#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
লেখিকা: নিতু সরকার
পর্ব:১৯
( সারপ্রাইজ পর্ব)
সকালের মিষ্টি আলোয় রাতের আঁধার বিলীন হতেই উন্মোচিত হলো এক নতুন ভোর। ঘুম জড়ানো শীতল সমীরণের আলতো পরশে কেঁপে উঠলো মহীরুহের বুকে সদ্য গজানো কচি কচি কিশলয়ের দল। ভোরের পূবালী বাতাসে উড়ে এলো রাশি রাশি প্রশান্তির ঢেউ।
আজকাল রিদিমার মন প্রাণ ডুবে আছে তৃপ্তীশ নামক সেই অপছন্দের মানুষটার ঘোরে। যাকে কোন এক দিন সে এতো টাই অপছন্দ করতো যে তার নামটাও পর্যন্ত শুনতে পারতো না। অথচ ইদানিং সেই মানুষটার কণ্ঠ শুনে মনের মাঝে তার সুখের ঢেউ খেলে। মানুষটার দুষ্টু মিষ্টি কথায় লাজের শিহরনে কেঁপে ওঠে তনু মন। তাকে দেখার তৃষ্ণায় চাতকের মতো তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকে তার দুটো চোখ। নীরবতার মাঝে হৃদ গহীনের অন্তরালে যেন কেউ ফিস ফিসিয়ে গেয়ে ওঠে,
“ তুমি সূর্য উদয়ের
ভোরের পাখি হয়ে
আমার এ ঘুম ভাঙালে …
তুমি রোদেলা দুপুরের
মেঘের ছায়া হয়ে
প্রেমের পরশ দিলে…
সন্ধ্যার আকাশে
শুকতারা হয়ে
আমার জীবনে এলে…
নিঝুম রাতের
রূপালী জোছনা হয়ে
আমায় পথ দেখালে..”
আজকাল বাংলাদেশী শিল্পী আসিফের গাওয়া রোম্যান্টিক গান টা বড্ড বেশি ভালো লাগে রিদিমার। গানের লিরিক্স গুলো যেন তার মনের কথা বলে দেয়। যখনই একাকীত্ব সময় কাটায় তখনই ইউ টিউব খুলে শুনতে থাকে গানটা। প্রশান্তিতে বুজে রাখে চোখ। তৃপ্তীশ এর সেই আকুতি ভরা ভালোবাসার স্বীকারোক্তি গুলো একের পর এক তার কানে বাজতে থাকে। সাথে সাথে গাঢ় হাসিতে লেপ্টে যায় তার অধরের কোণ।
**
“ তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে ভাই। যে মেয়েটা তোকে পাবলিক প্লেসে এভাবে থাপ্পড় মারলো, এতো জঘন্য ভাবে অপমান করে বিয়ের প্রস্তাব নাকচ করে দিলো। সেই মেয়ের মাত্র একবার সরি বলায় সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলি।
মা তোমার ছেলে নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব একে ডাক্তার দেখাও বলে দিলাম।”
কথাটা বলে জোরে জোরে শ্বাস ফেলল রমা। রাগের চোটে তার মাথা খারাপ হবার জোগাড়। সর্বাঙ্গ জ্বলছে তার অস্বস্তিতে। কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা ভাইয়ের এই হটকারী সিদ্ধান্ত টা। অথচ আশ্চর্য জনক ভাবে মিসেস রিতা সেই তখন থেকে চুপ করে বসে। মেয়ের ঝাঁঝালো কথাগুলো শুনে একটুও রা কাটেন নি মুখে। রমা মায়ের শীতল ব্যবহারে যারপর নাই ভীষণ বিরক্ত হলো। গলার ঝাঁঝ বাড়িয়ে আবারো বলল,
“ তুমি কি শুনতে পাচ্ছো না মা আমি তোমাকে কি বলছি।”
মিসেস রিতা এ যাত্রায় মুচকি হাসলেন। সোফায় পিঠ ঠেকিয়ে আয়েশ করে বসে বললেন,
“ না।”
“ কিহ্!”
রমা যেন বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। মস্তিষ্কের সর্বত্র ছড়ালো উদ্বেগ। মনটা যেন হঠাৎ খুব করে কু গেয়ে উঠলো। রমা মনে মনে বলে উঠলো,
“ হে ঈশ্বর! এরা কি সবাই পাগল টাগোল হয়ে গেল না কি!”
আচমকা মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে হেসে উঠলো তৃপ্তীশ। রমার বিস্ময় যেন এবার সীমা ছাড়ালো। থমকে যাওয়া কণ্ঠ স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“ তোমরা দুজনে নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছো।”
মিসেস রিতা এবার শব্দ করে হেসে উঠলেন। সাথে তাল মেলালো তৃপ্তীশ। রমা বোকার মতো মা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে।
হঠাৎ আচমকাই হাসি থামালেন মিসেস রিতা। রমার ভ্রমে ডুবে যাওয়া খেই হারানো মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ তোর কি মনে হয়, এতো সহজে ওই দেমাগী মেয়ে কে ছেড়ে দেবো আমি? কক্ষনো না। ওকে ওর লেবেল না দেখানো পর্যন্ত আমার মনের জ্বালা জুড়বে না। কত্ত বড় সাহস! আমার ছেলেকে ভরা বাজারে থাপ্পড় মারে।”
মায়ের কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো রমা। মুখমন্ডল তার ফ্যাকাশে হয়ে গেছে বিস্ময়ে। সবেগে ছুটে চলেছে হাড় পাঁজরের খাঁচায় বন্দী হৃদ যন্ত্রটা। কাঁপা গলায় বলল সে,
“ মানে! কি বলতে চাইছো তুমি?”
তৃপ্তীশ আলতো করে হাত রাখলো দিদির কাঁধে। চোখে মুখে অদ্ভুত রহস্য ফুটিয়ে বলল,
“ সেটা সময় হলেই দেখতে পাবি। তার আগে বল তোর রিদিমার উপর ঠিক কতোটা রাগ জমেছে।”
রমা যেন এ কথায় আগ্নেয় গিরির মতো ফুঁসে উঠলো। মুখভঙ্গিমায় অতিশয় কাঠিন্যতা ফুটিয়ে বলল,
“ আজ পর্যন্ত কোনোদিন কারও উপরে আমার এতোটা ঘৃণা তৈরি হয় নি যতোটা ওই মেয়ের প্রতি জমেছে। আমার মনে হয় কি জানিস, কোনো দিন যদি ও আমার সামনে এসে দাঁড়ায় না, আমি জাস্ট ওকে খু ন করে ফেলবো।”
তৃপ্তীশ হেসে বলল,
“ ঠিক আছে সেই সুযোগ তোকে দেওয়া হবে। দেখি সে সময় তুই ঠিক কি করতে পারিস?”
ভাইয়ের কথা গুলো শুনে এবারও বিস্ময়ে খেই হারালো রমা। মুখের আদলে ফুটে উঠলো তার সেই চকচকে ছাপ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে আর এতো বিস্ময় নিতে পারছে না। মিসেস রিতা মেয়ের বাকরুদ্ধ চেহারার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ তোকে এতো চাপ নিতে হবে না। যা হবে তোর চোখের সামনেই হবে। শুধু মাত্র সঠিক সময়ের অপেক্ষা কর, বুঝেছিস।”
“ তোমরা আসলে কি করতে চাইছো বলোতো?”
মিসেস রিতা এবার ধমকে উঠলেন,
“ এতো প্রশ্ন করছিস কেন? বললাম তো সময় হলেই জানতে পারবি।”
রমা আর কথা বাড়ালো না। তবে ভালো মতোই বুঝতে পারল আগত সময়ে বিরাট আকারের একটা ব্লান্ডার হতে চলেছে। যার জেরে ওই মেয়ের অতীত বর্তমান ভবিষ্যত ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে।
**
তখন বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা হবে। আজ হঠাৎ করেই মিসেস চিত্রা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হুট করেই প্রেশার টা যেন তার আকাশ ছুঁয়ে গেছে। মাথা তোলার মতো অবস্থায় মোটেও তিনি নেই। সমর ডাক্তার কে সাথে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের ছুটে এসে বাড়িতে ঢুকলো। প্রেশার মেপে ওষুধ গুলো দেখে ডাক্তার বলল,
“ মাসিমা মনে হচ্ছে ইদানিং অনেক বেশি মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। বুঝলেন মিস্টার দত্ত, এই কারণেই ওনার প্রেশার এভাবে ফল্ট করেছে।”
সমর মায়ের দিকে গভীর ভাবে তাকালো। সে ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে মায়ের এমন অসুস্থতার কারণ টা আসলে কি। যবে থেকে রঙ্গন বিয়ে করেছে তবে থেকেই চিত্রা দেবী বায়না ধরেছেন তার ঘরেও একটা বৌমা লাগবে। সমর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মা কেন বোঝেনা সে আর কাউকে নিজের সাথে জড়াতে চায় না। জীবনে একবার হৃদয় ভাঙার মতো ভয়ানক বিষাক্ত অনুভূতি সয়ে কোনো রকম টিকে আছে সে। আবারো নতুন কেউ এসে যদি নতুন করে ভেঙে দেয় তাহলে সে কিভাবে সামলাবে নিজেকে! তাছাড়া যে আসবে সে যদি সায়ন কে আপন করে নিতে না পারে তখন! সৎ মায়ের মতো আচরণ করে টর্চার করতে থাকে। বাচ্চা টা এমনিতেই মা হারা। তায় অবুঝ! সে যদি তাকে হিংসে করে ক্ষতি করার চেষ্টা করে তখন কি হবে? না না! এতো বড় ভুল কিছুতেই সে করবে না। এ জীবনে নতুন কাউকে জড়িয়ে এতো এতো সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার চাইতে এই নিঃসঙ্গ জীবন অনেক অনেক ভালো।
ডাক্তার নির্দিষ্ট মাত্রার ওষুধ লিখে দিয়ে বেরিয়ে গেল। সমর মায়ের দিকে তাকালো। মিসেস চিত্রা কপালে হাত দিয়ে উচু বালিশে আধ শোয়া হয়ে শুয়ে আছেন। সমর আস্তে ধীরে মায়ের পাশে বসলো। নরম গলায় বলল,
“ এসব তুমি কি শুরু করেছ মা বলো তো!”
মিসেস চিত্রা কপাল থেকে হাত সরিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। চোখে মুখে অন্ধকার ছড়িয়ে আছে তার। সমর মায়ের একহাত নিজের মুঠোয় চেপে ধরে বলল,
“ মা তুমি কেন বুঝতে পারছো না। আমি আমার এই ভাঙাচোরা জীবনে আর কোনো দ্বিতীয় নারী কে জড়াতে চাই না। আমার বর্তমানে একটাই লক্ষ্য ছেলেটাকে মানুষের মত মানুষ তৈরি করা।”
মিসেস চিত্রা এবার উঠে বসার চেষ্টা করলেন। সমর সাথে সাথে মাকে উঠিয়ে বসালো। মিসেস চিত্রা টলটলে চোখে তাকিয়ে বললেন,
“ আর তোর জীবন, তার কি হবে? এতো বড় একটা পাহাড়ের মত জীবন তুই এভাবেই নিঃসঙ্গ হয়ে কাটিয়ে দিবি।”
সমর মায়ের মুখটা দুহাতের আঁজলায় ভরে নিলো। চোখে মুখে বিষন্নতা ছড়িয়ে কাতর কন্ঠে বলল,
“ মা গো তুমি কেন বুঝতে পারছো না। নতুন কেউ আমার জীবনে এলে আমার সায়ন টা একে বারে অনাথ হয়ে যাবে। তার শৈশবের অর্ধেক টা ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। বাকি অর্ধেক টা আমার সুখ খুঁজতে গিয়ে তুমি নষ্ট করে দিও না। প্লীজ!”
বলেই ধুপ ধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। মিসেস চিত্রা ছলছলে চোখে সেদিকে তাকিয়ে বুক ভরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে জানান দিলেন অশেষ অভিযোগ। কেন তিনি তার ছেলেটা কে এমন ভাগ্য দিলেন? কেন তার জীবনে প্রিয়ার মত একজন কপটি নারী এসেছিল? কেন তিনি এতো অসহায় হলেন? তিনি মা হয়ে যে আর ছেলের একাকীত্ব দেখতে পারছেন না।
*
দুই বাড়িতে ধুম পড়েছে বিয়ের আয়োজন নিয়ে। মাঝে বাকি মাত্র আর কয়েকটা দিন। নিজের পছন্দের ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে পেরে আনন্দে যেন মাটিতে পা পড়ছে না মনিকার। ওদিকে সুতপার মুখেও অফুরন্ত গর্বের হাসি। শেষ মেশ তিনিই তো পূনরায় ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক টাকে জোড়া লাগিয়েছেন। এরই মধ্যে পায়ের প্লাস্টার কাটা হয়েছে তপন বাবুর। তিনি এখন ক্রাচ ব্যবহার করে হাঁটেন। তবে খুব বেশি নয়। ওই টুকটাক উঠে বাথরুম যাওয়া কিম্বা উঠে এ ঘর থেকে ও ঘরে যাওয়া পর্যন্ত। সক্কাল সক্কাল পাবলিশার্স থেকে বিয়ের কার্ড এসে হাজির। পরমা ব্যস্ত হাতে বন্ধু বান্ধব থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী দের নাম লিখতে ব্যস্ত। পাশে বসে দীপ্ত। সেও নিজের বন্ধু বান্ধব আর আত্মীয় দের নাম সাজেস্ট করছে। রিদিমা সেই মুহূর্তে সেখানে এলো। মাথায় টাওয়াল পেঁচানো। গায়ে টকটকে সবুজ রঙের চুড়িদার। সদ্য স্নান সেরে আসার কারণে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে মেয়েটা কে। মনিকা রান্নাঘর থেকে গরম রুটির হটপট টা নিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখতে এসে মেয়ের মুখের দিকে তাকালো। সাথে সাথে মনটা তার ভরে এলো উষ্ণতায়। কি সুন্দর তার ছোট মেয়েটা। কি অপরূপ তার গড়ন। রঙ টা শ্যামা তাতে কি। মুখের আদলে যেন রাজ্যের মায়া ভাসছে। ওই যে ঘন ভ্রূ জোড়ার নিচে ভাসা ভাসা টানা দুটো চোখ, যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দুটো সুপেয় জলের ভাণ্ডার স্থাপন হয়েছে সেথায়। আর মুখের হাসি, সে যেন মুক্ত ঝরায় মনে। মনিকা নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলেন। কে বলে, কেবল মাত্র গৌর বর্নটাই সৌন্দর্যের প্রতীক। এই যে তার মেয়েটা চাপা রঙের। শ্যামা! তাকে কি তার সৌন্দর্যে ভাটা পড়েছে।
মনিকার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপর মেয়েটা তার শ্বশুর বাড়িতে চলে যাবে। তখন দেখতে ইচ্ছে করলেও যখন তখন দেখতে পাবে না। রাগ উঠলে বকতে পারবে না। অভিমান করে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারবে না। আবার অতিরিক্ত আদর পেলে বুকে জড়িয়ে ধরতেও পারবে না। আবেগের তাড়নায় মনিকার চোখ দুটো ভরে এলো সহসা। সে দুপা এগিয়ে মেয়েটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। রিদিমা তখন বোনের পাশে বসে নিজের বন্ধুদের নাম আর পরিচিত দের নাম কার্ডে লিখাচ্ছিল। মাকে কাছে দেখে রিদিমা তাকালো তার দিকে। আনমনেই জিজ্ঞেস করলো,
“ কিছু বলবে মা?”
মনিকা আর এক মুহূর্তও নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। হুহু করে কেঁদে ফেলল মুখে আঁচল চাপা দিয়ে। হঠাৎ মায়ের কান্না দেখে দুই বোন চমকে উঠলো। তারা লেখা লেখি বাদ দিয়ে ছুটে এলো কাছে। মা কে জড়িয়ে ধরলো দুই জন দুই পাশ থেকে। দুই বোনই কেঁদে ফেলল মায়ের সাথে। মনিকা দুই মেয়ে কে বুকে জড়িয়ে খুব খুব কাঁদলো। কাঁদতে কাঁদতে বিলাপের সুরে আওড়ালো,
“ আমার বুকটা যে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। মা রে, তোদের ছেড়ে আমি থাকবো কীভাবে?”
সেদিন বিকেলে দিদি কে সাথে নিয়ে নিমন্ত্রণ করতে বেরোল রিদিমা। প্রথমে হেমন্ত স্যারের বাড়ি গেল। তারপর গেল সীমা দের বাড়িতে। সেখান থেকে ফিরে এলো মিতালীদের আবাসনে। সেখানে আগে মিতালী কে কার্ড দিয়ে শেষে পৌঁছল সমর দের ফ্ল্যাটে। মিসেস চিত্রা তখন সায়ন কে হরলিক্স খাওয়াচ্ছিলেন। ফ্ল্যাটের বেল বাজতেই চুমকি দৌড়ে এসে দরজা খুলল। সাথে সাথে রিদিমাকে দেখে একগাল হেসে বলে উঠলো,
“ ওমা, দিদিমণি তুমি। এসো এসো। ওমা মা, দেখে যাও সায়ন সোনার ম্যাম এসেছে।”
সায়ন ম্যাম এসেছে শুনে একলাফে সোফা থেকে নেমে ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো রিদিমার কোলে। হরলিক্স মাখা চটচটে ঠোঁট দুটো চেপে ঠাস্ ঠাস্ করে দুই গালে মাখিয়ে দিল আদুরে চুম্বন। তারপর গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“ ও ম্যাম ম্যাম তুমি কি আজ থেকে আমাকে পড়াবে?”
রিদিমা সায়নের প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না। পেছন থেকে পরমা ওর জবাব দিলো।
“ না বাবু। তোমার ম্যাম আর তো তোমাকে পড়াতে পারবে না।”
“ কেন?”…. সায়নের অবুঝ জিজ্ঞাসা। পরমা তার নরম গাল টা টেনে বলল,
“ কারণ তোমার ম্যাম এর বিয়ে টোপর মাথায় দিয়ে। চামচিকি তে বাজনা বাজায় খ্যাংড়া কাঠি দিয়ে।”
বলেই খিল খিল করে হাসলো। সায়নের এসব কথা মাথায় ঢুকলো। সে শুধু বুঝলো তার ম্যাম আর তাকে পড়াতে আসবে না। আর এতেই বেচারার এতো কষ্ট হলো যে কেঁদেই ফেলল শব্দ করে। মিসেস চিত্রা ভারী শরীর টা নিয়ে কোনোমতে উঠে এলেন। রিদিমা আর পরমা কে দেখে মুখে চওড়া হাসি ফুটিয়ে বললেন,
“ ওমা রিদিমা এসো এসো। তা উনি কে তোমার দিদি নাকি!”
রিদিমা সায়ন কে আদর করতে করতে মিসেস চিত্রার কাছে এসে দাঁড়ালো। মিসেস চিত্রা নাতির কান্না দেখে বললেন,
“ দাদুভাই ও দাদুভাই একি কাঁদছো কেন? তোমার ম্যাম এসেছে। ভালো লাগছে না।”
সায়ন থামলো না বরং আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রিদিমা কে। পরমা হেসে বলল,
“ আহ্ হা রে, ম্যামের বিয়ে হয়ে যাবে শুনে বেচারা কাঁদছে। ইস্, কি ভালোবাসে রে সুনু তোকে। আমার তো দেখেই হিংসে হচ্ছে।”
মিসেস চিত্রা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন,
“ ম্যামের বিয়ে মানে?”
পরমা পার্স থেকে বিয়ের কার্ড টা বের করে মিসেস চিত্রার হাতে দিয়ে বললেন,
“ আন্টি আমার বোনের বিয়ে আগামী সপ্তাহে। আপনি আর আপনার পরিবারের সবাই সেদিন আনন্দ বাসরে উপস্থিত থেকে আমার বোন আর তার স্বামীকে একটু আশীর্বাদ করে আসবেন।”
মিসেস চিত্রা কার্ড টা হাতে নিয়ে বললেন,
“ অবশ্যই অবশ্যই।”
কিন্তু মনের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম ব্যথা কাটার মতো ফুটে গেল। কেন যেন মেয়েটা কে দেখলে মনের মধ্যে একটা সুপ্ত ইচ্ছা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতো। তবে আজকের পর থেকে তা আর কখনও উঠবে না। কারণ মেয়েটা যে অন্যের ঘরের অলংকার হতে যাচ্ছে।
চলবে…
#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
পর্ব:২০
দেখতে দেখতে সেই বিশেষ দিনটা এগিয়ে এলো দোরগোড়ায়। আজ রিদিমার বিয়ে। বর্ষালু মরশুমের শীতল বাতাস জানান দিলো,
“ মন মোর মেঘের সঙ্গী…
তখন সকাল। প্রভাতের মিঠে আলোয় চুইয়ে পড়া প্রশান্তি। বৃষ্টির ভেজা ঘ্রাণ ভেসে আসছে মৃদু মন্দ বাতাসে। রিদিমা ওয়াশ রুম থেকে বেড়িয়ে জানালাটা খুলে দিল। সাথে সাথে একরাশ শীতল পবন তাকে ছুঁয়ে দিলো আলতো স্পর্শে। শ্যাম্পু করা রেশমী চুলগুলো উড়তে লাগলো আবেশে।
রিদিমা হাতের মেহেন্দির দিকে তাকালো। গত কাল দিয়েছিল। রাতভর ছিল। কিছুক্ষন আগেই ধুয়ে তেল মাখিয়েছে। রঙটা খুব গাঢ় হয়ে ফুটেছে হাতে। তৃপ্তীশ এর পছন্দের ডিজাইন। সিলেক্ট করে পাঠিয়েছিল। খুব বেশি ঘিজিমিজি নয় আবার খুব বেশি হাল্কাও নয়। তবে খুব নজরকাড়া। তাতে মাঝখানে ‘T’ লেখা। তবে সেটা একটু ঝাপসা হয়ে গেছে। তবুও ভালো লাগছে দেখতে। সীমা পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে মুখ ঠেকালো কাঁধে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“ মনে হচ্ছে আমাদের জামাই বাবু অনেক ভালোবাসে তাই না।”
রিদিমা লজ্জায় লাল হয়ে আলতো করে মাথা নেড়ে সায় জানালো। রিনি ওপাশ থেকে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ মুখ কুঁচকে বলল,
“ কেন জানি না আমার মনটা হঠাৎ খুব অস্থির অস্থির লাগছে।”
“ তাই নাকি! তা হঠাৎ এমন হওয়ার কারণ!”
রিদিমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগেই হাতে চাপ পড়লো রিনির। আড় চোখে তাকিয়ে দেখলো জবা ওকে মাথা নেড়ে ইশারায় না জানাচ্ছে। রিনি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো জানালার ফাঁক দিয়ে উদাস দৃষ্টি মেলে। মনটা বড্ড বেশি কু ডাকছে। মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে। তবুও সে কথা মুখে আনতে পারলো না মেয়েটা। তাই প্রসঙ্গ বদলে বলল,
“ তোদের সবার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এক এক করে। দেখনা আমাদের গ্রুপ টা কেমন যেন ভেঙে যাচ্ছে।”
রিনির কথায় রিদিমা আবেগী হয়ে পড়লো। চোখ দুটো ভিজে উঠলো মন খারাপের অজুহাতে। তাইতো দুহাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো রিনি কে। কান্না ভেজা কণ্ঠে আলতো হেসে বলল,
“ মন খারাপ করিস না প্লীজ। আমি তো বেশি দূরে যাচ্ছি না। তোদের আসে পাশেই থাকবো সব সময়।”
মেয়ের বিয়ে নিয়ে এবাড়িতে সবার ব্যস্ততা তুঙ্গে। রিনি জবা সীমা আগের দিন এসে হাজির। সুতপাও বৌমা কে সাথে নিয়ে হাজির হয়েছে বিয়ের দিন সকাল সকাল। মনিকা আর তপন বাবুর শরীর অসুস্থ তাই তাকেই আগ বাড়িয়ে সব কিছুর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে। ওদিকে বাড়ির বড় ছেলের দায় দায়িত্ব পড়েছে দীপ্তর কাঁধে। তার সাথে কাঁধ মিলিয়ে দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছে অভয়।
বেলা সামান্য বাড়তেই পরমার শ্বশুর শাশুড়ি এসে হাজির। তেনারা আবার দুই পক্ষের তরফ থেকে আমন্ত্রিত অতিথি। একদিকে একমাত্র ননদের জায়ের ছেলে আরেকদিকে ছেলের শ্বশুরবাড়ি। তাই ঠিক করেছেন এখন দেখা করে চলে যাবেন ননদের বাড়িতে। তারপর একেবারে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে ফিরবেন বরের গায়ে হলুদ ছুঁইয়ে। থাকবেন বিয়ে পর্যন্ত।
“ কই! বিয়ের কনে কোথায়! তাকে দেখি একটু।”
দিদির শাশুড়ির ডাকে শাড়ির আঁচল টা গায়ে টেনে বাইরে বেরিয়ে গেল রিদিমা। তিনি একটা নেকলেস গহনার বাক্স থেকে বার করে রিদিমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন,
“ এই নাও তোমার উপহার।”
হার টা পরানো শেষে থুতনিতে চুমু খেয়ে বললেন,
“ বাহ্ তোমাকে দারুন মানিয়েছে তো।” কই
রিদিমা তাকে প্রণাম করতেই তিনি ইতঃস্তত করে উঠলেন।
“ আরে থাক থাক হয়েছে। দেখি তোমার মেহেন্দি কেমন হয়েছে!”
রিদিমা হাত দুটো মেলে দেখালো। তিনি ভালো করে দেখে বললেন,
“ ডিজাইন তো সুন্দর ফুটেছে কিন্তু এই মাঝের t লেখা টা অমন আবছা কেন? মেহেন্দি তোলার পর কি হাতে সরষের তেল লাগাও নি?”
সে উত্তর পরমা দিলো পাশ থেকে।
“ দিয়েছিল তো। কিন্তু মাঝের ওই একটা অক্ষরেই শুধু মাত্র রং ধরে নি।”
“ আচ্ছা যাগ্গে বাদ দাও। নান্দীমুখের অনুষ্ঠান শেষ হতেই আমরা কিন্তু হলুদের তত্ত্ব নিয়ে চলে আসবো। তাই গুছিয়ে থেকে। হলুদ শেষ হতেই কমিউনিটি সেন্টারে যেতে হবে। সন্ধ্যায় আশীর্বাদ শেষে একেবারে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হবে। লগ্ন কিন্তু আটটা বেজে সতের মিনিটে।”
পরমা শাশুড়ির কথায় মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বোন কে নিয়ে চলে গেল ছাদে। যেখানে এই নান্দীমুখের আয়োজন করা হয়েছে। ওপাশে ফাঁকা ঘরে চাপা সুরে ধমকে উঠলো জবা।
“ তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কেন ওসব বলতে যাচ্ছিলি বলতো। ওর মন খারাপ হয়ে যেত না!”
রিনি হতাশ গলায় বলল,
“ বিশ্বাস কর। আমার একটুও ভালো লাগছে না কেন জানি। মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে।”
সীমা ওদের কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রিনির কাঁধে হাত রেখে ছোট গলায় বলল,
“ এসব কথা আর বলিস না প্লীজ। কেউ শুনতে পারলে খুব খারাপ ভাববে। এমনিতেও জানিসই তো এই বিয়ে নিয়ে মেয়েটা কে কম টর্চার সইতে হয় নি।”
রিনি মাথা নাড়ালো। অতঃপর ঠিক আছে বলে বেরিয়ে এলো ঘরের বাইরে।
*
জমকালো রাত। আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে কমিউটিনি ভবন। আমন্ত্রিত আত্মীয় স্বজনদের ভিড় যেন উপচে পড়ছে হল ঘরটিতে। লাল টুকটুকে বেনারসি আর গা ভর্তি সোনার গহনায় রিদিমাকে একদম যোধা আকবর মুভির যোদা বাঈ লাগছিল দেখতে। কপালে সেই রাজস্থানি টিকলি নাকে বিশালাকার নথ। টানা টানা চোখ দুটো তে স্মোকি সাজ। আর পুরুষ্ট ঠোঁট জোড়া রাঙানো চেরি রেড লিপস্টিকে। কপালের মাঝ খানে মধ্যম আকৃতির একটা টুকটুকে লাল টিপ। যাকে ঘিরে মানানসই ফেব্রিকের কলকা আঁকা। ব্যস, তাতেই যেন অপূর্ব লাগছে মেয়েটা কে। তন্মধ্যে সানাইয়ের আওয়াজ শোনা গেল। রিনি আর জবা বাদে সকলে হুড়মুড় করে ছুটলো বর দেখতে।
*
তখন সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টা বাজে। মিসেস চিত্রা ছোট্ট সায়ন নিয়ে গুছিয়ে বেরিয়ে এলেন। সমর তখন ডাইনিং রুমে বসে একমনে কাজ করছে ল্যাপটপে। গায়ে সাধারণ ট্রাউজার আর টি শার্ট। মিসেস চিত্রা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ তুই গেলে কিন্তু মেয়েটার পরিবার খুব খুশি হতো।”
সমর ল্যাপটপে ব্যস্ত আঙুল চালিয়ে বলল,
“ আলফাল কথা বলো নাতো মা। তুমি ভালো করেই জানো এসব বিয়েফিয়ে তে যাওয়া আমার একদম পছন্দ না। তাও যদি আত্মীয় হতো ভেবে দেখতাম। কোথাকার কে তার নেই ঠিক। আমি যাবো না।”
মিসেস চিত্রা আর কথা বাড়ালেন না। শুধু বললেন,
“ ঠিক আছে যাসনা। কিন্তু আমাদের অন্তত পৌঁছে তো দিয়ে আয়।”
তারপর গলা বাড়িয়ে জোরে ডেকে উঠলেন,
“ চুমকি, তোর হলো!”
চুমকি নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। একটা লাল কাতানের শাড়ি পড়েছে মেয়েটা। ফর্সা শরীরে দারুন মানিয়েছে তাকে। তাতে আবার খোঁপায় গোলাপ ফুল গুঁজেছে। সেই সাথে প্রসাধনীর ছোঁয়ায় সৌন্দর্য যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। চুমকি মাথার গাজরা টা ঠিক করতে করতে এগিয়ে এলো কাছে। সমর হঠাৎ চোখ তুলে তাকালো। চুমকির মাথা নষ্ট করা সাজ দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“ বিয়ে খেতে যাচ্ছিস নাকি করতে।”
চুমকির মুখটা একথায় শুকিয়ে পাংশু হয়ে গেল। মুখ কালো করে ঠোঁট উল্টে বলল,
“ তুমি এমন কেন গো দাদাভাই। কি এমন সেজেছি বলোতো!”
“ ওর কথা বাদ দে তো। সব কিছুতেই ওর বাড়াবাড়ি। নিজে যাবে না আবার কেউ সাজলে তাকে কথা শুনাতেও ছাড়বে না। ওকি কি বোঝে সাজের। বিয়ে বাড়িতে একটু এরকম না সাজলে চলে!”
মায়ের বকুনি খেয়ে সমর আর কথা বাড়ালো না। নিজের মতো কাজ করতে লাগলো। মিসেস চিত্রা চুমকির দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ বাহ্ খুব সুন্দর লাগছে তো তোকে। কে সাজিয়ে দিল এত সুন্দর করে?”
চুমকি লাজুক হেসে বলল,
“ তিনতলার মিতালী দি। আজ সেও বেনারসি পরেছে। দারুন লাগছে দেখতে।”
মিসেস চিত্রা ঘড়িতে সময় দেখে বললেন,
“ কি রে পৌঁছে দিতে যাবি নাকি আমরা অটো নিয়ে চলে যাবো।”
“ পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো। রঙ্গন আর আন্টি আসছে ওর গাড়ি নিয়ে। ওদের সাথে চলে যাও।”
মিসেস চিত্রা আর কথা বাড়ালেন না। আস্তে ধীরে বেরিয়ে গেলেন বাইরে। সমর ল্যাপটপ টা রেখে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ছেলে কে এক পলক দেখে মায়ের দিকে সতর্ক বানী ছুঁড়ে বলল,
“ সায়ন কে কারও কাছে ছাড়বে না কিন্তু। আর যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে আসবে।”
**
বিয়ে বাড়ির বিশাল আয়োজনের মাঝে মানুষের ঢল নেমেছে যেন। আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব পাড়া প্রতিবেশী দের ভিড়ে একদম থৈ থৈ অবস্থা। রিদিমাকে বসানো হয়েছে হল ঘরের ডানপাশে একটা রাজকীয় সিংহাসনে। তাকে ঘিরে সমানে চলছে ফটোশুট। হলের একদম শেষ মাথায় চলছে বিয়ে পড়ানোর আয়োজন।
মিসেস চিত্রাকে দেখে রিদিমা হাসি মুখে এগিয়ে এলো। সায়নের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“ আন্টি এতো দেরি করলেন যে।”
“ ওই হয়ে গেল একটু। বোঝই তো বুড়ো মানুষ।”
বলে মিসেস চিত্রা হাসলেন। তারপর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মেয়েটার দিকে। তার যেন নজরই সরছিল না মেয়েটার মুখ থেকে। সাবেকিয়ানা সাজে মেয়েটাকে এতটাই সুন্দর লাগছিল তা যেন বলার বাইরে। চুমকি রিদিমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“ তোমাকে কি সুন্দর লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না।”
রিদিমা সে কথায় কেবল লাজুক হাসলো। তবে উত্তর দিলো না। আসলে সবাই সত্যি কথাই বলে। মেয়েদের গায়ে নাকি বিয়ের জল পড়লে সুন্দরী হয়ে যায়। রিদিমা কে দেখে যেন তেমনই লাগছে মিসেস চিত্রার।
রঙ্গন পাশ থেকে সামনে এসে রিদিমার দিকে স্মিত হেসে জানালো,
“ কেমন আছেন শ্যালিকা ম্যাডাম।”
রিদিমা রঙ্গন এর দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো।
“ ভালো। আপনি কেমন আছেন জিজু?”
“ খবর টা তোমার বান্ধবী বোধ হয় ভালো বলতে পারবে। তা কোথায় আছেন তিনি।”
বলেই এদিক ওদিক চোখ ঘোরালো। রিদিমা আবারো হেসে বলল,
“ চিন্তা করবেন না জিজু। আপনার বউ সুস্থই আছে। ওদিকে গেছে বরপক্ষের সাথে একটু টাস্কি দিতে।”
রঙ্গন চোখ দুটো বড় বড় তাকিয়ে বলল,
“ ওহ্ নো।”
গিফ্ট টা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“ এই নাও ধরো তাড়াতাড়ি তোমার গিফ্ট। আমাকে তাড়াতাড়ি বৌ খুঁজতে যেতে হবে। নয়তো, বোঝোই তো বুড়ো বয়সে কচি বউ। রিস্ক নেওয়া যাবে না।”
বলেই চোখ টিপলো সে। রিদিমা রঙ্গন এর কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠলো। রঙ্গন ও হাসলো ওর হাসি দেখে।
“ আর শোনো বিয়ের ঝামেলা মিটলে তোমার কর্তা কে নিয়ে একদিন আসবে কিন্তু। অগ্রিম নিমন্ত্রণ করে গেলাম।”
রিদিমা বলল,
“ আচ্ছা যাবো।”
রঙ্গন চলে গেল মিসেস চিত্রা কে নিয়ে। তন্মধ্যে হেমন্ত তুলি কে নিয়ে উপস্থিত হলো সেখানে। কোলে তার দুবছরের মেয়ে। তুলি আর রঙ্গন গিফ্ট টা হাতে তুলে দিয়ে ছবি তুলছিল রিদিমার পাশে দাঁড়িয়ে ঠিক তখনই ভেসে এলো চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ।
_______
“ এই বিয়ে কিছুতেই হবে না।”
মিসেস রিতার হুংকার ভরা চিৎকারে এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেল একেবারে। হৈ হুল্লোড় ভরা পরিবেশে মুহূর্তের মধ্যেই যেন আছড়ে পড়লো শুনশান নীরবতার ঝড়। বর পক্ষ থেকে শুরু করে কনে পক্ষ প্রত্যেকে যেন বিস্ময়ে হত বিহ্বল। প্রত্যেকের চোখে একটাই প্রশ্ন, কি কারণে এই গণ্ডগোল। কি এমন নিগূঢ় রহস্য উন্মোচিত হয়েছে এই শেষ বেলার আসরে।
তৃপ্তীশ এর বাবা নন্দন বাবু স্ত্রীর কাছে এগিয়ে এলেন। তার দিকে তাকিয়ে অবাক সুরে বললেন,
“ কি হয়েছে রিতা। হঠাৎ এতো চিৎকার চেঁচামেচি কেন করছো?”
“ এমনি এমনি চেচাচ্ছি না। সঙ্গত কারণেই চেচাচ্ছি আমি।”
কিছুটা দূরত্বে একটা চেয়ারে তপন বাবু বসা ছিলেন। তিনি ব্যস্ত হয়ে ক্রাচে ভর করে এগিয়ে এলেন কাছে। চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে বিনম্র কন্ঠে বললেন,
“ কি হয়েছে দিদিভাই, কোন রকম সমস্যা…
মিসেস রিতা যেন সে কথার কর্ণপাতও করলেন না। বরং পুরোহিত মশাইয়ের দিকে আগুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবারো ছুঁড়ে দিলেন ভয়ংকর হুংকার,
“ কি হলো ঠাকুর মশাই শুনতে পান নি আপনি। বললাম না এই বিয়ের অনুষ্ঠান এক্ষুনি বন্ধ করুন।”
অমন হুংকার শুনে পুরোহিত মশাই চুপসে গেলেন একেবারে। দীপ্ত পরমা মনিকা থেকে শুরু করে সকলেই উদ্বেগ নিয়ে ছুটে এলো সেখানে। চেঁচামেচির মাঝে পরমার শ্বশুর শাশুড়ি আর পিসি শাশুড়ি এগিয়ে এলেন। মিসেস রিতার দিকে তাকিয়ে সূচি দেবী শুধোলেন,
“ কি হয়েছে ছোট। এভাবে বিয়ে বন্ধ করতে বলছিস কেন?”
মিসেস রিতা এবারও সে কথার জবাব দিলেন না। বোধ হয় মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন। ওদিকে নন্দন বাবু স্ত্রীর ব্যবহারে প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। সেই সাথে তার মেজাজটাও খারাপ হলো মান সম্মান উচ্ছন্নে যাচ্ছে দেখে। তিনি মিসেস রিতার বাহু ধরে টেনে নিজের দিকে ফেরালেন। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“ রিতা, কি হচ্ছে কি এসব! হঠাৎ করে বিয়ে বন্ধ করতে চাইছো কেন?”
মিসেস রিতা স্বামীর হাত টা ঝাড়ি মেরে ছাড়িয়ে নিলেন। হাতের মুঠোয় চেপে ধরা এক বাঞ্চ দশ বাই বারো ইঞ্চি মাপের এক বাঞ্চ ফটো এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,
“ কেন চাইছি তোমরা নিজের চোখেই দেখে নাও। আমার মুখের কথা তোমাদের বিশ্বাস হবে কেন?”
মুহূর্তেই সবাই থমকে গেল ফটো গুলো দেখে। মনে প্রশ্ন জাগলো, কি এমন থাকতে পারে সেখানে যা নিয়ে এতো কিছু। নন্দন বাবু একে একে সেই ফটো গুলো দেখতে লাগলেন। সহসাই রাগে অপমানে মুখটা তার পাংশু বর্ন হলো। সাথে সাথে সেগুলো ফ্লোরে ফেলে তিনিও হুঙ্কার ছুঁড়ে চিৎকার করে উঠলেন,
“ বাবু, উঠে আয়। এই বিয়ে কিছুতেই হবে না।”
হতবাক তপন বাবু মাটিতে পতিত ছবি গুলোর দিকে তাকাতেই থমকে গেলেন। চোখ দুটো বুজে নিলেন লজ্জায়। ইস্, নিজের মেয়ের এমন রুপ তিনি যে কখনও দেখবেন তা যেন তার কল্পনাতেও আসেনি কখনও।
সুতপা আর মনিকা ত্রস্ত ছুটে এসে সেগুলো কুড়িয়ে চোখের সামনে তুলে ধরতেই তারা স্তব্ধ হয়ে গেলেন একেবারে। নিজেদের চোখ কে যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলেন না, তাদের মেয়েকে এক জ্বলজ্যান্ত পুরুষকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সেই পুরুষ টাও তাকে দুহাতে এমন ভাবে নিজের বুকে জড়িয়ে রেখেছে দেখে মনে হচ্ছে তাদের মাঝে যেন প্রেম উথলে পড়ছে। মনিকার বাকি ছবি গুলো আর দেখার সাহস হলো না। সে রীতিমত ধপ করে বসে পড়লো সেখানে। এরই মধ্যে তৃপ্তীশ উঠে এসে ছবি গুলো দেখতে লাগলো। মুখের আদলে এমন একটা বিস্ময়কর ভাব ফুটিয়ে তুলল যেন সে সত্যিই ভীষণ অবাক হয়েছে সেগুলো দেখে। সেই ছবি গুলো একে একে পৌঁছে গেল ভরা বিয়ে বাড়ির সকলের কাছে। সকলের মুখে চাপা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়তেই মিসেস রিতা মনে মনে হাসলেন। যাক, তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে মনে হচ্ছে। এবার ডঙ্কায় শেষ বাড়ি মারতে নিজেকে আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে চিৎকার ছুঁড়ে বললেন,
“ কি হলো এখনও তোমরা দাঁড়িয়ে আছো কেন? বললাম না এই বিয়ে হবে না।”
________
মনিকা যেন এ পর্যায়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। উঠে দাঁড়িয়ে মিসেস রিতার হাত ধরে অনুনয় করে বললেন,
“ এমন কথা বলবেন না দিদিভাই। আমার মেয়েটা যে লগ্নভ্রষ্টা হবে।”
“ হলে হবে। তাই বলে কি আপনার সাত না ঙের সাথে চষে বেড়ানো মেয়ে কে আমাদের ঘাড়ে গছাবেন।”
“ আমার মেয়ে এমন নয়। বিশ্বাস করুন এই ছবি গুলো সব মিথ্যে।”
রিদিমা চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ছুটে সেখানে হাজির হতেই থমকে গেল মায়ের আর্ত অনুনয় দেখে। গুটি গুটি পায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তার দিকে তাকালো রমা। গলা হাঁকিয়ে বলে উঠলো,
“ এই যে সতী দেবী এখানে চলে এসেছেন। জানেন আপনারা, এই মেয়ে মাত্র কয়েক মাস আগেও আমার ভাইয়ের সাথে বিয়ে করবে না বলে জেদ ধরে ছিল। হঠাৎ কি হলো কে জানে! ধুম করে বিয়েতে রাজি হয়ে গেল। এখন বুঝতে পারছি যার সাথে ইটিস পিটিস করতো সেতো খেয়ে দেয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ওই জন্যই আমার ভাই কে বোকা বানিয়ে তার ঘাড়ে চাপাতে চাইছে।”
মিতালীর হাতেও একটা ছবি এসে পৌঁছেছে। সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রিদিমা সেই পুরুষের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। রিদিমার সাথের পুরুষ টাকে দেখা মাত্রই চিনে ফেলল সে। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে হুট করেই বলে উঠলো,
“ ওহ্ মাই মাইন! এতো আমাদের সমর বাবু। আমাদের সোসাইটির সবথেকে রিচেস্ট পার্সন। রিদিমা ওনার ছেলে কে পড়ায়। ওই তো ওনার মা আর ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ওখানে।”
মিতালীর হাতের ইশারা পেয়ে সকলের দৃষ্টি ঘুরে গিয়ে পড়লো তাদের দিকে। মিসেস রিতা মুখ ভেংচে বললেন,
“ এবার বুঝেছি, এতো বারণ করা সত্ত্বেও কেন এই মেয়ে পড়াতে যাওয়া বন্ধ করে নি। মধু! পর পুরুষের কাছে গিয়ে মধু খেতে যেত যে। ছিঃ! আগে যদি জানতাম তাহলে মরে গেলেও এই বাড়িতে সম্বন্ধ করতে আসতাম না।”
রঙ্গন সাথে সাথে এগিয়ে এসে মিতালীর হাত থেকে ছবিটা নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরতেই চমকে উঠলো। মিসেস চিত্রা ছবি টা দেখে সাথে সাথে বুকে হাত চেপে বসে পড়লেন চেয়ারে। তার চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে তার মস্তিষ্ক প্রায় শূন্য হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।
“ আন্টি আপনি ঠিক আছেন?”
রঙ্গন এর প্রশ্নে মিসেস চিত্রা রিক্ত দৃষ্টি তে তাকালেন তার দিকে। অতঃপর কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন,
“ সমর কে এখানে আসতে বল।এক্ষুনি!”
রঙ্গন সাথে সাথে সেখান থেকে সরে গিয়ে একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো। পকেট থেকে ফোন বার করে কল লাগালো সমর কে।
________
সমর ল্যাপটপে কাজ করছিল। হঠাৎ রঙ্গন এর ফোন পেয়ে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হড়বড় করে সে বলে উঠলো,
“ হ্যালো! সমর! ইয়ার তুই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে বাড়িতে চলে আয়।”
কথা গুলো শুনে সমরের ভ্রূ কুঁচকে গেল। সে বিস্ময় নিয়ে শুধোল,
“ কেন? আমি তো বললাম আমি যাবো না ওখানে।”
রঙ্গন ওকে কথা শেষ করতে না দিয়েই আবারো বলল,
“ ভাই এখানে বিশাল এক সমস্যা হয়ে গেছে।”
সমস্যার কথা শুনে চমকে উঠলো সমর। হুট করেই মা ছেলের চিন্তায় বুকটা কেঁপে উঠলো তার। সে তাড়াহুড়ো করে শুধোল,
“ মা আর সায়ন ঠিক আছে তো।”
“ এখনও পর্যন্ত আছে। কিন্তু কতক্ষন থাকবে আমি জানি না। তুই শিগগির চলে আয় ভাই।”
“ মানে কি হয়েছে…
কথা টা পুরো শোনার আগেই ফোন কেটে দিলো রঙ্গন। চিন্তায় উদ্বিগ্ন সমর হ্যালো হ্যালো করে উঠলো বার কয়েক। কিন্তু কাজ হলো না। কল ব্যাক ও করলো কিন্তু রিসিভ হলো না দেখে আর এক মুহূর্তও দেরি করলো না সমর। মুহূর্তের মধ্যেই গাড়ির চাবি নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
_______
“ আমি সত্যিই ভাবিনি! তুমি আমাকে এভাবে চিট করবে রিদিমা।”
বলেই একটানে গলার মালা ছিঁড়ে তৃপ্তীশ রিদিমার মুখে ছুঁড়ে মারতেই রিদিমা হাউমাউ করে ডুকরে কেঁদে উঠলো। তৃপ্তীশ এর হাত দুটো চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো,
“ বিশ্বাস করো তৃপ্তীশ, এই ছবি গুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতির। এই গুলো যারা তুলেছে তারা আমাকে বদনাম করার জন্য এ সব করেছে। সমর বাবুর সাথে আমার এরকম কোনো আজেবাজে সম্পর্ক নেই। উনি ভীষণ ভালো এবং সম্মানিত একজন মানুষ। প্লীজ তৃপ্তীশ আমাকে বিশ্বাস করো।”
তৃপ্তীশ এক ঝাড়া দিয়ে রিদিমার হাত টা সরিয়ে দিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলো,
“ সেটাই। সে কারণেই তো তোমার কলেজের সামনে আমার গায়ে হাত তুলেছিল ওই দিন। আমাকে শাসিয়েও ছিল ওই লোক যাতে তোমার আসেপাশে না যাই। সেদিন বুঝি নি। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি উনি তোমার প্রতি এতো কেন পজেসিভ ছিলেন।”
“ না তৃপ্তীশ তুমি ভুল ভাবছো। এটা মিথ্যে। বিশ্বাস করো আমি…!”
তৃপ্তীশ আর দাঁড়ালো না। মাথার টোপরটা দুমড়ে মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলে ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। ছেলের পেছন পেছন হাঁটা দিলেন নন্দন বাবু ও। রমা মুখে যা এলো তাই বলে গাল মন্দ করতে বেরিয়ে গেল। মিসেস রিতা হুট করে রিদিমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষন আগে আশীর্বাদে পরানো সোনার নেকলেস টা রিদিমার গলা থেকে টান দিয়ে খুলে নিলেন। মিসেস মনিকার দিকে বিষাক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“ শুধু জন্ম দিলেই হয় না। ছেলে মেয়েকে সুশিক্ষায় মানুষ ও করতে জানতে হয়।”
মিসেস রিতা ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন কমিউনিটি সেন্টারের বাইরে। চোখে মুখে তার তৃপ্তির হাঁসি। মনে সুখের আবেশ। যাক, শেষ পর্যন্ত ওই বজ্জাত মেয়ের দর্প ভাঙতে পেরেছেন তাহলে। মিসেস রিতা বেরিয়ে যেতেই বিয়ে বাড়ির আসরে ভাঙন ধরলো। তার পিছু পিছু একে একে বেরিয়ে যেতে লাগলো বরযাত্রীর সবাই। মনিকা রক্তিম চোখে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। তারপর আচমকাই ঠাস্ করে থাপ্পড় কষিয়ে দিলেন রিদিমার ডান গালে। চড়ের তোড়ে মেয়েটা পড়তে নিলেই তাকে দুপাশ থেকে আগলে ধরলো রিনি জবা আর সীমা। মনিকা তেড়ে এসে ওদের হাত থেকে রিদিমাকে টেনে এনে চুলের মুঠি খাবলে ধরে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করলো।
“ অসভ্য মেয়ে। পড়াতে গিয়ে এসব করে বেরাতিস তুই। তোকে আজ মেরেই ফেলবো আমি।”
দুচারটে চড় মারতেই সুতপা এসে ঠেকালো বোন কে। রিদিমা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“ মা বিশ্বাস করো, এসব মিথ্যে। বাবা বিশ্বাস করো এই সব কিছু মিথ্যে।”
মেয়ের কথায় আজ আর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না তপন বাবু। তার অভিব্যক্তি কেমন যেন পাথরের মতো হয়ে গেছে। রিদিমা ছুটে বাবার কাছে এসে দাঁড়ালো। বাবার হাত ধরে হৃদয়ের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে বলল,
“ বাবা তুমি অন্তত আমাকে বিশ্বাস করো। এই ছবিতে যা কিছু দেখানো হয়েছে সব কিছু মিথ্যে। বাবা…
তপন বাবু আলগোছে মেয়ের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত টা ছাড়িয়ে নিলেন। অশ্রু সিক্ত চোখে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বললেন,
“ বাবার ভালোবাসার ভালো প্রতিদান দিলি মা। খুব ভালো প্রতিদান দিলি।”
বলেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সরে গেলেন সেখান থেকে। রিদিমা আজ তার সবচেয়ে ভরসার জায়গা হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ঠিক তখনই মিসেস চিত্রা এগিয়ে এলেন সামনে। রিদিমার পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,
“ তপন বাবু, আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে। আমি আপনাদের মেয়েকে আমার পুত্র বধূ করতে চাই। এক্ষুনি। এই মণ্ডপে।”
চলবে….
#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
পর্ব: ২১
আচমকা ঝড়ের প্রশমনে যেমন নিস্তব্ধতায় থমকে যায় চারিদিক। গুমরে ওঠা মেঘেরা শুধু মাঝে মাঝে তাদের অস্তিত্বের জানান দেয়। ঠিক তেমনই করেই এক গুমোট ভারাক্রান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে গোটা কমিউনিটি সেন্টার জুড়ে। যেখানে মনিকার কান্নার শব্দরা ছাড়া বাকি সব কিছু স্তব্ধ।
ওদিকে রিদিমা নির্বিকার। হল ঘরের পিছলে পড়া আলোয় তার রক্তিম নয়ন যুগল ভরসা খুইয়ে নুয়ে পড়েছে অন্তরের ভাঙনে। তপন বাবুর বলা ওই ছোট্ট দুটো বাক্য তাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, সে তার নিজের অস্তিত্ব ইতিমধ্যে হারিয়ে ফেলেছে ওই মানুষটার চোখে।
রিদিমা চোখ বুজে ব্যাথাতুর শ্বাস ছাড়লো। দুপা পিছিয়ে টলে পড়ে যেতে নিতেই তাকে নিমেষেই আগলে নিলো পাঁচ জোড়া হাতের দৃঢ় বন্ধন। রিনি জবা সীমা অভিষেক আর কপিল। রিদিমা ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের দিকে তাকাতেই তারা তাকে চোখের ইশারায় ভরসা যোগালো। বোঝালো, ভয় পাস না। আমরা আছি তোর পাশে। তন্মধ্যে কপিল একটু সাহস দেখালো। রিদিমার ওই অচঞ্চল মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ আঙ্কেল আন্টি, আপনারা শুধু শুধু রিদি কে দোষারোপ করছেন। আপনারা বোধ হয় জানেন না আজকাল টেকনোলজি কতটা এগিয়ে গেছে। যেকোনো ছবি এ আই দিয়ে অনায়াসে বানিয়ে ফেলা যায়। আপনি চাইলে আমি এক্ষুনি প্রমাণ এনে দেখাতে পারি।”
বেচারা কপিলের কথা শেষ হতে না হতেই মুখের উপর ঝামটা দিয়ে ওঠে সুতপা,
“ তাই যদি হবে তাহলে ও কেন বলল এসব ছবি গুলোর পরিস্থিতি আলাদা। তারমানে তো এটাই দাঁড়ায় এই ছবি গুলো মিথ্যে নয়, সব সত্যি।”
কপিল আর বলার মতো কথা পেল না সুতপার জবাব শুনে। কারণ কথাটি যে তারও কানে এসেছে। মেয়েটা আসলেই বোকা। কিছু কিছু সময় যে পরিস্থিতি বুঝে সত্যিটা চেপে যেতে হয় সেটা জানে না। সুতপা মনিকা কে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ছুটে এসে রিদিমার এক হাত খাবলে ধরলো খপাত করে। অতঃপর গলার স্বরে প্রচন্ড তেজ ঢেলে বলে উঠলো,
“ বল, ওই এক বাচ্চার বাপের মাঝে কি এমন পেলি যে এতো ভালো একটা ছেলে তোর নজরে এলো না।”
রিদিমা চমকে তাকালো সুতপার দিকে। বিস্ফারিত নয়ন যুগল যেন ছিটকে পড়ার জোগাড়। ত্রস্ত মস্তিষ্কের দাপাদাপিতে শ্বাসের বেগ বেড়ে একাকার। ওদিকে সুতপা বলতেই থাকলো,
“ ওহ্ হো তাই তো বলি এতো এতো কাহিনী হয়ে যাচ্ছে। মা টা পর্যন্ত মরতে পড়লো তাও মেয়ে রাজি হয় না কেন?
এবার বুঝেছি, টাকা দেখে পিছলে গেছিস তাই না। টাকাওয়ালা লোক ফাঁসাবি বলে এক বাচ্চার বাপের সাথে ফষ্টিনষ্টি করতেও তোর বিবেকে বাঁধলো না। ছি, তোর টাকার উপর এতো লোভ।”
“ মাসীমণি!”
কন্ঠ চিরে শব্দ টুকু কোনোমতে বেরিয়ে এলো মেয়েটার। সুতপার নোংরা কথার বানে ভেসে রিদিমা যেন মাটিতে মিশে গেল। প্রবল আশায় বুক বেঁধে নজর ঘুরিয়ে বার বার তাকালো বাবা মায়ের দিকে। যাতে তাদের কেউ একজন যেন প্রতিবাদ করে বলে ওঠে,
‘চুপ করো তোমরা। আমার মেয়ে এমন কাজ কখনও করতেই পারে না। যে যাই বলুক না কেন, আমি জানি আমার মেয়ে কেমন। কারণ আমি আমার মেয়েকে জন্ম দিয়েছি। এতো গুলো বছর ধরে নিজের বুকে জড়িয়ে মানুষ করেছি। আমি তাকে বিশ্বাস করি। এই মহাবিশ্বের চন্দ্র সূর্যের অস্তিত্ব যেমন সবাই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে, ঠিক তেমনি করেই আমি আমার মেয়েকে বিশ্বাস করি।’
রিদিমা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ওই অশ্রু ভেজা কাজল কালো চোখে চেয়ে। মেকাপে সজ্জিত কপোল জোড়া তার ভিজে একাকার বয়ে যাওয়া নোনা জলের ঢলে। অপেক্ষার প্রহর গুনলো হৃদয়ের সবটুকু আশ্বাস উজাড় করে দিয়ে। এই বুঝি কেউ তার হয়ে দুটো কথা বলল।
কিন্তু হায়! তার সমস্ত আশায় জল ঢেলে শেষ পর্যন্ত কেউ এগিয়ে এলো না তাকে ভরসা দিয়ে তার চরিত্রের উপর লেপ্টে যাওয়া কালিমা টুকু মোচন করে দিতে। কেউ এলো না তার পাশে দাঁড়িয়ে বলতে,
চিন্তা নেই! আমি আছি।
সুতপা এতে করে যেন আরেকটু সুযোগ পেল। সেদিনের অপমানের শোধ তুলতে বলল,
“ এই যে তোকে ওই লোক খেয়ে দেয়ে ছেড়ে দিয়েছে। এদিকে তৃপ্তীশ ও তোর মুখে জুতো মেরে চলে গেল। এবার কার গলায় ঝুলবি। তোর এই কেচ্ছা শোনার পর তো মনে হয় রিক্সাওয়ালা ও তোকে পুছবে না।”
মিসেস চিত্রা এতক্ষণ একপাশে বসে ছিলেন চিন্তায় ভাবনায় ভঙ্গুর হয়ে। কি থেকে কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করছিলেন একমনে। তার ছেলেটা আজ চার বছরের অধিক সময় হলো একাকিত্বের জীবন পার করছে। প্রিয়ার কাছে ঠকে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কখনও কোনো দিন তাকে কোনো নারীর প্রতি আসক্ত হতে দেখা যায় নি। তাহলে আজ হঠাৎ এমন একটা ঘটনা কীভাবে ঘটে গেল সেটাই যেন তার বোধগম্যতার ঊর্ধ্বে চলে গেছে।
কিন্তু আচমকা সুতপার নোংরা কথা গুলো শোনা মাত্রই তার মাথায় যথারীতি আগুন ধরে গেল। তার নিষ্পাপ ছেলেটার পাশাপাশি নিরপরাধ মেয়েটা কে এভাবে কলঙ্কিত হতে দেখে মনে মনে এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। সাথে সাথে তিনি চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে এলেন সবার সামনে। রিদিমার ভাঙাচোরা মুখটার দিকে তাকিয়ে তার ঠান্ডা হয়ে আসা হাত দুটো মুঠোয় পুরে নিলেন।অতঃপর, সবার মাঝে জোর গলায় বলে উঠলেন,
“ তপন বাবু, আপনাদের কারও যদি আপত্তি না থাকে আমি আপনাদের মেয়েকে আমার পুত্র বধূ করতে চাই। এক্ষুনি, এই মণ্ডপে।”
______
রেলওয়ে ক্রসিং এর বিরাট জ্যাম কাটিয়ে সমরের গাড়িটা তখন সদ্য থেমেছে সেন্টারের বাইরে। ওমনি গলা ফাটিয়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। চাপ বাঁধা গুমোট অন্ধকারে মুহূর্তে তলালো ধরণী।
সমর কোনো মতে গাড়িটা পার্ক করে দৌড়ে ঢুকলো হলে। ততক্ষণে জেনারেটর চালু করা হয়েছে। সমর সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই থমকে গেল বিয়ে বাড়ির থমথমে অবস্থা দেখে। তবে সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। তন্মধ্যে মায়ের কণ্ঠ কর্ণপাত হলো সামনে জমা ভিড়ের মধ্যে থেকে। মায়ের বলা কথা গুলো শুনে ব্যস্ত পায়ে ভিড় ঠেলে ঢুকলো ভেতরে। ততক্ষণে মিসেস চিত্রা আরেক দফা একই কথা বলে উঠতেই পাশ থেকে গর্জে উঠলো সমর।
“ মা! কি হচ্ছে এখানে?”
মনিকা চোখ তুলে সমর কে দেখা মাত্রই উঠে ছুটে এসে খাবলে ধরলো তার শার্টের কলার। আগুন ঝরা চোখে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,
“ শয়তান, আমার মেয়েটার সর্বনাশ করতে তোর বিবেকে বাঁধলো না।”
“ মা! ওনাকে দোষ দিও না। উনি নির্দোষ।”
রিদিমার কথা বলা শেষ হতেই মনিকা সমরের কলার ছেড়ে ছুটে গিয়ে আবারো চড় কষালো মেয়ের গালে।
“ শয়তান মেয়ে, পিরিত দেখাও এখনও।
নিজের হাতে জীবনটা নরক বানিয়ে ফেলে এখনও পিরিত দেখাও তুমি তাই না!”
মিসেস চিত্রা রিদিমা কে টেনে নিজের আড়ালে রেখে মনিকার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কন্ঠে তেজ ঢেলে বললেন,
“ খবরদার, আমার হবু পুত্রবধূর গায়ে যেন ভুলেও আর হাত না তোলা হয়।”
মনিকা ক্ষেপা চোখে তাকালো। ঝাঁঝাল গলায় ব্যাঙ্গ করে বলে উঠলো,
“ উহ! হবু পুত্রবধূ। কে দিয়েছে আপনার ছেলে কে মেয়ে। আমরা তো দেই নি। তাহলে?”
মিসেস চিত্রার কথা ফুরায় এ পর্যায়ে এসে। ঘাড় ঘুরিয়ে আবোধ চোখে চায় ছেলের দিকে। ততক্ষণে মনিকা রিদিমার হাত ধরে টেনে আড়াল থেকে এনে দাঁড় করালো সবার সামনে। চোখে তার আগুন। যেন পুড়িয়ে জ্বালিয়ে শেষ করে দেবে।
এদিকে হতভম্ব সমর। এতক্ষণের কথাবার্তা শুনে মাথার উপর তার আকাশ ভেঙে পড়লো যেন। তন্মধ্যে রঙ্গন আর হেমন্ত তাড়াহুড়ো করে ছুটে এলো সেখানে।
“ এদিকে আয়। আমি তোকে সবটা বলছি!’ বলেই টেনে নিয়ে গেল হলের কোণে।”
একদফা বিস্তর আলোচনা শেষ করে সমর ফিরে এলো রঙ্গনের সাথে। দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে সরাসরি গিয়ে দাঁড়ালো রিদিমার সামনে। বিধ্বস্ত মেয়েটার মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে বলল,
“ মিস্ রিদিমা আমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে আপনার কোনো সমস্যা আছে।”
সমরের প্রস্তাব শুনে সাথে মুখ তুলে তাকালো রিদিমা। ভেঙে আসা দূর্বল কণ্ঠে আওড়াল,
“ আপনি তো কোনো দোষ করেন নি। তাহলে কেন শুধু শুধু তার দায় নিতে চাইছেন।”
“ দোষ কার সেটা না হয় পরেই আলোচনা হোক। তার আগে বলুন আপনার এই বিয়েতে আপত্তি আছে কি না।”
রিদিমা এ কথার জবাব দিলো না। অভিব্যক্তি হীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো পাথরের মতো। সমর মেয়েটার অনুভূতিহীন চেহারা ভালো করে দেখলো।
“ নীরবতা সম্মতির লক্ষণ। তাহলে আপনার মত আছে তাইতো।”
এবারেও সেই নীরবতার শৃংখলে এঁটে নিজেকে বন্দী করে রাখলো রিদিমা। সমর এক পলক মনিকার হিংস্র দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সোজা চলে গেল তপন বাবুর কাছে। তিনি হলের ছড়িয়ে থাকা চেয়ার গুলোর একটায় ভঙ্গুর হয়ে বসেছিলেন। তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সমর। সমর কে দেখে তপন বাবু মুখ তুলে তাকাতেই সে বলল,
“ দেখুন তপন বাবু, যেহেতু আপনার মেয়ের নামের সাথে আমার নাম জড়িয়ে এতো বড় একটা কান্ড ঘটে গেছে। তাই আমি আপনার কাছে আপনার মেয়েকে বিয়ে করার অনুমতি চাইছি।”
তপন বাবু হতাশার চাহনিতে তাকিয়ে রইলেন সমরের মুখের দিকে। লোকটার কণ্ঠে দম্ভ, প্রবৃত্তিতে শুধু দায় টুকু কাটানোর ভাব। তার মেয়ের প্রতি এই লোকটার কোনো রকম অনুভূতি নেই। কিসের ভরসায় মেয়েকে তুলে দেবেন এমন একটা ছেলের হাতে। যে আবার আগে থেকেই বিবাহিত, এক সন্তানের পিতা।
“ কি হলো জবাব দিন। আপনার মেয়ে কিন্তু রাজি এই বিয়েতে।”
বলে এক পলক পেছন ঘুরে তাকালো রিদিমার দিকে। তপন বাবু মুখ নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“ তনু দীপ্ত বিয়ের ব্যবস্থা শুরু করো।”
চলবে…