তার নাম জানিয়েছি সূর্যাস্তকে পর্ব-১০

0
15

#তার_নাম_জানিয়েছি_সূর্যাস্তকে
#লাবিবা_আল_তাসফি

১০.
প্রকৃতি তার রুক্ষ মেজাজ শান্ত করতেই বুঝি ধরণীর বুকে অশ্রু বিসর্জন দিতে মরিয়া হয়ে পড়েছে। বর্ষার ঝাপটায় সজনে গাছের সবথেকে দুর্বল, চিকন ডালটা ভেঙে পড়েছে। গাছে বসে থাকা কালো কাকটা নিজেকে আরো গুটিয়ে নিয়েছে। আশপাশে তাকিয়ে নিজের বর্তমান স্থানের থেকে বিপদমুক্ত স্থানের খোঁজে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে।
খানিক বাদে বাদেই বজ্রপাত হচ্ছে। সেই শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠছে পুরতন দালানটা। তবে সেদিকে আপাতত তিহুর মন নেই। সে প্রকৃতির থেকেও ভারী মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার সেই ভারী মুখখানা নিরবে পর্যবেক্ষণ করে প্রোণো। শুধায়,

‘ক্ষুধা পেয়েছে তিহু। খাবারটা রুমে নিয়ে আসো। বেশি করে আনবে।’

তিহু জবাব না দিয়েই বেরিয়ে গেল খাবার আনতে। প্রণো সেদিক তাকিয়ে হতাশ হয়। এক হাতে গামছায় চুল মুছে অন্যহাতে নাদিমকে কল করে। স্বভাবসুলভ ভাবেই শান্ত ভাবে বলে,

‘আমি কোনো প্রব্লেম ছাড়াই পৌঁছে গেছি। বাকিদের টেনশন করতে মানা কর।’

নাদিম খুশি খুশি গলায় বলে উঠলো,

‘এমন ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে বাড়ি ফেরার কারণটা কি তোর বউ? ভিষণ সুন্দরী বুঝি? বন্ধু দেখি এক দিনেই কুপোকাত!’

প্রোণো এ পর্যায়েও নাদিমের কথাকে নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করলো। কাজেই উত্তর বিহীন কল কেটে দিলো। কাটার পূর্বে শুনতে পেল নাদিম ভারী গলায় বলছে,

‘উত্তর না দিয়ে কল কাটবি না প্রো….’

প্রোণো বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসলো। বৃষ্টিতে ভেজাটা তার জন্য অনুচিত। এই সময়ে বাড়িতে ফেরাটাও নিতান্তই ছেলেমানুষী। তবুও সে সেই অনুচিত ছেলেমানুষী কাজটা করে ফেলেছে। কেন করেছৈ তার পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। তার মন বাড়িতে ফিরতে চেয়েছে তাই সে ফিরেছে। মনের চাওয়ার উপর যুক্তিবিদ্যা দুধ ভাতের মতো।

তিহু ঠিক দশ মিনিটের মাথায় ফিরে এলো। হাতে তার ট্রে। খবার এনে প্রোণোর সামনে বিছানায় নামিয়ে রাখলো। কোনো কথা না বলে ছোট পায়ে গিয়ে জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জানালার সাদা কাঁচে ফোটা ফোটা বৃষ্টি পানি গড়াচ্ছে। তিহুর মন চাইছে ছাদে গিয়ে একটু ভিজতে। তিহু তার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিলো। জানালা থেকে সরে তোয়ালে হাতে রুম থেকে বের হতে নিলেই প্রোণোর কথায় দাঁড়িয়ে যায়।

‘ভুলেও এখন ছাদে যাবে না তিহু। ওয়েদার খারাপ। ভিজলে ঠান্ডা, জ্বর লেগে যাবে।’

তিহু দস্যু চোখে তাকালো প্রোণোর পানে। যেন চোখ দিয়েই আজ প্রোণোর হৃৎপিণ্ডের রক্ত শুষে নিবে। প্রোণো তিহুর দৃষ্টিকে খুশি মনে অবজ্ঞ করলো। খিচুড়ির প্লেট হাতে নিয়ে শুধালো,

‘রান্না কি তুমি করেছো? স্মেল সুন্দর। গরুর মাংস হলে আরো ভালো হতো। কাল বাজার থেকে আনবোনি। সুযোগ বুঝে আবার একদিন খিচুড়ি রান্না করিও।’

তিহুও প্রোণোর কথাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করলো। এভাবে তার মান ভাঙানো যাবেনা। তিহুর অভিমান যেন তেন নয়। পাহাড় পর্বতের চুড়ায় ঝুলে থাকার মতো অভিমান তার। কাজেই গাল ফুলিয়ে এসে চেয়ারে বসলো সে। যথা সম্ভব প্রোণোর থেকে দূরত্ব রেখে চলতে হবে। তবেই না হবে অভিমান!
প্রোণো তিহুর পদক্ষেপ দেখলো। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো খানিক। বলে উঠলো,

‘ওখানে কেন গেলে? বেডে আসো। খাইয়ে দেই তোমায়।’

প্রোণোর কথায় কাজ হলো। তিহু বড় বড় চোখ করে চেয়ে আছে। মান অভিমানের কথা ভুলে বিষ্ময় নিয়ে সে প্রোণোকে দেখছে। সে কি সত্যিই তিহুকে খাইয়ে দিতে চায়? খোলসে বন্দী করা হৃদয়টা মুহূর্তেই স্বল্প ভালোবাসার ছোঁয়ায় নাজুক হয়ে যায়। ঝড়ঝড় করে ভেঙে যায় অভিমানের দেয়াল।
তিহুর আহ্লাদে গদগদ মুখখানা দেখে প্রোণো মুচকি হাসে। মেয়েটার স্বভাব বাচ্চা সুলভ। ভালোবাসা পেলেই মোমের মতো নরম হয়ে যায়।

তিহু বিছানায় গোল হয়ে বসলো। বাধ্য মেয়ের মতো প্রোণোর তুলে দেওয়া লোকমা গালে নিলো। প্রোণো তিহুর উজ্জ্বল এই মুখশ্রী দেখে শান্তি পায়। মেয়েটার মাঝে এতক্ষণের মলিতা দূর হয়েছে। এই প্রশান্তিকে চিরতরে গ্রহণ করতেই হয়তো সে সাময়িকের জন্য তিহুর মলিনতাকে জাগ্রত করলো পুনরায়।

‘কোন বিষয় তোমাকে বিরক্ত করছে তিহু? আমায় না বললে জানব কিভাবে বলো?’

তিহুর হুশ ফেরে। সে কিভাবে ভুলে গেল সে কথা! পুনরায় আঁধার নামে তার বদন জুড়ে।

‘আমাদের সম্পর্কটা শিকল দিয়ে জোড়া তিহু। কিন্তু লোহায় ও মরিচা পড়ে। ক্ষয় হয়। একসময় খুব সহজেই তা ভেঙে যায়। তাই সম্পর্কের এই শিকলকে মজবুত করতে চাইলে নিজেদের মাঝে বোঝাবুঝির ব্যাপারটা মজবুত করতে হবে।’

প্রোণো থামে। তিহু কথা বলছে না। নিরবে খেয়ে চলছে। প্রোণো পুনরায় লোকমা তুলে দেয় তিহুর গালে। শুধায়,

‘ভালোবাসা বুঝিনা আমি তিহু। তবে তোমায় ভালো রাখতে আমায় পৃথিবীর শেষ মাথায় যেতে হলেও যাব। আমার কথাকে সিনেমার ক্লাসি ডায়লগ হিসেবে নিবেনা ভুলেও। প্রত্যেক কথার পেছনে যুক্তি থাকে। আমি বোঝাতে চাচ্ছি তোমায় ভালো রাখতে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। আমি আমাদের জন্য সুন্দর একটা ভবিষ্যত তৈরি করবো। যেখানে তুমি সবসময় উজ্জ্বল তারার মতো ঝলমল করতে পারবে। কিন্তু তার জন্য তোমায় আমাকে আপন ভাবতে হবে তিহু। ভুল বোঝাবুঝির মাধ্যমে সম্পর্ক আগানো যায় না।’

তিহুর মলিন হৃদয়টা অকারণেই হেসে উঠলো যেন। তীব্র উচ্ছাসে দিকবেদিক হলো। প্রোণোর কথার গভীরতা তিহুকে ছুঁতে পেরেছে। লুকিয়ে রাখা হৃদয়কে ভালোলাগার প্রলয়ে জড়াতে পেরেছে। তিহু গালের খাবার নিয়েই তার অভিযোগ রাখে প্রোণোর সম্মুখে। যত অভিমান, অভিযোগ বোঝাবুঝির মাধ্যমেই ঠিক করা যাক!

‘আপনার বান্ধবীদের কথা জানতে চাই। ঘরে সুন্দরী বউ রেখে বাইরের পেত্নী সুলভ মেয়েদের সাথে এত মেলামেশা কিসের?’

প্রোণো তিহুর কথায় মুখভাব গম্ভীর করে নেয়। শান্ত চোখ জোড়ার শীতল চাহনি নিক্ষেপ করে শীতল গলায় শুধায়,

‘এটাই কি মুখভারের কারণ?’

তিহু সরল জবাব দেয়,

‘হুম। তবে এই উত্তর দেওয়ার আগে এটা বলুন তো আপনারা এ ধরণের কাজের জন্য আসামিদের কি শাস্তি দেন?’

‘তুমি হিসেবে ভুল করেছ তিহু। আমার ডিপার্টমেন্ট এসব স্টুপিড বিষয় নিয়ে কাজ করেনা। আমাদের সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট উপর লেভেলের আসামি, মন্ত্রী লেভেলের লোকদের হান্ট করে। এসব স্টুপিড কাজে সময় ব্যায় করার সুযোগ নেই আমাদের।’

তিহু ছোট চোখ করে বলে,

‘এটা স্টুপিড বিষয় কিভাবে হতে পারে? একজন স্বামী তার বউকে ঠকাচ্ছে এটার মতো জঘন্য অপরাধকে স্টুপিড কিভাবে বলতে পারেন?’

‘তোমার স্বামী কি তোমায় ঠকিয়েছে তিহু?’

প্রোণোর কন্ঠ আগের তুলনায় দ্বিগুণ শান্ত মনে হলো। কন্ঠস্বরের শীতলতা তিহুর গলার স্বর রোধ করলো। কি ভয়ংকর শীতল সে স্বর। তিহুর অনুভব হলো স্বপ্নে দেখা সেই অজগরটা আজ তার গলা পেঁচিয়ে রেখেছে। শরীরের লোমকূপ গুলো সটান দাঁড়িয়ে পড়েছে। তিহু প্রোণোর চোখে চোখ রাখতে পারলো না। সাহস হলো না যেন। কি তীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি! কিছুক্ষণের আগের কোমল মানুষটা হঠাৎ যেন ভয়ংকর এক জীবে পরিণত হয়েছে।

তিহু ধীর গলায় বলে,

‘তেমনটা বলিনি। আমি আপনাকে অবিশ্বাস করিনি প্রোণো।’

প্রোণো জবাব দিলো না। হাতের প্লেট ট্রে তে নামিয়ে রেখে বিছানা থেকে নেমে গেল। ওয়াস রুমে ঢুকে কিছুটা শব্দ করেই দরজা বন্ধ করলো। তিহু তখনো বিছানায় বসে। তার চোখ দুটো ছলছল করছে। প্রোণো খায়নি। তার খাবারটুকু প্লেটে রয়ে গেছে। তিহু ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকাবার চেষ্টা করে। সে সত্যিই প্রোণোকে অবিশ্বাস করেনি। সে তো কেবল স্বল্প অভিমান করেছিল। পরিণতি এমন হবে জানলে কখনো সে অভিমানকে তার কাছে ঘেঁষতে দিত না।
তিহুর চোখ থেকে বর্ষার ন্যায় জল গড়ায়। রোধ করে রাখা শব্দরা গন্ডি পেরিয়ে মাঝে মাঝেই বেরিয়ে আসে হুঁ হুঁ শব্দ করে। প্রোণো তখন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে। তিহুর করুন পরিস্থিতি দেখে কঠিন চোখ জোড়া কিছুটা শান্ত হয়। পুরুষালী কঠিন চোয়ালের পরিবর্তন সেভাবে লক্ষ করা যায় না। তবে তিহুর কান্নাভেজা সুশ্রী মুখ আর থেকে থেকে কেঁপে ওঠা দেহখানা দেখে তার হৃদয় নরম হয়। কঠিন ভাবে এড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি ভাবে বাতিল না করে কিছুটা সহজ আচরণের সিদ্ধান্ত নেয়। শরীরের পোশাক পরিবর্তন করে রুম থেকে বের হওয়ার পূর্বে জানায়,

‘আমার বন্ধুমহলে কোনো মেয়ে নেই। কখনো ছিলনা। নিজ স্ত্রী রেখে‌ অন্য কারো দিকে নজর দেওয়ার পূর্বে যেন আল্লাহ সেই অপবিত্র চোখ জোড়া নিয়ে নেন! অন্যথায় আমি নিজ হাতে সেই চোখ ধ্বংস করবো। আমি আমার দেহের কোনো অংশের বেইমানি সহ্য করবো না।’

প্রোণো বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। অশ্রুসিক্ত নয়নে তিহু তার যাওয়ার পানে চেয়ে শব্দ করে কেঁদে ফেলে। আকুতি ভরা কন্ঠে বলে ওঠে,

‘আমায় শাস্তি দেন প্রোণো কিন্তু মুখ ঘুরিয়ে নিবেন না! প্লিজ!’

____________

প্রিমার উপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। আগামী একমাস প্রিমার বাড়ির বাহিরে যাওয়া মানা। তার হাত খরচের টাকাও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কেবল এতটুকুই নয়, তার সকল কার্ড লক করে দেওয়া হয়েছে। রুম থেকে তার মোবাইল, ল্যাপটপ সরানো হয়েছে। এই ভয়ংকর শাস্তির বিরোধীতা করতে পারলো না প্রিমা। পুরোটা সময় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। প্রিয়ম বোনের হয়ে কিছু বলতে নিলে প্রান্তিক চোখের ইশারায় বাঁধা দেয়। এখানে জবাব দিলে হয়তো শাস্তি হিসেবে এবারের ছুটিটা তাকে বউ বিহীন কাটাতে হবে। কাজেই সে নিরবতা পালন করলো। পাবেল কখনোই প্রোণোর উপর কথা বলার সাহস রাখে না। আজও কিছু করতে পারলো না তাই। কেবল ব্যাথিত চোখে তাকিয়ে রইল। প্রান্তির চোখ ভরা জল। প্রিমাকে কাঁদতে দেখলে সে কিছুতেই না কেঁদে পারে না। এটা আবেগ নাকি টুইন সিস্টেম তা সে জানে না। সে কেবল জানে এখন তাকে কাঁদতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত প্রিমার মন খারাপ থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত কাঁদতে হবে।

চলবে………?