তিথি – ১৪
আশিক বেরিয়ে যাওয়ার পর তিথি শাড়িটাকে খুলে আটপৌরে করে পেঁচিয়ে নিলো। শাড়ি পরার অভ্যাস না থাকায় পায়ে পেঁচিয়ে যাচ্ছে বারবার। রাস্তায় উঁচু করে ধরে হেঁটেছে। আর এখন তো অনেকটা খুলে এসেছে। শাড়ি পরতেও জানে না ও। কুঁচি ধরতে গেলেই ঝামেলা হয়। একটা ধরে তো আরেকটা খুলে আসে। তাই বেশ শক্ত করে আটপৌরে প্যাঁচ দিয়ে দিয়ে কোমরে বেঁধে নিলো। এটা তুলনামূলক সহজ। নানিকে দেখেছে এভাবে শাড়ি পরতে। নানি বেঁচে থাকলে এই বিপদের সময় তার কাছে চলে যাওয়া যেত।
তিথির মা চলে যাওয়ার পরে ফুফুর বাড়ি থেকে শিরিনের কাছে যাওয়ার মাঝের সময়টা ও নানির কাছেই ছিল। মামা-মামিরা, কাজিনরা এমনকি আশেপাশের প্রতিবেশী মহিলারাও ওকে ওর মা তুলে কটু কথা শোনাতো। খোঁটা দিত। নিজের ছেলেমেয়েদেরকে তিথির সাথে মিশতে দিত না মামিরা। বলত, তিথির মা খারাপ, তিথিও খারাপ হবে। তিথির সাথে মিশলে তাদের ছেলেমেয়েরাও খারাপ হয়ে যাবে। একা একা ঘুরত তিথি, একা একাই খেলত। নানির কাছে ঘুমাতো, নানিই আগলে রাখত ওকে। তবুও ও ছুটে যেতে চাইতো, সবার সাথে খেলতে, সবার সাথে মিশতে। তখনই ঝগড়াঝাটি লেগে যেত। তিথিকে দেখলেই মামিরা সবাই রেগে যেত। এসব কিছু থেকে তিথিকে উদ্ধার করেছিল শিরিন। পরে মামা, মামিদের সাথে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছিল। যতবার আতিক, রায়নার সাথে মামাবাড়ি গিয়েছে, তিথিকে কেউ আর দূর ছাই করত না কিন্তু সম্পর্কের উষ্ণতা তৈরি হয়নি। একটা ঠান্ডাভাব রয়েই গেছে। এখন ওখানে গেলে তিথিকে জায়গা দেবে না কেউ। শিরিন আর শিরিনের মেয়ে এই পরিচয় ছাড়া তিথির কোনো পরিচয়ই তো তৈরি হয়নি।
চোখে পানি দিয়ে অশ্রুর দাগ ধুয়ে ফেলল তিথি। রুমের বাইরে এসে বাসাটাকে ঘুরে দেখতে চেষ্টা করল। এই বাসায় থেকেই পরবর্তী ভাবনা ভাবতে হবে। নিজেকে গুছিয়ে ফেলতে হবে। শিরিনের মাথা থেকে তিথিকে বিয়ে দেওয়ার পোকা দূর না হওয়া পর্যন্ত একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। কিন্তু শিরিনের মাথা থেকে ভাবনাটা যদি কোনোদিনও দূর না হয়? কচ্ছপের কামড় বলে একটা কথা আছে। কচ্ছপ যদি কিছু কামড়ে ধরে একবার তাহলে ওটার গলা কেটে না দেওয়া পর্যন্ত ছাড়ানো যায় না। শিরিন অনেকটা ওই টাইপ মহিলা। যা একবার করবেন ভেবেছেন তা করেই ছাড়েন, তার মাথা থেকে সেটা কিছুতেই সরানো যায় না। তিনি ধরেই নিয়েছেন তিনি যা করছেন তিথির ভালোর জন্যই করছেন, তার চেয়ে বেশি তিথির ভালো কেউ করবে না, তো এই ভাবনাটা তার মাথায় গেড়ে বসেছে, এর থেকে সরবেও না। আরেকবার কান্নাএলো তিথির।
বাসাটা বেশ বড়। তিনটে বেডরুম। একটাতে আশরাফ সাহেব থাকেন। ফার্নিচার বাদেও একটা ছোট বার কাউন্টার দেখে ঢোঁক গিলল তিথি। মদ, মাতাল এইসব শব্দগুলো ব্রেইনে নেগেটিভ ইমেজ তৈরি করার মতো ইনফরমেশনে সাঁটা। ও একটু একটা বোতলের ছিপি খুলে ঘ্রাণ নিলো, আসলেই মদ নাকি পানি ভরে রাখা সেটা দেখার জন্য। মদের বোতলগুলো সুন্দর হয় বলে অনেকেই মদ ছুঁয়ে না দেখলেও বোতল কালেকশনে রাখে। সেইরকম হলো না, কর্ক খুললেই মিষ্টি, মৃদু ঝাঁঝাঁলো,হালকা বোঁটকা একটা গন্ধ এসে নাকে লাগল। তিথির বুকে কাঁপা-কাঁপি লেগে গেল। আসলেই মদ! কে খায় মদ? আশিক নাকি আশিকের বাবা? রেগুলার খায় বোঝা যাচ্ছে। ঘরের অন্য ফার্নিচারগুলো ধুলোয় মলিন শুধু এইজায়গাটাই চকচক করছে। কাজের ছেলেটার কাছে জিজ্ঞেস করবে? কিন্তু ওই ছেলে তো সারাক্ষণ ঘুমে ঢুলছে। ঘুমাতে ঘুমাতেই দু-একটা কাজ করে। কোনো প্রশ্ন করলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। তিথির অসহায় লাগল, কান্না পেয়ে গেল।
শেষে নেশাখোরদের ভেতর এসে পড়ল?
রান্নাঘরে হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। আশরাফ সাহেব বারেককে ডেকেই যাচ্ছেন। কিন্তু ছেলেটা একবারও ডাক নিচ্ছে না। হয়তো কোথাও ঘুমিয়ে গেছে, গাল হা করে। কিন্তু আশরাফ সাহেব বিরতিহীন ডেকেই যাচ্ছেন। প্রচুর অধ্যাবসায় আছে লোকটার নিঃসন্দেহে।
তিথি নিজেকে শক্ত করে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। আশরাফ সাহেব টিশার্ট আর পায়জামা পরে লাল-সবুজ গামছা একটা কোমরে বেঁধে খুন্তি হাতে চুলার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। রান্না করছেন আর জোরে জোরে বারেককে ডাকছেন,
— ‘এই গরম মশলাটা একটু খুঁজে দে না?’
তিথি অবাক হয়ে তাকালো রান্নাঘরের চারিদিকে। গত রাতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চায়ের সরঞ্জাম খুঁজে বের করেছিল। ম্যাজিক না জানলে এখান থেকে কিছু খুঁজে বের করা মুশকিল। আলু, পেঁয়াজ, আদা, রসুন সব ফ্লোরে টাল করে রাখা। সেগুলো পরিমাণে অল্প বলে এখনও এখানে দাঁড়ানোর জায়গা আছে, নইলে অনায়াসে কোনো ক্ষেত বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। হাড়ি, পাতিল, প্লেট, গ্লাস ব্যবহারের পরে আর জায়গামতো রাখা হয়নি কিছুই। একটার উপর আরেকটা উঠে উঠে বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। এরা পড়ে কেন যায়নি ভেবেই অবাক হলো তিথি। ওর একবার মনে হলো সরে চলে যেতে। তবু্ও কোথায় যেন আটকে গেল। বাবার বয়সী একজন মানুষ রান্না করতে গিয়ে গোলমালে পড়েছে, দেখে সরে যেতে পারল না তিথি। এগিয়ে এসে বলল,
— ‘আমি কিছু কাজ করে দেব, আংকেল?’
আশরাফ সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে একগাল হাসলেন আর সাথে সাথে হাহা করে উঠলেন,
— ‘না, না, বৌমা, তুমি তোমার ঘরে যাও। আমাদের পরিবারের নিয়ম আছে নতুন বউ তিনদিন বিছানা থেকে নামবে না।’
তিথি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। শিরিন ওকে কাজ না পারার জন্য হাজারটা বকেছেন, এত বড় মেয়ে রান্না করতে জানে না বলে গালমন্দ করেছেন কিন্তু কখনো কিছু শেখাননি, করতেও দেননি। তিথিকে কখনো চুলার কাছে যেতেই দিতেন না। চা বানানো, ইনস্ট্যান্ট নুডলস আর খালেক সাহেব অসুস্থ হলে তার চাল-ডাল সেদ্ধ খিচুড়িটা ছাড়া কিছুই শেখা হয়নি তিথির। যেদিন অনেক রান্নার চাপ থেকেছে, টুকটাক একটু সবজি কেটে দিয়েছে মাঝেসাঝে, দুটো রুটি করেছে তাও বেসাইজ, এই পর্যন্তই তিথির দৌঁড়!
ভদ্রলোক ওকে কিছু করতে বললে ও বিপাকেই পড়ত।
আশরাফ সাহেব বললেন,
— ‘মেয়েদের কাজ হলো রান্নাঘরে। ভালো ভালো পদ রান্না করবে, স্বামি-ছেলেদেরকে খাওয়াবে, দেখতেই কত ভালো লাগে। এই যে নতুন বউ, লাল শাড়ি পরবে, ঘুটঘুট করে ঘরজুড়ে ঘুরে বেড়াবে, তবেই না ঘর ভরে যাবে, মন ভরে যাবে। কী কুক্ষণে পড়ালেখা করতে শিখিয়েছিলাম আর চাকরি করতে দিয়েছিলাম আমার অদৃষ্ট জানে। মাস্টারনী হয়ে তিনি এখন আমার উপর মাস্টারি করেন। আমাকে শেখান, ‘এক বোতল খেলেও মাতাল, দশ মিলির এক চুমুকেও নাকি মাতাল!’ হুহ, মাস্টারনী! ভেবেছে আমি তার পা ধরে বসে থাকব। যা? গেছিস তো কতদিন। আমি ডাকতে গিয়েছি? আমি আর্মিম্যান। পারি না এমন কোনো কাজ নেই। রান্না, আমার হাতের তুড়ি! হুহ!’
হেহে করে হাসলেন আশরাফ সাহেব।
তিথি দেখল পাতিলে মাংস চড়েছে। বিশাল এক পাতিল। অন্তত সাত, আট কেজি মাংস রান্না করা যাবে এই পাতিলে। সেখানে কেজি দুয়েক চড়ানো হয়েছে। পাতিলের তলায় পড়ে আছে মাংস। হলুদ মরিচের গুঁড়ো দেওয়া হয়েছে পর্যাপ্ত থেকে আরও বেশি।
খুন্তি নাড়াতে নাড়াতে আশরাফ সাহেব বললেন,
— ‘আমার বাবা বলত বুঝেছ, বৌমা? মাংস খেতে যদি ঝালে না হিসিয়েছ আর যদি টেনে ছিঁড়তে না হয়েছে তবে মাংস রান্নাই হয়নি। মেজবান বাড়িতে মাংসে ঝাল না হলেই বাবা বলত, পাকাইন্যা মজবুত না। হেহে, মানে হচ্ছে, রাঁধুনি আনাড়ি। কোনো কোনোদিন মাকে বসিয়ে রেখে বাবা মাংস রাঁধত, সে কী আয়োজন! আমার সব ভাইবোনেরা উঠোনে গোল হয়ে বসতাম, পেঁয়াজ কেটে দিচ্ছি, মশলা বেঁটে দিচ্ছি, আলু কেটে দিচ্ছি, লাকড়ি এনে দিচ্ছি। লুঙ্গি কাছা বেঁধে বাবা রান্না করছে। বাঁটা লালমরিচ ঝোলের সাথে মিশে টকটকে লাল রঙ ধরছে আর আগুনের আঁচে, আগুনের আলোয় বাবার মুখও টকটকে হয়ে যেত। যখন খেতে বসতাম তখন আমাদের সব ভাইবোনেরও মুখের রঙ সেইরকম টকটকে হয়ে যেত, ঝালে। সে কী ঝাল! নাক দিয়ে, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, সবার নাক টানার শব্দ, গাল দিয়ে শিষ দেওয়ার শব্দ – কিন্তু সেই স্বাদও তো ভোলার না। আর আজকালকার বাচ্চাদের মায়েরা মানুষ করবে লুতুপুতু করে, ফার্মের মুরগীর রান চিবিয়ে এরাও ফার্মের মুরগী হবে। দু কিলো হাঁটতে গেলেই চারবার রিকশা ডাকবে। যাও যাও, তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন, বৌমা? ঘরে যাও। তিনদিন ঘর থেকে বেরোবে না। তারপর তোমার সংসার তুমি বুঝে নিও। আমি হবো তোমার এসিস্ট্যান্ট। আমরা দুজনে মিলে ওই মাস্টারনীকে শিখিয়ে দেবো, কী ভাবে সংসার করতে হয়?’
সব গল্পেই নিজের স্ত্রীকে টেনে আনা ভদ্রলোকের অভ্যাস। তিথির তবুও একটু সাহায্য করতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ভদ্রলোক যেভাবে বৌমা, বৌমা করছেন তাতে আর দাঁড়ালো না ও।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যে রুমটাতে ঢুকল সেটাকে আদৌতে ঘর বলা যায় কীনা সন্দেহ আছে তিথির। বিছানার চাদর এককোণা ঝুলতে ঝুলতে ফ্লোরে লেগে আছে। দুটো বালিশ ওয়ালের সাথে লাগিয়ে রাখা, দেখে মনে হচ্ছে এদেরকে এখানে কেউ আধশোয়া ভঙ্গিতে মুচড়িয়ে রেখেছে। চেয়ার টেবিল আছে। চেয়ারের উপর একগাদা কাপড় দলা করে রাখা। এগুলো সম্ভবত ময়লা কাপড়, টেবিলের উপর আরেকগাদা লন্ড্রি করা কাপড় দেখা যাচ্ছে। কাবার্ড আছে একটা রুমে, সেখানে ওঠার সৌভাগ্য এদের হবে না। বরং তার অবস্থাও বেহাল। ড্রয়ার আধাখোলা হয়ে পড়ে আছে। সেখান থেকেও কাপড় ঝুলে ঝুলে পড়ে আছে। বই, নিউজপেপার, লিফলেট, ফাইল, ডায়েরি, খাতা, প্যাড সবাই যত্রতত্র পড়ে তিথির দিকে তাকিয়ে আছে যেন। একটা কাপে চা শুকিয়ে কাপ কাত হয়ে আছে। চানাচুরের প্যাকেট খোলা হয়েছিল, স্ট্রাপলারের পিন দিয়ে আটকে ফেলে রাখা হয়েছে। ওয়াশরুমের সামনের পাপোশ চলে এসেছে খাটের কাছে, বিছানার চাদর সরে আলগা হয়ে আছে, সেখানে ভেজা তোয়ালে রাখা। তোয়ালেটা ঝুলছে চিটচিটে ভেজা সেই পাপোশের উপর। শুচিবাইগ্রস্ত শিরিন এই দৃশ্য দেখলে এইবাড়ি থেকে যাওয়ার পর গোসল না করে কাউকে তার ঘরে ঢুকতে দিতেন না।
এইবাড়িতে থাকতে হবে চিন্তা করে তিথি ঘরগুলোকে একটু মানুষ করার চিন্তা করল। ময়লা কাপড়গুলো বেঁধে ফেলল, পরিষ্কারগুলো ভাঁজ করে কাবার্ড গুছিয়ে ফেলল। বিছানা টানটান করল, কাগজপত্র গুছিয়ে একজায়গায় রেখে জানালাগুলো খুলে দিলো। দুপুরের রোদে ঘর ঝিকিমিকি করতে লাগল। বেরিয়ে আসার সময় দরজার পাশের ওয়ালে বড় হোয়াইট বোর্ডে চোখ গেল, মার্কার দিয়ে লেখা ‘love is the seventh sense, which destroys All the six senses.’
তিথি হেসে ফেলল, এই ছেলে অবশ্যই বড়সড় ছ্যাঁকা খেয়েছে।
ঘন্টাখানেকের ভিতর তিথি পুরো বাসাটাই গুছিয়ে ফেলল, কেয়ারটেকারকে ডাকিয়ে একজন ছুটা বুয়া ঠিক করে ফেলল ঘরের যাবতীয় কাজ করার জন্য, ততক্ষণে আশরাফ সাহেব রান্না সেরে ফেলেছেন আর আশিকও ফিরে এসেছে।
বাসায় চারিদিকে তাকিয়ে আশরাফ সাহেব যতই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছেন আশিকের সন্দেহ ততই বাড়ছে। এ তো একেবারেই সিনেমাটিক ব্যাপারস্যাপার। সবাইকে ইমপ্রেস করবে, সবার মনের ভিতর গেঁড়ে বসবে তারপরে একদিন টাকা-পয়সা, সোনা-দানা নিয়ে জবাই করে চলে যাবে। মুখ দেখে তো আর চোর, ডাকাত চেনা যায় না। যদি চেনা যেত কতই না ভালো হতো!
নতুন কাজের লোককে ঘর পরিস্কার করতে দেখে আশিকের সেই সন্দেহ আরও বেড়ে গেল! নানারকম জিজ্ঞাসাবাদ করে দারোয়ানকে ডেকে তবে সে নিশ্চিত হলো, এই কাজের লোক এই বিল্ডিংয়ে আগে থেকেই কাজ করে, বিভিন্ন বাসায় সে বিশ্বস্ত অনেকদিন ধরে। তবুও আশিকের সন্দেহ গেল না, ও সরু চোখে তিথিকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকল। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করতে থাকল। কিন্তু গোল বাধল এই মেয়েটার দিকে তাকালেই ওর আজীবন লালিত চিরকুমার থাকার বাসনায় চিড় ধরতে শুরু হয়। রাগে, দুষ্টুমি করে হলেও তিথির যতটা কাছাকাছি গেছে আশিক এতটা কাছে কখনো কোনো মেয়েকে আসার সুযোগটাই দেয়নি ও। তখন থেকেই বারবার তিথির দিকে চোখ যাচ্ছে, ভাবতে না চাইলেও ওকেই ভাবছে, মন আর মস্তিষ্ক দুটো ভিন্ন পথে চলছে।
আশিক পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে, মরিয়া হয়ে গেছে। হৃদয়ের গোপন কথাটি শুনতে পাচ্ছে না, এভাবে হৃদয় ব্যাকুল হতে পারে ভাবতেই পারে না ও – তাই তিথিকে তাড়াতে আরও ব্যস্ত হয়ে গেছে। আটপৌরে শাড়ি পরে নতুন ছুটা বুয়ার পেছন পেছন তাকে কাজ দেখিয়ে দেওয়ার সময় তিথিকে দেখে আশিক আবারও দোটানায় পড়ে গেল, ওকে কেমন বউ বউ মনে হতে থাকল! লাভ এট ফার্স্ট সাইট কথাটি শুনেছে আশিক, আজগুবি বলেই মেনেছে। এই আজগুবি জিনিস যে লাভ এট ফার্স্ট টাচ হয়ে ওর মনটাকে উলোটপালোট করে দেবে তা ও কোনোদিন ভাবেওনি, আজও বিশ্বাস করল না!
*****
আশিককে যা যা আনতে বলেছিল তার কিছুই আনেনি ও, দুটো জামা-সালোয়ার ছাড়া। এমনকি একটা টাওয়েলও না। তিথির কান্না পেতে লাগল। জামাগুলো দেখে হলো মেজাজ খারাপ। সস্তার জামা, তার উপর জরি,চুমকি আর ডলার দিয়ে জবরজং করা। রঙগুলোও সেইরকম। একটা জামকালার জামার সাথে পেস্ট কালার চুড়িদার আর ওড়না, আরেকটা কটকটা হলুদ জামার সাথে টিয়া রঙের সালোয়ার ওড়না। তিথি যাই পরে ওকে মানিয়ে যায় বলে জামাকাপড় নিয়ে ও কখনোই ঝামেলা করেনি, শিরিন যা পছন্দ করেছে, সোনামুখ করে পরে ফেলেছে। কিন্তু এই জঘন্য জামা দেখে জঘন্য রুচির মানুষটার উপর মন তিতা তিতা হয়ে গেল ওর। তিতা মন আর কুঁচকে থাকা ভুরু নিয়ে ও গোসল করতে ঢুকল। সারারাতের দৌঁড়াঝাঁপের ধকল, কান্নাকাটিতে শরীর ম্যাজমেজে হয়ে আছে। গোসল ছাড়া কিছুতেই ফ্রেশ লাগবে না। ভাবনাচিন্তা করার প্রয়োজনেও ফ্রেশ মাথার খুব দরকার এখন। অনেকক্ষণ সময় নিজেকে শাওয়ারের নিচে ছেড়ে রাখল। মাথার উপর অজস্র জলরাশি চোখের পানির চেহারা নিয়ে বুকের কষ্ট আর সামনের দিনগুলোর অনিশ্চয়তাও ধুয়ে দিয়ে দিচ্ছে। গোসল করে ভেজা চুল মুছতে মুছতে তিথি বেরিয়ে এসে শুনল আশিক বোঝাচ্ছে তার বাবাকে,
— ‘বাবা, এই মেয়েটাকে আমি একদমই চিনি না। তুমি প্লিজ আমার কথাটা বিশ্বাস করো। একবার বিশ্বাস করো। ও স্বীকার করেছে আমার কাছে। সব স্বীকার করেছে।’
— ‘কী স্বীকার করেছে?’
— ‘ওর যে মা, সে আসলে ওর মা না, ওর খালা। সেই খালা মানে ওর মা, কিন্তু আসলে মা না খালা, ওকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে ওর ভাইয়ের সাথে।’
— ‘কী মা না খালা। খালা না মা। কীসব বলছিস?’
আশিক হতাশ গলায় বলল,
— ‘আচ্ছা, বাদ দাও। ওর ফ্যামিলি থেকে ওকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল।’
— ‘সেই কথা তো বৌমা শুরু থেকেই বলেছে, এখানে নতুন করে আলাদা করে স্বীকার করার কী হলো?’
— ‘আরেহ, ও তো বলেছে আমার জন্য বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছে, আসলে ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে তাই পালিয়েছে।’
— ‘তা ঠিকই তো। ভাইয়ের সাথে আবার বিয়ে কীভাবে হয়? পালাবেই তো। না, না বৌমা ঠিক কাজ করেছে।’
— ‘বাবা, ও তোমার বৌমা না। আর ভাই না। ওর খালা যে ওর মা, তার ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছিল।’
— ‘আশিক তুই আমাকে কনফিউজড করে দিচ্ছিস। একবার বলছিস ভাই, আরেকবার বলছিস ভাই না। আবার মা খালাতে ও ঝামেলা করে রেখেছিস।’
— ‘বাদ দাও। আসল কথা হচ্ছে, আমি এই মেয়েটাকে চিনি না আর এই মেয়েটাও আমাকে চেনে না।’
— ‘তবে তো ভালোই হলো। বিয়ের আগে চেনাচেনি না থাকাই ভালো। তোর মায়ের সাথে আমার ভাব-ভালোবাসা ছিল বলেই সে আমার মাথার উপর উঠে কোর্ট মার্শাল নৃত্য করে। তুই অনেক লাকি। তোর বউটা ভালো আছে। কী সুন্দর ঘরদোর সব সুন্দর করে দিলো। আমি বলেছিলাম, আমাদের পরিবারের বউরা তিনদিন বেডরুম থেকে বেরোয় না। তাও শুনল না। সব ঠিকঠাক করে যত্ন করে কাজ করল। তোর মা যে নেই এই বাসাতে, এটা এখন এই বাসা দেখলে কেউ বুঝবেই না। আজকেই চার হাত এক করে দেই। চেনাপরিচয় বিয়ের পরেই হোক, বউয়ের সাথেই ভাব ভালোবাসা তৈরি হোক।’
বউ কথাটায় আশিক একটা ধাক্কা খেল। তিথির স্পর্শ এখনো ওকে ভেতর ভেতর আন্দোলিত করে চলেছে। কিন্তু এমন তো হবার কথা নয়। ও কখনোই কোনো মেয়েকে ওর জীবনে ওর জীবনে আসতে দেবে না, দৃঢ়সংকল্প ওর। প্রেম ভালোবাসার জায়গা ওর জীবনে নেই। প্রেমে পড়ে ভালো ভালো মানুষের মাথা খারাপ হতে দেখেছে ও। তিনটে ভাই ওরা। এক প্রাণ ছিল। আলাদা আলাদা ঘর থাকলেও এক ঘরে একটা পাঁচ ফিট বাই সাত ফিটের খাটে গলা জড়াজড়ি করে ঘুমোতো। একজনের পা আরেকজনের গলায়। হরিহর আত্মা একেবারে। যেই না বড়ভাই আশফি প্রেমে পড়ল সেই তার প্রাইভেসি দরকার হলো, ফোনে কথা বলে প্রাইভেট টাইম পাস করা লাগত, প্রেমিকার সাথে কোয়ালিটি টাইম পার করতে গিয়ে ভাইদের সাথে আর সময় কাটানো হতো না। বেডরুমের দরজা ভেতর থেকে লক করা শুরু হলো, ভাইদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হলো। সেই থেকে প্রেম, ভালোবাসা, নারী এই শব্দগুলো নিষিদ্ধ আশিকের কাছে।
মেজভাই আরাফের বিয়েও যখন ঠিকঠাক হলো, সেও ওই মেয়ের জন্য দিওয়ানা প্রায়, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেই বিয়েতে ভাংচি দিয়েছিল আশিক। আরাফের মন খারাপ হয়েছিল কিন্তু আশিকের সাথে দুরত্ব তো তৈরি হয়নি। এভাবে বিয়েশাদি করে ভাইদের মাঝে অন্য মেয়েদের কেন আসতে হয় বোঝে না আশিক। ওর জীবনেও কোনো মেয়ে আসবে না। তাই, তিথিকে তাড়াতেই হবে। রাগ করে বাবাকে বলল,
— ‘থাক বাবা, বাদ দাও। আমার মাকেই ডাকতে হবে এখন। মা ছাড়া এই মেয়েকে ঘর থেকে কেউ বের করতে পারবে না। আমার ভুল হয়েছে, কাল রাতেই মাকে সব জানানো উচিত ছিল। ভেবেছিলাম মাকে ছাড়াই সমাধান করতে পারব। আসলে আমি শুধু মায়ের দোষটাই দেখি, তোমার মতো সাত লাইন বেশি বোঝা মানুষের সাথে একসাথে বসবাস করতে মায়েরও যে কতটা কষ্ট তা এত দিন বুঝি নাই। মায়ের চিল্লাপাল্লাই আমার কানে বেজেছে, তুমি যে তাকে কতটা ধৈর্যহারা করে দিয়েছ তা আজ বুঝতে পারছি। আমার মাকেই লাগবে এখন।’
তিথি আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনে দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেল। আবার আরেকটা পরীক্ষা! যত সহজে আশিকের বাবাকে ধোঁকা দেওয়া গেছে, ওর মাকে বোকা বানানোটা মোটেই সহজ হবে না। মেয়েদের চোখ এমনিতেই সূক্ষ্ম হয়, সেই মেয়ে মা হলে তার নাক, চোখ, কান, মগজ সব আরও ধারালো হয়ে যায়। তিথির মিথ্যে তিনি চুটকিতে ধরে ফেলবেন।
কী বুদ্ধি করবে এবার তিথি? আশিকের কাছে কত মিনতি করল তবুও আশিকের মন নরম করা গেল না? এই বাড়ি থেকে যদি রাস্তায় নামতেই হয় তবে আশিককেও ও দেখে নেবে।
এই বাড়িতে থাকার জায়গা না পেলেও আশিককে খেলা ও দেখাবেই। আশিকের ট্রামকার্ডের বিপরীতে নিজের হাতের কার্ডের হিসেব-নিকেশ করাতে ব্যস্ত হলো ও…
চলবে…
আফসানা আশা