তার শহরের মায়া পর্ব-৩২

0
868

#তার_শহরের_মায়া 😍
#পার্ট_৩২
#Writer_Liza_moni

রাত প্রায় নয়টার দিকে কলিং বেল বেজে উঠায় জুঁই গিয়ে দরজা খুলে দেয়। কিছু অপরিচিত মুখ দেখে ভ্রু কুঁচকে সালাম দিয়ে জুঁই জিজ্ঞেস করলো,,

আসসালামুয়ালাইকুম,, আপনারা কারা?

ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমরা সি আই ডি। তূর্যর সাথে দেখা করতে পারি?

ওহ আচ্ছা। আসুন ভেতরে আসুন।

জুঁই দরজার কাছ থেকে সরে তাদের ভেতরে ঢুকার জন্য রাস্তা করে দিল। তূর্যর মা তাদের কে সোফায় বসতে বলে তূর্যর রুমে চলে গেল।অনু তখন তূর্য কে সুপ খাইয়ে দিচ্ছিল।

তূর্য তোর সাথে কয়েক জন অফিসার দেখা করতে এসেছেন।

তূর্য মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,, এই সময় এসেছেন তারা। আচ্ছা রুমে পাঠিয়ে দাও।

আরেএএএ কী বলেন রুমে পাঠিয়ে দিতে? আমি আপনাকে মেডিসিন খাওয়াবো এখন। একটু পর আসতে বলুন।

আচ্ছা। ওনাদের নাস্তা দাও,,
মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো তূর্য।

এখন তো ডিনারের সময়।এই সময় নাস্তা? তুই এক কাজ কর,, ওনাদের বলিস ডিনার করে যেতে,,

তার পর ও হালকা পাতলা কিছু দাও।

ঠিক আছে। তূর্যর মা চলে গেলে অনু তূর্যর খাবার শেষ করে মেডিসিন খাইয়ে দিল।

তূর্য খুব করে বউয়ের এত সেবা যত্ন উপভোগ করছে।

ঔষধ খাইয়ে অনু রুম থেকে চলে যাওয়ার সময় তূর্য অনু কে ডেকে বললো,,
শুনো,,জামাল স্যার, মাধবী,রবিন,দিপ্ত এনারা এসেছে।যাওয়ার সময় ছোট করে বলে দিও আমার রুমে আসার জন্য।

অনু ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকিয়ে বললো,, আপনি জানতেন উনারা আসবেন?

হুম জানতাম।তাই তো ভালো মন্দ রান্না করতে বলেছিলাম মাকে।

আমাকে বলেন নাই কেন?

এমনিতেই। মনে ছিল না।

মনে ছিল না?এখন তো কোনো ভালো মন্দ রান্না হয়নি। আপনি যেহেতু সুপ খাচ্ছেন সেহেতু আপনি মাংস খাবেন না বলে তো আমি মাংস রান্না করতে দিই নাই।

কি বলো ?কি রান্না হইছে তাহলে? উনারা ডিনার করবেন কী দিয়ে?

রান্না তো হইছে আলু ভাজি আর ডাল।ডিম ভাজি ও আছে।

কিহ,,? এই সব দিয়ে উনারা খাবেন এখন?

হুম।কী আর করবে?

অনু রুম থেকে চলে যেতে যেতে দাঁত কেলিয়ে মনে মনে বললো,, আমাকে না বলার শাস্তি। দেখুন এখন কেমন লাগে? চিন্তা করতে থাকেন আর আমি উনাদের খাবার রেডি করি হি হি হি ।

তূর্য মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। এখন কী এই সব দিয়ে উনাদের ডিনার করাবে?উফফ ভাল্লাগে না।
.
.
অনু ড্রইং রুমে এসে সবাই কে বললো,,

আসসালামুয়ালাইকুম। তূর্য আপনাদের তার রুমে যেতে বলেছে।ডাক্তার ওকে বেড রেস্টে থাকতে বলেছে। না হলে ও নিজেই আসতো।

সমস্যা নাই।আমরাই যাচ্ছি ওর কাছে।
(জামাল)

মাধবী অনু কে পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে ঠোঁটে জোর পূর্বক হাসি ফুটিয়ে বললো,,,
তুমি তাহলে তূর্যর ওয়াইফ?Am i right…?

Yeah… আপনার ধারণা ঠিক।
অনু জুঁই এর দিকে তাকিয়ে বললো,,
জুঁই উনাদের তোমার ভাইয়ার রুমে নিয়ে যাও।

জুঁই মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।
আসুন,,,

জুঁই এর পিছনে পিছনে তারা সবাই তূর্যর রুমে চলে গেল।অনু মাধবীর হাব ভাব দেখে বিরক্ত হলো। কেমন করে যেন তাকিয়ে ছিল।যেনো চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে।

অনু রান্না ঘরে চলে গেল। গিয়ে দেখে তার শ্বাশুড়ি মা শরবত বানিয়ে ফেলেছে।ট্রেতে মালতা,আঙুর, কমলা,আর আপেল কেটে সাজিয়ে ফেলেছে।

বউমা আমি শরবত নিয়ে যাচ্ছি। তুমি বল গুলো নিয়ে আসো।
অনু মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।
.
.
জামাল সাহেবরা তূর্যর রুমে গিয়ে তূর্যর পাশে বসলেন। তূর্য তাদের কে দেখে উঠে বসতে গেলে তারা বাঁধা দেয়। কিন্তু মাধবী গিয়ে তূর্যর কাঁধ ধরে বসিয়ে দিতে গেলে অনু রুমে ঢুকে। তূর্যর মুখ বরাবর মাধবীর পিঠ দেখে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় অনুর।

মাধবী তূর্যকে আধশোয়া হয়ে বসিয়ে দিয়ে তূর্যর পাশে বসে পড়লো।

অনু তূর্যর দিকে দাঁত কটমট করে তাকিয়ে টি টেবিলের উপর ট্রে টা রেখে রুম থেকে চলে গেল।

অনুর হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ বুঝলো না তূর্য।

তোর বউটা সুন্দর আছে।
(দিপ্ত)

নজর দিবি না।ভাবি হয় তোদের।

নজর দিই নাই। সুন্দর তাই সুন্দর বললাম।

ফর্সা হলে কী হইছে?গাইয়ার মতো কী করে শাড়ি পড়ে আছে দেখো না,,? নিশ্চয় গ্রামের গাইয়া, অশিক্ষিত ক্ষেত মেয়ে।
তাচ্ছিল্য করে মুখ বাঁকিয়ে বললো মাধবী।

তূর্য মুচকি হেসে বললো,,,
অনুর বাবার বাড়ি গ্রামেই। আমার বাড়ি ও গ্রামে।আর অনু গাইয়া,ক্ষেত কোনোটাই না। তুমি ওকে অশিক্ষিত বলছো কেন মাধবী?
তুমি জানো ওর শিক্ষা সম্পর্কে?

জানার ইচ্ছা ও নাই।

ইচ্ছা না থাকলেও জানতে হবে। তুমি যখন আমার বউকে নিয়ে এই সব বলেছো তোমাকে তো অবশ্যই জানতে হবে।
অনু এইবার ওদের ভার্সিটিতে সবার থেকে ভালো রেজাল্ট করেছে। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে ও।আর তুমি তাকে অশিক্ষিত ক্ষেত গাইয়া বলছো? শুধু শাড়ি পরেছে বিধায়?
শাড়িতেই নারী।আর চুলে নারীর সৌন্দর্য। শাড়ি পরতে ওর ভাল্লাগে।তাই পরে।কারো পোশাক দেখে কিন্তু তার যোগ্যতা বিচার করা ঠিক না।

মাধবী চুপ করে রইলো।

তুমি সব সময় উচিত কথা বলো।আর অনেক সুন্দর গুছিয়ে কথা বলো। তার জন্যই তোমাকে আমার এত ভালো লাগে।
এই সব প্রসঙ্গ বাদ দাও। তোমার শরীর কেমন আছে?ঐ গ্যাং কে নিয়ে অনেক ব্যাস্ত ছিলাম।তাই হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার পর আর আসা হয়নি।অপরাধী কন্ঠে বললো জামাল উদ্দিন চৌধুরী।

ঠিক আছে স্যার। সমস্যা নেই। আমি আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছি। সুস্থ হয়ে গেছি আমার বউয়ের সেবায়। আম্মু,বউ , বোন সবাই খুব খেয়াল রাখছে।

আলহামদুলিল্লাহ।শুনে ভালো লাগলো।
(জামাল)

বউয়ের সেবা যে আমি কখন পাবো? কপাল চাপড়ে বললো রবিন।

তোর আর এই জন্মে বিয়ে করা হবে না।দাঁত কেলিয়ে বললো দিপ্ত।

হবে হবে,,মাধবী থাকতে আর মেয়ে লাগে কেন?
মাধবীর দিকে তাকিয়ে বললো রবিন।

মাধবী চোখ গরম করে রবিনের দিকে তাকালো। মনে মনে বললো,,

“”আমি যারে চাই সে অন্য একটাকে বিয়ে করে বসে আছে।আর আমি যারে চাই না সে আমার জন্য কাইন্দা মরে। অদ্ভুত।””

সবাই নাস্তা করে নেয়। কথা বলতে বলতে। শুধু মাধবী এক গ্লাস শরবত খেয়ে আড় চোখে তূর্যর দিকে তাকিয়ে ছিল।

বাহির থেকে তূর্য আর মাধবীর দিকে চোখ গুলো বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল অনু। মাধবী মেয়েটা কেমন একটা। আজাইরা ফালতু মাইয়া। আমার জামাই কে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে।
বিয়া হইতো না তোর দেখিস খাটাস বেডি।
.
.
তো গ্যাংটাকে কী ধরতে পেরেছেন স্যার?

হুম ধরতে পেরেছি। আচ্ছা মতো কেলানী দিয়েছে রবিন ওরে।যে তোমাকে গুলি করে ছিল।

তূর্য হাসলো।এই মানুষগুলো সত্যি খুব ভালো।সব সময় সবাইকে নিজেদের আপন ভাবে।
নিজের পরিবারের পর এই মানুষগুলো তূর্যর আরেক পরিবার।
.
.
ডিনারের সময় সবাই ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলে ও মাধবী তূর্যর রুমে খাবে বলে জানায়। মাধবীর কথা শুনে অনুর ইচ্ছে করছে এ মেয়ের চল গুলো এক টা একটা করে ছিঁড়তে।
কতো বড় অসভ্য, বেয়াদব মেয়ে দেখছো?মিনি মাম কমন সেন্সটুকু নেই এই মেয়ের। নির্ঘাত উনার সহকর্মী বলে। না হলে এই মেয়ের সব শখ বের করে দিতাম।লুচু মাইয়া।

তূর্যর সাথে আমার কিছু কথা আছে।যা আমি একান্ত ওর সাথে বলতে চাই। খাবার পারলে এখানে এনে দাও। না হলে খাবো না।

অনুর দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বিরক্ত হয়ে বললো মাধবী।

কত্ত বড় সাহস এই মেয়ের। আমাকে বলে কিনা আমার জামাইয়ের সাথে তার একান্ত কিছু কথা আছে।এই মেয়ের কলিজা কত বড়।খবিস মাইয়া।

অনুর ফেস দেখে তূর্যর খুব হাসি পাচ্ছে। তূর্য মনে মনে মাধবীকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিল।অনু কে জ্বলতে দেখে তার খুব ভাল্লাগছে। দেখো মাহিরের সাথে তোমাকে দেখলে আমার কেমন জ্বলতো।

তূর্য ও মাধবীর কথার সাথে তাল মিলিয়ে বললো,,
অনুমেঘা মাধবী যখন এখানে আমার সাথে কথা বলতে বলতে খাবার খেতে চাচ্ছে তাহলে ওকে খাবারটা এখানে এনে দাও।

তূর্যর কথায় অনু ভীষণ অবাক হলো। সাথে অভিমান ও।অনু কিছু না বলে সেখান থেকে চুপ করে চলে গেল।
কেন? ওনার সাথে যদি কথা থাকে সেটা কী সবার সাথে খাবার খেয়ে এসে বলা যেতো না? আমার বেড রুমে অন্য একটা অপরিচিত মেয়ে কেন আমার হাসব্যান্ড এর সাথে বসে কথা বলে বলে ভাত খাবে কেন?

অনু মাধবীর খাবার টা তূর্যর রুমে দিয়ে আসলো।

মাধবী শয়তানি হেসে অনুর হাত থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে বললো,,
তুমি এখন আসতে পারো। তূর্যর সাথে আমার কথা আছে।

অনুর চোখে পানি চিকচিক করছে।তূর্য রং দিকে এক নজর তাকিয়ে মনে মনে বললো,,, এই মেয়ের সাথে পিরিতি না,, দাঁড়াও চান্দু তোমার সব পিরিতি আমি বের করবো।

তূর্য অনুর দিকে তাকিয়ে বললো,,কী হলো তাও। মাধবী কিছু বলবে তোমার জন্য বলতে পারছে না।

অনু কিছু না বলে চলে গেল। রাগে গা জ্বলছে ওর। (তূর্য বাবু তুমি জানো ও না তোমার কপালে আজ কী আছে)

.
.
তুমি কি সত্যি এই মেয়ের সাথে সুখী?

তূর্য হাসলো। অবশ্যই সুখি। অনেক বেশি।দেখছো না তুমি একা কথা বলতে চাইছো বলেই আমার বউটার কত রাগ হচ্ছে।ফেস দেখেছো ওর।

দেখলাম। তূর্য অনু মেয়েটা থেকে কী আমি দেখতে খারাপ?কম সুন্দর আমি? কেন আমাকে ভালোবাসা গেল না?

শুনো মাধবী,,
আমি যেমন মেয়ে চাইতাম তুমি তেমন নও।আর আমি তোমাকে সব সময় আমার বোনের চোখে দেখেছি।দেখি এবং ভবিষ্যতে ও দেখবো।মেঘুপাখি আমার মনের মত একজন মেয়ে।যে বুঝে ভালোবাসার মানে।

মাধবী ভ্রু কুঁচকে বললো,,মেঘুপাখি কে ?

তূর্য মুচকি হেসে বললো,, আমার অনুমেঘা।ওরে আমি মেঘুপাখি বলে ডাকি।

ওহ।অনু কী একাই ভালোবাসার মানে বুঝে? আমি কী বুঝি না?

জানি না আমি।এই সব কথা এখন কেন বলছো? আমি এখন বিবাহিত। আমি বলবো আমার চিন্তা তুমি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও। রবিন তোমাকে ভালোবাসে। তুমি ওকে বিয়ে করে নাও।দেখবে সুখী হবে।

মাধবী তূর্যর কথায় কান দিলো না,,, তূর্যর মুখের সামনে এক লোকমা ভাত ধরে বললো খাও,,, একটা বার,,,

এমন সময় অনু রুমে আসে। মাধবীর জন্য টিস্যু পেপার নিয়ে,,, তূর্য আড় চোখে দরজার কাছে অনুকে দেখে মুচকি হেসে হা করলো,,,
মাধবীর হাতে তূর্য কে ভাত খেতে দেখে অনুর চোখ থেকে তার অজান্তেই টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো,,,,

পৃথিবীর কোনো মেয়েই এই দৃশ্য সহ্য করতে পারবে না।সব কিছুর ভাগ দিতে পারলে ও নিজের স্বামী আর সন্তান কে কখনো ভাগ দিতে পারে না মেয়ে জাতি।

চলবে,,,,, 🍁