তুই আমার আসক্তি পর্ব-১২

0
3

(রুমান্টিক এলার্ট,অতিরিক্ত রুমান্টিক গল্প পছন্দ না তারা দূরে থাকুন)

#তুই_আমার_আসক্তি
#পর্ব_১২
#লেখিকা_তাসনিম_তালুকদার_বুশরা

কপি করা বিশেষ ভাবে নিষিদ্ধ ❌

কিছুক্ষণ পর নেহার অবশেষে স্নেহার ঠোঁট ছেড়ে দিলো। স্নেহা হাঁপাতে হাঁপাতে শ্বাস নিতে লাগলো বুক ওঠানামা করছে দ্রুত তালে। চোখেমুখে রাগ অভিমান আবার কোথাও যেনো অচেনা এক কম্পন রয়ে গেছে।

নেহার স্নেহার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো, সেই দৃষ্টি যেনো শুধু দেখা নয় একটা অনুনয়, একটা আবেদন।

নেহার: এই জান… আমার কথা টা শুন না, প্লিজ। তারপর না হয় তুই রাগ করবি।

স্নেহা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। নিঃশ্বাস সামলে নিয়ে ঠোঁট শুকিয়ে ফেললো ধীরে। কণ্ঠস্বরে এবার আরেকটু স্বাভাবিকতা ফিরলো।

স্নেহা: আচ্ছা বলুন দেখি, কি বলতে চান?

নেহার আর দেরি করলো না। স্নেহার গলায় মুখ গুঁজে দিলো, যেনো বাইরের পৃথিবী থেকে নিজেকে আড়াল করে শুধু নিজের সত্যিটা প্রকাশ করতে চাইছে। তার কণ্ঠস্বর নরম, তবুও ভারী

নেহার: ইমরানকে তুই ভুল বুঝিস না, স্নেহা। ও আসলে বাস্তবতাটা দেখেই না করেছে সুহা কে।

স্নেহা হঠাৎ কপাল কুঁচকে নেহারের দিকে তাকালো। তার চোখে স্পষ্ট প্রশ্নচিহ্ন ভেসে উঠলো।

স্নেহা: মানে…? বাস্তবতা দেখে না করেছে মানে কি?

ওর কণ্ঠে রাগের ঝাঁজ থাকলেও, ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা স্পষ্ট। নেহার একটু থেমে স্নেহার চোখের দিকে তাকালো সেই চোখে ভয়, কৌতূহল আর অস্থিরতার আগুন মিলেমিশে জ্বলছে।

রুম খানা নিস্তব্ধ হয়ে রইলো শুধু দু’জনের দ্রুত শ্বাসের শব্দ মিলিয়ে এক অদ্ভুত চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে।

কিছু ক্ষণ পর নেহার গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে স্নেহার চোখের দিকে তাকালো। কণ্ঠে ছিলো ভারী সুর, যেন অনেকটা বোঝানোর চেষ্টা করছে

নেহার: সুহারা অনেক ধনী, স্নেহা। তুই তো জানিসই, সুহা ওর বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। আর ইমরান ওর সংসার তো গ্রামের মাটিতে বাঁধা। বাবা নেই, শুধু মা আছেন। ছোট্ট একটা বাড়ি, সীমিত আয়। এখন বল এসব শুনে কি তোকে মনে হয়, সুহা সত্যিই ইমরানের সাথে সম্পর্কে জড়াবে?

স্নেহা স্তব্ধ হয়ে গেলো। কিছু বলার আগেই নেহার আবার ধীরে ধীরে কথা চালিয়ে গেলো

নেহার: আর না হয় আবেগে জড়িয়েও গেলো, কিন্তু পরে…? পরে যখন বাস্তবতা সামনে আসবে, তখন কি ওর বাবা–মা ইমরানকে মেনে নেবে? না কখনোই না।

স্নেহা দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইলো। নেহারের কথা কানে বাজছিলো, আর ভেতরে কোথাও এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হচ্ছিলো। অবশেষে নিচু স্বরে প্রশ্ন করলো

স্নেহা: ও আচ্ছা… তাহলে এসব কারণেই ইমরান ভাই সুহাকে রিজেক্ট করেছে..?

নেহার আর কিছু বললো না। শুধু ধীরে ধীরে মুখ গুঁজে দিলো স্নেহার গলায়। স্নেহা অনুভব করলো, নেহারের নিঃশ্বাস ওর গলায় গরম হয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আর সেই ছোঁয়ায় উত্তরটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো।

নেহার: হু।

রুম খানা পুনরায় নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। বাইরে বাতাসে পাতার খসখস শব্দ, ভেতরে শুধু একে অপরের নীরব শ্বাসের প্রতিধ্বনি।

~~

দুপুরের রোদটা ছিলো নরম, হালকা হাওয়া বইছিলো ক্যাম্পাসের পেছনের নির্জন জায়গায়। চারপাশে গাছের ছায়া পড়ে মাটিতে ছোপ ছোপ আলোর খেলা তৈরি করেছে। কোলাহল থেকে দূরে, শুধু দু’জন মানুষ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ইমরান আর সুহা।

ইমরান কে এখানে আসতে হয়েছিলো নেহার আর আশিকের জেদের কাছে হার মেনে, অথচ সুহা একেবারেই জানতো না ওকে এভাবে সামনে পাবে।সুহা করে স্নেহা বলেছিলো তুই এখানে একটু দাঁড়া আমি আসছি।তারপর হঠাৎ সামনে ইমরানকে দেখে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। প্রথম ধাক্কা কাটতেই চোখেমুখে ভেসে উঠলো জমে থাকা অভিমান আর রাগ।

কিছুক্ষণ নীরবতা ভেঙে সুহা হঠাৎ কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো

সুহা: আপনি আমাকে এমন মেয়ে ভাবলেন…? টাকা–পয়সার জন্য আপনাকে ছেড়ে চলে যাবো? এতটা ছোট করে দেখলেন আমাকে? আমি আপনাকে সত্যি ভালোবাসি, ইমরান ভাইয়া। এটা কোনো ক্ষণিকের আবেগ নয়।

তার চোখে চিকচিক করছে অশ্রু। দুপুরের আলোয় সেই অশ্রু যেন আরও ঝলমলে হয়ে উঠলো।

ইমরান স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সুহার দিকে। চোখের গভীরে চাপা কষ্ট, ঠোঁটে অনিচ্ছুক দৃঢ়তা। ধীরে, ভারী স্বরে বললো

ইমরান: শোনো, পড়াশোনা শেষ হলেই যে আমি একটা ভালো চাকরি পাবো, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ, আর সাধারণভাবেই বাঁচতে চাই। তোমার দুনিয়া আমার থেকে আলাদা। তুমি এখন ভাবছো আমাকে ভালোবাসো.. কিন্তু পরে? যখন বাস্তবতার দেয়াল আসবে সামনে, তখন? তখন আফসোস করবে, সুহা। আর আমি চাই না… আমার জন্য কেউ তার জীবনের জন্য আফসোস করুক।

দুপুরের রোদটা ছিল ভারী আর নীরব। চারপাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো ভবনগুলো যেন কেবল দাঁড়িয়ে আছে সব শব্দ গিলে ফেলে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। গরম হাওয়াটা ধীরে ধীরে বইছে, তবুও সুহার বুকের ভেতরটা কেমন যেন কাঁপছে। ইমরান এর ঠোঁট শক্ত করে যেন কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না।

হঠাৎ সুহা রেগে উঠে এগিয়ে এল ইমরানের দিকে। চোখে অদ্ভুত এক জেদ আর তীব্র আবেগ। পায়ের পাতার ভর রেখে সে ইমরানের হাত ধরে থাকা কটারটি আলতোভাবে চেপে ধরল, যেন কেবল হাত নয় তার হৃদয়ের ওপরও নিয়ন্ত্রণ চাইছে।

সুহা: আমি বললাম না আমি আপনাকে ভালোবাসি..!সুহার কণ্ঠ কেঁপে উঠল, কিন্তু তার চোখ দুটো অচল একটা গভীর অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে।মানে আমি আপনাকে চাই, যে কোনো মূলে। ধনী-গরিব এসব আমার কাছে মেটার করে না। আপনি পড়াশোনা করেছেন, আমি করছি। আমরা ঠিক আমাদেরটা ম্যানেজ করে নিতে পারবো। আমি ভয় পাই না।

ইমরান হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এই প্রথম কোনো মেয়ে এতটা কাছে এসেছে তার তার নিঃশ্বাস যেন তার বুকের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, তার চোখের ভাষা কেমন যেন অজানা, বিপজ্জনকও। দুপুরের আলোয় সুহার মুখটা হালকা ঘামে ভিজে ঝলমল করছে, যেন একসাথে নিষ্পাপ আর বেপরোয়া।

ইমরানের গলা শুকিয়ে গেল। কণ্ঠটা ভারী করে সে বলল, সুহা তুমি ভুল করছো। আমার সাথে তুমি থাকতে পারবে না সারাজীবন।

তার ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত ব্যথা আর ভয় মিশে গেল। কিন্তু সুহা নড়ল না। তার আঙুলগুলো এখনও ইমরানের হাতে, শক্ত করে ধরা—যেন সে যা চায়, সেটা ছাড়বে না।

সুহা: হঠাৎ কণ্ঠটা ভারী করে বলল,আমি যা করছি, সেটা আমার সুখের জন্য। তাতে আপনার কি? আপনি আমাকে একসেপ্ট করুন নয়তো,সে ইমরানের কলারের দিকে হাত বাড়িয়ে টেনে নিলো আরও কাছে, চোখে জেদ আর চাহনিতে ভয়ঙ্কর এক দৃঢ়তা।কিডন্যাপ করে নিয়ে বিয়ে করে ফেলবো আপনাকে।

ইমরান: কিছুটা থমকে গেল। চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। কণ্ঠে হালকা বিস্ময় মেশানো গাম্ভীর্য তুমি এসব করবে…? মেয়ে মানুষ হয়ে?

সুহা: ঠোঁটে বিদ্রূপের হাসি টেনে দিল। কণ্ঠে অদ্ভুত স্থিরতা অবশ্যই। আপনি যদি বিয়ে না করেন, তাহলে আমাকেই তো কিছু একটা করতে হবে, তাই না? বলুন তাহলে আমার প্রপোজ একসেপ্ট করবেন কিনা?

ইমরান কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। সুহার চোখের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতর কেমন যেন ঝড় বয়ে গেল। এত জেদ, এত ভালোবাসা এমন কিছু সে আগে কখনো দেখেনি। হঠাৎই তার ঠোঁটে মুচকি হাসি খেলে গেল।

সে মাথা নেড়ে সম্মতির ইশারা করতেই সুহার চোখ জ্বলে উঠল খুশিতে। মুহূর্তের ভেতর সে ইমরানের কলার ছেড়ে দু’হাত দিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, যেন পৃথিবীটা এক মুহূর্তে থেমে গেছে।

ইমরানও এবার হাত বাড়িয়ে সুহার কোমর জড়িয়ে ধরল। তার ঠোঁটের কোণে হাসি, কণ্ঠে গভীর আবেগ ধন্যবাদ, আপনাকে ইমরান ভাইয়া অনেক, অনেক, অনেক ধন্যবাদ।

দুপুরের নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল তাদের হৃদস্পন্দনের শব্দে। অদ্ভুতভাবে শান্ত অথচ ঝড়ের মতো উগ্র সেই মুহূর্তে তারা দু’জনেই বুঝল—এই সম্পর্কের বাঁধন আর ভাঙার নয়।

হঠাৎ করেই পরিবেশটা অদ্ভুত নীরব হয়ে গিয়েছিল। সুহা আর ইমরান একে অপরের চোখে চোখ রেখে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তটা যেন থমকে গেছে কোনো শব্দ নেই, কেবল দু’জনের হৃদস্পন্দন ভেসে আসছে।

ঠিক তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো স্নেহা, নেহার আর আশিকের সমস্বরে বলা শব্দ,
আস্তাগফিরুল্লাহ!

সাথে সাথেই ইমরান আর সুহা লাফ দিয়ে আলাদা হয়ে গেল। দুজনের মুখ লাল হয়ে উঠল, একে অপরের দিকে তাকাতেই কেমন অপ্রস্তুত হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে।

আশিক: মুখ বাঁকিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল—দুই শালা মিঙ্গেল হয়ে গেলো, আর আমাকে একা সিঙ্গেল রেখে দিলো? ছ্যাহ! তোদের মতো বন্ধু আমার চাই না।

নেহার: ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি টেনে বলল আমাদের চেহারা সুন্দর, তাই পটাতে সময় লাগে না। তোর চেহারা তো বান্দরের মতো, কে আর ধরা দেবে?

সবাই একসাথে হেসে উঠল, আশেপাশের গাছপালাও যেন কাঁপতে লাগল তাদের হাসির ঝড় সামলাতে না পেরে।

আশিক: এবার ভীষণ গম্ভীর মুখে বুক ফুলিয়ে বলল—আজকে সিঙ্গেল দেখে আমাকে টিটকারি দিচ্ছিস? মনে রাখিস, আমার বউ খুব তাড়াতাড়ি আমার কাছে চলে আসবে… হু!

স্নেহা: হেসে গড়িয়ে পড়ে বলল কিরে সুহা, প্রেম হওয়ার আগেই ইটিসপিটিস শুরু করেছিস? ছ্যাহ!

সুহা: বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে, চোখ টিপে দুষ্টুমি ভরা ভঙ্গিতে বলল—করলাম আর কয়! তার আগেই তো সবাই চলে আসলে।

হাসির রোল আবার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। দুপুরের শান্ত আকাশে সূর্যের আলোও যেন এই হাসির সঙ্গে মিশে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

চলবে……