তুই আমার আসক্তি পর্ব-০৬

0
3

(রুমান্টিক এলার্ট,অতিরিক্ত রুমান্টিক গল্প পছন্দ না তারা দূরে থাকুন)

#তুই_আমার_আসক্তি
#পর্ব_৬
#লেখিকা_তাসনিম_তালুকদার_বুশরা

কপি করা বিশেষ ভাবে নিষিদ্ধ ❌

অফিস রুমে টেবিলের ওপর ছড়ানো কাগজগুলো যেন মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেলো স্নেহার চোখের জলে। বুক কাঁপতে কাঁপতে সে ধরা গলায় বললো,

স্নেহা: আমাকে আপনি, আপনি করে বলেন কেনো নেহার ভাই..? আমি না হয় ভুল বুঝেছি কিন্তু আপনি যদি একবার বোঝাতেন, আমি তো বুঝতাম! এমন করে দূরে ঠেলে দেন কেনো..?

চোখ ভিজে আসা স্নেহার কণ্ঠ কাঁপছিলো। কিন্তু তার বিপরীতে দাঁড়ানো নেহারের চোখে কোনো নরম আবেগ নেই, বরং ঠাণ্ডা তাচ্ছিল্যের ছাপ।

নেহার: ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে হিমশীতল গলায় বললো,বুঝার দরকার নেই। বের হন। আর দয়া করে—আমার সামনে আর আসবেন না। এসব ন্যাকামো আমার একেবারেই ভালো লাগে না। যান, এখন থেকে আমার কাজ আছে।

কথাগুলো যেন ছুরি হয়ে বিঁধলো স্নেহার বুকের ভেতর। সে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজার হ্যান্ডেল ঘোরার শব্দ হলো। স্নেহা তাড়াহুড়ো করে চোখের পানি মুছে নিলো, ভাঙা মুখে জোর করে স্বাভাবিকতার মুখোশ চেপে ধরলো।

নেহার: কাম ইন।

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো এক তরুণী। তার গায়ে শর্ট ড্রেস, আত্মবিশ্বাসে ভরা চোখ। হাতে ফাইল ধরে নরম অথচ স্পষ্ট কণ্ঠে বললো,

তরুণী:স্যার, আর দশ মিনিট পর একটা ইম্পরট্যান্ট মিটিং আছে।

নেহার চোখ নামিয়ে ঘড়িতে তাকালো। সময়ের কাঁটা যেন হঠাৎ করেই তার ধৈর্য শেষ করে দিলো। গম্ভীর ভঙ্গিতে বললো,

নেহার:হুঁ… আপনি যান, আমি আসছি।

তরুণীটি বিনয়ী মাথা নাড়িয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো। দরজা বন্ধ হতেই কেবিনের ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এলো।

নেহার এবার ঘুরে দাঁড়ালো স্নেহার দিকে। চোখে বিরক্তির রেখা, গলায় ক্লান্ত ঠাণ্ডা সুর।

নেহার: আপনার মনে হয়, এটাও নিয়ে সন্দেহ করবেন? এই মেয়ের সাথে আমি শুধু কথা বললাম, আর তাতেই আপনার এত ভাবনা! আচ্ছা বলুন তো, আমি কয়জনের ব্যাপারে আপনাকে এক্সপ্লেইন করবো? প্রতিদিন? প্রতিটি মুহূর্তে? তার থেকে ভালো না—এই সম্পর্কটাই না থাকা..!

শব্দগুলো যেন প্রতিধ্বনির মতো ধাক্কা মারলো স্নেহার বুকের ভেতর। চোখ ভিজে উঠলো আবারও, ঠোঁট কাঁপলো কিছু বলতে চাইলো সে, কিন্তু শব্দ গলার ভেতরেই আটকে গেলো।

এরই মাঝে নেহার কোনো সুযোগ না দিয়েই কাগজপত্র হাতে তুলে নিলো, গা ঘুরিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে।

কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ রুমটিতে শুধু স্নেহার নিঃশ্বাস আর ভাঙা কান্নার শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো। সে নিজের চোখের পানি সামলাতে সামলাতে টেবিলের দিকে তাকালো—যেখানে অল্প আগেই তারা দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলো। এখন সেই টেবিলটাও যেন তাকে ফাঁকা, একলা আর তিক্ত মনে করাচ্ছে।

অবশেষে আর সামলাতে পারলো না স্নেহা। ভেঙে পড়া বুক নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। অফিসের কোলাহল তাকে আরও নিঃসঙ্গ করে তুললো। প্রতিটি পা ফেলতেই যেন মনে হচ্ছিলো—তার ভেতরের পৃথিবীটা ধ্বসে যাচ্ছে।

বাইরে বেরিয়ে আসতেই সে আর ধরে রাখতে পারলো না অশ্রুধারা ভিজিয়ে দিলো তার সব গোপন শক্তিকে।

~~

রাত ঠিক নয়টা।
বাড়ির ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই নেহার থমকে দাঁড়ালো। আলো জ্বলছে, তবুও অদ্ভুত এক নীরবতা ছেয়ে আছে চারপাশে। সাধারণত এই সময়টায় বাড়িটা প্রাণবন্ত থাকে—স্নেহার টুকটাক হাসি, কথার ঝংকার, কিংবা রান্নাঘরের আওয়াজে ভরে ওঠে। কিন্তু আজ সবকিছু যেন অচেনা লাগছে।

সোফার এক কোণে বসে আছেন মৌসুমী খান। তিনি চুপচাপ, অচল বসে আছেন যেন গভীর চিন্তায় হারিয়ে গেছেন। স্নেহা না থাকলে এমন নীরবতা হতেই পারে..?আচ্ছা সকালের জন্য কি রেগে আছে ওর বউ..?

নেহারের ভেতরটা কেমন অস্থির হয়ে উঠলো। সামনের টেবিলে রাখা চায়ের কাপটিও ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, যেন অনেকক্ষণ ধরেই তিনি এভাবেই বসে আছেন।

নেহার কাছে গিয়ে গলা নামিয়ে বললো,

নেহার: মা… কি হয়েছে? এভাবে চুপচাপ বসে আছো কেনো….?

তার কণ্ঠে এক অজানা শঙ্কা মিশে ছিলো।

মৌসুমী খান আস্তে করে নড়েচড়ে বসলেন। নেহারের ডাক যেন তার ধ্যান ভাঙলো। চোখ তুলতেই মনে হলো, তার ভেতরে অনেক না-বলা কথা জমে আছে। ঠোঁট কাঁপলো হালকা, তারপর ধীরে ধীরে বললেন—

মৌসুমী খান:আর বলিস না বাবা.. ” স্নেহা টার যে কি হয়েছে! আজকে সারাদিন রুমে বসে আছে, সেই সকাল এগারোটার দিকেই ইউনিভার্সিটি থেকে এসে আর রুম থেকে বের হয়নি। আমি খাওয়ার জন্য বারবার ডাকলাম, তবু কিছু খাচ্ছে না। শুধু একটাই কথা বলছে—চলে যাবে বাড়িতে। এমনকি সাকিবকে ফোন দিতে চাইছিলো। আমি বললাম, তুই দিয়ে আসবি। তারপর আবার বললাম—তোর মামা তো এখন বিজনেসের কাজে কয়েক দিনের জন্য বাইরে গেছে, কয়দিন পড়ে যা। কিন্তু শুনলো না! এখনি যেতে হবে, জিদ ধরেছে।

মায়ের কথাগুলো শুনে নেহারের বুকের ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠলো। তাহলে কি সত্যিই স্নেহা অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে?

চোখে ভ্রুকুটি নামলো নেহারের, কিন্তু ঠোঁটে স্থিরতা রেখে শান্ত গলায় বললো,

নেহার:আচ্ছা আমি দেখছি। তুমি যাও, ঘুমিয়ে পড়ো।

মৌসুমী খান আর কিছু না বলে মাথা নাড়লেন।

নেহার ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরের তলায় উঠতে লাগলো। মনে মনে বললো,

নেহার:আগে ফ্রেশ হওয়া দরকার… তারপরই স্নেহার কাছে যাবো। যা-ই হোক, আজ রাতে ওকে বুঝিয়ে শান্ত করতেই হবে।

সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ যেন ভারী লাগছিলো, কারণ ওর মনে হচ্ছিলো—উপরে রুমে বসে থাকা সেই মেয়েটিই আজ তার পৃথিবীর সবকিছু বদলে দিতে পারে।

~~

রাত দশটা।
নেহার স্নেহার রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। রুমটা অন্ধকার, বিছানাও খালি। চারদিকে নীরবতা নেমে আছে। হঠাৎ করেই বুকটা ধক করে উঠলো নেহারের—কোথায় গেলো?

সে তাড়াতাড়ি সোজা বেলকনির দিকে গেলো। সেখানেই দেখতে পেলো, স্নেহা একা বসে আছে। চুলগুলো খুলে দিয়েছে, বাতাসে উড়ছে হালকা করে। বেলকনির ক্ষীণ আলোয় তার মুখটা যেন আরও ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে, চোখ দুটো ফোলে গেছে কান্নায়।

নেহারের ভেতরটা কেমন যেন ভেঙে গেলো। অকারণেই এত বকাঝকা করলাম একটা অপরাধবোধ তাকে গ্রাস করলো।

নরম কণ্ঠে এগিয়ে গিয়ে বললো

নেহার:জান… রাগ করে আছিস এখনো?

স্নেহা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। ঠোঁটে টেনে আনলো একটুখানি কৃত্রিম হাসি।

স্নেহা:না না, আমি রাগ করবো কেনো? রাগ করার মতো কিছু কি হয়েছে?

কথার ভেতরেই ছিলো চাপা কষ্ট, তবুও মুখে হাসি ধরে রাখলো। তারপর একটু থেমে যোগ করলো

স্নেহা:চিন্তা করবেন না, মামা আসলেই আমি চলে যাবো। আমি তো কথা দিচ্ছি—আমার এইসব ন্যাকামো আপনাকে আর দেখতে হবে না। আপনি শান্তিতে থাকতে পারবেন।

স্নেহার ঠোঁট থেকে শেষ কথা ঝরে পড়তেই নেহারের ভেতরে যেন তীব্র ঝড় বয়ে গেলো। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সে এগিয়ে গিয়ে এক টানে স্নেহাকে নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো কোমর, যেন ভয় করছে—একটু দেরি হলেই মেয়েটি হাতছাড়া হয়ে যাবে।

স্নেহা ছটফট করতে লাগলো, বারবার নিজে কে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। চোখে রাগ, ঠোঁটে ক্ষোভ জমে আছে।

কিন্তু নেহার হাল ছাড়লো না। কণ্ঠ ভাঙা, তবুও আন্তরিকতায় ভরা

নেহার: প্লিজ জান… আমাকে মাফ করে দে। আমি আর কখনো একরকম ব্যবহার করবো না তোর সঙ্গে। তখন যা বলেছি, ইচ্ছে করে বলিনি। সবই রাগের বশে, বুঝলি? শুধু রাগের বশে…!

কথাগুলো শোনার পর স্নেহার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো, তবুও সে নিজেকে শক্ত করলো। ঠোঁটে হালকা কম্পন, কিন্তু চোখে ভাসলো জেদ।

স্নেহা: মানুষ রাগের বশে-ই নাকি সত্যিটা বলে, তাই না? আপনিও তাই বলেছেন… আমার আবেগ আপনার কাছে ন্যাকামো মনে হয়। যে আমাকে বুঝতেই চায় না, তার সঙ্গে আমি আপাতত থাকবো না। আমি চলে যাবো। আপনি আমাকে ভালোই বাসেন না… ছাড়ুন আমাকে।

তার কথাগুলো যেন তলোয়ারের মতো কেটে গেলো নেহারের ভেতরটা। বুকের মধ্যে চেপে বসলো অচেনা ভয়—সে যদি সত্যিই চলে যায়…?

তবুও নেহারের হাতের বাঁধন ঢিলা হলো না। চোখে শুধু ভেসে উঠলো ব্যাকুল অনুনয়।

চলবে…..