তিথি পর্ব-১৮

0
395

তিথি – ১৮
নওলি গ্রামে যখন পৌঁছালো তিথিরা তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে। পাখিরা ঘরে ফেরার জন্য ডানা ঝাপটে যাচ্ছে। প্রকৃতিও নিরিবিলি হয়ে গেছে। তিথির দেখা সেই আগের মতো কিছু নেই। সব বদলে গেছে। খালের উপর ব্রিজটা একইরকম আছে শুধু। ভেঙেচুরে নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে। নিচের খাল শুকিয়ে গেছে। ভরাট। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে নদীটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। ব্রিজ পার হয়ে লাল ইটের রাস্তাটায় পিচ ঢালাই হয়েছে। দুপাশে আগে শুধুই ধানক্ষেত ছিল যতদুর চোখ যায়- একেবারে দিগন্ত পর্যন্ত। এখন বাড়িঘর উঠেছে। বাজার দেখা যাচ্ছে। বাজারের ভিতর দিয়েই রিকশাভ্যান চলছে ওদের নিয়ে। বাজারে চায়ের দোকানে আড্ডা জমতে শুরু করেছে। বাজার রেখে ওরা ডানদিকে নদীর পাড়ঘেঁষে রাস্তা ধরে চলতে শুরু করল। নদী আগে একেবারে রাস্তার সাথে ছিল, এখন অনেক দূরে সরে গেছে। পানি কমে গেছে। এটা মধুমতি নদী। তিথির নানাবাড়িও বেশি দূর না এখান থেকে। চিত্রা নদী আছে সেখানে। কী বিখ্যাত নদীগুলোর নাম! কী সুন্দর নাম! তিথির স্মৃতিতে নদীটা আছে, রাস্তা আছে, ঠিকঠাক মিলে যাচ্ছে কিন্তু তাদের চেহারায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। এই যে রাস্তাটা ধরে যাচ্ছে ওরা এর দুপাশে এখন পাড়া, পাকা বাড়ি, দোতলা বাড়ি, টিনের বাড়ি, মাটির ঘর সব আছে কিন্তু তিথির স্মৃতিতে রাস্তার দুপাশ জুড়ে শুধু ধূ ধূ মাঠ । বিস্তির্ণ ফসলের মাঠ!
সবচেয়ে অবাক হলো তিথি চার্চের সামনে এসে। ভেঙেচুরে গেছে একদম, কিন্তু সেটা অবাক করা বিষয় না। তিথির কল্পনায় চার্চটা ছিল বিশাল আকৃতি নিয়ে, কী তার জৌলুশ! এখন নিতান্তই ছোট একটা পাকা ঘরের মতো দেখা যাচ্ছে যার মাথায় আধাভাঙা ক্রুশটা ঝুলছে। সামনের স্কুলটাও সেইরকম। আগে কী রহস্যময় লাগত স্কুলটাকে! আসলে চারপাশে বাঁশের চাটাই আর মাথার উপরে টিনের ছাউনি দেওয়া তিনটে কামরার স্কুলঘর। উঁচু বাউন্ডারি দেওয়ালের জন্যই মনে হয় রহস্যঘেরা লাগত। আহা শৈশব! কতই না দারুণ ছিল এই জিনিসগুলো তিথির স্মৃতিতে! আজ এসে না দেখলে সেইরকমই বিশাল মনে হতো এদের সবসময়ই। খুব স্পেশাল মনে হতো। আসলে এরা এত সাধারণ বলেই কেউ চেনেনি এদেরকে, কোনো কাগজ কলমে নেই এদের নাম।
চার্চ আর স্কুল পেরিয়ে নদীর দিকে রাস্তাটা ডানে মোড় নিয়েছে, তিথি সেদিক নির্দেশ করে কাঁপতে লাগল। বুক কাঁপছে, হাঁটু কাঁপছে সমান তালে। বড় একটা বাঁশঝাড়, পুরোনো মসজিদ দোতলা হয়েছে, তারপরেই তিথি আর চেনে না। আগে এতো বাড়িঘর ছিল না। এখন একেবারে ঘনবসতি। হয়তো আগে যেখানে পুকুর ছিল, মাঠ ছিল, গাছের ঝোপ ছিল, এখন সেখানে ঘরবাড়ি উঠে গেছে। ছোটবেলার স্মৃতি সম্বল করে সেখানে পথ চিনে কোনো বাড়ি বের করা অসাধ্য। মসজিদ ছাড়িয়ে ভ্যান রাস্তার একপাশে থামিয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করল তিথি,
— ‘এখানে জাহিদুল ইসলামের বাড়িটা কোনদিকে?’
— ‘কোন জাহিদুল? উত্তরপাড়ার?’
— ‘তা তো জানি না। ওনার ছোটভাইয়ের নাম জাফর।’
— ‘ওহ। ফাঁস নিয়ে মইরেছে যে জাহিদ?’
তিথি একটু দমে গেল। এক মুহূর্ত মাথা নাড়িয়ে জানান দিলো হ্যাঁ সেই জাহিদের বাড়িই খুঁজছে ও।
লোকটা রাস্তা দেখিয়ে দিলো।
সন্ধ্যের কাছাকাছি সময়ে বাড়িটার ভেতরে পা পড়ল তিথির। উঠোনের তিনদিকে ঘর। আগে দেখা তবু সবই অচেনা লাগছে। পুরোনো জরাজীর্ণ বাড়ি। যে ঘরটা ওদের ছিল, যেখানে তিথি ওর বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমোতো, যে বারান্দায় পাটি পেতে ওর মা খেতে দিতো সেটায় আলো জ্বলেনি। উঠোনের অন্যদিকে আগে কোনো ঘর ছিল কি-না মনে নেই তিথির। হয়তো ছিল না। এখন দুপাশেই ঘর উঠেছে। একটা ঘর জাফরকাকার ছিল মনে পড়ল ওর। ওদের ঘরের চেয়ে সেগুলোর চেহারা ভালো। নতুনই করা হয়েছে হয়তো। কে থাকে ওখানে? তিথি ডাকল
— ‘কেউ আছেন?’
দুবার ডাকার পরে মধ্যবয়সী এক মহিলা বের হয়ে এলেন। তিথিকে দেখে জানতে চাইলেন,
— ‘কিডা গো তুমি? কার কাছে আসিছো?’
— ‘এই ঘরের লোক কোথায়?’ তিথি হাত তুলে নিজেদের ঘরটাকে দেখাল।
— ‘ওই ঘরে তো কেউ থাকে না। অপঘাত মৃত্যু হয়েছিল বলে ওইঘর আমরা তালাবন্ধ করেই রাখি। তা তুমি কারে খুঁজতিছো? তুমি কিডা?’
— ‘আমি জাহিদুল ইসলামের মেয়ে। তিথি। এই বাড়িতে কে থাকে এখন?’
— ‘জাহিদ ভাইয়ের মেয়ে? দাঁড়াও দাঁড়াও।’
মহিলা ভেতরে গিয়ে বাইরের আলো জ্বালিয়ে দিলেন। আলোতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তিথির মুখ দেখে বললেন,
— ‘ও আল্লাহ, তাই তো। এ তো একদম ভাবিসাবের মুখটা বসানো। তুমি তো একদম তোমার মায়ের মতো দেখতে হইছো। আসো আসো ভেতরে আসো। আমি তোমার কাকি হই। তোমার কাকা হচ্ছে জাহিদ ভাইয়ের জ্ঞাতি। আপারা কেউ তো আর আসে না ইদিক। আর জাফরও তো নিরুদ্দেশ। আমরাই ভিটে দেইখে রাখি। আসো মা। ভেতরে আসো।’
— ‘আমি ওই ঘরটাতে যাব। তালার চাবি আপনাদের কাছে?’
— ‘চাবি তো আমাগের কাছেই। তয় ওই ঘর তো খুলিনে। চাবি কোনজাগাই রাখিছি খুঁজতি হবে। আর ওই ঘর তো পরিস্কার করিও না। কতদিন আটকা আছে। তুমি কি আজকেই চইলে যাবা? চইলে গেলে খুলে দিচ্ছি। কিন্তু ওইঘরে তো থাকতি পারবানানে? থাকার মতো নেই কিছু। আমরা দেইখেশুনে রাখি আর এইপাশে ঠিকঠাক কইরে নতুন ঘর বানায়ে নিছি।’
আন্তরিক শোনালো মহিলার গলা।
— ‘তুমারে দেইখে আমার কী যে ভালো লাগতিছে। কোনোদিন ভাবিইনি আবার দেখতি পাবো। তুমার মা কী যে ভালোবাসত আমায়। কত আনন্দে ছিলাম আমরা।’
ভ্যানওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে আশিকও ঢুকল বাড়ির ভেতর। ভদ্রমহিলা ওকে দেখে সংকুচিত হলেন। তিথিকে জিজ্ঞাসা করল,
— ‘আমাগের জামাই নাকি?’
বেশ স্পষ্ট করেই তিথি জানাল,
— ‘না, আমার সাথে ঢাকা থেকে এসেছেন উনি।’
— ‘ওহ’
অসন্তোষ মহিলার গলায়। তিনি আর উত্তর করলেন না কিন্তু তিথি দেখল তার মুখটা কালো হয়ে গেছে। মহিলার এতক্ষণের আন্তরিকতাও মিলিয়ে গেল। হুট করে ঘরের ভেতর গিয়ে একটুবাদেই একটা চাবি নিয়ে ফেরত এলেন। মরিচা পড়া একটা চাবি। সেটা দিয়ে বেশ কসরত করে তালা খোলা হলো। দরজা খুলতেই বন্ধ ঘরের ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এসে ঢুকল। আশিক মোবাইলের আলো দিয়ে হাতড়ে সুইচবোর্ডের সন্ধান পেলেও দেখল তাতে আলোর ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুতের কানেকশন নেই।
— ‘আমরা এই ঘরে আসিনে। ঘরের কিছু ধরিনে। তাই কারেন্ট দিয়া হয়নি এই ঘরে।’
এখন? এসে তো পড়ল কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। কিন্তু রাতটা কীভাবে কাটবে? এই ঘর তো থাকার অনুপযুক্ত। আর কাকি দাবী করা মহিলাও আশিকের পরিচয় পেয়ে আগ্রহ হারিয়েছেন নিজের ঘরে তিথিকে থাকতে দিতে।
আশিক পরিস্থিতি বুঝল সহজেই। কিন্তু ওর তিথিকে একা ফেলে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। মুখে সেটা না বলে ও চুপ করে থাকল। তিথিরও সাহস হচ্ছে না আশিককে চলে যেতে বলার। আশিকই যেন ওর সবচেয়ে আপনজন। দুজনেই চুপ করে থাকল।
— ‘কাকি, আপনি কি কাউকে ডেকে ঘরটা একটু পরিস্কার করিয়ে দিতে পারেন? টাকা দিলাম আমি প্রয়োজনে। আর একটু আলোর ব্যবস্থা করা দরকার।’
তিথির কন্ঠে স্পষ্ট কর্তৃত্ব৷ তিথি জানে এই বাড়ি, জায়গার মালিক তিথি, অন্য যারা বসত করছে তারা দখলকারি অথবা আশ্রিত। নিজেরটুকু এখন নিজের প্র‍য়োজনেই বুঝে নিতে হবে ওর। এগুলো কিছু দাবি করবে না বা এসব কিছু নেওয়ার ইচ্ছেও নেই ওর। কিন্তু নির্বিঘ্নে প্রয়োজনীয় সময়টুকু কাটাতে এদের সহযোগিতা তিথির দরকার। তাতে একটু কঠিন হতে হলেও তাই হতে হবে।
— ‘এখন?’
মহিলা বাইরে চলে গেলে ঘরের অন্ধকার ছেড়ে বারান্দায় এসে বলল আশিক।
— ‘জানি না। তবে আজ রাতে তো কিছুই হবে না। কাল সকালে ঘরটাতে খুঁজব, কিছু পাই কি-না। বাবা কিছু লিখে রেখে গেছেন কি-না। মা কোনো চিঠি রেখে যেতে পারে। জানি না। হয়তো কিছুই নেই। আশেপাশের লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করব। এই কাকির কাছে জানতে চাইব। দেখি?’
— ‘এরা তো আমাকে দেখে বিরূপ আচরণ করছে। সত্যিটা না বললেই হতো। দুদিনই তো। তাতে সহজ হতো না ব্যাপারটা?’
— ‘হয়তো। তবে জানো কি, কী হলো? আমার মা সবসময় আমার জীবনকে সহজ করতে গিয়ে আমাকে কখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতেই দেয়নি। চোখ তুলে কথা বলতে দেয়নি। তার কোলে মাথা গুঁজে দুনিয়ে দেখেছি আমি, মেরুদণ্ড সোজা করতে শিখিইনি। এইসব নোংরা চাহনি, ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের অভ্যাস আছে আমার। পাশ কাটিয়ে যেতেই জানি আমি। কখনো মা এটা শেখায়নি যে যেখানে আমার অন্যায় নেই, অপরাধ আমি করিনি, সেখানে আমার মাথা নিচু হবে কেন? আজকে একটা নতুন জীবন বেঁচে দেখলাম কেমন লাগে? একটু কঠিন হবে, মনজিল দূরে সরবে তবে মনোবল অটুট থাকলে প্রাপ্য আমি ঠিকই পাব। লোকের বাঁকা চোখের ভয় আমি আর করব না।’
— ‘বাহ! না তে নারীজাতি আর বিপ্লব? এই দুটো একসাথে কীভাবে যায়? মাথা সোজা করার ভূত চেপেছে। গ্রামদেশে স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষের সাথে রাত কাটালে নতুন সোজা করা এই মাথাটা আর ঘাড়ে থাকবে না। হুহ। কী প্রতিবাদ! এই, এই, বলো তো এই বুদ্ধি নিয়ে রাতে ঘুমাও কী করে? অনেক বুদ্ধি আছে তো জানতাম। নাকি সব জমিয়ে রাখা বুদ্ধি আমার পেছনে খরচ করে ফেলেছ? তোমার এই বিপ্লব দুটোদিন পরে করলে কী হতো?’
তিথির চোখে পানি এসে গেল। সেটা লক্ষ্য করে আশিক আবার বকল ওকে,
— ‘আরেহ ছিঁচকাঁদুনে রানি দেখছি। নারীজাতির ষোলোকলার অন্যতম ছলাকলা। একটু চোখের পানি বাঁচিয়ে রাখো, সোনা? রাতটা কীভাবে কাটবে সেটা ভাব।’
— ‘কীভাবে?’
তিথিকে উৎসুক হতে দেখা গেল।
— ‘সেটা আমি কী জানি? ভাববে তো তুমি। তোমার বাড়ি। তুমি আমাকে সাথে এনেছ।’
— ‘একটাই তো রাত। এইভাবে কোথাও বসে টসে কাটিয়ে দেওয়া যাবে।’
— ‘বাঘে এসে তুলে নিয়ে যাবে।’
— ‘যাহ! এটা কি সুন্দরবন?’
— ‘সেটা এক রাত ঘরের বাইরে কাটালেই বোঝা যাবে। তারপর বুঝে যাবে বাঘ ভালুক শুধু জঙ্গলে না লোকালয়েও থাকে। তুমি ঘরের ভেতর থাকলে নাকি বাইরে সেটা মুখ্য না, মেইন ব্যাপার হচ্ছে তুমি একটা ছেলের সাথে রাত কাটালে। সকাল হলে এই লোকালয়ের বাঘ ভালুকরা তোমায় টেনে টেনে খেয়ে ফেলবে।’
— ‘তবে? কী করব এখন?’
— ‘আমি এখানে এই ঘরে ঢুকে যাচ্ছি। হালকা একটু ঝাড়ুর বাড়ি পড়লেই হবে। তুমি ওই আন্টিটাকে ম্যানেজ করো তার ঘরে থাকা যায় কি-না? আর খাওয়ারও তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আমি বাজার ঘুরে আসি। এদের জন্য কিছু নিয়েও আসি। ব্যাগভরা বাজার দেখলে এদের মন নরম হবে।’
— ‘তুমি যদি পালিয়ে যাও?’
তিথিকে ভীত দেখাল।
— ‘সে সুযোগ তো রইলই। পালাতেও পারি।’
হাসল আশিক।
— ‘ঢাকা ছাড়ার সাথে সাথে তোমার বুদ্ধিও তোমাকে ছেড়েছে। এখন শুধুই ভয় পাচ্ছ। আমাকে যখন জোগাড় করতে পেরেছ তো বাকি রাস্তা আমি না থাকলেও তুমি পার হয়ে যেতে পারবে। বি ব্রেভ, বি ইয়োরসেল্ফ! বিপ্লবী না হয়ে বুদ্ধিমতি হও!’
একটু বাদেই সেই কাকিকে দেখা গেল অন্য একজন মহিলাকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। হাতে চার্জার লাইট আর ঝাড়ু, বালতি ভরা পানি। বিছানার চাদর ঝেড়েঝুড়ে পরিস্কার চাদর বিছানো হলো, ময়লা ধূলা উপর উপর ঝাড়া হলো, মেঝেতে পানি ঢেলে দিয়ে ঝাড়ু দিয়েই ঠেলে পরিস্কার করে ঘরটাকে রাত কাটানোর উপযুক্ত করা হলো।
আশিক বাজারে গেছে, তিথি উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল। পরিস্কার করা শেষে কাকি যখন ডাকল তিথিকে ও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। চার্জারের আলোতে ঘর দৃশ্যমান। সেই ঘর, সেই খাট, সেই আলমারি, একটা আলনা, আলনায় এখনো ওর বাবা-মায়ের ব্যবহৃত কাপড় ঝুলছে। একটা ড্রেসিং টেবিল। সেখানে মায়ের ছোঁয়া সব জিনিস। একটা চিরুণি, তিব্বত পমেড, কাজল, চুড়ি, হাঁসমার্কা নারিকেল তেল – সব তেমনি পড়ে আছে, শুধু ধূলোয় মলিন হয়েছে। মাথার উপরে আড়কাঠে ফ্যান ঝুলছে। এখানেই ঝুলে ওর বাবা সব অপমানের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন! কেঁপে উঠল তিথি। কাকিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো।
আশিকও ফিরল বেশ ব্যাগভরা বাজার নিয়ে। গ্রামের বাজারে এই রাতে বেশি কিছু পাওয়া যায়নি। চাল, ডাল, তেল ছাড়াও ডিম আর গোটাদুই মুরগি দেখা যাচ্ছে। মিষ্টির প্যাকেট, বিস্কিট, দুই লিটার কোল্ড ড্রিংকস এর বড় বোতল। যা যা পেয়েছে তাই এনেছে।
সেই রাতে উনুন জ্বালিয়ে রান্না চড়ল আবার।
— ‘তোমার কাকা জাহিদ ভাইয়ের কাছে ভাইয়েরও বেশি ছিল। জাহিদ ভাই, জাফর ভাই আর তুমাগের এই কাকা একসাথেই বড় হইছে, একসাথে স্কুলেত গেছে। পাশের ভিটায় আমাগের ঘর ছিল। তোমার মায় আমারে খুব ভালোবাসত। রাঙাবউ কয়ে ডাকত। তুমিও আমারে রাঙাকাকি বইলো।’
— ‘আপনি কতদিন দেখেছেন আমার মাকে?’
— ‘এই ধরো বছর পাঁচ। তুমি তখন স্কুলে যাওয়া শুরু করছ, তখন আমার বিয়ে হলো আর আমি এই বাড়ি আলাম৷ আমার ছেলেমেয়েও হয়ে গেছে তখন। আমি ভাবির পিছপিছ থাকতাম। কী যে হাসিখুশি মানুষ ছিল! একবার হাসতে শুরু করলে চোখ দিয়ে পানি না আসা না পর্যন্ত থামত না সে। আর হাসত ও কথায় কথায়। ভাইজানে বকত, আবার নিজেই হেসে ফেইলত ভাবির হাসি দেখে। এমন হাসিখুশি পরিবার আমি আর কোনোদিন দেখলাম না।’
— ‘আপনি ছিলেন তখন এই বাড়িতে? সেইদিন?’
তিথির গলাটা কেঁপে উঠল।
রাঙাকাকিও চোখ বড় করে তাকালেন। তারপর চুলোর আগুন উসকে দিয়ে মাথাটা শুধু উপর-নিচ করলেন।
— ‘কী হয়েছিল সেদিন?’
ব্যাকুল জিজ্ঞাসা তিথির।
— ‘আমি জানিনে।’
রাঙাকাকি তাকাল না তিথির দিকে।
— ‘রাঙাকাকি, আমি শুধু আমার মাকেই খুঁজতে খুঁজতে এসেছি।’
— ‘সে তুমারে খোঁজেনি কোনোদিন?’
— ‘না।’
— ‘এত পাষান সে হলো কিরাম কইরে? তুমারে সে চোখে হারাতো। কইতো তুমি তার কলিজা।’
— ‘কাকি?’
— ‘হয়। কী থেকে কী হলো জানিনে। জাহিদ ভাইয়ের সাথে ঝগড়া হইছিল। সে প্রায়ই তারা কাইজে করতো। ভাইজান রাগ করে বাইত আসতো না। আবার মিলেমিশে যেত দুজন। তুমারে ঘুম পাড়িয়ে পুকুরের পানিত পা ডুবিয়ে বসে থাকত দুজন, রাত্তিরে, চান্দের আলোয়। আমি বেড়ার ফাঁক দিয়ে দুজনরে দেখে কত হাসতাম আর শরম পাইতাম।’
— ‘তারপর?’
— ‘ভাবি রাগ করে থাকলে ভাইজান নতুন শাড়ি আনত। লোহাগড়া থেইকে মিষ্টি আনতো। রঙিন প্যাকেটের বিস্কুট আনত।’
— ‘তারপর?’
— ‘ভাইজান রাগ কইরে থাকলি ভাবি ভাত খেত না। ভাবিকে ভাত খাওয়াতি তখন ভাইজানই আবার রাগ ভুলে হাত পায় ধরত।’
— ‘তারপর? সেইদিন কী হয়েছিল?’
— ‘জানিনে। সেইদিনও তো চিল্লাচিল্লি হলো। ভাবিজানের শরীরটা খারাপ ছিল। মনে হয় পোয়াতি হইছিল আবার। ভাবিজানের এক বোনের আসার কথা ছিল। আমি আর ভাবি মিলে চাল কুটলাম, রান্নবাড়া করলাম।’
–‘ঝগড়া কেন হয়েছিল?’
— ‘জানিনে। তাদের কথার ভেতর কেউ ঢুকুক ভাইজানে চাইত না। ঝগড়াঝাঁটি শুনলে তাই এই বাড়ি আমরা আসতাম না। তবে আন্দাজ করেছিলাম ভাইজান আর বাচ্চা চাইত না। ভাবির শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছিল নাকি তুমি হওয়ার সময়। ভাবির মরণ- বাঁচন লেগেছিল।’
— ‘ঝগড়া করে মা চলে গেল?’
— ‘হয়। আমাগের সাথে কথাও কলো না। অন্যদিন ঝগড়া করে ভাইজান বাড়ি ছাড়ে, সেদিন ভাবি বাড়ি ত্যাগ দেলো।’
— ‘তাহলে জাফর কাকা?’
রাঙাকাকি চুলোর আগুনের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন,
— ‘জানিনে আমরা কিছুই। ভাবিজান বের হলেন দেখলাম। তারপরেই জাফররে দেখলাম পেছন পেছন বের হতে। ভাবি আর ফিরল না। খবর পেলাম বাপের বাড়িত যায়নি। জাফর ও আর ফিরল না। আমি বিশ্বাস করি না, মাগো, একগলা পানিতে দাঁড়িয়েও এইকথা আমি বিশ্বাস করি না। তয় পাঁচটা দিন লোকের কথায় টেকা গেল না। না টিকতে পাইরে ভাইজান ফাঁস নিলো। ওই ঘরের মধ্যে এক সকালে আমিই প্রথথম দেখলাম তারে।’
রাঙাকাকি কেঁদেই যাচ্ছেন। তিথিও কাঁদছে।
— ‘কাকা আর মা….?’
তিথি কথা শেষ করল না।
— ‘জাফর ভাই আমুদে মানুষ ছিল। ঢাকায় পড়ত। ছুটিতে বাড়ি আসত। বাড়িতে উৎসব লাইগে যেত সেদিন। সবাইকে ডাইকে ডাইকে কথা বলত সে। পোলাপানগুলোরে পড়াইতে বসাতো। মাছ ধরতে যেত। তোমারে কান্ধে নিয়া নাচত। হাসি ঠাট্টা করতো ভাবির সাথে। ভাবিকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাইত। ঢাকাত্তে আসার সময় ভাবির জন্য শাড়ি আনত। ভাবি ফুল পছন্দ কত্তো, ফুল কিনে আনত। কয়দিন ভাবি খুব আনন্দে থাকত। লোকে এইগুলো ভালো চোখে দেখত না। কানাকানি করত। ভাইজানের কানে কথা তুলত। তিলকে তাল কত্তো।’
— ‘মা আর কোনোদিন আসেনি? আপনাকে কোনোদিন কোনো খবর দেয়নি?’
— ‘না। সে একবার আসলেই তো সব পরিস্কার হয়ে যেত। মানষে দুয়ে দুয়ে চার মিলাইল। জাফর ভাইও ফিরল না, সেও ফিরল না। দুইজনেই নিরুদ্দেশ। তাই লোকে কলো, তারা একসাথেই নিরুদ্দেশ হয়েছে। জাহিদ ভাই ঘরের থেকে বেরুতে পাততো না। বউ পালানো যে পুরুষের জন্য কত লজ্জার! তাও আপন ছোটভাই! সবচেয়ে আপন দুইটা মানুষ বেইমানি কল্লো। ভাইজান লোকের সামনে আর মুখ বাইর করবে কেমনে? পুরুষ মানুষের আর কী থাকল বাকি? আমি আজও ভাবি, কী করে তারা পারল ফেরেশতার মতো মানুষটার বুকে দাগা দিতে? তারা তো খুনই কল্লো মানুষটারে!’
মায়ের প্রতি ঘৃণা দ্বিগুণ হলো তিথির। আকন্ঠ ঘৃণার আগুনে পুড়তে পুড়তে মায়ের গল্প শুনল রাঙাকাকির কাছে সারারাত। ভোরের দিকে চোখ লেগে এলো। সকালের দিকে ঘুম ভাঙলো চিৎকার, চেঁচামেচিতে। রাঙাকাকির তিন মেয়ে দুই ছেলে। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন পাশের গ্রামে। দুই ছেলে লোহাগড়ায় রাজমিস্ত্রীর যোগালের কাজ করে। আর ছোটো মেয়েদুটো বাড়িতেই রাঙাকাকির সাথেই থাকে। কাকা গত হয়েছেন। ঘরবাড়ি করা হয়নি। তিথির বাবার যা কিছু জমিজমা,পুকুর, বাড়ি দেখাশুনা করেন, জমির আয়, পুকুরের মাছ আর ছেলেদের আয় দিয়ে সংসার চলে। নতুন ঘরও উঠাতে পারেন নি। আগের ঘরগুলোই সংস্কার করে চলছে দিন। তিথির বাবার ঘরটা সবচেয়ে ভালো হলেও ওই ঘরে ভয়ে কেউ থাকতে চায় না। আজকে আশিক ছিল। রাতেই হয়তো রাঙাকাকি ছেলেকে জানিয়েছিলেন ফোনে তিথির আসার খবর। এখন তার ছেলেরা এসে হাঁকডাক জুড়ে দিয়েছে সকাল সকাল।
— ‘কী এত্তদিন পরে আইসে জুইড়ে বসেছে। ওরে ঢুকতি দিলো কিডা?’
— ‘মায়ের চরিত্র পাইছে। পরপুরুষ নিয়ে বাইত আইছে।’
— ‘কাকার বাড়িত কোনো নষ্ট মাইয়েছেলে থাকতি দেবো না। কোন সাহসে ঢুকল এই মাইয়ে? বের হ এখনি বের হ। এই গিরামে ঢুকলি কোন সাহসে?’
তিথির কানে গরম সীসার মতো ঢুকছিল সব। রাঙাকাকির দিকে একবার তাকাল তিথি। এত বিষ অন্তরে চেপে রেখেছিলেন এই মহিলা, গতরাতের আন্তরিকতায় একটুও টের পায়নি ও। আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে বাইরে এলো ও।
বেশ লোক জড়ো হয়েছে বাইরে। দাঁত বের করে হাসছে। দুটো ছেলে হম্বিতম্বি করে যাচ্ছে। ষোলো সতেরো বয়স হবে। ময়লা, সস্তার জিন্স আর শার্ট পরা। দুজনের হাতেই লাঠি, মারমুখী ভঙ্গি! উল্টোদিকের ঘরের বারান্দায় আশিককেও দেখা গেল। ঘুমভাঙা চোখে বেরিয়ে এসেছে।
তিথি হাত ইশারায় ছেলেদুটোকে ডাকল। ফুঁসতে ফুঁসতে একজন বলল,
— ‘তুমারে এই বাড়িত থাকতে আমরা দিবো না। জাহিদ কাকার বাড়ি কোনো বেবুশ্যের ছোঁয়া লাগতে দেবো না। ফুফুগের ফোন করেছি, তারা বলেছে তোমারে বের করে দিতি।’
এদের ঔদ্ধত্য দেখে তিথি অবাক হয়ে গেল। এই সব সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশ তিথি। ফুফুদের সেখানে বলার কিছু নেই আর এরা তো একেবারেই উটকো। তিথি নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
— ‘আমি থাকতে এসেছি তোমাদের কে বলল? আমি এসব বেঁচ দেবো। খদ্দের সাথে নিয়ে এসেছি। বায়না হয়ে গেছে। ওই যে, ওই সব কিনে নিচ্ছে।’
আশিককে দেখিয়ে দিলো তিথি।

তিথির উপস্থিত বুদ্ধিতে আশিক অবাক হলো না একটুও, এর বুদ্ধির অভিজ্ঞতা ওর আছে, বিপদের মুখে পড়ে ওর বুদ্ধি আশ্চর্যজনক ভাবে খোলতাই হয়ে যায়। ছেলেদুটো থতমত খেয়ে গেল। ওরা এসেছিল তিথিকে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিতে। দখল করা সম্পত্তিতে যেন তিথি ভাগ না বসায়, কিন্তু উলটো হলো ঘটনা। যদি সব বিক্রি হয়েই যায় তবে আর যার যাই হোক না কেন এদের লবডঙ্কা! তিথির মায়ের চরিত্র সর্বজনবিদিত, লোক জড়ো করতে কষ্ট হয়নি, তিথিকে চুনকালি মাখিয়ে বের করে দেওয়াটাও কষ্টের না। কিন্তু সম্পত্তি হাতবদল হলে ওদের তো আর কিছুই করার নেই।
ফুঁটো হওয়া বেলুনের মতো চুপসে গেল সব। গজরাতে গজরাতে বাড়ির ভেতর ঘুরতে লাগল। মজা নেওয়া লোকের ভিড়ও কমতে লাগল।
তিথি আর কিছু বলল না। পুকুরের পানিতে মুখ ধুলো, কিছুক্ষণ পা ডুবিয়ে বসে থাকল আশিককে সাথে নিয়ে। বাড়ির কোণাকাচা ঘুরে ঘুরে দেখল তারপর বাবার ঘরে গিয়ে ঢুকল। আলমারি খোলাই ছিল, সবকিছু একটা একটা করে খুঁজল। যা খুঁজছে, কোনো একটা চিঠি বা কোনো ফোন নাম্বার, ঠিকানা কিছুই পেলো না। শুধু কিছু বই আর একটা প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া ফটো এলবাম। তিথি, তিথির মা আর তিথির বাবা – একটা সুখি পরিবার, সেই সুখি পরিবারের উপর হাত বুলিয়ে দিলো তিথি।
নতুন তালা এনে লাগিয়ে দিলো ঘরে। রাঙাকাকির সামনে এসে বলল,
— ‘রাঙাকাকি, আমি আপনাকে ঘরছাড়া করতাম না। করব না। সবকিছু আমার, আপনি থাকুন এখানে। আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি বিঘ্ন ঘটাতে আসব না। হঠাৎ হঠাৎ কোনোদিন হয়তো আমার বাবার ঘরে থাকতে আসব। তবে কিছু নিতে আসব না। তবে কাল যা কিছু বলেছেন তার বাইরে যদি কিছু বলার থাকে বলে দিন আমাকে। কিছু যদি জানেন…’
রাঙাকাকি এবার হাউমাউ করে কাঁদলেন। ঘরে গিয়ে ভাঁজে ভাঁজে মলিন হওয়া এক টুকরো কাগজ এনে দিলেন তিথির সামনে,
— ‘ভাবি আসছিলো। ঘটনার অনেকদিন পরে তুমার মায় আইছিলো, এক রাইতের বেলায়। যেদিন তোমার বাপ ফাঁস দিলো তারও তিন চার বছছর পরে আইছিলো। আমি জিগাইছিলাম, কী ঘটনা? কিছু না কয়ায় ফেরত গেছিলো, শুধু কানছিলো। ওই ঘরের খাটের উপর বইসা শুধু কানছিলো। এই ঠিকানাডা দিয়ে গেছিলো। কইছিলো যদি কোনোদিন তুমি আসো, তো তোমারে এইটা দিতে। আমি তুমার ফুফুগোরে দিতে চাইছিলাম ঠিকানাডা কিন্তু তুমার কাকা আটকাইলো আমারে।’
আবারো কেঁদে দিলেন মহিলা,
— ‘আমরা লোভ করেছিলাম, মাগো। মাফ কইরে দেও আমারে। তুমরা যদি মিলমিশ হয়ে যাও, এই বাড়িত আইসা থাকতে চাও তো, এই সবকিছু তো ছাইড়া দিতে হবে, তাই ভয় পাইছিলাম। তাই লুকাইতে চাইছিলাম। ‘
তিথি কিছু বলল না। কিছু যায় আসে না এসবে। যিনি উপরে বসে পরিকল্পনা করেন তার হাতের পুতুল সবাই। আশিক জানতে চাইল,
— ‘এবার?’
— ‘বাবার কবর দেখা হয়নি কোনোদিন আমার। চলো যাই?’
নিজের জন্মস্থান ছেড়ে আবারও পা বাড়াল তিথি অজ্ঞাতবাসে থাকা সেই মায়ের খোঁজে …

চলবে
আফসানা আশা