তার নাম জানিয়েছি সূর্যাস্তকে পর্ব-০৯

0
19

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

৯.
বন্ধুমহলের একমাত্র গম্ভীর শান্ত স্বভাবের ব্যক্তিত্ব প্রোণো। গ্রুপের বাকি সবাই যখন সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে গিটারের তারে সুর তুলতে ব্যস্ত থাকতো সে তখন এক কোণে বসে বইয়ের পাতা উল্টাতো। সে যেন অন্যসবার থেকে কয়েক শতাব্দী পেছনে বাস করতো। খানিক বাদে বাদে ভারী গলায় বলতো,

‘অকারণে শব্দদূষণ কেন করছিস? এখানে কি কনসার্ট হচ্ছে?’

গ্রুপের সবথেকে উদাস ছেলে নাদিম তখন হাই তুলে বলতো,

‘জীবনের প্রতিটা মুহূর্তই উপভোগ যোগ্য। চাইলে দুজনকে নিয়ে গিটারে সুর তুলেও কনসার্টের ফিল নেওয়া যায়। কিন্তু তার জন্য হৃদয় লাগে, অনুভূতি লাগে। বইয়ের পৃষ্ঠায় লেগে থাকা জ্ঞান দিয়ে কেউ তা উপভোগ করতে পারে না।’

সেসব সময় এখন অতীতের স্বর্ণ পাতায় রয়ে গেছে। জীবন আটকে পড়েছে দায়িত্ব আর অর্থ উপার্জনের খাদে। সেই উদাসীন ছেলেটাও আজ টাইম টু টাইম অফিস করে। একটা সফটওয়্যার কোম্পানি চালায় সে। উদাস চোখে আকাশে চেয়ে থেকে হাই তোলার সময় হয়না এখন আর। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে এখন বুক চিরে বেরিয়ে আসে ক্লান্তির নিঃশ্বাস।

মিহুল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বড় করে শ্বাস ফেলে। চোখ বন্ধ করে বলে,

‘কত বছর এই স্বাদ পাই না!’

পরক্ষণে দোকানীকে ডেকে বলে,

‘চাচি আপনার হাতে জাদু আছে বুঝলেন। অন্য কোথাও চা খেয়ে তৃপ্তি পাওয়া যায় না‌। আর এক কাপ বানান তো।’

প্রোণো তখনো তার কাপে চুমুক দেয়নি। তিহু কল করায় সে যতটুকু অবাক হয়েছে তার থেকে বেশি অবাক হয়েছে কল কেটে দেওয়ায়। এই মেয়ের কখন কি মর্জি হয় কে জানে!

‘কে ছিলো? ভাবী?’

মৃদুলের কথায় প্রোণোর ছোট করে উত্তর দেয়,

‘হুহ।’

নাদিম এবার উৎসাহ নিয়ে বলে ওঠে,

‘বিয়ে তো করলি বেশ নাটক করে। তোর বউ এখনো আছে? আমি তো ভাবলাম ডিভোর্সের জন্য উকিলের খোঁজ নিতে এলি কিনা!’

নাদিমের ত্যাড়া কথা প্রোণো পুরোপুরি ভাবে এড়িয়ে গেলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সময় দুটো পেরিয়েছে। আকাশে রোদ নেই। পেজা তুলার মতো ধুসর মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। আর এক পশলা বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।
প্রোণো চায়ের কাপে চুমুক বসায়। সাথে সাথেই চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। চিনির পরিমাণ অতিরিক্ত। তার উপর চা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় মিষ্টির পরিমাণটা তার জিভে অসহনীয় ঠেকছে। প্রোণো চায়ের কাপ নামিয়ে রাখে। তা দেখে মিহুল বলে,

‘ঠিক কি হয়েছে বল তো? ওদের কথা বাদ দে। তুই আমাকে বল। বিবাহ জীবন নিয়ে দুঃখে থাকলে আমার থেকে ভালো সলিউশন আর কোথাও মিলবে না বন্ধু। তিন বছরের অভিজ্ঞতা! কোনো ফি ছাড়াই সলিউশন দিয়ে দিব।’

প্রোণো চোখ কোণা করে তাকায়। নাদিম চাপা হাসছে। মৃদুলের মুখভাব বোঝা যাচ্ছে না। সে আপাতত অন্যদিক মুখ ফিরিয়ে আছে।

প্রোণো ফুস করে শ্বাস ফেলে। অসহায় ভাবে বলে,

‘এক্সাক্ট কোন কারণ গুলোতে মেয়েরা আপসেট হয়?’

মিহুলের মুখের হাসি মুহূর্তেই গায়েব হয়ে যায়। তার চোখ জুড়ে এড়িয়ে পড়ে অসহায়ত্বের ছাপ। কন্ঠস্বরে অসহায় ভাব নামিয়ে জবাব দেয়,

‘কোনো এক্সাক্ট কারণ নাই মামা! তুই যদি বলিস সুন্দর লাগছে এই কথাটাও তাদের আপসেট করতে পারে আবার যদি বলিস সুন্দর লাগছে না সেটাও আপসেট করতে পারে। সর্বশেষ যদি কিছু না বলিস সেটাও তাদের আপসেট করতে পারে।’

প্রোণোর চোখ ছোট হয়ে এসেছে। কপালের চামড়ায় ভাঁজ ফেলে সে বিরবির করে বলে ওঠে,

‘হরেবল!’

______________

ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নেমেছে। তিহু রুমের জানলা মেলে দিয়ে সটান দাঁড়িয়ে আছে। জানালার বাইরে যে গাছটা রয়েছে তার ডালপালা বৃষ্টির ছন্দে দুলছে। তাদের বেশ খুশি লাগলেও খুশি মনে হলো না ডালে বসে থাকা কাকটাকে। বৃষ্টির পানিতে তার গোছানো পালক অগোছালো হয়ে পড়েছে। করুন চোখে এক মনে চেয়ে আছে আকাশ থেকে ঝড়তে থাকা বৃষ্টি কণার দিকে। মাঝে মাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশে দেখছে। নিশ্চয়ই তার সঙ্গী সাথীদের খুঁজছে। তিহুর নিজেকে এই একাকী কাকটার মতোই মনে হলো।
বাইরে চেয়ে থাকতে থাকতেই তিহু দেখলো তার রুমের মেঝেতে পানি গড়াচ্ছে। তিহু দ্রুত হাতে জানালা বন্ধ করে। হেঁটে এসে বিছানায় বসে। তার ভিষণ মন খারাপ করছে। বাবার বাড়িতে থাকলে তিহুর এই মন খারাপি খুব সহজেই ভালো হয়ে যেত। কিন্তু এখন হচ্ছে না। খিচুড়ি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে খুব। বৃষ্টির সময় মন খারাপ হলে খিচুড়ি খেতে হয়। এটা ওষুধের মতো কাজ করে।
তিহু রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে উকি দেয়। সকিনা পাটায় ভর্তা বাটছে। তিহু মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাস করে,

‘রেমী আপু কোথায়?’

‘মেজ ভাবী আর ছোড ভাবী গেছে একুরিয়াম পরিষ্কার করতে। একটা মাছ মরছে। ছোড ভাবী কষ্ট পাইছে খুব। সখের জিনিস!’

তিহুর মুখটাও দুঃখী দুঃখী হয়ে যায়। দুঃখের কথা শুনলে তার কেমন দুঃখ দুঃখ পায়। এটা অনেকটা সংক্রমনের মত। কারো হাসি দেখলে হাসি পায়, দুঃখ দেখলে দুঃখ পায়, কান্না দেখলে কান্না পায়। কিন্তু এই দুঃখ তিহুর মন খারাপের থেকে বড় না।

তিহু তার খিচুড়ি খাওয়ার সখের কথা সকিনাকে বলতেই সে জানিয়েছে,

‘খালাম্মায় বলছে কচুর ফুল ভর্তা করতে, রুই মাছের ঝোল আর আলু দিয়ে মুরগি কষা করতে।’

তিহুর মুখ ছোট করে বলে,

‘ভাত কি হয়ে গেছে?’

‘না। মুরগি কষা আর ভর্তা করা শ্যাষ। এখন কুকারে চাউল বসাই দিয়া মাছ ধুইয়া দিয়া যামুগা আমি। মাছ কেডা রানবে তা দেখনের কাজ নাই আমার।’

তিহুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে বেশ ফুরফুরে মেজাজে বলে,

‘তোমার আর কিছু করতে হবে না। তুমি বরং হাত মুখ ধুয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নাও। বাকিটা আমি দেখছি।’

সকিনা খুশি হলেও মুখে প্রকাশ করলো না। আড় চোখ করে বললো,

‘বুইঝেন কিন্তু নতুন ভাবী! পরে আমারে দোষাইতে পারবেন না কিন্তু।’

‘এত প্রেশার যে কেন নাও তুমি! আজ এখানেই খেয়ে যাও?’

‘নাহ। আমার দাওয়াত আছে। আরেক যে বাড়ি কাজ করি সেইখানে। গোশত ভাতের। আমি তাইলে গেলাম নতুন ভাবী।’

তিহু খিচুড়ির জন্য ডাল নামিয়েও থেমে যায়। কিছু একটা ভেবে এক ছুটে ড্রয়িং রুমে যায়। প্রিয়ম আর পাবেল ড্রয়িং এ বসে টাস খেলছে। প্রান্তিক সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। তিহু বাকিদের কাউকে না দেখে পাবেলকে বললো,

‘এই যে দেবর নম্বর টু! বউকে আনতে যাবেন না?’

‘আজই যাব। বিকেলে। এতদিন বাদে এলাম, বউয়ের মুখ না দেখলে ভালো লাগে?’

তিহু মৃদু হাসে। বলে,

‘তা ঠিক। তার পূর্বে দুপুরে যদি খিচুড়ি রান্না করা হয় কেমন হবে?’

প্রিয়ম কিছু বলার‌ পূর্বেই প্রান্তিক বলে উঠলো,

‘খুবই ভালো হয় যদি সেটা রেমী রান্না না করে।’

প্রান্তিকের কথায় পাবেল হেসে ফেলেছে। তিহু বুঝতে না পেরে ভ্রু বাঁকা করে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে পাবেল বলে,

‘মেজ ভাবীর খিচুড়ি রান্নর হাত ভয়ংকর। একবার খেলে দ্বিতীয়বার খাওয়ার সখ ঘুচে যাবে টাইপের।’

‘কোনো ব্যাপার না। আমি চমৎকার খিচুড়ি রাঁধতে পারি।’

তিহুর কাজ শেষ। তিন দেবরের সম্মতি পেয়ে গেছে আর কি চাই? বর সাহেব চুলোয় যাক। সে ফিরলে প্রলয় ঘটবে। রক্তের বন্যা বইয়ে শ্বাস নিবে তিহু। সে মোটেও দুর্বল নারী না যে বরের ধোঁকাবাজিতে কেঁদে কেটে বাবার বাড়ি যেয়ে উঠবে!

______________

প্রোণো বাড়ি ফিরলো বৃষ্টি মাথায় করে। শরীর থেকে তার চুপ চুপ করে পানি পড়ছে। বাহিরে তখনো বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে থেকে থেকে। দিনের এই দুপূরের সময়টাকেও মনে হচ্ছে ভর সন্ধ্যা। খানিকের মাঝেই রাত নামলো বলে। বাড়ির সকলে তখন ডায়নিং এ খেতে বসেছে। তিহু তার শ্বাশুড়িকেও সবার সাথে খাওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি নাকচ করেছেন সাথে সাথে। তিহু নিচু মুখ করে বেরিয়ে এসেছে।
বাহিরের ঝুম বৃষ্টির সাথে সবার প্লেটে খিচুড়ি আর কষা মাংস পড়তেই সবার চোখ চকচক করছে যেন। কিন্তু তিহুর চোখ থমকে আছে দরজার কাছে। সে দেখতে পাচ্ছে তার খুব অপ্রিয় বরটা ভেজা শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সম্মুখে। তিহুকে দেখতেই সরল মুখে বললো,

‘গামছা আর লুঙ্গি এনে দাও তিহু। চেঞ্জ না করে ঢুকতে পারছি না।’

চলবে…..