করা বলে, আমার মতে সেটা বোকামি। তুই কেনো বুঝিস না অর্পন? এতোদিন একা ছিলি, কিন্তু এখন তুই একা নয়। একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে এনেছিস তুই। মেয়েটার জীবন তোর সাথে জুড়ে গেছে। আর কারোর কথা না হোক অন্তত মেয়েটার কথা তো ভাব। তোর কিছু হয়ে গেলে প্রাপ্তির কি হবে? সে তো তোর ভরসা তেই, তোর হাত ধরেই শ্বশুর বাড়ি এসেছে।”

অর্পনের হাসিখুশি মুখটা এই পর্যায়ে মলিন হয়ে যায়। এমনটা নয় যে, সে প্রাপ্তিকে নিয়ে চিন্তা করে না। বরং প্রাপ্তির চিন্তা অর্পনেরই বেশি। তবে তার জন্য নিজের দায়িত্ব থেকে তো দুরে সরতে পারে না। পুলিশদের জীবনটাই যে এমন। ঝুকিপূর্ণ, অনিশ্চিত, ভরসাহীন। মৃত্যু যে কোনো সময়, যে কোনো দিক থেকে চলে আসতে পারে। তাই বলে কি দায়িত্ব ভুলে যাবে? সেটা তো সম্ভব নয়। রুবিয়ার দিকে শান্ত চোখে তাকায় অর্পন। মলিন কন্ঠে বলে,

—“তোমরা আছো কি করতে? আমার কিছু হলে তোমরা ওকে দেখে রাখবে। আমার একটা বৌয়ের খরচ চালাতে পারবে না?”

রাগ হয় রুবিয়ার। অর্পনের এই সব উল্টো পাল্টা কথার সাথে সে পূর্ব পরিচিত। তবুও আজকের কথা প্রচন্ড তিক্ত লাগছে। রুবিয়া রাগী কন্ঠে জবাব দেয়,

—“বাজে বকা বন্ধ কর অর্পন। শুধু খাওয়া পড়াই সব নয়। একটা মেয়ে ডাল ভাত খেয়ে গাছের নিচেও জীবন কাটাতে পারে। যদি তার স্বামী তার সাথে থাকে। তুই না থাকলে এতো টাকা পয়সা, বিলাসিতা দিয়ে কি করবে প্রাপ্তি?”

অর্পন নিরুত্তর। তর্ক বাড়ানোর মতো আর কোনো শব্দ তার শব্দভান্ডারে নেই। নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়ে অর্পন। সে তো সাহসী। মৃত্যুর ভয় কখনো পায়নি। তবে আজ ভয় পাচ্ছে। আজ খুব করে চাইছে অনেক বছর বাঁচতে। প্রিয় মানুষটার সাথে একটা নিরাপদ, সুস্থ জীবন যাপন করতে। সেটা কি ভালোবাসার জন্য? হবে হয়তো।

—————————–

হাতে অর্পনের ফাইল নিয়ে সাগরের কেবিন থেকে বের হয় অঙ্কন। উদ্দেশ্য, অর্পনের কাছে যাওয়া। পথিমধ্যে হঠাৎ নজর আটকে যায় হসপিটালের বারান্দার শেষ প্রান্তে। সেখানে সুপ্তি আর একটা ছেলে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সুপ্তির মুখটা মলিন হলেও ছেলেটার ঠোঁটে অমায়িক হাসি। যেনো এই মুহুর্তে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি সে। সুখ তার ঠোঁটের ফাক গলিয়ে উজ্জ্বল হাসির ঝঙ্কার তুলে ছড়িয়ে পড়ছে। বিষয়টা একদম হজম করতে পারে না অঙ্কন। কোনো এক অজানা কারণে মেজাজটা বিগড়ে যায়। হাসি খুশি মুখটা মুহুর্তেই গম্ভীর রুপ ধারণ করে। বড় বড় কদম ফেলে এগিয়ে যায় সেদিকে। ছেলেটার পেছনে দাঁড়িয়ে কর্কশ কন্ঠে বলে,

—“আজকাল হসপিটালে সার্কাস হয় নাকি?”

অঙ্কনের গম্ভীর কন্ঠের আওয়াজ শুনে পাশে ফিরে তাকায় ছেলেটা। ডক্টরদের এপ্রোণ পরিহিত অঙ্কনকে মুহুর্তেই চিনে ফেলে। কিন্তু অঙ্কনের কথার অর্থ সে বুঝতে পারে না। কিছু না বোঝার ভঙ্গিতে বলে,

—“মানে?”

—“মানে যেভাবে হাসছো। আমি ভাবলাম সামনে সার্কাস চলছে হয়তো। চলছে কি?”

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ছেলেটা। অঙ্কনের এমন অদ্ভুত কথার মানে বুঝতে তার বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এদিকে সুপ্তি সরু চোখে তাকিয়ে আছে অঙ্কনের দিকে। অঙ্কন যে তাকে অপমান করতে এখানে এসেছে সেটা বুঝতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না সুপ্তির। দুজনের এমন ভিন্ন ভিন্ন চোখের চাহনি দেখে গলা খাঁকারি দেয় অঙ্কন। ছেলেটার দিকে মুখ করে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“পরিচয় দাও।”

—“স্যার, আমি ডক্টর দাসের এসিস্টেন্ট।”

অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে উত্তর দেয় ছেলেটা। অঙ্কন পূর্বের তুলনায় কন্ঠ আরও বেশি গম্ভীর করে বলে,

—“তাহলে তোমার তো ডক্টর দাসের সাথে থাকার কথা। এখানে কি করছো?”

—“তেমন কিছু না স্যার। এমনি একটু কথা বলছিলাম।”

—“বেতন কি কথা বলার জন্য দেয়া হয় তোমাকে? কাজের জন্য বেতন পাও। তাহলে কাজ করে টাকাটা হালাল করে নাও। কাজে ফাঁকি দিয়ে হারাম টাকা আর কতদিন খাবে?”

অর্পনের গম্ভীর কন্ঠে কড়া কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলে ছেলেটা। নিচু কন্ঠে বলে, “স্যরি স্যার!” সাথে সাথে সেখান থেকে প্রস্থান নেয়। ছেলেটা চলে যেতেই সুপ্তির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় অঙ্কন। একটা হাত পকেটে গুঁজে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কাঠকাঠ কন্ঠে বলে,

—“যেখানে সেখানে ছেলেদের সাথে ঢলাঢলি নিশ্চয়ই ভদ্র পরিবারের মেয়েদের বৈশিষ্ট্য নয়। স্বভাবটা পরিবর্তন করার দরকার মনে করছি।”

—“কিন্তু আমি মনে করছি না। বরং পরিবর্তন আপনার স্বভাবে আনা দরকার। আমার পেছনে লেগে থাকা বন্ধ করুন।”

সুপ্তির কাঠকাঠ কন্ঠের জবাব শুনে রেগে যায় অঙ্কন। রাগের কারণে কপালের মধ্যভাগের শিরা ফুলে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে রাগে কিড়মিড় করতে করতে অর্পন বলে,

—“তোমার মাঝে ভদ্রতার বড্ড অভাব।”

—“তাতে আপনার তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আপনি বরং নিজের চিন্তা করুন। আমাকে নিয়ে ভাবার জন্য অনেকে আছে। আপনি কেনো শুধু শুধু আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করছেন?”

ঝাঁঝালো কণ্ঠে কথাগুলো বলেই হনহন করে সেখান থেকে চলে যায় সুপ্তি। অঙ্কনের থেকে পাওয়া পূর্বের আচরণ গুলো ভোলেনি সুপ্তি। কিচ্ছু ভোলেনি। সবকিছু মনে রেখেছে। পই পই করে ফিরিয়ে দেবে সব। প্রতিটা খারাপ আচরণের জবাব দেবে। দেবেই দেবে।

এদিকে সুপ্তিকে এভাবে রাগ দেখিয়ে চলে যেতে দেখে আরও রেগে যায় অঙ্কন। সুপ্তির কন্ঠ হতে নিঃসৃত কড়া কথাগুলো কর্ণকুহরে ঝঙ্কার তুলে বাজতে থাকে। রাগ সামলাতে না পেরে অঙ্কন নিজে নিজেই চেচিয়ে বলে,

—“হ্যা জানি তো। অনেকে আছে তোমার কথা ভাবার জন্য। তুমি আবার সেলিব্রিটি কি না। অন্যদের পেছনে ছেলেদের লাইন লেগে থাকে। আর তোমার আশেপাশে ছেলেরা মশা-মাছির মতো ভিন ভিন করে। চোখ দিয়েই গিলে খায়। সুযোগ পেলে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে চায়। কিন্তু তুমি তো এসব দেখতে পাও না। চোখ থাকলে তো দেখবে। চশমা পাল্টাও, সাথে ব্রেনটাও ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়ে পরিস্কার করো। চাইলে আমার কাছে ভদ্রতা শেখার জন্য কিছু ক্লাস করতে পারো। তাহলে যদি কোনো ভদ্রতা সভ্যতা ভেতরে আসে। বেয়াদব মেয়ে একটা।”

আপন মনে বকবক করতে করতে হনহন করে সেখান থেকে চলে যায় অঙ্কন। ভালো মেজাজটা বিগড়ে দিলো মেয়েটা।

চলবে?

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ৩৮
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

নিশুতি রাত! প্রকৃতিতে ছেয়ে আছে নিকষ কালো অন্ধকার। বাহিরে নেই কোনো আলোর চিহ্ন। তবে হসপিটালের ভেতরের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে রাত আর দিনের মধ্যে কেনো পার্থক্য বোঝা যায় না। অনবরত লোক সমাগম আর প্রিয়জনদের করুন আর্তনাদ রাত দিনের তফাত ভুলিয়ে দেয়।

রনির পাশে হুইল চেয়ারে বসে আছে অর্পন। সকলের কথার বিরুদ্ধে গিয়ে জোর করে চলে এসেছে এখানে। নিজের শরীরের অসুস্থতাকেও পরোয়া করেনি। ভাগ্যিস, প্রাপ্তিকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পারানো হয়েছে। না হলে অর্পনকে নির্ঘাত বাঁধা দিতো।

ইতিমধ্যে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। বাহাত্তর ঘন্টা পূর্ণ হতে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকি। এখনো কোনো প্রকার রেসপন্স করেনি রনি। ডক্টর স্পষ্ট বলে দিয়েছেন আশা ছেড়ে দিতে। রনি কোমায় চলে গেছে। সে আর উঠে দাঁড়াবে না। কখনোই চোখ মেলে তাকাবে না। কথাগুলো ভাবতেই বুকটা ভারি হয়ে আসে অর্পনের। রনির একটা হাত চেপে ধরে শক্ত কন্ঠে বলে,

—“আপনি এভাবে হার মানতে পারেন না স্যার। আপনি তো দুর্বল মানুষ নয়। বরং এর চাইতে আরও কঠিন পরিস্থিতি আপনার জীবনে এসেছে। তখন তো হার মানেন নি। তাহলে আজ সামান্য আঘাতে পরাজিত হয়ে গেলেন? উঠুন রনি স্যার। আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে। আপনার থেকে সবকিছু শুনবো। আপনার গায়েব হওয়ার কারন। অপরাধীদের গোপন তথ্য। সব তো আপনার কাছেই আছে। আপনি তো আমাকে কিছু বলতে চাইছিলেন। সেগুলো বলবেন না? উঠুন, বলুন কি বলতে চাইছিলেন? আমি শুনবো স্যার। আমি সব শুনবো। রনি স্যার….…..!”

অর্পনের করা কোনো প্রশ্নের জবাব দেয় না রনি। নিথর হয়ে মিশে আছে হসপিটালের শুভ্র রঙা বেডে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যন্ডেজে মোড়ানো। অনেক রক্তক্ষরনের ফলে মুখটা ফ্যাকাশে লাগছে। বুকের ব্যথা বাড়ে অর্পনের। রনির এই অবস্থার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।

কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ অনুভব করতেই ঘুরে তাকায় অর্পন। পেছনে মলিন মুখে দীপ্তি দাঁড়িয়ে আছে। দুই চোখে তার অপরাধবোধ। এক পলক ব্যথাতুর চোখে রনির দিকে তাকিয়ে অর্পনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। অপরাধী কন্ঠে বলে,

—“আমাকে ক্ষমা করে দাও ভাই। আজ আমার জন্য তোমার এই অবস্থা।”

—“আমার নয়! আমাদের এই অবস্থা।”

অর্পনের তৎক্ষনাৎ জবাব শুনে চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে দীপ্তির। অর্পনের দৃষ্টি রনির নিথর মুখের দিকে। সেদিকে নজর রেখেই অর্পন বলে,

—“আপনার স্বামী আমাদের দুজনকেই মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। শেষ মুহুর্তে রনি স্যার আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। পাথুরে রাস্তায় পড়ে গিয়ে এতটুকু আঘাত পেয়েছি মাত্র। না হলে রনি স্যারের পাশে আমিও শুয়ে থাকতাম। নিথর, জড়বস্তুর মতো।”

দীপ্তির চোখ থেকে টুপটাপ অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মাথাটা নিচু করে নিরবে চোখের জল বিসর্জন দেয়। মায়া লাগে না অর্পনের। বরং রাগ হয়। নিজের ওপর রাগটা সীমা ছাড়িয়ে যায়। দীপ্তির কথা না শুনলে আজ তাদের এই অবস্থা হতো না। রনিও সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো। রাগ সামাল দিতে না পেরে অর্পন কঠিন কন্ঠে বলে,

—“আপনি যাকে বাঁচাতে চাইছেন সে একজন অপরাধী। তার অপরাধের কোনো সীমা নেই। অসংখ্য মেয়েদের তাদের পরিবার থেকে আলাদা করেছে সে। নিকৃষ্ট মানুষের হাতে তুলে দিয়ে ওদের জীবন অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। ড্রাগসের মতো ভয়ানক বিষ আমাদের ছাত্র সমাজে বিলিয়ে দিয়েছে। নেশায় আসক্ত করে ফেলেছে দেশের অর্ধভাগ। বিষিয়ে দিয়েছে তাদের মন। নষ্ট করে দিচ্ছে তাদের ভবিষ্যতে। তার অপরাধের মাপকাঠি এখানেই আটকে নেই। শাখা প্রশাখা গজিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আপনার পরিবারের ক্ষতি করেছে। আপনার বোনকে ইচ্ছাকৃত অন্ধ বানিয়ে রেখেছে। পাষাণে পরিণত হয়েছে সে। এতোকিছুর পরেও আপনি তাকেই বাঁচাতে চাইছেন। কেনো?”

চোখ তুলে তাকায় দীপ্তি। দুই চোখে এখনও অশ্রুকণা বিদ্যমান। ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে ধরা গলায় বলে,

—“মন যে মানছে না। মন বলছে এই সব মিথ্যে। এর পেছনে লুকনো কোনো কারণ আছে, যা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। সজীব খারাপ সেটা আমি মানতে পারছি না।”

—“তাহলে বলবো আপনি অন্ধ হয়ে গেছেন।”

—“আমি তাকে কাঁদতে দেখেছি। নিস্তব্ধ মধ্য রাতে সকলের অগোচরে করুন স্বরে আর্তনাদ করতে শুনেছি। তুমিই বলো, পাষাণ মানুষ কি কখনো কাঁদে?”

—“শুধুমাত্র এই কারণে আপনি তাকে বাঁচাতে চাইছেন?”

অর্পনের কন্ঠে বিস্ময়। দীপ্তি ডানে বামে মাথা নেড়ে বলে,

—“আমি শুধু সত্যিটা জানা পর্যন্ত সময় চাইছি।”

—“তাহলে তাই হোক। অলরেডি কিছু প্রমান হাতে এসে গেছে আমার। আর অল্প কিছু প্রমান জোগাড় করা বাকি। তারপর সবার সামনে থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে তাকে জেলে বন্দী করবো। আর আপনি যার জন্য এতো সহানুভূতি দেখাচ্ছেন, খুব তাড়াতাড়ি আপনার মনোভাবও বদলে যাবে। আপনি নিজে বলবেন তাকে শাস্তি দিতে। কথাটা মিলিয়ে নিবেন। আপনার অনুরোধে তাকে একবার ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু দ্বিতীয়বার ছাড়বো না। কারণ সে শুধু দেশের শত্রুই নয়। সে এখন আমার ব্যক্তিগত শত্রু।”

জোড়ালো কন্ঠে কথাগুলো বলেই হুইলচেয়ারের চাকা হাত দিয়ে ঠেলে পেছনে ঘোরায় অর্পন। নিজে নিজেই চাকা ঠেলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। দ্বিতীয় বারের জন্য আর পেছন ফিরে তাকায় না।

দড়জার বাইরে দাঁড়িয়ে অর্পন আর দীপ্তির সব কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে সাগর। সজীবের প্রতি দীপ্তির এতো বিশ্বাস দেখে বুকটা ভারি হয়ে আসে সাগরের। ব্যথাতুর নয়নে হাতের ফাইলটার দিকে তাকায়। সেই মুহূর্তে কেউ এসে কাঁধে হাত রাখে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পায় অঙ্কনকে। তার দৃষ্টিতে হাজারো প্রশ্ন। অর্পনের থেকে চোখ সরিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সাগর। হাতের ফাইলের দিকে তাকিয়ে বলে,

—“এখনো দীপ্তি তার স্বামীকে বিশ্বাস করতে চাইছে। তাকে বাঁচাতে চাইছে। এতোকিছুর পরেও কেনো অঙ্কন?”

—“বাঙালি মেয়েরা এমনই ভাই। বড্ড সরল, ভিষণ বোকা। খুব সহজেই সবাইকে বিশ্বাস করে নেয়।”

—“ওর এই বিশ্বাস যে ওকে আরও কষ্ট দেবে অর্পন। এতোদিন তো শুধু সজীবের বাইরে করা কর্মকান্ড প্রকাশ পেয়েছে। তার ভেতরের শত্রুতা যখন সামনে আসবে, তখন যে দীপ্তি পুরোপুরি ভেঙে যাবে। এই সত্যিটা জানার পর, দীপ্তি নিজেকে সামলাবে কি করে?”

এই প্রশ্নের উত্তর অঙ্কন জানে না। তার কাছে এর কোনো জবাব নেই। তবে দীপ্তির জন্য অঙ্কনের ভিষণ খারাপ লাগছে। ইসস… সহজ সরল মেয়েটা এভাবে ঠকে গেলো! এতো বড় ধোঁকা সে মানতে পারবে তো?

—————————

অর্পন যখন নিজের কেবিনে ফিরে আসে তখন প্রাপ্তি গভীর ঘুমে। অর্পনের বেডেই ঘুমিয়ে আছে সে। সাগর এখানে আলাদা একটা বেডের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলো, কিন্তু অর্পন তা করতে দেয়নি। বিয়ের প্রথম রাতেই সে দেশ সেবা করতে চলে গেছিলো। মেয়েটা তার ভাগের একফোঁটা ভালোবাসাও পায়নি। এখনও তাকে দূরে সরিয়ে রাখাটা অন্যায় হবে। তাই নিজের কাছে, নিজের পাশেই রেখেছে। পরিবারের বড়দের সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে সাগর। তাই কাজটা করা খুব একটা কঠিন হয়নি।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বেডের কাছে চলে আসে অর্পন। কিন্তু এই পর্যায়ে পড়ে যায় বিপাকে। অঙ্কনের সাহায্য নিয়ে হুইল চেয়ারে বসেছিলো। এখন এতো উঁচু বেডে সে একা উঠবে কিভাবে? পায়ের হাড় ভেঙে না গেলেও আঘাতটা অনেক গভীর। নিজে থেকে হাঁটাচলা সম্ভব হচ্ছে না তার। চিন্তিত অর্পন আশা ভরা দৃষ্টিতে দড়জার দিকে তাকায়। দড়জার সামনে দিয়ে একজন ওয়ার্ডবয়কে যেতে দেখে আস্তে করে ডাকে।

অর্পনের ক্ষীন কন্ঠের আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে যায় প্রাপ্তির। হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসে নিজের পাশে হাতড়াতে থাকে। নিজের পাশে অর্পনর অস্তিত্ব না পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়ে। ঘটনাটা বুঝতে পেরে প্রাপ্তির হাতটা খপ করে ধরে ফেলে অর্পন। অভয় দিয়ে বলে,

—“অস্থির হয়ো না, আমি এখানেই আছি।”

—“কোথায় গেছিলেন আপনি? নিচে কি করছেন?”

—“একটু কাজে বাইরে গেছিলাম।”

—“এই অবস্থাতেও কাজ করতে হবে। কাজ দেখাচ্ছেন আমাকে?”

প্রাপ্তির রাগী কন্ঠ শুনে হেঁসে ফেলে অর্পন। ইতিমধ্যে এয়ার্ডবয় কাছে চলে আসে। তার সাহায্য নিয়ে বেডে উঠে বসে অর্পন। পিঠের কাছে বালিশ চাপা দিয়ে অর্পনকে বসিয়ে ওয়ার্ডবয় চলে যায়। প্রাপ্তি অর্পনের কাছেই বসে। ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। যেনো দেখার চেষ্টা করছে অর্পনের আঘাতপ্রাপ্ত মুখ। কিন্তু সামনে নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। মনটা ভারি হয়ে যায় প্রাপ্তির। এই প্রথমবার নিজের চোখের দৃষ্টি না থাকায় আফসোস হয়।

প্রাপ্তির ব্যথাতুর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা আন্দাজ করে নেয় অর্পন। আর এক মুহুর্ত সময় ব্যায় না করে হ্যাচকা টানে প্রাপ্তিকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সেভাবেই পড়ে থাকে প্রাপ্তি। আজ লজ্জা বা সংকোচ কোনোটাই কাজ করছে না। বরং মনের মধ্যে এক আকাশ সমান প্রশান্তি অনুভব করছে। কয়েক পল নিরবতায় কেটে যায়। নিরবতা ভেঙে অর্পন প্রশ্ন করে,

—“কিছু কি বলতে চাইছো? তোমার চোখে আমি অনেক কথা দেখছি। কিন্তু সেটা মুখ পর্যন্ত আসছে না। এতো সংকোচ কেনো?”

জবাব দেয় না প্রাপ্তি। সেভাবেই অর্পনের প্রশস্ত বুকে পড়ে থাকে। প্রশান্তি খুঁজে পায় সেখানে। অর্পনও আর কোনো কথা বলে না। সময় দেয় প্রাপ্তিকে। কিছু সময় নিরব থেকে প্রাপ্তি বলতে শুরু করে,

—“এই পৃথিবীতে কোনো মানুষই পার্ফেক্ট নয় অফিসার। প্রত্যেকটা মানুষের কোনো না কোনো দিক থেকে কমতি আছে। কারো গায়ের রঙ কালো, তো কারো উচ্চতা কম। কারো নাক বোঁচা, তো কারো কন্ঠস্বর মোটা। কেউ দেখতে অসম্ভব সুন্দরী কিন্তু তার একটা পা খোঁড়া। এভাবে দেখতে গেলে প্রতিটা মানুষেরই কোনো না কোনো দিক দিয়ে কমতি আছেই। আমার বাবা বলতেন, একটা মানুষ যদি সবদিক থেকেই পার্ফেক্ট হতো তাহলে তার মধ্যে অহংকার বেড়ে যেতো। অহংকারে অন্ধ হয়ে সে সৃষ্টিকর্তাকেই ভূলে যেতো। তাই হয়তো সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেকের মধ্যে কোনো না কোনো কমতি রেখেছেন। যাতে দিন শেষে আমরা আমাদের স্রষ্ঠাকে না ভুলি। তেমন আমার মধ্যেও একটা কমতি আছে। আমি অন্ধ। জন্মগত নই কিন্তু অন্ধ তো। তবে আমার চোখে না দেখতে পারা নিয়ে কখনো কোনো আফসোস ছিলো না। আমি এটাই মানতাম যে সবার যেমন একটা দিকে কমতি থাকে আমার না হয় এই দিকে কমতি আছে।”

একদমে কথাগুলো বলেই থেমে যায় প্রাপ্তি। অর্পনের বুক থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে। বাঁধা দেয় না অর্পন। বরং প্রাপ্তির বলা এক একটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে। প্রাপ্তি ধরা গলায় ফের বলতে শুরু করে,

—“চোখের দৃষ্টি শক্তি হারানোর পর আমি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলাম। তখন আমার পরিবার আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছে। নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। সত্যি বলতে, নিজের পরিবারের ভরসা আর সাহসে আমি নিজের কমতি ভুলেই গেছিলাম। কোনো আফসোস ছিলো না দৃষ্টি শক্তি হারানোর জন্য। এই বিশাল বড় কমতি সহই নিজের জীবন গুছিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু আজ আমার চোখে দেখতে না পারা নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে অফিসার। মন খালি আফসোসের সুরে একটাই কথা বলছে, যে তারে আমি চোখে দেখিনি। কেনো দেখিনি? এতো বড় অক্ষমতা কেনো আমার মধ্যে? আপনাকে এই চোখে দেখতে বড্ড ইচ্ছা করছে অর্পন। খুব বেশি ইচ্ছে করছে।”

প্রাপ্তির চোখের কোণে অশ্রুকণা চিকচিক করছে। যে কোনো সময় গড়িয়ে পড়বে যেনো। প্রাপ্তির মনের ব্যাকুলতা বুঝে তৃপ্তির হাসি হাসে অর্পন। এ যেনো জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। প্রিয় মানুষকে দেখতে চাওয়ার আকুতি ক’জনের মধ্যে থাকে? মনের মধ্যে পবিত্র ভালোবাসা না থাকলে এভাবে দেখতে চাওয়ার বাসনা কখনোই জাগে না। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি নিয়ে অর্পন মোহনীয় কন্ঠে বলে,

—“চোখের দেখাটাই কি সবকিছু প্রাপ্তি? তাহলে তো পৃথিবীতে অনুভব নামের এই শব্দটাই থাকতো না। সবার ভালোবাসার ধরণ এক হয় না। মানুষ ভেদে তাদের ভালোবাসার ধরণ, প্রকাশ দুটোই ভিন্ন। তুমি আমাকে চোখে দেখতে না চেয়ে অনুভব তো করতে পারো। একবার ছুঁয়ে দেখো, দেখবে সেটা চোখের দেখার চেয়ে হাজার গুন বেশি তৃপ্তিদায়ক।”

প্রাপ্তি যেনো ঘোরের মধ্যে চলে যায়। অন্ধকার দৃষ্টি মেলে হাতটা বাড়িয়ে দেয় অর্পনের দিকে। ডান হাতের আঙুল গুলো ছুয়ে দেয় অর্পনের রোগাক্রান্ত মুখ। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে অর্পন। অনুভব করে প্রিয় মানুষটার এক একটা স্পর্শ। প্রাপ্তির কম্পিত হাত বিচরণ করে অর্পনের মুখ জুড়ে। অর্পনের সূঁচালো চোখা নাকের সাথে হাতের তালু ঠেকতেই শিরশির করে ওঠে প্রাপ্তির শরীর। অনুভুতিটা বড্ড প্রখর। চোখে দেখার চেয়ে ছুঁয়ে দেখার অনুভূতি কি বেশি গাঢ়? নাহলে এমন অদ্ভুত শিহরণ জাগছে কেনো দেহে? এ যেনো প্রখর শীতের মধ্যে কেউ ঠান্ডা বরফ ঢেলে দিয়েছে শরীরে। অর্পনের দেহের উষ্ণতায় সেই বরফ ধীরে ধীরে গলছে। এমনটাই অনুভব হচ্ছে প্রাপ্তির। এই অনুভূতি ভিষণ সুন্দর। বড্ড বেশি আবেদনময়, হৃদয় উথাল করা।

ধীরে ধীরে প্রাপ্তির হাতটা ছুয়ে দেয় অর্পনের কপালে মোড়ানো শুভ্ররঙা ব্যান্ডেজ। তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব করে অর্পন। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। ব্যান্ডেজের অস্তিত্ব অনুভব করতেই হুট করেই হাত সরিয়ে নেয় প্রাপ্তি। লাফিয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায়। তড়াক করে চোখ মেলে তাকায় অর্পন। চোখে তার বিস্ময়। দৃষ্টি মেলেই দেখতে পায় প্রাপ্তির চোখে বইতে থাকা অবাধ অশ্রু কণা। ভ্রু কুঁচকে তাকায় অর্পন। কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই প্রাপ্তি মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে পাগলের মতো বলতে থাকে,

—“না না! আমি এভাবে অনুভব করতে চাই না। আমি তো আমার সুস্থ অফিসারকে চাই। এই অসুস্থ, আঘাতপ্রাপ্ত অফিসারকে আমি অনুভব করতে চাই না। আমার বুকে ব্যথা করছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। আপনি কি তা বোঝেন?”

ফের প্রাপ্তির হাতটা ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসে অর্পন। মাথা বুকের সাথে চেপে ধরে বলে,

—“তুমি বলছো আমি বুঝি না?”

—“না, আপনি বোঝেন না।”

—“তাহলে কে বোঝে?”

—“যেই হোক, সেটা আপনি তো একদম না।”

প্রাপ্তির বাচ্চাসূলভ কথা শুনে হেঁসে ফেলে অর্পন। প্রাপ্তির মাথাটা আরও একটু গভীর ভাবে চেপে ধরে কপালে ছোট্ট করে চুমু দেয়। এক হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

—“আমি তো অবুঝ। বুদ্ধি কম। তাই বুঝিনা। একবার সুস্থ হয়ে উঠি, তারপর তুমি সব বুঝিয়ে দিও।”

কোনো জবাব দেয় না প্রাপ্তি। অর্পনের বুকে মাথা রেখে গুটিশুটি মেরে পড়ে থাকে। প্রশান্তি লাগছে এই জায়গাটায়। যেনো এই বুকে মাথা রাখলে সকল চিন্তা দূর হয়ে যায়। এভাবে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে অর্পনের বুকেই। ঘুমের ওষুধের প্রভাবে চোখ খুলে রাখা দায় হয়ে পড়েছে। অর্পনও নিরবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

মান অভিমান মেটাতে গিয়ে দুজন এতোটাই মগ্ন হয়ে গেছে যে আশেপাশের কোনোদিকে তাদের নজর নেই। যদি একবার নজর বুলিয়ে দেখতো, তাহলে দেখতে পেতো হিংসায় জ্বলতে থাকা এক জোড়া চোখ। যে তার জ্বলতে থাকা আগুন লাল চোখে সব ঘটনা পর্যবেক্ষন করছে। যে কোনো মুহুর্তে ঝাপিয়ে পড়বে ওদের ক্ষতি করতে।

চলবে?