তার নাম জানিয়েছি সূর্যাস্তকে পর্ব-২+৩

0
57

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

২.
আজ সকাল থেকে তিহুর রুটিনে বিশাল পরিবর্তন নেমেছে। নিয়মের সাতদিন কেটে যাওয়ায় আজ সকাল থেকে সবাই টুকটাক কাজ করছে। তিহুর এতে বেশ লাভ হয়েছে। সে আজ সকালে দু ঘন্টা বেশি ঘুমিয়েছে। সকালের নাস্তা বানিয়েছে তার মেজ জা এবং ছোট জা। অন্যজন বাবার বাড়ি গিয়েছে গতকাল। তিহুর ধারণা সে কাজে ফাঁকি দিতে বাপের বাড়িতে টপকে গেছে। এসব তিহু খুব করে বুঝতে পারে।

তিহু দুদান্ত এক কাজ করেছে। পার্মিশন ছাড়াই তার এক ননদের রুমে ঢুকে পড়েছে। এটা অবশ্য সে ইচ্ছা করেই করেছে। সারাদিন একা একা বসে থাকতে কার ভালো লাগে?
এবাড়ির নিচতলা ভাড়া দেওয়া। দুটো পরিবার থাকে সেখানে। তিহুর অবশ্য এখনো কোনো ভাড়াটিয়ার সাথে দেখা হয়নি। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলা দুটোই তাদের। দ্বিতীয় তলায় ডায়নিং, ড্রয়িং, রান্নাঘর আর দুটো বেডরুম। একটা তার অন্যটা তার শ্বাশুড়ির। বাড়ির বাকি সবার থাকার ব্যবস্থা তৃতীয়তলায়।
তিহু কখনো তৃতীয় তলায় যায়নি। যায়নি বলতে তার সুযোগ হয়নি।

তিহুর ননদ দুজন জমজ। তাদের নাম প্রিমা,প্রান্তি। সে আপাতত কার রুমে আছে সে নিজেও জানে না। তবে তিহু কিছুটা আতঙ্কিত। যদি ধমকে ওঠে!
কিন্তু তেমন কিছুই ঘটলো না। তিহুকে দেখতেই মেয়েটা মিষ্টি করে হাসলো। মেয়েটার হাতে পেইন্টের ব্রাস। সামনেই ক্যানভাস টানানো। তাতে চিত্র এখনো ফুটে ওঠেনি। আরো কিছু রংয়ের আচর কাটলে হয়তো বোঝা যাবে। তাছাড়া তিহু এসব আর্টের ব্যাপারে অনেক বেশিই অদক্ষ। তার এখনো মনে আছে ছোট বেলায় মানুষ আঁকাতে গিয়ে উগান্ডার ছাগল এঁকে ফেলেছিল। ক্লাসের সবার সে কি হাসি! অপমান সহ্য করতে না পেরে তিহু ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলেছিল। সেই কথা মনে পড়লে তিহু এখনো লজ্জা পায়।

‘আরে ভাবী! এসো বসো। এই দেখোনা ব্যস্ততার জন্য তোমার সাথে ঠিকঠাক কথাই হলোনা।’

তিহু ভেবে পেলোনা ঠিকঠাক কথা বলতে মেয়েটা ঠিক কি বুঝিয়েছে। তাদের তো কখনো কথাই হয়নি। সেখানে ঠিক আর বেঠিক!

‘তোমাদের দুজনকে সবসময় ব্যস্ত দেখি। তাই ভাবলাম একটু দেখা করে যাই। যেহেতু একই বাড়িতে আছি!’

‘তোমার এই কাজটা আরো আগে করা উচিত ছিলো। যাই হোক এসেছো বেস করেছ। বলো কেমন কাটছে সময় এখানে?’

তিহু মুচকি হাসে। বলে,

‘সত্যি বলবো নাকি ফরমাল জবাব দিব?’

‘উহু ওসব ফরমালিটি বাহিরের মানুষের জন্য। আমি তো তোমার আপন মানুষ। এখানে নো ফরমালিটি।’

তিহু অবাক হয় কিছুটা। এত প্রাণোচ্ছল মানুষ নিজেকে কিভাবে সারাদিন বদ্ধ রুমে বন্দী করে রাখে? এ বাড়িতে কিছু তো একটা চলছে। যা সে জানে না বা বুঝতে পারছে না।
তিহু প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে,

‘তার আগে তুমি বলো তুমি প্রিমা নাকি প্রান্তি?’

মেয়েটা খিলখিল করে হেসে ফেলে।

‘তুমি আমাকে না জেনেই এতক্ষণ গল্প করছিলে? আমি প্রান্তি। শোনো তোমাকে আমাদের চেনার সহজ একটা উপায় বলছি। প্রিমার ঠোঁটের কোণে একটা তিল আছে। গাঢ় বাদামী রঙের। আমার নেই। বাকি সব সেম সেম। ইভেন ভাইয়ারাও আমাদের এভাবে চিনতে পারে। ছোট ভাইয়া এখনো ভুল করে। ওর মাথায় ঘিলু কম। ও নিজের বউকেও তিশার জায়গায় মাঝেমধ্যে দিশা বলে ডেকে ফেলে।’

তিহুর খেয়াল হয় সে এখন পর্যন্ত তার কোনো দেবরদের ও দেখেনি বাড়িতে। ব্যাপারটা অদ্ভূত। সে এ বাড়িতে এসেছে আটদিন হয়েগেল এখন পর্যন্ত এ বাড়িতে কোনো পুরুষ লোককে দেখা যায়নি।

‘তোমার ভাইয়ারা সবাই কোথায়? আমি এখনো কাউকে দেখিনি। বাসায় আসেননা কেউ?’

প্রান্তি ক্যানভাস থেকে চোখ সরিয়ে তিহুর দিকে তাকায়। বিষ্ময় ভরা চোখে চেয়ে বলে,

‘এমা তুমি ভাইয়াদের সম্পর্কে জানো না?!’

তিহু একটু থতমত খেয়ে যায়। যেন সে এ বাড়ির ছেলেদের সম্পর্কে না জেনে বিশাল কোনো ভুল করে ফেলেছে। ভুল তো সে একটা করেছেই। আর তা হলো এ বাড়ির বড় কলাগাছটাকে বিয়ে করা। এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ভুল তিহু তার গোটা জীবনে করেনি।

তিহুর চুপসে যাওয়া মুখ দেখে হেসে ফেলে প্রান্তি।

‘এত নার্ভাস কেন হচ্ছো? তোমার না জানাটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তোমার বর হচ্ছে আমাদের সবার বড়। মেজ ভাইয়া প্রান্তিক। সে একজন ডাক্তার। প্রতিদিনই বাসায় ফেরে তবে রাত করে। আবার আলো ফোটার আগেই বেরিয়ে যায়। এজন্য তোমার সাথে দেখা হয়নি। ভাইয়া ভাইয়ার এক ফ্রেন্ডের ক্লিনিকে গেস্ট ডক্টর হিসেবে আছে। আর একমাস পর এতটা ব্যস্ত থাকবে না। সেজ ভাইয়া আর্মিতে। ছুটি ছাড়া তাকে দেখতে পাওয়া যায় না। আর ছোট ভাইয়া একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে জব করে। ভাইয়া বাসায় আসে রাত আটটায়। তুমি তখন তোমার রুমে থাক হয়তো। এভাবেই কারো সাথে দেখা হয়না তোমার।’

তিহু মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলো। এই পরিবারের মতো ব্যস্ত পরিবার পৃথিবীতে দুটো নেই হয়তো। এই পরিবারে বর্তমানে সেই একজন যার কোনো ব্যস্ততা নেই।
প্রান্তি মনোযোগ দিয়ে ক্যানভাসে তাকিয়ে রয়েছে। যেন সে গভীর কিছু ভাবছে। তিহু একবার ক্যানভাসে অন্যবার প্রান্তির পানে চাচ্ছে। শিল্পীর চোখ যা দেখতে পায় তা নাকি সাধারণ মানুষের চোখ দেখতে পায়না। তরু সে কথাটারই চাক্ষুষ প্রমাণ দেখতে চাচ্ছে।
এর মাঝে প্রান্তি বেশ গম্ভীরভাবে বলে উঠলো,

‘ভাবী তুমি না সেকেন্ড ইয়ারে?’

তিহু খানিক ভেবে উত্তর দিলো,

‘তেমনটাই তো মনে পড়ছে।’

‘ক্লাসে যাচ্ছ না যে!’

তিহু হেসে জবাব দেয়,

‘বিয়ে হয়েছে। ঘর,বর সামলে পড়াশোনা করার সময় কোথায় বলো?’

উত্তরে প্রান্তি ভিষণ সিরিয়াস হয়ে জবাব দিলো,

‘ভাইয়ার সাথে তোমার দেখা হয়নি এখনো এজন্যই এমনটা ভাবতে পারছ। সমস্যা নেই দু এক দিনের মাঝেই তুমি বাস্তবতা শিখে যাবে। এই দুটো দিন না হয় ছেলেখেলা ভাবেই কাটাও।’

তিহু কপাল কুঁচকায়।

‘কেন কেন?’

‘কারণ দু একদিনের মাঝেই তোমার বর ফিরছেন।’

তিহুর বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। তার বর ফিরছে! তিহু না চাইতেও বেশ উত্তেজনা অনুভব করছে। মুখে সে যতই বলুক বর নামক মানুষটার ব্যাপারে সে কেয়ার করেনা কিন্তু মন যেন অন্য কিছু ভাবে। তার মন তাকে না জানিয়েই যেন প্রোণো নামক মানুষটার জন্য বুকের ছোট একটা অংশ গুছিয়ে রেখেছে। তিহু বোঝে না যে মানুষটাকে সে কখনো দেখেনি, যার গলার স্বর অবদি শোনেনি, যার সম্পর্কে কিচ্ছুটি জানে না সে তার জন্য এমন অনুভূতি কিভাবে তৈরি হতে পারে!
উত্তর হয়তো একটাই। মানুষটা তার স্বামী। পৃথিবীর সবথেকে মধুর সম্পর্ক। তার সবথেকে কাছের মানুষ ঐ অজানা মানুষটা।

‘ভাইয়াকে নিয়ে ভাবতে বসে গেলে নাকি!’

প্রান্তির কন্ঠে দুষ্টুমি। তিহু একটু লজ্জা পায়। মুখে বলে,

‘তুমি কিন্তু বেশ দুষ্টু।’

‘অন্য ভাবীরাও সেটাই বলে।’

অন্য ভাবীদের কথা উঠতে তিহু সোজা হয়ে বসে। একটু আমতা আমতা করে বলে,

‘তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিলো। কিছু মনে করো না কেমন?’

‘একটা কেন দশটা জিজ্ঞেস করো। আমার আপত্তি নেই।’

তিহু কিছুটা স্বস্তি পায় জেন।

‘ভাবীরা কেউ আমার সাথে কথা বলেন না কেন?’

‘ইসস দেখেছো তোমায় এখনো আমাদের গ্রুপে অ্যাড দেওয়া হয়নি। আজই দিয়ে দিবনি। তুমি মন খারাপ করোনা গো। আসলে তোমার এ বাড়িতে আসার ঠিক দুদিন পূর্বে এ বাড়িতে বিশাল ঝামেলা হয়েছে। মায়ের উপর রাগ করেই তোমার বড় ফিরে গেছেন। বাড়ির সকলে মায়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো রুম ছেড়ে বের হয়না। ভাবীরা যখন বের হয় তখন মা আশপাশে থাকে বলেই হয়তো তারা কথা বলেন না। কিন্তু গ্রুপে তারা তোমার খুব প্রশংসা করেন। সেজ ভাবী তো সারাক্ষণ বলেন তুমি কত মিষ্টি দেখতে!’

তিহু জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করে। এ পরিবারের কিছুই সে বুঝতে পারে না। অংকের থেকেও জটিল এ পরিবারের মানুষ গুলোর সম্পর্ক। এ পরিবার সম্পর্কে যত জানছে তিহু জেন তত বেশি গোলক ধাঁধার ঘরে আটকে যাচ্ছে। আর তিহুর বর? সে তো নিজেই এক গোলক ধাঁধা। মানুষটা কি একবারের জন্য তার খোঁজ নিতে পারতো না? তিহু কি অন্যায় করেছে? তিহুর উপর কিসের রাগ তার? তিহুকে কিসের শাস্তি দিচ্ছে সে?

চলবে…….?

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

৩.
দিবস রজনী আমি যেন কার..
আশায় আশায় থাকি…
তাই চমকিত মন, চকিত শ্রবণ
তৃষিত আকুল আঁখি।

ভেজা চুলে গামছা ছুঁতে ছুঁতে গুণ গুণ করছে তিহু। প্রান্তির সাথে কথা বলার পর থেকেই তার মন বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। তিহু জানালার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়। জানালার পাশেই মস্ত এক সজনে গাছ। ডাল পালা ছড়িয়ে রাজার মতো দাঁড়িয়ে আছে। এই গাছটার ছোট্ট একটা ডালে প্রতিদিন ঠিক দুপুর টাইমে দুটো চড়ুই পাখি এসে বসে। তিহুর মতে পাখি দুটোর মাঝে গভীর প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। পক্ষীকুল থেকে অদূরে আসে তারা একান্ত কিছু সময় কাটাতে। তিহু রোজ তাদের মনোযোগ দিয়ে দেখে। একটা পাখি পুরোটা সময় শান্ত হয়ে বসে থাকি। অন্যটা ভিষণ ছটফট করে। শান্ত হয়ে বসে থাকা পাখিটা নিশ্চয়ই পুরুষ পাখি হবে, অন্যটা মেয়ে। তিহু এক পলক দেখেই বলে দিতে পারে। তবে আজ তারা আসেনি। তিহুকে খানিক মনমরা দেখালো। ওরা কি বাড়িতে ধরা পড়েছে? ধরা পড়ার ব্যাপারটা জঘন্য।

তিহু যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন তার জীবনে হঠাৎ আসা বৃষ্টির মতো করেই প্রেম এসেছিল। ছেলেটা ছিলো তার এক ক্লাস সিনিয়র। একদিন টিফিনের পর ক্লাসে যেতেই তার টেবিলে একটা চিঠি সাথে একটা লাল গোলাপ পায়। চিঠিতে খুব সুন্দর করে প্রেমের প্রস্তাব করা ছিলো। বলা আছে প্রেমে পড়তে কারণ লাগে না। তিহুর ও কোনো কারণ ছিলো না। সে ও চিঠি দাতাকে না দেখেই টুপ করে তার প্রেমে পড়ে গেল। লজ্জায় লাল নীল হয়ে আকাশে ভাসতে লাগলো। দু রাত তার ঘুম হলো না। চিঠির জবাবে কি লিখবে ভাবতে ভাবতেই হয়রান।
তিহু রঙিন কাগজ কিনলো। আরো দু রাত জেগে চিঠি লিখলো। কিন্তু তা আর তার হঠাৎ করে হওয়া প্রেমিক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলো না। কিভাবে যেন চিঠিখানা তার বাবার হাতে পৌঁছে গেল। তিহু নিশ্চিত ভাবে চিঠি তার স্কুলব্যাগে রেখেছিল। সেটা সকাল হতেই বাবার হাতে কিভাবে গেল বুঝতে পারলো না। এখানে নিশ্চিত কোনো ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।
সে যাই হোক। পুরো একমাস তিহুর ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। বাবা ঠিক করে কথা বলতেন না। তাকে অপরিচিতর মতো ট্রিট করা হতো। কা ভয়ংকর সে অনুভূতি! তিহুর একমাত্র প্রেম এভাবেই ঘর ছেড়ে পালালো। এরপর তার জীবনে আর কখনো প্রেম আসেনি। তিহু সচেতন ভাবেই মনের ঘরে খিল লাগিয়েছিল।

তিহুর উদাসিনতা কাটে কাজের মেয়ে সকিনার কথায়।

‘বড় ভাবী? আহেন। আমার কাজ কাম শ্যাষ। আমি এহন অন্যবাড়ি যাইতাম। মেজ ভাবী রানতেছে। আফনেও আহেন। সব গুছগাছ কইরা দিছি এহন খালি চুলায় দেবেন আর উঠাবেন।’

তিহু চুলে পেঁচিয়ে রাখা গামছা খুলে ফেলে। নেড়ে দিতে দিতে বলে,

‘না খেয়েই চলে যাবে?’

‘ওমা! খাওনের জন্য বইসা থাকি নাকি আমি? একটা প্যাট, খাওনের অভাব হয়না। তাছাড়া আফনাগো মানুষ হিসাব করা মাছ। আমি খাইলে একজনের ভাগে কম পড়ব। আফনের শ্বাশুড়ি যা হিসাবি!’

এটা অবশ্য সকিনা ভুল বলেনি। তার শ্বাশুড়ি ভিষণ হিসাবি মানুষ। এ কয়দিনে তা ঠিক ঠিক বুঝেছে তিহু। বাড়াতে কখনো বাড়তি বাজার করা হয়না। বসুর চাচা মাসিক বাজার করে দিয়ে যান একবারে এবং তা দিয়েই পুরো মাস কাটাতে হয়। এখন মাসের শেষ প্রায়। ফ্রিজে মাছ মাংস বলতে খুব অল্প পরিমাণ রয়েছে। তিহুর এ বাড়িতে নতুন আসা উপলক্ষে অনিয়মিত রান্না করা হয়েছে। তাছাড়া দুদিন কিছু বাড়তি মেহমান ছিলো। সব মিলিয়ে এ মাসে অন্যমাসের তুলনায় বাজার খরচ পড়েছে বেশি। রান্নার তেল শেষের পথে। তিহু এ কথা সবুর চাচাকে বললে তিনি বলেছেন,

‘এ কথা আপনার শ্বাশুড়ির কাছে বলেন বউ। আমার হাতে কিছুই নাই। আমাকে যা বলা হয় আমি তাই করি শুধু।’

এ বাড়ির কাজের লোক থেকে শুরু করে সকলে তার শ্বাশুড়িকে মানেন খুব। তার কথাতেই চলে পুরো সংসার। কিন্তু তেল ছাড়া রান্না চলবে কিভাবে? মাস শেষ হতে এখনো নয়দিন বাকি।

তিহু মাথয় কাপড় টেনে সকিনাকে বলে,

‘অতো ভেবোনা তো তুমি। এসো দুপুরের খাবারটা খেয়ে যাও। তুমি নাহয় আমার ভাগের এক পিস মাছ খেলে।’

সকিনার চোখ চকচক করে ওঠে। দু বছর যাবত কাজ করছে সে এই বাড়িতে। এবাড়ির কেউ কখনো তাকে এক বেলা ভাত খেতে বলেনি। এতে অবশ্য সকিনার আপত্তি ছিলো না। মাইনে অন্যসব বাড়ির থেকে বেশি দেয় এ বাড়িতে। এক বেলা ভাতে কি আসে যায়!

সকিনাকে টেবিলে খেতে দেওয়া হয়েছে। তিহু তাকে বেশ বড় দেখে এক পিস মাছ দিয়েছে খেতে। তিহুর মেজ জা রেমী ভাজি করছে। চার পদের সবজি দিয়ে ভাজি করা হচ্ছে। তিহু ভাবছে সে একঠু ভাজি চেয়ে আনবে কিনা। রেমীর সাথে তার কথা হয়নি এখনো।
তিহু রান্নাঘরের দরজার সামনে মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। রেমী আড় চোখে তাকে দেখে। বলে,

‘কিছু লাগবে তোমার?’

তিহু আমতা আমতা করে।

‘একটু ভাজি নিতাম। সকিনার খাওয়া প্রায় শেষ।’

‘একটা বাটি দাও। আমি তুলে দিচ্ছি।’

তিহু দ্রুত পায়ে বাটি হাতে রেমীর পাশে দাঁড়ায়।

‘তুমি করে বলেছি বলে রাগ করোনি তো? বয়সে কিন্তু তুমি আমার থেকে অনেকটাই ছোট। আমার ছোট বোনটা তোমার বয়সী। তোমায় দেখলে আমার তোমাকে ছোট বোনের মতোই মনে হয়। তবে তুমি যদি চাও তাহলে বড় জায়ের মতো করেও দেখতে পারব।’

তিহু চোখ মুখ চকচকে। রেমী তার সাথে কথা বলায় সে বেশ খুশি। তুমি, আপনিটা আপাতত ম্যাটার না। তবে রেমী যদি তার সাথে ভাব দেখিয়ে কথা বলতো তাহলে তিহু অবশ্যই তার সম্মানে বড় হওয়ার ফায়দা লুটে নিত। আপাতত সেসব মাফ।

‘কোনো ব্যাপার না। আমার নাম ধরেই ডেকো না হয়। এ বাড়িতে আমি এতগুলো বড় বোন পাব তা ভাবিনি। আমার তো নিজেকে ভাগ্যবতী বলে মনে হচ্ছে।’

রেমী মুচকি হাসে। সে কথা খুব কম বলে। বাকি দুজন জায়ের সাথেও তার তেমন কথা হয়না। সে বাদে এ বাড়ির বাকি সবঢ়মেয়ে বউয়েরাই চটপটে স্বভাবের। তিহু হয়তো সবার প্রাণকেন্দ্র হয়ে থাকবে। মেয়েটা বেশ মিষ্টি স্বভাবের। কি দারুন ভাবে কথা বলে!

______________

তিহু সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। মাথার উপর শব্দ করে ফ্যান ঘুরছে। তবে ফ্যানের বাতাস যেন তার দেহ পর্যন্ত পৌঁছাতে পাড়ছে না। মাঝ পথ থেকেই হাওয়া হয়ে যাচ্ছে।
এ বাড়ির অন্যসবার রুমে এসি থাকলেও এ রুমটাতে নেই। তার বর কি অন্যসবার থেকে গরীব? তেমন হলে তিহুর খুব দুঃখ হবে। সে তো ভালো ব্রান্ডের জামাকাপড় ছাড়া পড়তে পারে না। তিহু মোবাইল হাতে নিয়ে গুগলে সার্চ করলো,

‘How much money does a detective earn per month’

কিন্তু গুগলের জবাব দেখে তিহুর চোখ কপালে। ও মা গো! এত হলেতো তার রানীর হলে থাকার কথা। তাহলে সে একশো বছরের পুরোনো রং ওঠা দালানের এসি বিহীন কামরায় কি করছে? সে কি ভুল করে এখানে চলে এসেছে?
তার বর মশাই ফিরলে তিহু অবশ্যই জানতে চাইবে এ রুমে এসি কেন লাগানো হয়নি। ঠিক কোন উদ্দেশ্যে। সে কি চাইছে এই অতি গরমে হিট অ্যাটাকে তিহু মারা যাক? এর জবাব তিহুর অবশ্যই অবশ্যই দরকার।
তিহু হুড়মুড় করে প্রান্তির ঘরে হানা দেয়।

‘বালিকা শুনছো? চটপট করে তোমার স্বৈরাচার ভাইয়ের নম্বরখানা দাও তো।’

প্রান্তি সবে গোসল করে বের হয়েছে। বেলা করে গোসল করতে ভালো লাগে তার। সে চকিত চোখে তিহুর দিকে তাকিয়ে আছে। তিহুর হঠাৎ এমন কথায় সে খানিক অবাক হয়েছে। ভাইয়ের ব্যাপারে তিহুকে সে তেমন একটা আগ্রহী দেখেনি। সে খানিক হতাশ হয়েছিল। তিহুর হঠাৎ এই পরিবর্তনে সে খানিক চিন্তিত। সব ঠিক থাকলেই হলো!

‘কিন্তু ভাবী ভাইয়াতো কারো কল ধরছে না!’

‘সেটা পরের ব্যাপার। শূন্য দশমিক শুন্য এক ভাগ সম্ভাবনা যেখানে আছে সেখানে হাল ছাড়তে নেই, জানো না এ কথা?’

প্রান্তি উপর নিচ মাথা নাড়ায়। এই ভাবীকে তার মনে ধরেছে খুব। সে খুশি মনে ভাইয়ের নম্বর ফাঁস করে দিলো। ভাইয়ের এই নম্বর কেবল সে এবং প্রিমা জানে। অন্য কাউকে জানানো মানা। কিন্তু প্রান্তি সেই নিষেধাজ্ঞা পেরিয়ে তিহুকে নম্বর দিয়ে দিয়েছে। কিছু সময় জীবনের রিস্ক নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরী।

চলবে………?