তিথি পর্ব-১০

0
357

তিথি – ১০

লিফট থেকে বের হয়ে পাঁচতলার একটা ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আশিক, পেছনে তিথি আর এই বিল্ডিংয়েরই আরও সাতজন। সাথে কেয়ারটেকার, গার্ডও আছে। রাগে আশিকের মেজাজ সপ্তম আসমানে বসে আছে। হাত কাঁপছে সমানে। কী করবে আর কী করবে না ভেবে না পেয়ে জ্যাকেটের নিচের দিকটা একবার রোল করে গুটিয়ে নিচ্ছে আবার খুলে দিচ্ছে।
তিথিও শঙ্কিত। না জানি আবার কোন নাটকের ভিতর দিতে যেতে হয়। এমনিতেই গত কয়েকদিন ওর নিস্তরঙ্গ জীবন ঝড়ো হাওয়ার মুখে পড়ে আছে আর আজকের দিনটা তো উত্তেজনায় সুনামি বইয়ে দিয়েছে। শরীর মন ক্লান্তিতে একটু বসতে চাইছে। হালকা হাওয়ায় বারান্দায় বসে, আদা-লবঙ্গ-তেজপাতা দিয়ে জ্বাল করা পানিতে একটা টিব্যাগ ফেলে দিয়ে আয়েশ করতে ইচ্ছে করছে। আগুন গরম চা মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে ফেলবে নিমেষেই আর হালকা ইলেক্ট্রিক শকের মতো একটা ঝাঁড়া খাবে শরীর জুড়ে। ব্যস চাঙা হয়ে যাবে সাথে সাথেই।
ঘরটাতে ঢুকেই অবাক হলো তিথি। হালকা সব ফার্নিচারে মেয়েলি সূক্ষ্ম রুচির ছাপ স্পষ্ট কিন্তু অগোছালো সবকিছুই। সোফার কুশন জায়গায় নেই, ফুলদানিতে বহুদিন ধরে ফেলে রাখা ফুল পঁচছে, পর্দাগুলো রিঙ ছেড়ে একটা গিট্টু দিয়ে স্ট্যান্ডের উপর উঠিয়ে রাখা, বুকশেলফ, ট্রফিশেলফ, শোকেস, ফার্নিচার সবকিছুতে এক ইঞ্চি ধূলা, চায়ের কাপ পড়ে আছে, বই ছড়িয়ে আছে, বুকশেলফ এর কাচটাও খোলা পড়ে আছে, মাথার উপরে ময়লা সিলিং ফ্যান, পায়ের নিচে ময়লা কার্পেট পাতানো। জায়গায় জায়গায় মাকড়সার জাল। হয় বাড়ির মহিলা অসুস্থ না হলে অনুপস্থিত।
তিথির ভাবনাটা একেবারেই সঠিক। দীর্ঘদিন এই বাসাটা মেয়েলি স্পর্শ বিবর্জিত। ঘরের কর্ত্রী পাঁচ বছর আগে ঘর ছেড়েছেন ঝগড়া করে।
আশরাফুজ্জামান, বয়স ছাপ্পান্ন, আর্মি অফিসার ছিলেন। এখন অখণ্ড অবসর। অবসরে তার একটাই প্রিয় কাজ যেটাকে কর্তব্য হিসেবে নিয়ে নিয়েছেন তা হলো আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশির কাছে স্ত্রী রেহনুমার বিষোদগার করা আর সন্তানদের কাছে মায়ের নামে নিন্দেমন্দ করে তাদেরকে মায়ের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা। স্ত্রী রেহনুমা সুলতানা। একটা নামকরা ইংরেজি স্কুলের ডাকসাইটে শিক্ষিকা। আশরাফ সাহেবের সাথে আনঅফিসিয়াল সেপারেশনে আছেন গত পাঁচ বছর ধরে। কার্যত স্বামীর নাম মুখে আনেন না তবে আশরাফ সাহেবের প্রতিটি কাজ, ভালো-মন্দ বিচার না করেই বিরুদ্ধাচারণ করেন।
এই সাবেক সম্পর্কের দম্পতির তিন ছেলে। বড় ছেলে আশফি, মেজ ছেলে আরাফ আর ছোটজন আশিক। বড়ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে পালিয়েছে পিতামাতার সংসার নামের রণক্ষেত্র থেকে! রণক্ষেত্রই বটে, সবসময়ই বাবা মায়ের তীব্র বাক্যবাণ, ঢাল-তলোয়ারের মতো ঝনঝন করে বাজতেই থাকত, রাত নেই দিন নেই, যত দিন তারা একসাথে ছিলেন। মেজজন মায়ের একটু কোলঘেঁষা, সম্প্রতি দেশের বাইরে থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে একটা চাকরি করছে আর মায়ের সাথেই থাকছে। ফলাফল আশরাফ সাহেব মেজপুত্রের মুখদর্শন করছেন না, আলাপ বন্ধ আছে। রইল বাকি আশিক, ছোটপুত্র। পড়াশোনা শেষ করেছে। একটা কনসালটেন্সি ফার্মে চাকরি করছে। তীব্র নারীবিদ্বেষী! যাবতীয় মেয়েসন্তানের জন্মের সুখবরে, ‘বংশের লালবাতি’ বলে কটাক্ষ করে, নারীরা অতিমাত্রায় ডমিনেটিং হয় বলে বিশ্বাস করে, সেই বিশ্বাসের পক্ষে প্রমাণ তো মা রেহনুমাই দিয়ে যান সর্বদা। আশিক অকারণ অসম্ভব ঘৃণা পোষণ করে সমগ্র নারীজাতির উপর। মেয়েদের সাথে কথা বলে না পারতপক্ষে, তাকায় না, বান্ধবি নেই এমনকি ঘরের কাজের জন্যও বারেক নামের একটা ছেলেকেই রাখা হয়েছে।

এই যখন অবস্থা তখন তিথিকান্ডে আশরাফ সাহেব যারপরনাই খুশি হলেন। এই আনন্দ তিথিকে পাওয়া বা ছোটপুত্রের বিবাহসংক্রান্ত আনন্দ আয়োজনের জন্য নয় মোটেও, বরং জাদরেল আর অবাধ্য স্ত্রীকে শায়েস্তা করার একটা দারুণ উপায় পাওয়া গেল বলে। ছেলের বিয়ের মতো ভয়াবহ গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে তার মায়ের কোনো ভূমিকা থাকবে না, রেহনুমাকে সদর্পে জানান দেওয়া যাবে যে, পুত্রের জীবনে তার মায়ের কোনো গুরুত্বই নেই, এটাই আশরাফ সাহেবের জীবনের বিরাট আনন্দের উপলক্ষ হয়ে গেল। তবে তিথি বলে নয় এখানে যদি তিথির বদলে অন্য কোনো মেয়ে এমনকি কোনো মধ্যবয়সী দুই বাচ্চার মাও থাকত তিনি এমনিই খুশি হতেন, বলাবাহুল্য!
রেহনুমাকে হারিয়ে দেওয়ায় আশরাফ সাহেবের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, সে যেকোনো উপায়েই হোক না কেন, যেকোনো বিনিময়মূল্য দিতে হোক না কেন, প্রয়োজনে নিজের নাক, কান বিসর্জন দিয়েও তিনি রেহনুমার শান্তির ঘুমে বিঘ্ন ঘটাবেন!

এদিকে আশিক তিথিকান্ডে ফেঁসে গিয়ে ভয়াবহ গাড্ডায় পড়ে গেল, যতই সে তিথিকে অস্বীকার করতে লাগল ততই আরও বেশি গর্তে ডুবে যেতে লাগল। তিথির অভাবনীয় নাটকে সবাই ততই বিশ্বাস করতে লাগল, বিয়ের প্রলোভন দিয়ে আশিক তিথির সারল্যের সব রকম সুযোগ তো নিয়েছেই এখন তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে সচেষ্ট। অসহায় তিথিকে এমন বিপদে দেখে, মেয়েদের নির্বুদ্ধিতা আর স্বাধীনতার বিপক্ষে যে যার মতো মতবাদ দিলো কিন্তু নিজের মেয়ের সাথে তিথিকে মিলিয়ে ফেলে সবার অবস্থানই হলো তিথির পক্ষে।

তিথি বেশ কেঁদেকেটে, খানিকটা নাক টেনে, কতকটা চোখের পানিতে শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে ঘটনা আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলল। অবলীলায় গল্প বলে গেল,
—- ‘এইজন্যই, এইজন্যই ও আমাকে কখনো ওর বাবা, মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় নি, বাড়িতে আনেনি, আমার বাড়িতেও কোনোদিন যায়নি। আমি ওর নাম ছাড়া কিছু জানি না। শুধু লিটনের ফ্ল্যাটে নিয়ে গেছে।’

— ‘কী? লিটনের ফ্ল্যাট কেন? আমার তিন চারটে বাড়ি আছে ঢাকা শহরে। মহিলা শকুনি গিলছে বসে বসে, তবুও আমার বৌমাকে নিয়ে কেন লিটনের ফ্ল্যাটে যেতে হবে?’
সেনাসুলভ হুংকার ছুঁড়লেন আশরাফ সাহেব।

— ‘আব্বা, শকুনি ফিমেল জেন্ডারই হয়। আর লিটনের ফ্ল্যাট কোনো বাসা নয়, রুমডেটের যেকোনো জায়গাকে কোড ল্যাঙ্গুয়েজে বলে লিটনের ফ্ল্যাট।’
বিরক্ত হলো আশিক। কিন্তু তারপরেই বুঝল, আশরাফ সাহেবের ভুল শুধরে দিতে গিয়ে ও আরও বেশি পাঁকে জড়িয়ে গেছে, তিথির মিথ্যেকেই সত্যি প্রমাণ করে ফেলেছে। নিজেকে বেক্কল শ্রেণির উপরের দিকের সদস্য মনে হলো আর চুপ হয়ে গেল!

— ‘দেখেছেন, আব্বা? কীভাবে বলল আপনার ছেলে? যখন প্রেম করেছে তখন এভাবেই ফুঁসলিয়ে ফাঁসলিয়ে আমার মতো কত নরম মনের মেয়েকে নিয়ে না রুমডেটে গেছে। আমি এখন কী করব? আমার বাবা আমাকে মেরেই ফেলবে। আমার বিয়ে দিচ্ছিল কত আনন্দ করে। কী সুন্দর গেইট সাজিয়েছিল। লাল লাল মরিচবাতি জ্বলছে আর নিভছে। জ্বলছে আর নিভছে। কী সুন্দর! আমার এক চাচাতো বোন এভাবে পালিয়ে গিয়েছিল তাকে খুঁজে বের করেছে আমার আব্বা, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে বাড়ি নিয়ে গিয়েছে। তারপরে কী করেছে জানেন?’

উৎসুক পরোপকারী মানুষগুলোর উৎসাহে ভাটা দিয়ে বলল,
—- ‘না, বলব না। এখন মুখে আনতেও আমার ভয় লাগছে। আহারে!’
কেঁদে ফেলল তিথি।

আশরাফ সাহেবের সিপাহিকঠিন চোখেও পানি এলো এলো ভাব, তিনি বলে উঠলেন,
—- ‘আহারে!’

— ‘কীসের আহারে? এই মেয়ে ডাকাতি করার জন্য এসেছে। খোঁজখবর নিয়েই এসেছে। বাসায় আমি আর বাবা ছাড়া কেউ থাকে না জেনেই ও এভাবে এসে ঘরে ঢুকতে চাইছে। আচ্ছা, আমাকে বিশ্বাস না করতে চাইলে কইরেন না, আমাকে শাস্তি দিতেই না হয় পুলিশ ডাকেন? ওর ফ্যামিলিতে ফোন দেন? দেখেন, ওর কোনো বিয়েটিয়ে হচ্ছিল, কি না? যা বলছে তার একবিন্দুও সত্যি না।’

রাত গভীর হচ্ছে। আশিকের এত কথার ভিতর টক করে একটা কথা তিথির মাথায় ঢুকে গেল। তা হলো এই বাড়িতে শুধুই আশিক আর ওর বাবা থাকে। দুজন পুরুষ মানুষ। বিপদজনক হতে পারে। রাস্তা থেকে শয়তানগুলোর হাত থেকে দৌঁড়ে বেঁচেছে, এই ঘরের ভেতরও তো সেই একই বিপদ ঘটতে পারে। সভ্য মানুষের মুখোশ পরেই তো ঘুরে বেড়ায় হাসিবের মতো বিকৃত মনের মানুষগুলো। তিথির গলা শুকিয়ে আসতে থাকল। এবারে পুলিশের আগমনপ্রত্যাশী হলো ও নিজেই। আসুক পুলিশ। ও এইবাসায় রাত্রিযাপন করবে সেটা রেকর্ড হয়ে থাকুক পুলিশের খাতায়। তবেই ওর ক্ষতি করার সাহস আর কারো হবে না।
তবে ততক্ষণে কারো মনেই তিথিকে নিয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। তবু আশিকের জোরাজুরিতে আশরাফ সাহেব তিথিকে জেরা করতে বসলেন নাটকিয় মেজাজে।
— ‘নাম কী?’
— ‘তিথি।’
— ‘পুরো নাম বলো।’
— ‘জান্নাতুল আদন।’
— ‘বাবার নাম?’
— ‘খালেক আহমেদ।’
— ‘আজকে বিয়ে ছিল তোমার?’
— ‘হ্যাঁ।’
— ‘হলো না কেন?’
— ‘আমি পালিয়েছি বলে।’
— ‘কেন পালিয়েছ?’
তিথি ইশারায় আশিককে দেখিয়ে দিলো।
আশরাফ সাহেব ফের জানতে চাইলেন,
— ‘ওকে চেনো তুমি?’
— ‘হ্যাঁ।’
— ‘কীভাবে?’
— ‘আমার সাথে ফোনে রঙ নাম্বারে পরিচয়। ফোনেই প্রেম হয় আমাদের। তারপর দেখা করি।’
— ‘ও তো বলছে, তোমাকে চেনে না?’
— ‘ও ভয় পেয়েছে। আমাকে বলেছে ওর বাবা নাকি খুব ভয়ংকর লোক। জল্লাদের মতো। ওর বাবা ছাড়া পরিবারে আর করো স্বাধীনতা নেই। স্ত্রী-সন্তান কারো কোনো দাম নেই। আমাদের প্রেমের কথা জানলে ওকে নাকি ত্যাজ্য করে দেবে।’

— ‘কী? আমার নামে এতোবড় মিথ্যে কথা? আমি জল্লাদ? আমি স্বাধীনতা দেই না?’
আশরাফ সাহেব ক্ষিপ্ত হলেন, চোখ গরম করে তাকালেন আশিকের দিকে।

— ‘বাবা, ওই মেয়েটা আমাকে ফাঁসাচ্ছে। ও ভালো করেই জানে সবকিছু আর সেই অনুযায়ী খেলছে।’

— ‘একটু আগে বললে, তুমি ওকে চেনো না। ও তোমাকে চেনে না৷ এখন বলছ ও জানে সবকিছু। না চিনলে জানল কীভাবে?’

আশিক বুঝল আবার ওর কথা ব্যাকফায়ার করেছে। চিকন করে বলার চেষ্টা করল,
—- ‘আমি ওকে চিনি না। কিন্তু ও তো সব খবর নিয়েই এসেছে।’

কেউ আর আশিকের কথাকে পাত্তা দিলো না।
এবারে তিথির কাছে ওর বাড়ির ফোন নাম্বার চাইলে তিথি একটু বিপদে পড়ল। তবুও একটা চান্স নিলো। — ‘আমি ফোন নাম্বার দিচ্ছি, আপনি যা জানার জেনে নিন, কিন্তু প্লিজ আমি কোথায় আছি জানাবেন না কাউকে। তাহলে আমাকেও ধরে নিয়ে যাবে। আর আশিককে ছাড়া আমি বাঁচব না। এখান থেকে কোথাও যাব না।’
চোখ ডলে কাঁদল তিথি। আশরাফ সাহেবের মায়া হলো। এমন একটা নরম মেয়ে! তার স্ত্রী রেহনুমার একেবারেই বিপরীত চরিত্র। ওইরকম দজ্জাল চরিত্রের মহিলারা রাজত্ব করে যায় কিন্তু এই মেয়েটা আশিকের চাকরানী হয়ে থাকবে বলে হাতেপায়ে ধরছে বারবার। পুত্রের স্ত্রীভাগ্যে ইর্ষা হলো আশরাফ সাহেবের। রাজকপাল আশিকের!

আশরাফ সাহেব নিজেই ফোন দিলেন তিথির দেওয়া নাম্বারে। কথা বললেন কিছুক্ষণ। উপস্থিত সবার মাঝে তখন টানটান উত্তেজনা। তিথিরও বুক কাঁপছে। মায়ের নাম্বার দিয়েছে তিথি। না জানি শিরিন কী বলবে? এবাড়ি থেকে যদি আজ কিছুতেই বেরোতে চায় না ও। শিরিন যদি নিতে আসে ওকে? আবার যদি আতিকের সাথে বিয়ে দিতে চায়? কুলে এসেই কি তরী ডুববে? ফিঙ্গারক্রস করে বসে রইল ও।

আশরাফ সাহেব বেশ নাটকিয়তা তৈরি করলেন, ফোন করলেন পাশের ঘরে গিয়ে। তারও চেয়ে বেশি নাটুকে স্বরে দুহাত মেলে বললেন,
—- ‘এই মেয়েটা যা বলেছে সব সত্যি বলেছে। ওর নাম তিথি। ওর আজ বিয়ে ছিল। ও বাড়ি থেকে পালিয়েছে। ওর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, মা ফিট হচ্ছে বারবার। ওদের এক প্রতিবেশী ফোন ধরেছিল।’

তিথি একটা ছোট শ্বাস ফেলে, ক্লান্ত মাথাটা টেনে সোজা হয়ে বসল। ওর হাঁসফাঁস লাগছে। বাবা তো অনেক আগে থেকেই অসুস্থ। আর মা! মায়ের জন্য মন কেমন করে উঠল ওর। তবুও ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলো মনে মনে, ভাগ্যিস ফোনটা মা ধরেনি! মনে সাহস এলো। আরও কিছুসময় নাটকটা চালানো যায়। ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
—- ‘কিচেনটা ওইদিকে তো? আমি যাই, সবার জন্য চা করে আনি। আমার মাথা ফেটে পড়ে যাচ্ছে, এখন চা না হলে আমি মরেই যাব।’
কারও অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে তিথি ভেতরে ঢুকে গেল।

আশিক তিড়িক করে লাফ দিয়ে উঠল,
—- ‘এটা একটা গ্রুপ। ডাকাতদল। সব এদের প্ল্যানিং। আপনারা এখনো বুঝতে পারছেন না? পুরোনো বাংলা ছবিও তো আছে একটা এরকম।’

— ‘বন্দিনী। রঞ্জিত মল্লিক আর মৌসুমি চ্যাটার্জির। আর তুমি সেটা মনে করিয়ে দিয়ে এই মেয়েটাকে অসহায় করে দিয়ে এখন ডাকাত সাজাতে চাইছ? স্টুপিড, তবে প্রেম কেন করেছিলে?’
আশরাফ সাহেব অকারণ হুংকার দিলেন।

— ‘বাবা, আমি কোনো প্রেমট্রেম করিনি। বিশ্বাস করো, আমি জীবনে এই মেয়েকে দেখিনি।’

বাপ ছেলের ডুয়েলে বাগড়া দিলো বাড়ির কেয়ারটেকার,
—- ‘স্যার, রাত দেড়টা বাজে। আপনারা ঝামেলা শেষ করেন। বাসাবাড়িতে এইরকম ঝামেলা করা ঠিক না। অন্যরা কমপ্লেইন দেয়। আশিক স্যার আর টালবাহানা কইরেন না। আপা সুন্দর অনেক। সিনেমার নায়িকাগো মতন। বোম্বের নায়িকাগো মতন সুন্দর। এমন সুন্দর মেয়ে আর পাইবেন না।’

রান্নাঘর তুমুল এলোমেলো। কাজের ছেলেটার সাহায্য নিয়ে সব খুঁজে খুঁজে সবার জন্য চা করে ট্রলি ট্রে ঠেলতে ঠেলতে তিথি যখন ড্রয়িংরুমে ঢুকল তখন সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে আজ রাতেই কাবিন করিয়ে দেওয়া হবে আশিক আর তিথির। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের এক ছাদের নিচে বিয়ের দলিল ছাড়া রাখাটা ঠিক হবে না কোনোভাবেই। এত রাতে কাজি কোথায় পাওয়া যাবে সেই চিন্তায় পড়ল না কেউ। সব বিয়েতেই এত বেশি ঝামেলা পাকে যে সেইসব মিটিয়ে বেশিরভাগ বিয়েই নাকি পড়ানো হয় রাতের শেষভাগে। এলাকার কাজি সাহেবকে ফোন করলেই চলে আসবে।

তিথি বিপদ টের পেলো। নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই পড়ে গেছে। এখন অস্বীকার করা মানে নিশ্চিত হাজতখানায় ঠিকানা হবে। আগুনগরম চায়ে চুমুক দিয়ে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেলল ও।

আশিকও তথৈবচ। ও নিরীহ ছেলে, তিথির পাতা ফাঁদে আটকে গেছে। যাই বলছে নিজেকে ডিফেন্ড করতে তাই ব্যাকফায়ার করছে। একটা মেয়ে আশিকের নাম ছাড়া কিছু জানে না তা কেউ খেয়ালই করছে না। নিজের বাবাই এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে এখন বিয়ে না করলে ‘বিয়ের আশ্বাস দিয়ে ধর্ষণের অপরাধে’ ওকে এখনই আজীবন কারাদণ্ড দিয়ে দেবে সবাই। আর লোক জানাজানিও বাড়ছে প্রতি মূহুর্তে। পাশের ফ্ল্যাট থেকে লোক এসে পড়েছে, নিচের থেকেও এসে জেনে গিয়েছে কী সমস্যা? কৌতুহলী মুখ বাড়ছেই।

আশরাফ সাহেবের উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। আনন্দেই আছেন তিনি। বেশ খোশমেজাজে আছেন। ছেলের বিয়ের ঝামেলা শেষ করে স্ত্রীকে ফোন দিয়ে জানাবেন কখন সেই চিন্তায় রয়েছেন। কীভাবে আর কতটা রঙ ছড়িয়ে ছেলের বিয়েতে নিজেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ আর রেহনুমাকে একেবারেই গুরুত্বহীন প্রমাণ করে দেবেন তাই ভেবে ভীষণ খুশি তিনি। স্ত্রীকে ফোন করেই তিনি তার কালেকশনের সেরা হুইস্কির বোতলটা নিয়ে বসবেন। একটা একটা শট নেবেন আর একটু একটু করে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবেন রেহনুমা নামের অতি দজ্জাল বদমহিলাটাকে!

চায়ে চুমুক দিয়ে আনন্দে চোখ বন্ধ করে ফেললেন তিনি। মেয়েটা চাও বানিয়েছে ভালো। রেহনুমার বানানো চা খেলে মনে হয় পেট্রোলে চিনি গুলিয়ে দিয়েছে। আর বারেক তো মিনারেল ওয়াটার গরম করে সামনে দেয়! চায়ের আসল স্বাদ ভুলতেই বসেছিলেন তিনি…

চলবে…
আফসানা আশা