তার নাম জানিয়েছি সূর্যাস্তকে পর্ব-২৭

0
16

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

২৭.
সময় কিভাবে পার হয়ে যায় তা যেন টের পাওয়া যায়না। রাতে নিদ্রার জন্য চোখ বুজতেই যেমন দিন হয়ে যায়, তেমনি পলকের মাঝেই সময় হয়ে ওঠে অতিত। সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত গুলো সুখময় অতিতের স্মৃতি হিসেবে আটকে রয়। এগিয়ে আসে জীবনের নতুন অধ্যায়।
সুখময় সেসব পুরোনো অধ্যায়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে কখন আকাশ কালো করে রাত নেমেছে তা টের পায়নি তিহু।
রাতের আকাশটায় তারা ঝলমল করছে। মেঘের রাশি চাঁদের সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতেছে। স্নিগ্ধ হাতে আড়াল করছে চাঁদকে। খানিকের জন্য আঁধার করে তুলছে ধরণীকে।
এত সুন্দর একটা রাতেও তিহুর মন ভার। পড়নে সুন্দর লাল রংয়ের জামদানি শাড়ি। চুলগুলো খোঁপা করা হয়েছে। খোঁপায় প্রোণো লাল গোলাপ গুঁজে দিয়েছে। তিহু কিছুক্ষণ বাদে বাদেই হাত দিয়ে গোলাপটা ছুঁয়ে দেখছে। ভালোলাগার বদলে মলিনতায় ছেয়ে যাচ্ছে তার মুখ খানা। আজ রাত পার হলেই প্রোণোর ছুটি শেষ। কাল সে ফিরে যাচ্ছে। সময় এত দ্রুত কিভাবে কেটে গেলো!
তিহু ছাদে দাঁড়িয়ে রেলিং থেকে নিচে উঁকি দেয়। বাড়িতে আজ মানুষের আনাগোনা খুব। কিছুটা আমেজ মুখর পরিবেশে। সাকিলের বিয়ে আজ। কিছুক্ষণ আগেই বউ‌ ঘরে তোলা হয়েছে। তিহু বউয়ের মুখ দেখেনি। দেখতে ইচ্ছা ও হয়নি। প্রিমার জন্য মনটা কেমন করছে তার। প্রিমা আজ সকাল সকাল তার বান্ধবীর বাসায় গিয়েছে। জানিয়েছে আজ রাতে সে ফিরবে না। হয়তো কাল বা দুদিন পর ফিরবে।
তিহুর মনে হয়েছে প্রিমার জন্য এখন এভাবে কিছুটা ব্রেক নেওয়াই ভালো। এখানে থাকলে সে অযথা কষ্ট পেত।
তিহুর ধ্যান ভাঙল ফোন কলে।
প্রোণো কল করেছে।

‘বলুন।’

‘প্রিমা ফিরেছে?’

‘না। ও আজ ফিরবে না জানালো।’

‘আচ্ছা।’

‘আপনি কোথায়? টিকিট পেয়েছেন?’

‘সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আছি। দু পাঁচ জনের পরই পেয়ে যাব।’

‘ঠিক আছে।’

‘তোমার জন্য কিছু চাই?’

তিহু এ কাথার জবাব দিতে কিছুটা সময় নেয়। স্বল্প হাসি টেনে বলে,

‘এই মুহূর্তে আপনি হলেই হবে। দ্রুত আসুন।’

ওপাশে নিরবতা নেমে আসে। তিহুর মন ভারের কারণ প্রোণো জানে। তার এই ছোট্ট চাওয়ার অর্থ ও সে বোঝে। ছোট্ট করে জবাব দেয়,

‘আসছি।’

কল কাটতেই তিহুর চোখ ভিজে ওঠে। প্রোণো চলে গেলে সে আবার একা হয়ে উঠবে। তার জীবনটা আবার কিছু দিনের জন্য থমকে যাবে। অবসর সময় গুলোতে কি করবে সে?

‘কে ওখানে? প্রিমা?’

পেছনে কারো গলার আওয়াজ পেয়ে তিহু দ্রুত হাতে চোখ মুছে। ঘুরে দাঁড়াতেই ম্লান আলোয় সাকিলের চেহারাটা নজরে আসে।
সাকিল পুনরায় প্রশ্ন করে,

‘প্রিমা? এটা কি আপনি?’

তিহু শক্ত গলায় বলে,

‘না ভাইয়া। আমি তিহু।’

সাকিল থেমে যায়। কিছুটা ইতস্তত করে বলে,

‘ওহ্, ভাবী! কেমন আছেন?’

‘আলহামদুলিল্লাহ।’

তিহু জবাব দিয়ে নিচে নামার জন্য প্রস্তুত হয়। আর যাই হোক এত রাতে কোনো পুরুষ লোকের সাথে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকাটা কোনো ভদ্রতার লক্ষণ নয়। যতই সে বিবাহিত হোক না কেন।
তিহু সিঁড়ি ঘরে পৌঁছাবার সাথে সাথেই পেছন থেকে সাকিল পুনরায় ডেকে ওঠে। কিছুটা সংকোচ এবং জড়তা নিয়ে বলে,

‘ভাবী, কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম।’

তিহু দাঁড়ায়। বলে,

‘হ্যাঁ, বলুন।’

‘প্রিমা কোথায়?’

তিহু তীক্ষ্ণ চোখে সাকিলের মুখভাব একবার পর্যবেক্ষণ করে নেয়। প্রগাঢ় দৃষ্টি ফেলে শক্ত মুখে বলে,

‘কেন? প্রিমাকে কেন দরকার?’

তিহুর কঠোর গলায় দেওয়া জবাব সাকিলকে বিভ্রান্ত করে তোলে। প্রিমার বিষয়ে সাকিলের সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক না এ কথাটা যেন সে তার কঠোর কথাতেই বুঝিয়ে দিতে চাইছে। সাকিল বুঝেও একবারের জন্য নিজেকে বেহায়া করে তোলে। আমতা করে বলে,

‘না মানে কেবল জানতে চাচ্ছিলাম সে ঠিক আছে কিনা।’

তিহু এবার পুরোপুরি ভাবে মুখ করে তাকায় সাকিলের দিকে। তার চোখের দৃষ্টি আগের মতো তীক্ষ্ণ নয়। সহজ এবং শান্ত ভঙ্গিতে বলে,

‘ভাইয়া, আপনি বিয়ে করেছেন। আপনার জীবন অলরেডি একজনের সাথে জুড়ে গিয়েছে। আশা করি, আপনি সেটা ভুলে যাননি। প্রিমা ভালো আছে। আমি আশা করবো প্রিমাকে নিয়ে আপনার মনে আর কোনো কৌতুহল না আসুক। লিভ হার অ্যালোন। আপনি আপনার নতুন জীবন এবং জীবন সঙ্গিনীকে নিয়ে ভাবুন।’

কথাগুলো বলে তিহু অপেক্ষা করেনা। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে। কিন্তু কয়েক ধাপ পার হতেই হঠাৎ থেমে যায়। কিছু একটা মনে পড়তেই আবার ফিরে এসে বলে,

‘ভাইয়া শুনুন, এই বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। আমরা খুব দ্রুত শিফট করবো। আপনিও বাসা বদলানোর প্রস্তুতি নিন যত দ্রুত সম্ভব। সামনের মাসের মধ্যে হলে সেটা আরো বেশি ভালো হয়।’

তিহু এবারও সাকিলকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। সাকিলের থেকে কোনো অযুহাত শুনতে চায় না সে। সাকিলকে সে পার্সোনালি না চিনলেও প্রিমার মুখে তার কথা শুনে তিহুর মোটেও বোকাসোকা মনে হয়নি। তিহুর মনে হয়েছে লোকটা সেয়ানা বোকা। বোকার মুখোশধারী এক চতুর লোক। প্রিমা তাকে চমৎকার ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ বলে ব্যাখ্যা করেছে কিন্তু তিহুর আজ তার সাথে কথা বলে তেমন কিছু অনুভব হয়নি। অ্যাভারেজ বাঙালি ছেলেরা যেমন হয় ঠিক তেমন। তবে আলাদা ভাবে একটা জিনিস অনুভব করেছে সে। লোকটা সত্যিই প্রিমাকে পছন্দ করে। প্রিমার কথা জিজ্ঞেস করার সময় তার চোখের ভাষা স্পষ্ট তা জানান দিয়েছে। কিন্তু সে তার অনুভূতির ব্যাপারে অজ্ঞাত।
মূলত এ কারণেই তিহু তাকে বাড়ি ছাড়ার জন্য বলেছে। সাকিল তার অনুভূতির বিষয়ে ক্লিয়ার হলে তা ভবিষ্যতে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিহুর সাকিল মানুষটাকে কোনোদিন থেকেই ভালো ঠেকছে না। প্রিমা এই মানুষটার সাথে না জড়িয়েই ভালো হয়েছে।

____________

চারপাশে আঁধারে তলানো। শূন্যতায় তলিয়ে গেছে বাড়ির আমেজ। বহু দূর থেকে দু একটা কুকুরের ক্লান্তিহীন গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে। রাতের এই নিস্তব্ধতা ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে প্রতিটি হুংকার। ঘুমে মজে যাওয়া এই শহরের বুকে দুজন মানুষের চোখে এখনও ঘুম নেই। ঘরের বাতিটা তখনো জ্বলছে। খোলা জানালা থেকে ফুরফুর করে বাতাস ঢুকে জানালার পাশের পর্দাটিকে দুলিয়ে তুলছে।

অন্ধকার এই রাতের মতোই আঁধারে তলানো তিহুর সুন্দর মুখখানা। সে মেঝেতে বসে প্রোণো ল্যাগেজ গুছিয়ে দিচ্ছে। ভাঁজ করা শার্ট গুলোর ভাঁজ খুলে পুনরায় ভাঁজ করে তা সুন্দর করে গুছিয়ে রাখছে ল্যাগেজের এক কোনে।
প্রোণো বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে তিহুর কাজ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে। সে বাসায় আসার পর থেকেই তিহু এমন অদ্ভূত আচরণ করছে। এই আচরণের অর্থ যে তার অজানা এমন নয়।
সময় পার হয়ে গেলেও যখন তিহুর কাজ শেষ হয়না তখন সে ধৈর্যচ্যুত হয়। নিজেই নেমে আসে বিছানা থেকে। অবাধ্য সঙ্গীনির অভিমান ভাঙবেনা যেনে সে দু হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নেয় তিহুকে। তিহু চমকায়। বড় চোখ করে তাকায় প্রোণোর দিকে।
প্রোণো সে দিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না।
তিহুকে বিছানায় নামিয়ে দিয়ে একই গতিতে সুইচ টিপে রুমের বাতি নিভিয়ে দেয়।
তিহু হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,

‘কি করছেন? আমার গোছানো বাকি এখনো।’

‘হুসসস। কথা না। চোখ বন্ধ করো।’

‘কিন্তু..।’

তিহুকে দ্বিতীয় কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে প্রোণো। অন্যহাতে তিহুর মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বলে,

‘আজ এভাবেই ঘুমাও? কাল থেকে তোমার যত ইচ্ছা কাজ করিও।’

চলবে……..