তারে আমি চোখে দেখিনি পর্ব-৪৪+৪৫

0
99

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ৪৪
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্তি নিয়ে বাসায় ফেরে অর্পন। লোকেশন না জানায় সজীবের মাকে খুঁজতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এর মধ্যে রাবেয়া বেগমও নিজের বাসায় থাকছেন না। শান কেও পাওয়া যায়নি কোথাও। ইচ্ছে করেই গা ঢাকা দিয়ে আছে দুই মা ছেলে। তবে শানের বিষয়টা ভাবাচ্ছে অর্পনকে। ওই মাদকাসক্ত ছেলেটা এতো চতুরতা দেখাচ্ছে কিভাবে? এমন আকাশ পাতাল ভাবনা ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরে প্রবেশ করে অর্পন। প্রাপ্তি সোফায় বসে আছে। সামনের টি টেবিলে চায়ের কাপ। মনে হচ্ছে অর্পনের জন্যই অপেক্ষা করছিলো।

অর্পনের গায়ের পারফিউমের গন্ধ নাকে আসতেই তার উপস্থিতি বুঝে যায় প্রাপ্তি। ঠোঁট ছড়িয়ে প্রশস্ত হেঁসে বলে,

—“আপনি এসে গেছেন অফিসার!”

—“তুমি কি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে?”

—“আপনি ছাড়া আর কার জন্য অপেক্ষা করবো? আপনার জন্য চা বানিয়েছি, খাবেন?”

অর্পনের ভ্রুদ্বয় কুঁচকে যায়। চোখের দৃষ্টি হয় তীক্ষ্ণ। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলে,

—“তুমি চা বানিয়েছো?”

—“হ্যা।”

—“পণ্ডিতি করতে কে বলেছে? যদি হাত পুড়ে যেতো?”

অর্পনের রাগী কন্ঠ। প্রাপ্তির রান্না ঘরে যাওয়া অর্পন মোটেও পছন্দ করছে না। না দেখে যদি আগুনে হাত দিয়ে ফেলতো। তখন কি হতো?

মিষ্টি করে হাসে প্রাপ্তি। হাতড়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

—“মা সাহায্য করেছে। আমার সাথেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। কোনো সমস্যা হয়নি তো।”

মন গললো না অর্পনের৷ চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে শাসন সুরে বলে,

—“তবুও রান্নাঘরে যাবে না। মনে থাকে যেনো।”

কথাগুলো বলেই চায়ের কাপে চুমুক দেয় অর্পন। তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেলে। বেশ ভালো হয়েছে চা টা। এতোটাও ভালো আশা করেনি অর্পন। বড় বড় চুমুকে কাপটা খালি করে টেবিলে রেখে দেয়। এরপর একএক করে শার্টের বোতাম খুলতে থাকে। প্রাপ্তি সময় নিয়ে বলে,

—“আমার চোখের চিকিৎসার বিষয়ে ডক্টরের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন আপনি। কথা হয়েছে?”

—“হুম!”

—“কি বলেছেন ডক্টর? আমি কবে দেখতে পাবো?”

অর্পনের ব্যস্ত হাত জোড়া থেমে যায় মুহুর্তেই। চেহারার স্বাভাবিকতা বদলে মলিন হয়ে যায়। সত্য লুকাতে চায় প্রাপ্তির থেকে। প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলে,

—“সুপ্তিকে একবার আসতে বলো তো। তুমি একা একা থাকো, নিশ্চয়ই বোরিং লাগে। সুপ্তি এসে থাকুক কিছুদিন এখানে। তাহলে তোমারও ভালো লাগবে আর আমিও কিছুটা নিশ্চিন্ত হবো।”

—“প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছেন?”

অর্পন এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকায়। আমতা আমতা করে বলে,

—“না সেটা না। আসলে আমি….. ”

হঠাৎ করেই অর্পনের ফোন বেজে ওঠে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে অর্পন। এই মুহুর্তে কোনো একটা বাহানার বিশেষ প্রয়োজন ছিলো। পরে সবটা বুঝিয়ে বলা যাবে প্রাপ্তিকে। তবে এই মুহুর্তে অর্পন প্রাপ্তির প্রশ্নের জবাব দিতে প্রস্তুত নয়। পকেট থেকে ফোন বের করে কথা বলতে বলতে বেলকনিতে চলে যায় অর্পন। কথা শেষ করে তড়িঘড়ি করে ঘরে আসে। তাড়াহুড়ো কন্ঠে প্রাপ্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“একটা জরুরি দরকারে বাইরে যাচ্ছি। ফিরতে একটু দেরি হবে।”

—“এই মাত্রই কাজ শেষ করে বাসায় আসলেন। এখন আবার কোথায় যাচ্ছেন?”

—“এসে সবটা বলবো।”

এটুকু জবাব দিয়েই তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যায় অর্পন। প্রাপ্তির চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। আবার খারাপ কিছু হয়নি তো? বিপদ পিছু কেনো ছাড়ছে না?

————————–

বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা সাগরের কেবিনে এসে হাজির হয় অর্পন। সাথে অঙ্কনও আছে। একরাশ কৌতুহল নিয়ে একটা ছোট্ট মেমোরিকার্ডের দিকে তাকিয়ে আছে দুজন। সেই মুহুর্তে অর্পন সেখানে উপস্থিত হয়। মেমোরি কার্ডের থেকে নজর সরে দুই ভাইয়ের। অর্পন ধপ করে সামনের চেয়ারে বসে কৌতুহলী কন্ঠে বলে,

—“ভাই, কি হয়েছে রনি স্যারের? উনি ঠিক আছেন তো?”

—“রনি স্যার আগের অবস্থাতেই আছে অর্পন। তার কিছু হয়নি।”

—“তাহলে, এতো জরুরি তলব কেনো?”

সাগর টেবিলের ওপর রাখা একটা ছোট্ট বাক্স থেকে একটা মেমোরি কার্ড বের করে। সেটা অর্পনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

—“অফিসার রনির মাথায় পেছন দিকে এই চিপটা আটকানো ছিলো। চুলের মাঝে খুব সুক্ষ্ম ভালো লুকিয়ে রেখেছিলো চিপটা। তার দেখাশোনার জন্য যে নার্সকে রেখেছি, সেই চিপটা পেয়েছে। আমার মনে হয় এতে বিশেষ কিছু আছে। নাহলে এতো সুক্ষ্ম ভাবে লুকিয়ে রাখবে কেনো?”

অর্পনের চোখে কৌতুহল। চোখের দৃষ্টি তীঘ্ন। মেমোরি কার্ডটা হাতে নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে অর্পন। কৌতুহল জাগে মনে। নিজের ফোনে মেমোরি কার্ডটা লাগায়। একটা মাত্র ফোল্ডার আছে মেমোরিতে। ফোল্ডারটা ওপেন করতেই সেখানে তিনটা ভিডিও শো করে। কৌতুহল নিয়ে একটা ভিডিও অন করে অর্পন। ভিডিওতে একজন বয়স্ক মহিলাকে দেখা যাচ্ছে। হাত পা বেঁধে খাটের ওপর ফেলে রেখা হয়েছে। মুখটাও কাপড়র দিয়ে বাঁধা। পাশ থেকে একজন মানুষের পুরুষালি কন্ঠ শোনা যায়। রসিকতা করতে করতে লোকটা বলে,

—“ভাগ্নে! বড্ড বেশি অবাধ্য হয়ে যাচ্ছিস দিন দিন। মায়ের কথা ভুলে গেলি নাকি? নিজের মন মর্জি চলার আগে একবার নিজের মায়ের কথা ভাব। আমার কথা না শুনলে তোর মা কিন্তু আর এই পৃথিবীতে থাকবে না। জানিসই তো আমি কেমন। আমি যা বলি, তাই করি। শেষ বারের মতো ওয়ার্নিং দিচ্ছি। এরপর আর ওয়ার্নিং দেবো না। সোজা তোর মায়ের লাশ তোর সামনে হাজির করবো।”

ভিডিওটা শেষ হয়ে যায়। উপস্থিত তিন ভাইয়ের কৌতুহলী চোখ বিস্ময়ে বদলে গেছে। তবে অর্পনের ভাবভঙ্গি ভিন্ন। সে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। ভিডিও শেষ হতেই অর্পন চিন্তিত স্বরে বলে,

—“এই কন্ঠটা আমার চেনা। ভিষণ চেনা। মনে হচ্ছে এই কন্ঠের মালিক আমার পরিচিত।”

—“আমারও তাই মনে হচ্ছে ভাই। কোথাও শুনেছি এই কন্ঠ।”

অঙ্কনের কৌতুহলী কন্ঠ। সময় ব্যায় করে না অর্পন। সাথে সাথে পরের ভিডিও অন করে। এবার যেনো বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটে। অফিসার রনির স্ত্রী ইভাকে রে**প করার ভিডিও এটা। এবং ইভার ধ**র্ষ***ন**কারীর চেহারা দেখে চমকে ওঠে অর্পন। থমকে যায় তার চোখ জোড়া। অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় ল্যাপটপের দিকে। একই অবস্থা সাগর আর অঙ্কনেরও। সাগর অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বলে,

—“এটা কিভাবে সম্ভব?”

বিস্ময় অর্পনের চাহনিতেও। ফোনটা নিয়ে সোহেলের নাম্বারে একটা ছবি সেন্ট করে অর্পন। পরপর নাম্বারে ডায়াল করে। ফোন রিসিভ হতেই অর্পন গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“একটা ছবি পাঠিয়েছি তোমাকে। দেখে বলো তো চেনো কি না?”

কয়েক সেকেন্ড সময় নেয় সোহেল। পরপরই ফোন কানে ধরে বলে,

—“স্যার, এটা তো সজীব বসের মামা। আমরা তাকে ওস্তাদ বলে ডাকতাম। আপনি কি ওনাকে চেনেন?”

—“ইভার খু**ন এই লোকটাই করেছে?”

—“জ্বি স্যার।”

সাথে সাথে ফোন কেটে দেয় অর্পন। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। চোখের শিরা ধীরে ধীরে রক্তলাল রং ধারণ করছে। মেমোরি কার্ডটা টান দিয়ে ফোন থেকে খুলে নেয় অর্পন। সেটা পকেটে পুরে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কাঠকাঠ কন্ঠে বলে,

—“সবাইকে হিসাব দিতে হবে। প্রতিটা পাপের হিসাব। কোনোরকম ছাড় পাবে না কেউ।”

কথাগুলো বলেই হনহন করে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় অর্পন। পেছন পেছন ছোটে সাগর আর অঙ্কনও।

—————————-

ড্রয়িংরুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছে নুহাশ। রুবিয়া রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত। বকুলকে রান্না শেখাচ্ছে রুবিয়া। এমন সময় বাসার কলিং বেল বাজে। রুবিয়া রান্নাঘর থেকেই চেঁচিয়ে বলে,

—“কানে কি তুলো গুঁজে রেখেছো? কলিং বেল বাজাচ্ছে কেউ। দড়জা কি ভুতে খুলবে?”

রান্নাঘর থেকে কড়া গলায় চেঁচিয়ে বলে রুবিয়া। বিরক্তি নিয়ে খবরের কাগজটা টেবিলে রাখে নুহাশ। গলা চড়িয়ে বলে,

—“যাচ্ছি যাচ্ছি।”

বলে দড়জার দিকে হাঁটা দেয়। যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলে,

—“গলা তো নয়, যেনো ফাটা বাঁশ।”

আপন মনে বকবক করতে করতে দড়জা খুলে দেয় নুহাশ। দড়জার বাইরে অর্পন দাড়িয়ে আছে। চোখ মুখ শক্ত তার। কঠিন চাহনি দিয়ে নুহাশের দিকে তাকায় অর্পন। গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“ভেতরে আসতে দেবে না নুহাশ কাকু?”

—“আরে অর্পন, আয় ভেতরে আয়। অনেকদিন পর তোর দেখা পেলাম। তোকে তো আজকাল পাওয়াই যায় না।”

নুহাশের আমোদিত কন্ঠ শুনে তাচ্ছিল্য হাসে অর্পন। নুহাশকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে গিয়ে বসে। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“ইভাকে চেনো নুহাশ কাকু?”

অর্পনের মুখে ইভার নাম শুনে চেহারার রঙ বদলে যায় নুহাশের। চেহারায় ভয়ের ছাপ ফুটে ওঠে। ইতিমধ্যে রুবিয়া রান্নাঘর থেকে চলে এসেছে। অর্পনের থমথমে চেহারা দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পায়নি। চুপচাপ দাড়িয়ে দেখতে থাকে। রুবিয়ার দিকে একনজর তাকিয়ে শুকনো ঢোক গেলে নুহাশ। আমতা আমতা করে বলে,

—“ক… কে ইভা? কার কথা বলছিস? আমি তো চিনি না।”

—“ভেবে বলো! কারণ আমি বলতে শুরু করলে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটাও পাবে না।”

ঠান্ডার মধ্যেও ঘামতে শুরু করেছে নুহাশ। কানের দুইপাশ দিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে কপালের ঘাম মোছে নুহাশ। শক্ত কন্ঠে জোর দিয়ে বলে,

—“আমি চিনি না কোনো ইভাকে।”

অর্পনের রাগ এবার আকাশ ছুয়ে যায়। রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। হুট করেই উঠে দাঁড়িয়ে নুহাশের কলার চেপে ধরে শক্ত হাতের মুঠো করে নাক বরাবর ঘুসি দেয়।

দাঁড়ানো থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যায় নুহাশ। নাক থেকে গলগল করে রক্ত বের হতে থাকে। বকুল ভয়ে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে দূরে। রুবিয়া এই পর্যায়ে চেঁচিয়ে ওঠে,

—“কি হচ্ছে এসব? নিজেদের মধ্যে লড়াই কেনো করছিস অর্পন?”

—“সেটা তোমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করো রুবিয়া কাকি। সে একটা গর্ভবতী নিষ্পাপ মেয়েকে ধ**র্ষ**ন কেনো করেছে? নিরপরাধ মেয়েকটাকে খু***ন কেনো করেছে? বাচ্চা ছিলো মেয়েটার গর্ভে। কি দোষ ছিলো ওই নিষ্পাপ শিশুটার? কেনো খু***ন করলো তাকে?”

চিৎকার করে প্রশ্ন করে অর্পন। চোখ দুটো থেকে যেনো আগুন ঝরছে। অর্পনের বাঘের মতো গর্জন শুনে দৃশ্যমান রুপে কেঁপে ওঠে রুবিয়া। ছলছল চোখে তাকায় নুহাশের দিকে। নুহাশ এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। নজর লুকানোর চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে সেখানে সাগর আর অঙ্কন উপস্থিত হয়। অর্পন ফ্লোরে পড়ে থাকা নুহাশের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠে বলে,

—“নিজে থেকে সব স্বীকার করবে? নাকি তোমার কুকর্ম পুরো দুনিয়ার সামনে লাইভ দেখাবো?”

হঠাৎ করেই নুহাশের চেহারার রঙ বদলে যায়। অসহায় ভালো মানুষের চেহারার পেছনে লুকিয়ে থাকা নোংরা চেহারা বেরিয়ে আসে। নুহাশ উঠে দাড়িয়ে রাগী কন্ঠে বলে,

—“হ্যা আমি করেছি এই সব। আমিই মেরেছি ইভাকে। শা**লি**র তেজ বেশি ছিলো। তাই তার তেজ সারা জীবনের জন্য নিভিয়ে দিয়েছি। বেশ করেছি!”

রুবিয়ার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ে। এতো বছর ধরে যার সাথে সংসার করছে সে একজন চরিত্রহীন খু**নি! এটা যেনো কিছুতেই মানতে পারছে না রুবিয়া। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রুবিয়া বলে,

—“এসব কি বলছো নুহাশ? তুমি খু***ন করেছো? কিন্তু কেনো?”

—“কেনো করবো না? আমি আর আপা মিলে এতোগুলা বছর ধরে ড্রা****গ**সে***র ব্যবসা করে আসছি। একটা কাক পক্ষিও টের পায়নি। টাকার পাহাড় ছিলো আমাদের। কিন্তু যেদিন থেকে ওই পুলিশ অফিসার রনি আমাদের কেসটা হাতে নিয়েছে, সেদিন থেকেই আমাদের ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে। শয়তানটা ছদ্মবেশে আমাদের সাথে থেকে সব প্রমান জোগাড় করে ফেলেছি। যেগুলো পুলিশের হাতে গেলে আমাদের সবার জেল নিশ্চিত। যখন বুঝতে পারি, তখন ওকে আটকাই। কিন্তু শয়তান টা প্রমানগুলো কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল। এতো মারধর করার পরেও সেগুলো ফিরিয়ে দেয়নি। তাই বাধ্য হয়ে ওর বৌকে তুলে নিয়ে যাই। শা***লা তবুও প্রমানগুলো দিতে নারাজ। তাই ওরই চোখের সামনে ওর বৌকে ধ***র্ষ***ন করি। তবে মারতে চাইনি। শুধু ধ***র্ষ***ন***ই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জামাইয়ের মতোই শা***লি***র মধ্যে ভরপুর তেজ ছিলো। কিছুতেই বাগে আনতে পারছিলাম না। তাই গলা চেপে ধরে ওর তেজ কমিয়ে দেই। মরে যাবে সেটা বুঝতে পারিনি। ওকে মেরে ফেলা আমার উদ্দেশ্য ছিলো না।”

কথার মাঝেই সশব্দে চড় পড়ে নুহাশের গালে। গালে হাত দিয়ে নুহাশ সামনে তাকাতেই দেখে রুবিয়া আগুন লাল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে রুবিয়ার এমন ভয়ঙ্কর রুপ নুহাশ এর আগে কখনো দেখেনি। রুবিয়া তেড়ে এসে নুহাশের কলার চেপে ধরে। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে,

—“তোর মতো একটা পশুর সাথে আমি এতগুলো বছর সংসার করেছি, সেটা ভাবতেই ঘেন্না লাগছে আমার। তোর ওই নোংরা হাতের ছোঁয়া আমার শরীরে আছে। ইচ্ছে করছে নিজের শরীর টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলি। আমি তোকে ঘেন্না করি নুহাশ। ঘেন্না করি। আজ নিজের সিদ্ধান্তের ওপর আফসোস হচ্ছে। কেনো তোর মতো একটা পাপিকে ভালোবেসেছিলাম। কেনো তোর হাত ধরে নিজের বাড়ি, নিজের পরিবার ছেড়েছিলাম। তোকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করবো না নুহাশ। কোনোদিন না।”

চিৎকার করে কথা গুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে রুবিয়া। জীবনের একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য সারাদিন তাকে আফসোস করতে হবে। নুহাশের চোখে রাগ স্পষ্ট। তার সংসার ভাঙার জন্য অর্পন পুরোপুরি দায়ি। নুহাশ রেগে অর্পনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“তোর সাথে আমার কোনো শত্রুতা ছিলো না অর্পন। শত্রুতা তুই নিজেই তৈরি করেছিস। প্রথমে আমার ব্যবসায় নিজের পা ঢুকিয়ে আমার লোকশান করেছিস। এখন আমার সংসার ভাঙলি। এর মাশুল তোকে দিতে হবে অর্পন।”

—“আগে নিজে বাঁচো, তারপর আমার পেছনে লাগতে এসো।”

অর্পনের কথা শেষ হতেই বেশ কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবল ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হয়। নুহাশকে তাদের হাতে তুলে নিয়ে অর্পন বলে,

—“একে থানায় নিয়ে যান। আমি একটু পরে আসছি।”

দুইজন কনস্টেবল নুহাশের দুই হাত চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায়। নুহাশ যেতে যেতে চেচিয়ে বলে,

—“আমি তোকে ছাড়বো না অর্পন। এর শোধ আমি তুলবোই।”

তার কোনো কথা গায়ে মাখে না অর্পন। ঘাড় ঘুরিয়ে কনস্টেবল রহিমের দিকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“কাজ হয়েছে?”

—“জ্বি স্যার।”

অর্পনের ঠোঁটে বাঁকা হাসি। হাসতে হাসতে সেখান থেকে চলে যায়। এই হাসির পেছনে লুকানো রহস্য ধরতে ব্যর্থ হয় সাগর। শুধু কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

চলবে?

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ৪৫
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

হন্তদন্ত ভঙ্গিতে থানায় এসে পৌঁছান রাবেয়া বেগম। চেহারায় তার দুশ্চিন্তার ছাপ। পাগলের মতো এদিক সেদিক কাউকে খুঁজতে থাকেন। অর্পন চেয়ারের ওপর আয়েশি ভঙ্গিতে বসে চা খাচ্ছে। রাবেয়া বেগম সেদিকে ছুটে যান। অর্পনের সামনে দাড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন,

—“আমার ছেলে কোথায় অফিসার?”

অর্পন ধীরে সুস্থে চায়ে চুমুক দিয়ে বলে,

—“সেল নাম্বার বাইশ। সজীব সেখানেই আছে।”

—“আমি সজীবের কথা বলছি না অফিসার।”

—“তাহলে কার কথা বলছেন?”

—“আমি শানের কথা বলছি। আমি জানি তুমি সব জেনে গেছো। আর আমার ছেলেকে তুমিই কোথাও সরিয়ে ফেলেছো। সত্যি করে বলো আমার ছেলে কোথায়।”

—“যদি না বলি।”

অর্পনের হেঁয়ালিপূর্ণ বাক্য গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয় রাবেয়া বেগমের। তিনি টেবিলের ওপর দুই হাত ঠাস করে রেখে বলেন,

—“ভালো হবে না কিন্তু ছেলে। আমার শানের যদি কিছু হয়। আমি তোমাকে ছাড়বো না।”

অর্পনের স্বাভাবিক চেহারা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়। ধীরে ধীরে চেহারাতে রাগ ফুটে ওঠে । তবে নিজেকে শান্ত রাখে অর্পন। যথাসম্ভব গম্ভীর কন্ঠে বলে,

—“চলুন একটা ডিল হয়ে যাক। আপনি সজীবের মাকে ছেড়ে দিন। আমিও শানকে ছেড়ে দেবো। এক হাতে দেবেন। এক হাতে নেবেন।”

রাগে কিড়মিড় করে ওঠেন রাবেয়া বেগম। তার ইচ্ছে করছে এই মুহুর্তে অর্পনকে খুন করতে। কিন্তু অর্পনকে মারলে তার ছেলের খবর পাবে কোথায়? তাই বাধ্য হয়েই রাজি হয়ে যান রাবেয়া বেগম। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,

—“বেশ! এক ঘন্টার মধ্যে তাকে নিয়ে আসছি। তবে কথা দাও, এর মধ্যে শানকে এখানে হাজির করবে। সেই সাথে আমাকে এবং আমার ছেলেকে কোনো বাঁধা বিহীন চলে যেতে দেবে। কথা দাও।”

অর্পন কোনো জবাব দেয় না। শুধু মুচকি হাসে।

—————————-

এক ঘন্টার মধ্যেই আবার থানায় এসে হাজির হন রাবেয়া বেগম। সাথে নিয়ে এসেছেন তারই বয়সী একজন মহিলাকে। হুইলচেয়ারে বসে মাথা এলিয়ে আছেন বৃদ্ধা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি অসুস্থ। হুইল চেয়ারে সজীবের মাকে নিয়ে এসে সোজা অর্পনের সামনে দাঁড়ান রাবেয়া বেগম। উৎসুক চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,

—“আমার ছেলে কোথায়?”

—“এতো অধৈর্য হচ্ছেন কেনো? একটু অপেক্ষা করুন।”

এটুকু বলেই অর্পন পাশ থেকে একজন মহিলা পুলিশকে চোখের ইশারায় কিছু বোঝায়। অর্পনের ইশারা বুঝতে পেরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় সে। এগিয়ে এসে পেছন থেকে রাবেয়া বেগমের হাত পেচিয়ে ধরে। চমকে ওঠেন রাবেয়া বেগম। ছোটাছুটি করতে করতে বলে,

—“তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে অর্পন। আমাকে চলে যেতে দেবে বলেছিলে। তাহলে ওয়াদা ভঙ্গ করছো কিভাবে? এটাই কি তোমার সততা?”

—“আমি কি একবারও নিজের মুখে হ্যা বলেছিলাম?”

অসহায় বোধ করেন রাবেয়া বেগম। ছেলের চিন্তায় পাগল প্রায় অবস্থা তার। আকুতি ভরা কন্ঠে বলেন,

—“আমার শান কোথায়? কি করেছো তুমি ওর সাথে?”

—“কিছুই করিনি। শুধু একজন আদর্শ নাগরিকের দায়িত্ব পালন করেছি। আপনার মাদকাসক্ত ছেলেকে রিহ্যাব সেন্টারে পাঠিয়ে দিয়েছি। যেটা আপনার আরও আগে করা উচিত ছিলো।”

রাবেয়া বেগম বাকরুদ্ধ। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন।

——————–

ইদানীং অর্পনের মুড ঠিক নেই। কোনো কারণ নিয়ে ভিষণ চটে আছে সে। প্রাপ্তিকে কড়া কথা শোনাতেও দুবার ভাবে না অর্পন। এর কারণ হলো প্রাপ্তির চোখের অপারেশন। প্রাপ্তি কোনো ভাবে জেনে গেছে তার চোখের অপারেশন করালে দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এতে প্রাপ্তির মৃত্যুর ঝুঁকি আছে। কথাটা জানার পর থেকে প্রাপ্তি অপারেশন করাতে চাইছে। তবে অর্পন সম্মতি দিচ্ছে না। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে তুমুল ঝামেলা হচ্ছে। সেই ঝামেলার রেশ ধরেই অর্পন প্রাপ্তির সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।

যদিও অর্পনের রাগ দেখে প্রাপ্তি হার মেনে নেয়। তবুও অর্পন নিজের অবস্থান থেকে এক চুলও নড়ছে না। কথাও বলছে না। সেই সকল কথা ভাবতে ভাবতে মন খারাপ করে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রাপ্তি।

রাতে অর্পনের বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যায়। ঘরে ঢুকে প্রাপ্তিকে না দেখে এদিক সেদিক খুঁজতে থাকে। খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে বেলকনিতে পেয়ে যায় প্রাপ্তিকে। একদম বেলকনির মাঝ বরাবর রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছে প্রাপ্তি। উদাসীন চোখে তাকিয়ে আছে উপরের দিকে। চোখ দুটো হালকা ফোলা। কিন্তু কেনো? কাঁদছিলো কি? অর্পনের বুকটা ধক করে ওঠে। সে কি বেশি কঠোরতার দেখাচ্ছে প্রাপ্তির সাথে? মেয়েটাকে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেনি তো? ভাবতে ভাবতে নিঃশব্দে বেলকনির দড়জায় এসে দাঁড়ায় অর্পন। প্রাপ্তি উপরের দিকে তাকিয়েই বলে,

—“আর কি করলে আপনার ক্ষমা পাবো অফিসার? আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না?”

অর্পন নির্বাক। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে শুধু। প্রাপ্তি হালকা হেসে বলে,

—“আমার একটা বহু পুরনো ইচ্ছে আছে। পূরণ করবেন?”

—“কি ইচ্ছে?”

অর্পনের কৌতুহলী কন্ঠ। প্রাপ্তি ফের মুচকি হেসে বলে,

—“আমি ওই দূর আকাশের পাখি হবো। নিজের ছোট্ট দু’টি ডানা মেলে পুরো আকাশ ঘুরে বেড়াবো। তবে কথা দিলাম, দিন শেষে এই আপনার বুকেই ফিরে আসবো। দেবেন সেই স্বাধীনতা?”

—“আমার কাছে তোমার নিজেকে পরাধীন মনে হচ্ছে কি?”

—“নাহ্, আপনি আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন। তবুও আপনার কাছে আমার ছোট্ট একটা আর্জি।”

অর্পন নির্বাক। প্রাপ্তির কথার প্রেক্ষিতে কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। তার শব্দ ভান্ডারে যেনো শব্দের সংকট পড়েছে। প্রাপ্তি তাকে কথার জালে বেশ ভালোভাবেই জড়িয়ে নিয়েছে।

অর্পনকে উত্তর না দিতে দেখে মুচকি হাসে প্রাপ্তি। চোখে না দেখলেও পরিস্থিতি বেশ বুঝতে পারছে। প্রশঙ্গ বদলে হাতড়ে অর্পনের হাতটা আলতো করে ধরে। ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে,

—“ঘুম পাচ্ছে খুব। চলুন ঘুমাবো।”

নির্বাক অর্পন শব্দ বিহীন প্রাপ্তির সাথে চলে যায়। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীরের শক্তি কমে গেছে। তাই বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের দে-শে পাড়ি জমায় অর্পন। তবে ঘুম নেই প্রাপ্তির চোখে। সে চুপচাপ শুয়ে অর্পনের ঘুম গাঢ়ো হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। যখন বুঝতে পারে অর্পন গভীর ঘুমে মগ্ন তখন চোখ মেলে তাকায়। ডান কাতে ফিরে হাতের ওপর মাথা রাখে। বাম হাত দিয়ে ছুয়ে দেয় অর্পনের মুখ। সময় নিয়ে একটু একটু করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। আপন মনে বিড়বিড় করে বলে,

—“ক্ষমা করবেন অফিসার। এভাবে ঘুমের সুযোগ নিয়ে আপনাকে ছোঁয়ার জন্য। কি করবো বলুন? আমার চোখে যে আলো নেই। এই চোখে দৃষ্টি থাকলে সেই দৃষ্টি সর্বোক্ষন আপনাতেই স্থির থাকতো। একবার, দুইবার, বহুবার দেখতাম। কিন্তু সেই ক্ষমতা যে নেই আমার। তাই বার বার ছুয়ে অনুভব করি। মনের চোখ দিয়ে দেখি। রাগ করবেন না কেমন।”

ফিসফিস করে কথাগুলো বলে নিজেই লজ্জায় লাল নীল হয়ে যায় প্রাপ্তির। পরক্ষণেই আবার চেহারায় মলিন ভাব ফিরে আসে। ফিসফিস করে আপন মনে বলে,

—“আরও একবার ক্ষমা চাই। জীবনের এই প্রথম এবং শেষ বার আপনার অবাধ্য হচ্ছি। শেষ বারের মতো ক্ষমা করে দেবেন প্লিজ।”

দুই হাতে মুখ ঢেকে উল্টো দিকে শুয়ে পড়ে প্রাপ্তি। সে কি কান্না লুকাতে চাইছে? নাকি চোখের পাতায় ভেসে ওঠা না বলা কথা?

——————————–

সকাল সকাল থানায় চলে আসে অর্পন। ভেতরে ঢুকতেই! দীপ্তিকে বসে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ায়। দীপ্তি ততক্ষণে অর্পনের উপস্থিতি বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়িয়েছে। অর্পন কৌতুহলী কন্ঠে প্রশ্ন করে,

—“আপু আপনি! এতো সকালে! কোনো দরকার?”

—“সজীবের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম অর্পন। তুমি ছিলে না, তাই এখানে বসে অপেক্ষা করছিলাম আমি কি ওর সাথে দেখা করতে পারি?”

কিছুটা অবাক হয় অর্পন। কিন্তু কোনো দ্বিমত পোষণ করে না। চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।

অর্পনের সম্মতি পেতেই দ্রুত পায়ে সজীবের সেলের দিকে চলে যায় দীপ্তি। পথিমধ্যে একটা সেলে রাবেয়া বেগমকে দেখতে পায়। ধুলো জড়ানো ফ্লোরে অসহায় ভঙ্গিতে বসে আছেন তিনি। কিছুক্ষনের জন্য থেমে যায় দীপ্তির পা জোড়া।। রাজকীয় পোষাক পড়ে ঠাঁটে চলাফেরা করা মানুষটা আজ জমিনে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সবই তার কৃকর্মের ফল। এরপর দীপ্তির নজরে আসে নুহাশ। বেচারা মার খেয়ে ফ্লোরে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে পেটানো হয়েছে অনেক। সকলকে একজন দেখে সোজা সজীবের সেলের সামনে চলে আসে দীপ্তি। সজীব ফ্লোরে শুয়ে ছাঁদের দিকে তাকিয়ে ছিলো। মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছে হয়তো। দীপ্তি ধীর কন্ঠে ডাকে,

—“সজীব!”

শুয়ে থেকেই পাশ ফিরে তাকায় সজীব। দিপ্তিকে এখানে দেখে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। যেনো, নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তার বিস্মিত চোখের ভাষা বুঝে ফেলে দীপ্তি। সেলের ভেতরে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

—“এদিকে আসো সজীব। কথা আছে তোমার সাথে।”

এই পর্যায়ে সজীব নিশ্চিত হয় এটা আসলেই দীপ্তি। তার চোখের ভ্রুম বা মনের ভুল নয়। তড়িৎ গতিতে ছুটে আসে সজীব। দীপ্তির হাত জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো চুমু খায়। ধরা গলায় বলে,

—“তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো দীপ্তি?”

—“কিসের জন্য ক্ষমা করবো? আর কেনই বা ক্ষমা করবো? কম কষ্ট দিয়েছো আমাকে?”

সজীবের চেহারা মুহুর্তেই মলিন হয়ে যায়। তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

—“তাই তো। আমার পাপের কোনো সীমা নেই। ক্ষমা শব্দটা আমার জন্য নয়। ভাগ্যটাই যখন কালো, সেখানে আলোর আশা করাটাই ভুল।”

—“তোমার এতো কথা আমি শুনতে আসিনি। শুধু এটুকু বলতে এসেছি যে, জেল থেকে বেরিয়ে সোজা আমার কাছে আসবে। মা আর আমি অপেক্ষায় থাকবো তোমার জন্য। আমি নতুন করে বাড়িটা সাজিয়েছি সজীব। তুমি ফিরে আসার পর সংসারটাও নতুন করে সাজিয়ে নেবো।”

সজীবের চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। এটা দুঃখের অশ্রু নয়। এটা তো খুশির অশ্রু। দীপ্তির কথার অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে, দীপ্তি সজীবকে ক্ষমা করে দিয়েছে। আবার নতুন করে সব শুরু করতে চাইছে। সজীবের জন্য এরচেয়ে বেশি খুশির আর কিচ্ছু নেই।

——————————

সাগরের কেবিনে বসে কিছু রিপোর্ট ঘাটাঘাটি করছে অঙ্কন। পাশেই সাগর আয়েশ করে চা খাচ্ছে। রিপোর্ট দেখার এক পর্যায়ে অঙ্কন সাগরকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“শুনলাম দীপ্তি আপু নাকি সজীবের কাছে ফিরতে চাইছে। কথাটা জানো ভাই?”

—“অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটা তো হওয়ারই ছিলো। স্বামী স্ত্রী ওরা।”

সাগরের সহজ জবাব। মন মানে না অঙ্কনের। কোথাও একটা খাদ থেকেই যাচ্ছে। নজর তুলে অঙ্কন ধীর কন্ঠে বলে,

—“তোমার একটা সুযোগ নেয়া উচিত ছিলো ভাই৷ হয়তো দীপ্তি আপুর মন বদলে যেতো।”

চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে যায় সাগর। বুকের ব্যথা ফের দগদগে ঘা হয়ে ফিরে আসছে। এই অসয্য দহন আর কতকাল সইতে হবে কে জানে? কাপটা টেবিলে রেখে জানালার বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সাগর। উদাসীন কন্ঠে বলে,

—“সব প্রণয়ের গল্প সুন্দর হয়না অঙ্কন। কিছু গল্প অসমাপ্ত থাকে। আমি সেই অসমাপ্ত পথের একজন ব্যর্থ পথিক। দিশাহীন, কুল কিনারা বিহীন।”

—“তোমার খারাপ লাগছে না ভাই?”

—“সুপ্তির কোথাও বিয়ে হয়ে গেলে তোর কেমন লাগবে?”

সাগরের তৎক্ষনাৎ জবাবে থতমত খেয়ে যায় অঙ্কন। নজর লুকাতে মাথা নিচু করে ফেলে। সাগর হেসে বলে,

—“আমি জানি। আমার ভাইটা ওই, বদমেজাজি, রাগী, বোকা, ঝগড়ুটে বাচ্চা মেয়েটার প্রেমে পড়েছে। কিন্তু প্রেম নিবেদন করা তোর ব্যক্তিত্বের সাথে যায় না। তাই বলতে পারছিস না।”

—“প্রশঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছো?”

—“যে গল্পের শেষ পাতায় বিচ্ছেদ লেখা হয়ে গেছে। সেই গল্প আর নতুন করে পড়ার কিছু নেই অঙ্কন। এই কাহিনির সমাপ্তি এখানেই।”

দু’জনের কথার মাঝেই দড়জায় এসে ঠকঠক আওয়াজ করে একজন নার্স। হালকা মাথা ঢুকিয়ে বিনয়ের সাথে বলে,

—“স্যার, ওটি রেডি। আর ডক্টর রাহুল আপনাদের ডেকে পাঠিয়েছেন।”

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে সাগর বলে,

—“চল অঙ্কন, সময় হয়ে গেছে।”

অঙ্কনের চেহারায় সংকোচবোধ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। একরাশ অস্বস্তি নিয়ে সে বলে,

—“কাজটা কি ঠিক হচ্ছে ভাই? ভাইয়া জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”

—“দেখা যাক কি হয়। দোয়া করি সব যেনো ভালো হয়। এখন চল।”

অঙ্কনের চেহারায় স্পষ্ট ভয়ের আভাস। দুরুদুরু বুকে এগিয়ে যায় সাগরের সাথে। কে জানে, আজ প্রাপ্তির ভাগ্যে ঠিক কি আছে?

চলবে?