তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব-১২

0
2271

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১২

ইয়াদ রুমে ঢুকে ভ্রু কুঁচকালো কারণ রুমে কেউ নেই। সারারুম চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো, নাহ সত্যি কেউ নেই। কিন্তু রুমে তো তার স্ত্রী থাকার কথা। ইয়াদ এসবে মাথা না ঘামিয়ে ব্লেজার খোলে সোফায় রেখে সোফায় বসে পা থেকে শো খুলতে লাগলো। কপালের ভাজে বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে ইয়াদের, চরম বিরক্তি। রুমে পড়ার স্লিপার পায়ে পড়ে কাবার্ডে নিজের ড্রেস আনতে গিয়ে চোখে পড়লো মেয়েদের ড্রেস।

ইয়াদ রেগে বললো, What the hell is this ?

ইমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো এতোবড় রুমে একা বসে থেকে তাই রুম থেকে বের হয়ে বেলকনি মানে মিনি ছাঁদে গিয়ে রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আর চোখ থেকে পড়ছে শ্রাবণ ধারা। রুম থেকে ইয়াদের রাগী গলা শুনে চমকে উঠে ইমা, পা বাড়ায় রুমের দিকে। ইয়াদ ইমার ড্রেসগুলো হাতে নিয়ে ছুঁড়ে মারে আর ইমা দরজার কাছে এসে দাড়াতেই ড্রেসগুলো তার মুখের ওপর গিয়ে পড়ে, কেঁপে উঠে ইমা হঠাৎ মুখের ওপর এসে পড়ায়। ইয়াদ কারো অস্তিত্ব বুঝতে পেরে বেলকনির দরজার দিকে তাকায়। মুখ দেখা যাচ্ছে না কাপড়গুলো মুখের ওপর পড়ায়। ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইয়াদ। ধবধবে সাদা হাতে মুখের ওপর পড়া কাপড়গুলো ধরেছে মেয়েটা। ড্রেসের লং হাতার জন্য শুধু হাতের কবজি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নিলো ইয়াদ। সাদা রঙের ফ্লোর পর্যন্ত লম্বা একটা গ্রাউন পড়ে আছে তাই পা দেখা যাচ্ছে না আর মাথায় হিজার সেটাও বুঝা যাচ্ছে। ইয়াদ বিরক্ত হয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।

ইমা মুখের ওপর থেকে কাপড়গুলো সরিয়ে কাঁপা গলায় নিচু স্বরে বললো, কী হয়েছে ?

ইমার কাঁপা গলায় বলা সামান্য কথাটা ইয়াদের মনে হলো হৃদয় স্পর্শ করে গেলো। এতো নিচু আর শান্ত গলা ইয়াদ হয়তো আগে শুনেনি। ইয়াদ এক মুহুর্তের জন্য থমকে গেলেও পরে আর সেটাকে পাত্তা দিলো না।

ইয়াদ কাবার্ড থেকে নিজের ড্রেস হাতে নিয়ে পর্বের ন্যায় ঝাঁঝালো রাগী গলায় বললো, আমার কাবার্ডে নিজের জিনিস রাখার সাহস হলো কীভাবে তোমার ?

ইয়াদের রাগী গলায় ইমা খানিকটা কেঁপে উঠলো তবে নিজেকে সামলে অনেকটা সাহস নিয়ে বললো, গতকাল কবুল বলার আগ পর্যন্ত এটা শুধু আপনার ছিলো কিন্তু কবুল বলার পর থেকে আপনার সব জিনিসে আমারও সমান অধিকার হয়ে গেছে এমন কী আপনার উপরও।

ইমার এমন কথা শুনে ইয়াদ দিগুণ রেগে তার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো। কিন্তু তার অগ্নি দৃষ্টি স্থায়ী হলো না। আজও ইমা কান্না করছিলো তাই তার চোখের ঘন পাপড়িগুলো ভিজে গেছে আর চোখের ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছে তীব্র বেদনা। ইয়াদ চমকে উঠলো ইমাকে দেখে সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে সেদিনের ইমা আর আজকের ইমায় আকাশ পাতাল তফাত। মলিন পোশাকে তাঁকেও সেদিন অনেকটা মলিন লেগেছিলো কিন্তু আজ তাকে দেখে পরীও হার মানতে বাধ্য হবে। ইয়াদের দৃষ্টি ইমার চোখেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো। ইমা যতটা সুন্দর তার থেকেও কয়েকগুণ বেশি সুন্দর তার ঘন পাপড়িতে ঘেরা বড় আর গোল গোল মায়াবী চোখগুলো। যে চোখে একবার হারালে ফিরে আসার পথ খুঁজে পাওয়া হয়তো অসম্ভব আর তাই ইয়াদের মতো খিটখিটের মেজাজের মানুষ হার মেনে গেছে ঐ চোখের কাছে। ইয়াদের এমন দৃষ্টিতে ইমা অস্বস্তিতে পড়ে গেলো কিছু বলছে না শুধু তাকিয়ে আছে। ইমা চোখ নামিয়ে নিলে ইয়াদের হুঁশ ফিরে সে কী করেছে এতক্ষণ। ইয়াদ এক সেকেন্ড লেট না করে ওয়াশরুমে ঢুকে গিয়ে ধরাম করে দরজা আটকে দেয় আর ইমা চমকে দরজার দিকে তাকায়। মানুষটা এমন কেনো করলো বুঝতে পারে না ইমা। ইমা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে সোফার সামনে ফ্লোরে রাখা ইয়াদের শোগুলো নিয়ে শো তাকে রেখে দিলো। সোফার উপর ফেলা ব্লেজার হাতে নিতেই আবার সেই মিষ্টি গন্ধ নাকে লাগলো যা গতকাল শেরওয়ানিতে পেয়েছিলো। ইমা ব্লেজারটা নাকের কাছে নিয়ে লম্বা একটা শ্বাস নিলো কী মিষ্টি গন্ধ। ইমা নাকের কাছে থেকে ব্লেজার সরিয়ে ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকালো টপটপ পানির আওয়াজ আসছে ভেতর থেকে। ইমা বুঝতে পারছে না তার জীবনের মোড় তাকে কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছে না তার সামনে সুখ আছে নাকি আগের মতোই দুঃখ আর তিক্ততা। ইমা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ব্লেজারটা কাবার্ডে তুলে রাখলো সাথে নিজের ড্রেসগুলোও। তারপর ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গায়ের ডায়মন্ডের জুয়েলারি আর হিজাবের পিন খুলতে লাগলো। এদিকে ঝর্ণা ছেড়ে দুহাত দেয়াল ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াদ।

বিড়বিড় করে বললো, এই মেয়ে এখানে কী করে এলো ? তবে কী সেদিন এই মেয়ের আমার সামনে আসা রুবিনা কবিরের কোনো চাল ছিলো ? নাকি আমার সাথে এই মেয়েকে দেখে ওকেই সিলেক্ট করেছে কিছু বুঝতে পারছি না।

ইয়াদ অনেক কিছু চিন্তা করতে করতে শাওয়ার শেষ করলো অনেক সময় নিয়ে। ইমা রুমে বসে আছে ইয়াদ কখন বের হবে আর সে ফ্রেশ হবে। ইয়াদ একটা টাউজার আর টিশার্ট পরে টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হলো। সামনে তাকাতেই কপাল কুঁচকে গেলো ইয়াদের।

দ্রুত পায়ে বেডে সামনে দাঁড়িয়ে রাগী গলায় বললো, Who did it ?

ইমা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলো তাই ইয়াদের রাগী গলায় আবারো চমকে উঠলো। কী হয়েছে বুঝতে পারলো না।

ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, কী হয়েছে ?

ইয়াদ হাতের টাওয়েল বেডে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ছবি থাকার জায়গাটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো, এখানকার ছবি কোথায় ?

ইমা শান্ত ভঙ্গিতে বেডের পেছনের দিক দেখিয়ে দিলো ইয়াদ দেখলো ছবিটা দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে উল্টো দিকে করে রাখা মানে ছবির পেছনের সাইড দেখা যাচ্ছে শুধু কিন্তু ছবি দেখা যাচ্ছে না।

ইয়াদ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, এটা এখানে কে রেখেছে ?

ইমা আগের ন্যায় বললো, আমি।

ইয়াদ রেগে ইমার দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, Who the hell are you ? আমার জিনিসে হাত দেওয়ার সাহস হলো কীভাবে ?

ইমা ভয়ে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে বললো, দেখুন এই রুমে এখন আমিও থাকবো আর নামাজও পড়বো ইনশাআল্লাহ। রুমে প্রাণীর ছবি থাকলে সেখানে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না আর সেটা আমি কখনো চাই না। আমাদের প্রিয় নবী বলে গেছেন কোনো প্রাণীর ছবি আঁকা এবং ঘরে টানানো থেকে বিরত থাকতে, তাই আমি সরিয়েছি।

ইয়াদ আর কিছু বলতে পারলো না। আঙ্গুল তুলে ইমাকে শাসিয়ে বললো, নেক্সট টাইম আমার রুমের কোনো পরিবর্তন করার চেষ্টাও করো না সেটা তোমার জন্য একদমই ঠিক হবে না।

ইমা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো আর ইয়াদ পাশ কাটিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে চুলে ব্রাশ করতে লাগলো। ইমা নিজের ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে দেখে ইয়াদ বেডে বসে ল্যাপটবে কিছু করছে। তাই চুপচাপ গিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে মাথার টাওয়েল খুলে দিলো আর তার লম্বা ঘন কালো চুলগুলো পিঠ পেড়িয়ে ফ্লোর ছুঁই ছুঁই হয়ে গেলো। এতো রাতে চুল ভেজানোর ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু এতো ঝামেলার জন্য মাথা ভনভন করছিলো তাই শাওয়ার নিতে বাধ্য হলো। ইয়াদ কাজ করতে করতে হঠাৎ সামনে তাকিয়ে থমকে গেলো। ইমা একটু কাত হয়ে চুল মুছছে। পিঠের এক সাইড থেকে চুল সরে নিচের দিকে সরে এসেছে আর সেই সাইডের ইমার ফর্সা ঘাড়টা দেখা যাচ্ছে। যেখানে ছোট ছোট চুলগুলো ভিজে লেপ্টে আছে। ইয়াদের চোখ আঁটকে গেছে ইমার মেঘের মতো চুলে। ইয়াদ মনে করার চেষ্টা করলো এর আগে কখনো কারো এতো সুন্দর চুল দেখেছে কিনা কিন্তু ফলাফল শূন্য। এমনই ইয়াদ মেয়েদের থেকে দুরত্ব বজায় চলে আর তাছাড়া যা মেয়ে তার চোখে পড়েছে সবারই কাঁধ পযন্ত খুব স্টাইল করা চুল। চুলের এমন ন্যাচারল লুক ইয়াদ আগে দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। ইয়াদের পরিচিত মানুষগুলো এখন ইয়াদকে দেখে চিনতে পারবে না কারণ সবসময় কপালের ভাজে বিরক্তি নিয়ে চলা ইয়াদ আর এখনকার ইয়াদের পার্থক্য আকাশ পাতাল। এই ইয়াদের কপালের ভাজে বিরক্তি নয় গভীর কালো চোখে আজ মুগ্ধতা বিরাজ করছে। ইয়াদ নিজেকে প্রশ্ন করছে সে কী করছে এসব আর সে কী ভুলে যাচ্ছে মেয়েরা কালসাপ। ভালোবাসার মায়ায় জড়িয়ে তা গলার ফাসে পরিণত করবে। না না ইয়াদের তো এই মায়া আটকালে চলবে না। তার প্রতিশোধ নিতে হবে, খুব ভয়ংকর প্রতিশোধ, তার বাবার সাথে হওয়া অন্যায় আর প্রতারণার প্রতিশোধ। ইয়াদ কাউকে ছাড় দিবে না। ইয়াদ ঘৃণা করে মেয়েদের আর তাদের সৌন্দর্যকে। কারণ নিকৃষ্ট মেয়েগুলো নিজের রুপকে কাজে লাগায় উদ্দেশ্য হাসিল করতে। ইয়াদ ঘৃণা করে তার পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া বিশাল এই হামিদ সাম্রাজ্যকে। আজ শুধু এই সাম্রাজ্যের জন্য ইয়াদের চোখে সবাই অপরাধী সবাই ঘৃণিত। কী লাভ হয়েছে এই এতো সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে ? তার শৈশব ধ্বংস করে দিয়েছে এই সম্পদ। ইয়াদের মনে হতো তার থেকে রাস্তায় বড় হওয়া ছেলেটা সুখী কারণ সে দিন শেষে একবেলা খেয়ে বাবা-মায়ের ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে যেতো আর দিনশেষে ইয়াদ হয়ে পড়তো নিঃসঙ্গ আর একা। ইয়াদ ইমার দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার মনে এখন ভাসছে পুরনো কিন্তু তিক্ততার স্মৃতি যা তাকে হাসতে ভুলিয়ে দেয় তাকে করে তুলে ভয়ংকর আর কঠিন একজন মানুষ। ইয়াদের চিন্তার মাঝেই তার চোখমুখ লাল হয়ে গেলো রাগে তবু থম মেরে বসে রইলো। এ যেনো কোনো ঝড়ের আগ মুহূর্ত।

ইয়াদ গম্ভীর আর থমথমে গলায় বললো, আমার সামনে থেকে এখনই চলে যাও নাহলে তার পরিণতি ভালো কিছু হবে না।

ইয়াদের হঠাৎ কথায় ইমা চমকে পেছনে তাকালো আর ইয়াদের চোখমুখ দেখে ভয় পেয়ে গেলো। কী হয়েছে বুঝতে পারলো না। সে তো কিছু করেনি তাহলে ইয়াদ এমন করছে কেনো ?

ইমা ইয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, কী হয়েছে আপনার, আপনাকে এমন লাগছে কেনো ?

ইয়াদ তখনো সেভাবেই থম মেরে বসে আছে দেখে ইমা ভয়ে ভয়ে নিজের কাঁপা হাতটা ইয়াদের কাঁধে রেখে বললো, আপনি ঠিক আছেন ?

ইয়াদ অগ্নি দৃষ্টিতে লাগলো ইমার হাতের দিকে যেটা এখন তার কাঁধে অবস্থান করছে। তা দেখে তার রাগ যেনো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। এই মেয়ের সাহস হলো কীভাবে আবরার হামিদ ইয়াদকে স্পর্শ করার ? চোখদুটো অগ্নিকুণ্ড রুপ ধারণ করেছে। ইমা হাতটা কাঁধে রাখার পরও অসম্ভব কাঁপছে ইমার হাতটা।

চলবে,,,,,,