তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব-৪১+৪২

0
1906

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪১

ইশান কথার প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার জন্য উঠে চলে যেতে নেয় কিন্তু কথা পেছন থেকে হাত টেনে ধরে ইশানের।

ইশান ঘুরে না তাকিয়েই বলে উঠে, কথা হাতটা ছাড়ো কথা।

কথা শান্ত গলায় বলে, হাতটা ছাড়ানোর আগে ভালো করে একবার ভেবে নিন। আজ যদি এই হাতটা ছাড়তে হয় আর কোনোদিন কিন্তু ধরার সুযোগ পাবেন না।

ইশান হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়াচ্ছিল কিন্তু কথার বলা শেষ হতেই ইশান শান্ত হয়ে যায় আর বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকায় কথার দিকে। ইশান কথার দিকে তাকাতেই কথা ইশারায় বুঝায়, সে যা বলেছে একদম সত্যি, কোনো মজা করেনি।

কথা ইশানের হাত ধরে রেখেই বললো, উত্তরটা কিন্তু এখনো পাইনি আমি।

ইশান অসহায় গলায় বললো, কাউকে ভালোবাসি বলার অধিকার আমার বাবা-মা আমার থেকে কেড়ে নিয়েছে। যার প্রতিটা রক্তকণিকায় দুজন খুনীর রক্ত বইছে তার কাউকে ভালোবাসি বলার যোগ্যতা নেই।

কথা ইশানের হাত ছেড়ে দিয়ে ইশানের পাশে দাঁড়ালো আর বললো, বাবা-মায়ের অন্যায়ের শাস্তি সন্তান কেনো পাবে ? তারা পাপ করেছে তাদের পাপের শাস্তি তারা পেয়েছে। তাদের পাপের শাস্তি আপনি কেনো পাবেন ?

খুনী বাবা মায়ের সন্তান হয়ে জন্মানোই আমার অপরাধ।

কথা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, যেমন কালো হয়ে জন্মানোটা আমার অপরাধ ?

ইশান গলার স্বর কঠিন করে বললো, আমাদের সবাইকে আল্লাহ তাআ’লা সৃষ্টি করেছে। কালো হয়ে জন্মানো তোমার কোনো অপরাধ নয়।

কথা এবার ইশানের চোখে চোখ রেখে বললো, কালো হয়ে জন্মানো যদি আমার অপরাধ না হয় তাহলে খুনীর সন্তান হয়ে জন্মানোটাও আপনার অপরাধ নয়। আপনি নিজের বাবা-মা নিজে ঠিক করেননি। আল্লাহ তাআ’লা যাদের আপনার বাবা-মা ঠিক করেছেন তারাই আপনার বাবা-মা হয়েছে। তারা অন্যায় করেছে, তার শাস্তিও তারাই ভোগ করেছে, এতে আপনার কোনো দোষ নেই।

ইশান আর কিছু না বলে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো আর কথা সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। অনেক বড় আঘাত পেয়েছে ইশান, এতো সহজে সেটা কাটিয়ে উঠতে পারবে না।

৪৩.
ইয়াদ আর ইমা সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। দুদিন বেশ ইনজয় করেছে দুজনেই। ইয়াদের জামাই আদর পাওয়ার সখ মিটে গেছে আর এসবে ইমা বেশ মজা নিয়েছে। সারা গ্রাম ঘুরে দেখিয়েছে ইয়াদকে। ইমা তার বাবা-মায়ের পুরনো বাড়িতে গিয়েছিলো। এতো বছরে সব জঙ্গল আর ধুলোবালিতে ঢাকা পরে গেছে। ইমার নানা বাড়ির মালিক এখন অন্য মানুষ তাই সেখানে যাওয়া হয়নি। দুদিন গ্রামে থেকে আজ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে ইয়াদ আর ইমা। আসার আগে তৌহিদুর আর তাহেরকে বারবার বলে এসেছে ইয়ানার বিয়েতে আসতে। তৌহিদুর ইমাকে বলে দিয়েছে যখনই ইচ্ছে হয় যেনো তৌহিদুরের বাসায় চলে যায়। সেটাই ইমার বাবার বাড়ি এখন থেকে।

ইয়াদ গাড়ি ড্রাইভ করছে ইমা সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, এখন থেকে রাগ করে বাবার বাড়ি চলে যেতে পারবো কিন্তু।

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, বাই চান্স, তুমি কী আমাকে ভয় দেখাচ্ছো ?

ইমা মজা করে বললো, বাবাহ, আমার ঘাড়ে কটা মাথা আবরার হামিদ ইয়াদকে ভয় দেখাবো ?

ইয়াদ কিছু বললো না সামনে দেখে ড্রাইভ করতে লাগলো চুপচাপ। তা দেখে ইমা আবার বললো, আপনি কী ভয় পান নাকি ?

ইয়াদ সামনে দৃষ্টি রেখে বললো, পৃথিবীর সব পুরুষরাই তাদের স্ত্রীকে ভয় পায়। আর কাউকে পাক আর না পাক স্ত্রীকে অবশ্যই ভয় পায়।

ইমা ইয়াদের দিকে হালকা ঘুরে বললো, তার মানে আপনিও আমাকে ভয় পান ?

ইয়াদ ছোট ছোট চোখ করে ইমার দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার কী মনে হয়, আমি তোমাকে ভয় পাই ?

ইয়াদের তাকানো দেখে ইমা নিজেই ভয় পেয়ে গেলো আর সোজা হয়ে বসে সামনে তাকিয়ে বললো, আপনি আর ভয় দুইটা বিপরীত শব্দ মনে হয় আমার কাছে। আপনি ভয় পাবেন আমাকে ? সেটা কোনোদিন হবে না।

ইয়াদ বিড়বিড় করে বললো, হ্যাঁ আমি তো বোকা। তোমাকে বুঝতে দেই আমিও তোমাকে ভয় পাই আর তুমি আমার মাথায় উঠে বসে থাকো।

গাড়ি থামান গাড়ি থামান।

ইমার চিৎকারে ইয়াদ ভয় পেয়ে ব্রেক কষলো আর গাড়ি একটু গিয়ে থেমে গেলো। গাড়ি থামতেই ইমা নিজের সীট বেল খুলে লাভ দিয়ে নেমে গেলো গাড়ি থেকে।

ইয়াদ অবাক হয়ে বললো, আরে আরে কোথায় যাচ্ছো তুমি ?

ইয়াদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ইমা এক দৌড়ে রাস্তার অপর পাশে চলে গেলো ফুচকা স্টলের কাছে। কড়া ঝাল দিয়ে ফুচকা দিতে বললো। ইয়াদ নিজেও নেমে এসে ইমার সামনে দাঁড়ালো পকেটে হাত গুঁজে।

ধমক দিয়ে বললো, এভাবে কেউ আসে ? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

ইমা ফুচকা বানানো দেখতে দেখতে বললো, আমি জানি ফুচকার কথা বললে আপনি জীবনেও গাড়ি থামাতেন না।

ইয়াদ রেগে বললো, তো রাস্তার এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার জন্য কে গাড়ি থামাবে। তুমি জানো এইগুলো কীভাবে বানায় ? কত নোংরা,,,,

ইয়াদকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললো, দেখুন ফুচকা নিয়ে যা ইচ্ছে তাই বলুন, তবু এটা দেখলে না খেয়ে থাকতে পারবো না আমি। তাই শুধু শুধু কষ্ট করে এতো কথা বলে লাভ নেই।

ইয়াদ ফুচকাওয়ালাকে পাঁচশ টাকার নোট দিয়ে ইমার দিকে তাকিয়ে বললো, যত ইচ্ছে খাও আর খাওয়া হয়ে গেলে গাড়িতে চলে এসো আমি গাড়িতেই আছি।

ইয়াদ হনহনিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে পড়লো আর ইমা ইচ্ছে মতো ফুচকা খেতে লাগলো। অতিরিক্ত ঝাল হওয়ায় চোখ মুখ লাল টকটকে হয়ে গেছে ইমার। খাচ্ছে আর হাত দিয়ে মুখে বাতাস করে যাচ্ছে। আর না পেরে খাওয়া বন্ধ করে গাড়িতে গিয়ে বসে কোনোমতে ইয়াদকে যেতে বললো। ইমার গলাটা কেমন যেনো লাগলো ইয়াদের কাছে তাই ঘুরে তাকালো। ইমাকে দেখে চমকে উঠলো ইয়াদ। চোখ, মুখ, ঠোঁট টকটকে লাল হয়ে গেছে, যেনো টাচ করলেই রক্ত বের হয়ে যাবে।

এ কী তোমার এই অবস্থা কেনো ?

ইমা ভেঙে ভেঙে বললো, ফুচকা অনেক ঝাল ছিলো।

ইয়াদের ইচ্ছে করছে ফুচকা ওয়ালাকে ধরে মরিচের গুঁড়োয় গোসল করাতে কিন্তু সেটা পারছে না, কারণ দোষ তার থেকে ইমার বেশি। ইয়াদ তাড়াতাড়ি পানির বোতল বের করে দিলে ইমা ঢকঢক করে সবটা শেষ করে দিলো। তবু হু হা করছে ঝালে। ইয়াদ কী করবে বুঝতে না পেরে ইমার দুগাল ধরে কাছে এনে মুখে ফু দিতে লাগলো। ইয়াদের হঠাৎ এমন কাজে ইমা ঝালের কথা ভুলে হা করে তাকিয়ে আছে ইয়াদের দিকে। ফু দিতে দিতে ইয়াদ আর ইমার ঠোঁট দুটো একদম ছুঁই ছুঁই করছে। ইমা পাথরের মতো বসে আছে, হঠাৎ ইমার ঠোঁটে হালকা ছুঁয়ে গেলো ইয়াদের ঠোঁট। তাতে ইয়াদও পাথরের মতো জমে গেলো।

অনেক সময় পর ইয়াদ সরে গেলো ইমার থেকে আর বললো, এখন ঠিক আছে ?

ইমা কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো সে ঠিক আছে। ইয়াদ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। একটু পর দুটো আইসক্রিম নিয়ে এসে ইমার হাতে দিয়ে খেতে বললো। ইমা একটা খোলে খেতে লাগলো। একটু পর আরেকটা খোলে ইয়াদের মুখের সামনে ধরলো। ইয়াদ ইমাকে অবাক করে দিয়ে নতুন আইসক্রিমটা সরিয়ে দিলো, ইমার খাওয়া আইসক্রিমটা টেনে নিলো। তারপর ইমার খাওয়া জায়গায় মুখ লাগিয়ে খেয়ে নিলো। ইয়াদের কাজে ইমা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো আর তা দেখে ইয়াদ মুচকি হাঁসলো। বাকিটা সময় দু’জন মিলেই দু’টো আইসক্রিম শেষ করলো। বাসায় এসে দেখে কথাকে যেতে দেয়নি ইয়ানা। সবাই একসাথে ডিনার করা শেষে কথা চলে যেতে চাইলো। জোর করলেও থাকতে রাজি হয় না তাই ইয়াদ ইশানকে বলে কথাকে পৌঁছে দিতে। ইশানের যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও ভাইয়ার কথা অমান্য করার সাধ্য নেই।

ইশান ড্রাইভ করছে হঠাৎ কথা বলে উঠলো, ইয়াদ ভাইয়ার রোগ মনে হয় আপনার উপর টান্সফার হয়ে গেছে।

ইশান কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললো, মানে ?

কথা ভাবুক ভঙ্গিতে বললো, দেখুন না ইয়াদ ভাইয়া এখন কত সুন্দর হাসি খুশি হয়ে কথা বলে আর আপনি মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে রাখেন।

ইশান না বুঝে বলে, বাংলার পাঁচ মানে কী ?

কথা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, সেটা তো আমিও সঠিক জানি না। যতদূর জানি এটা একটা কথার কথা।

ইশান ভ্রু কুঁচকে বললো, তোমার কথা ?

কথা নাক ছিটকে বললো, নাহ্ এই কথা সেই কথা না। ধূর আমার নামটা বেশ কনফিউজিং।

ইশান কথার অবস্থা দেখে আড়ালে মুচকি হাঁসলো। মেয়েটা বাস্তববাদী হলেও বেশ সহজ সরল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাকিটা পথ কথার বকবক শুনে পার হয়ে গেলো। মাঝে ইশানও দু একটা কথা বলেছে তবে আগের মতো নয়। কথা গাড়ি থেকে নেমে ইশানকে ভেতরে যেতে বললে ইশান না করে গাড়ি নিয়ে চলে আছে। যতক্ষণ ইশানের গাড়িটা দেখা যায় ততক্ষণ তাকিয়ে থেকে কথাও বাসার ভিতরে চলে যায়। কলিংবেলের শব্দে ছাহেরা বেগম দরজা খুলে দেয়।

কথাকে দেখে রাগী গলায় বলে, এটা কী বাড়ি নাকি হোটেল যখন ইচ্ছে যাচ্ছো যখন ইচ্ছে আসছো ? তুমি যাওয়ার আগে আমাকে বলে গিয়েছিলে, নাকি থাকার আগে আমাকে জানিয়েছো ?

কথা ভেতরে যেতে যেতে বললো, আমি ইমা আপুদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। এখানে বলার কী আছে ?

ছাহেরা বেগম রেগে বললো, কথা আমি তোর মা, তুই কোথায় যাবি, সেটা আমাকে বলে যাবি না ?

রাগটা দমিয়ে রাখলেও আর পারলো না কথা। রেগে চিৎকার করে বললো, মা কে মা, আপনি ? মা কাকে বলে সেটা আপনি জানেন ?

ছাহেরা অবাক হয়ে বললো, তুই কীভাবে কথা বলছিস আমার সাথে ?

কথা উঁচু গলায় বললো, কেনো কষ্ট হচ্ছে আমার এমন ব্যবহারে ? এর থেকেও অনেক বেশি কষ্ট, তুমি মনিমাকে দিয়েছো, ইমা আপুকে দিয়েছো ? তুমি এতটা জঘন্য মানুষ আমি সেটা ভাবতেও পারিনি আমি। তুমি ইমা আপুর মনে মণিমাকে নিয়ে এতো এতো খারাপ ধারণা তৈরি করেছিলে যে মানুষটা মরার আগেও নিজের মেয়েকে এবার কাছে পায়নি।

ছাহেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কথার দিকে। মেয়েটা এসব কথা কোথা থেকে জানতে পারলো সেটা বুঝে উঠতে পারছে না।

কথা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, কী ভাবছো, আমি এসব কোথা থেকে জানতে পারলাম ? তোমার কুকীর্তির কথা মণিমা সুন্দর করে চিঠিতে জানিয়ে গিয়েছে আপুকে। আর গতকাল রাতে আমার ফোন খুঁজতে খুঁজতে আপুর রুমের ড্রয়ারে এলবাম আর মণিমার চিঠি পেয়ে যাই। আমার ভাবতে ঘেন্না লাগছে তুমি আমার মা। তবে তুমি এবার বুঝতে পারবে সন্তান থেকেও না থাকার যন্ত্রণা কাকে বলে। তুমি যেমন মণিমার থেকে ইমা আপুকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলে আমি নিজেই তোমার থেকে অনেক অনেক দূরে সরে যাবো। তারপর তুমি বুঝতে পারবে মণিমার কষ্টটা।

ছাহেরা ভয়ে ভয়ে বললো, কথা তুই আমাকে ভুল বুঝেছিস।

কথা কড়া গলায় বললো, হ্যাঁ ভুল বুঝেছিলাম এতোদিন, এবার ঠিক বুঝেছি।

কথাগুলো বলে এক মুহুর্ত ছাহেরার সামনে দাড়ালো না কথা। নিজের রুমে চলে গেলো। পরিবারের ঝামেলা থেকে কথা বরাবরই দূরে থাকে তাই এসবের কিছুই জানতো না। গতরাতে ইমার রুমে ফোন খুঁজতে গিয়ে চিঠিটা পেয়ে যায় আর চিঠি পরে নিজের মায়ের আসল রুপ জানতে পারে কথা। নিজের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনতে পেলো আরমান। সেও ভাবতে পারছে না তার মা নিজের বোনের সাথে এমন জঘন্য অন্যায় করেছে। আরমানও ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো মায়রে থেকে। আরমান ইমার সাথে কম অন্যায় করেনি কিন্তু তার জন্য সে প্রতি মুহূর্তে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে এসেছে কিন্তু তার মায়ের মধ্যে কোনো অনুশোচনাও নেই। এতো কিছুর পরও নিজের সাফাই গাইতে চাইছিলো।

ছাহেরা বেগম ঘুরে আরমানকে দেখে বললো, দেখেছিস তোর বোন কতটা বেয়াদব হয়েছে ?

আরমান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, পাপ কাউকে ছাড়ে না মা। যা করেছো তার ফল তো ভোগ করতেই হবে।

আরমানও নিজের রুমে চলে গেলো আর ছাহেরা ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। সে একদিন মেয়ের এমন ব্যবহার মানতে পারছে না আর তাহেরা কতগুলো বছর এসব সহ্য করেছে।

৪৪.
বিয়ের শপিং করতে এসেছে ইয়ানা আর রেহান। ইয়ানার সাথে ঘুরতে ঘুরতে রেহানের মাথা ঘুরছে এখন।

রেহান ক্লান্ত গলায় বললো, ইয়ানা একটা বেনারসি খোঁজার জন্য পুরো মল ঘুরা শেষ তবু তোমার পছন্দ হচ্ছে না ?

ইয়ানা বেনারসি দেখতে দেখতে বললো, দেখুন বিয়ে জীবনে একবারই আসে। তাই সবকিছু মন মতো হওয়া চাই। আপনার কষ্ট হলে বাসায় চলে যান আমি একাই করতে পারবো।

রেহান বোকার মতো হেঁসে বললো, আরে না না কষ্ট হবে কেনো ? তোমার যতক্ষণ লাগে শপিং করো।

ইয়ানা তুমি এখানে ?

আরমানের গলা শুনে চমকে ইয়ানা পেছন ফিরে তাকালো। আরমান কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে ইয়ানার দিকে। রেহান ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরমানের দিকে।

রেহান একবার আরমানকে দেখে নিয়ে ইয়ানার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ইয়ানা উনি কে ?

ইয়ানা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে আর রেহান তাকিয়ে আছে ইয়ানার দিকে।

চলবে,,,,

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪২

রেহান একবার আরমানকে দেখে নিয়ে ইয়ানার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ইয়ানা উনি কে ?

ইয়ানা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে আর রেহান তাকিয়ে আছে ইয়ানার দিকে।

ইয়ানা আলতো করে রেহানের হাত আঁকড়ে ধরে আরমানের উদ্দেশ্যে বললো, আসসালামু আলাইকুম স্যার।

রেহান একবার ইয়ানা ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে ইয়ানার দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে বললো, স্যার ?

ইয়ানা হাসি মুখে রেহানের দিকে তাকিয়ে বললো, উনি আমার ভার্সিটির টিচার মিস্টার আরমান মাহমুদ আর রেহান হচ্ছে আমার বাগদত্তা।

ইয়ানা পরের কথাটা আরমানের দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো। রেহান আরমানের সাথে হাত মিলিয়ে সৌজন্যমূলক কথা বললো। আরমান চলে গেলে রেহান ইয়ানাকে বেনারসি দেখতে বললো কিন্তু ইয়ানার আর কিছুতেই মন লাগছে না।

রেহানকে বললো, আমার এগুলো ভালো লাগছে না, ভাইয়াকে বলে দেবো ডিজাইনার দিয়ে ডিজাইন করে দিতে।

রেহান কিছু একটা ভেবে বললো, ঠিক আছে বেনারসি থাক তুমি জুয়েলারি আর বাকি যা যা লাগে যেসব দেখো।

ইয়ানা মলিন হেঁসে বললো, আমার শরীরটা খারাপ লাগছে অন্যদিন শপিং করবো আজ বাসায় চলুন।

রেহান ব্যস্ত গলায় বললো, কী হয়েছে তোমার, বেশি খারাপ লাগছে ? আমাকে বলো কোথায় কষ্ট হচ্ছে। না চলো হসপিটালে গিয়ে টেস্ট করলেই বুঝা যাবে।

রেহানের ব্যস্ততা দেখে ইয়ানা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।

আরে আপনি এতো ব্যস্ত হচ্ছেন কেনো ? এমনই ঘুরাঘুরি ভালো লাগছে না আজ আর, অন্যদিন করবো বাকি শপিং।

রেহান স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, ঠিক আছে ফুডকোর্টে গিয়ে আগে খাওয়াদাওয়া করে নেই।

ইয়ানা আর কথা বাড়ালো না রেহানের সাথে ফুডকোর্টে চলে গেলো। আরমানের কথা ভেবে নিজেদের স্পেশাল মোমেন্ট নষ্ট করার মানেই হয় না। তাই ঠিক করলো কিছু খেয়ে তারপর শপিং করবে আবার।

৪৫.
আজ কথার ক্লাস নেই, কথা ক্লাসে বসে আছে গালে হাত দিয়ে। ক্লাসে বসে থাকতে বিরক্ত লাগছে তার কিন্তু বাসায় যেতেও ইচ্ছে করছে না। কী করবে সেটা ভেবে হঠাৎ ইশানের কথা মাথায় এলো। ঝটপট নিজের ফোন বের করে ইশানকে কল দিলো। দুবার রিং হয়ে কেটে গেলো কিন্তু ইশান রিসিভ করলো না। কথাও জেদ ধরে দিতেই থাকলো।

ইশান রিসিভ করে বিরক্ত গলায় বললো, হ্যালো,,,

কথা ইশানকে পুরোটা শেষ করতে না দিয়ে অস্থির গলায় বললো, এখনই আমার কলেজের সামনে আসুন প্লিজ। একদম লেট করবেন না এখনই আসুন, লেট করলে কিন্তু অনেক বড় বিপদ হয়ে যাবে।

কথাটা শেষ করে কল কেটে দিলো কথা। অপর পাশ থেকে ইশান ব্যস্ত গলায় হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে। ইশান আবার ট্রাই করলে কথার ফোন সুইচ অফ বলছে। ইশান অলরেডি ঘামতে শুরু করেছে টেনশনে। কথা এভাবে কেনো বললো তার কোনো বিপদ হলো নাকি সেটা ভেবে ইশানের চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটলো কথার কলেজে। এদিকে কথা জোশে পরে এভাবে বলে ফেলেছে কিন্তু এখন ভয়ে কাঁপা-কাঁপি করছে ইশান তার কী অবস্থা করবে সেটা ভেবে। দশ মিনিটের মধ্যে ইশান কথার কলেজের গেইটের সামনে গাড়ি থামালো। কথা গেইটের সামনেই দাড়িয়ে ছিলো ইশান দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে কথার সামনে দাড়িয়ে কথার হাত মুখ ভালো করে চেক করতে লাগলো।

ব্যস্ত গলায় বললো, কী হয়েছে এভাবে আসতে বললে কেনো ?

কথা অবাক হয়ে বললো, আরে কী হবে ? এমনই আসতে বলেছি আপনি এমন করছেন কেনো ?

ইশানের মাথা গরম হয়ে গেলো কথার এমন হেয়ালি দেখে আর রেগে ধমক দিয়ে বললো, এমনই এমনই কেউ এভাবে আসতে বলে ? জানো আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কীভাবে ড্রাইভ করে এসেছি তোমার কোনো আইডিয়া আছে ইউ ইস্টুপিট ?

কথা ইশানের ধমক খেয়ে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। মাটির দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইশানের বলা শেষে চুপ হয়ে গেলে কথা ঘুরে কলেজের ভেতরে যেতে চাইলে ইশান হাত টেনে ধরে বলে, কী হলো কিছু না বলে এখন আবার কোথায় যাচ্ছো ?

কথা গাল ফুলিয়ে বলে, আপনাকে আর কিছুই বলবো না আমি। আপনি কতগুলো বকা দিয়েছেন আমাকে।

ইশান এবার শান্ত গলায় বলে, আরে বাবা তুমি ওভাবে ডাকছিলে। আমি ভেবেছি তোমার কোনো বিপদ হয়েছে, তাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

কথা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, আমার বিপদ হলে আপনার কী ?

ইশান বিড়বিড় করে বললো, সেটা যদি বুঝতেই পারতে তাহলে এভাবে কষ্ট দিতে না।

ইশানের কথা বুঝতে না পেরে কথা আবার একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে ইশান জানালো কিছু বলেনি সে। আর জানতে চাইলো ইশানকে এভাবে ডাকার কারণ। কথাও গরগর করে ক্লাসের বিষয়ে সব বলে দিলো। ইশান কিছু একটা ভেবে বললো গাড়িতে উঠে বসতে।

কথা জানলা দিয়ে বাইরে দেখে বললো, কোথায় যাচ্ছি আমরা ?

ইশান দুষ্টুমি করে মুচকি হেঁসে বললো, আজ যেদিকে চোখ যায় সেদিকে চলে যাবো।

কথা মুগ্ধ হয়ে দেখলো ইশানের সেই হাসি আর আনমনে বলে উঠলো, আপনি সবসময় এমন হাসতে থাকবেন। আপনার গম্ভীর মুখ মানায় না এমন হাসি খুশি ভালো লাগে।

ইশান হাসিটা বজায় রেখে কথার দিকে তাকিয়ে বললো, কিছুদিনের জন্য হাসিটা বিসর্জন দিয়ে অনেক মূল্যবান কিছু পেয়ে গেছি।

কথা ছোট ছোট চোখে ইশানের দিকে তাকালে ইশান হা হা করে হাসতে লাগলো আর কথা ইশানকে চড় থাপ্পড় দিতে লাগলো। ইশানের হাসি থামছেই না আর কথা তাকে মেরেই যাচ্ছে।

৪৬.
সারা বাড়ি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। আজ ইয়ানার বিয়ে গতকাল গায়ে হলুদ গেছে। তাকে দেখতে আজ লাল পরীর মতো লাগছে। ইয়াদ আর ইশান খুব ব্যস্ত সময় পার করছে। ইশানের দায়িত্ব পরেছে গেস্টদের এটেন্ড করা আর ইয়াদ সবদিক দেখছে। ইয়ানাকে সাজানো হচ্ছে একটু পরই বরযাত্রী চলে আসবে।

ইয়ানা আপু তোমার হলো, বরযাত্রী চলে আসবে তো।

শাড়ীর আঁচল ঠিক করতে করতে ইয়ানার রুমে ঢুকে ইমা কথাটা বললো। সামনে তাকিয়ে ইয়ানাকে দেখে কথা বন্ধ হয়ে গেলো ইমার।

ইমা ইয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, আজ রেহান ভাইয়ার হুঁশ উঠে যাবে তোমাকে দেখে।

ইমার গলা শুনে ইয়ানা নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। পেছনে ঘুরে ইমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। ইমা প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও নিজেকে সামলে ইয়ানাকে জড়িয়ে ধরলো।

ব্যস্ত গলায় বললো, কী হয়েছে আপু তুমি কাঁদছো কেনো ?

ইয়ানা কাঁদতে কাঁদতে বললো, ভাইয়াকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো ? ভাইয়াকে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারবো না।

ইমা কী বলবে বুঝতে পারছে না ? ইয়ানা জ্ঞান হবার পর থেকেই ইয়াদের সাথে থেকেছে সবসময়। ইয়ানা যেমন ইয়াদের জান, ইয়াদও ইয়ানার জান বলা যায়। ইমা শান্তনা দেওয়ার ভাষা খোঁজে পাচ্ছে না। ইমা খেয়াল করেছে গত দুদিন ধরে ইয়াদের মনটাও ভার হয়ে আছে।

ইমা ইয়ানার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, আপু তুমি তো দূরে কোথাও যাচ্ছো না, ইচ্ছে করলেই তোমার ভাইয়ার কাছে চলে আসতে পারবে।

ইয়ানা তবু নিঃশব্দে কান্না করতে লাগলো। কথা এতক্ষণ চুপচাপ দেখছিলো, এবার ইয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, এটা কী করছো ইয়ানা আপু ? এতো কষ্ট করে উনারা সাজালো সব কেদে নষ্ট করে দিচ্ছো ? এবার তো তোমাকে দেখে রেহান ভাইয়া ভুত ভেবে ভয়ে পালাবে।

ইয়ানা ইমাকে ছেড়ে কথার দিকে তাকালো কোমরে হাত দিয়ে দাড়িয়ে। কথা সবকটা দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে লাগলো আর ওর হাসি দেখে ইয়ানা আর ইমাও হেঁসে দিলো। হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে চার পাঁচটা মেয়ে ঢুকলো আর ইয়ানার সাথে মজা করতে লাগলো। ইমা তাদের চেনে তারা সবাই ইয়ানার ফ্রেন্ড। নিচ থেকে বর এসেছে আওয়াজ আসতেই সবাই নিচে চলে গেলো শুধু ইয়ানার বেস্টফেন্ড নিধি রয়ে গেলো।

নিধি ইয়ানার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো, তুই কী রেহান ভাইয়াকে ঠকাচ্ছিস না, ইয়ানা ?

নিধির মুখে এমন কথা শুনে ইয়ানা চমকে উঠলো, অবাক হয়ে তাকালো নিধির দিকে।

কীসের ঠকানোর কথা বলছিস তুই ?

নিধি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, তাকে কিন্তু তুই বলিসনি তুই অন্য একজনকে ভালোবাসিস।

ইয়ানা কাঠ কাঠ গলায় বললো, ভালোবাসি না ভালোবাসতাম।

নিধি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ইয়ানা ভালোবাসার কখনো পাস্ট টেন্স হয় না। ভালোবাসতাম, ভালোবাসি বা ভালোবাসবো বলে কোনো শব্দ হয় না। ভালোবাসার একটাই শব্দ হয় আর সেটা হলো ভালোবাসি। কোনোদিন যদি তুই বলিস তুই আরমান স্যারকে আগে ভালোবাসতি এখন আর বাসিস না। তাহলে বুঝে নেবো তুই কোনোদিন তাকে ভালোই বাসিসনি। যা ছিলো সেটা তোর আবেগ বা মোহ।

ইয়ানা নিধির কথা শুনে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো আর বললো, তুই এখন কী করতে বলছিস আমাকে, তুই বল। যে মানুষটাকে আমি ভালোবাসি তার মনে আমার জন্য ভালোবাসা তো দূর ভালোলাগাও নেই। আর যে মানুষটাকে আমি বিয়ে করছি সে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে।

নিধি ইয়ানার থেকে চোখ সরিয়ে বললো, আমি বলছি না তুই বিয়েটা ক্যান্সেল করে দে। শুধু এটাই বলতে চাইছি রেহান ভাইয়ার থেকে কিছু লুকিয়ে তার সাথে মিথ্যা ভালোবাসার অভিনয় করে তাকে ঠকাস না। মানুষটা সম্পর্কে যতটা জেনেছি সে ধোঁকা ডিজার্ভ করে না।

ইয়ানা বেডে বসে বললো, তাকে আমি কখনো ঠকাবো না। যেদিন সত্যি তাকে ভালোবাসতে পারবো সেদিন তাকে ভালোবাসি বলবো। আমার বিশ্বাস সে আমাকে যথেষ্ট সময় দেবে। আর আমার সামনের জীবনে আমি অতীতের কোনো জায়গা রাখবো না। আমি আরমান স্যারকে কোনো দোষ দেই না কারণ তার মনে অন্যকেউ আছে সেটা জেনেই তাকে ভালোবেসেছিলাম। যে আমার না তাকে জোর করে আমার করতে চেয়েছিলাম।

নিধি বললো, ইয়ানা তুই একবার স্যারকে বলে দেখতে পারতি, তুই তো কোনোদিন তাকে কিছু বলিসনি।

ইয়ানা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, আরমান স্যার ভার্সিটির নতুন ম্যামকে ভালোবাসে।

নিধি অবাক হয়ে বললো, কী সব বলছিস আবোল তাবোল ?

ইয়ানা সেদিন আরমানের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে যা যা দেখেছিলো সব নিধিকে খোলে বললো।

নিধি মাথায় হাত দিয়ে বললো, আরে গাধী তুই পুরোটা না দেখেই ভুল বুঝেছিস। সেদিন তোকে স্যারের কেবিনের সামনে দেখে আমি এগিয়ে আসি কিন্তু তুই ততক্ষণে চলে যাস আর তখনই রুমের ভেতর থেকে স্যারের গলা শুনে আমি তাকিয়ে দেখি স্যার গোলাপ ফুলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে ম্যামকে বলছে দুঃখীত সে অন্যকাউকে ভালোবাসে আর ভদ্রভাবে ম্যামের ফুলগুলো ফিরিয়ে দেয়।

ইয়ানা নিধির কথা শুনে প্রথমে অবাক হলেও পরক্ষণে বললো, সে অন্যকাউকে ভালোবাসে আর সেটা আমি নই, সেটা কে তুইও জানিস আর আমিও ভালো করেই জানি। ম্যামকে যেমন ফিরিয়ে দিয়েছে আমাকেও ফিরিয়েই দিতো। তার থেকে কিছু ভালোবাসা অপ্রকাশিত থেকে যাওয়াটাই ভালো নয় কী ?

নিধি এগিয়ে গিয়ে ইয়ানাকে শান্তনা দিতে লাগলো। একটু পরই ইয়ানাকে নিচে নিয়ে যাওয়া হলো। রেহান মুগ্ধ হয়ে দেখছে আজ তার স্বপ্নের রানীকে। ইয়ানাকে দেখে ইয়াদের চোখ ভরে উঠলো পানিতে আর ইশান গিয়ে ইয়াদকে সামলে নিলো। ইয়ানার চোখদুটো আশেপাশে সেই মানুষটাকে খুঁজছে। চিরদিনের জন্য অন্যকারো হয়ে যাওয়ার আগে প্রিয় মানুষটার মুখ একবার দেখে নিতে ইচ্ছে করছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেলো সেই কাংখিত মানুষটাকে। যাক ইয়ানা শেষ অনুরোধটা রাখতে এসেছে তাহলে। নীল রঙের পাঞ্জাবির উপর কালো কটি পরা, কুঁকড়া চুলগুলো আজ আরো বেশী কুঁকড়া লাগছে, চোখে সানগ্লাস আর ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি। আজ রেহানকেও কিছু কম লাগছে না খয়েরী রঙের শেরওয়ানিতে কিন্তু ইয়ানার সেদিকে খেয়াল নেই। ইয়ানা আরমানের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে ইমাকে দেখতে পেলো। কথার সাথে দাঁড়িয়ে কোনো কিছু নিয়ে হাসিতে ঢলে পরছে ইমা আর তার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসছে আরমান আর চোখ ভরা পানি নিয়ে আরমানের দিকে তাকিয়ে আছে ইয়ানা।

সবার চোখের আড়ালে চোখের পানিটুকু মুছে নিলো ইয়ানা আর বিড়বিড় করে বললো, আপনি সত্যি ভালো বেসেছিলেন ইমাকে তবে সেটা বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছেন। আমিও আপনাকে সত্যি ভালো বেসেছিলাম। আর সেটা ঠিক সময়ে বুঝতেও পেরেছি কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় ছিলো না কখনো, ভালো থাকবেন স্যার।

একটা সাইন আর পর পর তিনবার কবুল বলে ইয়ানা হামিদ আজ থেকে মিসেস রেহান আহমেদ হয়ে গেলো। রেহানের ঠোঁটের কোণে প্রাপ্তির হাসি আর ইয়ানার চোখের কোণে হারানোর কষ্টের পানি। আরমানের ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি ইমার হাসিমুখ দেখে, ইমা মুগ্ধ হয়ে দেখছে নিজের ভালোবাসা নিজের স্বামীকে আর ইয়াদও মুগ্ধ হয়ে ইমাকে দেখছে। ইমাকে আজ একদম পরীর মতো লাগছে। একেকটা দৃষ্টির ভাষা আজ এক এক রকম অনুভূতি প্রকাশ করছে।

বেশ রাত হয়ে গেলো ইয়ানার বিদায়ের সময়। ইয়াদ আর ইশানকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো ইয়ানা। ইশান শব্দ করে কেঁদে দিলেও ইয়াদ নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। তাদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভাই বোনের কান্না দেখে ইমা আর কথাও কেঁদে দিলো। ইয়ানাকে জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে ইয়াদ দ্রুত রুমের দিকে চলে গেলো আর ইশান সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো যতক্ষণ গাড়ি বাড়ির গেইট পেরিয়ে না গেলো। কথা আজ যাবে না তাই আরমান তাকে রেখে আগেই বাড়ি চলে গেছে। ইয়ানা চলে গেলে ইমা ইয়াদকে খুঁজতে রুমে চলে গেলো। ইমা রুমে গিয়ে দেখে রুম অন্ধকার, লাইটের সুইচ দিয়ে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে এক কর্ণারে হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে দেখলো ইয়াদকে। ইমা ইয়াদের সামনে গিয়ে ফ্লোরে বসে ইয়াদের কাঁধে হাত রাখলো। ইয়াদ হুট করে ইমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ইয়াদের কান্না দেখে মনে হচ্ছে অনেকটা সময় চাপা দিয়ে রাখা কান্নাটা ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে বেড়িয়ে আসছে এখন। ইমা ইয়াদকে বাঁধা দিলো না বরং নিজের দু’হাত ইয়াদের পিঠে রাখলো।

ইয়াদ কাঁদতে কাঁদতে বললো, ইমা আমার ছোট পুতুলটা আজ অন্য কারো হাতে তুলে দিলাম। ইমা আমার ভয় করছে আমার কলিজাটাকে ভালো রাখবে তো রেহান ? আমার কলিজাটা ভালো না থাকলে আমিও যে শান্তিতে থাকতে পারবো না।

ইমা শান্তনা দিয়ে বললো, রেহান ভাইয়া অনেক ভালো মানুষ, আপুকে ভালোবাসে। আপনি চিন্তা করবেন না ইয়ানা আপুকে ভালো রাখবে সে।

ইয়াদ শান্ত হতে পারলো না ইমাকে জড়িয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। এদিকে ছাঁদে পা ঝুলিয়ে বসে আছে ইশান। বাড়ি এখন প্রায় খালি, নিকট আত্নীয় কেউ না থাকায় বিয়ে শেষেই সবাই চলে গেছে। ইশানের চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। কথা গিয়ে নিঃশব্দে ইশানের পাশে পা ঝুলিয়ে বসে পড়লো।

ইশান কথার দিকে না তাকিয়েই বললো, জানো কথা, ভাইয়া যেদিন আপুকে নিয়ে ইউকে চলে গিয়েছিলো সেদিনও আমার খুব কষ্ট হয়েছিলো। চিৎকার করে কেঁদেছিলাম ভাইয়া আর আপু চলে যাওয়ার পর। অনেকগুলো বছর পর যখন দুজনেই ফিরে এলো তখন আমার মনে হয় সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলাম আমি। আপুটা আজ আবার আমাদের ছেড়ে অন্যের বাড়ি চলে গেলো। সেবার তো ফিরে এসেছিলো কিন্তু এখন ফিরে আসবে না আর কখনো। আসবে দু’এক দিনের জন্য অতিথি হয়ে।

কথাগুলো বলতে বলতে ইশানের চোখ থেকে টপটপ পানি পরতে লাগলো। কথা আলতো হাতে ইশানের চোখের পানি মুছে দিলো। ইশান মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকালো কথার দিকে। সেই দৃষ্টি কথার বুকে বিধলো তীরের মতো। ইশান আর কথা চুপচাপ বসে রইলো ছাঁদে পা ঝুলিয়ে। ইশানের চোখ থেকে মাঝে মাঝে পানির কণা গড়িয়ে পরছে।

৪৬.
ফুলে সাজানো বেডে ফুল পরীর মতো বসে আছে ইয়ানা। নিজেকে এই মুহূর্তে অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে ইয়ানার কাছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিও মনে হয় শুকিয়ে গেছে। এখন কাঁদলে শুধু চোখ জ্বালা করে পানি বের হয় না। রুমটা তার পছন্দের রজনীগন্ধা দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। ফুলের গন্ধে মনে হচ্ছে কোনো বাগানে বসে আছে সে। দরজা খোলার শব্দেও ইয়ানার কোনো হেলদোল হলো না। রেহান দ্রুত পায়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো সেটা ভালোই বুঝতে পারলো ইয়ানা। রেহান ইয়ানার হাত ধরে হেঁচকা টানে বেড থেমে নামিয়ে ফেললে ইয়ানা অবাক চোখে তাকালো রেহানের দিকে। হঠাৎ হেঁচকা টান দেওয়ায় মাথার ঘোমটা সরে গেছে। ইয়ানা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রেহানের রাগী চেহারা।

চলবে,,,,