তিথি – ১৭
তিথি ঘুমিয়ে পড়েছে। টানা দুইদিনের উত্তেজনা আর ক্লান্তির পরে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। চোখজুড়ে ঘুম নেমে এসেছে।
আশিক চুপচাপ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তিথি চুল খুলে দিয়েছে। জানালার খোলা বাতাসে এলোমেলো চুলগুলো আরও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আশিকের চোখেমুখে এসে লাগছে সেগুলো। ওর বিরক্ত হওয়ার কথা কিন্তু কেন জানি ও বিরক্ত হচ্ছে না। চুলের ঘ্রাণে অদ্ভুত মাদকতা আছে। যদিও আশিক জানে এটা চুলের ঘ্রাণ না, দামি ব্রান্ডের শ্যাম্পুর ঘ্রাণ। দুদিন শ্যাম্পু দিয়ে চুল না ধুলে এই একমাথা, একডালা চুল দিয়ে এমন বোঁটকা গন্ধ বেরোবে যে ভূত পালাবে।
তবুও আশিকের কেমন জানি শিহরণ জাগছে শরীরে। তিথির চুলের ঘ্রাণে নাক ডোবাতে ইচ্ছে করছে। এক বোতল শ্যাম্পুতে নাক ডোবালেও কি এরকম অনুভূতি জন্মাবে? একবার চেষ্টা করে দেখতে হবে সেটা।
তিথির প্রসাধনহীন মুখের দিকেও বারবার তাকাতে ইচ্ছে করছে। ওর মুখজুড়ে এই আলো, এই আঁধার। চোখ ফেরাতেই ইচ্ছে করছে না। আবার এবড়োথেবড়ো রাস্তার ঝাঁকুনিতে তিথির ওড়নাটা এসে মৃদু ছুঁয়ে যাচ্ছে ওকে। তাতেও তো কেমন কেমন যেন লাগছে ওর। এই মেয়েটা ব্ল্যাক ম্যাজিকই করে। তা না হলে একবার চুলের জাদু, একবার মুখের মায়ায় কেন পড়ছে আশিক? এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেন? না তে নারীজাতি কেন মোহাবিষ্ট করে দিয়ে যাচ্ছে ওকে? ভাবতে ভাবতে আশিকেরও চোখ লেগে এলো।
আশিকেরই ঘুম ভাঙল আগে। গরমে ঘেমে ঘুম ভেঙেছে। গাড়ি থেমে আছে। যতক্ষণ বাস চলছিল বাতাসে গরম অনুভূত হয়নি। এখন থেমে থাকাতে রাস্তার পাশ থেকে যে হালকা হাওয়া আসছে তাতে ভেতরের ভ্যাপসা গরমটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ননএসি বাস। নরমাল চেয়ারকোচ। এই লাইনে কি এর চেয়ে ভালো গাড়ি চলে না? নাকি মেয়েটা টাকা বাচাতে কম ভাড়ার গাড়ির টিকেট কেটেছে? একটু নড়েচড়ে বসল ও। বাইরে যাওয়া দরকার। হালকা হতে হবে। তিথির ঘুম ভাঙেনি এখনো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ওর বিরক্তি বাড়ল। অকারণ ঝামেলা মাথায় চাপিয়ে দিয়েছে এই মেয়েটা। অফিস থেকে ছুটি নেওয়া হয়নি। এক চার্চ আর স্কুলের সুত্র ধরে ঠিকানা খুঁজে মেয়েটাকে পৌঁছে দিতে কয়দিন লাগবে কে জানে? ততদিনে চাকরি থাকবে তো? নিজের উপরেও বিরক্তি লাগছে। সেধে সেধে ঝামেলা নিলো মনে হচ্ছে। পালিয়ে যেতে পারলেই ভালো হতো। নেমে গিয়ে উল্টোদিকের বাসে উঠে পড়লেই একটানে সকালে ঢাকায়। নিজের পরিকল্পনায় মনে মনে আনন্দে হেসে ফেলল আশিক। মৃদু শিষ দিতে দিতে নেমে গেল বাস থেকে।
মিনিটখানেক বাদে তিথিরও ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ঘুম চোখে কোথায় আছে বুঝতে একটু সময় লাগল। তারপরেই পাশে আশিককে খুঁজল। রাস্তার দুপাশে গ্রাম। সামনে পেছনে গাড়ির সারি। গ্রামগুলোর মাথায় জমাট আঁধার। বাসের জানালা থেকে মাথা বের করেও আশিককে কোথাও দেখা গেল না। তিথির এবারে ভয় করতে লাগল। এই যে বাসে উঠে বসেছে এক অজানা ঠিকানার উদ্দেশ্য এটা হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় না। কোথাও যাওয়ার নেই সেজন্যেও না। অনেকদিন ধরেই তিথি ভেবে আসছিল নিজের শেকড়টা একবার খুঁজে দেখতে হবে। বাবা তো মরেই গেছে, যার জন্য তিথি আর তিথিকে ছুঁয়ে থাকা সবগুলো মানুষের জীবন তছনছ হয়ে গেছে তাকে খুঁজে বের করবে ও। একটাবার তার মুখোমুখি হবে। তাকে জিজ্ঞেস করবে, ‘কেন?’
এতটা অপমানের ভেতর কেন তিথিকে ফেলে রেখে যাওয়া কেন?
শাহানাকে একবার খুঁজে বের করতে চায় তিথি! শাহানার সামনে দাঁড়িয়ে একবার জানতে চাইবে, কীভাবে একটা মানুষকে এতটা লজ্জায় ফেলে রেখে গিয়েছিল যে সেই মানুষটা পৃথিবীর মানুষের চোখের সামনে দাঁড়ানোর চাইতে মরে যাওয়া শ্রেয়তর মনে করেছে? আর তিথির প্রতিদিন মানুষের নোংরা কৌতুহলের সামনে মরে যেতে ইচ্ছে করে, বারবার মরে যেতে ইচ্ছে করে। কথায় আছে, যে মাটিতে আছাড় খেয়েছ, সেখান থেকেই দাঁড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। তাই তিথি সেখানেই যেতে চায়, যেখান থেকে শাহানা হারিয়ে গেছে, জাফর কাকা হারিয়ে গেছে। সেখানে গিয়েই খুঁজবে ও ওদের।
শাহানা কি আর কোনোদিন আসেনি, খোঁজেনি ওকে? জাহিদ নামের লোকটাকে না হয় সে মন থেকে মুছে ফেলেছে কিন্তু তিথি তো শাহানার নিজেরই অংশ। নিজের অংশকে কি এভাবে ভুলে থাকা যায়? শিরিন যেমন এই তিথিকে বকাঝকা করে কাঁদিয়ে দেয় আবার ঘুমিয়ে পড়লেই এসে চুপিচুপি আদর করে যায় তেমনি করে কি শাহানার কখনো তিথিকে বুকে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করে না? অন্য কাউকে না, অন্য কিছু না, তিথিকে একবার দেখতে ইচ্ছে করে না? অবশ্যই করে। সে নিশ্চয়ই কোনো একদিন এসেছে ওখানে। খুঁজেছে তিথিকে। এবার তিথি খুঁজবে তাকে। সামনে বসিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর নেবে, একটা একটা করে। তাকে উত্তর দিতেই হবে। এতদিন এত অপমান তিথির, সেই সব অপমানের উত্তর তাকে দিতেই হবে।
অনেকবার শিরিনের কাছে জানতে চেয়েছে নড়াইলেই ওই ঠিকানা। কিন্তু শিরিন তো কোনোকিছুরই, অপ্রিয় কোনোকিছুরই মুখোমুখি হতে দেবে না ওকে। কিছুতেই বলেনি কিছু। আতিক হয়তো কোনোভাবে জানতে পেরেছিল গ্রামের নামটা। তাই সেদিন ওকে জানিয়েছিল। তাও তো ভুলে গেল ও। এখন কীভাবে খুঁজে বের করবে সেই জায়গা, যেখানে ওর নাড়ি পোঁতা আছে?
কতদিন লাগবে পৌঁছাতে? কত রাত? একা একটা মেয়ে কীভাবে সামলাবে এই রাতের আঁধার? তাই তো আশিককে সাথে আসতে বাধ্য করেছিল। সে কি আশিকের উপর ভরসা করে? মোটেও না।
একটা দিনে কি কখনো ভরসা আসে কারও উপর? আর আশিকের সবটাই তো শত্রুতায় ঠাসা। তবে অচেনা শত্রুর চাইতে চেনা শত্রু তুলনামূলক নিরাপদ।
আর তিথির সিক্সথ সেন্স ওকে আস্বস্ত করেছে, আর যাই হোক বিরুদ্ধতা করলেও, তিথির কষ্ট বাড়িয়ে দিলেও, ওকে পদে পদে নাজেহাল, বিরক্ত, বিব্রত, হেনস্থা করে মজা নিলেও যাকে সত্যিকারের ক্ষতি করা বলে আশিক তা কখনোই করবে না।
কীভাবে এই বিশ্বাস এসেছে তিথির মনে তা জানে না ও, তবে জানে এইটুকুই যথেষ্ট। এইটুকুই অনেক তিথির জন্য। মানুষের কাছ থেকে এর চাইতে বেশি কিছু চাওয়ার নেই তিথির। কিন্তু কোথায় সে? আশিক কোথায়? তিথির হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করল। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে কেঁপে কেঁপে কাঁদতে থাকল ও।
মিনিট দশেক পরে আশিকের কন্ঠ শুনল ও। জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তিথিকে ডাকল। বলল,
— ‘লম্বা জ্যাম সামনে। ঘন্টাদুই লাগবে ঘাটে পৌঁছাতে। ওয়াশরুমে যাবে? গেলে নেমে আসো। নইলে ফেরির আগে আর ফ্রেশ হতে পারবে না।’
কী ছিলো ওইটুকু কথায় জানে না তিথি। ও একছুটে বাস থেকে নেমে আশিকের কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল। আকস্মিকতায় আশিক হতভম্ব হয়ে গেল, কিন্তু বুঝতে পারল তিথির মনের অবস্থা।
তিথির অকূল সমুদ্রে আশিকই এখন একমাত্র খড়কুটোর আশ্রয়!
*****
ফেরিঘাটের গাড়ির জট ঠেলে গাড়ি যখন নড়াইলের লোহাগড়ায় এসে থামল তখন ঘড়ির কাঁটায় দশটা। রোদে ঝলমলিয়ে উঠেছে জেলাশহরের পথঘাট। আশিক আর তিথির মাঝে একটা প্রায় বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব এসে গেছে। দুজনেই প্রতিযোগিতা ভুলে সমঝোতায় এসেছে, তিথি নিজের প্রয়োজনে আর আশিক দায়ীত্ববোধের জায়গা থেকে।
হালকা নাস্তা করে দুজনেই বেরিয়ে পড়ল রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যালয়ে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের জেলা অফিস এখানে। জেলার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বা চার্চ কোথায় কোথায় আছে তার একটা তালিকা পেলে তিথির স্মৃতির চার্চটাকে হয়তো পাওয়া যাবে এই আশায়। কিন্তু হতাশ হতে হলো, এখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের অপূর্নাঙ্গ একটা তালিকা আছে কিন্তু অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে একেবারে কোনো তথ্যই নেই বলতে গেলে। এরপরে গেল জেলা তথ্য অফিসে। সেখানেও কাগজে কলমে কিছুই পাওয়া গেল না। কোনো নথিপত্রেই চার্চের কোনো অস্তিত্ব নেই। হয়তো তিথির স্মৃতি ওকে কোনো প্রতারণা করেছে এই ভেবে একেবারেই হতাশ হয়ে পড়ল তিথি। আর কোনোভাবেই তো খুঁজে পাবে না ওই ঠিকানা। আতিকের ফোন তখনও বন্ধ। আশিকের বাসা থেকে ক্রমাগত ফোন আসায় সেটাও অফ করে রেখেছে আশিক। সকালে একবার সাহস করে আশিকের ফোন দিয়ে রায়নাকে ফোন করেছিল তিথি কিন্তু ফোন ধরেছিল হেলাল। তিথি আর কথা বলেনি, কেটে দিয়েছিল কল।
জেলা অফিসে এসেও কিছু পাওয়া গেল না। সবাই যেন নতুন কোনো গল্প শুনছে এভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছে কিন্তু কারো কাছেই কোনো তথ্য নেই। জেলায় খৃষ্টান অধিবাসীদের সংখ্যা একেবারেই কম, বাস্তবে তাদের কোনো উপাসনালয় থাকলেও কাগজে-কলমে নথিভুক্ত করা নেই। তিথি বুঝে উঠতে পারছে না কোথায় যাবে এরপর। কোন রাস্তায় গেলে পাওয়া যাবে কোনো একটু ইনফরমেশন। নাকি কখনো খুঁজেই পাওয়া যাবে না? মন খারাপ করে তিথি বসে পড়ল একটা বেঞ্চে।
— ‘আপনারা নাকি খেশটানগে মশজিদ খোঁজতেছেন? আমারে কলো একজনে।’
একটু যেন আশার আলো দেখলো তিথি। লুঙ্গি আর ফতুয়া পরা, কাঁচাপাকা দাড়ি মুখে একটা লোক এসে দাঁড়াল সামনে। তিথি তাড়াতাড়ি করে বলল,
— ‘চেনেন আপনি? কোথায় সেটা?’
পান চিবুতে চিবুতে লোকটা বলল,
— ‘সে তো আমাগের গিরামে। গিরামে কাজটাজ নাই, আমি সরকারি অপিসির বাইরি দুকান দিছি, পান-বিড়ি বেচি। আমারে একজনে যায়ে কলো, ঢাকাত্তে দুইজন সাম্বাদিক আসেছে, তারা চার্চ খোঁজতেছে। আমি ভাবলাম আমাগের গিরামে একখান আছে, সেইখেন কি-না?’
— ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। বলেন কোথায় সেটা?’
তিথির যেন আর তর সইছে না। তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ থেকে এক হাজারের একটা নোট বের করে দিলো। আশিক বিরক্ত হলো তিথির উপর। লোকটা আদৌ সত্যি কথা বলছে কি-না তা শিওর না হয়েই টাকা দেওয়ার দরকার কী ছিল! একেই বলে মেয়েমানুষের বুদ্ধি! হাঁটুতেই থাকে!
— ‘তা ধরেন, ইটা হলো ইতনে গিরামে…’ তিথির বাড়িয়ে দেওয়া টাকাটা পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলতে থাকল লোকটা।
তিথি উত্তেজনায় ফুটছে,
— ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ, ভাইয়া এই গ্রামের নামই বলেছিল, আমার মনে পড়েছে।’
— ‘না না, ইতনে না। যদিও ওগের বাজার, রাস্তা সব আমাগের ইতনে গিরামেই কিন্তু খেস্টানরা থাকে নওলি গিরামে। খালের উপর ব্রিজডা পারোয়ে, ইটির রাস্তা। কতদূর গেলেই এটটা স্কুল আর চার্চ। এক ইংরেজ খেস্টান আইসে স্কুলডা খুলেছিল। বিনা বেতনে পড়াতো। দুই, তিনক্লাশ পড়ত। তারপরে গিরামে প্রাইমারি স্কুল হয়ে গেল আর লোকেরা কতো ওই স্কুলে পড়লে সব খেস্টান হয়ে যাবে। তাই স্কুলও বন্ধ হলো। আর খেস্টানরা ছিলই অল্প কয়েক ঘর। তারাও কেউ কেউ লোহাগড়া চইলে আসলো, কেউ কেউ ঢাকায়, কেউ বিদেশ চইলে গেছে। চার্চেও তালা, স্কুলেও।’
তাহলে গ্রামের নাম নওলি। তিথি উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল। খুব কাছাকাছি এসে গেছে ও সেই ঠিকানার। সেই চার্চের কাছে গেলেই, ও চিনে ফেলবে সেই বাড়ি যাওয়ার রাস্তা! নদীঘেঁষে ধুলোওড়ানো লম্বা পথ সামনে। তিথির চোখ আনন্দে চকচক করতে লাগল।
আশিক তাড়াতাড়ি এসে তিথির হাতটা শক্ত করে ধরল। তিথি তা টেরও পেলো না…
ও ভাসছে…
চলবে…
আফসানা আশা