তার শহরের মায়া পর্ব-৩১

0
840

#তার_শহরের_মায়া 😍
#পার্ট_৩১
#Writer_Liza_moni

এলোমেলো হয়ে হসপিটালের ওয়েটিং রুমে বসে আছে অনু। চোখ থেকে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে।শক হয়ে গেছে।নড়া চড়া ভুলে গেছে সে। দুনিয়ার কোনো কিছুতেই এখন তার খেয়াল নেই।মন মস্তিষ্ক সব জুড়ে আল্লাহ কে ডাকছে,,,যেনো তূর্য ভালো হয়ে যায়। তূর্যর যেনো কিচ্ছু না হয়।

ঘন্টা খানেক আগে তূর্য কে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হয়।দুটো গুলি লেগেছে তার গায়ে। একটা পায়ে আর একটা পিঠের দিকে।
.
তনু আর মাহির অনু কে নিয়ে হসপিটালে আসে। এলোমেলো অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তনু।
তার বোনের সাথেই কেন এমন হয়? কেন মেয়েটা একটু সুখের মুখ দেখলেই দুঃখরা এসে দরজায় কড়া নাড়ে?

অনুর এই পাথর হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না তনু। কেমন যেন হয়ে গেছে অনু। চুপ করে এক দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। কখন ডাক্তার বের হবে?

অনুর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আধ ঘন্টা পর ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে আসেন।

অনু বসা থেকে উঠে গিয়ে পাগলের মতো জিজ্ঞেস করে,,

তূর্য ঠিক আছে তো? ভালো হয়ে যাবে তো তূর্য?

শান্ত হোন মিসেস তাওহীদ তূর্য।
অপারেশন সাকসেসফুল। আমরা তাকে কেবিনে স্ফিট করে দিবো। দোয়া করেন যেন তিন ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসে।

তূর্য কে কেবিনে নেওয়ার পর অনু এলোমেলো পায়ে হেঁটে তূর্যর কাছে গেলো।

কী সুন্দর ঘুমিয়ে আছে দেখো না? আমাকে আর আজকে জ্বালাচ্ছে না। কতো ভদ্র হয়ে গেছে।

অনু তূর্যর পাশে একটা টুল টেনে বসলো। তূর্য চোখ বন্ধ।অনু কাঁপা হাতে তূর্যর হাত নিজের হাতের মুঠোয় রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তনু মাহির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনুর দিকে তাকিয়ে আছে।

অনুর কান্না দেখে একটা নার্স বলে উঠলো,,
আপনার স্বামী কে ভীষণ ভালোবাসেন তাই না?

অনু কিছু বললো না।

এই ভাবে কান্না করবেন না এখানে। পেশেন্টের সমস্যা হতে পারে।

অনু দ্রুত চোখের পানি মুছে বললো,, আমাকে কিছুক্ষণ এর জন্যে ওনার সাথে একা থাকতে দিবেন?
আমি একটু ও কান্না করবো না।

ঠিক আছে। পেশেন্টের জ্ঞান ফিরলে ডাক্তার কে জানাবেন।

অনু কে তূর্যর কাছে রেখে নার্স চলে গেল।
অনু তূর্যর মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আপনি খুব খারাপ তূর্য। আমাকে কতটা কষ্ট দিচ্ছেন আপনি জানেন? আপনাকে ছাড়া আমি এখন আমাকে নিয়ে একদম ভাবতে পারি না। আপনি খুব খুব খুব খারাপ।

অনু তূর্যর কপালে একটা চুমু খেলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,,
ভালো হয়ে যাননা তূর্য। এই চুপ করে শুয়ে থাকা তূর্য কে আমার ভালো লাগে না।

দুই ঘণ্টা পর তূর্যর জ্ঞান ফিরে আসে। চোখ পিটপিট করে তাকালো। পাশ ফিরে অনু কে দেখে মুচকি হাসলো।অনু তূর্য কে হাসতে দেখে মাথার চুল গুলো টেনে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,,
এত হাসি পায় কেন? আমার কলিজা কলিজার জায়গায় নাই।আর আপনি শুধু হাসেন। ওয়েট আমি ডাক্তার কে বলছি।

অনু বসা থেকে উঠতে যাবে তার আগেই ডাক্তার কেবিনে এসে ঢুকে।
অনুর দিকে তাকিয়ে বললো,,
আপনার হাসবেন্ড এখন বিপদ মুক্ত।এত টেনশন করার কিছু নেই। ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দিবো। ঘুমিয়ে নিক।

ডাক্তার তূর্য কে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দিয়ে চলে গেল।অনুর চোখ মুখ ফুলে গেছে।সব কিছু উলোট পালোট হয়ে গেছিলো তার।

ফোনে তূর্যর গায়ে গুলি লাগার কথা শুনে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল তার।একটুর জন্য মনে হয়ে ছিল এই বুঝি সে তূর্য কে হারিয়ে ফেলবে,,
ভাবতেই কলিজা কেঁপে উঠলো অনুর।

তূর্য কে দুই ঘণ্টা ঘুমানোর ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। এখন প্রায় সন্ধ্যা হতে চললো। তূর্যর খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।

অনু কেবিন থেকে বের হয়ে তনুর উদ্দেশ্যে বললো আমাকে বাড়িতে যেতে হবে। উনার জন্য সুপ রান্না করে আনতে হবে। বাহিরের খাবার খাওয়াতে চাই না।

হুম। মাহির তুমি এখানে থাকো আমি আর অনু যাচ্ছি।

কী বলো?একা যেতে পারবা তোমরা?

আপু এই ঢাকা শহরে চার বছরের ও বেশি সময় আছি। আমরা ছোট না।একা যেতে পারবো।

অনু আর দাঁড়ালো না। হসপিটাল থেকে বের হয়ে আসলো।অনুর পিছনে পিছনে তনু ও আসলো।
.
.
বাড়িতে এসে অনু শাওয়ার চালু করে তার নিচে বসে পড়লো। ভালো লাগছে না তার।আধা ঘন্টা পর ওয়াস রুম থেকে বের হয়ে চুল মুছে রান্না ঘরে চলে গেল। চার দিক
কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তূর্য কে খুব মনে পড়ছে আজ।অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।চুলায় গরম পানি বসিয়ে রেখে মায়ের কাছে ফোন করে বললো তূর্যর কথা।

চিন্তা করিস না মা। তূর্য ভালো হয়ে যাবে।

আমার সাথেই কেন এমন হয় বলো তো? আমি তাকে আকড়ে ধরতে চাই তাকেই আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চায় কেন আল্লাহ? আমার কিচ্ছু ভালো লাগছেনা মা।

মায়ের সাথে কথা শেষ করে মোবাইল রাখতেই আবার কল আসল।অনু কল রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে তূর্যর মায়ের কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। তিনি কান্না করতে করতে বললো,,
আমার ছেলেটা কেমন আছে?কী হয়েছে আমার ছেলের? আমি কত হতভাগিনী আমার ছেলের এমন একটা পরিস্থিতিতে আমি ওর পাশে নাই।

শান্ত হোন মা। তূর্য ভালো আছেন।ডাক্তার তাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন।
আল্লাহর রহমতে বড় কোনো ক্ষতি হয়নি।
.
.
অনু তূর্যর জন্য সুপ রান্না করে টিফিন বক্সে ভরে মোবাইল টা নিয়ে ফ্লাটে তালা লাগিয়ে যাওয়ার সময় তনু ও অনুর পাশে এসে দাঁড়াল।

তোকে যেতে হবে না আপু। আমি একা যেতে পারবো। আমি গিয়ে দুলাভাই কে পাঠিয়ে দিবো।

একটা কথা ও বলবি না। তোর এই বিপদে আমি তোর কাছে থেকে ও কিছু করবো না তুই ভাবিস কী করে? অনেক বড় হয়ে গেছিস?

অনু আর কিছু বললো না।তনুকে নিয়েই হসপিটালে পৌঁছে গেল।
.
.
হসপিটালে পৌঁছে দেখে মাহির কোথাও নেই। তূর্যর কেবিনে গিয়ে তার দেখা মিলে। তূর্যর পাশে বসে আছে।আর তূর্য দরজার দিকে তাকিয়ে আছে অস্থির হয়ে। কখন অনু আসবে?

অনু কে কেবিনে ঢুকতে দেখে তূর্য হাসলো। তার চোখ গুলো চিক চিক করে উঠলো।যেনো খুব মূল্যবান কিছু দেখতে পেয়েছে সে। কিছুক্ষণ আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায় তূর্যর।

অনু কেবিনে আসলে মাহির কেবিন থেকে বের হয়ে গেল।
অনু তূর্যর দিকে তাকিয়ে বললো,,
একদম দাঁত কেলাবেন না। জীবন শেষ আমার। আপনার চিন্তায়।

আমাকে তো তুমি ভালোবাসো না,,, তাহলে আমি মরলে তোমার কী?

আপনি যদি বয়সে বড় না হতেন আর আমার স্বামী না হতেন তাহলে এখন কসিয়ে এক চড় মারতাম। আপনি মরলে আমার অনেক কিছু। আপনাকে আমি ভালোবাসি না।তাতে আপনার সমস্যা কি? অনেক বেশি বকেন আপনি।
রেগে কথা গুলো বললো অনু। এমনিতেই তূর্যর জন্য ভয়ে ভয়ে শেষ সে।কত যে দোয়া করছে যেনো বেঁচে যায়,,আর এই ছেলে বলে সে মরলে আমার কী?

অনু তূর্যকে আধশোয়া হয়ে বসিয়ে দিল। তার পর সুপ খাইয়ে দিল নিজের হাতে। শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিয়ে ঔষধ খাইয়ে দিল।

তূর্য মনে মনে বললো,,
ভালোই হয়েছে। এই গুলি গুলো লেগেছে আমার গায়ে। না হলে তো আমার একটা মাত্র আদরের বউয়ের এত যত্ন পেতাম না।

অনু তূর্যর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।সে বুঝার চেষ্টা করছে তূর্য ঠিক কী ভাবছে? বুঝতে না পেরে বললো,, শুধু শুধু যদি মুচকি মুচকি হাসতে দেখেছি দাঁত ভেঙ্গে দিবো একদম।

কারো রাতের ঘুম হারাম করে তিনি মুচকি মুচকি হাসছে।

তূর্য তাও মুচকি হেসে বললো,,
খেয়েছো তুমি?

খাবো না আমি।গলা দিয়ে খাবার নামবে না। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।নিজেকে নিয়ে ভাবুন।

অনুর যে তূর্যর উপর অভিমান জমেছে। কেন লোকটা একটু খেয়াল করে কাজ করে না?যে লোক গুলো গুলি মেরেছে ঐ গুলো রে পাইলে আমি কাইটা টুকরো টুকরো করে কুত্তারে খাওয়াতাম।
.
.
অনু রাতে তূর্যর সাথেই থেকে গেল। মাহির আর তনু রাতে বাড়িতে চলে যায়। দিনের ১১টা বাজে তূর্যর মা বাবা, জুঁই আর অনুর মা বাবা এসে পৌঁছায় হসপিটালে। তূর্যর মা বাবা আর নিজের মা বাবাকে দেখে অবাক হয় অনু।

তোমরা আসবা আমাকে বলো নাই কেন?

এত কিছু মাথায় ছিলো না।তনু জানে আমরা আসবো যে।

আমাকে বলে নাই তো।

তূর্যর মা তূর্যর কেবিনে গিয়ে তূর্যর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কান্না করে দিল। তোমার দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া আল্লাহ। আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে দিয়েছো।

মা কেঁদো না। দেখো আমি একদম ঠিক আছি। গতকাল থেকে অনু কান্না করতে করতে শেষ। এখন তুমি ও যদি এই ভাবে কান্না করো তাহলে কী হবে বলো তো? আমি তো ঠিক আছি তাই না? ভালো হয়ে যাবো ইনশাল্লাহ।
.
.

টানা এক সাপ্তাহ হসপিটালে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছে তূর্য। বন্দি এই কেবিনে দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। আজকে রিলিজ করে দিবে তূর্য কে।আর ও কিছু দিন থাকার কথা ছিল তার। কিন্তু আর এক দিন ও এই হসপিটালে বন্দী থাকলে মরেই যাবে।

অনু বাড়ির সব কিছু গুছিয়ে রেখে হসপিটালে আসছে।অনুর মা বাবা চলে গেছেন আর ও দুই দিন আগে। কিন্তু তূর্যর মা,বাবা আর জুঁই রয়ে গেছে। তূর্য ভালো হওয়া না অব্দি তারা যেতে চান না।
.
.
অনু, তূর্যর বাবা মা মিলে হসপিটাল থেকে রিলিজ করে তূর্য কে বাড়িতে নিয়ে যায়। তূর্য কে বিছানায় শুয়ে থাকতে বলে অনু রান্না ঘরে চলে গেল।

দুপুর হয়ে এসেছে প্রায়।সবার জন্য এখন ও রান্না করা হয়নি।অনু রান্না ঘরে গিয়ে দেখে,,
তূর্যর মা আর জুঁই মিলে রান্নার সব জোগাড় করে ফেলেছে।অনু তাদের দিকে তাকিয়ে বললো,, এমন ননদ আর শ্বাশুড়ি থাকলে আমার এত চিন্তা কীসের,,,?

চলবে,,,, 🍁