তিথি – ৫
কতক্ষণ ঘোরের ভিতরই ছিল তিথি। এমন নিঁখুতভাবে ওকে এঁকেছে হাসিব, তার উপরে গালের রঙগুলো, পুরো সাদাকালো তিথিকেই যেন রঙে রঙিন করে দিয়েছে। শিল্পির চোখ একেই বলে! অল্প একটু দেখাতেই, মনের ক্যামেরায় পুরোপুরি ধারণ করে ফেলেছে দৃশ্যটা। কালিতে আঁকা, কিন্তু চড়া রোদের আলো-ছায়াও ছবিতে স্পষ্ট। তিথি পাহাড়ি খরস্রোতা নদীর মতো, শুধু বাঁক আর বাঁক, ঘুরানো-প্যাচানো, এই রাত তো এই সালোক সকাল! কিন্তু গভীরতা নেই, গোপনীয়তা নেই – নেই কোনো রহস্যময়তা। আশ্চর্যজনকভাবে হাসিবের আঁকা তিথির সারামুখে আলো আঁধারি রহস্য, চোখে সেই ছাদের ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার পরের মূহুর্তটা আটকে আছে – একটু ভয়, একটু বিষাদ, হাসিবের জন্য খানিকটা করুণা। আঁকানো চোখেই পড়ে নেওয়া যাচ্ছে সবটা। এমন ব্রিলিয়ান্ট শিল্পি হাসিব, তিথি শুধু অবাকই হয়নি, বিস্মিত, হতবাক, হতভম্ব হয়ে গিয়েছে!
তিথির গণ্ডিটা অনেক ছোট, পরিবারের বাইরে দুঘর প্রতিবেশি আর দুটো-পাঁচটা মেয়ে বন্ধু। তাদের পরিবার। সেইসব চেনাজানা মানুষগুলো ছাপোষা। খালেক সাহেবের মতো চাকুরে নইলে ব্যবসায়ী। কেউ কেউ হয়তো একটু আধটু গান করে। কেউ আবার হয়তো শখের কবি। কিন্তু এমন প্রফেশনাল আর্টিস্ট এর দেখা কখনোই পায়নি আগে কখনো। শুধু কালিতে এমন জীবন্ত করে মানুষের মুখ আঁকা যায় এ তিথির ভাবনারও বাইরে। স্কুলে টুকটাক ছবি এঁকেছে তিথি নিজেই, তাতে রঙ চড়িয়েছে।
আঁকা ছবি বলতেই তিথির মাথায় আসে ‘জাতীয় পতাকা’, ‘একটি গ্রামের দৃশ্য’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ আর নইলে জয়নুল আবেদীনের কাক, গরু আর ডাস্টবিনের ছবিগুলো!
হাসিবের আঁকা এই ছবিটায় মনে হয় প্রাণ আছে। ওর সামনের ক্যানভাসের তিথিটা একদম জ্যান্ত। একটু আঙুল ছুঁইয়ে, ম্যাজিক করে রঙ ছড়িয়ে দিলেই প্রাণ পাবে নির্জিব কাগুজে তিথি আর কলকল করে কথা বলে উঠবে, কথা বলতে বলতে বাড়ি মাথায় তুলবে!
*****
ইনস্ট্যান্ট স্যুপ বানিয়েছে তিথি। নামেই স্যুপ, কর্ণফ্লাওয়ার আর কিছু মশলার ফ্লেভার মেশানো ঘন তরল। ঘুমাতে যাওয়ার আগে তিথির হালকা খিদে খিদে লাগে। তখন টুকটাক কিছু মুখে দিতে হয়। শিরিন কিছু না কিছুর যোগাড় রাখে সবসময়ই। ফ্রিজ খুললেই দুটো মিষ্টি, একটুকরো কেক, নইলে আস্ত পুডিং, আইসক্রিমের খালি বক্সে পোরা নুডলস, অল্প মাংসে রান্না করা তেহারি নইলে রুটি আর কলা – কিছু না কিছু আছেই। বিস্কিট আর ফল তিথির দুচোখের বিষ! কলা আর আম ছাড়া অন্য কোনো ফল ওকে দিয়ে গেলানো যায় না। এর পেছনে ওর কড়া যুক্তি আছে। তিথি বলে, ‘কেউ একবার আমের স্বাদ পেলে, অন্য কোনো ফল মুখে রোচে কীভাবে?’
বিস্কিট খেলেও শিরিনের ঝামেলা একটু কমত! তিনবেলার খাবার ছাড়াও তিথির এই মধ্যরাতের খানাপিনার আয়োজন থেকে রক্ষা পেতেন।
রামিম ঘুমিয়ে যাওয়ার পর পুরো ঘর ঠান্ডা। রায়নাও ঘুমিয়ে পড়েছে। আর হেলাল ভাইও বিছানায় পিঠ লাগানোর সাথে সাথে নাক ডাকতে শুরু করে। পুরো ফ্ল্যাটে তিথি একা জেগে আছে। মধ্যরাত। রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে থেকে ফেসবুকের নিউজ ফিড স্ক্রোল করা ওর জন্য নরমাল। কোনোদিন দুইটার ভিতর ঘুম এসে গেলেই তাড়াতাড়ি ঘুম এলো মনে হয়। রায়নার বাসায় আসার পর থেকে এটা বেড়েছে। সাধারণত বিছানা বদল, জায়গা বদল হলে মানুষের ঘুম আসতে চায় না কিন্তু তিথির হয়েছে উলটো। বারোটার আশেপাশে ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে না ঘুরতেই ওর চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসতে চায়। চোখ টেনে টেনে রেখেও ঘুম এড়ানো যায় না। সেটা হয়তো এই বাড়িটা অনেক নিরিবিলি বলে। মেইন রাস্তা ছেড়ে গলিপথে অনেকটা হাঁটতে হয়। চার পাঁচ মিনিটের মতো। আশেপাশে বাড়িঘর কম। নতুন নতুন এপার্টমেন্ট উঠছে। মাথা উঁচু করেনি তারা এখনো। এই বাড়িটা আটতলা আর সামনের, একেবারে মুখোমুখি বাড়িটা নয়তলা। আর সব টিনের ছাপড়া বাড়ি। সামনে ওয়াসার পানির পাম্প। একটা মুদিদোকান। রাতের রাস্তা, একেবারেই ফাঁকা, পথচারীর দেখা নেই। নেড়ি কুকুরগুলো থেকে থেকে খেউখেউ করে উঠছে। পৌষের শেষ দিনগুলোর ভারী কুয়াশা রাস্তার আলো ঘিরে রেখেছে। সেই আলো বেশিদূর পৌঁছাতে পারছে না। কোথাও আলো কোথাও জমাটবাঁধা ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঠিক যেমন করে তিথির ছবিটাকে এঁকেছে হাসিব তেমন!
গরম স্যুপের বোলটা নিয়ে জানালার ধারে বসল তিথি। খাটের পাশেই বড় জানালা। জানালা খুলে দিলো। সামনে কোনো বড় বিল্ডিং নেই বলে বাতাস আটকে গেল না। ফুরফুর করে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে ঘর ভরে গেল। একচামচ স্যুপ মুখে দিয়ে কোঁত করে গিলে ফেলে মুখ বিকৃত করল ও। কর্ন স্যুপ ওর ভালো লাগে না। থাই ফ্লেভারটা মজা। আর কিছু পায়নি বলে এটা দিয়েই লেটনাইট স্ন্যাকস এর কাজ চালাতে চেয়েছিল। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে গরম স্যুপে চুমুক দেওয়ার অনেক মজা। ওরা যখন ছোট ছিল, দুপুরের খাবার দিতে সবসময়ই শিরিন দেরি করত। নিজের কাজ গুছিয়ে, গোসল, নামাজের পার্ট শেষ করে তবেই সবাইকে নিয়ে খেতে বসত। কোনো কোনোদিন সেটা তিনটে-চারটে অবধি গড়াত। ততক্ষণে তিথি, রায়না, আতিক তো খিদেয় নাকাল। শিরিন একটার দিকে রান্না হওয়া ভাতের মাড়টা নিতেন। তাতে সামান্য লবণ আর গোলমরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে স্যুপের নাম করে পরিবেশন করতেন ওদের।
এইসব ভুংভাং জিনিসের চাইতেও সেই ফ্যানের স্বাদ ছিল কত ভালো, তিথি বিড়বিড় করল মনে মনে। একটু টমেটো কেচাপ ঢেলে নিলেও হতো, স্বাদটা চেঞ্জ হতো কিন্তু রায়নার রান্নাঘর পুরোপুরি গোছগাছ হয়নি এখনো। ওর ভিতরে কিছু খুঁজে পাওয়া অসাধ্য তিথির জন্য।
ও পঁচা স্বাদের স্যুপ গিলতে গিলতে হাসিবকে ভাবতে থাকল। কী দারুণ মানুষ! হেনার মতো না একেবারেই আবার হেলালের মতোও না। হেলাল অনেকটা স্থুল আবেগের মানুষ। রায়নাকে সে খুবই ভালোবাসে আর সেই ভালোবাসা উৎকটভাবে সবার সামনে প্রকাশ করে। আর হাসিবের চোখের দিকে তাকালে ধোঁয়াশা দেখে তিথি। কিছুই পড়া যায় না সেই চোখের ভাষা থেকে, বোঝাও যায় না কিছু। অথচ কী সরল আর উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ!
সারা সন্ধ্যা হাসিব ক্রেয়ন আর কালার পেপার নিয়ে হুটোপুটি করেছে রামিমের সাথে। রামিম তো নানান রঙের ক্রেয়ন দেখেই হামলে উঠেছিল। সবগুলো নিয়ে ওর হাতের মুঠোয় পোরা চাইই চাই। কিন্তু ওইটুকু হাত নিয়ে এঁতে উঠতে পারছিল না, হাত গলে বেরিয়ে যাচ্ছিল। তাতেই কেঁদে উঠছিল! হাসিবের কাছে কত কত মাস্টারপিস পেইন্টিঙের রেপ্লিকার এলবাম দেখল তিথি। নাম শুনল কত কত আর্টিস্টের! ভ্যান গঁগ, পাবলো পিকাসো, বাঁতিচেল্লি, ফ্রিদা কাহলো, মাইকেল এঞ্জেলো, সালভাদর ডালি! এবস্ট্রাকট আর্ট দেখল। জ্যাকসন পোলোকের আঁকা ছবিগুলো গুগল করে দেখালো হাসিব তিথিকে। তিথি কিছুই বুঝল না ছবিগুলোর। একটার নাম দ্যা ডিপ। কেন ডিপ, কী আছে ছবিতে, কী বুঝাচ্ছে বুঝতে না পেরে তিথি নিজেকে আনাড়ি ভেবে লজ্জা পেয়েছিল। পরে হাসিব বুঝিয়ে দিয়েছিল, কিছু না বোঝাটাই নাকি এবস্ট্রাকট পেইন্টিং এর সার্থকতা! একেকজন একেকটা অর্থ ধরে নেবে, নিজের মনের গোপন কথার প্রতিফলন হবে পেইন্টিঙের নানান রঙের শেডে!
আরশাদের সাথে বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হয়েছিল তিথির। সেইভাবেই মেলামেশাও হয়েছিল। দুবার খুব কাছে এসেছিল আরশাদ, তিথির হাতটা মুঠোয় নিয়ে ঠোঁট ছুঁইয়েছিল হাতের উল্টোপিঠে। একটা শিরশিরানি বোধ জেগেছিল তিথির, একটা ভালো লাগা। অত্যন্ত সুদর্শন, সুপুরুষ আরশাদকে ভালো লেগেছিল তিথির কিন্তু হাসিবের প্রতি মুগ্ধতা কাজ করছে, অপার মুগ্ধতা!
*****
রায়নার সাথে শপিংয়ে আসা খুবই বিরক্তিকর। যেকোনো জিনিসের জন্য মার্কেটের সবগুলো দোকান ঘুরবে, সে বিশটা হোক বা পঞ্চাশটা। সবগুলো দোকান ঘুরে ঘুরে কিনবে কিন্তু সেই প্রথম দোকানটা থেকেই! তারচেয়ে দুঃখের কথা নিজে পছন্দ করে, ঘুরে ঘুরে, দামাদামি করে কেনা সেই জিনিসটাই বাসায় এসে আর কিছুতেই ওর পছন্দ হবে না। ও তখন তিথিকে আবার পাঠাবে সেই জিনিসটা পালটে আনতে। আবার একই জামার যদি ভিন্ন দুটো রঙ আনা হয় দুইবোনের জন্য, রায়না হয়তো নিজের জামাটা নিজেই পছন্দ করবে তবুও বাসায় ফিরে তিথির জামার রঙটাই ওর বেশি পছন্দ হবে আর তিথিও নিজেরটা কিছুতেই ওকে দেবে না। এই নিয়ে কতদিন মারামারি অবদি গেছে ঘটনা। বাধ্য হয়ে শিরিন একই রঙের জামা কিনতেন সেখানেও রায়নার আপত্তি, তিথির অবয়ব সুন্দর, সব রঙেই তাকে মানায় কিন্তু ওর একটু মোটার ধাত, বেশ নাদুসনুদুস শরীর, যা তিথিকে মানায় তা কিছুতেই রায়নাকে মানায় না। মোটের উপর কোনোকিছুই রায়না পছন্দ করে উঠতে পারে না। ডিসিশন নিয়ে উঠতে পারে না ঠিকঠাক। আর তিথি একেবারে স্ট্রেইট। পছন্দ-অপছন্দ, করণীয়টা খুব সহজেই বুঝে নিতে পারে। আর একথাও সত্যি পছন্দের বেলায় তিথিকে খুব বেশি খাটতে হয় না। ওর দেহপল্লব অনিন্দ্যসুন্দর। সিনেমার নায়িকাদের মতো মাপা মাপা দেহের খাঁজগুলো। ছিপছিপে শরীরের কোথাও অতিরিক্ত নেই, কোথাও কমতি নেই। আকর্ষণীয় গঠনের ফিগার, ফলে যাই পরে না কেন, যে রঙেই সাজুক না কেন খুব সহজেই মানিয়ে যায়। রায়না হিংসে করে বলে আলুর শরীর। আলু যেমন সব মাছের সাথে, সব তরকারিতে এমনকি ভর্তা,ভাজিতেও মানিয়ে যায় তেমনি তিথি সব পোশাকেই অপ্সরা হয়ে যায়!
নিজের জন্য কাপড় কিনতে গেলে ওকে প্রচুর ঘাটাঘাটি করতে হয়, সবকিছুতো ওকে মানায় না এই কারণ দর্শিয়ে। তিথি ক্ষেপে যায় এই কথা শুনলে। ও জানে রায়না শুধু পোশাক না সবকিছুতেই খুঁতখুঁত করে, বাছাবাছি করে আর দামাদামি তো আছেই। বার্গেইনিংয়ের ওস্তাদ মনে করে ও নিজেকে। বিক্রেতা যে দাম বলে তার ঠিক চার ভাগের এক ভাগ দাম বলে। দোকানী সেই দামে দিতে না চাইলে, বেরিয়ে আসার ভান করে। অনেক সময় দোকানী পিছন থেকে ডাকে না আবার অনেক সময় ডেকে রায়নার বলা দামেই দিয়ে দেয়। তাতে কিন্তু রায়নার তৃপ্তি হয় না। ওর মনে হতে থাকে ও মনে হয় দামটা বেশি বলে ফেলেছে তাই বিক্রেতা দিয়ে দিয়েছে। আরেকটু কম দাম বলা উচিত ছিল!
এসব নানাকারণে তিথি রায়নার সাথে শপিংয়ে আসতে নিমরাজি থাকে। আজকে তো আরো ইচ্ছে করছে না। তার কারণ হাসিব। তিথির শরীর চঞ্চল কিন্তু মনটা বরাবরই শান্ত। একের পর এক বিয়ে ভাঙায় আরও শান্ত হয়ে গেছে। সেই শান্ত নদীতে মৃদুমন্দ ঢেউয়ের পাল তুলেছে হাসিব। রায়নার বাসায় এসেছে পাঁচদিন। গত দুটো দিন হাসিব শুধু তিথির ছবি এঁকেছে। ভোরের সূর্যকে পেছনে রেখে, বিকেলের কনে দেখা আলোর মাঝে, সন্ধ্যের আলো আঁধারিতে কিংবা শীতের রাতে কুয়াশার মাঝে খোলা ছাদে স্পটলাইটের আলোর ছটায়! নানান রঙের তিথি আর নানান ঢঙের তিথিতে স্ক্র্যাপবুক ভরে গেছে। জলরঙের তিথি, ক্যানভাসে এক্রিলিক ছুঁইয়ে তিথি, অয়েল পেইন্টিং, মিনিয়েচার সবখানে তিথি। কয়েকটা ঘন্টা দিনে হাসিবের সামনে বসে থাকা, দাঁড়িয়ে থাকা। হাসিব ছবিতে মগ্ন, কিন্তু তিথি তো তা না! তিথি কেঁপে কেঁপে উঠেছে হাসিবের হাতের তুলির প্রতিটা স্ট্রোকে, পেন্সিলের প্রতিটা আঁচড়ে!
ঘুমভাঙা রাঙাচোখে, বাসি কাপড়ে, এলোচুলে, হাই তুলতে থাকা তিথিরও একটা ছবি এঁকেছে হাসিব। সেই ছবিটা কেড়ে নেওয়ার জন্য তিথি অনেকটা সময় গাল ফুলিয়ে ছিল। ওর মান ভাঙাতে হাসিব ছবিটা দিয়ে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু নিষেধ করেছিল ছবিটা নষ্ট করতে।
—- ‘এহ’
করে মুখ ভেংচালেও অসুন্দর মূহুর্তের ছবিটা তিথি ফেলে দেয়নি, যত্ন করে রেখেছে নিজের কাপড়ের ভাঁজে!
হাসিবের হাতে আঁকা ছবি হতে ওর প্রাণ আঁইঢাই করছে। রায়নাকে তাড়া দিতে দিতে সন্ধ্যের আগে আগে বাসায় ফিরল ওরা। রায়না এমনিতেও ওর ওপর রেগে আছে। ওকে এনেছে রামিমকে সময় দেওয়ার জন্য, নিজে দুটো গল্প করার জন্য কিন্তু ওর দেখাই পাচ্ছে না দুইদিন ধরে। তার উপর আজ কিছু কিনতেও দিলো না ঠান্ডা হয়ে। শুধু অস্থির অস্থির। এই অস্থিরতা একেবারেই ভালো লাগছে না রায়নার। বেড়াতে এসেছে বলে কিছু বলেনি তিথিকে তবে বেশি বাড়াবাড়ি দেখলে ঠিক বকবে। হাসিবের সাথে এতো মেলামেশার একেবারেই দরকার নেই। নিজের শাশুড়িকে ভালোমতো চেনে ও। পানের থেকে চুন খসলে, নিজের ছেলের দোষ দেখবেন না, সবটা তিথির মাথার উপর দিয়ে যাবে! আর আত্মিয়তার ভিতর সম্পর্ক হওয়া ভালোও না! রায়না চায় না একেবারেই। তিথিকেই শাসন করতে হবে।
তিথি কোনোরকমে কাপড়চোপড় ছেড়েই দৌঁড় দিলো হাসিবের ফ্ল্যাটে। ওকে যেন নেশায় পেয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রায়না। তাড়াহুড়োয়ও চোখে কাজল টানতে, কপালে টিপের ফোঁটা দিতে ভুল হয়নি তিথির!
হাসিব ইজেলে ক্যানভাস সেট করে, কালার প্যালেটে নতুন রঙ গুলিয়ে বসে আছে চুপচাপ। নতুন ছবির প্রতীক্ষায় আছে। বসার ভঙিটাও বিষন্ন। দুইহাঁটু বুকের কাছে এনে, হাতদিয়ে হাঁটুদুটো জড়িয়ে রেখেছে! তিথির চঞ্চল পায়ের আওয়াজে মুখে তুলে তাকিয়ে মৃদু হাসল। তিথি ভেবেছিল রেগে আছে হাসিব, তাতো নয়ই বরং অমায়িক দেখালো ওকে। উঠে দাঁড়িয়ে আবার হাসলো, — ‘ভালো আছ, তিথি? তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। কফি খাবে? ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে।’ বলেই ফ্লাস্ক থেকে বড় এক মগ কফি ঢেলে তিথির হাতে ধরিয়ে দিলো। বড্ড তাড়া যেন ওর৷ তিথির উত্তর শোনার অপেক্ষা নেই।
—- ‘কাল তো তুমি চলে যাবে, আজকে একটা স্পেশাল ছবি আঁকব তোমার।’
রিমোটের বাটন টিপে মিউজিক প্লেয়ার অন করে দিলো। আগে থেকে গান সেট করা আছে। হালকা ভলিউমে বেজে উঠল
“Let me say that since
Since we’ve been together
Loving you forever
Is all I need
Let me be the one you come running to
I’ll never be untrue.”
তিথির মাতাল মাতাল লাগতে লাগল। হাসিবের ঘরে গদি আঁটা দুটো বেতের মোড়া আছে। সেগুলো টেনে এনে ঘরের কোনায় রেখে একটাতে নিজে বসল, আরেকটাতে তিথির হাত ধরে বসালো।
তিথিকে মুগ্ধ করে মিউজিক প্লেয়ারে বেজে চলেছে
“Let’s, let’s stay together
Loving you whether, whether
Times are good or bad, happy or sad”
আবেশে মাথা ঝিমঝিম করতে থাকল তিথির।
একটা এলবাম বের করল হাসিব। সেটা খুলতে খুলতে বলল,
—- ‘তিথি, সব আর্টিস্টের বিশেষ কেউ থাকে যাদের ছবি মনের মাধুরী মিশিয়ে শিল্পি এঁকে চলে তার ভুবনে। সব শিল্পিই আজীবন খোঁজ করে কাঙ্ক্ষিত সেই মডেলের। আমার মনে হচ্ছে তাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। শুধু একটা বিশেষ ছবি আঁকার বাকি আছে। তুমি দেখবে আমি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাব।’
তিথি অবাক হয়ে তাকিয়ে শুনতে থাকে। হাসিবের স্বর গাঢ় হয়,
—- ‘তিথি, আদি অনাদিকাল থেকে শিল্পসাহিত্যে নারীশরীর খুব আকর্ষণীয়। স্রষ্টার শৈল্পিক এই সৃষ্টিকে কবিরা, গল্পকাররা, গীতিকাররা, আঁকিয়েরা, ভাস্কররা নানারূপে আবিস্কার করে বারবার! তাতেও মুগ্ধতা কমে না, সৌন্দর্যের রহস্যের কমতি হয় না। তল খুঁজে পায় না এর গভীরতার, হার মানে এর ঢেউয়ের উন্মত্ততায়। তবু এর রহস্য উন্মোচনে কারও চেষ্টার কমতি নেই। নগ্নতাকে শিল্পি বারেবারে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে এমন বহু উদাহরণ আছে। দেখো…. ‘
এলবামটা খুলে একটা একটা পাতা উলটে যায় হাসিব, ‘দি বার্থ অফ ভেনাস’ ‘ গ্রান্ড ওডেলিস্ক’ ‘থ্রি গ্রেসেজ’… এরপরে হাসিবের আঁকা পেন্সিলস্কেচ – কোনোটা শুধু পেন্সিলের আঁচড়, কোনোটা রঙতুলিতে পূর্নাঙ্গ নারীদেহ! কয়েকশ ছবি।
— ‘এরকম একটা ছবি চাই আমি তোমার।’
তিথির ঘোর কাটল। নিজেকে খুব অসহায় অবস্থায় আবিষ্কার করল,
—- ‘কিন্তু আমি কেন এই ছবির মডেল হবো?’
— ‘একবার ভেবে দেখো, তিথি, সব গোঁড়ামি বাদ দিয়ে উদার হও, তোমার সত্যিকারের বাঁধন তো কেউ নেই। এতো নিঁখুত শরীর তোমার, আমি যদি ঠিকঠাক ফুঁটিয়ে তুলতে পারি, আমার সাথে সাথে তুমিও বিখ্যাত হয়ে যাবে। মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাবে। কত ডিমান্ড জানো, ন্যুড মডেলের?’
মরিয়া হয়ে বলল হাসিব।
ঘৃণায় তিথির শরীরটা রিরি করে উঠল। রাগে, আতঙ্কে কাঁপতে থাকল ও,
—- ‘অসম্ভব, আমি কিছুতেও আপনার ছবির মডেল হবো না।’
হাসিব হাসল। অপ্রকৃতস্থ হাসি,
—- ‘তিথিরানি, আমার ছবির মডেল তো তুমি অনেকক্ষণ। শুধু এই একটা ক্যানভাসই ফাঁকা আছে। তোমার না বলার অপেক্ষায় তো আমি নেই।’
তিথি তাকিয়ে দেখলো, এ এক অসুস্থ উন্মাদের দৃষ্টি। এই ঘোলা চোখের দৃষ্টি ও বারবারই দেখেছে, কিন্তু পড়তে পারেনি। ওর চোখে রঙের চশমা চোখে এঁটে দিয়েছিল হাসিব। সত্যিটা ওকে দেখতে দেয়নি। ফাঁদে পড়া পাখির মতো তড়পাতে থাকল তিথি। মাথা ঘুরে গেলো, শরীর নিস্তেজ মনে হতে লাগল।
অশরীরী ভয়ের চুড়োয় উঠে তোতলাতে তোতলাতে বলল,
—- ‘কফিতে কি মিশিয়েছিলেন আপনি?’
হাসিব আবারও বড় মধুর করে হাসল!
চলবে…
আফসানা আশা