তার নাম জানিয়েছি সূর্যাস্তকে পর্ব-১৯+২০

0
16

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৯.

চা থেকে কুয়াশার মতো হালকা ধোঁয়া উঠছে। কুণ্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়াগুলো বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে একসময়। প্রান্তি একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। যেনো সে কিছু ভাবছে, এমন না—বরং কোনো ভাবনা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতেই ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সে। ধোঁয়ার ভেতর কিছু আবিষ্কারের ক্ষমতাও তার নেই। তবুও চুপ করে বসে থেকে ধোঁয়া দেখা তার এক ধরনের মানসিক আশ্রয়। নিজের ভেতর জমে থাকা চিন্তাগুলো থেকে দূরে থাকার একটি বাহানা।

মোছাদ্দেফা চা খাচ্ছেন একটু ভিন্নভাবে। তিনি কাপের গরম চা পিরিচে ঢেলে তাতে চুমুক দিচ্ছেন। গরম চা তাঁর সহ্য হয় না, আবার বাতাসে রেখে পুরোপুরি ঠান্ডা চাও ভালো লাগে না। পিরিচে ঢালামাত্রই চা দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যায়—তাতেই তাঁর শান্তি। চায়ে চুমুক দিলেই বুকের ভেতর প্রশান্তি নামে। কতদিন পর মেয়ের হাতের চা খাচ্ছেন তিনি! এই সামান্য চা তাঁর কাছে এক অসামান্য ঠেকছে।

আর এই যে তাঁর পাশে ছোট মেয়ে বসে আছে, এটাও তাঁর ভালোলাগার বড় কারণ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে একাকিত্বও বাড়ে। তাঁরও বেড়েছে। মানুষের সঙ্গ ভালো লাগে—না বললেও অন্তত শুনতে তো পারে। আবার কখনো কখনো শব্দ ছাড়াও, শুধু পাশে বসে থাকা—এটুকুই হয়ে ওঠে বড় প্রাপ্তি।

এখন যেনো সেই মুহূর্ত চলছে—মা-মেয়ের নিঃশব্দ এক মিলনায়তন।

প্রিমা খানিক পরে এলো, হাতে নাস্তার প্লেট নিয়ে। রান্নার প্রতি তার ভালোলাগা বরাবরই ছিল, তবে ব্যস্ততার কারণে খুব কম সুযোগ পেত সে নিজে রান্না করার। আজকের দিনটা সে বিশেষ মনে করছিল, তাই নিজের হাতে সবাইকে রান্না করে খাওয়ানোর ইচ্ছে পোষণ করল। তিহুরাও ফিরছে আজ, কিন্তু তার ছোট ভাবি গতকাল ভাইয়ার ওপর রেগে বাবা বাড়িতে চলে গিয়েছিল। রাগ কমে যাওয়ায় সকালেই ফিরে এসেছে, তবে এই ঘটনা বাড়ির অর্ধেক মানুষই জানে না। আর প্রিয়মও আসবে আজ, তার অসুস্থ স্ত্রীর সঙ্গে। সব মিলিয়ে আজ পরিবারের সবাই একত্রিত হবে — এমন একটা দিনে প্রিমা নিজ হাতে রান্নার প্ল্যান করে বসেছে। সে যথাসম্ভব তার মন খারাপের বিষয় সকলের থেকে আড়াল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন নয় যে কেউ জানতে পারলে তার মন ভালো হয়ে যাবে। তাহলে লোককে মনের খবর জানিয়ে লাভ কি? কোনো লাভ নেই। নিজের এই হিসেবে দাঁড়িয়েই প্রিমা তার আবেগকে আড়াল করেছে একবার,দুবার নয় শতবার।

____________

তিহুরা যখন ফিরলো, তখন প্রায় দুপুর তিনটা বেজে গেছে। ঘন জ্যামের কারণে একঘন্টার পথ তারা তিন ঘন্টা ধরে পাড়ি দিয়েছে। তিহু জ্যামে আটকে থেকে প্রোণোর কিনে দেওয়া আইসক্রিমগুলো খেল—তবে সবগুলো নয়, বাকিগুলো গরমে গলে সাগর হয়েছে। নামতে নামতে তিহু প্রোণোর দিকে তাকিয়ে বললো,

‘আপনি একসাথে এতগুলো কেন নিলেন? অযথা নষ্ট হলো না?’

প্রোণো ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে উত্তর দিল,

‘তুমি চাইলে বলেই নিলাম, নয়তো বদনাম হতো।’

‘কার বদনাম হতো?’

তিহু ভ্রু তুলে প্রশ্ন করল।

‘নিঃসন্দেহে আমার।’

তিহু বিভ্রান্ত হয়ে ভ্রু বাঁকিয়ে বললো,

‘কেন হতো? কে করতো বদনাম?’

প্রোণো দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলো, তারপর হাতে চুল উল্টে বলল,

‘আমার বউ ছাড়া অন্য কাউকে বদনাম করতে দেখিনি, তাই শিওর বলতে পারছি না আর কে কে করতে পারে।’

তিহু এবার বুঝলৌ প্রোণো ঠিক কি বলতে চাইছে। তাই সে ও দুষ্টুমির সুর ধরে একটু মুচকি হেসে বলল,

‘তাহলে তো আপনার বউই সবচেয়ে ক্ষমতাবান!’

প্রোণো ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল,

‘আসলে তাই, তাই তো আমার সম্মান-ইজ্জত সবকিছু তারই হাত ধরে।’

দুজনের মধ্যকার সেই হালকা মজা, আর গরমের ভ্যাপসা দুপুরের ক্লান্তি যেন একটু হালকা করে দিল। তিহুর মনে হল, দূরত্বের ক্লেশ কিছুই না, যখন এমন ছোট ছোট মুহূর্তগুলো থাকে।

___________

প্রোণোর ফিরে যাওয়ার দিন ঠিক হয়েছে। সেই খবর শোনার পর থেকেই তিহু কেঁদে চলছে। সে মোটেও ইচ্ছাকৃত ভাবে কাঁদছে না, বরং কান্না থামাতে গিয়ে আরও বেশি কাঁদছে। দু’হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে সে বারবার নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু অশ্রু যেন থামতেই চাইছে না।

প্রোণো নিস্পৃহ ভঙ্গিতে কাউচে বসে আছে, হাতে একটি আপেল। কামড় বসাতে বসাতে সে চুপচাপ তিহুর কান্না দেখছে। তিহুর চোখে জল, গলায় কাঁপুনি—সবই যেন তার কাছে এক রকম চেনা দৃশ্য। সে একবারও উঠে তিহুকে থামানোর চেষ্টা করছে না। তাকে কাঁদতে দিচ্ছে। এতে যদি মন হালকা হয়!

ঘরের দরজায় প্রান্তি দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটি ছোট বাটি, তাতে আইসক্রিম। প্রোণোর কাছে শুনেছে, তিহুর আইসক্রিম পছন্দ খুব। তাই তাকে একটু সান্ত্বনা দেওয়ার আশায় আইসক্রিম নিয়ে এসেছে। সঙ্গে প্রিমাকেও ডাকতে গিয়েছিল সে, কিন্তু প্রিমা তখন রান্নাঘরে ব্যস্ত।

প্রিয়মের স্ত্রী বাড়িতে প্রথমবারের মতো পা রেখেছেন গর্ভে সন্তানের ভার নিয়ে—সেই প্রথমেই খেতে চেয়েছেন কাস্টার্ড। ফল হিসেবে তাতে যোগ করতে বলেছে মিষ্টি কুমড়ার ছোট ছোট টুকরো। এই অদ্ভূত খাবারের টেস্ট কেমন হবে তা নিয়ে প্রিমার মাঝে দারুন আগ্রহ। তাই আপাতত অন্য কোনোদিকে দৃষ্টি দিতে পারছেন না সে।

‘ভাইয়া কিছু একটা বলো। ভাবী তো থামছে না।’

প্রান্তির গলায় অসহায়ত্বের ছোঁয়া। তিহুর জন্য সে কষ্ট পেলেও তার কিছু করার নেই যে।

প্রোণো প্রান্তির কথা শুনে তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো তিহুর দিকে। কাঁদতে কাঁদতে গায়ের ওড়না কখন গড়িয়ে মেঝেছে পড়েছে—খেয়াল নেই মেয়েটার। প্রোণোর দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ হলো। সে তীক্ষ্ণ চোখে বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসা তিহুকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো।
এতক্ষণ তার চোখে ক্রন্দনরত অর্ধাঙ্গিনীর জন্য মায়া থাকলেও এখন তা রাগের শিখায় পরিণত হলো।
হাতের আধ খাওয়া আপেলটা টি টেবিলে রেখে উঠে সে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রান্তিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

‘এক মগ ঠান্ডা পানি নিয়ে আয়।’

প্রান্তি সাথে সাথেই ভাইয়ের হুকুমে পানি আনতে ছুটলো। প্রোণো এক মুহূর্ত ও দেরী করলো না।
প্রায় সাথে সাথেই ধুম আওয়াজ তুলে দরজা বন্ধ করে দিল।
বিছানায় বসা তিহু দরজা বন্ধের উচ্চশব্দে কেঁপে উঠলো। এতক্ষণ চেষ্টা করেও যে চোখের পানি বন্ধ হচ্ছিলো না তা নিমিষেই বন্ধ হলো।
তিহু ভেজা লাল চোখ জোড়া তুলে অবাক চোখে তাকালো। কি হলো বা হচ্ছে বুঝতে সময় লাগলো।

বেদনায় জর্জরিত হৃদয় আর অশ্রুসিক্ত চোখে তিহু আবিষ্কার করল এক অপরিচিত প্রোণোকে।
যতটা সে তাকে চিনেছে, প্রোণো নিঃসন্দেহে এক শান্তপ্রকৃতি মানুষ—চিন্তায় কম্পিউটারগতিও থাকলেও তার ভাবভঙ্গি সবসময়ই স্থির ও সংযত।
ভয়ংকর পর্যায়ে রেগে গেলেও নিজেকে সর্বোচ্চ শান্ত রাখার কৌশল জানা আছে মানুষটার।
কিন্তু এই মুহূর্তে তার চোখেমুখে যে কঠোরতা, তা ভিন্ন কিছু বলছে। চোখদুটি যেন অচেনা, ঠোঁটদুটো শক্ত করে বন্ধ, রাগ যেন সেখানে ধরা পড়ে আছে।
তিহুর বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল।
সে কি কিছু ভুল করে ফেলেছে?
কোনো অনিচ্ছাকৃত অন্যায়?
তিহু ভেতরে ভেতরে খুঁজে চলে, সেই ভুলটা—যেটা হয়তো সে জানেই না যে সে করেছে।

‘কান্না থামালে কেন? কাঁদো তিহু। এই মুহূর্তে কান্না বাদে অন্য কিছুতে তোমার মনোযোগ দেওয়া মোটেও ঠিক না।’

তিহুর চোখে যে সামান্য জল চুপচুপ করছিল কিন্তু ঝড়তে বাঁধা পাচ্ছিল, তারাও পালালো যেন। প্রোণোর আচরণে তিহু ভয় পাচ্ছে। সে শক্ত হয়ে বসলো। ফোলা ফোলা চোখ দিয়ে প্রোণোকে দেখলো। নাহ এই মানুষটা তার প্রেমিক বর না। কিছুতেই হতে পারে না।

তিহু নড়াচড়া করতে গিয়ে হঠাৎ টের পেল তার গায়ে ওড়নার অনুপস্থিতি। ওড়নার এক অংশ তার কোলে, আরেক অংশ মেঝেতে লুটিয়ে রয়েছে।
সে নিঃশব্দে ওড়নাটা তুলে গায়ে মাথায় পেঁচিয়ে নিল। ঠিক তখনই প্রোণোর কণ্ঠে ধমকের সুর ভেসে এলো—

‘ও কেন গায়ে দিচ্ছো? জড়িয়ে কি হবে? যা দেখার গত ত্রিশ মিনিটে দেখে নিয়েছি। এখন নতুন করে দেখার আর কিছু নেই।’

প্রোণোর কথাগুলো কামান থেকে ছোড়া গোলার মতো তিহুর বুকে আঘাত হানে।
লজ্জা, অপমান আর বিস্ময় মিলেমিশে তিহুর বুকটা ভার হয়ে ওঠে।
প্রোণো যদি একটু আলতো করে কথাটা বলতো, তাহলে হয়তো সে শুধু লজ্জাই পেত।
কিন্তু না—এই অপমানটা ইচ্ছাকৃত।
তিহুর চোখে জলের ঢেউ আবার ফিরে আসে। শব্দহীন কান্না বেয়ে নামে তার গাল বেয়ে।

প্রোণোর মায়া হয় না। সে পুনরায় বলে,

‘তিহু be aware of your surroundings. এ বাড়িতে তুমি একা থাকো না। সামান্য কাঁদতে গিয়ে নিজের গায়ের ওড়না, গায়ে আছে কিনা তা ভুলে গেলে কিভাবে চলবে?’

তিহু জবাব দেয় না। অপমানের হ্রেস কাটেনি এখনো। এই ঘা এত সহজে ঘুচে?

প্রোণো চোখ বন্ধ করে একবার গভীর শ্বাস নিল। যেন কিছু বলতে চেয়েও চুপ করে গেল।
তারপর ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে দরজাটা খুললো।
ঠিক যেমনটা সে ভেবেছিল, তেমনি—
প্রান্তি ঠান্ডা পানির গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রোণো গ্লাসটার দিকে একবার তাকালো। তারপর চোখ নামিয়ে ঘর থেকে বের হতে হতে নিচু গলায় বলল,

‘তোর ভাবীকে দে।’

চলবে……

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

২০.
আকাশ মেঘলা। ঠান্ডা ক্ষীণ বাতাস বয়ে চলছে। এমন পরিবেশে কড়া করে এক কাপ রঙ চা খেতে মন চাইছে প্রোণোর। কিন্তু কেন যেন আবার ইচ্ছেটা পূরণ করতে মন চাইছে না। হয়তো তার মন ভারের কারণে!

পুরুষ মানুষের জীবন কঠিন। জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের আচরণ ভিন্ন। সবার সঙ্গে তাদের মাপ কাঠি অনুযায়ী আচরণ করতে হয়। এসব কিছু জগতের স্বাভাবিক নিয়ম। তার থেকেও জটিল বিষয়—ঘরের বউ। এটা একটা অলৌকিক জীব। গোটা চল্লিশ বছর সংসারের পরও এই জীবের ন্যাচার সম্পর্কে বুঝতে পারা যায় না। প্রোণো তো মাত্র শিশু এ অধ্যায়ে!
তবে প্রোণোর মন ভারের কারণ ভিন্ন।
বউ নামক জীবটা তার জীবনে খুব একটা ঝামেলা আনছে না।
বরং তার প্রতিদিনকার জীবনটা একটু রঙিন হয়েছে।
তার জীবনের এই সুন্দর পরিবর্তনের কারণেই মেয়েটার প্রতি দারুণ টান অনুভব হয়। এই যে চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে, তার বুকের ভিতরের শব্দটা বেড়ে চলছে। কিন্তু কী করার আছে?
তার হাতে কিছুই নেই।
তার উপর মেয়েটাকে কাঁদতে দেখলে তার পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে। সান্ত্বনা দেওয়ার মতো বাক্যও যে তার জানা নেই।
এতসব লুকায়িত অনুভূতি লুকিয়ে রাখতে গিয়েই সে মেয়েটাকে একটু বেশিই বকে ফেলেছে। তবে বকাটা যে একদম উচিত হয়নি, তা নয়। বাড়িতে নিঃসন্দেহে অনেক মানুষ। বাড়ির বউ হিসেবে অবশ্যই তাকে এসব বিবেচনা করতে হবে। তাছাড়া ঘরের দরজা খোলা ছিল, এটা নিঃসন্দেহে সে জানতো।
তাই…

হাহ্।

প্রোণো তপ্ত শ্বাস ফেলে।

‘ডিপ্রেশন বন্ধু?’

প্রোণো জবাব দেয় না।

‘হয় হয়, এমন হয়।
দু’একবার সিগারেটে টান দিলেই দুঃখ কষ্ট হাওয়া। ট্রাই করবি?’

নাদিমের মুখে রসিকতার হাসি। সে তার হাতে থাকা সিগারেটে শেষ দু’টান দিয়ে দূরে ফেলে দেয়। ঠোঁট চোখা করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দোকানিকে বলে,

‘মামা, এই ভদ্রলোককে এক টাপ চা খাওয়ান। তিনি বিয়ে করে ভদ্রলোকের বেশ ধরেছেন। দেন দেন, এক কাপ চা ই দেন।’

প্রোণোরও মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে একটা সিগারেট হলেও বেশ হয়। কিন্তু সে সিগারেট শেষ করে বাড়িতে ফিরতে পারবে না। তিহু হয়তো এটা পছন্দ করবে না।
সে আজ অন্তত তিহুর পছন্দ না এমন কোনো কাজ করবে না।

————

টেবিলে চায়ের কাপ সাজিয়ে রাখা। এতক্ষণ তা থেকে ধোঁয়া উড়লেও এখন আর উড়ছে না। ঠান্ডা হয়ে গেছে।
আলেয়া বেগম সেই ঠান্ডা চায়ের কাপেই চুমুক বসিয়ে চুক চুক করে চা খাচ্ছেন।
সাবিহা সেই কখন ভেতরের রুমে গেছে, এখনো ফেরেনি।
আলেয়া চা খাওয়া থামিয়ে ছেলেকে আস্তে করে বললেন,

‘চা টা নে! ভালো হয়েছে। মেয়ে আর যাই হোক, চা কিন্তু দারুণ বানায়।’

সাকিল তার মায়ের কথা পুরোই অগ্রাহ্য করলো।
সে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকলো চায়ের কাপের দিকে।
শুনেছে, পুরুষ মানুষেরা কাঁদে না। আসলেই কি কাঁদে না, নাকি দায়িত্বের ভারে লুকিয়ে যায়?
সাকিল তার চোখে ভীড় করা ছোট্ট জলরাশিকে আড়াল করার চেষ্টা করে।
এই জল কাউকে দেখতে দিতে মানা।

কলিকে সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে নিয়ে এসেছে সাবিহা। সঙ্গে এসেছে কলির মা আর বড় বোন।
কলির উপস্থিতি টের পেয়েও সাকিলের ভেতরের পরিবর্তন হলো না।
সে তখনো চায়ের কাপের দিকেই তাকিয়ে।
আলেয়া ছেলের আচরণে প্রচণ্ড বিরক্ত। এমন আচরণ করলে এই ছেলেকে কেউ বিয়ে করবে?
সে হাতের কনুই দিয়ে ছেলেকে ধাক্কা দিলেন।
সাকিল জোর করে চোখ জোড়া তুলে সামনে তাকালো। তার চোখের সামনে ফুটফুটে সুন্দর এক রমণী। এমন সুন্দরী মেয়ের দিকে তাকালেই যে কোনো পুরুষের হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সাকিলের হৃদস্পন্দন থমকে আছে। তার বুক ভার হয়ে আছে, চাপা যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে।

‘কি জামাই, মুখে হাসি নেই কেন? মেয়ে পছন্দ হয়নি?’

কলির বোনের প্রশ্নে সবাই সাকিলের দিকে তাকালো।
কলি নিজেও অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে। যেন তাকে পছন্দ হয়নি—এই কথাটা সে জীবনে প্রথম শুনলো।
সাকিলের উত্তর দিতে দেরি হওয়ায়, আলেয়া নিজেই উত্তর দিলেন—

‘কি যে বলো মা! পছন্দ কেন হবে না? ও আসলে লজ্জায় কথা বলতে পারছে না। আমার মেয়েটার থেকেও ছেলেটা বেশি লাজুক।’

পরিবেশ কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হলো।
বাকি সময়টুকুর পুরোটাই সাকিল মাথা নিচু করে বসে রইলো।
যদিও আলেয়া বার কয়েক কনুই দিয়ে আঘাত করেছে তাকে সামনে তাকাতে, কিন্তু এবার আর সাকিল তা করেনি।
সন্ধ্যা হতেই তারা কলিদের বাড়ি থেকে বিদায় নিল। ফেরার জন্য সিএনজি রেডি ছিল।
সাকিল বাড়ির গেট থেকে বের হওয়ার পূর্বেই কলি তাকে পেছন থেকে ডাকলো।

‘সাকিল সাহেব!’

সাকিল খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়ালো।
কলি তার কাছাকাছি এসেই প্রশ্ন করলো,

‘আপনার প্রেমিকা কি আমার থেকেও সুন্দরী?’

সাকিল প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চাইলো না। তাই মুচকি হেসে বললো,

‘সে আমার চোখে সুন্দরী বলেই তো সে আমার প্রেমিকা।’

সাকিল ভেবেছিল, এমন কথায় হয়তো মেয়েটা মুখ ভার করবে।
তার অহংকারে আঘাত পড়ার কারণে হয়তো স্পষ্ট রাগ ফুটে উঠবে মুখজুড়ে।
কিন্তু তার কিছুই হলো না। বরং সে মিষ্টি করে হাসলো।

‘আজ থেকে তাহলে আমায় সুন্দরী ভাবতে শুরু করুন।
বিয়ের পরও প্রেমিকাকে সুন্দরী ভাবাটা আমার খুব একটা পছন্দ হবে না।’

সাকিল অবাক হয়। এই মেয়েটাকে সে এভাবে কখনোই কল্পনা করেনি।
ভেবেছিল মেয়েটা হবে উগ্র স্বভাবের। কিন্তু তার কথাবার্তা অত্যন্ত সাবলীল।

‘সাকিল সাহেব?’

‘জ্বী, শুনছি।’

‘লন্ডনে থাকা কালে আমার বেশ কিছু প্রেমিক ছিল। এই ধরুন চার–পাঁচ জন! তারা সবাই ধনী ছিল, দেখতেও যথেষ্ট সুদর্শন।’

‘আচ্ছা।’

‘আপনায় আমি এসব কেন বলছি, জানেন?’

‘কেন?’

‘কারণ আমি জানি, খুব শীঘ্রই আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হতে চলছে।
এসব কথা পরবর্তীতে জানাজানি হলে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে।
এই দেশে ভুল বোঝাবুঝিটা অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। তাই না বলুন?’

‘জ্বী।’

‘আপনি কিন্তু শুরু থেকেই আমায় ভুল বুঝে বসে ছিলেন।
আপনার চোখ দেখেই বুঝে ফেলেছি আমি। হিউম্যান সাইকোলজি খুব ভালো বুঝি আমি।’

‘জ্বী।’

‘আপনি অবাক হচ্ছেন না?’

‘হচ্ছি।’

‘ভেরি গুড! আমি আপনায় অবাক করতেই চাচ্ছিলাম।
এখন বলুন তো, আপনার প্রেমিকা কে? প্রিমা না প্রান্তি?’

এবার সাকিল নিজের বিস্ময় ধরে রাখতে পারলো না যেন। না চাইতেও তার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো।

‘তাদেরকে কিভাবে চেনেন আপনি?’

কলি হাসে। বলে,

‘হবু বরের বিষয়ে খোঁজ নেব না?
আপনার চার পুরুষের খোঁজ নিয়ে ফেলেছি আমি। সেখানে এই টপিকটা খুবই সাধারণ।
এবার বলুন, কে আপনার প্রেমিকা?’

সাকিল ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।
এক মুহূর্তের জন্য তার সর্ব শরীর জমে গিয়েছিল।

‘আপনি এত কিছু জানেন যখন, এটাও নিশ্চয়ই জানেন।’

‘জ্বী না, এই একটা বিষয়ই আমি জানি না। কারণ আমার মনে হয় আপনি নিজেও এই বিষয়ে ক্লিয়ার না। তাই না, সাকিল সাহেব?’

কলির কথা একেবারেই ভুল নয়।
উঁহু, কলি সম্পূর্ণভাবে ঠিক।
সাকিল সত্যিই জানে না।

প্রান্তির কোমল স্বভাব তার ভালো লাগে। মেয়েটাকে দেখলেই মন আনন্দে ছলকে ওঠে।
আর প্রিমা? তাকে দেখলে সাকিল অস্থির হয়। তার কথার ভাঁজে আটকা পড়ার ভয়ে বিচলিত হয় সে।
দিন শেষে তাকে না দেখতে পেলেও একরাশ চিন্তা হাজির হয়।

তাহলে কি সে সত্যিই জানে না তার মন ঠিক কাকে চায়?
সাকিল লজ্জা অনুভব করে।

কলি মুচকি হাসি ঝুলিয়ে বললো—

‘আপনার অনিশ্চিত প্রেমিকাদের ভুলে, এখন থেকে নাহয় আমার দিকে নজর দিবেন! কেমন, সাকিল সাহেব?’

সাকিল জবাব দিলো না।
কলি ঠোঁট চেপে হাসে।
হাতের মুঠোয় থাকা ছোট এক কাগজের টুকরো সাকিলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে—

‘এখানেই তাহলে সমাপ্তি টানি? সবাই অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।’

সাকিল হাত বাড়িয়ে কাগজের টুকরোটা নেয়।
ভাঁজ না খুলেই নির্দ্বিধায় বুক পকেটে রেখে দেয়।
যাওয়ার পূর্বে এক পলক কলির দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হাসে। বলে—

‘আসি তাহলে।’

‘জ্বী, অবশ্যই। শীঘ্রই দেখা হচ্ছে তাহলে!’

সাকিল চলে যায়। জবাব দেয় না।
কলি অবশ্য জবাবের আশা করেনি।
এভাবেই ভালো লাগে মানুষটাকে তার।

**চলবে…**