তারে আমি চোখে দেখিনি পর্ব-০৭

0
99

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ০৭
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

হসপিটালের সব ফর্মালিটি পূরণ করে প্রাপ্তির কেবিনে আসে সজীব। ডক্টর সাগরের সামনে দাড়িয়ে বিনয়ের সাথে বলে,

—“থ্যাঙ্কস এগেইন ডক্টর। আমার অনুপস্থিতিতে আপনি আমার বোনের খেয়াল রেখেছেন। আপনার প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।”

এবার অর্পনের দিকে ঘুরে দাড়িয়ে বলে,

—“আপনার কি আর কিছু জানার আছে অফিসার? নাহলে আমরা বাসায় চলে যাবো। বাসায় কেউ এখনো জানে না প্রাপ্তির সাথে ঘটা দূর্ঘটনার কথা। আশা করি আমার কথা আপনি বুঝতে পারছেন।”

—“যেতে পারেন আপনারা।”

অর্পনের সম্মতি পেয়ে সজীব প্রাপ্তির কাছে এগিয়ে আসে। প্রাপ্তির হাত ধরে বসা থেকে উঠিয়ে দাঁড় করায়। হাটুর আঘাতটা তুলনামূলক বেশি তাই দাঁড়াতে বেশ কষ্ট হচ্ছে প্রাপ্তির। সজীবের হাত শক্ত করে ধরে চোখ মুখ কুচকে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যথার জন্য পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতেই পারছে না। প্রাপ্তির যে দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে সেটা তার চেহারাতেই স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। অর্পন সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতেই সজীব হুট করে প্রাপ্তিকে কোলে তুলে নেয়। সুপ্তির দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলে,

—“চল ছুটকি।”

এটুকু বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় সজীব। এদিকে প্রাপ্তিকে কোলে তুলতে দেখে সেখানেই থেমে গেছে অর্পন। দুই হাত মুঠো করে ধরে চোয়াল শক্ত করে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। কেনো যেনো সজীবের প্রাপ্তিকে কোলে তোলা অর্পনের পছন্দ হলো না। হতে পারে সে প্রাপ্তির ভাই, কিন্তু তাই বলে কি হুট হাট কোলে তুলতে হবে? যখন তখন হাত ধরতে হবে? আশ্চর্য।

সজীব চলে যেতেই অর্পনের কাছে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে সাগর। দুই পকেটে হাত গুজে অর্পনের মুখোমুখি দাঁড়ায়। তীক্ষ্ণ চোখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলায় অর্পনের। সাগরের এমন দৃষ্টি দেখে ভ্রু কুঁচকে যায় অর্পনের। ভ্রু কুঁচকে রেখেই সন্দিহান কন্ঠে অর্পন বলে,

—“কি? এভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছো কেনো?”

—“কি, সেটা তো তুই বলবি? ব্যপার কি বলতো! আমাদের রাগী গম্ভীর পুলিশ অফিসার মাহবুব অর্পন খান আজ এমন অদ্ভুত বিহেব করছে কেনো?”

এবার পেছন থেকে এগিয়ে আসে অঙ্কন। সাগরের পাশাপাশি দাড়িয়ে পকেটে দুই হাত গুজে সুরু চোখে তাকিয়ে বলে,

—“ডালমে কুছ কালা হে সাগর ভাইয়া। আমিও খেয়াল করেছি ভাইয়ার এই অদ্ভুত আচরণ গুলো। কিছু একটা ব্যপার তো অবশ্যই আছে।”

দুজনে মিলে এভাবে চেপে ধরায় বেশ বেকায়দায় পড়ে যায় অর্পন। তড়িৎ গতিতে ভাবতে থাকে এদের প্রশ্ন থেকে কিভাবে বাঁচা যায়। কিন্তু কাজের সময় উপস্থিত বুদ্ধি যেনো ঘুমিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ ভেবে কোনো উপায় না পেয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়ায় অর্পন। একটা ছোট্ট কাশি দিয়ে গলা পরিস্কার করে বলে,

—“দেখো ভাই, তুমি যা ভাবছো এমন কিছুই না। তোমরা ভূল ভাবছো।”

—“আচ্ছা তাই। তাহলে ঠিক কোনটা তুই বোঝা আমাকে। আমি একজন হার্ট সার্জন। হার্টের অপারেশন করি আমি। আর তুই আমাকে দিয়ে ভাঙাচোরা জোড়া দিচ্ছিস। কাটা ফাট ড্রসিং করাচ্ছিস। কেনো? হসপিটালের প্রতিদিন এমন অনেক পেসেন্ট আসে। কই কখনো তো এমন অনিয়ম করার মতো পরিস্থিতি আসেনি। তুই নিজেও কিছু পেসেন্ট এনেছিস এখানে কিন্তু তাদের যে সমস্যা সেই ডক্টর তাদের ট্রিটমেন্ট করেছে। তাহলে এই মেয়েটা কি যেনো নাম, শক্তি না মুক্তি?”

অঙ্কন হুট করে জবাব দেয়,

—“ভাইয়া ওটা প্রাপ্তি।”

—“হ্যা, প্রাপ্তি। তার বেলায় ভিন্ন নিয়ম কেনো? তার বেলায় আমিই কেনো? কেনো কেনো কেনো? এর জবাব আমি চাই।”

সাগরের করা প্রশ্নের কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না অঙ্কন। আসলে সে এমনটা কেনো করলো তা নিজেই বুঝতে পারছে না। এ*ক্সি*ডে*ন্টে*র রোগীর ট্রিটমেন্ট করার জন্য অন্য ডক্টর নিযুক্ত আছে। কিন্তু অর্পন তাদের বাদ দিয়ে সাগরকে টেনে এনেছে প্রাপ্তির ট্রিটমেন্ট করতে। তার কারণ অর্পন অন্য কারো ওপর ভরসা করতে পারছিলো না। কিন্তু প্রাপ্তিকে নিয়ে তার এত মাথাব্যথা কেনো সেটা ভেবেই অর্পন অবাক। এমনটা করার তো কোনো কারণ ছিলো না। তাহলে এমন কেনো হচ্ছে? নিজের কর্মের কোনো মানে অর্পন নিজেই খুঁজে পাচ্ছে না।

এদিকে অর্পনকে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে দেখে সাগর হাতের ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়ি থেকে চোখ সরিয়ে বলে,

—“বেঁচে গেলি আমার এখন একটা অপারেশন আছে তাই। না হলে সব উত্তর আমি এখনই নিয়ে ছাড়তাম। যা, বাড়ি গিয়ে উত্তর রেডি কর। কাজ শেষ করেই আমি হাজির হবো তোর কাছে। মামিকে বলিস খিচুড়ি আর শুটকি ভর্তা করতে। এসে খবো।”

অর্পন নির্বিকার, সাগরের কথার প্রতিউত্তরে ঠিক কি বলা উচিত সেটা ভেবে পাচ্ছে না। সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে অর্পনের। কথাগুলো বলেই সাগর লম্বা লম্বা কদম ফেলে চলে যায়। সাগরের পেছন পেছন অঙ্কনও ছোটে। তবে যাওয়ার আগে অর্পনের দিকে আরো একবার সরু দৃষ্টিতে তাকাতে ভোলে না।

_____________

ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে টিভি দেখছে দীপ্তি। তার পছন্দের একটা মুভি চলছে টিভিতে। কিছুক্ষণ পর টিভির থেকে চোখ সরিয়ে একবার মেইন গেটের দিকে তাকায়। দুপুর গড়িয়ে গেছে অনেক্ষণ হচ্ছে কিন্তু প্রাপ্তি সুপ্তি এখনো বাড়ি ফিরলো না। সজীবও সেই যে বেড়িয়েছে, তারও কোনো খবর নেই। গেটের থেকে চোখ সরিয়ে নিজের সেলফোনটা হাতে নেয় দীপ্তি। কল লিস্ট থেকে একটা নাম্বার বের করে ডায়াল করে ফোনটা কানে ধরে। রিসিভ হতেই দীপ্তি প্রশ্ন করে,

—“আম্মা কেমন আছেন রুমা? খাবার খেয়েছে? ওষুধ দিয়েছিলি?”

রুমার কোনো আওয়াজ না পাওয়া গেলেও ওপাশ থেকে শোনা যায় কারো মোটা কন্ঠের কর্কশ আওয়াজ। ওপাশ থেকে দীপ্তির শ্বাশুড়ি রাবেয়া বেগম কর্কশ কন্ঠে বলে ওঠেন,

—“আজন্মের জন্য বাড়ি থেকে বিদায় হয়েছে নাকি? রুমা! মহারানীকে বল এক্ষুনি যেনো সে বাড়ি ফিরে আসে। সন্ধ্যার মধ্যে তাকে আমি আমার চোখের সামনে দেখতে চাই।”

এটুকু বলেই থেমে যান তিনি। কথা শেষ হতেই যে তিনি সেখান থেকে প্রস্থান নিয়েছেন সেটা তার ভারি কদমের আওয়াজ শুনে বোঝা যাচ্ছে। রাবেয়া বেগমের কদমের আওয়াজ থেমে যেতেই ওপাশ থেকে রুমা ফিসফিস করে বলে,

—“ভালো ভাবি, কেনো জানি আপনার ওপর বড় মা আজ খুব ক্ষেপে আছে। আপনারে সামনে পেলে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে নিতো। এতো রেগে কেনো আছে বুঝলাম না। দুপুরে ভাতও খায়নাই। ওষুধও ফালাই দিলো।”

ফোনের ওপারের বলা সবার সব কথা চুপচাপ শুনছে দীপ্তি। বুক চিরে বেরিয়ে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস। শ্বাশুড়ি তার প্রচন্ড কড়া। সংসার জীবনে দীপ্তি স্বামী নিয়ে খুবই সুখী। ভালোবাসার কোনো অভাব কখনো পড়তে দেয়নি সজীব। বিয়ের দিন থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে তাকে। দীপ্তির কোনো সখ, কোনো ইচ্ছা সজীব অপূর্ণ রাখনি। তবে শ্বাশুড়িকে নিয়ে দীপ্তি একটুও সুখী নয়। প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত শাসন করেন তিনি। তার ডিকশিনারিতে হয়তো স্বাধীনতা নামের কোনো শব্দই নেই।

দীপ্তিকে চুপচাপ থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে যায় রুমা। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে হাতে নিয়ে দেখে কল কেটে গেছে কি না। কিন্তু কল তো কাটেনি। তাই আবার ফোন কানে নিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বলে,

—“হ্যালো! ভালো ভাবি! কথা বলছেন না কেনো?”

এতোক্ষণে হুশ ফেরে দীপ্তির। ছোট্ট একটা শ্বাস নিয়ে রুমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—“হুম, আমি আজকেই বাসায় আসছি রুমা। তুই আম্মার খেয়াল রাখিস।”

এটুকু বলেই ফোনটা কেটে দেয় দীপ্তি। আর কোনো কথা বলতে ইচ্ছা করছে না তার। শ্বাশুড়ির কথা শুনে দিপ্তি এটুকু তো বুঝতে পেরেছে যে, যাই হয়ে যাক না কেনো তাকে আজ বাড়ি ফিরতেই হবে। না হলে বড় একটা ঝড় উঠবে।

দীপ্তির ভাবনার মাঝেই প্রাপ্তিকে কোলে নিয়ে রুমে উপস্থিত হয় সজীব। পেছন পেছন সুপ্তি এসেছে। এদিকে প্রাপ্তিকে সজীবের কোলে দেখে ভ্রু কুচকে যায় দীপ্তির। ভালো করে খেয়াল করতেই প্রাপ্তির শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ডেজ চোখে পড়ে। এটা দেখেই বিচলিত হয়ে পড়ে দীপ্তি। আহাজারি কন্ঠে বলে ওঠে,

—“কি হয়েছে প্রাপ্তির? এতো ব্যান্ডেজ করা কেনো ওর শরীরে? আর এতো রক্ত? তুমি কিছু বলছো না কেনো সজীব? কি হয়েছে আমার বোনের?”

দীপ্তির চিৎকার চেচামেচি শুনে বাসার সবাই সেখানে উপস্থিত হয়। মারুফ সাহেব মেয়ের অবস্থা দেখে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসেন। সাথে আসেন দিলারা বেগম। মেয়েকে সজীবের কোল থেকে নামিয়ে আস্তে করে সোফায় বসিয়ে দেন মারুফ সাহেব। দিলারা বেগম পাশে বসে এক হাতে মেয়েকে আগলে নেন। মেয়ের এমন করুন অবস্থা দেখে চোখ জলে ভরে গেছে তার।

কামরুল রহমান লাঠি ভর দিয়ে এগিয়ে এসে প্রাপ্তির পাশে বসেন। নাতনি শরীরের চোটগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। মারুফ সাহেব সজীবকে উদ্দেশ্য করে ব্যস্ত কন্ঠে বলেন,

—“এসব কি দেখছি বাবা? কি হয়েছে আমার মেয়েটার? ওর শরীরে এতো আঘাত কেনো?”

—“রাস্তায় একটা ছোট্ট এক্সিডেন্ট হয়েছে বাবা, তেমন কিছু না। ডক্টর দেখিয়েছি, তিনি বলেছেন কিছুদিন বেড রেস্টে থাকলে ঠিক হয়ে যাবে।”

মারুফ সাহেবের মন মানছে না। তিনি বিস্তারিত শুনতে ছটফট করছেন। ব্যপারটা বুঝতে পেরে সজীব মারুফ সাহেবের উদ্দেশ্যে বলে,

—“ছুটির পর প্রাপ্তি বাসায় আসার জন্য বেরিয়েছিলো। তখন রাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি যাওয়ার সময় ধাক্কা লেগে রাস্তায় পড়ে গেছে প্রাপ্তি। তেমন গুরুতর কিছু না বাবা। আপনি প্লিজ চিন্তা করবেন না।”

মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোধক সম্বোধন করেন মারুফ সাহেব। কিন্তু মেয়ের চিন্তায় মনটা এখনো বিচলিত হয়ে আছে। তিন মেয়ের মধ্যে প্রাপ্তিকে নিয়েই বাড়ির সবার একটু বেশি চিন্তা। তার কারণ প্রাপ্তির চোখে না দেখা। যদিও সজীব প্রাপ্তিকে সবসময় সাহস দিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে শিখিয়েছে। আর পরিবারের সাপোর্ট পেয়ে প্রাপ্তিও নিজের প্রতিবন্ধকতা ভূলে স্বাভাবিক ভাবে চলতে শিখেছে। তবুও তার মধ্যে কমতি যে একটা আছে সেটা শতভাগ সত্যি। তাই তো প্রাপ্তিকে নিয়ে মারুফ সাহেবের চিন্তা বেশি।

সবার প্রশ্নের জবাব দিয়ে সজীব প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে আসে। দিলারা বেগম প্রাপ্তিকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলেন। সজীব দিলারা বেগমের সামনে হাটু মুড়ে বসে বিনয়ের সাথে বলে,

—“আপনি কান্না কেনো করছেন মা? প্রাপ্তি দুর্বলদের একজন নয়। আমাদের প্রাপ্তি স্ট্রং গার্ল। আর রইলো আজকের কথা তাহলে সেক্ষেত্রে বলবো, জীবনে চলার পথে এমন ছোট বড় দুর্ঘটনা হয়েই থাকে। ধরুন এমন কিছুই হয়েছে। আমি প্রাপ্তিকে রুমে নিয়ে যাচ্ছি, ওর রেস্টের প্রয়োজন।”

সজীবের কথার সাথে সম্মতি জানিয়ে কামরুল রহমান বলেন,

—“দাদু ভাই ঠিক বলেছে বৌমা। প্রাপ্তি দিদিভাইয়ের বিশ্রামের প্রয়োজন।”

দিলারা বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ফেলেন। হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানান। শ্বাশুড়ির সম্মতি পেতেই সজীব আবার প্রাপ্তিকে কোলে তুলে নেয়। তারপর সোজা প্রাপ্তির রুমে নিয়ে চলে আসে। বিছানায় শুইয়ে হালকা করে চাদরটা টেনে দেয়। পেছন ঘুরতেই দেখে সুপ্তি পেছনে দাড়িয়ে আছে। এখনো কেউ রুমে আসেনি। সুপ্তি একবার দড়জার দিকে নজর বুলিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,

—“তুমি বাবাকে মিথ্যে কেনো বললে দাদাভাই? আপির কোনো এক্সিডেন্ট হয়নি।”

সুপ্তির কথা শুনে সজাগ চোখে তাকায় সজীব। দড়জার দিকে নজর রেখে সুপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

—“ওই কথা একদম মুখে আনবি না ছুটকি। তুই তো জানিস দাদু হার্টের রোগী। এসব শুনলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আর মার তো এমনিতেই প্রাপ্তিকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। এই কথা শুনলে চিন্তায় মা নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তাই চুপ থাকাই ভালো। যা হবার তা হয়ে গেছে, এখন এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল কেমন।”

সুপ্তি কিছু না বলে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। কোনো কারণে সুপ্তি ভয় পাচ্ছে। ভীষণ ভয়। ভয়ে চোখ মুখের নকশা পরিবর্তন হয়ে গেছে। মনের এই ভয় থেকে বাচার রাস্তা খুঁজছে সুপ্তি।

এরই মাঝে সেখানে উপস্থিত হয় দীপ্তি সহ পরিবারের সবাই। সবাই প্রাপ্তির পাশে বসে প্রাপ্তিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সবার মনোযোগ প্রাপ্তির দিকে দেখে দীপ্তি সজীবের হাত ধরে একটু দূরে নিয়ে যায়। সবার দিকে একবার নজর বুলিয়ে বেশ ধীর কন্ঠে বলে,

—“আম্মা না খেয়ে আছে। ওষুধও খায়নি। এখনই বাড়ি যেতে বলছে।”

দীপ্তির কথা শুনে হতাশার নিশ্বাস ছাড়ে সজীব। তার মা বড্ড জেদি। যখন মাথায় যে জেদ চাপে সেটা করেই ছাড়ে। মায়ের কথা অমান্যও সজীব করতে পারে না। মাকে যে সে বড্ড ভালোবাসে।

সজীবকে চুপ থাকলে দেখে চোখ জলে ভরে আসে দীপ্তির। ছলছল চোখে তাকায় বিছানায় শুয়ে থাকা প্রাপ্তির দিকে। বোনের এই অবস্থা দেখে কোথাও যেতেও মন চাইছে না। কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই। কারণ প্রাপ্তি জানে সজীব তার মাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। মায়ের ডাক সজীব কখনো অবজ্ঞা করবে না। অবশ্য এতে দীপ্তির কোনো অভিযোগ নেই। এই স্বার্থপরতার যুগে সজীব যে তার মাকে এতটা ভালোবাসা দিচ্ছে সেটা দেখে দীপ্তির গর্ব হয়। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে দীপ্তি বলে,

—“আমি রেডি হয়ে আসছি।”

পেছন ঘুরতেই দীপ্তি হাত ধরে ফেলে সজীব। অসহায় কন্ঠে বলে,

—“আজকে চলো প্লিজ। কথা দিচ্ছি তোমাকে এই বাড়ি আবার নিয়ে আসবো। তাও খুব তাড়াতাড়ি। তোমার উদাসীন চেহারা আমার বুকে তীরের মতো আঘাত করে দীপ্তি। সেটা কি তুমি বোঝো?”

দুই হাতে চোখ মুছে ফেলে দীপ্তি। মুখে লম্বা হাসি টেনে বলে,

—“আমার এখানে থাকার চেয়ে আম্মার কাছে যাওয়া বেশি জরুরি। আমি এটা বুঝি সজীব। আমি একদম মন খারাপ করিনি।”

মুচকি হেসে নিজের রুমে চলে যায় দীপ্তি। রেডি হয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দুজন। তবে যাওয়ার আগে সজীব বারবার করে বলে গেছে সবাইকে প্রাপ্তির খেয়াল রাখতে। সাথে কাল আবারও আসবে প্রাপ্তিকে দেখতে সেটাও বলে গেছে।

লাইব্রেরিতে একটা উপন্যাস হাতে নিয়ে বসে আছেন মারুফ সাহেব। পূর্ণ মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করছেন উপন্যাসের পাতায়। কিন্তু মনোযোগ দিতে পারছেনই না। পারবেন কিভাবে? নিজের মেয়ের এমন করুন অবস্থা দেখে কোনো বাবা কি পারে চিন্তা মুক্ত থাকতে। এমন সময় পেছন থেকে কারো পায়ের আওয়াজ পান মারুফ সাহেব। কেউ এদিকেই আসছে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখেন সুপ্তি এসেছে তার কাছে। ভয়ে পুরো জড়সড় হয়ে আছে মেয়েটা। মেয়ের ভয়ার্ত মুখ দেখে হাতের বইটা পাশের টেবিলে রেখে দেন। তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে সুপ্তির হাত ধরে চেয়ারে এনে বসান। হাঁটু মুড়ে সামনে বসে আদুরে কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

—“কি হয়েছে আমার ছোট আম্মুর? চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেনো? স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছো?”

সুপ্তি মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। মারুফ সাহেব ভ্রু কুঁচকে বলেন,

—“তাহলে?”

—“সে এসেছে বাবা। সেই পুরনো শত্রু। আপিকে তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো।”

সুপ্তির কথার কোনো মানেই খুঁজে পাচ্ছেন না মারুফ সাহেব। ভ্রু কুঁচকে ভাবতে থাকেন সুপ্তি কার কথা বলছে? কোন শত্রু। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই চমকে ওঠেন মারুফ সাহেব। তড়িৎ গতিতে তাকান সুপ্তির দিকে। ভয়ে সুপ্তি থরথর করে কাঁপছে। মারুফ সাহেব সুপ্তিকে একহাতে জড়িয়ে ধরে অভয় দিয়ে বলেন,

—“এই কথা কেনো বলছো আম্মু? ওটা তোমার মনের ভূল।তোমার আপির তো এক্সিডেন্ট হয়েছে।”

—“না! তোমরা সবাই চিন্তা করবে তাই দাদাভাই মিথ্যে বলেছে। আপিকে কেউ কিডন্যাপ করতে চেয়েছিলো বাবা। ওরা আপির এই অবস্থা করেছে। সেই শত্রু, পুরনো শত্রু।”

মারুফ সাহেবের কপাল ঘেমে গেছে। একহাতে সুপ্তিকে জড়িয়ে রেখে গভীর চিন্তায় পড়ে যান। সুপ্তির কথা যদি সত্যি হয় তাহলে প্রাপ্তির সামনে বিপদ! ঘোর বিপদ। মারুফ সাহেবের ভাবনার মাঝেই সুপ্তি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,

—“আ.. আমি কিছু করিনি বাবা। আমি কোনো অন্যায় করিনি। আমি কিছু করিনি।”

শুকনো ঢোক গেলেন মারুফ সাহেব। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলেন,

—“সুপ্তি আম্মু! বাবার ওপর ভরসা আছে তো?”

সুপ্তি উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোধক সম্বোধন করে। মারুফ সাহেব বোঝানোর ভঙ্গিতে বসে,

—“তাহলে আমার কথা মন দিয়ে শোনো। আজ যেটা হয়েছে সেটা শুধু একটা এক্সিডেন্ট। এছাড়া কিছুই না। তুমি পুরনো কথা একদম তুলবে না কেমন। সেই ঘটনা তুমি একেবারে ভূলে যাও। বাকিটা বাবা আছি তো, আমি সব সামলে নেবো। তুমি তো জানো এই কথা সবাই জানলে তোমার আপির বিপদ হবে। তোমার আপির কথা ভেবে সব ভূলে যাও আম্মু। আর এখন থেকে আপির সাথে সবসময় থাকবে। থাকবে তো?”

—“আচ্ছা।”

—“এই তো, সোনা আম্মু আমার। এখন যাও ঘুমিয়ে পড়ো। রাত বারোটা বাজতে যাচ্ছে। আর হ্যা সব ভূলে যাবে কেমন, সবটা।”

চলবে?