#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি
৬.
তিহুর তার বর খোঁজা হলো না। রান্নাঘরে ডাক পড়েছে তার। এত মানুষের জন্য নাস্তা তৈরি করতে যেয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে রেমীকে। তিশাকেও রান্নাঘরে দেখা গেল। ডুবা তেলে লুচি ভাঁছে সে। রেমী পাশে দাঁড়িয়ে লুচি বেলছে। সকিনা চোখ মুখ কুঁচকে আছে। বোঝাই যাচ্ছে সে চরম মাত্রায় বিরক্ত। তিহু সকিনার পাশে বসে। সকিনার হাত থেকে মসলার বাটিটা নিয়ে সরল হেসে বলে,
‘আমি মসলা করে দিচ্ছি। তুমি অন্যকিছু করো নাহয়।’
সকিনা খুশি হলো যেন। সে আলু ছুলতে বসলো। লুচির সাথে আলুর দম করা হবে।
তিহু আশপাশে তাকিয়ে তার শ্বাশুড়িকে কোথাও দেখতে পেল না। সে পুনরায় ফিসফিস করে সকিনাকে বললো,
‘মা কোথায় বলতো? দেখছি না যে!’
‘কোই আর যাইবো! নিজের ঘরের দরজায় খিল দিয়া বইসা আছে। আজকে তারে বাইরে দেখন যাইবো না।’
তিহু বোঝার মতো করে মাথা নাড়ায়। কিন্তু সবকিছুই তার কাছে ধোঁয়াশর মতো। কি যে চলছে এ বাড়িতে!
‘ভাবী তুমি আলুর দম করতে পারো?’
তিশার কথায় তিহু বোকা চোখে তাকায়। তিশা তিহুর বোকা চাহনি দেখে হেসে ফেলে।
‘এমা আমি এ বাড়ির ছোট বউ বলে কথা! কিভাবে তোমায় নাম ধরে ডাকি বলোতো। তাছাড়া ভাইয়া বাড়িতে রয়েছেন। তার সামনে তার বউকে নাম ধরে ডাকলে ব্যাপারটা কেমন হয়ে যায়না বলো?’
তিহু মুচকি হাসে।
‘বেশ তবে। তোমায় তবে আমি ছোট আপু বলে ডাকি?’
‘যা খুশি ভাই। আমার কিছুতে আপত্তি নেই।’
তিশা পুনরায় তিহুর দিকে ফিরে দুষ্টু হাসে। বলে,
‘তো ভাইয়াকে কেমন লাগলো? লজিকালি হিসাব করলে কাল তোমাদের প্রথম এবং স্পেশাল রাত ছিলো! অনুভূতি কেমন হুম হুম?’
তিশা ঠিক কোন দিকে ইশারা করছে বুঝতে বাকি নেই তিহুর। তার ফর্সা গালে রক্তিম আভা ছড়ায়। এভাবে কেউ লজ্জ দেয়?
কিন্তু তিহু এ কথার উত্তর ঠিক কিভাবে দিবে ভেবে পায় না। তার কি বলা উচিত মস্ত এক অজগরের সেই লকলকে জিভ আর তীক্ষ্ণ সবুজ চোখের কথা? তার প্রথম রাত একশ ভাগ স্পেশাল কেটেছে। দম বন্ধ হয়ে মরে যেতে যেতে বেঁচে যাওয়ার ঘটনাটা নিশ্চয়ই স্পেশাল!
তিহুকে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করে রেমী। সে তিশাকে বলে ওঠে,
‘তুমি সবার জন্য জুস নিয়ে যাও তিশা। সবাই অপেক্ষা করছে।’
তিহু মনে মনে কয়েকশো ধন্যবাদ জানায় রেমীকে। তবে তিশা যাওয়ার আগে বলে যায়,
‘পরে শুনব কিন্তু। রেডি থেকো!’
_____________
তিহু রান্নাঘরের দরজার আড়ালে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। ডায়নিং এ সবার সামনে যেতে ভিষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। তার থেকে বড় কথা সে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। লজ্জা তাকে ঘিরে ধরেছে। এভাবে কিভাবে সে সবার সামনে যাবে?
প্রান্তি তখন রান্নাঘরে এলো চিনির কৌট খুঁজতে। তিহু তাকে দেখতেই স্বস্তি পেল। আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বললো,
‘প্রান্তি তোমার ভাইয়া কি খেতে পছন্দ করেন?’
প্রান্তি কিছুটা ভাবুক উত্তর দেয়,
‘মেইবি কষা মাংস আর সাদা ভাত।’
‘তার পছন্দের রং কি?’
প্রান্তি কপাল কুঁচকে বলে,
‘তা ঠিক জানা নেই। কেন বলোতো?’
তিহু ফিচেল হাসে। সে তো শিওর হতে চাইছিল এভাবে তার বরকে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা সে ব্যাপারে। কিন্তু তা কি মুখে বলা যায়?
প্রান্তির কপালের ভাঁজ গাঢ় হয়। সে সন্দিহান গলায় বলে,
‘ভাবী তুমি ঠিক কি জানতে চাইছ বলো তো!’
তিহু ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। তার অভিনয় করার দক্ষতা একদম হিরো আলমের পর্যায়ে। যে কেউ বুঝে ফেলে তার অভিনয়ের বিষয়টা। তাই অভিনয় ধরে না রেখে বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে মনের কথাই বলে ফেলল,
‘আসলে আমি তোমার ভাইয়াকে খুঁজে পাচ্ছি না!’
প্রান্তি ফিক করে হেসে ফেলে তিহুর মুখ দেখে। কিছুটা এগিয়ে তিহুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
‘প্রথমত আমার যে সুদর্শন ভাইটা জুসের গ্লাস হাতে তোমার দিকে চেয়ে আছে সেটাই তোমার বর এবং দ্বিতীয়ত আমি প্রান্তি নই প্রিমা। নাইস টু মিট ইউ ভাবী।’
বলেই চোখ টিপ দিলো প্রিমা। তিহু ভালো করে লক্ষ করতেই দেখল সত্যিই এই মেয়েটার ঠোঁটের কাছে একটা তিল রয়েছে। তবে খুবই ক্ষুদ্র। খুব কাছ থেকে না দেখলে বোঝাই যাবে না!
লজ্জায় তিহুর মাথা নিচু হয়ে আসতে চায়। তখনই নজর আটকায় সামনে। কালো রঙের টিশার্ট পড়া শ্যাম পুরুষটি তার দিকেই তাকিয়ে। খানিক বাদে বাদে চমৎকার ভাবে চুমুক বসাচ্ছে জুসের গ্লাসে। তিহু চোখ ফেরাতে পারলো না। বেহায়ার মতোই চেয়ে থেকে পর্যবেক্ষণ করলো মানুষটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কপালের এক পাশে ছোট একটা কাঁটা দাগ। হয়তো কোনো মিশনে গিয়ে আঘাত পেয়েছে! চুল সুন্দর করে সেট করে রাখা। মুখমণ্ডল ক্লিন সেভ করা। আকর্ষণীয় জ লাইন। গোটা মানুষটাকেই তিহুর কাছে আকর্ষণীয় বলে মনে হচ্ছে। এই যে সে কথা বলার মাঝে মাঝেই আড় চোখে তিহুকে দেখছে সেটাও ভিষণ সুন্দর। তিহু চোখ ফিরিয়ে নেয়। আগুনে বেশিক্ষণ তাকাতে নেই। চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
‘তারপর? কেমন আমার ভাই?’
প্রিমার কথায় কান গরম হয়ে আসে তিহুর। লজ্জার আভা সারা মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পরলেও সে শক্ত হয়ে জবাব দেয়,
‘খারাপ না! চলবে!’
প্রিমা পুনরায় হেসে চিনির কৌট নিয়ে বেরিয়ে যায় রান্নাঘর থেকে। তিহু সময় নিয়ে বের হয়। তিহুকে দেখতেই বাকি তিন দেবরের একজন হেসে সালাম দেয়। তিহু মুচকি হেসে উত্তর নেয়। এত বড় বড় মানুষগুলোর মুখে ভাবী ডাক শুনতে কেমন অদ্ভূত লাগছে তার। তার উপর তারা সম্মানে ভাসিয়ে ফেলে আপনি করে বলছেন। তিহু সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। কিন্তু তাকে এ অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকতে দিলো না। প্রান্তিক রেমীকে বললো,
‘তুমি বসো। আজ ভাবী খাবার সার্ভ করবে। আমাদের কি আর রোজ রোজ এভাবে ভাবীর বেড়ে দেওয়া খাবার খাওয়ার সুযোগ হবে নাকি?’
তিহু বিপাকে পড়েছে। সে সবার প্লেটে তিনটা করে লুচি আর আলুর দম বেড়ে দিতে লাগলো। পাবেলের (ছোট দেবর) প্লেটে খাবার দিতেই সে বললো,
‘ভাবী আমাকে দুটো লুচি বাড়িয়ে দেওনা গো!’
তিশা সাথে সাথেই চেঁচিয়ে উঠলো,
‘এই একদম না। হিসাব করে বানানো লুচি। তোমাকে দুটো বেশি দিলে কম পরে যাবে।’
পাবেল হেসে মজা করে বলে,
‘সমস্যা কোথায় ভাবীর ভাগ থেকে নাহয় দিবে!’
তিহু পাবেলের প্লেটে একটা লুচি বাড়িয়ে দেয়। একইভাবে প্রান্তিক এবং প্রিয়মের প্লেটেও। পাবেলকে বলে,
‘ছোট ভাইয়াকে একাকে দিলে আমার অন্য দু ভাইয়ের মন ভার হবে না? আমি বরং আমার ভাগেরটা তিন ভাইকেই ভাগ করে দিলাম।’
প্রিমা, প্রান্তি অভিযোগ করে বসে। তারা কি দোষ করেছে? তিহু তাদের প্লেটেও একটা করে বাড়িয়ে দেয়। মুচকি হেসে বলে,
‘এ দুটো তোমার ভাইয়ার ভাগ থেকে!’
বাকি সবার চোখ আকাশে। প্রোণো নিজেও কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে। তার প্লেট এখনো ফাঁকা পরে আছে। তার ভাগের অন্য এক টুকরো লুচি তিহু তার শ্বাশুড়ির প্লেটে যোগ করে সকিনাকে দিয়ে তার রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। তিহু সবার প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসে। বলে,
‘আজ তোমাদের ভাইয়ার সাথে আমার শপিং এ যাওয়ার কথা। ব্রেকফাস্ট বাইরেই করে নিব। তোমাদের খাওয়া হলেই আমরা রেডি হয়ে বের হবো। এখন ঝটপট খেয়ে নাও তো!’
প্রোণো তার অঘটন প্রিয় বউকে অবাক চোখে দেখে। এই মেয়ের মাথায় এত বুদ্ধি আছে জানা ছিলো না তো!
চলবে……….?
(ভুল ত্রুটি মার্জনা করিবেন।)