তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব-৩৫+৩৬

0
1914

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৩৫

ইশান ইয়াদের থেকে চোখ সরিয়ে আড়ালে চোখের পানি মুছে নিলো। ইয়াদ চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে, এর মধ্যে ইয়ানা আর ইমাও নিচের নেমে এলো। ড্রয়িংরুমে ইশান আর ইয়াদকে দেখে একে অপরের দিকে তাকালো ইয়ানা আর ইমা।

ইয়ানা ইশানের দিকে একবার তাকিয়ে ইয়াদের দিকে তাকালো, কী হয়েছে ভাইয়া ?

ইয়াদ থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে, একটা টু শব্দও করছে না। এতে ইশানের মনে হলো ইয়াদও চাইছে সে চলে যাক। ইশান চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিয়েছে কিন্তু ইয়াদের নিরবতা ইশানকে কষ্ট দিচ্ছে। পরক্ষণে নিজের মনের কথা চিন্তা করে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো ইশান। ইয়াদের তো এটাই চাওয়া স্বাভাবিক। ইশান আবার চোখের পানি মুছে নিলো আর ইয়ানার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

ভালো থাকিস আপু আর হ্যাঁ তোদের খুব ভালোবাসি আমি, খুব। পারলে মাফ করে দিস আমাকে।

ইয়ানা অবাক হয়ে বললো, কী করেছিস তুই, যে তোকে মাফ করবো ?

ইয়ানার প্রশ্নের উত্তরে ইশান শুধু অসহায় মুখে হাঁসলো, যার মানে ইয়ানা বুঝতে পারলো না। সে চোখ ভরা প্রশ্ন নিয়ে ইশানের দিকে তাকিয়ে আছে, ইশান ধীর পায়ে ইমার সামনে দাড়ালো।

ভালো থেকো ভাবি আর আমার ভাইয়া আর আপুকেও ভালো রেখো। তোমাদের অনেক জ্বালিয়েছি তার জন্য মাফ চেয়ে নিচ্ছি।

ইশান এতটুকু কথা শেষ করে ইয়াদের দিকে তাকালো, ইয়াদ তখনো গম্ভীর ভাবে সামনে দৃষ্টি রেখে দাঁড়িয়ে আছে।

ইশান আবার ইমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমার ভাইয়ার বাহিরটা যেমন শক্ত, ভেতরটা তার থেকে কয়েকগুণ বেশি নরম। সারাজীবন শুধু কষ্ট পেয়ে গেছে, পারলে এখন একটু সুখ তার হাতের মুঠোয় এনে দিও।

ইয়ানা আর ইমা কিছুই বুঝতে পারছে না ইশান এসব কেনো বলছে। তাই হা করে তাকিয়ে আছে শুধু। ইশান ইমার সামনে থেকে এসে সোফার কাছে রাখা নিজের লাগেজটা হাতে নিতেই ইয়ানা আর ইমা আরো অবাক হয়ে গেলো।

ইয়ানা ব্যস্ত গলায় বললো, তুই এতবড় লাগেজ নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস এই অবেলায় ?

ইশান নিজের প্রতি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ফুটপাত, যেটা আমার আসল ঠিকানা, আসছি।

ইশান মেইন ডোরের কাছে যেতেই ইয়াদ গম্ভীর গলায় বলে উঠলো, দাঁড়া।

ইশানের পা থেমে গেলো তবে পেছনে ঘুরে তাকালো না কারণ তার চোখের পানি সে কাউকে দেখাতে চাইছে না।

ইয়াদ নিজের জায়গায় স্থির থেকে বললো, কার অনুমতিতে বাড়ির বাইরে পা রাখার সাহস দেখাচ্ছিস তুই ?

ইশান নিজের চোখ মুছে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, মানে ?

ইয়াদ কড়া গলায় বললো, ভাইয়াও বলছিস আবার আমাদের উপর কোনো অধিকারও নেই বলছিস ?

ইশান কিছু বুঝতে না পেরে বোকার মতে ইয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

ইয়াদ ইশানের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললো, আমার অনুমতি ছাড়া বাড়ির বাইরে পা রাখার কথা চিন্তা করেছিস কোন সাহসে ? জীবনের ২২ বছর নকল ইয়াসির হামিদের ছেলে হয়ে থাকলেও সত্যিকার ভাই ছিলি আবরার হামিদ ইয়াদের। তাই বাবা কে ছিলো ভুলে যা, বাকি জীবন আসল ইয়াসির হামিদের ছেলে আর আবরার হামিদ ইয়াদের ভাই হিসাবে এই বাড়িতেই কাটাবি তুই।

ইশান অসহায় গলায় বললো, কিন্তু ভাইয়া ?

ইয়াদ নিজের রুমের দিকে পা বাড়িয়ে বললো, এক কথা বারবার বলা আর আমার কথার উপর অন্যকারো কথা বলা একদমই পছন্দ করি না আমি। চুপচাপ নিজের রুমে যা এখানে আর কোনো আলোচনা চাই না আমি।

ইমা ইশানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে রুমে যাওয়ার ইশারা করে ইয়াদের পিছু পিছু নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরলো।

ইয়ানা ইশানের দিকে এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে মাথার পিছনে একটা থাপ্পড় মারলো। ইশান মৃদু চিৎকার করে মাথার পিছনে হাত বুলাতে লাগলো।

এটা কী করলি আপু ?

ইয়ানা ইশানের কান টেনে ধরে বললো, কেনো কী করেছি দেখতে পাসনি ? আর একবার দিয়ে দেখাবো নাকি ?

ইশান অসহায় গলায় বললো, তুই মাথায় থাপ্পড় মেরে মেরে আমার ব্রেনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিস।

ইয়ানা ইশানের কান ছেড়ে বললো, ঠিক বলেছিস আমার থাপ্পড় খেয়ে তোর মাথার মগজগুলো জৈব সারে পরিণত হয়েছে, তাই এমন ফালতু একটা কাজ করতে যাচ্ছিলি। যা চুপচাপ রুমে গিয়ে ঘুমা এতে যদি জৈব সার থেকে একটু মগজ তৈরি হয়।

ইয়ানা ইশানের দিকে শাসানো ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো। বিকেল হয়ে গেছে এই সময়টা ছাঁদে কাটাতে ভালো লাগে ইয়ানার। ইশান ভরা চোখে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। এতো ভালো মানুষগুলোর সাথে এতটা খারাপ কী করে হতে পারে ভেবে পায় না ইশান। চোখ মুছে লাগেজ নিয়ে রুমে ফিরে গেলো। ইয়াদের আদেশ উপেক্ষা করার সাধ্য ইশানের নেই।

ইমা রুমে এসে দেখে ইয়াদ সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।

ইমা ধীর গলায় বললো, আপনার কী খারাপ লাগছে, এতো তাড়াতাড়ি চলে এলেন যে আজ ?

ইয়াদ চোখ খুলে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ইমার দিকে আর বললো, কেনো তোমার অসুবিধা হচ্ছে আমি তাড়াতাড়ি চলে আসাতে ?

ইমা ব্যস্ত গলায় বললো, এমা তা কেনো হবে ? আসলে কখনো আসেন না তো, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম আর কী।

ইয়াদ আবার চোখ বন্ধ করে বললো, মাথাটা ধরেছে কড়া এক কাপ কফি নিয়ে এসো।

ঠিক আছে আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি এখনই কফি এনে দিচ্ছি।

ইমা রুম থেকে বের হয়ে গেলে ইয়াদ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুম চলে গেলো।

ইমা রুম থেকে বের হয়ে বিড়বিড় করে বললো, এই লোক জীবনে ভালো করে কথা বলতে শিখবে না। এর মুখে ভালো কথাও নিম পাতার জুস মনে হয়।

ইয়াদ ফ্রেশ হয়ে একটা ধূসর রঙের টিশার্ট, কালো টাউজার আর পায়ে কালো স্লিপার পরে মিনি ছাঁদে গিয়ে চেয়ারটাতে বসলো। পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম আলো চারপাশটা সুন্দর করে তুলেছে। পরিবেশটা যে কারো মন ভালো করতে সক্ষম। তবে ইয়াদের মন কতটা ভালো করতে পারলো সেটা বুঝা গেলো না। সে চুপচাপ বসে রইলো বাড়ির পিছনের বাগানের দিকে তাকিয়ে। নিজের জীবনটার প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গেছে ইয়াদের। জীবনের দিকে তাকালে মনে হয়ে কিছু ছাই পরে আছে সব দাউদাউ করে পুড়ে যাওয়ার পর। না কোনো রং আছে আর না আছে এক চিলতে হাসি।

আপনার কফি।

ইমার কথায় ইয়াদের বাস্তবে পদার্পণ হলো চিন্তার জগৎ থেকে।

ইমার হাতে এক কাপ কফি দেখে বললো, এক কাপ কেনো, তুমি খাবে না ?

ইমা ফট করে বলে ফেললো, আপনি শেয়ার করলে অবশ্যই খাবো ?

কথাটা শুনে ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো আর ইমা দাতে জিহ্বা কাটলো আর আমতা আমতা করে বললো, আমি আপনার মতো তেতো কফি খেতে পারি না।

ইয়াদ ইমার হাত থেকে কফিটা নিয়ে এক চুমুক দিয়ে বললো, তোমারটা আলাদা করে বানাতে।

ইচ্ছে করছিলো না তাই আর বানাইনি।

ইয়াদ আর কিছু বললো না চুপচাপ কফি খেতে লাগলো সামনের দিকে তাকিয়ে। ইমা তাকিয়ে আছে ইয়াদের দিকে। এই কয়েকদিনে ইয়াদের চেহারায় অনেকটা বিষন্নতা ফুটে উঠেছে আর আজ তা আরো বেশী তীব্র মনে হচ্ছে ইমার কাছে।

মলিন গলায় ইমা বললো, কী হয়েছে আপনার ?

ইয়াদ কফির কাপে চুমুক দিতে গেলে ইমার কথায় থেমে গেলো, কিছু একটা ভেবে পরক্ষণে আবার চুমুক দিয়ে শান্ত গলায় বললো, কী হবে, কিছু হয়নি ?

ইমা অসহায় গলায় বললো, আচ্ছা এখনো কী আপনি আমাকে একটুও বিশ্বাস করতে পারেননি ? একটু বিশ্বাসও অর্জন করতে পারিনি আমি ?

ইয়াদ কফির দিকে তাকিয়ে পুরোটা শেষ না করেই সামনে টেবিলটাতে রেখে দিলো। কী উত্তর দেবে ইমার প্রশ্নের ? কিছু না বলে চুপচাপ সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো ইয়াদ।

ইমা ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে বললো, জানেন তো ? ভালোবাসা জিনিসটা কারো কাছে পরশপাথরের থেকেও মূল্যবান, একবার পেয়ে গেলে অতি যত্নে লুকিয়ে রাখে মনের গহীনে যাতে হারিয়ে না যায়। আবার সেই ভালোবাসাই কারো কাছে পথের ধূলোর থেকেও মূল্যহীন, অবহেলা করে পায়ে মাড়িয়ে চলে যায়। তবে সময়ের ব্যবধানে পথের ধূলো ভেবে অবহেলা করা ভালোবাসাটাই পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে মানুষ। কিন্তু যা একবার হারিয়ে গেলে সেটা কী আর এতো সহজে মেলে ?

কথাটুকু বলে ইমার আঁটকে রাখা চোখের পানিটা লাগামহীন ভাবে গড়িয়ে গেলো। ইমা চোখের পানি আড়াল করার জন্য ইয়াদের সামনে থেকে চলে আসতে গেলে ডান হাতে টান পরলে দাঁড়িয়ে পরে। না দেখেই বলতে পারে ইয়াদ তার হাত ধরে রেখেছে শক্ত করে। ইমা ঘুরে তাকালো না সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো। ইয়াদও ইমার হাত না ছেড়ে সেভাবেই ধরে রইলো।

ইমা, পরশপাথরের থেকেও মূল্যবান জিনিসটা কখনো আমার ভাগ্যে মিলেনি। তাই লুকিয়ে রাখার প্রশ্নও আসে না। আর যেটা কখনো পাইনি সেটা অবহেলা করে পথের ধুলো ভেবে পায়ে মাড়িয়ে যাবো কীভাবে, সেটাও একটু বলে যাও।

কথাটা বলার সময় ইয়াদের কণ্ঠে লুকিয়ে ছিলো হাজারটা যন্ত্রণা আর হাহাকার। হয়তো ইমা বুঝতে পারলো ইয়াদের মনের হাহাকার। টলমলে চোখে ঘুরে তাকালো ইয়াদের দিকে আর ইয়াদও তাকালো ইমার দিকে। ইয়াদের চোখ দুটো অলরেডি লাল টকটকে হয়ে গেছে তবে আজ সেটা রাগের জন্য নয় বরং চাপা কষ্টগুলো চোখে ফোটে উঠেছে।

ইমা ইয়াদের ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললো, সত্যি কী পাননি, নাকি পেয়েছেন কিনা তার খোঁজই রাখেননি কখনো ?

ইয়াদের কী হলো সে নিজেও বুঝতে পারলো না। তবে ইমার কথাতে কিছু তো ছিলো যা ইয়াদকে বাঁধ্য করলো নিজের খোলস থেকে বের হয়ে আসতে। ইয়াদ একটানে ইমাকে কাছে টেনে নিলো, ইমা একদম ইয়াদের সামনে গিয়ে দাড়ালো ইয়াদের টান সামলাতে না পেরে। ইয়াদ ইমার চোখে চোখ রাখলো। ইমা দাঁড়িয়ে আছে আর ইয়াদ চেয়ারে বসে আছে, চেয়ারটা নিচু হওয়ায় ইয়াদের মাথাটা ইমার পেট বরাবর। ইয়াদ আচমকা ইমাকে জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ গুঁজে দিলো। ইমার সারা শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো ইয়াদের স্পর্শে। কথা বলা আর নড়াচড়া দুটোই বন্ধ হয়ে গেছে ইমার। কিছুটা সময় ওভারে পার করার পর ইমার মনে হলো তার পেটের দিকটার শাড়ী ভিজে উঠছে গরম তরলে, তবে কী ইয়াদ কাঁদছে ? ইমা নিজের কাঁপা হাতটা ইয়াদের মাথায় রাখতেই ইয়াদ আরো কষ্ট করে আঁকড়ে ধরলো ইমাকে।

ইমা কাঁপা গলায় বললো, আপনি কাঁদছেন ?

ইয়াদ কান্না ভেজা গলায় উত্তর দিলো, বারো বছর ধরে নিজের অনুভূতিগুলো লোহার খাঁচায় বন্দী রাখতে রাখতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি ইমা। জীবনের উপর এখন বিতৃষ্ণা এসে গেছে আমার আর পারছি না আমি।

সেদিন ইয়াদ নেশার ঘোরে কান্না করেছিলো আর আজ সজ্ঞানে। ইমার মনে হচ্ছে ইয়াদের সেদিনের কান্নার থেকেও আজকের নিঃশব্দের কান্না আরো বেশী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে ইমার ভেতরটাকে। সহ্য হচ্ছে না ইয়াদের চোখের জল। ইয়াদ হঠাৎ ইমাকে ছেড়ে এক টানে নিজের কোলের উপরে বসিয়ে দিলো। ইয়াদের প্রত্যেকটা কাজে ইমা একের পর এক অবাক হচ্ছে আজ।

ইয়াদ ইমার দুগালে হাত রেখে বললো, ভালোবাসো এই অনুভূতিহীন মানুষটাকে ?

ইমা ইয়াদের চোখে চোখ রেখে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। চোখ থেকে টপটপ পানি পরছে ইমার সাথে ইয়াদের চোখও ভেজা।

কখনো ধোঁকা দিবে না তো ?

যতদিন এই দেহে নিশ্বাস চলবে ততদিন শুধু ভালোবাসাই দেবো, অন্যকিছু কল্পনাতেও নেই।

ভালোবাসতে পারি না আমি, তাই সেটার শিক্ষক তোমাকেই হতে হবে। তবে একবার শিখিয়ে দিলে তোমার থেকেও বেশি ভালোবেসে দেখাবো। তবে যদি কোনোদিন ধোঁকা পাই, নিশ্বাসের মায়া ত্যাগ করবো, তবে তোমাকে কিছু বলবো না।

ইমা কিছু না বলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ইয়াদকে আর ইয়াদও জড়িয়ে নিলো নিজের জীবনের নতুন অধ্যায়কে।

৩৪.
দেখতে দেখতে কেটে গেলো তিনটা মাস। দিসার, রুবিনা আর কামরুলকে পুলিশের হাতে তোলে দিয়েছে ইয়াদ। খুনীর রক্তে হাত রাঙিয়ে নিজেও খুনী হতে চায় না ইয়াদ। পুলিশে দেওয়ার আগে পুরো এক মাস হসপিটালে ভর্তি ছিলো দিসার। দুই মাস বন্দী ছিলো ইয়াদের হাতে যার প্রত্যেকটা দিন নরক যন্ত্রণা ভোগ করেছে দিসার। প্রতিটা মুহূর্তে নিজের মৃত্যু প্রার্থনা করেও মৃত্যুর দেখা মেলেনি তার। জীবনটা হয়ে উঠেছিলো মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর। পেটের ক্ষুধায় হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে টাকাও চিবিয়েছে আর তা দেখে অট্টহাসিতে মেতে উঠেছে ইয়াদ। বাঁচিয়ে রেখেছে ঠিকই মৃত্যু থেকেও ভয়ংকর জীবন দিয়ে। একমাস হসপিটালে ভর্তি থাকার পর যখন মোটামুটি সুস্থ হয় আর তখনই সাথে সাথে পুলিশ গ্রেফতার করে দিসারকে। কামরুলকে আগেই পুলিশের হাতে দিয়ে দিয়েছিলো ইয়াদ। তবে রুবিনার মানসিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। সারাদেশের মানুষ জেনে গেছে রুবিনা আর দিসারের মুখোশের আড়ালের চেহারাটা। দুজনেরই ফাঁসির আদেশ হয়েছে আর কামরুলের বারো বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। দিসারের ফাসির আদেশ খুব তাড়াতাড়ি কার্যকর করা হবে কিন্তু রুবিনা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত মানসিক হাসপাতালে রাখার আদেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। হামিদ মঞ্জিল অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে কালো অতীতের সেই তীব্র যন্ত্রণাগুলোকে। তাদের নতুন জীবনে দিসার বা রুবিনা নামক কারো জন্য এক সেকেন্ড সময়ও নেই। ইয়াদ আর ইমার সম্পর্কের অনেকটা উন্নতি হয়েছে তবে এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়নি। বাকি সব স্বামী স্ত্রীর মতো সম্পর্কটা নয়, তবে একে অপরকে পাগলের মতো ভালোবাসতে শুরু করেছে।

ফোনের স্কিনে আরমানের একটা ছবি জলজল করছে আর সেদিকে টলমল চোখে তাকিয়ে আছে ইয়ানা। সবার ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না, সেটা আগে অনেক শুনেছে। তবে আজ নিজের সাথে হওয়ার জন্য ইয়ানা বুঝতে পারছে অপূর্ণতার কষ্ট কতোটা যন্ত্রণাদায়ক। আরমান হয়তো কোনোদিন জানতেও পারবে না তাকে কেউ পাগলের মতো ভালোবেসেছিলো, সবচেয়ে বেশি চেয়েছিলো। কখনো আর বলা হবে না তাকে, মনের লুকিয়ে রাখা কথাগুলো। কিছু ভালোবাসা হয়তো অপ্রকাশিত থাকাই ভালো।

ইয়াদ রাগী গলায় বললো, তুমি এতো কী রেডি হচ্ছো ? দেখতে আসবে ইয়ানাকে তোমাকে নয়, তাই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে গিয়ে দেখো ইয়ানার হলো কিনা।

ইমা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হিজাবটা পড়ছিলো আর ইয়াদ বেডে পায়ের উপর পা তুলে বসে কথাটা বলে উঠলে ইমা তার দিকে কড়া চোখে তাকালো।

চলবে,,,,

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৩৬

ইমা কড়া চোখে তাকালো ইয়াদের দিকে আর কোমরে হাত দিয়ে বললো, কোথায় সাজতে দেখলেন আমাকে ? হিজাবটা না পরলে তো উনাদের সামনে যেতেও দিবেন না।

ইয়াদ বেড থেকে উঠে দাড়িয়ে বললো, হিজাব পরেও যাওয়ার প্রয়োজন নেই। রেহান তো ইয়ানাকে পছন্দ করে কিন্তু ওর বাবা-মা না আবার ইয়ানাকে রেখে আমার বউ নিয়ে টানাটানি করে। তাই যাওয়ার দরকার নেই ওদের সামনে।

ইয়াদের কথা শুনে ইমা ফিক করে হেঁসে দিলো, তা দেখে ইয়াদ গম্ভীর গলায় বললো, হাসি বন্ধ করে ইয়ানার কাছে যাও।

ইমা হাসি থামিয়ে ইয়াদকে একটা ভেংচি কেটে ইয়ানার রুমে যাওয়ার জন্য বের হয়ে গেলো। ইমা যেতেই ইয়াদ মুচকি হাঁসলো। মেয়েটা এখন অনেকটা নরমাল হয়ে গেছে তবে ইয়াদের লাই পেয়ে দুষ্টুমিগুলো অনেক বেড়ে গেছে। মানুষ এতো সহজে নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে না, ইয়াদও পারেনি এখনো, এতটা পরিবর্তন হতে। তবে সে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবু মাঝে মাঝে আগের রুপ ফিরে আসে তার। ইমা ইয়াদকে ভয় পেলেও বুঝতে দেয় না। এমন ভাব করে যেনো ইয়াদের রাগে তার কিছুই আসে যায় না। ইয়াদ সেটা বুঝতে পেরে আড়ালে হাসে।

আপু আসবো ?

দরজায় ইমার গলা শুনে ফোনটা দ্রুত লুকিয়ে ফেললো ইয়ানা আর চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো।

হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো, হ্যাঁ ভাবি আসো।

ইমা গিয়ে দেখে ইয়ানা কিছুই করেনি এমনই বসে আছে তা দেখে ব্যস্ত গলায় বললো, এ কী আপু তুমি তো এখনো রেডি হওনি। উনারা তো এখনই চলে আসবে আর তোমার ভাইয়াও আমাকে পাঠালো তুমি রেডি হয়েছো কিনা দেখতে।

ইয়ানা নিচুস্বরে বললো, এখনই রেডি হয়ে নিচ্ছি।

ইয়ানার গলার আওয়াজে ইমার ভ্রু কুঁচকে গেলো, যে কেউ বুঝতে পারবে ইয়ানা কান্না করছিলো।

ইমা ব্যস্ত গলায় বললো, আপু তোমার গলা এমন লাগছে কেনো ? তুমি কী কান্না করেছো ?

ইয়ানা থতমত খেয়ে বললো, ক,,কই না তো, কান্না করবো কেনো ?

আমার থেকে লুকানোর চেষ্টা করে লাভ নেই আপু, আমি ভালো করেই চিনি তোমাকে। তুমি কী উনাদের সামনে যেতে চাইছো না ? অন্য কাউকে ভালোবাসো তুমি ?

ইমার কথা শুনে ইয়ানা চমকে উঠে ইমার দিকে তাকালো আর অস্থির গলায় বললো, না না তেমন কিছু না। আসলে বিয়ে হয়ে গেলে ভাইয়াকে ছেড়ে, তোমাদের সবাইকে ছেড়ে যেতে হবে তাই কষ্ট হচ্ছিলো।

তুমি দেখছি খুব বোকা, দেখে গেলেই বিয়ে হয়ে যায় নাকি, বোকা ?

ইয়ানা কিছু না বলে মলিন হাসলো। ইমা ইয়ানাকে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বললো। তারপর নিজের হাতেই সাজিয়ে দিতে লাগলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা যদি ইমার মনের কান্নাটা দেখতে পেতো। ইয়ানা অনেক কষ্টে নিজের চোখের পানি আটকে রেখেছে। এদিকে ইশান ব্যস্ত সব ঠিকঠাক আছে কিনা সেটা দেখতে। একমাত্র বোনকে দেখতে আসবে কোনো অভিযোগ যেনো করতে না পারে।

সব ঠিক আছে ইশান ?

ইশান পেছন ফিরে ইয়াদকে দেখে মুচকি হেঁসে বললো, হ্যাঁ ভাইয়া সব ঠিকঠাক।

ইয়াদ হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে বললো, তুই এমন হিরো সেজে বসে আছিস কেনো ? দেখ হিরো সেজে লাভ নেই, রেহান তার বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে ওর কোনো ছোটবোন নেই।

কথাটা বলে ইয়াদ দুষ্টু হাসলো আর ইশানের মুখটা মলিন হয়ে গেলো। চোখের সামনে কথার কপাল কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে তাকানো সেই মুখটা ভেসে উঠলো। নিজের অতীত ইশানের পথ আঁটকে দিয়েছে সে আর কথাী সামনে যায়নি গত তিন মাসে। তবে দূর থেকে দেখে গেছে আর আল্লাহর কাছে চেয়েছে ওর যারই হোক যাতে সুখী হয়।

ইয়াদ ইশানের পিঠ চাপড়ে বললো, কোন চিন্তায় ডুবে গেলি ? চিন্তা করিস না ইয়ানার পর তোর জন্যেও খোঁজে বের করবো কাউকে।

ইশান মুচকি হেঁসে বললো, খুঁজতে হবে না।

ইয়াদ সন্দেহ নিয়ে ইশানের দিকে তাকিয়ে বললো, কেনো নিজেই খুঁজে রেখেছিস নাকি ?

ইশান মলিন হেঁসে বললো, না তেমন কিছুই না। এসব বাদ দিয়ে বলো উনারা কখন আসবে ?

রেহান আমাকে কল দিয়েছিলো বাসা থেকে বের হওয়ার সময়। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে,,,

ইয়াদের কথা শেষ হওয়ার আগেই ডোরবেল বেজে উঠলে ইয়াদ গিয়ে দরজা খোলে দিলো। রেহানরা চলে এসেছে। রেহান ভেতরে এসে ইয়াদকে জড়িয়ে ধরলো।

ইয়াদ মুচকি হেঁসে রেহানের পিঠে হাত রেখে বললো, কেমন আছিস ইয়ার ?

রেহান ইয়াদকে ছেড়ে বললো, এই যে যেমন দেখতে পাচ্ছিস। তুই কেমন আছিস সেটা বল ?

ইয়াদ হাসিটা বজায় রেখে বললো, আলহামদুলিল্লাহ সব দিক থেকে ভালো রেখেছে উপরওয়ালা।

রেহান ইশানের দিকে তাকিয়ে বললো, এটাই বুঝি ইশান ?

ইয়াদ ইশানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললো, হুম এটাই ইশান।

রেহান এগিয়ে গিয়ে ইশানকে হাগ করলো আর বললো, তুমি আমাকে চেনো না বাট আমি তোমাকে চিনি। তার কারণটা অন্য একদিন বলবো।

রেহানের মা মুখ ফুলিয়ে বললো, এটা কিন্তু ঠিক হলো না ইয়াদ। বন্ধুকে পেয়ে আঙ্কেল আন্টিকে চোখেই পরছে না।

ইয়াদ লজ্জিত হয়ে বললো, আম,, সরি আন্টি আসলে এতোদিন পর দেখা তো তাই আর কী ,,,

রেহানের মা ইয়াদের মাথা হাত রেখে বললো, মজা করলাম তো, আমরা কিছু মনে করিনি।

ইয়াদ মুচকি হেঁসে রেহানের বাবার দিকে তাকিয়ে সালাম দিলো। সবার সাথে অনেক কথাবার্তা হলো। ইয়াদ আর রেহানের কথায় বুঝা যাচ্ছে তারা অনেক পুরনো ফ্রেন্ড। কথার মাঝেই ইয়াদ একজন সার্ভেন্টকে ডেকে বললো ইয়ানা আর ইমাকে দ্রুত নিচে আসতে। হালকা নাশতা করছে আর গল্প করছে সবাই। ইয়ানাকে দেখতে আসছে বললে একটু ভুল হবে, কারণ রেহানের পরিবার ইয়ানাকে আগে থেকেই ভালো করে জানে। এখানে মূলত বিয়ের ডেট ফিক্স করা হবে। ইমা ইয়ানাকে নিয়ে সবার সামনে আসলে ইয়ানা মিষ্টি করে সালাম দিলো ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে। ইয়ানাকে নিয়ে একটা সিঙ্গেল সোফায় বসিয়ে দিলো ইমা আর নিজে গিয়ে ইয়াদের পাশে বসলো কিছুটা দূরত্ব রেখে।

রেহানের মা বললো, ইয়াদ তুমি কিন্তু চিটিং করেছো চুপচাপ বিয়ে করে নিয়ে। তবে মাফ করে দিলাম বউমা দেখে।

ইয়াদ মুচকি হাঁসলো তার কথায় আর ইমা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। রেহান আড়চোখে বারবার ইয়ানাকে দেখে যাচ্ছে, তবে ইয়ানা এখনো কোনো দিকে তাকায়নি, তার দৃষ্টি ফ্লোরে। শরীরটা এখানে থাকলেও মনটা এখানে নেই। কী হচ্ছে, না সেটা দেখছে আর না বুঝতে পারছে। রেহানের মা রেহানের অবস্থা বুঝতে পেরে দুজনকে আলাদা কথা বলতে বললো। রেহানের মা বলার প্রায় সাথে সাথে রেহান উঠে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো তবে ইয়ানা বসেই আছে। আসলে সে কিছুই খেয়াল করেনি এখানে কী হচ্ছে। ব্যাপারটা কেউ খেয়াল করার আগেই ইমা ইয়ানার হুঁশ ফেরালো আর ছাঁদে যেতে বললো। রেহান এই বাড়িতে আগে একবার এসেছিলো আর থেকেও ছিলো দুতিনদিন তাই বাড়িটা তার চেনা। ছাঁদে গিয়ে চারপাশ ঘুরে দেখতে লাগলো রেহান। আগের থেকেও অনেকটা সুন্দর হয়ে গেছে ছাঁদটা।

৩৫.
কেমন আছো ইয়ানা ?

পরিচিত গলা শুনে চমকে পেছন ফিরে তাকালো ইয়ানা। ছাঁদে এসে কোনোদিকে না তাকিয়ে একপাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো। তখনই পেছন থেকে পরিচিত গলাটা শুনতে পেলো।

পেছনে দাঁড়ানো মানুষটা দেখে ইয়ানার মুখ অটোমেটিক হা হয়ে গেলো।

রেহান ইয়ানার অবস্থা দেখে ফিক করে হেঁসে বললো, হা বন্ধ করো মশা ঢুকে যাবে তো।

বিষ্ময়কর কণ্ঠে বললো, রেহান ভাইয়া তুমি এখানে ?

রেহান ভাব নিয়ে বললো, হুম আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম আসবো আর কথা রাখতে চলেও এসেছি।

ইয়ানার বিস্ময় এখনো কাটেনি। ইউকে পাশাপাশি বাসা ছিলো রেহান আর ইয়াদের। এই একটা মানুষের জন্য ইয়ানাও ইয়াদের মতো রোবটে পরিণত হয়নি। সবসময় ইয়ানাকে হাসিখুশি রাখতো রেহান। রেহানের মা বাবাও ইয়ানাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতো। বাসায় থাকলে বেশির ভাগ সময় রেহানদের বাসায় থাকতো ইয়ানা। ইয়াদ ইউকে গিয়ে রেহানের ক্লাসেই ভর্তি হয়েছিলো। ইয়াদ যেমন গম্ভীর রেহান ঠিক ইয়াদের বিপরীত। রেহান ইশানের মতোই হাসিখুশি আর সহজ সরল আর রেহান পেশায় ডক্টর। ইয়াদ একমাত্র এই রেহানের সাথে একটু ক্লোজ, রেহান ইয়াদের কষ্টের সময়ের সাথী ছিলো। সেদিন ইয়াদের জন্মদিন পালন করতে রেহানও ইয়াদের সাথে বাংলাদেশে এসেছিলো। রেহানের পুরো পরিবার ইউকে সেটেল্ড হয়ে গেছে অনেক আগে, রেহানের জন্মই হয়েছে ইউকে। ইয়াদ ইয়ানাকে নিয়ে ইউকে ব্যাক করার পর নিজেকেই সামলে উঠতে পারছিলো না। ইয়ানার কী খেয়াল রাখবে। সেই সময়টাতে ইয়ানার খেয়াল রেখেছে রেহান। অবশ্য ধীরে ধীরে ইয়াদ বোনের প্রতি যত্নশীল হয়ে উঠে তবে রেহানও সবসময় ইয়ানার খেয়াল রাখতো। ইয়ানা বড় হবার পর একদিন রেহানকে বলেছিলো, সে কেনো এতো খেয়াল রাখে ইয়ানার। উত্তরে রেহান বলেছিলো নিজের বউ নিজের হাতে মানুষ করে নিচ্ছি যাতে পরে কষ্ট করতে না হয়। ইয়ানা কথাগুলো কখনো সিরিয়াসলি নেয়নি তবে আজ বুঝতে পারছে রেহান মজার ছলে বললেও মনের কথাই বলে গেছে।

ইয়ানা চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে বললো, আমি কিছু বুঝতে পারছি না রেহান ভাইয়া, আপনারা বাংলাদেশে কবে আসলেন আর এসব কী ?

রেহান রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বললো, বাংলাদেশে এসেছি তাও প্রায় একমাস হতে চললো। একেবারে চলে এসেছি তো তাই সব ঠিকঠাক করতে একটু সময় লাগলো।

ইয়ানা অবাক হয়ে বললো, একেবারে চলে এসেছো মানে ?

রেহান ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ আসতে হলো তোমার জন্য। ইয়াদ নিজের বোনকে ছাড়া থাকতে পারবে না, আমি ইউকে থাকলে আমার সাথে বিয়ে দেবে না। তাই আর কী করার চলে এলাম।

ইয়ানা স্তব্ধ হয়ে গেছে রেহানের কথা শুনে। শুধু তার জন্য সব ছেড়ে এখানে চলে এসেছে। সেখানে রেহানের কতো ভালো একটা ক্যারিয়ার ছিলো। এই মুহূর্তে ইয়ানার মাথা থেকে আরমান নামটা পুরোপুরি বের হয়ে গেছে। তার মাথায় হাজারটা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে রেহানকে নিয়ে।

ইয়ানা বোকার মতো বললো, আমি এখনো কিছুই বুঝতে পারছি না,,, আপনি আমার,,,,

রেহান ইয়ানাকে ইশারায় চুপ করতে বললো আর নিজে মুচকি হেঁসে বললো, তোমার সব প্রশ্নের উত্তর একটাই। ভালোবাসি তোমাকে, দিন বা মাস ধরে নয়। তোমাকে ভালোবাসি সেটা অনেকগুলো বছর ধরে। ইয়াদের কাছে নিজেকে তোমার যোগ্য প্রমাণ করতে কোনোদিকে না তাকিয়ে ক্যারিয়ারে ফোকাস করেছি পুরো দমে। নিজেকে প্রমাণ করার পরই নিজের প্রাপ্যটা বুঝে নিতে এসেছি।

ইয়ানা গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে। ইয়ানার প্রায় মনে হতো রেহান তাকে ভালোবাসে কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হতো সে মজা করেছে। রেহানের আচরণে বুঝা যেতো না সে কোনো বিষয়ে সিরিয়াস আর কোনো বিষয়ে উদাসীন। ইয়ানার কী বলা উচিত বা করা উচিত ইয়ানা বুঝতে পারছে না।

রেহান বুঝতে পারলো ইয়ানার মনের অবস্থা আর তাই বললো, আজ বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে এসেছিলো বাবা-মা।

ইয়ানা চমকে তাকালো রেহানের দিকে, মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।

রেহান মুচকি হেঁসে বললো, ভয় নেই আমি তোমাকে সময় দিয়ে যাচ্ছি। তবে উত্তরটা যেনো হ্যা হয় সেটা খেয়াল রেখো।

রেহান চলে যেতে গিয়ে আবার থেমে গেলো আর ইয়ানার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, আজ তোমাকে ঠিক তেমনটাই দেখাচ্ছে যেমনটা সবসময় আমি নিজের মনে সাজাতাম তোমাকে।

রেহানের ফিসফিস গলার আওয়াজ ইয়ানার কানে লাগতেই সারা শরীর কেঁপে উঠলো অজানা কারণে। রেহান নিচে চলে গেলো আর ইয়ানা ছাঁদের ফ্লোরে বসে পড়লো। কী করবে সে এখন ? একটা মানুষ তাকে এতবছর আগলে রেখেছিলো, এতগুলো বছর ধরে ভালোবেসে গেছে নিঃস্বার্থভাবে। তাকে কীভাবে ফিরিয়ে দেবে ইয়ানা আর অন্যদিকে তার মনে অন্যকারো বসবাস। ইয়ানার হঠাৎ আতিকের কথা বলে পরে গেলো। হিসাব মিলিয়ে দেখলো আজ থেকে অনেকগুলো বছর আগে যেখানে আতিক দাঁড়িয়ে ছিলো আজ সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে রেহান। পার্থক্য খব একটা খোঁজে পেলো না। কলিকে না পেয়ে আতিকের জীবনটা আজও ছন্নছাড়া ভাবে চলছে। এখনো প্রতিটা মুহূর্তে চোখের পানি ফেলে মানুষটা।

৩৬.
ইয়ানা আর নিচে নামেনি ছাঁদেই বসেছিলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে তবু ইয়ানার কোনো হেলদোল নেই। খোলা পাশটায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে চুপচাপ আর দৃষ্টি আকাশের দিকে। ইয়ানা কী করবে বুঝতে পারছে না।৷ চিন্তায় এতোটাই মগ্ন ইয়াদ কখন তার পাশে এসে বসেছে টেরই পায়নি।

নে কফিটা ধর।

কারো গলার আওয়াজে চমকে উঠে পাশে তাকালো ইয়ানা। ইয়াদের হাতে দু কাপ কপি তার মধ্যে এক কাপ ইয়ানার দিকে এগিয়ে দিয়েছে।

ইয়ানা কফির কাপটা নিয়ে বললো, তুমি কখন এলে ভাইয়া ?

ইয়াদ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো, তুই যখন গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলি তখন।

ইয়ানা কিছু বললো না চুপচাপ কফি খেতে লাগলো আর ইয়াদ একটু নড়েচড়ে বসে বললো, রেহানকে দেখে তুই অবাক হবি আগেই জানতাম। তাই আমি তোকে আগেই জানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু রেহান বললো তোকে সারপ্রাইজ দেবে তাই আর বলতে দেয়নি। ইয়ানা আমি জানি তোর কারো সাথে কোনোরকম সম্পর্ক নেই। তাই চেয়েছিলাম আজই ডেট ফিক্সড করতে কিন্তু রেহানের কী হলো জানি না, নিচে গিয়ে বললো কিছুদিন পরে করার জন্য।

ইয়ানা রেহান অনেক ভালো ছেলে। আমি নিজের পর একমাত্র ওর কাছেই তোকে নিরাপদ মনে করতাম, তাই ওর সাথে থাকলে নিশ্চিন্তে থাকতাম। রেহান তোকে অনেক আগে থেকে ভালোবাসে আর সেটা প্রথমে তোকে না বলে আমাকে বলেছিলো। আমি ওকে বলেছিলাম আমার বোনের যোগ্য হিসাবে নিজেকে তৈরি করতে পারবে আমি নিজে তোকে ওর হাতে তুলে দিবো। ও নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে তবেই এসেছে তাই এবার আমার কথা রাখার পালা। ও তোকে সত্যি অনেক ভালোবাসে আর আঙ্কেল আন্টি তোকে কতটা ভালোবাসে সেটা আমার থেকে তুই বেশি ভালো জানিস। জীবনে বাবা-মায়ের ভালোবাসা না পাওয়ার আফসোস পূরণ করে দেবে ঐ মানুষ দুটো। আর সবদিক বিবেচনা করেই আমি রাজি হয়েছি, তবুও তোর যদি রেহানকে পছন্দ না হয় তাহলে আমাকে জানাস। জীবনটা তোর তাই আমি কখনোই তোর উপর কিছু চাপিয়ে দেবো না, জোর করে। প্রয়োজনে রেহানের কাছে মাফ চেয়ে নিবো তোর খুশির জন্য, এবার সিদ্ধান্ত তোর।

ইয়াদ উঠে চলে গেলো আর ইয়ানা সেখানেই বসে রইলো। ভাইয়ের বলা প্রত্যেকটা কথা ভাবতে লাগলো।

চলবে,,,