তার নাম জানিয়েছি সূর্যাস্তকে পর্ব-১৭+১৮

0
19

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৭.
তিহুরা আজ বাড়িতে ফিরে যাবে। আসার সময় খালি হাতে আসলেও যাওয়ার প্রস্তুতি দীর্ঘ। তিহুর মা সূর্য পর থেকেই রান্নাঘরে পিঠা বানানোর আয়োজনে নেমেছেন। তিহু ঘুম থেকে উঠেছে খানিক পূর্বে। প্রোণো হয়তো জগিং এ বেড়িয়েছে। তিহু রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। চোখ মুখ কুঁচকে বলে,

‘এত পিঠা কে খাবে?’

‘এগুলো ওবাড়িতে নিয়ে যাবি। বিয়ের পর প্রথম বাবার বাড়িতে এসেছিস। খালি হাতে ফেরা যায়?’

তিহু জবাবা দেয় না। আশপাশে তাকিয়ে বলে,

‘বাবাকে দেখছি না যে!’

‘প্রোণোর সাথে জগিং এ বেড়িয়েছে সে। তোরা যাচ্ছি কখন?’

‘প্রোণো ফিরলেই।’

‘কিছুদিন থেকে যেতে পারতি তো!’

‘প্রোণোর ছুটি নেই বেশিদিন। তাছাড়া আমি থাকা না থাকায় বা তোমাদের কি আসে যায়। আমাকে বিদায় করতে পেরে তো তোমরা বেশ খুশি।’

শেষের কথাটা তিহু অভিমান ধরে রেখে বললো। মেয়ের অভিমান বুঝতে পেরে খানিক হাসেন সোহেলি। মেয়েটা তার ছোট থেকেই চঞ্চল। এই চঞ্চলতার জন্য তাকে কতশত হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তা বলার বাহিরে। ভেবেছিলেন বড় হলে বুঝতে শিখবে কিন্তু না তার মেয়ে গায়ে বড় হলেও বুদ্ধিতে কিছুতেই বড় হলো না। মেয়েকে সামলাতে না পেরে এনায়েত তালুকদার মেয়েকে বিয়ে দিবেন সিদ্ধান্ত নিলেন। সোহেলি এ বিষয়ে মোটেও রাজি ছিলেন না। কিন্তু এনায়েত তালুকদার ও এক কথার মানুষ। তার জেদের কাছে হার মেনে সোহেলিকেও রাজি হতে হলো। বিয়ের পর মেয়ের সাথে যোগাযোগ না রাখলেও মেয়ের শ্বাশুড়ির সাথে সবসময় যোগাযোগ ছিল তাদের। মেয়ে কি করছে কেমন আছে তার খোঁজ তারা সবসময়ই নিত। কেবল মেয়ে কান্নাকাটি করবে সেই ভয়ে তারা মেয়ের সাথে যোগাযোগ রাখেননি। ‘আগে মানিয়ে নিতে শিখুক’ এটা ছিল এনায়েত তালুকদারের কথা। কিন্তু এ কয়দিনে যে সত্যিই তাদের মেয়ে মানিয়ে নিবে তা তারা ভাবেননি। সোহেলি অবাক হয়েছিল তার সাথে খুশিও। মেয়েটা তার এতদিনে বড় হলো বুঝি! তবুও সে মেয়েকে প্রশ্রয় দিতে চায় না। আজ কঠিন হলে হয়তো মেয়েটা অভিমান করবে কিন্তু একদিন ঠিক সুখি হবে।

‘তোমার বাড়িতে তুমি ফিরে যাবে এটা খুবই স্বাভাবিক তবে বাবার বাড়িটাও তোমার অন্য একটা বাড়ি কাজেই এখানে দু একদিন থাকতেই পার যদি তোমার স্বামীর পার্মিশন থাকে।’

তিহু মায়ের কথায় মুখ বাঁকায়। বলে,

‘আমি বরং আমার স্বামীর সাথে তার বাড়িতেই ফিরে যাই এখানে অতিথি হিসেবে থাকার চেয়ে। আমি অলরেডি আমার বাড়ির লোকজনদের মিস করতেছি।’

তিহু কথা বলতে বলতে অন্যদিকে ঘুরে যায়। তার চোখ ভরে পানি আসছে। কেন আসছে তার জানা নেই কিন্তু তার ভিষন কান্না‌ পাচ্ছে। মাত্র এ কয়েকদিনে সবাই কিভাবে এতটা পর হয়ে গেলো। তার মা, বাবা সবাই যেন বহু দূরে চলে গেছে তার থেকে। এতদিনের পরিচিত এই ঘর বাড়ি সব তার পর পর লাগছে। মন চাচ্ছে এক ছুটে সেই রংচটা বাড়িটায় ফিরে যেতে। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে,

‘আমি আর ফিরে আসবো না। কখনো না।’

___________

গোলাপ ফুল গাছটার ডাল পালা মরে যাচ্ছে। ঠিকঠাক যত্ন নেওয়া হচ্ছে না। প্রিমা কাঁচি হাতে গাছের ডাল কাটছে। খানিক দূরত্ব রেখে প্রান্তি চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। হাতে তার খোলা বই। বই পড়ার উদ্দেশ্যে এখানে বসলেও তার ঠিক বই পড়া হয়ে উঠছে না। প্রিমাকে সে এই বইটা গত দু বছরে আর না হলেও দশবার পড়তে দেখেছে। তাই কিছুটা কৌতুহল বসত সেও বইটা পড়া শুরু করেছে। কিন্তু দু পৃষ্ঠার পর আর আগাতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ বই নিয়ে বসে থাকার পর বিরক্ত হয়ে সে প্রিমাকে বললো,

‘শর্ট করে কাহিনী বল তো। এটা আগামী দু বছরে শেষ করতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না।’

‘শর্টে বললে উপন্যাসের অরিজিনাল স্বাদ পাওয়া যায় না। ধৈর্য নিয়ে পড়তে হয়।’

প্রান্তির এ কথা পছন্দ হলো না। সে উপন্যাসের বিষয়ে আগ্রহী না। সে আগ্রহী এটা জানতে যে প্রিমা ঠিক কেন এই উপন্যাসটা এত পছন্দ করে।

‘আপু আপনিও বই পড়েন? আমি এই প্রথম দেখলাম আপনায় পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বই পড়তে।’

পরিচিত গলায় প্রান্তি চোখ মেলে তাকায়। সাবিহা গোটা গোটা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই সামান্য কথার প্রতিউত্তরের জন্য বেশ আগ্রহী সে। প্রান্তি তার আগ্রহকে অগ্রাহ্য করতে পারল না।

‘ঠিক পড়ছি না। সুপার হিউম্যানরা যেমন বই খুলে চোখের সামনে ধরলেই সবটা তাদের ব্রেইনে সেভ হয়ে যায় তেমন ভাবেই না পড়ে ব্রেইনে সেভ করার চেষ্টা চালাচ্ছি।’

প্রান্তির রশিকতা ভরা এই উত্তরে বেশ সন্তুষ্ট সাবিহা। বরং প্রান্তি যদি বলতো সে সখের বশে বই পড়ছে তা শুনে হয়তো সাবিহা অবাকের চুড়ায় পৌঁছে যেত।
সাবিহা নিজেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রান্তিকে দেখিয়ে বললো,

‘তাহলে এবার আমাকে দেখে বলোতো কেমন সুন্দর লাগছে?’

‘ভিষণ সুন্দর। একদম ঘাস ফুলের মতো সতেজ।’

প্রান্তি আর সাবিহার কথার মাঝেই প্রিমা বলে উঠলো,

‘কোথাও যাচ্ছ বুঝি?’

এতক্ষণ প্রিমাকে খেয়াল না করা সাবিহা প্রিমাকে দেখা মাত্রই চঞ্চল হয়ে উঠলো। উৎসাহিত গলায় বললো,

‘আপু তুমিও বের হয়েছ! শুনলাম বড় ভাইয়ার সাথে অভিমান করে তুমি ঘরবন্দি হয়েছিলে?’

প্রিমার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। সে সন্দিহান গলায় বলে,

‘এ কথা কে বললো?’

‘ভাইয়া বললো।’

‘তোমার ভাইয়া ঠিক কিভাবে জানল?’

‘তা তো বলতে পারি না। তবে ভাইয়া সেদিন হঠাৎ করে হাসতে হাসতে বলছিল, “ঝগরুটে মানুষগুলো ও অভিমান করতে পারে তাহলে!” এভাবেই জানতে পারলাম।’

প্রিমার মুখটা অস্বাভাবিক ভাবে লাল হয়ে আসে। লোকটা তার সাথে দুদন্ড কথা বলতে চায় না বুঝি একারণেই। তাকে কি সত্যিই ঝগরুটে লাগে?’

প্রান্তি নিজেও কিছুটা চমকিত। সাকিলকে সেই জানিয়েছিল কথাটা কাজেই সে বিষয় ঘুরাতে বললো,

‘বললে না তো কোথায় যাচ্ছ!’

‘ভাইয়ার জন্য মেয়ে দেখতে। এবার বিয়ে পাকা করে তবেই ফিরব। যদি পরিস্থিতি ভালো হয় একবারে বউ নিয়েও ফিরতে পারি।’

সাবিহা কথাটা শেষ করা মাত্রই কানে টান অনুভব করলো। সাকিল চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার কানটাও সাকিলের হাতের মুঠোয়।

‘এত বেশি কথা বলা শিখেছিস কবে থেকে?’

সাকিল চোখ ঘুরিয়ে প্রান্তির দিকে তাকায়। প্রান্তির চোখে মুখে বিষ্ময়। সাকিলের বিয়ের বিষয়টা কি সত্যিই বিষ্ময়কর ঘটনা? প্রিমার মুখে তাকানোর সুযোগ হলো না তার। প্রিমা তার আগেই বিনা বাক্যে বাড়ির ভিতরের দিকে চলে গেছে। সাকিল প্রিমার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ।

‘কংগ্রাচুলেশন সাকিল ভাই। ফিরে এসে মিষ্টি খাওয়াতে ভুলবেন না কিন্তু।’

প্রান্তির ঠোঁট জুড়ে হাসি। খানিক আগের সেই বিষ্ময়ভাব পুরোপুরি বিলিন হয়েছে যেন। সাকিলের মনে হলো সে ঠিক প্রান্তিকেও জানে না। প্রান্তিও তার বোনের মতোই রহস্যময়ী। এরা দু বোন কি ভাবছে কি চাচ্ছে তা পুরোটাই রহস্য।’

___________

‘তিহু আমার শার্ট দেখেছ?’

‘না তো।’

‘রাতে তো এখানেই রেখেছিলাম।’

‘আমি কি জানি!’

প্রোণো আবারো সব এলোমেলো করে খুঁজতে গেলে তিহু তাকে থামিয়ে দেয়।

‘আপনি কেমন বর বলুন তো? দেখলেন তো কত সময় বসে এগুলো গোছালাম আমি। আবার এলোমেলো করছেন কেন?’

‘তার আগে এটা বলো তুমি এগুলো কাবার্ড থেকে বের করেছ কেন?’

‘নিয়ে যাব তাই।’

‘কেন? ওখানে তোমার জামা নেই?’

‘অবশ্যই আছে। হাতো গোনা কয়েকটা। আমার বর তো আর অন্যসবার বরদের মতো অপচয় পছন্দ করেনা। তাই ভাবলাম এগুলো বা এখানে ফেলে রেগে কি করবো, তার
থেকে বরং নিয়ে যাই!’

প্রোণো ছোট চোখ করে তাকায়। বলে,

‘বেশ, নিয়ে চলো। তবে তোমার বর অতটাও কৃপন নয় যে তোমার জন্য পরনের কাপড়টাও কিনে দিবে না! কিন্তু আমার শার্টটা কোথায়? একটু খুঁজে দেখ। আমি পাচ্ছি না তো।’

‘আপনি না খুঁজে পেলে আমি কিভাবে পাব বলুন তো? আপনার থেকে দুটো চোখ কি আমার বেশি আছে?’

প্রোণো হার মানে। সে এই তর্ক যুদ্ধে কখনোই জিততে পারবে না। আর না সে তার শার্ট খুঁজে পাবে। কিছু দুর্ঘটনা বশত হারিয়ে গেল খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু যদি কিছু ইচ্ছাকৃত ভাবে কেউ হারিয়ে ফেলে তা সে কিভাবে খুঁজে পাবে? প্রোণো বেডের উপর বসে। তিহুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

‘কি পড়বো আমি?’

তিহু হাসি হাসি মুখে বলে,

‘সে কি কথা! খুঁজে পাননি বুঝি? কি আর করার, বাবার একটা ফতুয়া এনে দেই?’

প্রোণো বা-হাতে নিজের মাথার চুল টানে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু গভীর ভাবনা চিন্তা করে। বলে,

‘যা করতে চাইছো করো তিহু। আমি আমার মত পরিবর্তন করার আগে তোমার কাজ শেষ করো। নয়তো বিপদে পড়ে যাবে।’

চলবে……….

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৮.
টেবিলে বেশ কয়েক পদের নাস্তা দেওয়া হয়েছে। জামাই আপ্যায়নে কোনো রকম কমতি রাখেননি সোহেলি। এত রান্না হচ্ছে অথচ সকাল থেকে এক গ্লাস পানিও মুখে তোলেননি তিনি। এত কাজ একা হাতে সামলে পানি খাওয়ার সময়টুকু পাচ্ছেন না। তার আবার ডায়াবেটিস। নিয়ম করে খাবার, ঔষধ খেতে হয়। নিয়ম ভাঙলেই শরীরে অস্থিরতা অনুভব হয়। এখনও হচ্ছে। আর অল্প কিছু পিঠা ভাঁজতে বাকি আছে। কিন্তু চুলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তরতর করে ঘাম ঝরছে। ঠিক তখনই এসে পড়ে তিহু—হাতে নাস্তার প্লেট। রুটি আর সবজি তাতে।

‘মা, খেয়ে নাও। ঔষধ আছে না?’

‘হাতের কাজটা শেষ করে খাচ্ছি। তুই গিয়ে প্রোণোকে নাস্তা দে।’

তিহু খাবারের প্লেটটা পাশে রাখে। বলে,
‘তুমি দাও গিয়ে। সাথে সাথে তুমিও খেয়ে নাও। পিঠা আমি ভাঁজছি।’

‘তুই পারবি না রে মা!’

‘পারব না বলে হাত গুটিয়ে থাকলে হবে? ও বাড়িতে আমায় কে এসব করে দেবে?’

সোহেলি শান্ত হয়। সে পাশে দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েকে পিঠা ভাঁজতে শেখায়। এভাবে হাতে ধরিয়ে কোনো কাজ সে মেয়েকে শেখায়নি কখনো। মেয়েটার কখনোই কাজের প্রতি আগ্রহ ছিল না।

এনায়েত তালুকদার সোফায় গা এলিয়ে বসে আছেন। বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলছেন। বয়স হয়েছে তার, এ বয়সে দৌড়ে বেড়ানো সহজ কাজ নয়। তিনি পাক্কা এক ঘণ্টা জগিং করেছেন। ডাক্তার বলেছে জগিং শরীরের জন্য ভালো। কিন্তু তার মতো মানুষদের কথা হয়তো বলেনি। যা করলে কিছুক্ষণের মধ্যে মরে যাবো—এমন অনুভূতি হয়, তা কিভাবে শরীরের জন্য ভালো হতে পারে? তার উপর দৌড়ানোর সাইড ইফেক্ট হিসেবে এখন তার অত্যন্ত ক্ষুধা অনুভব হচ্ছে। কিন্তু জামাইকে রেখে একা খাবার টেবিলে বসাটাও কেমন যেন অশোভন।

‘বেলা হয়েছে অনেক। চলো, জামাই—নাস্তাটা সেরে ফেলি।’

প্রোণোর পরণে এখনো জগিংয়ের পোশাক। অন্য সময় হলে এতক্ষণে তার গোসলও শেষ হয়ে যেত। কিন্তু তিহুর করা ভয়ংকর প্রাঙ্কটার জন্য সে ফেঁসে গেছে।

‘বাবা, আমাকে গোসল করতে হবে।’

‘হ্যাঁ, যাও তাহলে। ঝটপট গায়ে দুই মগ পানি ঢেলে আসো।’

প্রোণো হাত গুটিয়ে বসলো। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,
‘বাবা, আসলে আমার শার্টটা হারিয়ে গেছে…’

প্রোণো এটুকু বলে থামে। লজ্জায় তার গাল, কান লাল হয়ে উঠেছে।
এনায়েত তালুকদার ভ্রু কুঁচকান।

‘ঘরের মধ্য থেকে কিভাবে চুরি হলো?’

প্রোণো জবাব দেয় না। সে কিভাবে বলবে যে চোরটা অন্য কেউ নয়—সয়ং তার মেয়ে?

‘আচ্ছা, আমি কাউকে পাঠাচ্ছি মার্কেটে। শার্টের সাইজ আর কেমন শার্ট, তা বলে দাও।’

‘না, তার ঠিক দরকার নেই। আপনার কোনো শার্ট বা ফতুয়া থাকলে সেখান থেকে একটা দিলেই হবে।’

এনায়েত কিছু একটা ভাবলেন। পরক্ষণে হো-হো করে হেসে উঠলেন। তার হাসি গর্বের হাসি।

‘এই কথা! সে তোমার যেটা পছন্দ, তুমি নিতে পারো। তুমি তো আমার নিজের মানুষ! আমার ফতুয়া গুলো আমি বসুন্ধরার “জেন্টাল ওয়্যার” থেকে নিই। ওদের পোশাকের ভাবই আলাদা। এই দেখো, তোমার মতো ইয়াং ছেলেরাও এখন আমার স্টাইল পছন্দ করছে! ভালো ভালো! হা হা হা… তুমি জামাইই সত্যিই একজন দক্ষ লোক! তোমার চোখ আছে! যাও যাও, যেটা খুশি নাও।’

প্রোণো মুচকি হাসে কেবল। মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মুরুব্বি মানুষ যা ভাবতে চাইছে ভাবুক। আপাতত বাড়ি পর্যন্ত কিছু গায়ে জড়িয়ে ফিরতে পারলেই চলবে।

____________

তিহু মায়ের রুম থেকে সুই-সুতা চুরি করেছে। তার মা সুই-সুতা কাঠের আলমারির মাঝে তুলে রাখেন। বাবার ফতুয়ার বাটন ছুটে গেলে যত্ন করে সেলাই করে দেন। তাই সুই-সুতা তার মায়ের কাছে এক প্রকার রত্ন।

তবে এই চুরির পেছনে তার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। প্রোণোর কাছ থেকে চুরি করে রাখা শার্টটায় সে কিছু আঁকিবুঁকি করতে চায়—যেন মানুষটা দূরে গেলেও, যখন এই শার্ট গায়ে জড়াবে তখন তাকে অনুভব করতে পারে।

ইউটিউব থেকে সে সেলাই করা শিখেছে। প্রোণোর শার্টের বা পাশের বুকের কাছে সে সাদা সুতায় তার নাম গেঁথে দেবে। প্রোণো দেখলে কি রাগ করবে? করুক না হয়।
মানুষটা নয়তো দূরে গিয়ে ভুলে বসবে—সে এখন বিবাহিত। তার সুন্দর, গোল গাল একটা বউ আছে। এরপর দেখা যাবে ছয় মাস, বছরের পরেও তার বরের খোঁজ নেই।
তিহু তা কিভাবে সহ্য করবে?
সেসব ভয়ংকর কথা ভাবলেই মন ভার হয়ে আসে তার। মনে হয়, মাথার উপরে থাকা সূর্যটা কালো হয়ে আসছে। পৃথিবী থেকে সব আলো যেন মিলিয়ে যাচ্ছে।
তিহু নিজের এই অধঃপতনে অবাক হয়। কিভাবে সে এমন একজন মানুষের প্রেমে পড়তে পারে?
Just how !!

ঘড়িতে সকাল দশটা সতেরো বাজে। সূর্যের আলোয় বাড়ির পূর্বদিক ঝলমল করছে। দু-একটা কাক এসে সদর গেটের উপর বসেছে—এ বাড়ির নির্ভরযোগ্য পাহারাদার যেন তারাই। গোছগাছ সেরে তিহু নিচে নেমে এল। পরনে ছাই রঙের সুতির শাড়ি—মায়ের শাড়ি, যেটা তিহু চেয়ে নিয়েছে। প্রোণোও তার বাবার কাছ থেকে এমন ছাই রঙের এক ঢোলাঢালা ফতুয়া নিয়েছে। ঐ ঢোলাঢালা পোশাকেও লোকটাকে চমৎকার লাগছে।

পৃথিবীতে কিছু মানুষ যেন এমনভাবে জন্মায়, যাদেরকে কী পরানো হলো সেটা বড় বিষয় না—কাকের পোশাক পরালেও নজরকাড়া লাগবে। তার বরটা সেই দলের একজন। নজরকাড়া,বুদ্ধিমান এবং বউকে ভুলে যাওয়া মানুষ।
তিহুর আজকাল ইচ্ছে করে, কৌটায় করে হাঁড়ির নিচের কালি নিয়ে ঘুরতে। উঠতে বসতে বরের কানে পেছনে সে তিলক টেনে দিবে, যেন নজর না লাগে!

প্রোণো আগেই রিকশা ঠিক করে অপেক্ষা করছিল। তিহুকে এগিয়ে দিতে এলেন সোহেলি, সাথে আরও কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন। কিন্তু তিহু খুঁজে পায় না তার বাবাকে। আসার পর থেকে বাবার সাথে তেমন কথা হয়নি—আজও হলো না? বিয়ে দিয়ে কি তবে বাবা একটা দায় মিটিয়ে দিলেন?

অভিমানে চোখে জল আসে তিহুর। কিছু বলে না। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চুপচাপ রিকশায় উঠে বসে। বুকের ভিতর একটা কষ্ট বাজে ভাবে তাড়া করছে তাকে। যন্ত্রণা হয় খুব।

তিহুর মনে হয় পরিবার জিনিসটা আসলেই জটিল। অনেকটা মাছ ধরার জালের মতো।
তিহুর নিজের পরিবার কোনটা? যেটাকে পেছনে ফেলে যাচ্ছে, নাকি যেটার দিকে এগিয়ে চলেছে?
এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো সে কখনোই খুঁজে পাবে না।

‘মন খারাপ লাগছে?’

‘হুম।’

‘আইসক্রিম খাবে?’

‘হুম।’

‘কয়টা?’

‘অনেকগুলো।’

‘কোনো পছন্দের ফ্লেভার?’

‘ক্যারামেল বাদে সব।’

‘আচ্ছা।’

প্রোণো রিকশা থামায় একটা সুপারশপের সামনে। তিহুকে অপেক্ষা করতে বলে সে একাই যায়। ফিরে আসে দু হাত ভর্তি আইসক্রিম নিয়ে। সে সত্যিই অনেকগুলো ফ্লেভার এর আইসক্রিম এনেছে। তিহুর হাতে আইসক্রিমের ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বললো,

‘ওদের এখানে অরেঞ্জ আর ম্যাংগো নেই। অন্য কোথাও থেকে কিনে দিব কেমন?’

তিহু মাথা নাড়ায়, চোখে হালকা হাসি।
তার এখন বেশ ফুরফুরে লাগছে।
বিয়ের পরের জীবনটা—হ্যাঁ, এতটা খারাপও নয়!

_____________

প্রিমা সেই সকাল থেকে মুখ ভার করে বসে আছে। ঠিক মুখ ভার বলা যায় না। সে অন্যদিনের থেকে বেশি বেশি কাজ করছে। এই যেমন গোছানো কাপড় এলোমেলো করে আবার গোছানো। পড়ার টেবিল থেকে সব বই নামিয়ে নতুন ভাবে গোছানো। সব শেষে মায়ের রুমের আলমিরা থেকে কাপড় নামিয়ে গোছাতে শুরু করেছে। মোছাদ্দেফা মেয়ের কাজে অবাক হলেন না। কোনো বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করলে বা রেগে থাকলে প্রিমা এমন ব্যবহার করে। মোছাদ্দেফা চোখের চশমা ঠিক করতে করতে বললেন,

‘সময় থাকলে আমায় এক কাপ চা করে দিও প্রিমা।’

প্রিমা কথা বললো না। নিঃশব্দে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

মোছাদ্দেফা ফুস করে শ্বাস ফেললেন। বাচ্চাগুলো আর কতদিন রেগে থাকবে? তার সত্যিই খুব একা লাগছে।

প্রিমা বেরিয়ে যাওয়ার খানিক বাদেই প্রান্তি এলো। রুমে উঁকি দিয়ে হয়তো প্রিমাকেই খুজলো। সে চলে যেতে নিলে মোছাদ্দেফা বললেন,

‘প্রোণো আর বৌমা ফিরেছে’

‘এখনো ফেরেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।’

‘ভেতরে এসো। বসো। কথা বলি।’

প্রান্তি কিছু বললো না তবে এগিয়ে এলো।
মোছাদ্দেফা বিছানায় হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো,

‘দাঁড়িয়ে কেন, এখানে এসে বসো।’

প্রান্তি বিনা বাক্যে এগিয়ে গেল। বাধ্য মেয়ের মতো মায়ের দেখিয়ে দেওয়া জায়গায় বসলো। ভাই বোনদের মধ্যে প্রান্তি সবথেকে বাধ্য ধরনের। কারো কথা অমান্য করেছে বলে শোনা যায়নি কখনো। একই ভাবে সে ভিষণ শান্ত, ভদ্র এবং নরম মনের। মায়ের থেকে এই দূরত্বতায় সবথেকে বেশি আহত এই বাচ্চা মেয়েটা। সারাক্ষণ মায়ের আঁচল ধরে হেঁটে বেড়ানো মেয়েটা এতটাদিন মায়ের উপর রাগ করে আছে ভাবতেই চোখ ভিজে ওঠে মোছাদ্দেফার। বাচ্চাদের সাথে অনেক অন্যায় করে ফেলেছেন তিনি। অনেক অন্যায়!

চলবে……..