তিথি পর্ব-১০

0
355

তিথি – ১০

লিফট থেকে বের হয়ে পাঁচতলার একটা ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আশিক, পেছনে তিথি আর এই বিল্ডিংয়েরই আরও সাতজন। সাথে কেয়ারটেকার, গার্ডও আছে। রাগে আশিকের মেজাজ সপ্তম আসমানে বসে আছে। হাত কাঁপছে সমানে। কী করবে আর কী করবে না ভেবে না পেয়ে জ্যাকেটের নিচের দিকটা একবার রোল করে গুটিয়ে নিচ্ছে আবার খুলে দিচ্ছে।

তিথিও শঙ্কিত। না জানি আবার কোন নাটকের ভিতর দিতে যেতে হয়। এমনিতেই গত কয়েকদিন ওর নিস্তরঙ্গ জীবন ঝড়ো হাওয়ার মুখে পড়ে আছে আর আজকের দিনটা তো উত্তেজনায় সুনামি বইয়ে দিয়েছে। শরীর মন ক্লান্তিতে একটু বসতে চাইছে। হালকা হাওয়ায় বারান্দায় বসে, আদা-লবঙ্গ-তেজপাতা দিয়ে জ্বাল করা পানিতে একটা টিব্যাগ ফেলে দিয়ে আয়েশ করতে ইচ্ছে করছে। আগুন গরম চা মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে ফেলবে নিমেষেই আর হালকা ইলেক্ট্রিক শকের মতো একটা ঝাঁড়া খাবে শরীর জুড়ে। ব্যস চাঙা হয়ে যাবে সাথে সাথেই।

ঘরটাতে ঢুকেই অবাক হলো তিথি। হালকা সব ফার্নিচারে মেয়েলি সূক্ষ্ম রুচির ছাপ স্পষ্ট কিন্তু অগোছালো সবকিছুই। সোফার কুশন জায়গায় নেই, ফুলদানিতে বহুদিন ধরে ফেলে রাখা ফুল পঁচছে, পর্দাগুলো রিঙ ছেড়ে একটা গিট্টু দিয়ে স্ট্যান্ডের উপর উঠিয়ে রাখা, বুকশেলফ, ট্রফিশেলফ, শোকেস, ফার্নিচার সবকিছুতে এক ইঞ্চি ধূলা, চায়ের কাপ পড়ে আছে, বই ছড়িয়ে আছে, বুকশেলফ এর কাচটাও খোলা পড়ে আছে, মাথার উপরে ময়লা সিলিং ফ্যান, পায়ের নিচে ময়লা কার্পেট পাতানো। জায়গায় জায়গায় মাকড়সার জাল। হয় বাড়ির মহিলা অসুস্থ না হলে অনুপস্থিত।

তিথির ভাবনাটা একেবারেই সঠিক। দীর্ঘদিন এই বাসাটা মেয়েলি স্পর্শ বিবর্জিত। ঘরের কর্ত্রী পাঁচ বছর আগে ঘর ছেড়েছেন ঝগড়া করে।

আশরাফুজ্জামান, বয়স ছাপ্পান্ন, আর্মি অফিসার ছিলেন। এখন অখণ্ড অবসর। অবসরে তার একটাই প্রিয় কাজ যেটাকে কর্তব্য হিসেবে নিয়ে নিয়েছেন তা হলো আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশির কাছে স্ত্রী রেহনুমার বিষোদগার করা আর সন্তানদের কাছে মায়ের নামে নিন্দেমন্দ করে তাদেরকে মায়ের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা। স্ত্রী রেহনুমা সুলতানা। একটা নামকরা ইংরেজি স্কুলের ডাকসাইটে শিক্ষিকা। আশরাফ সাহেবের সাথে আনঅফিসিয়াল সেপারেশনে আছেন গত পাঁচ বছর ধরে। কার্যত স্বামীর নাম মুখে আনেন না তবে আশরাফ সাহেবের প্রতিটি কাজ, ভালো-মন্দ বিচার না করেই বিরুদ্ধাচারণ করেন।

এই সাবেক সম্পর্কের দম্পতির তিন ছেলে। বড় ছেলে আশফি, মেজ ছেলে আরাফ আর ছোটজন আশিক। বড়ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে পালিয়েছে পিতামাতার সংসার নামের রণক্ষেত্র থেকে! রণক্ষেত্রই বটে, সবসময়ই বাবা মায়ের তীব্র বাক্যবাণ, ঢাল-তলোয়ারের মতো ঝনঝন করে বাজতেই থাকত, রাত নেই দিন নেই, যত দিন তারা একসাথে ছিলেন। মেজজন মায়ের একটু কোলঘেঁষা, সম্প্রতি দেশের বাইরে থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে একটা চাকরি করছে আর মায়ের সাথেই থাকছে। ফলাফল আশরাফ সাহেব মেজপুত্রের মুখদর্শন করছেন না, আলাপ বন্ধ আছে। রইল বাকি আশিক, ছোটপুত্র। পড়াশোনা শেষ করেছে। একটা কনসালটেন্সি ফার্মে চাকরি করছে। তীব্র নারীবিদ্বেষী! যাবতীয় মেয়েসন্তানের জন্মের সুখবরে, ‘বংশের লালবাতি’ বলে কটাক্ষ করে, নারীরা অতিমাত্রায় ডমিনেটিং হয় বলে বিশ্বাস করে, সেই বিশ্বাসের পক্ষে প্রমাণ তো মা রেহনুমাই দিয়ে যান সর্বদা। আশিক অকারণ অসম্ভব ঘৃণা পোষণ করে সমগ্র নারীজাতির উপর। মেয়েদের সাথে কথা বলে না পারতপক্ষে, তাকায় না, বান্ধবি নেই এমনকি ঘরের কাজের জন্যও বারেক নামের একটা ছেলেকেই রাখা হয়েছে।

এই যখন অবস্থা তখন তিথিকান্ডে আশরাফ সাহেব যারপরনাই খুশি হলেন। এই আনন্দ তিথিকে পাওয়া বা ছোটপুত্রের বিবাহসংক্রান্ত আনন্দ আয়োজনের জন্য নয় মোটেও, বরং জাদরেল আর অবাধ্য স্ত্রীকে শায়েস্তা করার একটা দারুণ উপায় পাওয়া গেল বলে। ছেলের বিয়ের মতো ভয়াবহ গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে তার মায়ের কোনো ভূমিকা থাকবে না, রেহনুমাকে সদর্পে জানান দেওয়া যাবে যে, পুত্রের জীবনে তার মায়ের কোনো গুরুত্বই নেই, এটাই আশরাফ সাহেবের জীবনের বিরাট আনন্দের উপলক্ষ হয়ে গেল। তবে তিথি বলে নয় এখানে যদি তিথির বদলে অন্য কোনো মেয়ে এমনকি কোনো মধ্যবয়সী দুই বাচ্চার মাও থাকত তিনি এমনিই খুশি হতেন, বলাবাহুল্য!

রেহনুমাকে হারিয়ে দেওয়ায় আশরাফ সাহেবের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, সে যেকোনো উপায়েই হোক না কেন, যেকোনো বিনিময়মূল্য দিতে হোক না কেন, প্রয়োজনে নিজের নাক, কান বিসর্জন দিয়েও তিনি রেহনুমার শান্তির ঘুমে বিঘ্ন ঘটাবেন!

এদিকে আশিক তিথিকান্ডে ফেঁসে গিয়ে ভয়াবহ গাড্ডায় পড়ে গেল, যতই সে তিথিকে অস্বীকার করতে লাগল ততই আরও বেশি গর্তে ডুবে যেতে লাগল। তিথির অভাবনীয় নাটকে সবাই ততই বিশ্বাস করতে লাগল, বিয়ের প্রলোভন দিয়ে আশিক তিথির সারল্যের সব রকম সুযোগ তো নিয়েছেই এখন তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে সচেষ্ট। অসহায় তিথিকে এমন বিপদে দেখে, মেয়েদের নির্বুদ্ধিতা আর স্বাধীনতার বিপক্ষে যে যার মতো মতবাদ দিলো কিন্তু নিজের মেয়ের সাথে তিথিকে মিলিয়ে ফেলে সবার অবস্থানই হলো তিথির পক্ষে।

তিথি বেশ কেঁদেকেটে, খানিকটা নাক টেনে, কতকটা চোখের পানিতে শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে ঘটনা আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলল। অবলীলায় গল্প বলে গেল,

—- ‘এইজন্যই, এইজন্যই ও আমাকে কখনো ওর বাবা, মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় নি, বাড়িতে আনেনি, আমার বাড়িতেও কোনোদিন যায়নি। আমি ওর নাম ছাড়া কিছু জানি না। শুধু লিটনের ফ্ল্যাটে নিয়ে গেছে।’

— ‘কী? লিটনের ফ্ল্যাট কেন? আমার তিন চারটে বাড়ি আছে ঢাকা শহরে। মহিলা শকুনি গিলছে বসে বসে, তবুও আমার বৌমাকে নিয়ে কেন লিটনের ফ্ল্যাটে যেতে হবে?’

সেনাসুলভ হুংকার ছুঁড়লেন আশরাফ সাহেব।

— ‘আব্বা, শকুনি ফিমেল জেন্ডারই হয়। আর লিটনের ফ্ল্যাট কোনো বাসা নয়, রুমডেটের যেকোনো জায়গাকে কোড ল্যাঙ্গুয়েজে বলে লিটনের ফ্ল্যাট।’

বিরক্ত হলো আশিক। কিন্তু তারপরেই বুঝল, আশরাফ সাহেবের ভুল শুধরে দিতে গিয়ে ও আরও বেশি পাঁকে জড়িয়ে গেছে, তিথির মিথ্যেকেই সত্যি প্রমাণ করে ফেলেছে। নিজেকে বেক্কল শ্রেণির উপরের দিকের সদস্য মনে হলো আর চুপ হয়ে গেল!

— ‘দেখেছেন, আব্বা? কীভাবে বলল আপনার ছেলে? যখন প্রেম করেছে তখন এভাবেই ফুঁসলিয়ে ফাঁসলিয়ে আমার মতো কত নরম মনের মেয়েকে নিয়ে না রুমডেটে গেছে। আমি এখন কী করব? আমার বাবা আমাকে মেরেই ফেলবে। আমার বিয়ে দিচ্ছিল কত আনন্দ করে। কী সুন্দর গেইট সাজিয়েছিল। লাল লাল মরিচবাতি জ্বলছে আর নিভছে। জ্বলছে আর নিভছে। কী সুন্দর! আমার এক চাচাতো বোন এভাবে পালিয়ে গিয়েছিল তাকে খুঁজে বের করেছে আমার আব্বা, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে বাড়ি নিয়ে গিয়েছে। তারপরে কী করেছে জানেন?’

উৎসুক পরোপকারী মানুষগুলোর উৎসাহে ভাটা দিয়ে বলল,

—- ‘না, বলব না। এখন মুখে আনতেও আমার ভয় লাগছে। আহারে!’

কেঁদে ফেলল তিথি।

আশরাফ সাহেবের সিপাহিকঠিন চোখেও পানি এলো এলো ভাব, তিনি বলে উঠলেন,

—- ‘আহারে!’

— ‘কীসের আহারে? এই মেয়ে ডাকাতি করার জন্য এসেছে। খোঁজখবর নিয়েই এসেছে। বাসায় আমি আর বাবা ছাড়া কেউ থাকে না জেনেই ও এভাবে এসে ঘরে ঢুকতে চাইছে। আচ্ছা, আমাকে বিশ্বাস না করতে চাইলে কইরেন না, আমাকে শাস্তি দিতেই না হয় পুলিশ ডাকেন? ওর ফ্যামিলিতে ফোন দেন? দেখেন, ওর কোনো বিয়েটিয়ে হচ্ছিল, কি না? যা বলছে তার একবিন্দুও সত্যি না।’

রাত গভীর হচ্ছে। আশিকের এত কথার ভিতর টক করে একটা কথা তিথির মাথায় ঢুকে গেল। তা হলো এই বাড়িতে শুধুই আশিক আর ওর বাবা থাকে। দুজন পুরুষ মানুষ। বিপদজনক হতে পারে। রাস্তা থেকে শয়তানগুলোর হাত থেকে দৌঁড়ে বেঁচেছে, এই ঘরের ভেতরও তো সেই একই বিপদ ঘটতে পারে। সভ্য মানুষের মুখোশ পরেই তো ঘুরে বেড়ায় হাসিবের মতো বিকৃত মনের মানুষগুলো। তিথির গলা শুকিয়ে আসতে থাকল। এবারে পুলিশের আগমনপ্রত্যাশী হলো ও নিজেই। আসুক পুলিশ। ও এইবাসায় রাত্রিযাপন করবে সেটা রেকর্ড হয়ে থাকুক পুলিশের খাতায়। তবেই ওর ক্ষতি করার সাহস আর কারো হবে না।

তবে ততক্ষণে কারো মনেই তিথিকে নিয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। তবু আশিকের জোরাজুরিতে আশরাফ সাহেব তিথিকে জেরা করতে বসলেন নাটকিয় মেজাজে।

— ‘নাম কী?’

— ‘তিথি।’

— ‘পুরো নাম বলো।’

— ‘জান্নাতুল আদন।’

— ‘বাবার নাম?’

— ‘খালেক আহমেদ।’

— ‘আজকে বিয়ে ছিল তোমার?’

— ‘হ্যাঁ।’

— ‘হলো না কেন?’

— ‘আমি পালিয়েছি বলে।’

— ‘কেন পালিয়েছ?’

তিথি ইশারায় আশিককে দেখিয়ে দিলো।

আশরাফ সাহেব ফের জানতে চাইলেন,

— ‘ওকে চেনো তুমি?’

— ‘হ্যাঁ।’

— ‘কীভাবে?’

— ‘আমার সাথে ফোনে রঙ নাম্বারে পরিচয়। ফোনেই প্রেম হয় আমাদের। তারপর দেখা করি।’

— ‘ও তো বলছে, তোমাকে চেনে না?’

— ‘ও ভয় পেয়েছে। আমাকে বলেছে ওর বাবা নাকি খুব ভয়ংকর লোক। জল্লাদের মতো। ওর বাবা ছাড়া পরিবারে আর করো স্বাধীনতা নেই। স্ত্রী-সন্তান কারো কোনো দাম নেই। আমাদের প্রেমের কথা জানলে ওকে নাকি ত্যাজ্য করে দেবে।’

— ‘কী? আমার নামে এতোবড় মিথ্যে কথা? আমি জল্লাদ? আমি স্বাধীনতা দেই না?’

আশরাফ সাহেব ক্ষিপ্ত হলেন, চোখ গরম করে তাকালেন আশিকের দিকে।

— ‘বাবা, ওই মেয়েটা আমাকে ফাঁসাচ্ছে। ও ভালো করেই জানে সবকিছু আর সেই অনুযায়ী খেলছে।’

— ‘একটু আগে বললে, তুমি ওকে চেনো না। ও তোমাকে চেনে না৷ এখন বলছ ও জানে সবকিছু। না চিনলে জানল কীভাবে?’

আশিক বুঝল আবার ওর কথা ব্যাকফায়ার করেছে। চিকন করে বলার চেষ্টা করল,

—- ‘আমি ওকে চিনি না। কিন্তু ও তো সব খবর নিয়েই এসেছে।’

কেউ আর আশিকের কথাকে পাত্তা দিলো না।

এবারে তিথির কাছে ওর বাড়ির ফোন নাম্বার চাইলে তিথি একটু বিপদে পড়ল। তবুও একটা চান্স নিলো। — ‘আমি ফোন নাম্বার দিচ্ছি, আপনি যা জানার জেনে নিন, কিন্তু প্লিজ আমি কোথায় আছি জানাবেন না কাউকে। তাহলে আমাকেও ধরে নিয়ে যাবে। আর আশিককে ছাড়া আমি বাঁচব না। এখান থেকে কোথাও যাব না।’

চোখ ডলে কাঁদল তিথি। আশরাফ সাহেবের মায়া হলো। এমন একটা নরম মেয়ে! তার স্ত্রী রেহনুমার একেবারেই বিপরীত চরিত্র। ওইরকম দজ্জাল চরিত্রের মহিলারা রাজত্ব করে যায় কিন্তু এই মেয়েটা আশিকের চাকরানী হয়ে থাকবে বলে হাতেপায়ে ধরছে বারবার। পুত্রের স্ত্রীভাগ্যে ইর্ষা হলো আশরাফ সাহেবের। রাজকপাল আশিকের!

আশরাফ সাহেব নিজেই ফোন দিলেন তিথির দেওয়া নাম্বারে। কথা বললেন কিছুক্ষণ। উপস্থিত সবার মাঝে তখন টানটান উত্তেজনা। তিথিরও বুক কাঁপছে। মায়ের নাম্বার দিয়েছে তিথি। না জানি শিরিন কী বলবে? এবাড়ি থেকে যদি আজ কিছুতেই বেরোতে চায় না ও। শিরিন যদি নিতে আসে ওকে? আবার যদি আতিকের সাথে বিয়ে দিতে চায়? কুলে এসেই কি তরী ডুববে? ফিঙ্গারক্রস করে বসে রইল ও।

আশরাফ সাহেব বেশ নাটকিয়তা তৈরি করলেন, ফোন করলেন পাশের ঘরে গিয়ে। তারও চেয়ে বেশি নাটুকে স্বরে দুহাত মেলে বললেন,

—- ‘এই মেয়েটা যা বলেছে সব সত্যি বলেছে। ওর নাম তিথি। ওর আজ বিয়ে ছিল। ও বাড়ি থেকে পালিয়েছে। ওর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, মা ফিট হচ্ছে বারবার। ওদের এক প্রতিবেশী ফোন ধরেছিল।’

তিথি একটা ছোট শ্বাস ফেলে, ক্লান্ত মাথাটা টেনে সোজা হয়ে বসল। ওর হাঁসফাঁস লাগছে। বাবা তো অনেক আগে থেকেই অসুস্থ। আর মা! মায়ের জন্য মন কেমন করে উঠল ওর। তবুও ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলো মনে মনে, ভাগ্যিস ফোনটা মা ধরেনি! মনে সাহস এলো। আরও কিছুসময় নাটকটা চালানো যায়। ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

—- ‘কিচেনটা ওইদিকে তো? আমি যাই, সবার জন্য চা করে আনি। আমার মাথা ফেটে পড়ে যাচ্ছে, এখন চা না হলে আমি মরেই যাব।’

কারও অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে তিথি ভেতরে ঢুকে গেল।

আশিক তিড়িক করে লাফ দিয়ে উঠল,

—- ‘এটা একটা গ্রুপ। ডাকাতদল। সব এদের প্ল্যানিং। আপনারা এখনো বুঝতে পারছেন না? পুরোনো বাংলা ছবিও তো আছে একটা এরকম।’

— ‘বন্দিনী। রঞ্জিত মল্লিক আর মৌসুমি চ্যাটার্জির। আর তুমি সেটা মনে করিয়ে দিয়ে এই মেয়েটাকে অসহায় করে দিয়ে এখন ডাকাত সাজাতে চাইছ? স্টুপিড, তবে প্রেম কেন করেছিলে?’

আশরাফ সাহেব অকারণ হুংকার দিলেন।

— ‘বাবা, আমি কোনো প্রেমট্রেম করিনি। বিশ্বাস করো, আমি জীবনে এই মেয়েকে দেখিনি।’

বাপ ছেলের ডুয়েলে বাগড়া দিলো বাড়ির কেয়ারটেকার,

—- ‘স্যার, রাত দেড়টা বাজে। আপনারা ঝামেলা শেষ করেন। বাসাবাড়িতে এইরকম ঝামেলা করা ঠিক না। অন্যরা কমপ্লেইন দেয়। আশিক স্যার আর টালবাহানা কইরেন না। আপা সুন্দর অনেক। সিনেমার নায়িকাগো মতন। বোম্বের নায়িকাগো মতন সুন্দর। এমন সুন্দর মেয়ে আর পাইবেন না।’

রান্নাঘর তুমুল এলোমেলো। কাজের ছেলেটার সাহায্য নিয়ে সব খুঁজে খুঁজে সবার জন্য চা করে ট্রলি ট্রে ঠেলতে ঠেলতে তিথি যখন ড্রয়িংরুমে ঢুকল তখন সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে আজ রাতেই কাবিন করিয়ে দেওয়া হবে আশিক আর তিথির। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের এক ছাদের নিচে বিয়ের দলিল ছাড়া রাখাটা ঠিক হবে না কোনোভাবেই। এত রাতে কাজি কোথায় পাওয়া যাবে সেই চিন্তায় পড়ল না কেউ। সব বিয়েতেই এত বেশি ঝামেলা পাকে যে সেইসব মিটিয়ে বেশিরভাগ বিয়েই নাকি পড়ানো হয় রাতের শেষভাগে। এলাকার কাজি সাহেবকে ফোন করলেই চলে আসবে।

তিথি বিপদ টের পেলো। নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই পড়ে গেছে। এখন অস্বীকার করা মানে নিশ্চিত হাজতখানায় ঠিকানা হবে। আগুনগরম চায়ে চুমুক দিয়ে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেলল ও।

আশিকও তথৈবচ। ও নিরীহ ছেলে, তিথির পাতা ফাঁদে আটকে গেছে। যাই বলছে নিজেকে ডিফেন্ড করতে তাই ব্যাকফায়ার করছে। একটা মেয়ে আশিকের নাম ছাড়া কিছু জানে না তা কেউ খেয়ালই করছে না। নিজের বাবাই এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে এখন বিয়ে না করলে ‘বিয়ের আশ্বাস দিয়ে ধর্ষণের অপরাধে’ ওকে এখনই আজীবন কারাদণ্ড দিয়ে দেবে সবাই। আর লোক জানাজানিও বাড়ছে প্রতি মূহুর্তে। পাশের ফ্ল্যাট থেকে লোক এসে পড়েছে, নিচের থেকেও এসে জেনে গিয়েছে কী সমস্যা? কৌতুহলী মুখ বাড়ছেই।

আশরাফ সাহেবের উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। আনন্দেই আছেন তিনি। বেশ খোশমেজাজে আছেন। ছেলের বিয়ের ঝামেলা শেষ করে স্ত্রীকে ফোন দিয়ে জানাবেন কখন সেই চিন্তায় রয়েছেন। কীভাবে আর কতটা রঙ ছড়িয়ে ছেলের বিয়েতে নিজেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ আর রেহনুমাকে একেবারেই গুরুত্বহীন প্রমাণ করে দেবেন তাই ভেবে ভীষণ খুশি তিনি। স্ত্রীকে ফোন করেই তিনি তার কালেকশনের সেরা হুইস্কির বোতলটা নিয়ে বসবেন। একটা একটা শট নেবেন আর একটু একটু করে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবেন রেহনুমা নামের অতি দজ্জাল বদমহিলাটাকে!

চায়ে চুমুক দিয়ে আনন্দে চোখ বন্ধ করে ফেললেন তিনি। মেয়েটা চাও বানিয়েছে ভালো। রেহনুমার বানানো চা খেলে মনে হয় পেট্রোলে চিনি গুলিয়ে দিয়েছে। আর বারেক তো মিনারেল ওয়াটার গরম করে সামনে দেয়! চায়ের আসল স্বাদ ভুলতেই বসেছিলেন তিনি…

তিথি – ১১

“বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান,

এইবারে ঘুঘু তোমার বধিব যে প্রাণ”

তিথি ভেবেছিল বারেবারে ফাঁকি দিয়ে বিপদগুলো পার হয়ে যাচ্ছে, এইবার সত্যিই ও ফাঁদে পড়ে গেল!

এইবার আর ছুটে যাওয়ার উপায় নেই, বিয়ে নামের এই হাড়িকাঠে গলাটা এবার দিতেই হবে। তবুও একবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠল ও।

— ‘অসম্ভব! যে লোকটা আমাকে চিনতেই চাইছে না, তাকে আমি বিয়ে করব কীভাবে? আজ আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। বাবা-মায়ের কথা না শুনে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি। আমি জানি আমার ভুলের কোনো মাফ নেই। আমার বাবা মা আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না। কিন্তু আপনারা বলেন আজকে আশিক আমাকে অস্বীকার করছে, ওকে বিয়ে করে ওর ঘাড়ে জোর করে চেপে বসা কি আমার উচিত হবে? যতক্ষণ না ও আমার পা ধরে ক্ষমা চাইবে, প্রায়শ্চিত্ত করবে ততক্ষণ কোনো বিয়ে হবে না। হবেই না।’

টলটলে চোখ নিয়ে সবার দিকে তাকালো ও একে একে।

তারপর সবাইকে পিছনে রেখে, লম্বা করে পা ফেলে একেবারে বাসার ভিতরে চলে এলো আর একটা বেডরুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো।

আশিক হৈহৈ করে উঠল,

—- ‘এই তো, দেখলে এখন? এই মেয়ে ডাকাতি করতে এসেছে। ও কখনোই বিয়ে করবে না। এবার আমার কথা বিশ্বাস হলো? পুলিশ ডাকেন এবার।’

তিথির সুন্দর মুখ আর সরল কথায় লোকগুলো বিভ্রান্ত হয়েছে। বাবা মাকে ছেড়ে পালিয়ে আসার অপরাধের অনুতাপ কিংবা প্রেমিক প্রতারকে পরিণত হাওয়ার কষ্ট, তিথির বেদনাটুকু যেন ছুঁয়ে গেল সবাইকে। আসলেই তো, যার আত্মসম্মানবোধ আছে সে কি করে এই বিয়েতে রাজি হবে? নেহায়েতই, রাতে যাওয়ার জায়গা নেই বলে এই বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে তাকে।

দুইতলার বাসিন্দা জয়নাল সাহেব। ওনার একটা মেয়ে আছে। বিয়ে দিয়েছেন। মেয়েকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয়। সেই কষ্টটুকু যেন ছুঁয়ে দিয়ে গেল তিথি। তিনি আশিককে ডাকলেন,

—- ‘আশিক, তুমি কি এই মেয়েকে বিয়ে করবা?’

— ‘না, অসম্ভব!’

— ‘তাহলে এই মেয়েকে তুমি ডাকাত বলো কিভাবে? তুমি নিজেও তো বিয়েটা করতে চাইছ না। আবার মেয়েটা রাজি হচ্ছে না দেখে তাকে ডাকাত বলছ। তুমি তার সাথে যা করেছ তাতে যেকোনো স্বাভাবিক মেয়েই তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাইবে না। এখন মেয়েটার যাওয়ার যায়গা নেই বলেই ও এখানে থেকে গেল আমি বুঝতে পারছি।’

— ‘ঠিক বলেছেন। আহারে, কী সুন্দর মেয়ে। ঠিক কাজ হইছে, বাপ মায়ের অবাধ্য হলে কপালে লাথিঝাঁটাই জুটে। মেয়েটার শাস্তি পাওয়া দরকার ছিল। সে আশিকের আসল চেহারা ধরতে পারে নাই আগে। কিন্তু আশরাফ সাহেব, আপনার ছেলে এমন লম্পট সেটা কি আপনি কিছুই জানেন নি? এইজন্যই বাচ্চার মাথার উপর মায়ের দরকার আছে। নইলে এভাবেই পোলারা বিগড়ে যায়৷ ছিঃ ছিঃ। বিয়ে করবা না তো মেয়েটার সর্বনাশ কেন করলা?’

পাশের ফ্ল্যাটের হামিদ সাহেব বললেন আশরাফ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে।

আশরাফ সাহেব অত্যন্ত রেগে আছেন। বিয়েটা না হওয়াটা তাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। রেহনুমাকে কী কী বলবেন তার পুরো স্ক্রিপ্ট তৈরি করে ফেলেছেন মনে মনে। এমনকি রেহনুমার উত্তরগুলোও নিজেই দিয়ে রেখেছেন। সবকিছুই ভেস্তে গেল তার এই অপদার্থ ছেলের জন্য। অথচ এই ছেলেটাকে তার অন্য দুই ছেলের তুলনায় বুদ্ধিমান বলেই ভাবতেন তিনি। বুদ্ধিমান বলেই ছেলেটা মাকে ছেড়ে বাবাকে বেছে নিয়েছিল।

এখন দেখছেন এটাও বাপের মতোই হাদারাম হয়েছে। এমন একটা মেয়েকে এভাবে হাতছাড়া করে কেউ?

না, তিনি নিজে তো এতটাও বোকা নন। আর্মিতে ঢোকার কারণে বিয়ের জন্য কিছু বিধিনিষেধ ছিল। নির্দিষ্ট সময়ের আগে বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। কই উনি তো চাকরির জন্য রেহনুমাকে হাতছাড়া করেননি। গোপনে দুইবাড়ির মুরব্বি নিয়ে বিয়েটা ঠিকই সেরে ফেলেছিলেন। আহ, কী ছিল সেই দিনগুলো! বিবাহিত অথচ লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করতে হতো। কী লাজুক ছিলো রেহনুমা! ছুঁয়ে দিলেই যেন টুক করে লজ্জাবতীর লতার মতো বন্ধ হয়ে যেত, নুইয়ে যেত। আর এখন! সাউন্ড এনহেন্সার লাগে না, সেই সাত চড়ে রা কাড়ে না রেহনুমা নিজেই মাইকের মতো কড়াৎ কড়াৎ করতে থাকে কানের উপর।

আশরাফ সাহেব হুংকার দিয়ে বললেন,

—- ‘বিয়ে করবে না মানে কী? অবশ্যই বিয়ে করবে। গাধার বাচ্চা? আজকে রাতের মধ্যেই তুই মেয়েটাকে রাজি করাবি।’

বিয়েটা না হওয়াতে সবাই একটু মনক্ষুণ্ণ হলেন, এদিকে রাতও বাড়ছে। আশরাফ সাহেবের দায়ীত্বে তিথিকে রেখে সবাই যার যার ঘরের উদ্দেশ্য চলে গেলেন।

আশরাফ সাহেব মন খারাপ করে পিনো নোয়ারের বোতলের ছিপি খুললেন। বেডরুমের এক কোনায় তার পিচ্চি সাইজের বার কাউন্টার। ছোট একট ফ্রিজ আছে আর চার পাঁচটা বোতল। ওয়াইন আর হুইস্কি। আনন্দে তিনি হুইস্কির বোতল খোলেন আর কষ্টের তীব্রতা কমাতে বিভিন্ন স্বাদের ওয়াইন লাগেই গলায় ঢালতে। এইটুকুই। এইটুকুর জন্যই রেহনুমার সাথে তার যত সমস্যা। একটা মাতালের সাথে রেহনুমা কিছুতেই এক ছাদের নিচে থাকবে না সাফ জানিয়ে গেছে। তিনি রেহনুমাকে কিছুতেই বোঝাতে পারেননি একটা দশ মিলির ওয়াইন পেগ কাউকে মাতাল বানাতে পারে না। ছোট্ট এক পেগে তার দিব্যি আধাঘন্টা কেটে যায়। এইটুকুকেই তাল বানিয়ে রেহনুমা ঘর ছাড়ল। মনে আজ অনেক কষ্ট আশরাফ সাহেবের। বারটপ থেকে ওয়াইনের গ্লাস টেনে নিলেন। একটু সৌখিন এইদিক থেকে উনি। তুরস্কের একটা অকশন থেকে মাত্র দুটো গ্লাস কিনেছিলেন, ওয়াটারফোর্ড স্টিমলেস এর গবলেট। এমনিতে বারোটা গ্লাসের সেট, প্রতিটা আশি ডলার করে, মাত্র দুটো গ্লাস নিয়েছিলেন তিনশো ডলার দিয়ে। সেদিক দিয়ে জিতই হয়েছে, তিনি এতগুলো গ্লাস দিয়ে কী করতেন?

গ্লাসটা চকচক করছে। এই গ্লাসগুলো বারেকের হাতে দেন না তিনি, নিজে প্রচুর আগ্রহ নিয়ে পরিস্কার করেন। ওয়াইনে কেউ বরফ দেয় না। তাতে বিস্বাদ হয়ে যায় পানীয়। আজকে দিনটা অন্যরকম। গ্লাসে তিন টুকরো বরফ নিয়ে ড্রিংক তৈরি করে তিনি আশিকের পাশে এসে বসলেন। সোফায় মাথা ঠেকিয়ে দিয়ে চুলগুলো দুই হাতে মুঠো করে ধরে ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে আশিক। আস্তে করে তার পাশে বসে ওয়াইন গ্লাসে ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,

—- ‘আশিক, তুই কি কোনোভাবে তোর মাকে ভয় পাচ্ছিস? সে কোনোভাবে ঝামেলা করবে ভাবছিস? সে কিছু করার ক্ষমতা রাখে না। আমি মেজর আশরাফ তোকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি….’

বহুদিন পরে আগের সেনামেজাজ এসে গিয়েছিল আশরাফ সাহেবের কিন্তু আশিক তাকে পাত্তা না দিয়েই উঠে চলে গেল। আশিকের মাথায় নানা চিন্তা ঘুরছে। কোনোকিছুতেই সুবিধা করে ওঠা যাচ্ছে না। বুদ্ধি বের করা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় অবসরপ্রাপ্ত আর্মি মেজরের প্রলাপ শোনার ইচ্ছা তার নেই। এই লোকের সমস্ত চেতনা অবচেতনভাবে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে কীভাবে স্ত্রীকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা যাবে। তিনি জানেন তিনি স্ত্রীকে ঘৃণা করেন, সারাদিন স্ত্রীকে শায়েস্তা করার চিন্তায় থাকেন, কিন্তু মস্তিষ্ক তাকে ধোঁকা দিয়ে চলে। তিনি আসলে সমস্ত দিন তাকে ফিরিয়ে আনার বাহানা খোঁজেন। স্বাভাবিকভাবেই সোজা পথে হাঁটেন না, যতভাবে রেহনুমাকে বিব্রত করা যায় তার সবগুলো পন্থা অনুসরণ করে যান। আর তাই ছেলেদের কোনো গুরুত্ব নেই তাদের কাছে, ছেলেদের ব্যবহার করে বোকার মতো এক একটা ট্রিক খাটান আর মনে মনে ভাবেন বেশ শায়েস্তা করা গেল এবার রেহনুমাকে। আশিকের মনকে তাই তিনি একেবারেই পড়তে পারলেন না। আশিক নিজেই এই গাড্ডা থেকে নিজেকে বের করার উপায় ভাবতে থাকল।

আশিকের ধারণা এটা অবশ্যই বড় কোনো চক্রের কাজ। বড় কোনো মোটিভ আছে এদের। তিথিকে ভালোভাবে ইন্টেরোগেট করা দরকার। কিন্তু মেয়েটা দরজা আটকে বসে আছে। চোর ডাকাত যাই হোক না কেন এত রাতে একটা মেয়ের দরজায় নক করা মোটেও শোভনীয় নয়। কিন্তু ঘরে ডাকাত ঢুকিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমানোও তো যায় না! সকালে যা করার করা হবে, রাতটা কাটুক। সাপোর্টও যোগাড় করতে হবে। আপাতত একটু ঘুমিয়ে ব্রেইনে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা দরকার। সিঙ্গেল একটা সোফা টেনে মেইন দরজার সামনে নিয়ে সেখানে বসে পড়ল আশিক আর বারেককে বলল সেখানেই বিছানা পেতে ঘুমাতে। আর যাই হোক ঘর থেকে বেরুতে গেলে আশিককে ডিঙিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তিথিকে বের হতে গেলে বা কাউকে ঘরে ঢুকাতে গেলে আশিককে আগে ফেস করতে হবে।

তিথির অবস্থাও একইরকম। ডোরলক তুলে দিয়েও শান্তি হয়নি, দরজায় পিঠ লাগিয়ে বসে পড়েছে ফ্লোরে। এই বাসায় কোনো মহিলা থাকে না জানতে পারার পর থেকেই টেনশন শুরু হয়েছে। গার্ড শয়তানটার হাত থেকে বাঁচতে গরম কড়াই থেকে চুলার আগুনে লাফ দিলো না তো? আশিক নামের ছেলেটা তো আছেই, তার বাবাকেও বিশ্বাস করা যায় না কোনোভাবেই। মুখ দেখে মানুষ চেনার ক্ষমতা তো তিথির নেইই, সেটা হাসিবকে দিয়েই প্রমাণ হয়ে গেছে। তাই সব মানুষের পরেও তিথির প্রচন্ড অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। সবাই মুখোশ পরে আছে মনে হয়। এই শ্বাপদের জঙ্গলে নিজেকে বাঁচানোর উপায় নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়। চা বানানোর অজুহাতে তাই প্রথমেই তিথি এই বাসার কিচেনে গিয়ে ঢুকেছিল। খুঁজে এনেছে মাছ কাটার ছুরি, দুটো কাঁটাচামচ আর মরিচের গুঁড়ো। আত্মরক্ষার ব্যবস্থা। রাতটা পার করে এই বাসার ভাব বুঝতে হবে। খারাপ বুঝলে কালই কেটে পড়তে হবে। কিন্তু কালই বা তিথি কোথায় যাবে? এই দুনিয়াতে তিথির যাওয়ার মতো জায়গা কি আরেকটা আছে? রায়নার বাসাও তো তিথির জন্য নিষিদ্ধ জায়গা। কী করবে তিথি? ভাবতে ভাবতেই সেভাবে বসে থেকে ঘুমিয়ে পড়ল ও।

দরজায় নক পড়ার শব্দে তটস্থ হয়ে উঠল তিথি,

—- ‘মা?’ ‘মাগো?’ বলে সুন্দর করে ডাকছেন আশরাফ সাহেব। তিথি তার গলায় মধু মেশানো স্নেহকে পাত্তা দিলো না, ব্যাগের ভিতর রাখা ছুরিটকে মুঠো করে ধরল।

— ‘মাগো, সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ। এত দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা ঠিক না। আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ। যত রাত করেই ঘুমাই না কেন আজ পর্যন্ত সকালের সূর্য আমার আগে ওঠেনি। দেখো, আজও কেমন ফিট আমি! দুমাইল দৌঁড়াই প্রতিদিন। আজকে পারলাম না। আশিককে জাগাতেই পারলাম না। সে দরজার সামনে বিছানা পেতেছে। কী যে আজকালকার ছেলেমেয়েরা! সারারাত জেগে মোবাইলের ভেতর ঢুকে থাকবে, যতসব আনপ্রডাকটিভ কাজ! সকালে পড়ে পড়ে ঘুমাবে। ভোর কেমন এরা মনে হয় জানেও না!’

আশরাফ সাহেব কতক্ষণ একা একা বকে গেলেন। তিথি সাড়া দিলো না। তারপর খেয়াল হলো, এখন রাত না মোটেও। রাতের আঁধারে কেউ তার দরজা ধাক্কায়নি। রোদে উদ্ভাসিত একটা সকাল এসে গেছে। দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ঘন্টার কাঁটা নয়ের ঘর ছুঁয়ে গেছে। ও আস্তে আস্তে উঠল। ফ্রেশ হয়ে ঘরের বাইরে এলো। আস্তে আস্তে এদিক সেদিক উঁকি মেরে চলছে ও। বারেক নামের ছেলেটা এখনো বিছানা তোলেনি। রান্নাঘরের মোড়ায় বসে বসে ঢুলছে। ডাইনিং এ এসে দেখল আশরাফ সাহেব বসে নাস্তা করছেন। বাইরে থেকে আনানো খাবার। আগেরদিন দোকান থেকে আনানো হয়েছে। এক্সট্রা ছিল, গরম করে নেওয়া হয়েছে। পরোটা, সবজি, ডাল এমনকি ডিমভাজাটাও বাইরে থেকে আনানো। বাসী পরোটা গরম করায় রাবারের মতো হয়ে আছে, টেনে টেনে ছেঁড়া লাগছে। আশরাফ সাহেব হাসলেন তিথিকে দেখে,

—- ‘গুড মর্নিং। নাস্তা খেয়ে নাও। বারেক রান্না করতে পারে না। আমি পারি সবই, কিন্তু ইচ্ছে করে না। ব্রেডফেডও আছে, জ্যাম – বাটারও আছে। যা ইচ্ছা নিয়ে খাও।’

তিথি এই বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যাবে ভাবছে। কিন্তু দরজা জুড়ে এমনভাবে আশিক শুয়ে আছে ওকে পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব না। ও আশরাফ সাহেবের মোবাইলটা চাইল, আতিককে ফোন দেবে বলে। বাড়ির পরিস্থিতিও জানা যাবে আর নড়াইলের কোন ঠিকানায় যেতে হবে সেটাও জানা দরকার। কিন্তু ফোনটা ধরল শিরিন। তিথি কোনো আওয়াজ করল না। আস্তে করে ডিসকানেক্ট করে দিলো। আতিকের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে নেওয়া হয়েছে সম্ভবত। বড় বিপদেই পড়ল তিথি। আতিকের সাথে যোগাযোগ না করতে পারলে কোথায় যেতে হবে ও জানবে কীভাবে? আরও কয়েকদিন এখন এই বাড়িতে থাকতেই হবে ওকে। তিথি মনে মনে সংকুচিত হলো। বিয়ে হয় না হয় না তিথির। এখন বিয়ে নিয়েই জ্বালা হলো। হাসিবের সাথে বিয়ে এড়াতে আতিকের সাথে তিথিকে বিয়ে দিতে চাইলেন শিরিন, আর আতিকের সাথে বিয়ে অসম্ভব বলে পালিয়ে এসে আশিকের সাথে বিয়েটা এখন অনিবার্য হয়ে ঘাড়ে পড়েছে! কিছুক্ষণ অসহায় হয়ে ভাবল তিথি! আর যে যাই জানুক না কেন, আশিক তো জানে সব সত্যিটা। তাই ওর সাথেই একটা সমঝোতায় আসতে হবে এখন। কিংকর্তব্যবিমুঢ় দেখালো ওকে।

আশিক ঘুম থেকে উঠে, রাতের সবকিছু মনে করে লাফ দিয়ে পড়ল। তিথিকে হ্যান্ডেল করার আগে বাসার সিকিউরিটি নিশ্চিত করা দরকার। টেকনিশিয়ান ডেকে এনে সিসিটিভি ক্যামেরা ইন্সটল করার ব্যবস্থা করল। আজকে অফিস যাবে না আশিক। সারাদিন কী কী করা যায় তার তালিকা করতে বসল। তিথির সাথে কথা বলতে হবে। আসলে কী চায় ওই মেয়ে, ওর ডিমান্ডটাও জানতে হবে। একান্তই ডিল করা না গেলে মাকে ফোন করতে হবে। এমনিতে মায়ের ধারেকাছে না গেলেও এখন মনে হয় শুধুমাত্র রেহনুমাই পারবে এই মেয়ের ঝামেলা থেকে আশিককে বাঁচাতে!

চলবে…
আফসানা আশা