তিথি পর্ব-৭+৮

0
395

তিথি – ৭ ও ৮

রাবেয়া খাতুন, হেলাল আর হেনার স্বামী বসে আছে তিথিদের বসার ঘরে। রায়না আর রামিমকে নিতে এসেছে তারা। তার সাথে এক অসম্ভব প্রস্তাবও নিয়ে এসেছে। হাসিবের সাথে তিথির বিয়ের প্রস্তাব!

ঘটনার এক মাস পার হয়ে গেছে। ঘটে গেছে অনেককিছু। এতটা দুঃসময় তিথির পরিবার আগে কখনো প্রত্যক্ষ করেনি।

আক্ষরিক অর্থেই সবকিছু একসাথে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছিল। তিথি আর রায়নাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় বাসায় ফিরতে দেখে শিরিন সেন্সলেস হয়েছিলেন স্বভাবমতো, কিন্তু খালেক সাহেব দ্বিতীয়বারের মতো স্ট্রোক করেন। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে শিরিনকে ধাতস্থ করা গেলেও খালেক সাহেবকে নিয়ে মেডিকেলে ছুটতে হয়েছিল। আগেকার মাইল্ড স্ট্রোকে ঝুঁকি বেড়েছিল, এবারে এটাকটা বড়সড়ই হলো। অস্ত্রোপচারটা তাই করতেই হয়েছিল। তবে খালেক সাহেবকে আর সুস্থ করা যায়নি, বেঁচে ফিরেছেন তবে জড়পদার্থের মতো।

এসব কিছুর ভেতরে প্রতিবেশিরা, এলাকার মানুষজন সব জেনে যায়, সাংবাদিক আসে, পুলিশ আসে। মিডিয়া ট্রায়াল, ভিক্টিম ব্লেইমিং শুরু হয় জোরেশোরে। গার্লস গ্রুপগুলোতে, ওয়ালে ওয়ালে তিথির পক্ষে-বিপক্ষে পোস্ট, ট্রল, নিউজে ভরে যায়। কেউ বলে তিথির আস্কারা ছিল, কেউ বলে শাস্তিটা বড় হয়ে গেছে হাসিবের জন্য আবার কেউ কেউ তিথির মায়ের হিস্ট্রি টেনে এনে ওকেই দোষি প্রমাণ করে ফেলে। মিডিয়া ট্রায়ালে একটা লাভ হয়, খালেক সাহেবকে নিয়ে ছুটোছুটির ভেতরেও পুলিশ আসে। তিথির জবানবন্দি আর আবারও মেডিকেল টেস্ট করানো হয়। আতিকের নেওয়া ব্লাড স্যাম্পলের কোনো কাজই নেই, পুলিশের অনুপস্থিতিতে নেওয়া ব্লাড সেম্পল কোনো কাজেই লাগবে না, জানতে পারে সবাই। হেলালের পরিবার আবারও নিজেদের বোকামির দন্ড দেয়। ওইসময়ে তিথি আর রায়নাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়াটা নির্বুদ্ধিতা হয়েছিল।

হাসিবকে নিয়েও টানাহেঁচড়া শুরু হয়। তিথির ব্লাডে চেতনানাশকের উপস্থিতি, ওর স্টেটমেন্টকে সাপোর্ট করে ভালোভাবেই। বেশ ভালো গ্রাউন্ড পেয়ে যায় তিথির উকিল। এত কিছুর ভেতরে, এত দুঃসময়ে হেলালকে পাওয়া যায় না রায়নার পাশে, কিন্তু ভাইয়ের পক্ষে যাওয়া সমঝোতার আবেদন নিয়ে ঠিকই পরিবারসমেত হাজির হয়েছে আজকে তিথির হাত চাইতে।

শিরিন অদ্ভুত রকমের শান্ত হয়ে আছেন এমনিতেই। এত এত ধাক্কাতে স্বভাবসুলভ অল্পতেই উত্তেজিত হয়ে যাওয়াটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। খালেক সাহেবকে খাইয়ে দিতে হয়, পরিস্কার করানো লাগে, ক্যাথেটার চেক করা লাগে বারবার, ওষুধ দেওয়া লাগে। জলজ্যান্ত চলেফিরে বেড়ানো মানুষটাকে নিথর হয়ে পড়ে থাকতে দেখার যন্ত্রণা আছেই তার উপরে তিথিকে নিয়ে টেনশন। সব মিলিয়ে টেনশনে প্রায় ম্লান হয়ে গেছেন শিরিন।

বসার ঘরে রাবেয়া খাতুনের মুখোমুখি হয়ে ভেজা বারুদে আগুন আসার মতো ধপ করে জ্বলে উঠলেন,

— ‘হেলালের বউ। বাচ্চাও হেলালের। সে নিতে আসছে বউ বাচ্চাকে। আমি যেতে বলার কেউ না। আটকানোরও কেউ না। স্ত্রী স্বামীর কাছে যাবে, আমি কেন বাধা দেব? কিন্তু হেলাল তো স্বামী হওয়ার যোগ্য না। ছেলে হিসেবে সে হয়তো অসাধারণ। ভাই হিসেবেও ভালো। খুব ভালো কথা। আমার তাতে খুশিই লাগে। আমার আতিক এইরকম মাতৃভক্ত হলে আমিও খুশি হবো। তবে আমি তো রায়নার মা। আমি দেখব হেলাল স্বামী হিসেবে কেমন। সেইটা দেখলাম। সে দুধের বাচ্চাসহ বউরে রাস্তায় ধাক্কা দিয়ে ফেলল। কেন? ও কি রাস্তার মেয়ে? ওর বাপ-ভাই নাই? দোষ করলে আমার মেয়ে আমার হাতে দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারতেন। না তার আগেই আমার মেয়েটারে পথে উঠাই দিলেন। আর তারপর এতগুলা দিন, একবারও হেলালের বউ বাদ দেন, বাচ্চাটার কথাও মনে আসে নাই?’

— ‘বেয়াইন, আমরা পরিস্থিতি ঠান্ডা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেছিলাম। যে ঝামেলাটা যাচ্ছে। আমার হাড়ে এই বুড়াবয়সে এই জ্বালাই লেখা ছিল। এখন নিজেরাও একটু ঠান্ডামাথায় ভাবেন। তিথিকেও একটু বুঝান।’

রাবেয়া খাতুন বেশ নরম সুরে বললেন।

—- ‘তিথির ব্যাপারে পরে ভাবব, আগে রায়নারটা সমাধান করি?’

বেশ দৃঢ় শোনায় শিরিনের গলা। রায়নার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললেন,

—- ‘রায়না, তুমি কি হেলালের বাড়ি ফিরতে চাও? ভেবেচিন্তে বলো।’

রায়না উত্তর দেয় না। শিরিন পাশের ঘরে চুপ হয়ে বসে থাকা আতিক আর তিথিকে ডাকলেন। ওরা সামনে আসলে বেশ নমনীয় সুরে বললেন,

—- ‘এই বাড়িটা আমি রায়না আর রামিমের নামে লিখে দিতে চাই। তোমার আব্বার পিএফ থেকে পাওয়া টাকাটাও আমি রায়নার নামে ফিক্সড ডিপোজিট করে দেবো। তোমার কোনো আপত্তি আছে আতিক?’

আতিক নাসূচক মাথা নাড়ালো।

— ‘তিথি, তোমারও সমান অধিকার আছে সবকিছুতে। কিন্তু সব আমি রায়নার নামে লিখে দেবো। তুমি কিছু পাবা না। তোমার কোনো আপত্তি আছে?’

— ‘কী বলো মা এইসব? এইসব কথা বলো কেন? আমি কি চাইছি কিছু?’

— ‘চুপ! যা বলছি শুধু তার উত্তর দাও। আপত্তি আছে কি না সেইটা বলো।’

— ‘না, মা। তুমি সব আপাকে দিয়ে দাও।’

এবারে রায়নার দিকে তাকালেন শিরিন,

—- ‘রায়না, তোমার দুই ভাইবোনেরই কোনো আপত্তি নাই। তোমার বা তোমার ছেলের একবিন্দু অবহেলা আমি হতে দেবো না। এখনকার টানাটানি থাকবে না। গয়নাগাটি যা বেচি নাই কিছু, সব বেচে তোমার আর তোমার ছেলের খরচ দেবো। কোনোরকম অভাব হবে না। অন্তত রামিমের কোনো অভাব আমি রাখব না। এবারে তুমি ভেবেচিন্তে বলবা, তুমি ওই বাড়ি ফিরবা কি না? আমার দিক থেকে কোনো বাধা নাই। আমি তোমার মা, মা-ই থাকব। হয়তো তোমার সাথে সম্পর্ক থাকবে না। কিন্তু আমার দরজা খোলা থাকবে তোমার জন্য সবসময়। এরপরেও যদি কোনোদিন চলে আসতে ইচ্ছে হয়, মাথা উঁচু করেই আসবা।’

রায়না উত্তর দিতে পারে না। ওইবাড়িতে মাত্রই তো স্বপ্নের সংসার সাজিয়েছিল। বেছে বেছে সাধ্যের মধ্যে কেনা ফার্নিচার, খাটগুলো ছুঁয়ে দেওয়া। আলমারির ডিজাইনে আঙুল রাখা, বিছানার চাদর বা কিচেনের বয়মগুলো। সবকিছুর জন্যই অদম্য আকাঙ্ক্ষা। কি করে এক নিমিষেই সব অধিকার ছেড়ে দেবে? আবার হেলাল, বয়সের ব্যবধান বেশি হলেও ভালো তো রায়না বেসেছিল ওকে। প্রিয়তম সেই স্বামীকে ত্যাগ করার কথাও বা বলে কোন অভিমানে?

রায়নাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে শিরিন উত্তর পেয়ে যান। রাবেয়া খাতুনকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

—- ‘তাইলে বেয়াইন, নিয়ে যান রায়নাকে আর রামিমকে। সবার আত্মসম্মানবোধ মেরুদণ্ড নামক হাড়গুলোতে থাকে না, কারও কারও লেঞ্জাতেও থাকে। ভালোমতো লাথি মেরে, আতু বলে ডাকলেও দেখা যাবে, লেজ নাড়াইতে নাড়াইতে বলবে, জ্বি হুজুর।’

শিরিনের কথা বলার ঢঙে সবাই বেশ দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিল। তবুও রাবেয়া খাতুন ভয়ে ভয়ে বললেন,

— ‘আর তিথির ব্যাপারটা?’

— ‘তিথির কোন ব্যাপার?’

— ‘তিথি আর হাসিবের বিয়েটা। দেখেন সব তো নিজেদের মধ্যেই। আমরা আমরাই তো। নিজেদের ভেতর এই থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাচারির টানাটানি আর কেন? লোক জানাজানি, নিন্দেমন্দ তো কম হয়নি। হাসিবের যে অবস্থা তাতে ভালো মেয়ে পাওয়াও দুঃস্কর, আর তিথির যে বদনামি হলো তাতে ওকেও তো আর বিয়ে দিতে পারবেন না। তাই এই চারহাত আমরা এক করে দেই। সবদিকেই শান্তি।’

হেহে করে হাসল হেনার স্বামী। হেসে হেলাল আর নিজের শাশুড়ির দিকে দম্ভভরে তাকালো। বেশ কথাটা বলতে পারার দক্ষতা তার আছে, যতই ঘরজামাই থাকুক না কেন?

— ‘হাসিবের সাথে তিথির বিয়ে? এত কাণ্ডের পরেও? তার চেয়ে আমি নিজে গলা টিপে না হয় মেরে রেখে দেব।’

— ‘আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? যেভাবে রায়না ভাবিকে জিজ্ঞেস করলেন সেইভাবেই তিথিকেও জিজ্ঞেস করে দেখেন। ওরও তো মতামত থাকতে পারে। হাসিবের সাথে হাহা হিহি করতেই তো দেখতাম।’ বেশ চাল দিয়েছে এমন ভঙ্গিতে তাকালো হেনার স্বামী লোকটা। কিন্তু তার সবকিছুতে জল ঢেলে শিরিন বললেন,

—- ‘তিথি আমার কাছে আমার বোনের আমানত। সেই আমানতের খেয়ানত আমি তিথিকেও করতে দেব না। ও কারো বউ হয়নি, এখনো আমার মেয়ে পরিচয়ই ওর একমাত্র পরিচয়। ওর জীবনের সিদ্ধান্ত তাই আমিই নেব। বিয়ে তো দূরের কথা এই প্রসঙ্গেই আমি আর কোনো কথা বলব না। আর মামলা, পুলিশ, কোর্ট কাচারি যা হওয়ার সেই মতনই হবে। আমার হাত ধরে তিথি প্রতিটি হেয়ারিংয়ে যাবে। অবশ্যই যাবে।’

রাবেয়া খাতুন কড়া উত্তর দিতে চাইলেন, হেনার স্বামী বুদ্ধিমান, ইশারায় থামালেন ওনাকে। উকিল বারবার সাবধান করে দিয়েছে, উদ্ধত হওয়া যাবে না কোনোমতেই। আগে রায়নাকে বাড়ি নিতে হবে তারপরে ওকে দুর্বল করেই মামলাটা কৌশলে অন্য পথে নিতে হবে। রায়না এখন তুরুপের তাস। এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করা যাবে না যাতে রায়নার যাওয়াটা পণ্ড হয়ে যায়।

মিনিট দশেকের ভিতর রায়না তৈরি হয়ে এলো। রামিম তো অনেক আগেই হেলালের কোলে চড়ে বসেছে। তিথিকে জড়িয়ে ধরল রায়না। নিঃশব্দে কাঁদছে দুজনেই। তিথির জন্যই এত ভাঙন, অপরাধবোধে ছোটো হয়ে থাকে ও।

ভেতরের ঘর থেকেই ও বিদায় দিলো রায়নাকে। শিরিনও জড়িয়ে ধরলেন রায়নাকে। কপালে চুমু দিয়ে বললে,

—- ‘যদিও তোমার সিদ্ধান্ত আমার পছন্দ হয় নাই, তবুও নিজের জীবনের ডিসিশন তুমি নিজেই নিয়েছ, ভুল কি শুদ্ধ তা সময় বলে দেবে। তবে মন ছোট করবা না। যদি প্রয়োজন হয়, মনে হয় ওদের সাথে থাকতে পারবা না, চলে আসবা সাথে সাথেই৷ তবে চেষ্টা করবা এমন পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয় যেন তোমাকে আবার নিজের ঘর ছাড়তে হয়। রামিমকে দেইখো। ভালো থাইকো।’

রায়না বেরিয়ে গেলো হেলালের সাথে। রাবেয়া খাতুন বেরোতে গিয়ে দরজার কাছে থামলেন। একটু ইতস্তত করে বললেন,

—- ‘বেয়াইন, আরেকবার একটু ভাববেন প্রস্তাবটা। আমি কালকে একবার ফোন করব।’

— ‘ভাবাভাবির কিছুতো নেই। আমি পরিষ্কার বলে দিয়েছি সব। এটা আমি ভাববও না!’

— ‘দেখেন, তিথির কি অন্য কোথাও বিয়ে হবে? পারবেন বিয়ে দিতে? এমনিতেই মায়ের গুণপনার গল্পে টেকা যায় না তায় এই কেলেংকারী!’

— ‘প্রয়োজনে মেয়ে বিয়ে দেবো না বেয়াইন, তবুও ওই জানোয়ারের সাথে তো না-ই। ঘরের খুঁটি হয়েই আমার ঘরে থাকবে, আমার তিথি।’

হাসিবকে জানোয়ার বলায় চেতে উঠলেন রাবেয়া খাতুন। উকিলের সাবধানবাণী বিস্মৃত হলেন। ওইপাশে আতিকের হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা তিথিকে দেখে একগাল হেসে বিদ্রুপ করে বললেন,

—- ‘খুঁটিই তো দেবেন, বেয়াইন, খুঁটিই তো দেবেন! ঘরে এমন সিনেমা থাকলে দরকার কী বাইরে ছেলে ধরতে যাওয়ার? আমরা দূরে থাকি বলে জানি না, পাড়ার লোক তো রেখেঢেকে বলে না। অকারণে কি আর বিয়ে ভাঙে?’

বাঁকা হাসি হেসে কটাক্ষ করে প্রস্থান করলেন রাবেয়া খাতুন।

এদিকে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা দুইভাইবোনকে দেখে, তাদের সম্পর্ক নিয়ে বিশ্রী ইঙ্গিতে এতোক্ষনের ধৈর্য্য টলে জ্ঞান হারালেন শিরিন!

তিথি – ৮

রাতের আঁধার যেন আরও জেঁকে বসে এখন শিরিনের ঘরে। রাস্তার পরিচয়হীন কুকুরগুলোর অকারণ চিৎকার অসহ্য মনে হতে থাকে। সময় জানিয়ে চলা সচল ঘড়ির ক্রমাগত টিকটিক শব্দ থামিয়ে দিতে ইচ্ছে করে আজকাল। একটা নিশ্চুপ, নিঝুম, শান্ত, নিশ্চিন্ত ঘুমের আশ্রয়ে চোখ বুজতে ইচ্ছে করে খুব করে। কেমন একটা গোলোক ধাঁধাঁর মধ্যে পড়ে গেছে জীবনটা। সহজ সমাধান কিন্তু পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যতই সুতো গুটিয়ে এনে সেলাইটা বসাতে যাচ্ছেন, সুতোয় পাক খেয়ে আবার গিট্টু লেগে যাচ্ছে। যেই না একটু গুছিয়ে নিচ্ছেন সবকিছু, চেষ্টা করছেন জীবনযাপন স্বাভাবিক করতে তখনই একটা দমকা হাওয়া আবার সবটা এলোমেলো করে দিচ্ছে। দুদন্ড ঘুমাতেও পারেন না। খালেক সাহেবের নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু বোধশক্তি আছে। বলতে পারেন না কিন্তু শুনতে পারেন। তবে অনুভূতিগুলো আগের মতো আছে কীনা বোঝা যায় না এখনই। সবাইকে চিনতে পারেন কিনা তাও স্পষ্ট নয়। কখনো মনে হয় হয়তো তিথিকে দেখে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা বা রামিম কপালে হাত ছুঁইয়ে নানা, নান্না করে ডাকলে চোখটা একটু চকচক করে ওঠে মনে হয়। ডাক্তাররা আশা দিয়েছেন, ঠিকমতো নার্সিং করলে হয়তো সুস্থ হয়ে উঠতেও পারেন। আশেপাশে কাউকে না দেখলে মুখ দিয়ে গোঁগোঁ করে অর্থহীন শব্দ করেন। দিনরাতের পার্থক্য করতে পারেন না তাই রাতেও একটু বাদে বাদেই সঙ্গ চেয়ে আওয়াজ করে ডাকতে থাকেন। শিরিনকেও তাই তটস্থ থাকতে হয়। সতর্ক থাকেন সবসময়, সারারাত। রাতটাও তাই একরকম আধা ঘুম আধা জাগরণে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কাটে শিরিনের। ঘুমের অভাবে মেজাজ তিরিক্ষি হতে থাকে। তবু্ও শান্ত থাকেন। আজকাল তিথিকে বকতে হয় না নিজের থেকেই অনেক কাজ করে দেয়। তবুও ভয়ে ভয়ে থাকে সারাক্ষণ। ওর মুখটা দেখে মায়া হয়, ভুলচুক করে ফেললেও তাই শিরিন আর বকেন না।

সকালে ঘুম ভাঙতে একটু দেরিই হলো। শেষরাতের দিকে খালেক সাহেবও ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, আর শিরিনেরও ঘুম গাঢ় হয়ে এসেছিল। তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরে ঢুকলেন। রাতেই ধোয়ামোছা করে তকতকে করে রাখা অভ্যাস আছে শিরিনের। তিথি নাস্তা বানিয়ে রেখেছে। পাতলা রুটি, আলুভাজি আর ডিমপোচ। রুটি গোল হয়নি, সেদিকে তাকিয়ে হাসলেন মনে মনে। আলুভাজিতে হলুদ দিয়েছে, শিরিন দেন না। চুলায় ডিম আঁচে খিঁচুড়ি বসানো, পেঁপেঁ কেটে দেওয়া, মুরগির টুকরো দেওয়া। ব্লেন্ডার করে খালেক সাহেবকে খাওয়ানো হবে। শিরিন তিথিকে খুঁজতে গেলেন। বিছানাও তুলে ফেলা হয়েছে, বসার ঘর ঝেড়েমুছে, গুছিয়ে রাখা।

তিথির ঘরে উঁকি দিলেন। পড়ার টেবিলে একমনে পড়ে চলেছে ও। ঘরে পরা সাধারণ জামার উপর ঘরে পরা ফুলহাতা টিশার্ট। ফাল্গুনের শুরুতে হালকা হালকা ঠান্ডা পড়ে সকালটাতে। সোয়েটারে গরম লাগে, নাহলে একটু শিরশির করা হিম। তাই তিথি জামার উপর গেঞ্জিটা চড়িয়ে নেয়। অবিন্যস্ত চুলের বেণী ফ্লোর ছুঁইছুঁই। শিরিনের আওয়াজ পেয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো।

— ‘মা দেখো তো, চুলায় বাবার খিঁচুড়ি বসিয়েছি। কী অবস্থা?’

— ‘দেখেছি।’

শিরিন হাসলেন মনে মনে। একমাসের ব্যবধানেই মেয়েটা অনেক বড় হয়ে উঠেছে। এলোমেলো তিথি সবকিছু গুছিয়ে রাখছে, নিজেকে গোছাচ্ছে। সবসময় একটুখানি সাহায্য, একটুখানি উপকার করার জন্য রেস লাগিয়েছে যেন।

শিরিন এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত রাখেন তিথির। মাথাটা একটু টেনে বুকের মাঝে নেন। তিথি আদুরে বিড়ালছানার মতো আদর নিয়ে চুপ করে থাকে।

— ‘আমাকে ডাকিসনি কেন?’

— ‘ঘুমাচ্ছিলে মা। আরেকটু ঘুমিয়ে নিতে?’

— ‘আতিক নাস্তা খেয়ে গেছে?’

— ‘হ্যাঁ, ভাইয়া শুধু রুটি আর ডিম খেয়ে গেছে। আলুভাজি তখনো হয়নি।’

— ‘তুই খেয়েছিস?’

— ‘হ্যাঁ, মা। তিনদিন পরেই ক্যুইজ আছে একটা। এটেন্ডেন্স তো একেবারে কমে গেছে। একটু পড়ি। তারপরে তোমাকে সবজি কেটে দেবো। বাবাকে খাইয়ে দেবো। তুমি খেয়ে নাও। ভাজিতে লবন কম হয়েছে। আলাদা ছিটিয়ে নিও।’

— ‘পড়। আমি খেয়ে নেই। চা বানিয়ে তোকে দিচ্ছি।’

— ‘চা খাব না মা। ইচ্ছে করছে না।’

শিরিন কিছু বললেন না। চুপ করে সরে এলেন। চায়ের নামে তিথি কোনোদিন না করেনি। খালেক সাহেবের সাথে আতিক, তিথি, রায়নার চায়ের আড্ডাটা মনে করে চোখ ভিজে এলো তার। সংসারটা কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে দিনদিন।

সন্ধ্যেবেলায় আতিক ফিরল আলুপুরী নিয়ে। ছোটো ছোট সাইজ। হাতের তালুতে আটকে যাবে। দুইটাকা করে ছয়টা বারো টাকা। সাথে ধনেপাতার চাটনি। একটু হিসেবি খাওয়া। সংসারে আয়ের মানুষটা অথর্ব হলে সংসারটাও পঙ্গু হয়ে পড়ে। কোনোরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে টেনে নেওয়া শুধু। আতিকের বিসিএসের প্রিপারেশন মরিচিকা হয়ে উঠেছে। খালেক সাহেবের অফিসে একটা চাকরির জন্য চেষ্টা করছে। সংসারটার গতি হয়ে যাবে। আতিক স্কুলে পড়িয়ে যা পায়, তা তো খালেক সাহেবের ওষুধেই চলে যাবে- বাকি চিকিৎসা তো বাদই! সংসার সমুদ্রে আসলেই তুফান উঠেছে বড়। কেউ কোনো কূল খুঁজে পাচ্ছে না। এর ভিতর তিথির উকিলের খরচও আছে। নারীবাদী কিছু সংস্থা সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। তবে ওই আশ্বাসটুকুই।

তিথি প্রায় মুখ লুকিয়ে চলে এখন। মানুষের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে আগেই ছিল ও এখন তো সবার মুখে মুখে। পাড়ার মুদি দোকানে গেলেও ছোটোখাটো জটলা লেগে যায় ওকে ঘিরে। পারতপক্ষে এখন আর ও যায় না বাড়ির বাইরে। কলেজে গিয়েছিল একদিন, মায়ের বোরকায় মোড়া হয়ে। আতিক সবকিছু কিনে এনে রাখে, যেন বাইরে না যাওয়া লাগে। বিস্কিট কোনোদিন তিথির পছন্দ ছিল না, এখন তাও খেয়ে নেয়। স্কুল থেকে আসার সময় মাঝেমাঝে তাই পুরী, চিতই পিঠা কিনে আনে আতিক। এর চাইতে বেশি বাজেটের কিছু আনা সম্ভব না, পকেট জানান দেয়। খালেক সাহেবের চিকিৎসা, তিথির মামলা সবকিছুতে পানির মতো করে জমানো টাকাগুলো খরচ হয়ে গেছে। এখন বাবার অফিসের চাকরিটা হয়ে গেলেই, পেটেভাতে সংসারটা বাঁচাতে পারবে আতিক!

রাতের খাবার শেষ করে আতিককে ঘরে ডাকলেন শিরিন। তিথি আছে খালেক সাহেবের কাছে। বাবার পায়ের আঙ্গুল নাড়াচাড়া করছে একহাতে আরেকহাতে টুকরো নোটের কপি।

— ‘আতিক? রায়না গেছে কয়দিন হইছে আজকে?’

— ‘চার পাঁচদিন হবে।’

— ‘সাতদিন।’

— ‘কী হয়েছে, মা? হেলালরা কিছু সমস্যা করছে নাকি?’

— ‘না, সমস্যা ঠিক না। তবে আমি আভাস পাইতেছি। রায়নারে বুঝানো হইতেছে হাসিব তিথির কোনো ক্ষতি করতো না। আর তিথির কোনো ক্ষতি তো হয়ও নাই। তারপরে ধরো, তারা নাকি হাসিবের কসমেটিক সার্জারি করাবে। চোখ ভালো না হলেও চেহারা ঠিক হয়ে যাবে। হাসিবের ঢাকা শহরে দুইটা ফ্ল্যাট আছে। আরও খানিক জায়গা ও তো আছে ফ্ল্যাটের সামনে। ওইটাও ধর তিথিরে লিখে দেবে। তিথির নামেই লিখে দেবে।’

— ‘বল কি মা? তিথির নামে কেন লিখে দেবে?’

— ‘তিথিরে হাসিবের সাথে বিয়ে দিতে হবে, তার দাম। মামলা টামলা তুলে নেব তার দাম দেবে।’

— ‘অসম্ভব।’

— ‘অসম্ভব বললে তো হবে না। সেই বাড়ি তোমার বোনও আছে। তারও সংসার। বাচ্চা। আমাদের এই অবস্থা। খারাপ কী?’

— ‘তোমার মাথাটাতা খারাপ হয়ে গেল নাকি, মা? এই কথা বাদে আমারে অন্য যেকোনো কথা বল, আমি মেনে নেব। যা বলবা তাই করব।’

—- ‘মাথা এখনো খারাপ হয় নাই। তবে হইতে কতক্ষণ? যা সব হচ্ছে জীবনে! তুমিই বা কতদিন মাথা ঠান্ডা রাখবা? রায়না কাইন্দা ফেললে ফিরায়ে দিতে পারবা? দুই বোনের জীবনের সাথে সমঝোতায় আসবা না? বলা অনেক সহজ, আতিক। জীবনটা মোটেও সহজ না। তুমি যে বললা যা বলবা মেনে নিবা। কথা দিতে পারো, আমি যা বলব তাই তুমি শুনবা?’

— ‘ওই শয়তানটার সাথে তিথির বিয়ে বাদ দিয়ে যা তুমি বলবা, আমি তাই করব। যেভাবে বলবা সেভাবে করব।’

— ‘কথা দিলা আমারে! আমার মাথায় হাত দিয়া কসম করো?’

— ‘কী পাগলামি শুরু করছ? আচ্ছা যাও, যা বলবা আমারে তাই শুনব আমি। তাই করব। এই তোমার মাথায় হাত দিয়ে কিরা করলাম।’

— ‘তিথিরে তুমি বিয়ে করো, আতিক।’

এক মুহূর্তের জন্য নিজের কানকে অবিশ্বাস করল আতিক। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকল মায়ের দিকে।

শিরিন আবার বললেন,

—- ‘তিথিরে তুমি বিয়ে করলে আমি দুইটা মেয়েরেই বাঁচাতে পারব আতিক। বিবাহিত মেয়েকে তো আর কেউ বিয়ে দিতে বলবে না। মামলাটা নিয়ে পরে পরিস্থিতি বুঝে ভাবব। আর তিথির জন্য আমার ঘরের চেয়ে ভালো ঘর কোনোদিন হবে না।’

— ‘’কী ভয়ংকর কথা বলছ তুমি? তিথি আমার বোন।’

—- ‘ভুল। বোন তবে খালাতো বোন। তিথি আমার পেটের মেয়ে না, তোমার বাপের ঔরসজাত মেয়েও না। আমার বোনের মেয়ে। তোমার খালার মেয়ে। এইদেশে, আমাদের ধর্মে কাজিনের সাথে বিয়ে অহরহ হয়। এটা খুব স্বাভাবিক।’

— ‘আমি ওকে বোন বলেই জানি। রায়না আর তিথি আলাদা না আমার কাছে।’

— ‘তুমি জানলেই সেটা সত্যি হবে না। লোকে মানবে না। আমি পালছি তিথিরে। মেয়ের যত্ন দিছি। তাই বলে আমার মেয়ে হয়ে যায়নি ও। আশেপাশের মানুষের কানাঘুষায় এমনিতেও টেকা যায় না।’

— ‘অসম্ভব মা। তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।’

— ‘আমার মাথা খারাপ হওয়ারই তো কথা আতিক। স্বামী মরা মানুষের মতো পড়ে আছে। মেয়ে একটারে সাগরে ভাসায় দিলাম আরেকটারে সমাজের মানুষ জবাই দিবে, দেখব চোখের সামনে। কালকে ঘরে খাবার আসবে কীনা জানি না। ছেলে কথা শোনে না। অযোগ্য একটা মা আমি। আমার বেঁচে থাকার কী লাভ বলতে পারো?’

আঁচলে মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে সেন্সলেস হলেন তিনি।

আতিক চিৎকার করে তিথিকে ডাকল। তিথি দৌঁড়ে এসে মায়ের অবস্থা দেখে পানি নিয়ে ছুটে এলো। পানির ঝাপটা দিয়ে শিরিনের জ্ঞান ফেরাতে লাগল।

আতিক তিথির দিকে চোখ তুলেও যেন তাকাতে পারছে না। এতটাই সংকোচ এসে আটকে দিচ্ছে চোখের দৃষ্টিকে!

পরদিন দুপুরে খাওয়ার শেষে তিথির পাশে এসে বসলেন শিরিন। তিথি তখন স্টার মুভিজে এভেঞ্জার এন্ড গেম দেখছে। ডক্টর স্ট্রেঞ্জ এক আঙ্গুল উঁচু করে আয়রনম্যানকে ইশারা দিচ্ছে যে চৌদ্দ মিলিয়ন ছয়শো পঞ্চান্নটা রিয়েলিটির মধ্যে এটাই সেই একমাত্র রিয়েলিটি যেটায় থানোসকে হারানো যায়। আয়রনম্যান থানোসের মেলে দেওয়া দুইবাহুর বামহাতের গন্টলেটে টান দিলো, খুবই উত্তেজনাকর দৃশ্য। শেষের কাছাকাছি। ক্লাইমেক্স তুঙ্গে। তিথির চোখমুখ চোখা হয়ে আছে।

–’তিথি? ও তিথি?’

–’হুম।’

–’চোখমুখ ধুয়ে একটু ক্রিমট্রিম মাখ।’

— ‘একটু পরে মা। এই আর অল্প একটু। প্লিজ। চুপ করো এখন।’

— ‘একটা শাড়ি পর। তোর বাবা এস এস সির রেজাল্ট দিলে একটা কিনে দিলো না, লাল রঙের? কোনোদিন তো পরিস নাই। আজকে একটু পর। টাকাপয়সা থাকলে নতুন একটা শাড়ি কিনে দিতাম।’

আঁচলে চোখ মুছলেন শিরিন।

এবারে তিথি তাকাল অবাক হয়ে।

— ‘কী সমস্যা, মা? কী শাড়ি শাড়ি শুরু করলে? শাড়ি কেন পরব?’

— ‘আজকে তোর বিয়ে। তোর সেজমামা সাভার থেকে এসে যাবে একটু বাদেই। আর কেউ তো কাছাকাছি থাকে না। আমি সবাইকে খবর দিছি।’

তিথি সোজা হয়ে বসল এবার। রিমোট চেপে টিভি বন্ধ করল।

—- ‘’কী বিয়ে বিয়ে করছ মা। আমার বিয়ে মানে কী? কার সাথে বিয়ে? কখন বিয়ে? পাগল হয়ে গেছ তুমি?’

— ‘তোর বিয়ে। বাদ এশা। আতিকের সাথে।’

— ‘কী? কার সাথে? আবার বল?’

— ‘আতিকের সাথে।’

জোরেই বললেন এবার শিরিন।

তিথি থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। রাগে নাকি কষ্টদুঃখে ও জানে না।

— ‘ভাইয়ার সাথে? আমার বিয়ে?’

কথা বলতে পারল না আর ও। অস্ফুটে ‘অসম্ভব’ শব্দটাই উচ্চারণ করতে পারল শুধু আর ধপ করে বসে পড়ল।

— ‘খাওয়াইছি, পরাইছি আমি। মানুষ করছি আমি। এখন অন্য নাঙ ধরবা তুমি? তো আমার সংসার দেখবে কে? ওই বুড়া মানুষটার জন্য কি হাজার হাজার টাকায় নার্স রাখব? সেই ব্যবস্থাও কি রাখছ তুমি? ভাতার ধরতে গেছিলা, সেইখানেও মামলা খাওয়ায় হাজার হাজার টাকা খসতেছে। আমারে বলে অসম্ভব! ফেল আগে, পনেরো বছর ধরে যা খাওয়াইছি, সব বমি করে ফেল আগে! হারামজাদী! আমার মাইয়ার কপালটাও পোড়ায় আসছিস। বিয়ে করবি না, তো কি এত মহব্বত আমার ছেলের সাথে তোর। লাইগা থাকিস কেন ওর সাথে? রাত জাইগা কি এতো সিনেমা দেখিস? রিকশায় লাইগা বসিস, পাড়ার লোকে দেখে না বুঝি? আমার কানে দেয় না তারা? অসম্ভব শিখাস আমারে?’

এত নোংরা অভিযোগের উত্তর এলো না তিথির মুখে। কান্নাজড়ানো কন্ঠে শুধু ‘মা?’ বলে উঠল একবার।

শিরিন এবার স্বর নিচু করেন,

—- ‘যা মা শাড়িটাড়ি পরে নে। একটু সেজে নে। বিয়ের কনে, একদম খালি খালি ভালো লাগবে না। কয়টা দিন যাক। আতিকের চাকরিটা হলেই আমি অনুষ্ঠান করে লোক খাওয়াব। যা মা, তোর খারাপ তো আমি চাইব না কোনোদিন। আমি তোর মা, না? বল, মা না?’

*****

রাত আটটা। খালেক সাহেবের করা অর্ধসমাপ্ত ছাদে দাঁড়িয়ে আছে আতিক। সুন্দর মিষ্টি বাতাস। ছাদলাগোয়া সজনে গাছে ফুল এসেছে। বাতাসে ঝিরিঝিরি কাঁপছে ফুলের গোছা। একটু পরেই তিথিকে বিয়ে করতে হবে ওর। সাত আটজন আসার কথা থাকলেও এই সেই করে জনাবিশেক মানুষে ঘর ভরে গেছে। আতিকের কোনো উপায় নেই। ওর পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। পালানোই উচিত ওর। কিন্তু হাত পা বাঁধা। মায়ের আধাপাগল কসমের তোয়াক্কা করে না ও, কিন্তু আতিক পালাবে কী করে? পুরো সংসার ওর মাথার উপর। বাবার চিকিৎসা হবে না। আজ পালালেও কাল ফিরে আসতে হবেই হবে। চাকরিটা না হলে না খেয়ে থাকতে হবে। স্কুলের চাকরিটা ছাড়ারও উপায় নেই। দুটো টিউশনি আছে। ভিতর থেকে ডাক আসছে শুধু, কিন্তু পালানোর পথ নাই!

তিথি এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। তিথিকে আতিক ডেকেছিল ছাদে। কেউ বাঁধা দেয়নি ছাদে আসতে। তবে সদর দরজায় ঠিকই শিরিনের সজাগ দৃষ্টি আছে।

— ‘ছোটো আপু?’

আতিকের স্নেহের ডাকের উত্তর দেয় না তিথি।

আতিক বোঝে সব। কিন্তু নিরুপায়। একটু চুপ থেকে একটা ব্যাকপ্যাক বের করে দিলো,

—- ‘এখানে তোর মায়ের কিছু গয়না আছে তিথি। আমার মায়ের কাছে রাখা ছিল। মা পালিশ করিয়ে এনেছে আজ। আমি চুরি করেছি। কিছু টাকা আছে। তুই এখন চলে যাবি। জানি না আরও বড় বিপদে তোকে ঠেলে দিচ্ছি কি না, তবে আমার চোখে যা ঘৃণার সেই কাজ আমি করতে পারব না। এরচেয়ে হয়তো মৃত্যুও তোর আমার জন্য ভালো অপশন। তোর বাবার বাড়ি নড়াইল, চিত্রা নদীর পাড়ে, ইটনা গ্রামে। কিছু টাকা আছে ব্যাগটাতে। যাওয়ার খরচটা হবে। এর বেশি আমার কাছে নেই। গয়নাগুলো বেঁচে উপায় করিস। এর ভিতর চাকরিটা হয়ে গেলে আমি গিয়ে তোকে নিয়ে আসব।’

তিথি মুখে হাতচাপা দিয়ে কেঁদে ফেলল।

আতিক কাঁঠালগাছটা দেখিয়ে দিলো। দড়ি বেঁধে রেখেছে ও আগে থেকেই। নামতে কষ্ট হবে না। বড়জোড় হাত-পা ছড়ে যেতে পারে।

দড়ি বেয়ে নামার আগে আতিক ডাকল একবার তিথিকে,

—- ‘ছোটো আপু, একটা হাগ দিবি না যাওয়ার আগে?’

তিথি চোখের পানি মুছে হেসে দিলো,

—- ‘টাকা দিবি, তাহলে?’

ভাইকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে দুজনেই অনুভব করল কিছুই আর আগের মতো নেই। ভাই-বোন অচেনা হয়ে গেছে অনেক আগেই। মানুষের বলা কথাগুলো এসে জড়ো হয়েছে দুজনের মাঝখানে।

চলবে…

আফসানা আশা