তার নাম জানিয়েছি সূর্যাস্তকে পর্ব-২১+২২

0
16

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

২১.
টেবিলের এক কোণে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে তিহুর বই-খাতা। বহুদিন হলো তাদের সঙ্গে তার আর কোনো দেখা-সাক্ষাৎ নেই। তাদের সাথে এই টানাপোড়ার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না তিহুর। বিয়ের আগে ঘর টিকিয়ে রাখতে পড়াশোনাকে ঢাল বানাতে হতো—আশ্রয় পেতে পড়াশোনার ভান জরুরি ছিল। এখন আর সে প্রয়োজন নেই। তাছাড়া খানিক পূর্বেই পড়াশোনা না করে এ বাড়িতে স্হায়ি ভাবে থেকে যাওয়ার রাজটিকিট পেয়ে গেছে শাশুড়ির থেকে। এখন বরটাকে মানাতে পারলেই চলবে।
প্রোণো খুব সহজেই তার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিবে না তা তিহু বেশ করে জানে। এমনও হতে পারে এই উপলক্ষে তাকে এ বাড়ি থেকে মাস খানেকের জন্য বের হয়ে যেতে হয়। অবশ্য সে ইচ্ছাকৃত ভাবে বেরিয়ে যাবে না। তবে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে তার বর তাকে নির্ঘাত ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিবে।
তিহু কোথায় যেয়ে উঠবে তা ও একটা চিন্তার বিষয়। বাবার বাড়িতে ঠাই হবে না তার।
তার বাবা তাকে দেখা মাত্রই সদর দরজায় আরো দুটো নতুন তালা এটে দিবে। মায়ের কথা না-ই বা বলি। বাবার কথার বিপরীতে গিয়ে সে কখনোই চাবি হাতে এগিয়ে আসবে না।
তার একমাত্র উপায় হলো কোনো‌ একটা হোটেলে উঠে পড়া।
তিহু নিজের পার্স চেক করলো। টাকার পরিমাণ খুবই স্বল্প। ডাল ভাত খয়ে চার পাঁচ দিন কাটাতে পারবে সে। বাকি দিন গুলো? এই বন্ধু ঐ বন্ধু করে আরো পাঁচদিন। ততদিনে কি বরের মন নরম হবে না?
তিহু চিন্তিত ভঙ্গিতে কাবার্ড খোলে। বেছে বেছে কিছু জামা ল্যাগেজে গুছিয়ে রাখে। হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই প্রোণোর একখানা শার্ট ও খুব যত্নে ল্যাগেজে ঢুকিয়ে নেয়। এর থেকে বেশি কিছু তার প্রয়োজন হবে না। কাজ শেষে ফুস করে শ্বাস ফেলে সে। ভাগ্য তার আল্লাহর হাতে। তিহু ব্যথিত নয়নে পুরো রুমটায় একবার চোখ বোলায়। কি জানি? আজই হয়তো এই রুমে তার শেষ দিন। আর দেখা নাও হতে পারে। তিহু ব্যাথিত চোখে চেয়ে জানালার পর্দাগুলো ছুয়ে দেয়। নাটকটিয় ভঙ্গিতে বলে,

‘আমায় তোরা দোষী ভাবিস নে রে সই। আমি কি স্বাদে তোদের ছেড়ে যেতে চাই? এসবই আমার পাষাণ বরের চাল। তোরা তাকে ক্ষমা করিসনে সই। করিস নে…’

তিহু তার মনস্থির করেছে। দুবার প্রোণোকে কল দিতে গিয়েও থেমে গেছে। পুনরায় কথা সাজিয়ে নিয়ে দ্রুত হাতে কলে প্রেস করলো। ঘন্টা খানেক পূর্বে প্রোণোর সাথে হওয়া মনমালিন্য সে নেহাত ভুলে বসেছে।

কল ধরার সাথে সাথেই তিহু বেশ খোশ মেজাজে বলে ওঠে—

‘শুনুন, আমাকে দিয়ে পড়াশোনার নাটক আর হবে না। আজ থেকে পড়াশোনার সঙ্গে সকল সম্পর্ক চুকিয়ে দিলাম।
(গলা আরও দৃঢ় করে) তবে একটা কথা—আমায় ঘর থেকে বের করে দিতে চাইলে তা আপনার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না বলে দিচ্ছি। আমি এই বাড়ি থেকে একচুলও নড়ছি না।’

ওপাশে নিস্তব্ধতা। তিহুর বুক কেঁপে ওঠে। মনে হয়, এবার বুঝি ঝড় বয়ে যাবে।

কিন্তু হঠাৎ করেই শান্ত কণ্ঠে ভেসে আসে—

’কিছু খেতে চাও? আইসক্রিম বা চিপস?’

তিহু অবাক হয়ে চুপ করে থাকে। কপালের ভাঁজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। এই মানুষটার নীরব সম্মতি, মৃদু হাসি—সবকিছুই তাকে গোপনে জড়িয়ে ধরে। কে বলেছে এই মানুষটা পাষাণ? তিহু নিজ হাতে তার প্রাণভোমরা ছিনিয়ে নিবে।

‘ঝালমুড়ি আনিয়েন।’

‘ ….আচ্ছা।’

ওপাশে নরম হেসে ওঠে প্রোণো। এতক্ষণের চিন্তার জটলাগুলো নিমিষেই হারিয়ে যায়।
প্রোণো ফোন পকেটে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এক পলক হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,

‘উঠছি তাহলে?’

নাদিম প্রোণোর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে। বলে,

‘যা যা। লাল কাপড় দেখলে কি আর ষাঁড়কে থামিয়ে রাখা যায়?’

নাদিমের চড়া রসিকতায় বিরক্ত হয়েও হয়না প্রোণো। নাদিমকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে দোকানের বিল মিটিয়ে বের হয়ে পরে সে। নাদিম হাসতে হাসতে বলে,

‘বন্ধু যাওয়ার আগে দেখা করিস কিন্তু। বউ একটা গেলে আর একটা পাওয়া যাবে কিন্তু বন্ধু একটা গেলে আর একটা পাওয়া যাবে না।’

প্রোণো কড়া চোখে তাকাতেই নাদিম ফিক করে হেসে ফেলে।
প্রোণো কিছুদূর যেয়ে থেমে যায়। শিট! ঝালমুড়িটা ঠিক কোথায় পাওয়া যায়???

_____________

বাড়িতে ফিরেই সাকিল সোজা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে। পড়নের পোশাক পরিবর্তন করাটাও ক্লান্তির ঠেকছে। পাশের রুম থেকে তার মায়ের জোর গলা শোনা যাচ্ছে। ফোনে কথা বলছে হয়তো। ছেলেবউ হিসেবে তার কলিকে ভিষণ পছন্দ হয়েছে এমন কিছুই বলছে সে।

কলিকে যে তার পছন্দ হয়নি এমনটা নয়। মেয়েটা সুন্দরী, বুদ্ধিমতী। কিছুটা চটপটেও। শুধু তাই নয়, মেয়েটা খানিকটা রহস্যময়ীও। তবে বিয়ের ব্যাপারে সে এখনো নিশ্চিত হতে পারছে না।

প্রান্তির প্রতি তার যে ভালোলাগা জন্মেছে, তা এত সহজে মুছে যাওয়ার নয়। যদিও প্রান্তিকে বিয়ে করার কথা সে কখনো ভাবে নি। কেবলই জানে—মেয়েটাকে তার ভালোলাগে। সেই ভালোলাগা ভালোলাগাতেই সীমাবদ্ধ; কখনো তাকে নিয়ে কোনো গোপন কল্পনার জাল বোনেনি সে। এরপর প্রিমা নামক রহস্য তো রয়েছেই। সাকিল মাঝে মাঝে ভেবে পায়না তার এই সহজ জীবনে এত কঠিন চরিত্রের নারীরা কি করছে!

আলেয়া এসে নিরবে সাকিলের পায়ের কাছে বসে।
সাকিল কপাল কুঁচকে বিরক্ত গলায় বলে,

‘এখন আবার কি?’

আলেয়া আলতো গলায় বলে,

‘আমি তোর রুমে আসতে পারি না? এখন কি পারমিশন লাগবে তোর রুমে আসতে?’

‘অবশ্যই লাগবে মা। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেলে তাদের রুমে পারমিশন নিয়ে ঢোকাটা ভদ্রতা।’

‘ওসব ভদ্রতা আমার ভিতর নেই। আমি ছোটকাল থেকেই অভদ্র। আমার বাপজান আমাকে এই নিয়ে কত মারলো! আমি এখনো সুধরাইনি। তবে— নাতি নাতনি আসার পর সুধরানোর একটা সুযোগ আছে মনেহয়।’

‘মা দোহাই আপনার! য বলতে আসছেন দ্রুত বলে আপনার ঘরে যান। আমার মন মেজাজ ভালো নেই।’

‘ঠিক আছে। বউ কেমন দেখলি? কি মনে হয়?’

‘আমার কিছুই মনে হয়না মা। আমার সময় লাগবে।’

‘সময়ের কি আছে? মেয়ে দেখতে তো মাশআল্লাহ সুন্দরী। আচার ব্যবহারও মাশআল্লাহ। আবার ভাবার কি আছে?’

‘আপনিই যখন সব ঠিক করবেন তাহলে আমার কাছে শুনতে আসছেন কেন? আপনি একাই তো যথেষ্ট। আমার মতামত দিয়ে কি করবেন?’

আলেয়া খানিকটা দমলো। কন্ঠ নিচু করে বললো,

‘রাগিস কেন? আমি তো তোর মতামত শুনতেই আসছি। তোর মা হিসেবে আমার ও তো একটা মতামত থাকে তাই না। আমি কেবল তৌকে জানালাম যে আমি এই বিয়ের জন্য রাজি। মেয়ে,বাড়ি,পরিবার সবই আমার ভালো লাগছে। আমি এরকম একটা পরিবারের সাথেই আত্মীয়তা করতে চাচ্ছিলাম।
বাকিটা তোর ইচ্ছা। আমি তো তোকে জোর করতে পারব না। আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো আর বাপ মায়ের কথা ভাবে না। নিজেদের যা মন চায় করে।’

‘মা আপনি বেশি বলতেছেন।’

‘আমি তো বেশিই বলি। বড় হয়ে গেছিস না তোরা! আমার কথা তো এখন বেশিই মনে হবে।’

‘মা আপনি আপনার ঘরে যান।’

আলেয়া উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার পূর্বে শব্দ করে দরজা আটকে দিলো। শব্দ করে দরজা বন্ধ করাটা যে নিতান্তই ইচ্ছাকৃত তা সাকিল বেশ জানে। সে এটাও জানে তার মা এই বিয়েটা জোরপূর্বক ভাবে তাকে করতে বাধ্য করবে। সাকিল ভেবে পায়না তার বাবা এই মানুষটার সাথে অতগুলো বছর কিভাবে কাটিয়েছিল।
সাকিল শোয়া থেকে উঠে পোশাক পরিবর্তন করে। ডায়নিং এ তার মা বসে সুপারি কাটছেন। সাকিল তাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে ফ্রিজ খুলে একটা আপেল নিয়ে ঘর থেকে বের হতে গেলেই আলেয়া পেছন থেকে ডেকে ওঠেন।

‘কোথায় যাচ্ছিস?’

‘ছাদে।’

‘কি কাজে? বাড়িওয়ালির ঐ বজ্জাত মেয়েটার সাথে রংঢং করতে?’

‘মা বাজে কথা বলবেন না।’

‘বাজে কথা হোক আর যাই হোক না কেন ওমন বজ্জাত মেয়েকে আমি আমার ঘরে তুলব না। সে আমি মরে গেলেও না।’

‘আমি বরং আপনি মরে যাওয়ার পর বিয়ে করবো।’

আলেয়া হায় হায় করে উঠলো। তার ছেলে কিনা এখন তাকে মৃত কামনা করছে।

‘ও‌ খোকা তুই ওমন কথা বলতে পারলি? তুই আমাকে মরতে বলতে পারলি?’

‘আমি আপনাকে মরতে বলিনি মা। আপনি বেঁচে থাকুন এটা আমার কাম্য। অযথা ভুল বুঝছেন।’

‘আমি নিজের কানে শুনলাম তুই আমাকে মরতে বললি!’

‘ভুল শুনেছেন।’

‘আজকাল আমার বুকটা ধরফর করে। শরীর কাঁপে। মাথা ঘুরায়। সন্তানের অভিশাপেই হয়তো। আল্লাহ স্বামীর ছায়া কপাল থেকে তুলে নিলে এখন কিনা সন্তানকেও ছিনিয়ে নিচ্ছ!’

‘আপনি পানে তামাক খাওয়া কমান মা। তামাক মহানবী পছন্দ করতেন না। শরীরের জন্যও ভালো না। দেখবেন ওটা ছাড়লে আপনি দিব্যি সুস্থ।’

আলেয়া চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বলেন,

‘আমার অসুস্থতাও কি তোর বিশ্বাস হয়না এখন?’

সাকিল কথা বলে না। আর কথা বাড়ানো বেকার। সে দরজা চাপিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। শুনতে পায় তার মা এখনো বিলাপ করে চলছে,

‘আল্লাহ এ কোন দিন দেখালে তুমি আমায়? আমায় নিয়ে কেন গেলে না…….’

চলবে………

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

২২.
প্রিমা আজ মেরুণ রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। শাড়িটা তিহুর। কিছুদিন আগেই প্রোণো কিনে দিয়েছিল। কিন্তু সময়ের অভাবে এখনো শাড়ির ভাঁজটাও খোলা হয়নি। নতুন শাড়ি দেখে প্রিমা নিতে চায়নি। বলেছিল,

‘তোমার বর দিয়েছে যখন আগে তুমি পরো তারপর নাহয় আমি নিবো।’

তিহু তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করে জানিয়েছে,

‘আমার বর তোমার কি হয় শুনি? সে আমার বর হয়েছে কেবল মাস পেরিয়েছে আর তোমার ভাই বিগত বাইশ বছর ধরে। তাহলে কার অধিকার বেশি?’

তিহুর কথায় প্রিমা কেবল মিষ্টি হেসেছে। তার এই ভাবীটা অত্যন্ত চমৎকার একটা ক্যারেক্টার। যাকে পড়তে কোনো ক্লান্তি আসে না। কালো আকাশের একখন্ড নক্ষত্রের মতো। প্রিমা মাঝে মাঝে অবাক হয় ভিষণ। মেয়েটা তাদের দুইবোনের থেকে কেবল এক বছরের বড় কিন্তু তাদের বোঝাবুঝির তফাৎটা বিস্তার। একটা বছর কি একটা মানুষকে এতটা বুঝদার করে দিতে পারে? তিহুর মাঝে যে ছেলেমানুষী একেবারেই নেই তা নয়। কিন্তু সম্পর্কের মতো প্যাঁচালো জিনিসটা খুব ঠান্ডা মাথায় সামাল দিতে পারে মেয়েটা। প্রিমা যত তিহুকে দেখে ততই নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে।সে কি আদেও সামলাতে পারবে? তিহুর মতো তাকেও তো কোনো এক পরিবারে মানিয়ে নিতে হবে।

প্রিমা শাড়ি পড়েছে রেমির থেকে। রেমির শাড়ি পড়ানোর হাত চমৎকার। প্রিমা না চাইতেও রেমি অল্পপরিসরে সাজগোজ করিয়ে দিয়েছে। এই যেমন চোখে মোটা করে কাজল আর ঠোঁটে হালকা মেরুণ লিপস্টিক।
শাড়ি পরা শেষ হতেই প্রিমা সবার আগে তা তিহুকে দেখিয়েছে। তিহু তৎক্ষণাৎ প্রিমার হাতে এক হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলেছে,

‘আমি যখন বাবার বাসায় ছিলাম তখন কোনো নতুন কাপড় পড়লে বাবা,চাচ্চু,ভাইয়া,ভাবীরা এভাবে হাতের মুঠোয় টাকা গুঁজে দিত। আমিও এখন বড় ভাবী হয়েছি। এটা আমার তরফ থেকে।’

প্রিমা তিহুকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলে ওঠে,

‘তুমি আমার ভাবী আরো আগে কেন হলে না?’

জবাবে তিহু কেবল হেসেছে। প্রিমা তিহুর গালে টুপ করে এক চুমু খেয়ে দৌড়ে ছাদে উঠতে উঠতে বলল,

‘সাবধান ভাবী। এভাবে কবে না জানি আমি তোমার প্রেমে টেমে পড়ে যাই। তখন কিন্তু তোমার পিছু ছাড়ব না।’
.
.
রেলিংয়ে হেলান দিয়ে আকাশ মুখো হয়ে বসে আছে প্রিমা। বিকেলের হাওয়ায় ফুরফুর করে উড়ছে তার ঘন কালো রেশমী চুলগুলো। কিছু চুল অবাধ্য দুষ্টু ছেলেদের মতো আচরে পড়ছে তার চোখে,মুখে,ঠোঁটে।

কিছুটা দূরেই প্রান্তি রংতুলিতে প্রিমাকে ক্যানভাসে বন্দি করতে ব্যস্ত। দুই ভ্রুয়ের মাঝের সমতল জায়গাটায় কয়েক স্তরের ভাঁজ ফেলে অতি মনোযোগে ব্রাশের আচর কেটে চলছে শুভ্র পাতায়।

‘আর কতক্ষন?’

প্রিমার কন্ঠে বিরক্তি। এভাবে বসে থাকতে থাকতে ঘাড় বিষিয়ে উঠছে।

‘এইতো শেষ প্রায়। জাস্ট দুইটা মিনিট।’

‘এভাবে একপলক একপলক না তাকিয়ে দু মিনিট একটানা তাকিয়ে ভালো করে দেখেনে আমায় দেন আঁকা না বাপু। নয়তো আমি একটা আয়না এনে তোর সামনে সেট করে দিচ্ছি। নিজেকে দেখ আর আঁকা। আমার দ্বারা আর সম্ভব হচ্ছে না।’

‘জায়গা থেকে নরিস না প্লিজ। হয়ে গেছে প্রায়। আমার শোনা বোন নরিস না।’

‘ধুর। তাড়াতাড়ি কর।’

আকাশ ততক্ষণে লালচে আলোয় রেঙেছে। সূর্য দূর থেকে দূরদেশে তলিয়ে যাচ্ছে। পাখিদের আনাগোনা বেড়েছে। উঁচু আকাশে একটা একাকী চিলকে গোলাকার পথে উড়তে দেখা যাচ্ছে। যেন অন্যসকল পক্ষীকুল থেকে সে নিজেকে পৃথক করে রেখেছে। তার নিচ থেকে এত এত কাকের ঝাঁক আর বক ছুটে চলছে সে দিকে কোনো মন নেই তার।

‘আপনিতো চমৎকার আঁকেন!’

সাকিল একগাল হেসে এগিয়ে এসে প্রান্তির থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে দ্বারায়। পুনরায় কৌতুহল মেখে প্রশ্ন করে ওঠে,

‘ছবির মেয়েটা কে? আপনি?’

সাকিলের প্রশ্নে প্রান্তি খানিকটা অপ্রস্তুত বোধ করলো। কিছুটা বিরক্ত ও হলো বোধহয়।

‘আমি কেন হবো সাকিল ভাই? আমার সামনে শাড়ি পড়ে বসে আছে যে মেয়েটা এটা তার ছবি।’

সাকিল এবার সোজা সামনে তাকালো। মেরুণ রঙে মোড়ানো মেয়েটা যে প্রিমা তাতে কোনো সন্দেহ নেই তার। কিন্তু তার মাঝের এই স্নিগ্ধতা আজ প্রথম নজরে এলো তার। ছাদে পা দেওয়া মাত্রই তার চোখ এখানে আটকে পড়েছে। প্রিমার বিরক্তিতে কুচকে ফেলা চোখ, কপালের মাঝে আটকে থাকা এক টুকরো কালো টিপ সবই তার চোখে পড়েছে। কিন্তু কোনো এক কারণে এই মেয়েটার সাথে নিজ থেকে কথা বলার সাহস হয়না তার। প্রান্তিকে দেখলেই সে একগাল হেসে খুব সহজেই কথা শুরু করতে পারে কিন্তু প্রিমার ব্যাপারটা অন্য। কেমন একটা জটিলতা আর জড়তা তাকে পেঁচিয়ে নেয়।
এই যে এই মুহূর্তে প্রিমা সোজা কিন্তু তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে, তার হাত কাঁপছে। প্রাইমারিতে পড়াশোনার সময়কালে হাতের লেখা আনতে ভুলে গেলে যেমন কাঁপা কাঁপি অনুভব হতো অনেকটা তেমন।
সাকিল অপ্রস্তুত হেসে বলে,

‘আসলে এক মুহুর্তের জন্য আমার মনে হয়েছিল আপনি কোনো মানুষ না। জিন ভূত টাইপের কিছু একটা!’

‘কেন? এতটা বেমানান লাগছে আমায়?’

সাকিল হাসি থামিয়ে মাথা নাড়ে। আজ সবাই তার কথা উল্টো কেন বুঝছে আজব!

‘না না তা বলিনি মোটেই। আমি বলতে চাচ্ছি মানুষ ভাবার জন্য যেটা…. মানে নরমালি মানুষ…’

‘আমাকে নরমাল মানুষ লাগছে না?’

‘নাহ। অ্যাবনরমাল লাগছে।’

‘সিরিয়াসলি?’

‘আ’ম সিরিয়াস।’

‘আচ্ছা।’

প্রিমার মুখ অস্বাভাবিক ভাবে শান্ত হয়ে আসে। প্রান্তিকে তাগাদা দিয়ে বলে,

‘হলো তোর? না হলে থাক, আমি নিচে যাচ্ছি।’

সাকিল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী থেকে কী করে ফেলেছে, সে নিজেও জানে না। আসলে সে ফরমালি বলতে চেয়েছিল যে, প্রিমাকে সুন্দর লাগছে। কিন্তু মনে হচ্ছে উল্টে গণ্ডগোল করে বসেছে।

‘প্রিমা আমার হাত পা কাঁপছে।’

প্রিমা হাঁটা থামিয়ে অবাক চোখে তাকায়। প্রান্তিও কিছুটা বোকা চোখেই তাকিয়ে থাকে সাকিলের দিকে। এই লোকটা এখন নতুন করে আবার কি বলতে চাইছে।

‘মানে?’

প্রিমার প্রশ্নে সাকিল অস্বস্তি অনুভব করে। আফসোস হচ্ছে তার। এখন কিছু না বলাই বেটার ছিলো মেইবি। নাহয় প্রিমা তাকে ভুলই বুঝতো। অন্তত এমন জঘন্য পরিস্থিতি ক্রিয়েট হতো না।

‘আ..আসলে আমি বলতে চাচ্ছিলাম আপনাকে প্রিটি লাগছে কিন্তু আমার শরীর খারাপ থাকায় সেটা বলতে পারছিলাম না। আই মিন জার্নি করে জ্বর এসে গেছে তাই হাত পা কাঁপছে।’

প্রিমা গোল চোখ করে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। তারপর কিছু একটা ভেবে মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘ওকে। বুঝতে পেরেছি।’

সাকিল জানে না প্রিমা কি বুঝেছে তবে সে হাঁফ ছাড়ছে এটা ভেবে যে তারা দু বোনই ছাদ থেকে নেমে গেছে। এখন সে অন্তত কিছুটা একা নিরিবিলি সময় কাটাতে পারবে।

______________

প্রোণোর ফিরতে রাত হয়েছে বেশ। জরুরী কিছু কাজে আটকে পড়েছিল সে। অবশ্য তিহুকে সে কল করে জানিয়ে দিয়েছিল।
তিহুর রুমের লাইট জ্বলছে। মেয়েটা না ঘুমিয়ে তার অপেক্ষা করছিল নাকি? প্রোণো ব্যস্ত পায়ে রুমে ঢোকে। বিছানায় গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে তিহু। পাশেই ফোনে ম্লান স্বরে বাজছে অদ্ভূত কোনো এক সঙ্গীত। জারি,সারি বা ভাওয়াই— কিছু একটা হবে। প্রোণোর সঙ্গীত সম্পর্কে আইডিয়া নেই।
প্রোণো গান বন্ধ করে দেয়। তিহুর ঘুমন্ত মুখপানে একবার গভীর দৃষ্টি ফেলে সোজা ওয়াশ রুমে চলে যায় চেঞ্জ করতে।
ওয়াশরুম থেকে বের হতেই প্রোণো খেয়াল করে তিহু ঘুম থেকে জেগে গেছে। গোল হয়ে বিছানার মাঝখানে বসে আছে। প্রোণোকে দেখতেই জড়ানো গলায় প্রশ্ন করে,

‘কখন এসেছেন?’

‘এইতো দশ মিনিট হবে।’

‘আমার ঝালমুড়ি এনেছেন?’

প্রোণো তোয়ালেতে চুল মুছতে মুছতে হাসে। বলে,

‘তুমি আমার অপেক্ষায় ছিলে নাকি ঝালমুড়ির?’

‘দুইটাই।’

প্রোণো তিহুর দিকে দুটো চিপসের প্যাকেট এগিয়ে দেয়। বলে,

‘এত রাতে কোথাও ঝালমুড়ি পাইনি। অন্য কখনো এনে দিব। আজ এগুলো খাও। ফ্রিজে আইসক্রিম ও রাখা আছে।’

তিহু উপর নিচে মাথা নাড়ে। প্রোণোর দিকে এক নজর তাকিয়ে বলে,

‘গোসল করেছেন?’

‘হ্যাঁ। অনেক্ষণ বাহিরে ছিলাম যে।’

প্রোণোর চুল থেকে এখনো টুপটাপ করে পানি পড়ছে। শরীরে সে এখনো কোনো কাপড় জড়ায়নি। টুপটাপ করে ঝড়া পানির কনারা কোনো বাঁধা ছাড়াই রোণোর উদম দেহে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। তিহু কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,

‘এদিকে আসুন তো।’

প্রোণোকে আসতে বলে সে নিজেই বিছানা থেকে নেমে প্রোণোর দিকে এগিয়ে যায়। প্রোণোর হাতে থাকা তোয়ালে ছো মেরে টেনে নেয়। নিজের পায়ের উপর ভর দিয়ে আলতো হাতে চুল মুছে দিতে থাকে।
তিহুর কাজে প্রোণো প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও পরে সে নিজের মাথা নিচু করে দেয় তিহুর জন্য। তিহু প্রোণোর চুলে এলোমেলো ভাবে তোয়ালে ঘষতে ঘষতে বলে,

‘খেয়েছেন আপনি?’

‘উহু। খাবার আছে?’

তিহু চুল মোছা থামিয়ে হাত দিয়ে প্রোণোর চুল সেট করার অল্প চেষ্টা চালায়। মুখে বলে,

‘বসেন আমি নিয়ে আসছি।’

‘তুমি খেয়েছো?’

‘বরকে রেখে আমি একা খাবো?’

তিহু বারান্দায় তোয়ালে নেড়ে দিয়ে হনহন করে করে খাবার আনতে চলে যায়।
প্রোণো ভাবনায় পরে। ঝালমুড়ি না আনায় কি তিহু রাগ করেছে?

চলবে…….