তিথি পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0
1086

তিথি – ১৯ (শেষ পর্ব)

খালেক সাহেবের বাড়ি অর্থাৎ আতিক, রায়নার দাদাবাড়ি খুলনা শহরে। খালেক সাহেবের পোস্টিংও আগে খুলনাতেই ছিল। পরে ঢাকাতে আসার পর, ইদের বা গরমের ছুটিতে কোনোবার নানাবাড়ি তো কোনোবার দাদাবাড়ি যাওয়া হতো। তিথিও সাথে যেত। যশোর পার হতে হতেই উত্তেজনা আর আনন্দ বেড়ে যেত সবার। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে প্রতিটি দোকানের সাইনবোর্ড পড়ত ওরা। প্রতিটি জায়গার নাম মুখস্থ হয়ে যেত তখন।

রাজঘাট জায়গাটাও তিথির চেনা নাম। রাজঘাটের একটা পাটকলের শ্রমিক কলোনিতে বসে আছে তিথি এখন। জুটমিলের বাইরের গেইট দিয়ে ঢুকে সোজা মিলের ভিতর না গিয়ে ডানে খানিকটা রাস্তা ঘুরে আবার বাঁয়ে মোড় ঘুরলেই সারি সারি ঘর। এটাই নাকি কলোনি। মাটির মেঝে, পাশে বাঁশের বেড়া, উপরে গোলপাতার ছাউনি। লম্বা একটা ঘরের মাঝখানে চাটাই দিয়ে পার্টিশন করা। ওপাশে একটা চৌকি, এপাশে একটা চৌকি। মাঝখানে শোকেস আছে একটা। সেটার একপাশের দরজা ভেঙে গেছে, দড়ি দিয়ে বেঁধে আটকে রাখা হয়েছে। শোকেসের কাচ নেই। সবকিছুতে ময়লার আস্তর। একটা একুশ ইঞ্চি রঙিন টিভিতে স্টার জলসা চলছে। একটা আলনা এদিকে। আলনায় কাপড়ের টাল হয়ে আছে। দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট চারিদিকে।
ঘরের লাগোয়া একচালা রান্নাঘর। মাঝখানের দুইহাত চলাচলের পথটা স্যাঁতসেঁতে, পিচ্ছিল। ঠিক ওইপাশেই আরেকটা ঘর। সব একটার সাথে আরেকটা লাগানো। এদের নিত্যকর্ম, পানি বা গোসলের কী ব্যবস্থা ভেবে অবাক হলো তিথি। আসার সময় খোলা জায়গায় চাপকল দেখে এসেছে, সেটাই কি? তবে মেয়েরা গোসল কোথায় সারে?
রাঙাকাকির দেওয়া কাগজটাতে এই ঠিকানাটাই লেখা ছিল। এখানে কাকে দেখবে, কাকে পাবে, কী সংবাদ পাবে, আদৌ কিছু পাবে কি-না জানে না তিথি। কী সংবাদ চাইছে তিথি, কী জানলে খুশি হবে তাও জানে না। এমন কোনো সত্যের মুখোমুখি হতে পারে আজ ও যে সত্য ওকে শুধু মানুষকে ঘৃণা করতেই শেখাবে! সত্যিটা কি খুব নোংরা হবে? সেই নোংরা সত্যি জানার জন্যই কি এতটা দূর এসেছে তিথি?
একটা অল্পবয়সী মেয়ে ঢুকল ঘরে। মলিন পোশাক। ঢুকেই বলল,
— ‘কে আসছে খালা? ঘরে লাইট দাওনি কেন?’
লাইট জ্বলছে ঘরটাতে দিনের বেলায়ও। সূর্যের আলো এই বস্তির গলিপথে ঢুকতে পায় না। একটা লাইট পার্টিশনের ওইপাশটা আলো করে রেখেছিল, এইপাশ অন্ধকার। সেখানেই আশিক আর তিথি বসেছিল। ওদের সামনে শরবতের গ্লাস। আশিক একটানে নিজেরটা শেষ করে তৃপ্তির শ্বাস ফেলেছে। শিরিনের শুচিবায়ু শিক্ষা তিথিকে ওই গ্লাস ছুঁতেও দেয়নি।
যে মেয়েটা ঘরে ঢুকেছিল তার বুকের কাছে বই ভাঁজ করা ছিল। বইগুলো ভাঙা শোকেসের উপর রেখে এইপাশের বাতিটা জ্বালিয়ে দিলো মেয়েটা আর সাথেসাথেই তিথি চমকে উঠল। অবিকল চৌদ্দ বছরের তিথি। নিজের মুখে হাত বুলালো তিথি অজান্তেই । অনেকখানি খাঁড়া নাক, নাকের দুপাশে চমৎকার খাঁজকাটা, ভরা পূর্নিমার চাঁদের মতো মুখ, পাতলা ঠোঁট, ঠোঁটের কোণে হাসি – যেন আয়না দেখছে তিথি। মেয়েটারও চোখ বড় বড় হয়ে গেল কিন্তু চমকালো না বড় একটা। প্রশান্ত হেসে জড়িয়ে ধরল তিথিকে। তিথির দিক থেকে কোনো উষ্ণতা না পেয়ে বিব্রত হয়ে ছেড়ে দিলো। ইতস্তত করে বলল,
— ‘আমার গায়ে কি গন্ধ করতিছে? স্কুলে যাওয়ার আগে দুইটা, স্কুল শেষ করে আরও দুইবাড়ি পড়ায়ে আসলাম। কেউমেউ করা ছোটো বাচ্চাগেরে পড়াই। আমি ক্লাশ এইটে পড়ি, বাচ্চা ছাড়া কে পড়বে আমার কাছে? গোসল করার টাইম পাইনে। আর কলতলাও খালি পাওয়া যায় না।’
বলতে বলতে একটা মোড়া টেনে এনে বসল সামনাসামনি মেয়েটা। তিথির দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট করে বলল,
— ‘মা বলছিল আপনার কথা। আপনি আমার আপা হন। আমি ছোটবোন আপনার। আপনার সব জানি আমি। আপনার নাম তিথি। আপনি টক আচার খাইতে খুব পছন্দ করেন। আপনি বেড়াল ভয় পান। মাঝরাইতে খিদা লাগে আপনার…’
মেয়েটি তড়বড় করে বলেই যাচ্ছে। তিথির গলা কাঁপছে। কান্না দলা পাকিয়ে উঠে আসছে। ঘৃণায় মুখ সিঁটকে আসছে। ঘৃণাটাকে জিতিয়ে দিয়ে ও মেয়েটির আবেগটুকু থামিয়ে দিয়ে বলল,
— ‘তোমার মা কোথায়?’
মেয়েটি কড়া চোখে তাকালো তিথির দিকে। এতটুকু মেয়ের দৃষ্টি এত তীব্র যে তিথি চোখ নামিয়ে নিলো। তারপর চোখের দৃষ্টির চাইতে তীব্রতর করে মেয়েটি বলল,
— ‘আমার যে মা সে আপনারও মা।’
তিথির মেয়েটাকে বেয়াদব মনে হলো। এতো ঋজু হয় নাকি এতটুকু মেয়ে? গলার স্বর যেন ধার করে এনেছে সেভাবে বলল,
— ‘কোথায় তিনি?’
— ‘আপনি মায়ের কাছে আসেননি। আপনার প্রশ্নের উত্তর নিতে এসেছেন।’
তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলেই চোখ নামিয়ে নিলো মেয়েটি। তিথি দেখেছিল চোখে আগুন জ্বলছে ওর। কই তিথির চোখে তো এমন আগুন জ্বলেনি কোনোদিন! মেয়েটি চোখ তুলে আবার বলল,
— ‘বেশ, যা চাইছেন আপনি তাই পাবেন।’
তিথির পায়ের কাছে চৌকির নিচে একটা টিনের ট্র‍্যাঙ্ক রাখা আছে। মেয়েটা ঘটাং করে তার ডালা খুলল। হাত ঢুকিয়ে দিয়ে একটা খাম বের করে তিথির হাতে দিলো। বলল,
–‘আমার নাম জানতে চাননি আপনি একবারও। তার কোনো দরকার নেই আপনার হয়তো। আমার নাম তিতলি। আপনার নামে মিলিয়ে।’
একটু হাসলো তিতলি। তারপর বলল,
— ‘আপনি মাকে খুঁজলে তাকেই পেতেন। কিন্তু আপনি যা খুঁজছেন তা এখানে আছে। মা বলেছিল আপনি আসবেন। একদিন জীবনের চাইতে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আপনার জন্য যেন বেশি জরুরি হবে।’
তিথি অবাক চোখে তাকাল তিতলির দিকে। তিথির চেয়ে আট বছরের ছোট, কিন্তু অনেক পরিণত, অনেক ব্যক্তিত্বধারী। ওর হাত থেকে খামটা নিয়ে খুলল তিথি। খামটা দিয়েই তিতলি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সুন্দর রুলটানা খাতার কয়েকটা পাতা। শুরুতেই লেখা
‘আমার ইটলি বিটলি সোনা’
এবারে তিথি এতক্ষণের ধৈর্য্য হারালো। বিস্মিত আশিকের পেটের কাছে শার্টটা খামচে ধরল। কেঁদে ফেলল। শাহানা ঠিক এইভাবেই আদর করে ডাকত ওকে। ‘ইটলি বিটলি’ বলে। ভুলেই গিয়েছিল সেসব ও। আশিক নিজের অজান্তেই গভীর আলিঙ্গনে নিলো ওকে। ও আবার চিঠিখানা খুলে পড়তে শুরু করল –
“জানিস আমাদের একটা ছোট্ট ঘর ছিল? আনন্দের। খুশির। সেই ঘরে আমি ছিলাম, তুই ছিলি, তোর বাবা ছিল। রূপকথার গল্পের মতো, না? রাজা, রানি আর রাজকন্যে!
রূপকথা বলব না আজকে, সত্যি গল্প বলব। একদম সত্যি। যা তুই জানতে চাস।
রূপকথার গল্পে ডাইনি বুড়ি থাকে। এই গল্পে ডাইনিবুড়ি আমি নিজেই। আমার রাগ। তিতলি যখন পেটে আসলো সেই খবর তোর বাবাকে আমি দেইনি। বড় আপা মানে তোর শিরিন খালা এসে জানাবে ভেবেছিলাম। তার কথাই তোর বাবা মানতো একটু।
তুই যখন জন্ম নিলি অনেক কষ্ট হয়েছিল আমার, গলায় নাড়ি পেঁচিয়ে উল্টো হয়ে এসেছিলি। সব বাচ্চার মাথা আগে আসে, তুই আগে পা বের করেছিলি। যমের সাথে টানাটানি করেই আমি বেঁচেছিলাম সেবার, মনে হয় তোকে একা রেখে যেতে চাইনি তাই। তাই তোর বাবা আর সন্তান চায়নি। আমাকে খুব ভালোবাসতো নাকি সে, সেই বলত। বলতই শুধু, সে যে মিথ্যে ছিল তা আমি পরে জেনেছিলাম!
বড় আপার আসতে দেরি হলে তোর বাবা কেমন করে যেন জেনে গেল সব আর জোর করতে শুরু করল তিতলিকে মেরে ফেলতে। আমার চন্ডালি রাগ। আর দুটো দিন ধৈর্য্য ধরলাম না, ক্ষেপে গিয়ে এক কাপড়ে বাড়ি ছাড়লাম। ভেবেছিলাম আমি বড় আপার বাড়ি গিয়ে উঠব, সে সেখান থেকে হাতেপায়ে ধরে আমায় নিয়ে আসবে, ফিরিয়ে নেবে আমাকে!
সে এলো না, পেছন পেছন জাফর এলো। জাফরের সাথে আমার খুব ভাব ছিল। কত কত গল্প করতাম আমরা। জাফর গান গাইতো, আমি ওকে পিঠে বানিয়ে খাওয়াতাম। ধনেপাতা বেঁটে বরইভর্তা করে পুকুরপাড়ে বসে খেতাম। সিনেমা দেখতে যেতাম। আমাদের মেলামেশা লোকে দেখতে পারত না। শশুর, শাশুড়ি নেই। ননদেরা ইদে-অনুষ্ঠানে আসে। জাফর ছাড়া কে ছিল আর আমার? সেও ছুটিতে আসত। কটাদিন আমার আনন্দে যেত। দেবর-ভাবির এই মেলামেশা অনেকেই দেখতে পারত না। কুৎসা গাইতো। তাতে আমাদের কী? আমরা ভালো ছিলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঘুনপোকায় যে খেয়ে যাচ্ছিল তা তো টের পাইনি। যেদিন টের পেয়েছি, তার আগেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে আমার!
রাগ করে বাড়ি থেকে তো বেরোলাম। জাফর এলো পিছুপিছু, আমাকে ফিরিয়ে নিতে। আমি বললাম, ‘এসেছি যখন আর যাব না। বড় আপার বাড়ি যাব। তুমিও চলো। সিনেমা দেখব। ছোটচুলোয় রান্না করব। তোমার ভাই কাঁদতে কাঁদতে আমাকে আনতে যাবে।’
মজার কথা হলো যেন। জাফরও খুশি। যেন কোনো এডভেঞ্চারে নামলাম দুজনে। নওলি ছেড়ে লোহাগড়া থেকে খুলনার গাড়িতে উঠলাম। এক কাপড়েই দুজনে। সারা রাস্তা কী আনন্দে যে গেলাম। বেশি নাকি হাসতে নেই, তা যদি তখন জানতাম, তবে মুখ সেলাই করেই বসে থাকতাম। শরীর দুর্বল ছিল, বমি পাচ্ছিল, চোখ বন্ধ করে রাখলাম যশোরের পরে। ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম মনে হয়! রাজঘাটের কাছে এসে বাস উলটে গেল। আমার আর মনে নেই কিছু। জ্ঞান ফিরল নাকি পাঁচদিন পরে। হাসপাতালে। তাও পুরোপুরি ফিরল না। নাম ঠিকানা নাকি বলতে পারিনি। আরও দুদিন পরে হুঁশ এলো আমার। জাফরকে খুঁজলাম। সারা গাড়ির সব লোকই কমবেশি আহত হয়েছিল, কারো কারো হাত পা কাটা পড়েছিল, কারো মাথায় লেগেছিল। একজনও সুস্থ ছিল না। এদের মাঝে একটা মানুষই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল। সে আমাদের জাফর! বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। শার্ট প্যান্ট দেখে আমিই শনাক্ত করি। সাহস হারিয়ে ফেলি আমি। তোর বাবা, ফুফুদের সামনে যাওয়ার সাহসও হারিয়ে ফেলি। এক্সিডেন্টের সময় হাসপাতালে একজনের সাথে বোন পাতালাম। সেই ফরিদা আপাকে নিয়ে একরাতে আবার নওলি আসলাম। আমার কলিজা যে রেখে গেছি নওলি! বড় আপার বাড়ি যাওয়ার কথা তখন মনে পড়েনি। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই শুধু তোর জন্য ছটফটানি বেড়ে গিয়েছিল। গোপনেই ঢুকলাম নওলি। জাফরকে কবরে রেখে এসেছি এই খবর তার ভাইকে দেওয়ার সাহস আমার ছিল না, তাই লুকিয়ে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম তোকে নিয়ে তোর নানাবাড়ি চলে যাব আর তোর বাবাকে চিঠি লিখে সব জানাব। কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি এসে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আমার আব্বা, ভাই, তোর ফুফুদের সবাইকে দেখলাম। আর দেখলাম সবাইকে আহাজারি করতে। আমার নামে গালাগাল শুনছিলাম। জাফর আর আমাকে নিয়ে রটনা শুনছিলাম। বড় ঘোমটা টেনে আমারই ঘরের বারান্দার এক অন্ধকার কোণে বসে তোর বাবার জন্য মিলাদ পড়াতে দেখছিলাম। জাফর আর আমাকে নিয়ে সন্দেহ তোর বাবার মনেও ছিল সেদিন আমি টের পেলাম, নইলে লোকের কথায় সে আমার পায়ের নিচের মাটি সরিয়ে এভাবে চলে যেতে পারত না! ছাই ভালোবাসত সে আমাকে!
তোকে আমি কোথাও দেখলাম না। তোকে তোর ফুফুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে তারপরে আত্মহত্যা করেছিল লোকটা।
আমার আর ফেরার উপায় থাকল না। আমার বাপ ভাইদের কাছেও না। সবাই বিশ্বাস করে নিয়েছে আমার পা ফসকানোর গল্প। সবাই অভিশাপ দিচ্ছে।
মেয়েদের চরিত্রহানির গল্প মানুষ খুব সহজেই বিশ্বাস করে। প্রমাণ লাগে না। নিস্কলুষতা প্রমাণ করা লাগে। আমার হয়ে প্রমাণ কে দেবে? জাফর তো কবরে! আমি বলতে গেলে সবাই তখন বলত আমি নতুন গল্প বানাচ্ছি। জাফরের হাত ধরে পালিয়েছিলাম। জাফর মরে গেছে তাই ফিরে এসেছি। আমাকে কেউ বিশ্বাস করত না।
তুই নেই, তিতলি গর্ভে। আমি সবহারা! ফরিদা আপার সাথে চলে আসলাম। জুটমিলে কাজ নিলাম। তোকে দেখতে খুব ইচ্ছে করত। তোর গালে চুমু দিতে মন চাইত। গালে তুলে খাইয়ে দিতে ইচ্ছে করত। এক একবার ভাবতাম তোকে নিয়ে যাই। আবার নিজেকে আটকাতাম। কী খাওয়াব তোকে? নিজেই খেতে পাই না। অসুস্থ শরীর। জুটমিলের পরিশ্রম নিতে পারি না। বড়ঘরের মেয়ে আমি, বড়ঘরের বউ, তখন বস্তিতে থাকি। এক সপ্তাহ কাজ পাই, তো আরেক সপ্তাহে বিছানায়। তুই যেখানে আছিস পেটেভাতে তো আছিস, তাতেই আমার খিদে কমে যায়। তিতলি এলো। তোর জন্ম হয়েছিল, দেশের বড় ডাক্তারের হাতে। তিতলি জন্মালো কাঁদার মধ্যে। একদিন খোঁজ নিলাম তুই বড় আপার কাছে। আমি শান্তি পেলাম। তার কাছে তুই যতটা ভালো থাকবি, আর কারো কাছে না।
তোর জন্যই আমি তোকে ছাড়লাম। তোকে ছাড়তেই বড় কষ্ট ছিল আমার, তোকেই ছাড়লাম!
এই তিথি, তুই ভালো আছিস?’

চোখের পানিতে ভেসে ভেসে তিথি ব্যাকুল হয়ে তিতলিকে ডাকল। তিতলি এলো না। কাঁদার ভিতর দৌঁড়াল তিথি। নোংরা গলিটা পার হয়ে, মিলের বড় মাঠের সামনে এসে তিতলিকে পেলো। তিতলির চোখও জলে ভেজা। জড়ানো গলায় বলল,
— ‘মা অনেক কষ্ট পেয়েছে। আমাকে খেতে দিতে পারত না। আমি খিদায় কানতাম। আমার কত বড় বাড়ি, কত জমি আছে, সব থাকতেই আমার কপালে কিছুই জুটল না, আমার খাওয়ার কষ্ট হতো৷ মা তাও সহ্য করত। আপনার জন্য। আপনার কাছে গেলে, তখন যারা আপনাকে যত্ন করতেছিল যদি ফালায় দেয় আপনারে? ওইখানে সবাই আমার মায়েরে অসতী কয়, এইখানেও কয় কুলটা। আমার নাকি বাপের পরিচয় নাই, তাই শুনতে শুনতে বড় হইছি। তাও মায় কিছু কয় নাই। বুকে পাথরচাপা দিয়ে রাখছে, যেন আপনি ভালো থাকেন। আমার মায়ের আন্ধার যেন আপনারে না ছোঁয়। আর দেখেন না, সেই মায়েরে মা বলতেও আপনার কত কষ্ট হয়?’
— ‘মা কোথায়? আমাকে নিয়ে চলো তিতলি, আমার মায়ের কাছে নিয়ে চলো?’
তিতলি উত্তর করল না কোনো। নিজের মতো করে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে থাকল। পেছন পেছন তিথিও ছুটল। মেয়েটা গোরস্থানের ভেতর গিয়ে থামল। তিথির সমস্ত আশঙ্কা সত্যি করে দিয়ে বলল,
— ‘আপনি মা চান নাই। প্রশ্নের উত্তর চাইছেন। সে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিয়া গেছে। বাস এক্সিডেন্টে বুকে আঘাত লাগছিল, মাথায় আঘাত লাগছিল, চিকিৎসা হয় নাই, খানা-খাদ্য পায় নায়, পরিশ্রম করছে, তাই আর টিকে নাই। আরও তিন বছর আগেই চইলে গেছে।’
বন্যার জলের মতো করে ভেঙে পড়ল মেয়েটা এবার,
— ‘আমার মায় রাগী ছিল, আপা, পাগল ছিল, বেবুঝ ছিল! অত জটিল কিছু বুঝত না, সহজে যা মনে আসছে তাই করেছে। কিন্তু আমার মায় খারাপ ছিল না, চরিত্রহীন ছিল না, নোংরা ছিল না। আপনার জন্যই সে নিজেরে ছাড়ছে, আমারে ছাড়ছে। আমিও তো কিছু বুঝতাম না, লোকে আমার বাপের পরিচয় নিয়ে কত কথা বলত! মায় সুন্দরী ছিল, কত নোংরা কথা বলে আমার মারে নিয়া মানুষ, কই আমি তো কারো কথা বিশ্বাস করি নাই কোনোদিন। আপনারা কেমনে বিশ্বাস করলেন? আপনারা এমন কেন?’
বুকের মাঝে মাকে নিয়ে দুইবোনের এই আবেগঘন দৃশ্যের স্বাক্ষী থাকল শুধুই আশিক।
তিতলিকে বুকে করে শিরিনের কাছে ফিরল তিথি। আর পালিয়ে থাকা নয়। বুকের ভেতর আগুন থাকে, সেই আগুনের সন্ধান পেয়েছে তিথি! নিজের থেকে আট বছরের ছোট বোনের চোখে প্রজ্বলিত আগুন দেখে নিজেদ বুকেও আগুন জ্বালাতে শিখেছে ও। চৌদ্দ বছরের মেয়েটা একা একা জীবনের সংগ্রাম করছে, তিথি কেন পারবে না? শিরিনের সামনে শক্ত হয়েই দাঁড়াল ও। বিয়েটা সব সমস্যার সমাধান না। বিয়ে কোনো সমস্যারই সমাধান নয়। হাসিবের মায়ের কথায় কিছু আসবে যাবে না। লোকের নোংরা কথায়ও তিথির জীবন পাল্টাবে না। মানুষের কথার ভয়ে তিথির মা শাহানা যে ভুল করেছে সেই ভুল তিথি করবে না। কোথাও আর একসুতো ছাড় দেবে না, একচুল সরে দাঁড়াবে না নিজের জায়গা থেকে। আতিককে বিয়ে করবে না, বিয়ে করতে কেউ বাধ্য করলে বাড়ি ছেড়ে পালাবে না। কাউকে বাধ্য করতে দেবেই না, ওর জীবনের সিদ্ধান্ত ও নিজেই নেবে। হাসিবের যথেষ্ট শাস্তি হয়েছে, এরপরে আইন অনুযায়ী শাস্তি পাবে কি পাবে না, তা নিয়ে তিথির আর কোনো মাথাব্যথা নেই। রায়নার সংসারের শান্তি আনতে গিয়ে হাসিবকে ছেড়ে দেবে না ও। সমঝোতায় আসবে না তিথি। মামলা তুলে নেবে না। নতুন করে বাঁচবে তিথি, তিতলিকে নিয়ে, শিরিনের ভালোবাসায়।

পাঁচ বছর পরে

সিটি হাসপাতালের সাত নাম্বার কেবিনে এনাস্থেশিয়ার প্রভাবে ঘুমিয়ে আছে তিথি। গর্ভকালীন জটিলতা ছিল। এনিমিয়া প্রকট। বেশ বেগ পেতে হয়েছে ডাক্তারদের, তবে সফল সি-সেকশন হয়েছে। দুর্বল হলেও তিথি সুস্থ আছে। জমজ মেয়ে জন্ম দিয়েছে ও। দুই মায়ের নাম মিলিয়ে তাদের নাম রাখবে শায়না আর শাহরীন। নার্স এসে বাচ্চাদেরকে কোলে দিলে পুতুল দুটোর দিকে তাকিয়ে আরাফ আনন্দে হেসে ফেলল। পারলে হাততালি দিয়ে নাচে। আশিকের মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে ওর। আশিক নেই এখানে। আশরাফ সাহেব ওকে নিয়ে মিষ্টি কিনতে গেছেন। আশফিও এসেছে দেশে, ভাইয়ের এত আনন্দের সময়ে ভাইয়ের পাশে থাকতে।
রেহনুমা বাচ্চাদেরকে কোলে নিয়ে শিরিনের কাছে গেলেন। শিরিন বাচ্চাদের দেখে খুশি হলেও চোখেমুখে দুঃশ্চিন্তা তিথির জন্য। আজেবাজে খাবারে যত আগ্রহ তিথির পুষ্টিকর খাবারেব ততটাই অনীহা। দুইব্যাগ রক্ত লেগেছে। কী করে তিথির শরীরে রক্ত আনাবেন তাই ভাবছেন শুধু! তিথিকে নিয়ে তার দুর্বলতা আজও কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। সবকিছুর উপরে তিথির চিন্তাই তাকে ঘিরে রাখে অহর্নিশি। গত নয়মাস নিজের সংসার ফেলে তিথির কাছেই আশরাফ সাহেবের বাসায় ছিলেন তিনি। খালেক সাহেব মারা গেছেন দুই বছর আগেই, তিথির বিয়ের পরপরই। রায়নাও ফিরে এসেছে হেলালের সংসার ছেড়ে। একটা স্কুলে চাকরি করছে। আতিকের বিসিএস হয়নি। একটা প্রাইভেট ফার্মে বড় চাকরি পেয়েছে।
রায়না এসে পৌঁছাতে পারেনি এখনো। তিথির মেয়েদের জন্য জামা কিনতে গেছে। মাসীপিসির ছোঁয়া জামা নাকি পরাতে হয় সবার আগে। তিথির বাচ্চাদের তো ফুফু নেই, রায়নার খালা হওয়ার দাবি সবার আগে। তিতলি এত আবেগ, রীতিনীতির ধার ধারে না। অনেক সাহসী আর বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন মেয়ে। ও পোস্ট অপারেটিভে রয়েছে তিথির কাছে।
আশিককে আসতে দেখে আরাফ ব্যস্ত হলো। ওকে ক্ষেপাতে খুব মজা লাগে আরাফের। পাঁচ বছর আগে নারীজাতির কাছ থেকে আরাফকে দূরে রাখতে তিথিকে নিয়ে পালিয়েছিল আশিক। আজকে বাছাধনের মুখটা দেখার মতো হবে। ছবি তুলে রাখতে হবে ওই মুহূর্তের। এক মেয়েকে নিজে কোলে নিয়ে আরেকজনকে সিমির কোলে দিয়ে আরাফ একগলা আনন্দে ডুবে আশিককে বলল,
— ‘না তে নারীজাতিতে তোর ঘর যে ভরে গেল, আশিক?’
সবাই একসাথে হাসিতে ভেঙে পড়ল। আশফি, আতিক সবাই টপাটপ ছবি তুলে ধরে রাখতে লাগল এত আনন্দগুলোকে।
বাবা হওয়ার আনন্দে ভাসতে ভাসতে আশিক এগিয়ে গেলো আরাফের স্ত্রী সিমির দিকে নিজের কন্যাদ্বয়ের কানে আজানের সুর পৌঁছে দেওয়ার জন্য…

সমাপ্ত