তারে আমি চোখে দেখিনি পর্ব-০৮

0
101

#তারে_আমি_চোখে_দেখিনি
#পর্বঃ০৮
#লেখিকা_সাম্মী_ইয়াসমিন

নিজের রুমে বসে কেসের ফাইল দেখছিলো অর্পন। ইভা নামের মেয়েটার কেসটা এখনও একই জায়গাতে আটকে আছে। কোনো ক্লু খুঁজে পাচ্ছে না অর্পন। ফাইলটা রেখে ডান হাতের দুই আঙুল দিয়ে কপাল স্লাইড করতে করতে কিছু একটা ভাবতে থাকে অর্পন। আজ ড্রা*গ*স নিয়ে আসা লোকগুলোকে অর্পন হাতে নাতে ধরতো। ওদের ধরলে অর্পনের লাইফের সবচেয়ে বড় কেসটা আজ সল্ভ হয়ে যেতো৷ প্রাপ্তির জন্য আজ জীবন যুদ্ধে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো অর্পন। সারাদিন প্রাপ্তিকে নিয়ে হসপিটালে ব্যস্ত থাকায় থানায়ও যেতে পারে নি। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে কপাল থেকে হাত সরিয়ে নেয় অর্পন। সামনের টেবিল থেকে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে ডায়াল করে কনস্টেবল রহিমের নাম্বারে। হসপিটাল থেকে ফিরে রহিমের সাথে একবারও কথা বলা হয়নি। ডায়াল করার সাথে সাথেই রিসিভ করে রহিম। যেনো অর্পনের ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলো। রিসিভ করেই রহিম ব্যাস্ত কন্ঠে বলতে শুরু করে,

—“স্যার, আপনি কোথায় ছিলেন? সেই কখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি আপনি কল রিসিভ করছেন না। একটা জরুরি খবর দেয়ার ছিলো।”

—“আগে একটা নিশ্বাস ছাড়ুন রহিম সাহেব। দম আটকে ম*রে যাবেন তো। দম নিয়ে তারপর বলুন কি খবর জানানোর জন্য এতো অস্থির হয়ে আছেন।”

অর্পনের গম্ভীর কন্ঠ শুনে থেমে যায় রহিম। তারপর একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে রহিম বলে,

—“স্যার, ইভা নামের মেয়েটার বিষয়ে কিছু ইনফরমেশন পেয়েছি। আপনাকে তো আগেই বলেছিলাম মেয়েটা এখানে তার স্বামীর সাথে থাকতো। তার স্বামীর নাম রুহুল। সে এখানে থেকে ঠিক কি কাজ করতো সেটা জানি না তবে সিলেটের একটা গার্লস হোস্টেলে তার কোনো আত্মীয় থাকে। প্রতি মাসে রুহুল ওই হোস্টেলের একটা নাম্বারে দশ হাজার করে টাকা পাঠায়। রুহুল আর ইভা যে বাসায় থাকতো সেখানে গিয়ে আশপাশের প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করায় তারা ওদের পরিবার সম্পর্কে তো কিছু বলতে পারেনি তবে একটা লোককে দিয়ে ওই গার্লস হোস্টেলের নাম্বারে টাকা পাঠিয়েছিলো। রুহুল কোনো একটা কাজে ব্যাস্ত থাকায় নিজে দিতে পারেনি তাই ওই লোককে দিয়ে পাঠিয়েছিলো। খবরটা তার থেকে পেয়েছি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে রুহুল কার কাছে টাকা পাঠাতো?”

রহিমের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো অর্পন, যেনো এই মুহুর্তে কথাগুলো শোনা সবচেয়ে জরুরি। রহিম কথা শেষ করতেই অর্পন বলে,

—“সেটাও জেনে যাবো যে কার কাছে টাকা পাঠাতে। কাল সকালে আমরা সিলেটের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছি রহিম সাহেব। প্রস্তুতি নিয়ে তারপর থানায় আসবেন।”

—“জ্বি স্যার।”

কথা শেষ হতেই কল কেটে আধশোয়া হয়ে বসে অর্পন। ফোনটা হাতে নিয়ে কিছু একটা ভাবতে থাকে। ভাবনা শেষ হতেই ফোনের লক খুলে ফেসবুক আইডিতে লগইন করে। কিছুক্ষণ ফেসবুক স্ক্রল করে চলতে থাকা হাত থামিয়ে দেয় অর্পন। তারপর কিছু একটা ভেবে প্রাপ্তি বিনতে রহমান লিখে সার্চ দেয়। সার্চ করার সাথে সাথেই প্রাপ্তির আইডি সবার আগে চলে আসে। প্রোফাইলে প্রাপ্তির কালো শাড়ি পড়া একটা ছবি আছে। ছবিটা দেখে মনে হচ্ছে বেশ কয়েকবছর আগের। ছবিটাতে প্রাপ্তির চেহারায় একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব ফুটে উঠেছে।

কিছুক্ষণ প্রাপ্তির ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে অর্পন আইডিতে ঢুকে দেখতে থাকে। আইডি স্ক্রল করে কিছুটা আশ্চর্য হয়ে যায় অর্পন। একটা বিষয় অর্পনের কাছে খুবই অদ্ভুত লাগে। বিগত পাঁচ বছরে মাত্র চারটা পোস্ট করেছে প্রাপ্তি। তাও প্রাপ্তির খালি গলায় গাওয়া গানের রেকর্ড সেগুলো। অর্পন গানগুলো শুনতে থাকে। প্রাপ্তির গানের গলায় প্রথম বেখেয়ালি হয়ে গেছিলো অর্পন। আজও তাই হচ্ছে। মুচকি হাসে অর্পন, নিজের ভাবনা দেখে নিজেরই হাসি পাচ্ছে। তবে প্রাপ্তির আইডিতে এতো গানের রেকর্ড পোস্ট করা দেখে এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে প্রাপ্তি গান গাইতে অনেক পছন্দ করে।

কিন্তু একটা বিষয়ে অর্পনের কৌতূহল যেনো কমছে না। কেনো যেনো হিসার মেলাতে পারছে না। প্রাপ্তি গত পাঁচ বছরে তার আইডিতে মাত্র চারটা পোস্ট করেছে। কিন্তু পাঁচ বছর আগে সে আইডিতে যথেষ্ট একটিভ ছিলো। আইডিতে প্রতিদিন প্রায় চার থেকে পাঁচটা করে পোস্ট হতো। কিন্তু কেনো? প্রাপ্তি যদি জন্ম থেকেই অন্ধ হয় তাহলে শুরুতে এতোটা একটিভ থাকতো কিভাবে? আর পাঁচ বছর আগে এমন কি হয়েছিলো যায় জন্য সে সোস্যাল মিডিয়া থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে।

বিষয়টা অর্পনের মাথায় জট পাকিয়ে যাচ্ছে। প্রাপ্তি যেহেতু অন্ধ সেক্ষেত্রে তার সোশ্যাল মিডিয়াতে একটিভ না থাকাই স্বাভাবিক কারণ সে তো কিছু দেখতে পারে না। সেই হিসাবে যদি গত পাঁচ বছরের এক্টিভিটি স্বাভাবিক হয় তাহলে পাঁচ বছর আগের এক্টিভিটি স্বাভাবিক নয়। সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে অর্পনের। এর পেছনেও কি কোনো রহস্য আছে? কিন্তু কি? প্রাপ্তি কি তবে জন্ম থেকে অন্ধ নয়? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সে দৃষ্টি শক্তি হারালো কিভাবে?

__________________

সকালে ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে দীপ্তি। রান্নাঘর থেকে খাবারের বাটি এনে দিচ্ছে রুমা আর দীপ্তি সেগুলো সাজিয়ে রাখছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে একবার করে তাকাচ্ছে শ্বাশুড়ির রুমের দিকে। কাল বাসায় ফেরার পথে জ্যামে আটকে গেছিলো সজীব আর দীপ্তি। একারণে বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছিলো। বাসায় এসে দেখে শ্বাশুড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই থেকে ভয়ে ভয়ে আছে দীপ্তি। কালকেই শ্বাশুড়ির সাথে দেখা হলে আর সমস্যা থাকতো না কিন্তু তার দেয়া সময়ের মধ্যে আসতে না পারায় ভয়টা মনে জেঁকে বসেছে। কে জানে, এখন দেখা মাত্রই কি তান্ডব শুরু করে।

এরই মাঝে সজীব নিচে নেমে আসে। অফিসে যাওয়ার জন্য একেবারে তৈরি হয়ে নিচে এসেছে। সজীব চেয়ার টেনে বসে তার মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হন রাবেয়া বেগম। টেবিলের কাছে এসেই দীপ্তিকে দেখে মুখ ঘুড়িয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে যান। স্থীর হয়ে তাকিয়ে থাকেন। দীপ্তি আর সজীব যে চলে এসেছে সেটা তিনি জানতেন না। তাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই দীপ্তির মুখ দেখবেন সেটা আশা করেন নি। কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই তাকিয়ে থেকে উল্টো ঘুরে রুমের দিকে হাঁটা দেন। শ্বাশুড়িকে যেতে দেখে পেছন থেকে দীপ্তি বলে ওঠে,

—“নাস্তা করে যান আম্মা। খাবার রেডি।”

রাবেয়া বেগম পেছনে ঘুরে কটমট চোখে তাকান দীপ্তির দিকে। কর্কশ গলায় বলেন,

—“খেতেই তো এখানে এসেছিলাম। কিন্তু তোমার মুখ দেখে খাওয়ার ইচ্ছে মরে গেছে।”

—“এভাবে কেনো বলছেন আম্মা। কি করেছি আমি?”

দীপ্তির এই কথাটা যেনো আগুনে ঘি ঢালার কাজ করলো। রাবেয়া বেগম রেগে আগুন হয়ে চেচিয়ে ওঠেন। রাগে ফুঁসে উঠে বলেন,

—“কি করেছো জানো না তুমি? কি করোনি সেটা বলো। বাবার বাড়ি গিয়ে মেয়েরা কয়দিন থাকে শুনি? আজন্মকালের জন্য গেছিলে নাকি? আমাকে কেনো আসার কথা বলতে হলো? তুমি এবাড়ির বৌ, তোমার কোনো দায়িত্ব বোধ নেই? সময় মতো কেনো বাড়ি ফেরোনি তুমি? শ্বাশুড়ির কথার কোনো দাম নেই তোমার কাছে? কোন কুক্ষণে যে তোমার মতো অপয়া একটা মেয়েকে ছেলের বৌ করে এনেছিলাম কে জানে। এই কাজের জন্য আজো আফসোস করতে হচ্ছে আমাকে।”

ঝাঁঝালো কণ্ঠে কথাগুলো বলেই নিজের রুমে চলে যান রাবেয়া বেগম। দীপ্তির চোখ দুটো ছলছল করছে। বিয়ের এতো বছরেও সে শ্বাশুড়ির মন জয় করতে পারলো না। শত চেষ্টা করেও সব বৃথা গেছে। রাবেয়া বেগমের তিক্ত কথা দীপ্তির মনকে বিষিয়ে দিয়েছে। কান্না চেপে রাখতে না পেরে দৌড়ে চলে যায় দীপ্তি নিজের ঘরে।

ডান হাতের দুই আঙুল দিয়ে মাথা চেপে ধরে বসে আছে সজীব। স্ত্রী আর মায়ের দন্দে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে সজীবের। কার পক্ষ নেবে আর কাকে কষ্ট দেবে সেটা ভেবেই মাথা কাজ করে না। একজন তার ভালোবাসা, হৃদয়ের রানী, তার প্রিয়তমা স্ত্রী আর অন্যজন তার জীবন, তার পৃথিবী, তার সবচেয়ে প্রিয় মা। আপনজনের এই দন্দে অসহায় সজীব দিশেহারা বোধ করছে। বুঝতেই পারছে না যে কিভাবে সবকিছু ঠিক করবে। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সজীব। পাশে দাড়ানো রুমার দিকে একবার তাকায়। মেয়েটা ভয়ে কাচুমাচু করে দাড়িয়ে আছে। সজীব তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে যায় রুমার সাথে । ইতস্তত করে রুমা বলে,

—“ইয়ে, ভাইজান। ভালো ভাবি তো কোনো দোষ করে নাই।”

—“আমি জানি রুমা, তোর ভালো ভাবির দোষ নেই। এখানে সব দোষ আমার। নিজের পরিবারকে সুন্দর ভাবে পরিচালনা করতে আমি ব্যর্থ।”

—“আপনি মন খারাপ কইরেন না ভাইজান। আপনি একবার বলেন, বড় মা আপনার কথা ঠিক শুনবো।”

—“দেখছি।”

ছোট্ট একটা জবাব দিয়ে মায়ের ঘরের দিকে এগিয়ে যায় সজীব। মাকে যে তার যে করেই হোক মানাতে হবে, যেভাবে এতোগুলা বছর মানিয়ে আসছে। তার পরিবারকে সে ভাঙতে দেবে না, কখনো না।

মায়ের ঘরে ঢুকে দেখে রাবেয়া বেগম জানালার কাছের চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। চোখ দুটো তার বন্ধ। কোনো কথা বলছেন না তিনি। সজীব ধীর পায়ে তার মায়ের কাছে এগিয়ে যায়। নিঃশব্দে হাঁটু মুড়ে বসে মায়ের দুই পা জড়িয়ে ধরে। পায়ের ওপর কারো অস্তিত্ব অনুভব করতেই চোখ মেলে তাকান রাবেয়া বেগম। তাকিয়ে দেখেন সজীব তার দুই পা জড়িয়ে ধরে কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। রাবেয়া বেগম স্বাভাবিক কন্ঠে বলেন,

—“এখন আমার কাছে কি চাই? তোর কাছে তো বৌ আর তার বাবা মা বেশি জরুরি। তাহলে আমার কাছে কেনো এসেছিস?”

মায়ের কথা শুনে মাথা তুলে তাকায় সজীব। মুচকি হেসে মায়ের একটা হাত মুঠোয় পুরে নিয়ে বলে,

—“কারণ তারা আমার বৌয়ের বাবা মা, আর আপনি আমার মা। আমার বাবা, আমার মা শুধু আপনি। আপনি আমার পৃথিবী আম্মা। তাহলে আমি কার কাছে যাবো?”

—“তাহলে বৌয়ের বাবা মায়ের কাছে কেনো গিয়েছিলি?”

—“আম্মা, আপনি যেমন আমার পরিবার ঠিক তেমন তারা তো দীপ্তির পরিবার। আমি কি করে দীপ্তিকে ওর পরিবারের থেকে দূরে রাখি। এতে যে আমার পাপ লাগবে আম্মা।”

রাবেয়া বেগম চুপ হয়ে যান আর কোনো কথাই বলেন না। কারণ তিনি জানেন তার ছেলের কাছে দীপ্তি বা তার পরিবারের বিষয়ে কিছু বলে লাভ নেই। ছেলে যে তার বিয়ের পর তাদের হয়ে গেছে। তাই ওকে এসব বিষয়ে কিছু বলা বেকার।

মাকে চুপ থাকতে দেখে সজীব ধীর কন্ঠে বলে,

—“আপনার কোনো কথার অবাধ্য কখনো হয়েছি আম্মা? হইনি তো। আর ভবিষ্যতেও হবো না। তাহলে আপনি এমন কেনো করছেন? দীপ্তি অনেক ভালো মেয়ে আম্মা, ওকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখুন।”

সজীবের কথা শুনে রেগে যান রাবেয়া বেগম। তড়িৎ গতিতে উঠে দাড়িয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলেন,

—“তোর সৃতি শক্তি কি দুর্বল হয়ে গেছে সজীব? ভূলে যাওয়ার রোগ কবে থেকে হলো তোর?”

—“আমার সৃতি শক্তি ঠিকই আছে আম্মা, আমি কিচ্ছু ভুলিনি।”

—“তাহলে কথা অনুযায়ী কাজ কেনো হচ্ছে না? সেদিন কোথায় গেছিলি তুই? কাজ কেনো শেষ হয়নি? ব্যবসায় কত লস হয়ে গেছে সেটা জানিস? খবর রাখিস সেসবের?”

মাথা নিচু করে ফেলে সজীব। কিভাবে মাকে ম্যনেজ করবে সেটা মাথাতেই আসছে না। পুরো মাথা কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মায়ের সামনে এসে দুই হাত মুঠো করে ধরে বলে,

—“আমি নিজের মতো করে কাজ করছি আম্মা। ব্যবসায় কোনো লস হবে না। আমি সব সামলে নেবো। আমার ওপর ভরসা রাখুন।”

—“জীবনের লক্ষ্য কখনো ভূলে যাস না সজীব। তুই ভূলে গেলেও আমি ভূলতে দেবো না তোকে। বার বার মনে করিয়ে দেবো তোর জীবনের লক্ষ্য কি। কারণ ওটা ভোলা যে চলবে না।”

সজীব উপর নিচ মাথা নাড়ায়। মায়ের সাথে সুর মিলিয়ে বলে,

—“আপনি যেভাবে চলতে বলেছেন আমি সেভাবেই চলেছি আম্মা। যখন যা করতে বলেছেন তাই করেছি। ভবিষ্যতেও আপনার কথা অনুযায়ীই চলবো। এখন আমার পরিস্থিতি একটু বোঝার চেষ্টা করুন আম্মা। প্লিজ খেতে চলুন।”

সজীবের এতো মিনতির সূর শুনে মন গলে যায় রাবেয়া বেগমের। মাথা নাড়িয়ে হা বোধক সম্বোধন করেন। মায়ের স্বীকারোক্তি পেয়ে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সজীব। সেখান থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। এখন বৌকে মানাতে হবে।

রুমে ঢুকে দেখে দীপ্তি বেলকনিতে দাড়িয়ে নিঃশব্দে কান্না করে যাচ্ছে। তবে দীপ্তির কান্না দেখে সজীব একটুও অবাক হয় না। এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু দীপ্তির চোখের পানি সজীবকে বড্ড কষ্ট দিচ্ছে। সজীব ধীর পায়ে এগিয়ে এসে দীপ্তির পাশাপাশি দাঁড়ায়। কন্ঠ খাদে নামিয়ে ডাকে,

—“দীপ্তি……… ”

সজীবের আওয়াজ শুনে দীপ্তি হাতের তালু দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেলে। সজীব আহত কন্ঠে বলে,

—“আমাকে বিয়ে করে তুমি সুখ নামক বস্তুটা পেলে না তাই না দীপ্তি?”

দীপ্তি চমকে পাশে তাকায়। সজীবের চোখ দুটোও ছলছল করছে। সজীব ব্যাথাতুর কন্ঠে বলে,

—“তুমি হয়তো আমাকে কাপুরুষ ভাবো তাই না দীপ্তি? ভাবারই কথা। কারণ আমি এমন একজন পুরুষ যে নিজের চোখের সামনে নিজের স্ত্রীকে অপমান হতে দেখে চুপ করে থাকি। কিভাবে প্রতিবাদ করবো বলো? প্রতিবাদ করতে যে আমাকে আমার আম্মার মুখোমুখি হতে হবে। যেটা আমি কখনো পারবো না।”

থেমে যায় সজীব। একটা লম্বা দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করে,

—“আমি আম্মাকে এতো ভালো কেনো বাসি জানো? কারণ আমি জীবনে আমার বাবাকে খুব কম সময়ের জন্য পেয়েছি। খুব ছোট থাকতেই বাবাকে হারাই। তখন থেকে আম্মাই ছিলো আমার সব। স্বামী ছাড়া একজন নারীর এ জগতে বেঁচে থাকা খুব কঠিন। আর সাথে একটা বাচ্চা থাকলে তো কথাই নেই। সমাজের শেয়াল শকুনেরা ছিড়ে খেতে চায়। তবুও আমার আম্মা দমে যায় নি। সিংহের মতো গর্জন করে নিজের সন্তানকে এ সমাজের শেয়াল, শকুনদের থেকে রক্ষা করেছে। আম্মা ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই দীপ্তি। তুমি ওনার প্রতি কোনো রাগ মনে পুষে রেখো না।”

সজীবের দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে দাড়ায় দীপ্তি। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দীপ্তি বলে,

—“আম্মার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই সজীব। আর রাগ কেনো করবো? উনি তো আমার মায়ের মতো। আসলে এখানে সব দোষ তো আমার। আমিই ভালো বৌ হতে পারিনি। বিয়ের এতো বছরেও আম্মাকে কোনো নাতি নাতনি দিতে পারিনি, এটা তো আমার ব্যার্থতা। তাই ওনার রাগ করারটা স্বাভাবিক। নিজের এই ব্যার্থতা আমাকে শান্তি দিচ্ছে না সজীব। একটা বাচ্চার অভাব আমি ভীষণ ভাবে অনুভব করছি। আমি মা হতে চাই সজীব। আমি মা হতে চাই। তুমি দেখো, আম্মার কোলে একটা নাতি দিতে পারলে আম্মা আমার প্রতি আর রেগে থাকবেন না।”

—“চেষ্টা তো করছি দীপ্তি। ভাগ্যে থাকলে নিশ্চয়ই হবে।”

—“আমি এতোকিছু বুঝি না। আমার বাচ্চা চাই ব্যাস। তুমি ডক্টরের সাথে আজই যোগাযোগ করো।”

—“ট্রিটমেন্ট তো চলছে দীপ্তি। সামনের সপ্তাহে আবার ডক্টরের কাছে যাওয়ার ডেট আছে। ভাগ্যে থাকলে নিশ্চয়ই হবে তুমি এসব নিয়ে একদম মন খারাপ করো না।আর বাচ্চা না হওয়ার জন্য নিজেকে একদম দোষারোপ করবে না।”

ওদের কথার মাঝেই রাবেয়া বেগমের উচ্চ স্বরে গলার আওয়াজ শোনা যায়। তিনি দীপ্তিকে উদ্দেশ্য করে উচ্চ কন্ঠে বলেন,

—“বৌমা, কোথায় গেলে? এখন আমাকে না খাইয়ে রাখবে নাকি?”

শ্বাশুড়ির গলা শুনে মুচকি হেসে সজীবের দিকে তাকায় দীপ্তি। তার শ্বাশুড়িকে যে সজীব মানিয়ে ফেলেছে সেটা বুঝতে আর দীপ্তির বাকি নেই। সজীবের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে দৌড়ে নিচে নেমে যায়। দীপ্তির যাওয়ার দিকে একনজরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সজীব। আপন মনে বিড়বিড় করে বলে,

—“সরি দীপ্তি! আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি যে নিরুপায়।”

চলবে?