#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ৪১
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন
নিরবতায় কাটে বেশ কিছু প্রহর। সকলের কৌতূহল চোখের চাহনি মারুফ সাহেবের দিকে। বাকি ঘটনা জানার জন্য অধির আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে সকলে। কিন্তু মারুফ সাহেব কোনো জবাব দিচ্ছেন না। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছেন। নিরবতা ভাঙে সুপ্তির গলার আওয়াজে। সুপ্তি ফুপিয়ে উঠে থেমে থেমে বলে,
—“আব্বু আমাকে ডেকে বলেছিলো ফোনে শানের সাথে কথা বলতে। আমি আপু সেজে আব্বুর শিখিয়ে দেয়া কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম আমি তাকে পছন্দ করি না। সে যেনো আর আমার পেছনে না ঘোরে। কিন্তু ছেলেটা মানছিলো না। আপু মনে করে সে আমাকে বোঝাচ্ছিলো। বলছিলো সে নাকি আমার জন্য সব করতে পারে। তখন হঠাৎ করেই অবুঝ মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চলে আসে। আমি………”
এটুকু বলে আবার কেঁদে ফেলে সুপ্তি। তার শরীরের কম্পন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেটা ভয়ে, নাকি উত্তেজনায়? জানে না সুপ্তি। দুই হাতে চোখ মুছে ফের বলতে শুরু করে,
—“আমি তখন ছোটো ছিলাম। সিনেমার প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম বেশি। জীবনটাকেও সিনেমাটিক ভেবে বলেছিলাম, যদি আমাদের স্কুলের পাঁচ তলার ছাঁদ থেকে সে লাফ দিতে পারে তাহলে আমি তাকে মেনে নেবো। আমি ভেবেছিলাম ছেলেটা ভয় পেয়ে যাবে। এমন কাজ কখনোই করবে না। কিন্তু সে যে সত্যি সত্যি ছাঁদ থেকে লাফ দিবে সেটা আমি ভাবিনি।”
আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে সুপ্তি। এখন কান্নার চেয়ে হিচকি বেশি হচ্ছে। সুপ্তির ঠিক পেছনে দাড়িয়ে সকল কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলে অঙ্কন। মেয়েটাকে এভাবে কাঁদতে দেখে আহত দৃষ্টিতে তাকায়। সান্তনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।
উপস্থিত সকলেই নির্বাক, হতভম্ব। প্রাপ্তির চোখ অশ্রুসিক্ত। মাথা নিচু করে বাধভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সুপ্তি। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
—“ছেলেটা সেদিন সত্যি সত্যি ছাঁদ থেকে লাফ দিয়েছিলো। খবর পাই মারা গেছে। আমার একটা ভুলের জন্য কারোর প্রাণ চলে যাবে সেটা আমি কখনো ভাবিনি। আমি তো এমনটা চাইনি। আমি তো শুধু বাবাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। আম… আমি কোনো খু**ন করিনি। আমি সত্যি কোনো খু***ন করিনি।”
পাগলের মতো মাথা নেড়ে বলতে থাকে সুপ্তি। দিলারা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করেন। পুরো ঘর জুড়ে ফের পিনপতন নীরবতা ছেয়ে যায়। শুধু সুপ্তির ফোঁপানোর আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। প্রাপ্তি হতবাক, পাথরের ন্যায়ে বসে আছে। চোখ থেকে টুপটাপ অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়ছে। সুপ্তি থামতেই, সময় নিয়ে অর্পন বলে,
—“সজীব শানের বড় ভাই। নিজের ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে সজীব এই বাড়িতে আসে। দীপ্তি আপুকে বিয়ে করে সকলের কাছাকাছি চলে আসে। প্রতিশোধ পুরো করতে প্রাপ্তির এক্সিডেন করায়। তার উদ্দেশ্য ছিলো প্রাপ্তিকে প্রাণে মেরে ফেলা। কিন্তু পারেনি। সেই সময় প্রাপ্তির চোখে গুরুতর আঘাত লাগে। এই সুযোগের সৎব্যবহার করে সজীব। ডক্টরকে টাকা খাইয়ে ভুল চিকিৎসা দিতে বলে। বেঁচে থেকেও যাতে প্রাপ্তি মৃত্যুর যন্ত্রণা অনুভব করে, সেই জন্য ইচ্ছাকৃত ভাবে অন্ধ বানিয়ে রাখে। এবাড়ির সবাই তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতো। তাই তার জন্য কাজটা খুব সহজ হয়ে যায়।”
একদমে কথাগুলো বলেই থেমে যায় অর্পন। নরম দৃষ্টিতে তাকায় প্রাপ্তির দিকে। মেয়েটার চেহারা পুরোই বিধ্বস্ত। একের পর এক ধাক্কা মেনে নিতে পারছে না মেয়েটা। এরই মাঝে সাগর বলে ওঠে,
—“কাহিনি এখনো বাকি আছে অর্পন। শেষ হয়নি। সজীব শুধু প্রাপ্তিরই নয়, দীপ্তিরও অনেক ক্ষতি করেছে। দীপ্তি ট্রিটমেন্টের জন্য যখন আমার কাছে আসে তখন জানতে পারি সবটা। দীপ্তিকে না জানিয়ে ওর এবরশন করিয়েছে সজীব। যার ফলাফল, এখন সে সন্তান ধারণে অক্ষম। এই কথা ডক্টর দাস নিজে স্বীকার করেছে। এবরশনের সকল রিপোর্ট আছে আমার কাছে। ছেলেটা খুবই জঘন্য। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত।”
সকল কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন দিদার সাহেব। যদিও তিনি কিছুটা জানতেন। কিন্তু এইসবের পেছনে যে সজীব আছে সেটা জানতেন না। সকল প্রমান যখন হাতে এসেছে তখন অপরাধীর শাস্তি সুনিশ্চিত করা খুবই জরুরি। ফাইলগুলো হাতে নিয়ে সহসা দাড়িয়ে পড়েন দিদার সাহেব। কনস্টেবল রহিমের হাতে প্রমানগুলো দিয়ে বলেন,
—“আমি এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ছি তাহলে। দেরি করা ঠিক হবে না। অর্পন, তুমি থানায় ফোন করে পুলিশ ফোর্স পাঠাতে বলো। আমার বিশ্বাস, দীপ্তি এখন সজীবের কাছেই আছে।”
কথাগুলো বলেই দড়জার দিকে কদম ফেলেন দিদার সাহেব। মারুফ সাহেব উঠে এসে অর্পনের হাত চেপে ধরেন। অনুনয় সুরে বলেন,
—“আমার সুপ্তিকে কোনো শাস্তি দিও না বাবা। ও তো ছোট ছিলো। না বুঝে একটা ভুল করে ফেলেছে। ওর কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার। ও যা করেছে, সব আমার কথায় করেছে। আমাকে চাইলে শাস্তি দিতে পারো। কিন্তু আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও।”
অর্পন নিরবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। পকেট থেকে ফোন বের করে কারোর নাম্বারে ডায়াল করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে কিছুটা দূরে চলে যায়। সকলের থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে ফোনে কথা বলায় মনোযোগ দেয়।
———————–
বড় বড় দুটো লাগেজে জামা কাপড় সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছাচ্ছে সজীব। বিপদ আন্দাজ করতে পেরে আগেই পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে। অর্পনের হাতে ইতিমধ্যে সব প্রমাণ চলে গেছে, এটা বুঝতে আর সজীবের বাকি নেই। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা মানে নিজের বিপদ। তাই আপাতত বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকবে। দুইদিন পর দেশ ছেড়ে চলে যাবে। পরিকল্পনা মোতাবেক সব কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে সজীব।
কাজের ফাঁকে একনজর তাকায় নিজের বিছানার দিকে। বিছানার মাঝবরাবর জ্ঞানহীন অবস্থায় পড়ে আছে দীপ্তি। অতিরিক্ত কান্নাকাটির ফলে চোখ দুটো ফুলে উঠেছে। দীপ্তির শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ে সজীব। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে দীপ্তির দিকে। দীপ্তির মাথার কাছে বসে ফিসফিস করে বলে,
—“তোমার ক্ষতি করা আমার উদ্দেশ্য ছিলো না দীপ্তি। প্রতিশোধ নিতে তোমাকে ব্যবহার করতে হয়েছে শুধু। শুরু থেকেই অভিনয় করে গেছি তোমার সাথে। তবে অভিনয় করতে গিয়ে কখন যে ভালোবেসে ফেলেছি, সেটা বুঝতে পারিনি। এখন যে তোমার ক্ষতি করার কথা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারি না। আমার তোমাকে চাই দীপ্তি। খুব করে চাই। তাই তোমার অনুমতি ছাড়াই সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি। আমি জানি, এই সিদ্ধান্ত তুমি মেনে নেবে না। জ্ঞান ফেরার পর থেকে আমাকে ঘৃণা করবে। তাতে কোনো সমস্যা নেই। আমি নাহয় বাকিটা জীবন তোমার ঘৃণা নিয়েই বাঁচবো। তবুও তোমাকে নিজের থেকে দূরে যেতে দেবো না।”
কথার মাঝেই চোখ থেকে টুপ করে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সাথে সাথে মুছে ফেলে সজীব। তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায়। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
রাবেয়া বেগম নিজের ঘরের বিছানায় চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে ছিলেন। চোখ মুখ জুড়ে তার চরম হতাশা। সজীব ব্যস্ত পায়ে ঘরে ঢুকে নিজের মায়ের কাছে চলে যায়। রাবেয়া বেগমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
—“এক ঘন্টার মধ্যে আপনি শানকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন আম্মা। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। এয়ারপোর্টে আমার লোক আছে। তারা আপনাকে নিরাপদে দেশ থেকে যেতে সাহায্য করবে। আর শান কোথায়?”
—“বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে বলে যায়নি।”
রাবেয়া বেগমের ভাবলেশহীন উত্তর। সজীবের রাগটা এবার তরতর করে বেড়ে যায়। রেগে হুঙ্কার দিয়ে বলে,
—“বাড়িতে নেই মানেটা কি? অর্পন তার পুলিশ ফোর্স নিয়ে এলো বলে। আর এই মুহুর্তে তামাশা শুরু করেছে আপনার ছেলে?”
—“তো আমি কি করবো? আমাকে বলে কোনো কাজ করে নাকি তোর ভাই? কোনো একটা ছেলে আমার বাধ্য না। জ্বালিয়ে শেষ করে দিলো দুই ভাই মিলে।”
রাগ সামাল দিতে হাত মুঠো করে ধরে সজীব। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে ধাতস্থ করে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
—“এই ছেলেটাকে একটা শিক্ষা দেয়া অনিবার্য। আজ আপনার ছেলে যদি কোনো গন্ডগোল করে তাহলে আমি কিন্তু ওকে একদম বাঁচাতে যাবো না। কথাটা মনে রাখবেন।”
রেগে কথাগুলো বলেই হনহন করে বেরিয়ে যায় সজীব। রাবেয়া বেগমের ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেঁসে বলেন,
—“বাঁচাতে তো তোকেই যেতে হবে সজীব। মনে হয় কিছু একটা ভুলে যাচ্ছিস। কোনো ব্যপার না। মনে করিয়ে দেবো।”
————————-
অর্পনদের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে শান। অপালক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দোতলা বাড়িটার দিকে। উদ্দেশ্য, একনজর প্রাপ্তিকে দেখা, একটু কথা বলা। সেই আশায় প্রাপ্তির জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। মিনিট পাঁচেক পর গেইট দিয়ে একটা সাদা রঙের গাড়ি ঢোকে। গাড়িটা থামতেই সবার প্রথম বের হয় অর্পন। পরপর বের হন সুভাষ সাহেব এবং সন্ধ্যা বেগম। সবার শেষে বের হয় প্রাপ্তি। সন্ধ্যা বেগমের হাত ধরে বাড়ির ভেতরের দিকে চলে যায় সে।
গেইটের অপর পাশের একটা দোকানে দাড়িয়ে সবটা দেখছিলো শান। তার মুগ্ধ দৃষ্টি সোজা প্রাপ্তিতে আটকে আছে। সুযোগ খুঁজছে প্রাপ্তির সাথে কথা বলার। কিন্তু প্রাপ্তির চারপাশে অর্পন এবং তার পরিবার থাকায় যেতে পারছে না কাছে। দূর থেকেই কাতর নয়নে তাকিয়ে দেখছে শুধু।
বাড়ি ফিরেই ড্রয়িংরুমের সোফায় গা এলিয়ে দেয় অর্পন। শরীর এখনও পুরোপুরি সুস্থ নয়। তবুও দৌড় ঝাপ করতে হচ্ছে। অসুস্থ শরীরটা এতো ধকল আর নিতে পারছে না। আয়েসি ভঙ্গিতে গা এলিয়ে বসতেই অর্পনের ফোন বেজে ওঠে। বাম হাতে ফোনটা বের করে রিসিভ করে অর্পন। ফোনের ওপাশের ব্যক্তির কথা শুনে ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে। চাপা হেঁসে ফোনটা কেটে দেয় অর্পন। পরপরই ডায়াল করে কনস্টেবল রহিমের নাম্বারে। রিসিভ হতেই অর্পন গম্ভীর কন্ঠে বলে,
—“অফিসার জয়কে বলুন টিম নিয়ে ওদের গোডাউনে যেতে। আমিও আসছি।”
এটুকু বলেই ফোন কেটে উঠে দাঁড়ায় অর্পন। চিন্তিত হয়ে পড়েন মাহবুব সাহেব। প্রাপ্তি উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,
—“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
—“তোমার বোনকে ফিরিয়ে আনতে।”
সাথে সাথে উত্তর দিয়ে বেরিয়ে যায় অর্পন। বিজয় নিকটে দেখে পায়ের ব্যথাকেও তুচ্ছ মনে হচ্ছে যেনো। তবে অসুস্থ শরীরে আবার কোনো বিপদজনক কাজে যাওয়ায় মন সায় দিচ্ছে না মাহবুব সাহেবের। যদি অপরাধীদের সাথে আবার সংঘর্ষ হয়। অর্পন তো শারিরীক ভাবে সুস্থ নয়। চিন্তিত সুভাষ সাহেব ফোন করেন সাগরকে। রিসিভ হতেই তড়িঘড়ি করে বলেন,
—“অর্পন কোথাও একটা যাচ্ছে সাগর। এই অসুস্থ শরীর নিয়ে আবার কোনো বিপদে না পড়ে ছেলেটা।”
—“আমি দেখছি মামা। চিন্তা করো না।”
এটুকু বলেই ফোন কেটে দেয় সাগর। কিছুটা স্বস্তি পান সুভাষ সাহেব।
—————————
পুরনো বাড়িটার পেছন দিকে বিশাল বড় গোডাউন। সেখানে, মাটির নিচে একটি গুপ্ত কক্ষ বানানো হয়েছে। বিপদে পড়লে গা ঢাকা দেয়ার জন্য এই গুপ্ত কক্ষ বানিয়েছে সজীব। বলা বাহুল্য, এই গুপ্ত কক্ষের বিষয়ে এখনো কেউ কিছুই জানে না। দীপ্তিকে নিয়ে আপাতত এখানে আশ্রয় নিয়েছে সজীব। পরে সুযোগ বুঝে দেশ থেকে পালিয়ে যাবে।
সাজানো ঘরটায় প্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র আছে। ঘরের মধ্য ভাগে রাখা বিশাল বড় খাটের ওপর নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে সজীব। অনেক দৌড়াদৌড়ি হয়েছে। এবার একটু আরামের প্রয়োজন। পাশেই দীপ্তি ঘুমিয়ে আছে। ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে দীপ্তিকে। দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত কোনো রিস্ক নিতে নারাজ সজীব।
হঠাৎ করেই দড়জায় খটখট আওয়াজ হয়। ভ্রু কুঁচকে দড়জার দিকে তাকায় সজীব। এই ঘরের বিষয়ে শুধু মাত্র সে ছাড়া আর কেউ জানতো না। আজ আসার সময় সোহেলকে জানিয়েছে সাহায্যর জন্য। তাহলে কি সোহেল এসেছে কোনো কারণে? মনে মনে ভাবতে ভাবতেই দড়জার কাছে গিয়ে পৌঁছায় সজীব। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দড়জায় রাখা ছোট্ট ফুটোতে চোখ রাখে। ওপাশে সোহেল দাড়িয়ে আছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে একটানে দড়জা খোলে সজীব। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,
—“তোকে বলেছি না, বিশেষ দরকার ছাড়া এখানে আসবি না।”
—“বিশেষ দরকারেই এসেছি বস।”
—“কি দরকার?”
—“আসলে, দরকারটা ওর নয়! আমার।”
গম্ভীর কন্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে সামনে চলে আসে অর্পন। মুখে তার চমৎকার হাসি। পরপর পেছন থেকে বেরিয়ে আসে সাগর। সেই সাথে কিছু পুলিশ। হঠাৎ করেই অর্পন এবং তার পুলিশ ফোর্সকে দেখে চমকে ওঠে সজীব। নিজের চোখকেই যেনো বিশ্বাস করতে পারছেনা। পুলিশ যদি গোডাউনে আসেও, তবুও এই আন্ডারগ্রাউন্ডের গুপ্ত কক্ষের কথা তাঁদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। নজর ঘুরিয়ে সোহেলের দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় সজীব। হঠাৎ করেই যেনো হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সোহেলের ঠোঁটে বিজয়ের হাসি।
নিজেকে বাঁচাতে সজীব কিছু করবে, তার আগেই দুইজন পুলিশ কনস্টেবল সজীবকে ধরে ফেলে। রাগে ফুঁসে উঠে সজীব। সোহেলের দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলে,
—“তুই আমার সাথে বেইমানি করলি সোহেল!”
সোহেলের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। ব্যাঙ্গাত্বক সুরে সোহেল বলে,
—“আমি এখানে ছিলাম আপনার পাপের রাজত্ব ধ্বংস করতে। সেটাই করেছি।”
—“কিন্তু আমার সাথে তোর কিসের শত্রুতা?”
সজীবের চোখে বিস্ময়। কিন্তু সোহেলের চোখ অশ্রুসিক্ত। সে ধরা গলায় বলে,
—“আজমল শেখ নামক মানুষটার কথা মনে পড়ে বস? যার দারিদ্র্যতার সুযোগ নিয়ে আপনি তাকে ব্যবহার করেছিলেন। টাকার লোভ দেখিয়ে তাকে দিয়ে ড্রা**গ**স সাপ্লাই দিতে কাজে লাগান। এতে দেশের ক্ষতি হচ্ছে বুঝতে পেরে তিনি আপনার সাথে কাজ করতে অস্বীকার করেন। যার পরিণাম হিসেবে আপনি তাকে মৃত্যু উপহার দিয়েছিলেন। সেই আজমল শেখের ছেলে আমি।”
হতবাক সজীব কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে। যাকে এতগুলো বছর ধরে বিশ্বাস করে সব কাজে সামিল করেছে। সে কিনা তার শত্রু বের হলো! সজীব তার বিস্ময় কাটিয়ে না উঠতেই সোহেল আবার বলে,
—“শুধু আমার বাবাই নয়। আপনি এমন অসংখ্য মানুষের ক্ষতি করেছেন। রনি স্যারের বৌ ইভাকে অনেক কষ্ট দিয়ে মেরেছেন। আমার চোখের সামনে আপনার মামা মেয়েটাকে ধ**র্ষ**ন করে। প্রেগনেন্ট ছিলো মেয়েটা। কত কাকুতি মিনতি করেছে ছেড়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু আপনাদের মন গলেনি। মেরে ফেললেন। আপনার পাপের শেষ নেই। সবকিছুর হিসাব দিতে হবে আপনাকে। আর আপনার শাস্তি নিশ্চিত করতে আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষী আমি দেবো।”
কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে সোহেল। পুরুষ মানুষ হয়েও সে হাউমাউ করে কাঁদছে। আপনজন হারানোর ব্যথাটা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। চোখ জ্বলে অর্পনের। কান্নায় নয়। রাগে। সকলের উদ্দেশ্যে কড়া গলায় অর্পন বলে,
—“একে আমার চোখের সামনে থেকে সরাও। আমি একে আর সয্য করতে পারছি না।”
সজীব নির্বাক। তার চোখের দৃষ্টি নরম দেখায়। কিন্তু মুখে কোনো কথা নেই। হয়তো নিজের ভুল চোখের সামনে তুলে ধরায় বাক হারা হয়ে গেছে। বিনা বাক্যে পুলিশের সাথে চলে যায়। যাওয়ার পথে একবার পেছন ফিরে দীপ্তির দিকে তাকায়। অচেতন দীপ্তি এলোমেলো হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। জ্ঞান ফেরার পর সে কি আর সজীবের কাছে ফিরবে? দেখা করতে যাবে থানায়? নাকি সারাজীবনের জন্য মুখ ফিরিয়ে নেবে সজীবের থেকে?
চলবে?