তার নাম জানিয়েছি সূর্যাস্তকে পর্ব-০৪

0
15

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

৪.
তিহু ঘরজুড়ে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। হাতের মাঝে মুষ্টিবদ্ধ মোবাইল। অসহ্য রকম গরমে তার অতিচিন্তা যেন সূর্যের তেজকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। কপাল বেয়ে গড়িয়ে চলছে সূক্ষ্ম ঘামের স্রোত। নাকের ডগায় জমেছে শিশির কণার মতো বিন্দ বিন্দু ঘাম। ফর্সা মুখখানা অস্থিরতায় লাল হয়ে উঠছে ক্রমশ। তিহু বুক ভরে শ্বাস নেয়। চোখ বন্ধ করে একবার আয়াতুল কুরসি পড়তে নেয়। কিন্তু এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। বিপদের সময় এসবকিছু মনে থাকে না। তিহু ভয় পাচ্ছে, পাছে যদি তার বরের কন্ঠ হয় আলিফ লায়লার রাক্ষসের মতো! কিংবা কিংকং সিনেমার গরিলাটার মতো!
তিহু আবারো বড় করে শ্বাস নেয়। নশ্বর এ পৃথিবীতে প্রতিটি জীবকেই মৃত্যু বরণ করতে হবে। মৃত্যুর স্বাদ কেউ এড়িয়ে যেতে পারবে না। বাক্য দুটো মনে প্রাণে বিশ্বাস করে সে। তাই সে ভয় পাবে না। প্রোণোর নম্বরটা মোবাইলে তোলাই ছিল। তিহু চোখ বন্ধ করে ডায়াল করে দেয়।
মোবাইলে যতবার ডায়াল টোন বাজছে তিহুর হৃৎপিণ্ড তত জোরে শব্দ করছে। কি অদ্ভূত! হৃদয়ের কোনো একটা অংশ এর মাঝেও যেন আনন্দ অনুভব করছে। উত্তেজনায় ডিপ ডিপ শব্দ করছে। তিহুর পুরো দেহ জুড়ে থাকা এই উত্তজনা মুহূর্তেই মাটিচাপা পড়ল। প্রোণো তার কল রিসিভ করেনি।
তিহুর মনে হলো কেউ তার শরীরে বুঝে শুনে কাঁটা ফুটিয়েছে। এই লোকের এত বড় কলিজা! নাহ মোটেও এই লোকের কলিজা বড় নয়। বউয়ের ভয়ে লেজ গুটিয়ে বসে আছে এটা কাপুরুষের লক্ষণ। তিহু এতদিনে নিজের বর সম্পর্কে আরো একটা তথ্য উদ্ধার করেছে। তার বর ভিষণ রকম কাপুরুষ স্বভাবের!
তিহু উদাস ভঙ্গিতে বিছানার কোণ ঘেঁষে বসে পড়লো। চোখ জোড়া উদাস। তার মন বলছে সে এই সংসারের মায়ায় পড়েছে। তার না দেখা বরটার কল না ধরার মতো অতী সূক্ষ্ম বিষয়টাও তাকে আহত করছে। দিনে দিনে সে পাক্কা গৃহিণী হয়ে উঠছে। এমনটা মোটেও তার ইচ্ছা ছিলো না। সে তো মুক্ত পাখির মতো উড়তে চায়। দেশ বিদেশ ঘুরে অজানা শব্দ কুড়াতে চায়। তাহলে সংসারের মতো বন্দী জীবন কেন তার মন গ্রহণ করছে?

______________

মুছাদ্দেফা খাতুন নিজ ঘরে বসে কাঁথা সেলাই করছেন। ছোট ছোট কাথা। তার ঘরে নতুন অতিথি আসতে চলছে। এ বাড়িতে এই প্রথম কোনো ছোট প্রাণ আসবে। দাদী হিসেবে তার অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু চোখের পাওয়ার আর আগের মতো নেই। লাল আর কমলার মধ্যে আজকাল সে পার্থক্য খুঁজে পায় না। সময়ের সাথে সাথে ঘোলা হয়ে আসছে দৃষ্টিশক্তি। ডাক্তারের কাছে যাওয়া হচ্ছেনা। ঠিক অবহেলা বলা যায় না। একা একা যেতে সাহস হয়না। ছেলে মেয়েগুলো তার উপর অভিমান করে আছে। কতদিন হলো কেউ একবারের জন্য তার ঘরে উঁকি দিয়ে পর্যন্ত দেখেনি। মাঝে মাঝে মনে হয় ছেলে মেয়েদের সাথে তার সম্পর্ক দুই দেশের মাঝের সুউচ্চ বর্ডারের মতো হয়ে গেছে। একই ছাদের তলে থেকেও কারো সাথে কথা সাক্ষাৎ নেই।
এই যে তার সেজ ছেলের বউ গর্ভবতী একথা সে জেনেছে বাড়ির কাজের মেয়ের থেকে। এ বাড়ির প্রত্যেকেই হয়তো জানে এ কথা। কেবল সে ছাড়া। তাকে জানানো হয়নি কারণ সে মা হিসেবে ব্যর্থ। সকিনা যখন তাকে খবরটা দিল সে খুশির থেকে আহত হয়েছিল বেশি। যেন তীরের সুচালো লোহার অংশটা সজোরে তার বুকে আঘাত করলো। তবুও সে অভিমান করতে পারেনি। মা হয়ে অভিযোগ জানাতে পারেনি। কাকে জানাবে? সন্তানেরা যে দেয়াল তুলেছে! বউ তো অন্য বাড়ির মেয়ে! যেখানে সন্তানরাই তাকে শত্রু ভাবে সেখানে বউয়ের কথা আসবে কেন?

‘মা আসব?’

দরজায় টোকা পড়েছে। মুছাদ্দেফখা খাতুন সযত্নে সেলাইয়ের কাঁথা,সুতা বালিশের নিচে লুকালেন। চোখে আসা অল্প জলটুকুও মুছে নিলেন শাড়ির আঁচলে।

‘আসো।’

তিহু ছোটছোট পায়ে শ্বাশুড়ির ঘরে ঢোকে। হাতে চায়ের ট্রে। সাথে আছে গরম গরম পাকোড়া।
তিহু বিছানার উপর ট্রে নামিয়ে রাখে।

‘আপনার শরীর খারাপ করেছে নাকি?’

‘ও তেমন কিছুনা। এসব টুকটাক সমস্যা বয়সের সাথে সাথে সবারই হয়। আমার ও বয়স হয়েছে। মাজার ব্যাথা বাড়ছে। কিছুদিন পর পায়ের জয়েন্টে ব্যাথা হবে। তারপর পুরোপুরি বিছানায় পরে থাকব। এখন তো তাও হেঁটে চলে খেতে পারছি।’

‘কি যে বলেন মা! আপনার থেকেও কত বয়স্ক মানুষ দিব্যি সুস্থ অবস্থায় হেঁটে চলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু নিজের যত্ন নিলেই হয়। বয়স কোনো ব্যাপার না। ওটা কেবল অযুহাত। আমার কাছে চমৎকার একটা মালিশ আছে। আপনায় মালিশ করে দিব?’

‘ওসব মালিশে কাজ নেই। যদি পার রসুন দিয়ে সরিষা তেল গরম করে তাই মালিশ করে দাও।’

‘আচ্ছা। আসছি এক্ষুনি।’

তিহু উঠে গেল। মুছাদ্দেফা খাতুন সেদিকে তাকিয়ে আবারো বড় শ্বাস ফেলেন। মেয়েটাকে সে পছন্দ করে নিয়ে এসেছে বড় ছেলের জন্য। এই অপরাধেই হয়তো মেয়েটার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। ছেলেটা বউয়ের মুখটা অবদি দেখল না। কিসের জেদে? সে পছন্দ করেছে মেয়েটাকে তাই? এমন জানলে মুছাদ্দেফা এ বিয়েতে মানা করে দিত। পুতুলের মতো মেয়েটাকে কেন তার অপরাধের শাস্তি পেতে হবে। মেয়েটা কি পাপ করেছে?
কিন্তু নিয়তি নিষ্ঠুর। এখন তার হাতে আর কিছুই নেই। সে চাইলেও আর কিছু গুছাতে পারবে না। তার সোনার সংসারটা ভেঙে যেতে দেখেই হয়তো মরতে হবে তাকে। তার চোখ দুটো আবারো পানিতে ভরে আসতে চায়। সে শুনতে পায় তিহু ওপাশ থেকে জিজ্ঞাসা করছে,

‘মা সরিষা তেল তো দেখছিনা কোথাও। কোথায় রাখা আছে?’

এ বাড়িতে সরিষা তেল খাওয়া হয়না সেভাবে। মাঝে মধ্যে ভর্তা তৈরি করতে লাগে বলে ছোট বোতল কেনা হয়। কিন্তু মাস খানেক যাবত কোনো রকম ভর্তা করা হয়নি। তার সেজ ছেলে প্রিয়ম ভর্তা পছন্দ করে খুব। ছুটিতে এলে তখন প্রচুর ভর্তা করা হয়। মুছাদ্দেফা সবসময় নিজ হাতে যত্ন করে ভর্তা বানায় তখন। তার হাতের ভর্তা ছাড়া নাকি অন্যকারো হাতের ভর্তায় অর্জিনাল স্বাদ পাওয়া যায় না। তাই সে এই কাজটা খুব আনন্দ নিয়েই করে। কিন্তু…
মোছাদ্দেফা জোর গলায় উত্তর দেয়,

‘দেখ রান্নাঘরের তাকের উপর আছে। ছোট একটা বোতল। ১০০ মিলি এর।’

_____________

তিহু তার শ্বাশুড়ির থেকে ভার্সিটি যাওয়ার অনুমতি পেয়ে গেছে। যদিও সে সরাসরি অনুমতি দেয়নি। বলেছে,

‘বাবুর থেকে শুনে নিও একবার। ওর আপত্তি না থাকলে আমার কোনো আপত্তি নেই।’

এটাকেই তিহু সমর্থন হিসেবে ধরে নিয়েছে। তাছাড়া যে লোক লেজ গুটিয়ে লুকিয়ে বসে আছে তার থেকে পারমিশন নেওয়ার প্রয়োজন মনে করছে না সে। ব্যাটা কেবল বাড়িতে আসুক, তিহু তার গুটিয়ে রাখা লেজ টেনে সোজা করবে। আজ রাতটা কেটে দিন হলেই তিহু বাইরে যেয়ে শান্তির একটা শ্বাস ফেলবে। এ বাড়িতে থাকতে থাকতে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
কিন্তু বিপত্তি অন্যদিকে। তার একটাও সেলোয়ার কামিজ নেই এ বাড়িতে। এতদিন ধরে সে শাড়ি পরে কাটাচ্ছে। তিনটা শাড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ছে। তাকে কি জামা কাপড় কিনে দেওয়া হবেনা? আশ্চর্য! এ কেমন বনেদি পরিবার দেখে তাকে বিয়ে দিলো তার বাবা? শাড়ি পরেই ক্লাসে যাওয়া যেত কিন্তু এমন লাল রঙের সুতির শাড়ি পরে কে ভার্সিটিতে যায়? তার নিজের ও তো একটা সম্মান আছে তাইনা?

তিহু কাবার্ড খুলে খুঁজে দেখলো কোথাও তার জন্য একটা সুতির ছেড়া কামিজ পর্যন্ত রাখা আছে কিনা। কিন্তু না কোথাও নেই। কাবার্ড জুড়ে কেবল তার বরের ব্রান্ড নিউ শার্ট, টি শার্ট ভরা। তিহু ভেবে পায়না মানুষ এত দায়িত্বহীন,কিপ্টা কেমনে হয়। তার হাত খরচের জন্য যদি খবিস লোকটা টাকা না পাঠায় তাহলে সে এসব শার্ট, টি শার্ট ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দুশো, তিনশো টাকায় বিক্রি করে দিবে। কাস্টমারের চাহিদা হিসেবে দাম বাড়তেও পারে!

সারাদিনের অযথা ধকল শেষ করে তিহু যখন ঘুমানোর জন্য বিছানায় গেল তখনই সেদিন প্রথমবারের মতো তার মোবাইল বেজে উঠলো। প্রথম বলার কারণ তার বিয়ের পর অদ্ভূত ভাবে সবাই তাকে ভুলে বসেছে। হোক সেটা তার পরিবার কিংবা বন্ধু-বান্ধব। যেন বিয়ে করে তিহু অন্য গ্রহের বাসিন্দা হয়ে গেছে। যার সাথে পৃথিবীর মানুষদের যোগাযোগ রাখা নিষিদ্ধ।

চলবে……….?