তুই যখন ছুঁয়ে দিলি মন পর্ব-২২+২৩+২৪

0
14

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
পর্ব: ২২

নিস্তব্ধ রাত্রির শীতল আলিঙ্গনে আবদ্ধ তৃতীয়া তিথির এক খন্ড চাঁদ। বাতাসে মিশে ধুলো মাখা হালকা ঝড়ো গন্ধ। আকাশের বুকে মেঘেরা ভাসছে টুকরো টুকরো হয়ে। কিছুক্ষন আগেই ধরা কাঁপিয়ে বয়ে গেছে ছোটখাটো এক তাণ্ডব। সেই সাথে ধরিত্রীর বুক ভেসেছে বাঁধন হারা ধারায়। তবে রাত্রির এই তৃতীয় প্রহরে সব কিছু বড্ড শান্ত। সব কিছুতে যেন হাড় হিম করা প্রশান্তির রেশ বিরাজমান।

বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হতে হতে রাত দুটোর ঘর ছেড়েছে ঘড়ির কাঁটা। মাথা ভরা সিঁদুর লেপে প্রস্তর প্রতিমার মতো নীরবে বসে আছে রিদিমা, একদম চুপটি করে। চোখ মুখ বিষন্ন। চাহনি জোড়া স্থির। যেন কোনো কিছুতেই আর পরোয়া নেই মেয়েটার। সমর সেদিকে এক পলক তাকালো। সাথে সাথে অন্তরের গহীন হতে উগরে এলো তাচ্ছিল্যের গা জ্বালানো ব্যাঙ্গাত্মক হাসি।
হাহ! জীবন! প্রিয় মানুষটার প্রবঞ্চনার ঘোলা জলে একদিন তাকে ধুয়ে মুছে রংহীন করে দিয়েছিল। আর আজ, আবার নতুন করে রাঙানোর জন্য তাকে সেই পুরোনো পথের পথিক বানালো।

বিয়ে সম্পন্ন হতেই গলা থেকে বিয়ের মালা আর গলবস্ত্র টা খুলে ফেলল সমর। মন্ডপ থেকে বেরিয়ে ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে গলা হাকালো বাকি সকলের উদ্দেশ্যে,
“ রঙ্গন, অনলি ফাইভ মিনিটস্। এর মধ্যে ফটাফট ওদের কে নিয়ে বেরিয়ে আসবি। আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।”

ব্যস, আর দ্বিতীয় কোনো শব্দ খরচ না করে ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল সমর সেখান থেকে। পেছনে পড়ে রইলো এক অব্যক্ত উপেক্ষা আর একরাশ তাজা ঘৃণার উদ্বেগ। মিসেস চিত্রা ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বুকে জমা দীর্ঘশ্বাস টা ছাড়লেন বড্ড গোপনে। তিনি জানেন, আজ এই বিয়েটা কোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও তার ছেলে কখনই করতে চাইতো না। শুধু মাত্র তার কথার মান রাখতে আর মনিকার করা অপমানের জবাব দিতে না চাইতেও এই বিয়েটা সে করতে বাধ্য হয়েছে।
এরই মধ্যে রঙ্গন বেশ তৎপর হয়ে তাড়া দিলো সবাই কে। রিনি জবা সীমা ওরা রিদিমাকে বসা থেকে উঠিয়ে দাঁড় করালো। রিদিমা ধীর লয়ে মাথা তুলে তাকালো মায়ের দিকে। দেখলো সে রাগে ক্ষোভে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে আরেক দিকে। রিদিমা এক পা এক পা করে হেঁটে এলো মায়ের কাছে। ভাঙা গলায় বিষাদ ঢেলে বলল,
“ মা, আমায় বিদায় দেবে না।”

মনিকার কি হলো কে জানে, আচমকাই আর্তনাদ করে বুক ভাঙা কান্নায় ভেঙে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। মুখে শাড়ির আঁচল চেপে গরল বানী ছুঁড়ে বললেন,
“ চলে যা তুই আমার চোখের সামনে থেকে। তোর মুখ আমি আর দেখতে চাই না।”

মায়ের কথা শুনে রিদিমা তাচ্ছিল্য হাসলো। অশ্রু ভেজা চোখে তা যেন ভয়ংকর দেখালো।
“ ভেবে বলছো তো মা! দেখো, আবার সত্যি টা বেরিয়ে এলে আফসোস করো না যেন।”

মনিকা সে কথার জবাব দিলো না। প্রবল অভিমানে সিক্ত মুখ খানা ঘুরিয়ে রাখলো অন্যদিকে। রিদিমা এবার ভেজা চোখে বাবার দিকে তাকালো। মানুষটা নত মুখে বসে আছে চেয়ারে। স্থবির তার রোগাটে অবয়ব। সে আস্তে ধীরে তার কাছে এলো। বাবার পায়ের কাছে বসে বুজে আসা দূর্বল কণ্ঠে আওড়ালো,
“ বাবা, বিশ্বাস করো আমি সত্যিই কোনো অন্যায় করিনি। আর না কোনো পাপ কাজ করেছি।”

কষ্টে অপমানে ভেতরটা ভেঙেচুরে শেষ হয়ে গেলেও তপন বাবু অভিমানে রা কাটলেন না। আর না মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। কেবল ক্রাচে ভর দিয়ে উঠে আস্তে ধীরে বেরিয়ে গেলেন সেখান থেকে। তন্মধ্যে সুতপা এগিয়ে এলো হাতে বিদায়ের সামগ্রী নিয়ে। বোনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ অনেক তো মান অভিমান হলো এবার অন্তত শান্ত হ মনি। মেয়েটা কে এবার বিদায় দিতে হবে যে।”

কয়েক জন আত্মীয় আর কিছু প্রতিবেশী তখনও সেখানে উপস্থিত ছিল। তারাও এগিয়ে এসে একই কথা বলল। অবশেষে মনিকা বিরস মুখে বিদায় দিলো রিদিমা কে। রাত তিনটে পার করে নতুন বউ নিয়ে বাড়িতে ঢুকল সবাই। সেই মুহূর্তে কোনো রকম আয়োজন ছাড়াই শুধু দ্বীপ জ্বেলে রিদিমাকে বরণ করলেন মিসেস চিত্রা। সমর ঘুমন্ত ছেলে কে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে নিজের ঘরে ঢুকে দোর চাপালো। ওদিকে মিসেস চিত্রা রিদিমাকে নিয়ে ঢুকলেন নিজের ঘরে।
____________

গোটা এক রাতের প্রস্থান শেষে এক নতুন সূর্যদয়। নতুন এক প্রভাতের আগমনের সাথে সাথে সূচনা হয়েছে এক নতুন অধ্যায়। তবুও, চারপাশ ঘিরে ভাসছে ফেলে আসা অতীতের ধোঁয়াটে গন্ধ। চাপা ক্রন্দনে ভেজা ধ্বংসের হাহাকার।
বাড়ি ফিরে আসার পর থেকেই মিসেস চিত্রা অস্থির হয়ে আছেন। কাল থেকে ছেলের অভিব্যক্তিগুলো তার কাছে খুব একটা ভালো ঠেকে নি। তাই বাকি রাত টুকু এক মুহূর্তের জন্যও দুই চোখের পাতা এক করতে পারেন নি তিনি চিন্তায়। ছেলের ওই ভাবে বিয়ের আসর থেকে বেরিয়ে যাওয়া, আবার বাড়িতে ফিরে সব কিছু ফেলে ওভাবে নিজের ঘরে ঢুকে যাওয়া, এ সব কিছু খুব একটা ভালো কিছুর যে ইঙ্গিত নয় তা তিনি ভালোই বুঝতে পারছেন। এখন কথা হলো জল কদ্দুর গড়িয়েছে সেটা মেপে দেখা।

মিসেস চিত্রা সকাল সকাল ছেলের পছন্দের চিনি ছাড়া কালো কফি বানিয়ে নিয়ে এগোলেন তার ঘরের দিকে।
দরজাটা খোলাই ছিল দেখে তিনি নক না করে সরাসরি খুলে ডাকলেন মৃদু স্বরে,
“ বাবু…!”
সমর ব্যালকনিতে ছিল। মায়ের কণ্ঠ পেয়ে ধীর পায়ে হেঁটে এলো। চোখাচুখি হতেই দেখতে পেল মায়ের অপরাধী মুখাবয়ব। মিসেস চিত্রা কফিটা এগিয়ে দিয়ে হড়বড় করে বললেন,
“ বাবু, তুই কি রাগ করেছিস আমার উপর?”
সমর হাত বাড়িয়ে কফিটা নিয়ে বলল,
“ রাগ কেন করবো!”
“ এই যে আমার কারণে তোকে কাল বাধ্য হয়ে বিয়েটা করতে হলো!”
সমরের মায়ের দিকে তাকিয়ে কফির কাপে চুমুক দিলো। বিষের মতো তিতকুটে কফিটুকু গলার নিচে চালান করল ধীরে ধীরে। অথচ মায়ের কথার জবাবে কোনো প্রত্যুত্তর করলো না।
এদিকে মিসেস চিত্রার চোখে মুখে অস্থিরতা। মনের মাঝে রাশি রাশি অস্বস্তি। ছেলের এমন নীরবতায় দুশ্চিন্তা গুলো মাথার ঘিলু খুবলে খাচ্ছে কুড়ে কুড়ে।
“ কি হলো কিছু বল!”
“ কি বলবো আমি। তুমি ছেলের বউ চেয়েছো আমি এনে দিয়েছি। ব্যস! আমার দায়িত্ব শেষ।”
“ দায়িত্ব শেষ! এটা কেমন কথা! তুই কি মেয়েটা কে কখনও মেনে নিবি না!”
এমনিতেই গত কাল রাত থেকে মাথা গরম হয়ে আছে। তার উপর আবার সকাল সকাল মায়ের এই সব কথা একদমই সহ্য হলো না সমরের। সে মায়ের দিকে ক্ষেপা চোখে তাকালো।
দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“ কখন বললাম মেনে নেবো না। বিয়ে যখন করেছি একদিন ঠিকই মেনে নেবো। তবে তার জন্য সময়ের প্রয়োজন। এখন আপাতত এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।”
মিসেস চিত্রার চোখে মুখে সহসা খুশির বন্যা বয়ে গেল ছেলের কথা শুনে। চোখে মুখে বিস্ময় ছড়িয়ে তিনি বললেন,
“ তুই সত্যি বলছিস তো!”
“ তোমার কি মনে হয়!”
“ না মানে বিয়েটা যেভাবে হলো.. ”
সমর পিঠ ঘুরিয়ে পেছন ঘুরে দাঁড়ালো। দৃঢ়তার সাথে অনমনীয় কন্ঠে বলল,
“ বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন সেটা বিয়েই। কোনো ছেলেখেলা নয়। তাছাড়া আমি কারও কথায় প্ররোচিত হয়ে বিয়েটা করিনি। পরিস্থিতি বুঝে নিজের উদ্যোগেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই এতো চিন্তার কিছু নেই। এনি ওয়ে, এখন যাও, আমি একটু বেরোব।”
মিসেস চিত্রা সকালের সোনালী রোদের ন্যায় ঝকঝকে হেসে বললেন,
“ যাক বাবা, শেষ পর্যন্ত আমি নিশ্চিন্ত হলাম। যাই, গিয়ে দেখি রিদিমা উঠেছে নাকি। ইস্, সারারাত যেভাবে কেঁদেছে মেয়েটা।”
সমর মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না সে এই মুহূর্তে বিবাহিত। যেখানে গতকাল রাতেও সে সিঙ্গেল ছিল।
______

অফিসের কাঁচ ঘেরা ব্যালকনি। তার গায়ে বেয়ে ওঠা একঝাঁক নকল লতানো গাছ। এসির শীতল হওয়ায় মৃদু লয়ে কাঁপছে শিরশির করে। মিটিং রুমের রুদ্ধদ্বার কক্ষে এই মুহূর্তে জরুরি বৈঠক বসেছে। ব্যক্তি মাত্র তিনজন। সমর রঙ্গন আর শহরের দায়িত্ব প্রাপ্ত ওসি সঞ্জয় সিং। টেবিলের উপর ছড়িয়ে রাখা কালকের সেই ছবি গুলো। রঙ্গন বলল,
“ ওসি সাহেব, এতক্ষণ যা কিছু বললাম আশা করি আপনি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন এটা একটা ফ্রড কেস। তবে প্রমাণ টা কিন্তু আপনাকে খুঁজে বের করতেই হবে। আর তাও অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল।”
“ অফকোর্স, IPC এর সেকসন 420 অনুযায়ী এর শাস্তি ভয়ানক। আপনারা চিন্তা করবেন না। আমি আজ থেকেই তদন্ত শুরু করে দিচ্ছি। তার আগে আপনাদের একটা জিডি করতে হবে।”
সমর এতক্ষণ সোফায় গা এলিয়ে বসে ছিল। এবার সোজা হয়ে বসলো। অফিসারের দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস হয়ে বলল,
“ সেটা হয়ে যাবে। বাট রিমেম্বার, আমার কিম্বা আমার স্ত্রীর নাম যেন কিছুতেই পাবলিক না হয়। ইউ নো হাউ মিডিয়া টেক দিস আনক্সিয়াসলি।”
“ ইয়েস স্যার, চিন্তা করবেন না। আমি পার্সোনালি ব্যাপারটা খেয়াল রাখবো।”
অফিসার হাত মিলিয়ে ছবি গুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল। সমর হেঁটে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর থেকে গোটা শহরটা দেখা যাচ্ছে। দুরন্ত গতিতে ছুটে যাচ্ছে একের পর এক যানবাহন গুলো। সমর পকেট থেকে সিগারেট বার করে ধরালো। ঠোঁটে গুঁজে ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
“ যতদুর জানি রিদিমার ছেলেটার সাথে তো বিয়েটা ভেঙে গেছিল বোধ হয়। সেদিনের ওই ঘটনার পর তো সম্পর্ক থাকার কথাও ছিল না। তাহলে নতুন করে এই বিয়ের ঘটকালি আবার এগোলো কীভাবে?”
ভ্রূ তে ভাঁজ ফেলে গভীর চোখে তাকালো রঙ্গন। জানতে চাইলো,
“ তুই এতসব জানলি কীভাবে?”
“ না জানার কি আছে। ঘটনা গুলো তো আমার চোখের সামনেই ঘটে ছিল।”
রঙ্গন ফুস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাথা নেড়ে বলল,
“ কি একটা বিশ্রী কান্ড ঘটে গেল বলতো। মেয়েটা যে কীভাবে রিকভার করবে কে জানে।”
সমর সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল বিনে। দুই হাত পকেটে গুঁজে বলল,
“ ডোন্ট ওরি, কলঙ্ক মুছে গেলে এমনিতেই ও রিকোভার হয়ে যাবে। বাট আমার একটা কথা কিছুতেই মাথায় আসছে না। এতো কিছু ঘটে যাওয়ার পর এই সম্পর্ক টা জোড়া লাগলো কীভাবে?”
“ সেটা তো আমিও জানি না রে। এ ব্যাপারে রিদিমাই তোকে ভালো করে বলতে পারবে। এনি ওয়ে, তুই মেয়েটা কে মন থেকে মেনে নিয়েছিস তো।”
এই প্রশ্নে সমর বিরক্ত চোখে তাকালো। রঙ্গন অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“ না মানে যেভাবে বিয়েটা হলো আর কি!”
সমর পেছন ঘুরে দাঁড়ালো। কাঁচের দেয়াল ভেদ করে ফুটপাতে হেঁটে যাওয়া এক ফেরিওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ দেখ, বিয়েটা হয়তো আমাকে করতেই হতো একদিন না একদিন। তাছাড়া মা যেভাবে কদিন ধরে প্রেশার দিচ্ছিল আমি হয়তো বেশি দিন অসম্মত হয়ে থাকতে পারতাম না। কিন্তু তাই বলে এভাবে বিয়ে টা হবে আমি ভাবতেও পারি নি। যাইহোক, এখানে মেনে না নেয়ায় প্রশ্নই আসে না। তবুও সে যদি চলে যেতে চায় আমি বাঁধা হবো না।”
রঙ্গন অবাক হয়ে বলল,
“ রিদিমা চলে যেতে চাইবে কেন? সে তো নিজেই বিয়েতে সম্মতি জানিয়ে ছিল।”
সমর নিঃশব্দে হাসলো। মাথা নেড়ে বলল,
“ উহু, ওটাকে রাজি হওয়া বলে না। নিরুপায় হয়ে গতানুগতিক পরিস্থিতির সাথে গা ভাসানো বলে। যাগ্গে বাদ দে ওসব। আগে ওই কার্লপ্রিট টাকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে নিই তার পর এসব নিয়ে ভাববো।”
______

আজ যেন সায়নের আনন্দে আত্মহারা হবার দিন। ঘুম থেকে উঠে প্রিয় ম্যাম কে দেখে অস্থির হয়ে গেছে খুশিতে। বার বার ঘুরে ঘুরে দেখছে আর প্রশ্ন করে যাচ্ছে,
“ ও ম্যাম ম্যাম তুমি না বলেচিলে আল পলাতে আছবে না। তুমাল নাকি বিয়ে টোপল মাতায় দিয়ে। তাহলে আমাদেল বালি তুমি কি করচো?”
“ আহ্ হা দাদুভাই আবারো সেই একই কথা। আমি বললাম তো তোমার ম্যাম আজকের পর থেকে আমাদের বাড়িতেই থাকবে। তুমি না চাইতে তোমার ম্যাম সব সময় তোমার কাছে থাকুক।”

ছোট্ট সায়ন মাথা নেড়ে সায় জানালো। পর মুহূর্তে ঘুরে ফিরে আবারো সেই একই প্রশ্ন করলো,
“ ও ম্যাম, তোমাল না বিয়ে। টোপর..”

মিসেস চিত্রা এবার জোরে ধমক দিলেন।
“ আহ্ দাদুভাই।”

সায়ন ঠাকুমার ধমক খেয়ে কেঁপে উঠে ভ্যা করে কেঁদে উঠলো। রিদিমা পাশেই চুপ করে বসে ছিল। সেই মুহূর্তে সায়নের কান্না দেখে তাড়াতাড়ি করে তাকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে লাগলো। মিসেস চিত্রা অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন সেই দৃশ্য দেখে। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করলেন।
“ হে দীননাথ, তোমার কাছে একটাই প্রার্থনা। মেয়েটা যেন এভাবেই আমার ছেলে আর আর নাতি টাকে ভালোবেসে আগলে রাখে আজীবন।”

চলবে…

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
পর্ব:২৩

সময় টা নিরলস দুপুর। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। মাঝে মধ্যে ভেসে আসছে ঘন মেঘের গুড়গুড় শব্দ। সেই সাথে বইছে দমকা হাওয়ার ঝাঁপ। ছয়তলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে রিদিমা। গ্রিলটা দুই হাতের মুঠোয় চেপে ধরা। দৃষ্টি জোড়া শূন্যে আটকে। আজ যেন প্রকৃতি আর রিদিমার মাঝে কোনো অন্তর নেই। দুজনই কাঁদছে আপন আপন কষ্টে।

প্রতিটা সন্তানের কাছে চিরদিনই তার বাবা মা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা। যে কোনো বিপদে একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। যার ছায়ায় তারা বেড়ে ওঠে, আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। আজ সেই আশ্রয় টাই যেন হারিয়ে গেছে রিদিমার। অপাঙক্তেয় হয়ে রয়ে গেছে এই সুবিশাল ধরণীর বুকে। যার কোনো ভিত্তি নেই। আর না আছে কোনো মূল্যমান।

আনমনে ভিজে আসা গাল দুটো কাঁপা হাতে মুছে নিলো রিদিমা। কাঁদবে না কাঁদবে না ভেবেও বার বার ভিজে উঠছে অবাধ্য চোখ দুটো। বুকের ভেতর ভেঙেচুরে যাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে হৃদয়ের অন্তঃস্থল। আচমকা তার কাঁধে এক শীতল স্পর্শ ছুঁয়ে গেল। কানে ভেসে এলো চেনা সুর।

“ এভাবে কাঁদলে কি সমাধান মিলবে বলো। মিলবে না তো। শুধু শুধু শরীরটাই খারাপ হবে। তার চেয়ে বরং সব কিছু সময়ের হাতে ছেড়ে দাও। দেখবে সময় তার সময় মতো সব কিছুর সমাধান মিলিয়ে দিয়েছে।”

রিদিমা মাথা নেড়ে নিজেকে সামলালো। নাক টেনে ভাঙা গলায় বলল,
“ আপনি ঠিক বলেছেন আন্টি। আমি আর কাঁদবো না।”

আন্টি ডাক শুনে মিসেস চিত্রা ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। মৃদু ধমকে বললেন,
“ আন্টি আবার কি! মামনি ডাকবে তুমি আমাকে বুঝেছো।”

রিদিমা বিস্ময় ভরা চোখে তাকাতেই মিসেস চিত্রা অমলিন হাসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ তুমি এই বিয়েটা মানো তো রিদিমা।”

সহসা এ কথার জবাব দিতে না পেরে রিদিমা নজর নামিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিসেস চিত্রা বোধ হয় বুঝলেন মেয়েটার মনের কথা। যে পরিস্থিতিতে পড়ে বিয়ে টা হয়েছে তাতে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভোগা টা অত্যন্ত স্বাভাবিক। তিনি রিদিমার হাত ধরে টেনে এনে বিছানায় বসালেন। নিজেও তার পাশে বসলেন। মেয়েটার একহাত মুঠোয় পুরে বললেন,
“ আমার ছেলেটা একটু রাগী একটু গোমড়া মুখো কিন্তু মনটা সোনার মতো।
জানো তো একবার কি হয়েছে, এই তো গেল বছরের ঘটনা। এক ছিনতাইকারী ওর মোবাইল ছিনিয়ে পালাতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করে বসলো। লোকজন জড়ো হয়ে লোকটার ভিডিও বানাতে আরম্ভ করলো অথচ কেউ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার রিস্ক নিলো না পুলিশ কেসের ভয়ে। আমার ছেলেটা নিজ দায়িত্বে সেই ছিনতাইকারী কে হাসপাতালে ভর্তি করালো। তার সব রকম চিকিৎসা করিয়ে যেই সে সুস্থ হলো তাকে নিজের অফিসে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের ব্যবস্থাও করে দিলো। যাতে আর কোনোদিন এসব চুরি ছিনতাই করে তাকে পেট না চালাতে হয়।”

রিদিমা অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দেখে মিসেস চিত্রা স্মিত হাসলেন। বললেন,
“ তুমি হয়তো ভাবছো আমি আমার ছেলের সুনাম গাইছি যাতে তোমার মনে তার প্রতি পজেটিভিটি তৈরি হয়। আসলে ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়। আমি শুধু বলতে চাইছি আমি আমার ছেলেকে চিনি। তাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। আর এটাও জানি যে সে কোনোদিন তোমাকে অসম্মান করবে না। আগামীতে বিয়েটা নিয়ে তুমি যে সিদ্ধান্তই নাও না কেন সে তোমাকে একবারের জন্যও জাস্টিফাই করবে না।”

রিদিমা এবার সত্যিই লজ্জা পেল। চোখ নামিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“ আন্টি, আপনি আমাকে ভুল ভাবছেন। কাল অগ্নিদেব কে সাক্ষী রেখে সমর বাবু যখন আমার সিঁথিতে সিঁদুর পরালেন সেই তখনই আমি তাকে মন থেকে স্বামী মেনে নিয়েছি। তাই বিয়েটা না মানার প্রশ্নই আসে না।
তাছাড়া আমি কখনও ভুলবো না, যে সময়টায় আমার পাশে কেউ ছিল না সে সময়ে একমাত্র আপনি আর সমর বাবু ভরসা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাকে লগ্ন ভ্রষ্ট হবার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। আমাকে নিষ্কলুষ করে নতুন জীবন দিয়েছেন। এই যে এই মুহূর্তে কি সুন্দর করে আমাকে বোঝাচ্ছেন যাতে আমি সব কিছু ভুলে মুভ ওন করি। সেই আমি আপনাদের সাথে এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা কীভাবে করতে পারি। ছিঃ! তার আগে যেন আমার মরণ হয়।”

রিদিমার কথায় মিসেস চিত্রার মুখাবয়বে এক আকাশ সমান প্রশান্তির হাসি খেলে গেল। পরম মমতা নিয়ে তিনি মেয়েটার মাথায় হাত রাখলেন। ভরসা মিশিয়ে শীতল কণ্ঠে বললেন,
“ ছিঃ মা ওসব বলতে নেই। আসলে আমারই দোষ। খালি আজেবাজে ভাবনা গুলো মাথার ভেতর উঁকি দেয় সব সময়। যাগ্গে বাদ দাও। সকালে তো কিছুই খেলে না। এখন একটু কিছু নিয়ে আসি।”

রিদিমা স্মিত হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই মিসেস চিত্রা চুমকি কে ডাকতে ডাকতে কক্ষের বাইরে চলে গেলেন। রিদিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে তাকালো। সাথে সাথে মনটা উপচে পড়লো মমতায়। ছোট্ট সায়ন কোল বালিশ টাকে দুহাতে জড়িয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছো। কি যে আদুরে লাগছে তাকে দেখতে। রিদিমা আলতো করে হাত বুলালো সায়নের ফুরফুরে চুল গুলো তে। তারপর হঠাৎ কি যেন একটু মনে করে ঝুঁকে ঠোঁট ছোঁয়ালো তার নরম গালে। তাতে সামান্য একটু নড়ে উঠে আবারো ঘুমে তলিয়ে গেল বাচ্চাটা। রিদিমা ঘুমন্ত সায়নের দিকে তাকিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। সহসা ঝুপ করে চোখের পাতায় ভেসে উঠলো অতীতের ফেলে আসা স্মৃতি গুলো। এভাবেই তো বাবা তাকে মাঝে মধ্যে ঘুম পাড়াতো। কখনও মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো আবার কখনও বা পিঠে চাপড় দিতো মৃদু লয়ে। রিদিমা আস্তে ধীরে চোখ বুজে নিলো। বুকে হাত চেপে হাহাকারে চিৎকার করে ওঠা হৃদয় টাকে বোঝাতে চাইলো একদিন সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। একটু খানি ধৈর্য ধর রিদিমা! ব্যস আর একটু খানি ধৈর্য! রিদিমার মন তা মানলো বোধ হয়। তাইতো আবারো বাঁধ ভাঙা অশ্রুরা নেমে এলো দুচোখের সীমানা ভাসিয়ে।
ঠিক তখনই দরজার পাশ থেকে একটা ছায়া মূর্তি নিঃশব্দে সরে গেল। মেয়েটা জানতেও পারলো না কেউ একজন সেই তখন থেকে দাঁড়িয়ে তার বলা কথা গুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছে।
______

ইতিমধ্যে মাঝ খান থেকে কেঁটে গিয়েছে আরও দুটো একঘেঁয়ে দিন। দুটো দিনের ব্যবধানে রিদিমা আজ বেশ কিছুটা সুস্থ। গতকাল বিকেলে রিনি জবা ওরা এসেছিল। অনেকক্ষন ছিল ওরা। অনেক অনেক ভাবে ওকে বুঝিয়েছে। সেই সাথে গল্প ও হয়েছে অনেক। আজ আবার সীমা আর রঙ্গন এসেছিল। ছিল বেশ ঘন্টা খানেক মতো। অনেক গল্প করেছে দুই বান্ধবী মিলে। তবে রঙ্গন দা বেস্ট। এটা ওটা বলে এতো হাসিয়েছে সেই থেকে মনটা বেশ একটু ফুরফুরে লাগছে রিদিমার।

তখন সবে সন্ধ্যা গড়িয়েছে। রিদিমা সায়নকে নিয়ে এটা সেটা করছিল আর ওর মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনছিল। ঠিক তখনই চুমকি এলো ঘরে। ওকে ডেকে বলল,
“ বৌমনি, তোমাকে দাদাভাই ডেকেছে।”

হঠাৎ বৌমনি ডাকটা শুনে কেমন যেন চমকে উঠলো রিদিমা। গায়ের মধ্যে কাটা দিয়ে উঠলো শিরশির করে। ও বলল,
“ এক্ষুনি!”
“ হ্যাঁ।”

রিদিমা উঠে দাঁড়ালো। শাড়ির আঁচল টেনে নিজেকে পরিপাটি করে বলল,
“ আমি তো ওনার রুম চিনি না।”
“ এসো আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।”

বলে চুমকি আগে আগে হাঁটতে শুরু করলো। সমরের এপার্টমেন্ট টা বিশাল। প্রায় দু হাজার স্কয়ার ফিট নিয়ে। তাও আবার ডুপ্লেক্স। নিচে দুটো বড় বেড রুম সহ বিশাল কিচেন ওয়াশরুম ডাইনিং ড্রয়িং আর ঠাকুর ঘর। উপর তলা রিদিমা দেখেনি। আজই প্রথম যাচ্ছে সে চুমকির সাথে। সিঁড়ি বেয়ে চুমকির পেছন পেছন দোতলায় পৌঁছতেই এক বিরাট ধাক্কা খেল রিদিমা। এ যেন স্বপ্নের জগত তার চারিপাশ ঘিরে। কি বিশাল এক বসার ঘর। চারিদিক কাঁচের দেওয়ালে ঘেরা। বড় বড় কার্টন গুলো আলতো করে ঢেকে রেখেছে তাদের নিজের আড়ালে। সামনেই এল আকৃতির বিশাল সাদা রঙের সোফা। দেওয়াল জুড়ে জায়েন্ট স্ক্রিন। বড় একটা কাঁচের টি টেবিলে শোভা পাচ্ছে সাদা রঙের অর্কিড। ব্যালকনিতে ছোট ছোট অনেক গুলো টব ঝোলানো। তাতে নাম না জানা লতানো গাছ। সেসব দেখতে দেখতে রিদিমা একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। চুমকি ইশারায় জানালো এটা সমরের রুমের দরজা। রিদিমা বলল,
“ তুমি ডাকো।”

চুমকি ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে বলল,
“ না না। দাদাভাই তোমাকে ডেকেছে তুমিই যাও। আমি গেলে রাগ করবে। তাছাড়া এমনিতেও যার তার এখানে আসা বারণ।”

বলেই সে পালিয়ে গেল। রিদিমা কি করবে ভেবে ছোট করে নক করলো দরজায়। ঠিক তখনই দরজার পাল্লা খুলে ডেকে উঠলো সমর,
“ ভেতরে আসুন।”

হঠাৎ ভারী কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলো রিদিমা। মুখ তুলে সমরের দিকে তাকাতেই আচমকা লজ্জায় পেট মুচড়ে উঠলো তার। সহসা পা দুটোও কাঁপলো সমান তালে। সমর এতক্ষণ রিদিমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। মেয়েটা কে অমন অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারো বলল,
“ কি হলো আসুন।”

রিদিমা নিজেকে সামলে জড়তায় ভরা পা ফেলে সে ঘরে ঢুকলো। সমর সামনের সোফা দেখিয়ে বলল,
“ বসুন।”

রিদিমা সোফায় গিয়ে জড়সড় হয়ে বসতেই সমর বলল,
“ আপনার শরীর কেমন আছে এখন?”

রিদিমা মুখে কিছু না বললেও মাথা নেড়ে জানালো সে আপাতত ভালো আছে। সমর প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে ছিল সামনে। রিমলেস চশমার ফাঁক দিয়ে নজর গেঁথে ছিল মেয়েটার দিকে। সে ওভাবে তাকিয়ে থেকেই বলল,
“ গুড! আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করবো। প্লীজ সবিস্তারে জানাবেন।”

রিদিমা এতক্ষণ নতমুখে বসে ছিল। এমন কথায় এবার চোখ তুলে তাকালো। সমর বলল,
“ আমার জানা মতে বিয়ের পাত্র সেদিনের ওই বখাটে ছেলেটাই ছিল তাইতো?”

রিদিমা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। সমর তা দেখে বলল,
“ আশ্চর্য! এতো বড় একটা স্ক্যান্ডাল হয়ে যাবার পরও আপনার পরিবার রাজি হলো কীভাবে ওই বাস্টার্ড টার সাথে আপনার বিয়ে দিতে?”

লজ্জায় ঘৃণায় আবারো মাথা নিচু করে নিলো রিদিমা। তার মৌনতায় যেন হাজারও আক্ষেপ ঝরে ঝরে পড়ছিল ঝুরঝুরে বালির মতো। এখানে সম্পূর্ণ দোষ তার পরিবারের নয়। দোষ তারও আছে। সেই মানুষ চিনতে ভুল করেছে। অভিনয় কে সত্যি ভেবে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে একেবারে। বেশ অনেক্ষণ পর রিদিমা নিজেকে ধাতস্ত করলো। তারপর এক এক করে সব ঘটনা খুলে বলল। যেদিন প্রথম তৃপ্তীশ এর সাথে দেখা হয়েছিল সেদিন থেকে শুরু করে বিয়ের দিন পর্যন্ত এ টু জেড সব কিছু।

সবটা শুনে চুপ করে দাঁড়িয়েই রইলো সমর। তার বোঝা হয়ে গেছে। ওই স্কাউন্ড্রেল টা এতোদিন ধরে নাটক করেছে যাতে এভাবে প্রতিশোধ নিতে পারে।
রিদিমা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“ আর কিছু জানার আছে আপনার?”

সমর মাথা নেড়ে জানালো,
“ নাহ্!”
“ আমি কি এবার জেতে পারি?”

রিদিমার প্রশ্নে সমর ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক পল। তারপর নরম গলায় বলল,
“ এটা আপনারও রুম। থাকবেন নাকি চলে যাবেন আপনার ইচ্ছে।”
____

প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার আনন্দে সারা রাত জেগে দুমসে পার্টি করেছে তৃপ্তীশ। ভোরের দিকে কোনোমতে বাড়ি ফিরে গা এলিয়ে দিয়েছিল বিছানায়। সেই তখন থেকে সে ঘুম। ইচ্ছে ছিল একেবারে সন্ধ্যায় ওঠার। কিন্তু তা আর হলো না। দুপুরের পর পর মায়ের হাঁক ডাকে শেষ মেশ উঠতেই হলো তাকে। বিরক্তি নিয়ে আরমোড়া ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসতেই বাড়িতে পুলিশ দেখে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল সে। বসার ঘরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল মা বোনের ভীত সন্ত্রস্ত চেহারা। বাবা টাও কেমন যেন থমথমে মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে মায়ের কাছে জানতে চাইলো,
“ কি হয়েছে মা? বাড়িতে পুলিশ এসেছে কেন?”

মিসেস রিতা ছেলের কাছে এসে দাঁড়ালেন। কাঁপা গলায় ফিস ফিস করে বলল,
“ বাবু রে সর্বনাশ হয়ে গেছে।”

তৃপ্তীশ অবুঝের মতো করে বলল,
“ সর্বনাশ হয়ে গেছে মানে, কি হয়েছে!”
“ আমি বলছি।”

মিসেস রিতা কে থামিয়ে ওসি সঞ্জয় সিং সামনে এগিয়ে এলো। অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট দেখিয়ে বলল,
“ ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট মিস্টার তৃপ্তীশ রায়।”

বিস্ময়ে প্রবল ধাক্কা খেয়ে তৃপ্তীশ বলে উঠলো,
“ হোয়াট। কি করেছি আমি?”
“ বিয়ের নাম করে প্রতারণা করার অপরাধে IPC সেকসন 420 এর আন্ডারে আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।”

‘বিয়ের নামে প্রতারনা’ কথাটা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো তৃপ্তীশ। এতো বড় অপবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলল,
“ মিথ্যে কথা।
অফিসার, বিশ্বাস করুন আমি মোটেও কারো সাথে প্রতারণা করিনি। আপনিই বলুন একটা চরিত্রহীন মেয়েকে বিয়ে করতে না চাওয়া কি কোনো ধরনের প্রতারণার আওতায় পড়ে?”

সঞ্জয় সিং তৃপ্তীশ এর হাতে হ্যান্ডকাফ পরাতে পরাতে বলল,
“ সেটা বিচার করার আমি কেউ নই মিস্টার। সেটা তো কোর্ট বিচার করবে।”

নিজের হাতে হাতকড়া দেখে তিলমিলিয়ে উঠলো তৃপ্তীশ।
“ একি! আমাকে হাতকড়া পরাচ্ছেন কেন? আমি যে অপরাধী সেটা তো এখনও প্রমাণ হয় নি।”
“ হয়নি তো কি হয়েছে। তদন্ত চলছে। আশা করি খুব তাড়াতাড়ি প্রমাণও হয়ে যাবে।”

বলেই তৃপ্তীশ কে ঘাড় ধরে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বাড়ি থেকে বের করলো ওসি সাহেব। তারপর তাকে ঠেলতে ঠেলতে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল থানার উদ্দেশ্যে। ওদিকে পাড়ায় পুলিশ ঢুকতে দেখে গোটা এলাকা ভেঙে পড়েছে তৃপ্তীশ দের বাড়ির চারিপাশে। ফিসফাস ফুসফাস গুঞ্জন চলছে সকলের মুখে মুখে। গত দুদিন আগে বিয়ে করতে গিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তা মোটামুটি সবারই জানা। তবে আজকের ঘটনা ছিল অনভিপ্রেত। বিয়ের আসর ছেড়ে পাত্র পক্ষ কে বিয়ে ভাঙতে অনেককেই দেখেছে সকলে। কিন্তু সেই অপরাধে বাড়ি বয়ে পুলিশ আসতে এই প্রথম দেখছে সকলে। কৌতূহল তো হবারই কথা স্বাভাবিক। ছেলেকে নিয়ে পুলিশের গাড়িটা বেরিয়ে যেতেই মিসেস রিতা হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। হাত পা ছুঁড়ে আহাজারি করতে করতে বললেন,
“ ওগো, তুমি আমার ছেলেটা কে বাঁচাও। নয়তো ওর জীবন টা শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে যাবে।
ও রমা, জামাই কে শিগগির একটা ফোন কর। বল যেন তাড়াতাড়ি আসে এখানে। তোর ভাইকে যে ভাবে হোক ছাড়িয়ে আনতে হবে।”

চলবে.…

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
পর্ব:২৪

কথায় বলে মানুষ নাকি অভ্যাসের দাস। সব কিছু সহজে ভোলা গেলেও অভ্যাস ভোলা যায় না। আজকাল তপন বাবুরও হয়েছে সেই দশা। মনের ভুলে কখনও সখনও ভুল করে ফেলছেন। মাঝে মধ্যেই সেই নাম টা ধরে ডেকে ফেলছেন যাকে নির্বাসন দিয়েছেন স্বেচ্ছায়। তখন সকাল সাড়ে সাতটা। বিগত দিন দুয়ের বিস্তর টানাপোড়েন শেষে ঝরঝরে এক নতুন শুরু। কিন্তু তবুও তার মাঝে ওই এক টুকরো ভুলটাই যেন প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে বারংবার।

বহুদিন ধরেই চোখের সমস্যায় আক্রান্ত তপন বাবু। দৃষ্টি শক্তি তার বলতে গেলে চশমার দয়ায় টিকে। এই নিয়ে দুই দফা শল্য চিকিৎসাও করিয়েছেন চোখে তবুও লাভের লাভ বলতে গেলে তেমন কিছুই হয় নি। সকাল বেলা চা খেতে খেতে পেপার পড়া তপন বাবুর নিত্যদিনের অভ্যাস। বিগত দুই দিন মনের যন্ত্রণায় ভুল হলেও আজ আর সেটা হতে দেন নি তিনি। জীবন মানেই ভাঙাগড়া, তাকে যতো দ্রুত সম্ভব মানিয়ে নিয়ে এগোতে হয়। একথা তপন বাবু মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। তাইতো তিনি ভুলে যেতে চান সেই মেয়েটাকে যার হাতের চায়ে চুমুক দিয়ে তার রোজ সকালের মিষ্টি শুরু টা হতো।

পরমা রিদিমা দুই বোনই বাবার অভ্যেস সম্পর্কে অবগত। বিয়ে হবার আগে সেই বাবার চায়ের দায়িত্বে ছিল। বিয়ের পর রিদিমা। আজ আবারো বহুদিন পর তার সেই অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি হলো যেন। তপন বাবু সবে মাত্র পেপার টা খুলে বসেছেন তখন। তার গভীর দৃষ্টি গেঁথে সাদা কাগজে ভাসমান কালো অক্ষরের মাঝে। পরমা চায়ের কাপ সমেত প্লেট টা বাবার সামনে রেখে নীরবে পা বাড়িয়েছিল রান্নাঘরের দিকে। ঠিক তখনই তার কদম জোড়া থমকালো বাবার কথা শুনে,

“ সুনু, মারে! আমার চশমা টা একটু এনে দেতো।”

ভুল ভুল আর ভুল। আবারো সেই একই ভুল করে ফেলেছেন বুঝে সাথে সাথে চমকে উঠলেন তপন বাবু। হাতের মুঠোয় পেপার টা দুমড়ে মুচড়ে ধরলেন হতাশায়। ওই কু সন্তান কে মনে করবেন না ভেবে বিগত দুই দিনে কতবার যে নিজেকে প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ করেছেন তার ঠিক নেই। কিন্তু আর শেষ মেশ পারলেন কই। বেহায়া মন টা যে তাকেই চায় সব সময়। চেতনায় কিম্বা অবচেতনায়!
পরমা নরম পায়ে হেঁটে বাবার পাশে বসে। কাঁধে মাথা রেখে ধীর কণ্ঠে আওড়ায়,
“ বাবা, আমাদের মনে হয় সেদিন বুনু কে বিশ্বাস করা উচিত ছিল। কেন জানি মনে হচ্ছে ও এই ধরনের নোংরা কাজ কিছুতেই করতে পারে না।”

তপন বাবু নীরবে মেয়ের কথা শুনলেন। হৃদয় ভষ্ম করা শব্দ হীন এক দীর্ঘশ্বাসের সাথে মাথা এলিয়ে দিলেন সোফাতে। তারও যে মনটা এসব মানতে চায় না। যাকে জন্ম দিয়েছেন, নিজ শিক্ষায় নিজের হাতে বড়ো করেছেন তাকে চিনবেন না এটা হতে পারে না। কিন্তু মেয়েটা যে সবার সামনে দাঁড়িয়ে একবাক্যে স্বীকার করলো ছবি গুলো সত্যি ছিল।
এমন সময় মনিকার কর্কশ কন্ঠস্বর ভেসে এলো,
“ কতবার করে বলেছি এই বাড়িতে আর কক্ষনো ওই মেয়ের বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে না। আমার কথা তোমাদের মনে থাকে না তাই না। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী কারও কাছে মুখ দেখানোর মতো অবস্থা রাখেনি যে মেয়ে তাকে নিয়ে তোমাদের এতো আদিখ্যেতা কিসের শুনি। একটু ভালো আছি সেটাও তোমাদের সহ্য হচ্ছে নাতাই না…

বলতে বলতে কণ্ঠটা কান্নায় আটকে এলো মনিকার। মুখে আঁচল চেপে ধরা গলায় বললেন,
“ গতকাল রনির মা ফোন করেছিল। সান্ত্বনা দেওয়ার নাম করে এতো এতো বাজে কথা শোনালো যে শেষ পর্যন্ত ফোন অফ করে রেখে দিতে হলো আমাকে। সকালে সবজিওয়ালার থেকে দুটো সবজি নিচ্ছিলাম গেটে দাঁড়িয়ে। ঠিক তখনই পাশের বাড়ির মিসেস সেনগুপ্ত গলা ফেড়ে ডেকে উঠলো দোতলার বারান্দা থেকে। মনিকা দি কেমন আছো।
আমি তাকাতেই বলল,
যাই বলো তোমার ছোট মেয়ে কিন্তু সেই চালু। একেবারে ছক্কা হাঁকিয়ে দিয়েছে। কথায় আছে, সোনার আংটি আবার বাঁকা। এক বাচ্চার বাবা তাতে কি, লোকটার কিন্তু অনেক টাকা। তোমার মেয়েকে টাকার গদিতে বসিয়ে রাখবে।
এবার বল, এতো এতো অপমান কি আমাদের সত্যিই প্রাপ্য ছিল।”

বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লো। পরমা আর কথা বলতে পারলো না। দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে নিলো বুকে। তাকে যেভাবেই হোক শান্ত করতে হবে। নয়তো দেখা যাবে আবারো হার্ট এ্যাটাক করে বসলো মানুষটা।
_________

আজকের সকাল টা সত্যিই অনবদ্য। স্নিগ্ধ শীতল আর মনোগ্রাহী। সকালের প্রতকালীন কাজের সমাপ্তি টেনে নিচে নামতেই চোখ জুড়োনো এক অনভিপ্রেত দৃশ্যের সাক্ষী হলো সমর। কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে এক শ্যামলা রমণী দাঁড়িয়ে আছে। যার কোলে আধো ঘুমে আচ্ছন্ন ছোট্ট সায়ন। সমর চুপচাপ টেবিলে এসে বসলো। চশমার ফাঁক দিয়ে রিদিমার দিকে ঠাড় দৃষ্টি মেলে গলা হাঁকালো ভারী স্বরে,
“ মা, আমার কফি।”

রিদিমা যারপরনাই চমকালো। আড় চোখে একপলক সেদিকে তাকিয়ে সায়ন কে নিয়ে ঢুকে গেল ওয়াশ রুমের ভেতরে। সমর মন দিয়ে দেখলো কিন্তু তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। সায়ন ছোট্ট থেকেই মা হারা বলে ঠাম্মার কোলের ন্যাওটা। সারাদিন তার যেখানেই কাটুক রাত হলে ঠাম্মার কোলেই শান্তির ঘুম ঘুমায় সে। তবে বাবার কাছেও ঘুমোনোর অভ্যেস আছে সায়নের। কিন্তু সেটা সময় বিশেষে। সব দিন নয়। এদিকে বিয়ের রাত থেকে মিসেস চিত্রার নতুন শয়ন সঙ্গিনী হয়েছে রিদিমা। তাই বিগত কয়েক দিনে সায়নের সাথে তার বন্ডিং টা বেশ জমে উঠেছে।

সায়ন কে ফ্রেশ করিয়ে আস্তে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এলো রিদিমা। ছোট্ট সায়ন দৌড়ে গিয়ে বাবার কোলে উঠে বসলো। মিসেস চিত্রা নাতির জন্য দুধে ভেজানো কর্নফ্লেক্স আর ছেলের কফি নিয়ে টেবিলে রাখতে রাখতে ছেলেকে বললেন,
“ আগামী কাল সকালে দাদুভাইয়ের অ্যাডমিশন টেস্ট। ভুলে যাস নি নিশ্চয়ই।”

সমর কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
“ মনে আছে আমার। দশটায় রিপোর্টিং টাইম। কাল রেডি হয়ে থেকো। সাড়ে নটার পরপর বেরোব।”

মিসেস চিত্রা সায়নের দিকে দুধের বোল টা এগিয়ে দিলেন। মিষ্টি করে বললেন,
“ দাদুভাই ব্রেকফাস্ট টা তাড়াতাড়ি শেষ করো তো দেখি।”
“ আমি মামুনিল কাছে কাবো।”

সমর সবে মাত্র ঠোঁটে ছুঁইয়ে ছিল কফির কাপ টা। আচমকা ছেলের মুখে মামনি ডাক শুনে রীতিমত চমকে উঠলো বেচারা। সে ভ্রূ কুঁচকে বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ মামনি কে?”

মিসেস চিত্রা মুচকি হাসলেন। বললেন,
“ ওর মা।”
ছেলে কে একই রকম ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মিসেস চিত্রা হতাশার শ্বাস ফেললেন।
“ আরে বাবা ও রিদিমার কথা বলছে।”

রিদিমার নাম শোনা মাত্রই আস্তে ধীরে ভ্রুর ভাঁজ মিলিয়ে গেল সমরের। একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে এলো মুখ। মিসেস চিত্রা রান্না ঘরে দাঁড়ানো রিদিমাকে এক পলক দেখে নিয়ে বললেন,
“ আর কতদিন বলতো ম্যাম ম্যাম বলে ডাকবে মেয়েটা কে। তাই আমিই দাদুভাই কে বলেছি এখন থেকে রিদিমাকে মামনি বলে ডাকতে।”

সমর চশমার স্বচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে নিরেট চোখে তাকালো রান্না ঘরের দিকে। দেখলো মেয়েটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে চুমকির পাশে। খোপা এলিয়ে এক থোকা চুল গালের পাশ দিয়ে মুখের উপর ছড়িয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে সেগুলো সরিয়ে দিচ্ছে আলতো হাতে। সায়ন তক্ষুনি জোর গলায় ডেকে উঠলো,
“ মামুনি ও মামুনি…
“ হ্যাঁ
ডাকে সাড়া দিয়ে ব্যস্ত পায়ে হেঁটে এলো রিদিমা। সায়ন বাবার কোল থেকে নেমে রিদিমার হাত টেনে সমরের পাশের চেয়ারে বসালো। তারপর আবারো ছুটে গিয়ে বাবার কোলে চেপে আদুরে গলায় আবদার ছুঁড়ল,
“ আমাকে কাইয়ে দাউ। আ..!”

সমর রিদিমা উভয়েই হতভম্ব। দৃষ্টিতে দৃষ্টির মিলন হতেই লজ্জায় আড়ষ্ঠ হলো উভয়েই। সমর আলগোছে নজর সরিয়ে নিলো। ব্রীড়ায় জুবুথুবু রিদিমা দুধের বাটি টা টেনে নিয়ে আস্তে ধীরে খাওয়াতে আরম্ভ করলো সায়ন কে। মিসেস চিত্রা এই দৃশ্য দেখে ঠোঁট টিপে হাসলেন। সময় টা তাদের নিজেদের মতো করে কাটাতে দিয়ে আস্তে আস্তে ধীর পায়ে হেঁটে চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।
________

ঘন্টা চারেক পরের কথা। আচমকা অফিস থেকে ফোন এলো সমরের। মিসেস চিত্রা তখন সদ্য স্নানে ঢুকেছেন। তাই ফোনটা রিসিভ করলো চুমকি। কানে তুলে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে সমরের ভরাট কণ্ঠ ভেসে এলো,
“ তোর বৌমনি কোথায় রে?”
সায়নের সাথে পড়া পড়া খেলায় ব্যস্ত রিদিমা কে দেখে সে বলল,
“ সোনাই এর সাথে খেলছে। দেবো?”
“ হুম্!”
চুমকি ফোনটা রিদিমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ বৌমনি, এই নাও ফোন দাদাভাই কথা বলবে।”

রিদিমা ফোনটা কানে চেপে নরম গলায় হ্যালো বলতেই একদম হুট করেই যেন জমে গেল সমর। আচমকা বুকের ভেতর দামামা বেজে উঠলো দুম দুম করে। এক নাম না জানা অনুভূতির শীতল শিহরণ কেমন করে যেন দোলা দিয়ে গেল অজান্তেই। সমর শুকনো ঢোক গিললো। বুঝলো, নিঃশ্বাস টা ওর আটকে গেছে গলায়।
এদিকে ওপাশ থেকে কোনো রকম সাড়া শব্দ না পেয়ে রিদিমা আবারো হ্যালো বলতেই সম্বিত ফিরে গলা ঝাড়লো সমর। টাইয়ের নটটা ঢিলে করে সামনে রাখা জলের গ্লাস তুলে তড়িঘড়ি গলা ভেজালো বেচারা। তারপর রয়ে সয়ে বলল,
“ রিদিমা, আপনি ঠিক আছেন?”

গতকাল থেকেই শুধু চমকাচ্ছে রিদিমা। “এটা আপনারও রুম। থাকবেন নাকি চলে যাবেন আপনার ইচ্ছে।” শোনার পর বিস্ময়ে যতোটা না চমকে ছিল তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি লজ্জায় আড়ষ্ঠ হয়ে গেছিল মেয়েটা। তারপর আবার এই মুহূর্তে এমন একটা কথা। রিদিমার ভাবনা চিন্তা গুলো কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে বারেবারে। তাছাড়া এই অসময়ে অপ্রত্যাশিত সেই ব্যক্তির মুখ থেকে এমন একটা কথা শোনার পর যারপরনাই ভীষন অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো রিদিমা। তবুও জবাব দিতে কোনো মতে ছোট্ট করে বলল,
“ হুম্। ঠিক আছি আমি।”
রিদিমা ঠিক আছে জেনে সমর বেশ নিশ্চিন্ত হলো। সে ফের ডাকলো,
“ রিদিমা!”
কি ছিল সেই ডাকে কে জানে, রিদিমার ভেতর বাহির জুড়ে তড়িৎ প্রবাহের ন্যায় তরঙ্গ খেলে গেল অকারণে। সে শ্বাস আটকে আসতে করে জবাব দিলো,
“ হুম্”
“ আমি একচুয়ালী একটা দরকারে ফোন করে ছিলাম।”
খানিক চুপ থেকে আবার বলল,
“ একটু থানায় যেতে হতো আর কি! আপনি আসতে পারবেন।”
রিদিমা ভীষণ বিস্ময় নিয়ে ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“ থানা? থানায় কেন? কারও কিছু হয়েছে নাকি?”
ওপাশ থেকে খুব ধীর কণ্ঠে বলে উঠলো সমর,
“ রিদিমা আপনি ব্যস্ত হবেন না। কারও কিছু হয় নি। তবে আমাকে আর আপনাকে থানায় যেতে হবে। আপনি রেডি হয়ে থাকুন। আমি আসছি।”

সমর ফোন কাটতেই টুক টুক করে কল কেটে গেল। রিদিমা হতভম্ব হয়ে বসে রইলো সেখানেই। মাথার ভেতর তখন ভয় আর দুশ্চিন্তার মিশেলে প্রশ্নের ঝড় শুরু হয়েছে। কু ডাক ডাকছে মনের ভেতরে। বার বার প্রশ্ন জাগছে মনে, কি এমন হয়েছে যে হঠাৎ এভাবে থানায় যাওয়া লাগবে?
_______

বেলা তিনটে কুড়ি। সমরের গাড়িটা পৌঁছালো থানার সামনে। সে দরজা খুলে বেরিয়ে এপাশের দরজা খুলে রিদিমা কে বলল,
“ আসুন!”

শাড়ির আঁচলটা সামলে রিদিমা বেরোতেই সমর ওকে নিয়ে ঢুকলো থানার ভেতরে। রিদিমা পৌঁছতেই বিরাট এক ঝটকা খেয়ে চমকে উঠলো। থানার মধ্যে শুধু ওরা নয় অনেক পরিচিত মুখ দাঁড়িয়ে। রিদিমা নজর ঘুরিয়ে আরেকটু সামনে তাকাতেই দেখতে পেল তার বাবা বসে আছে একটা চেয়ারে। মাও তার পাশে বসা। পরমা দীপ্ত সুতপা মেসো মশাই অভয় দা সবাই মিলে একপাশে দাঁড়িয়ে। তাদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ানো মিসেস রিতা রমা তার হাসব্যান্ড আর তৃপ্তীশ এর বাবা নন্দন বাবু। সবার মুখেই একটা চাপা আতঙ্ক। অস্থির চেহারার গড়ন। পরমা বোন কে দেখা মাত্রই সব কিছু ভুলে দৌড়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো বুকে। ঠোঁট চেপে কান্না ঠেকিয়ে বলল,
“ কেমন আছিস বনু?”

রিদিমা সে প্রশ্নের জবাব দিলো না। আলগোছে ছাড়িয়ে নিলো পরমার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে। তন্মধ্যে রিদিমাকে দেখা মাত্রই মিসেস রিতার রোষানলে পেট্রোল পড়লো যেন। দপ করে জ্বলে উঠে হনহনিয়ে ছুটে এসে খামছে ধরলো রিদিমার হাত।
“ বেহায়া চরিত্রহীন মেয়ে কোথাকারের।
নিজে ফষ্টিনষ্টি করেছে তাতে কোনো দোষ নেই। অথচ আমার ছেলে তাকে বিয়ে করতে না করায় দোষ হয়ে গেল। অভদ্র বেহেলাজা মেয়েছেলে! আজকে তোকে যদি উচিত শিক্ষা না দিয়েছি তো আমার নামও রিতা না!”

বলে ঝড়ের বেগে হাত উঠাতে নিলেই সমর তা আটকে দিলো। সাথে সাথে এক ঝটকায় রিদিমাকে ছাড়িয়ে নিজের কাছে টেনে এনে ধমকে উঠলো ভয়ঙ্কর তেজি গলায়,
“ খবরদার, আমার ওয়াইফের গায়ে একটা নখের আঁচড় লাগলে আমি ভুলে যাবো আপনি বয়সে বড়। সো, বিহেভ ইওর সেল্ফ।”

এরই মধ্যে কয়েকজন লেডি কনস্টেবল ছুটে এসে মিসেস রিতা কে জাপটে ধরলো দুইপাশ থেকে। একজন লেডি অফিসার চোখ গরম করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“ থানার ভেতরে দাঁড়িয়ে মস্তানি করা না। এই কে আছিস এটাকে কেউ হাতকড়া পরাতো। ভেতরে নিয়ে ভালো মতো সাইজ করে দিই।”

নন্দন বাবু তাড়াহুড়ো করে স্ত্রী কে ছাড়িয়ে নিলেন ওদের হাত থেকে। হাত জোড় করে অনুনয়ের সুরে বললেন,
“ ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম। দয়া করে ক্ষমা করে দেন। আসলে ছেলের এই অবস্থা দেখে মাথার ঠিক নেই ওর।”

মহিলা অফিসার চোখের ইশারায় তাদের ছেড়ে দিতে বলে বলল,
“ ঠিক আছে প্রথম ভুল তাই ওয়ারনিং দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি। এর পর মারামারি কিম্বা হাঙ্গামা করলে সিধা চার্জ লাগিয়ে জেলে পুরে দেবো।”

সমর ততক্ষণে রিদিমাকে বাম বাহুতে আগলে নিয়েছে। সে রিদিমার লাল হয়ে যাওয়া হাত টা আরেক হাতের মুঠোয় পুরে সফ্ট গলায় বলল,
“ আপনি ঠিক আছেন তো রিদিমা।”

রিদিমা বিস্ময়ে বিমূঢ়তায় থমকানো অবস্হায় কোনোমতে মাথা নেড়ে হ্যা জানাতেই সে তেরছা চোখে তাকালো তপন বাবু আর মনিকার দিকে। ঠোঁট ছড়িয়ে তাচ্ছিল্য ভরা হেসে বলল,
“ এই রকম একটা জঘন্য ফ্যামিলিতে বিয়ে দিতে এতো মরিয়া হয়ে গেছিল আপনার পরিবার ভাবতেই অবাক লাগছে আমার। ছিঃ!”

চলবে…

পড়ুন সম্পূর্ণ রোম্যান্টিক থ্রিলার ইবুক #রাজযোটক
https://link.boitoi.com.bd/AApV

পড়ুন রোম্যান্টিক থ্রিলার ইবুক #অকল্পনীয়
https://link.boitoi.com.bd/HTLt

কমেন্ট করবেন কিন্তু।#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
পর্ব:২৩

সময় টা নিরলস দুপুর। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। মাঝে মধ্যে ভেসে আসছে ঘন মেঘের গুড়গুড় শব্দ। সেই সাথে বইছে দমকা হাওয়ার ঝাঁপ। ছয়তলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে রিদিমা। গ্রিলটা দুই হাতের মুঠোয় চেপে ধরা। দৃষ্টি জোড়া শূন্যে আটকে। আজ যেন প্রকৃতি আর রিদিমার মাঝে কোনো অন্তর নেই। দুজনই কাঁদছে আপন আপন কষ্টে।

প্রতিটা সন্তানের কাছে চিরদিনই তার বাবা মা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা। যে কোনো বিপদে একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। যার ছায়ায় তারা বেড়ে ওঠে, আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। আজ সেই আশ্রয় টাই যেন হারিয়ে গেছে রিদিমার। অপাঙক্তেয় হয়ে রয়ে গেছে এই সুবিশাল ধরণীর বুকে। যার কোনো ভিত্তি নেই। আর না আছে কোনো মূল্যমান।

আনমনে ভিজে আসা গাল দুটো কাঁপা হাতে মুছে নিলো রিদিমা। কাঁদবে না কাঁদবে না ভেবেও বার বার ভিজে উঠছে অবাধ্য চোখ দুটো। বুকের ভেতর ভেঙেচুরে যাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে হৃদয়ের অন্তঃস্থল। আচমকা তার কাঁধে এক শীতল স্পর্শ ছুঁয়ে গেল। কানে ভেসে এলো চেনা সুর।

“ এভাবে কাঁদলে কি সমাধান মিলবে বলো। মিলবে না তো। শুধু শুধু শরীরটাই খারাপ হবে। তার চেয়ে বরং সব কিছু সময়ের হাতে ছেড়ে দাও। দেখবে সময় তার সময় মতো সব কিছুর সমাধান মিলিয়ে দিয়েছে।”

রিদিমা মাথা নেড়ে নিজেকে সামলালো। নাক টেনে ভাঙা গলায় বলল,
“ আপনি ঠিক বলেছেন আন্টি। আমি আর কাঁদবো না।”

আন্টি ডাক শুনে মিসেস চিত্রা ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। মৃদু ধমকে বললেন,
“ আন্টি আবার কি! মামনি ডাকবে তুমি আমাকে বুঝেছো।”

রিদিমা বিস্ময় ভরা চোখে তাকাতেই মিসেস চিত্রা অমলিন হাসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ তুমি এই বিয়েটা মানো তো রিদিমা।”

সহসা এ কথার জবাব দিতে না পেরে রিদিমা নজর নামিয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিসেস চিত্রা বোধ হয় বুঝলেন মেয়েটার মনের কথা। যে পরিস্থিতিতে পড়ে বিয়ে টা হয়েছে তাতে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভোগা টা অত্যন্ত স্বাভাবিক। তিনি রিদিমার হাত ধরে টেনে এনে বিছানায় বসালেন। নিজেও তার পাশে বসলেন। মেয়েটার একহাত মুঠোয় পুরে বললেন,
“ আমার ছেলেটা একটু রাগী একটু গোমড়া মুখো কিন্তু মনটা সোনার মতো।
জানো তো একবার কি হয়েছে, এই তো গেল বছরের ঘটনা। এক ছিনতাইকারী ওর মোবাইল ছিনিয়ে পালাতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করে বসলো। লোকজন জড়ো হয়ে লোকটার ভিডিও বানাতে আরম্ভ করলো অথচ কেউ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার রিস্ক নিলো না পুলিশ কেসের ভয়ে। আমার ছেলেটা নিজ দায়িত্বে সেই ছিনতাইকারী কে হাসপাতালে ভর্তি করালো। তার সব রকম চিকিৎসা করিয়ে যেই সে সুস্থ হলো তাকে নিজের অফিসে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের ব্যবস্থাও করে দিলো। যাতে আর কোনোদিন এসব চুরি ছিনতাই করে তাকে পেট না চালাতে হয়।”

রিদিমা অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দেখে মিসেস চিত্রা স্মিত হাসলেন। বললেন,
“ তুমি হয়তো ভাবছো আমি আমার ছেলের সুনাম গাইছি যাতে তোমার মনে তার প্রতি পজেটিভিটি তৈরি হয়। আসলে ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়। আমি শুধু বলতে চাইছি আমি আমার ছেলেকে চিনি। তাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। আর এটাও জানি যে সে কোনোদিন তোমাকে অসম্মান করবে না। আগামীতে বিয়েটা নিয়ে তুমি যে সিদ্ধান্তই নাও না কেন সে তোমাকে একবারের জন্যও জাস্টিফাই করবে না।”

রিদিমা এবার সত্যিই লজ্জা পেল। চোখ নামিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“ আন্টি, আপনি আমাকে ভুল ভাবছেন। কাল অগ্নিদেব কে সাক্ষী রেখে সমর বাবু যখন আমার সিঁথিতে সিঁদুর পরালেন সেই তখনই আমি তাকে মন থেকে স্বামী মেনে নিয়েছি। তাই বিয়েটা না মানার প্রশ্নই আসে না।
তাছাড়া আমি কখনও ভুলবো না, যে সময়টায় আমার পাশে কেউ ছিল না সে সময়ে একমাত্র আপনি আর সমর বাবু ভরসা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাকে লগ্ন ভ্রষ্ট হবার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। আমাকে নিষ্কলুষ করে নতুন জীবন দিয়েছেন। এই যে এই মুহূর্তে কি সুন্দর করে আমাকে বোঝাচ্ছেন যাতে আমি সব কিছু ভুলে মুভ ওন করি। সেই আমি আপনাদের সাথে এতো বড় বিশ্বাসঘাতকতা কীভাবে করতে পারি। ছিঃ! তার আগে যেন আমার মরণ হয়।”

রিদিমার কথায় মিসেস চিত্রার মুখাবয়বে এক আকাশ সমান প্রশান্তির হাসি খেলে গেল। পরম মমতা নিয়ে তিনি মেয়েটার মাথায় হাত রাখলেন। ভরসা মিশিয়ে শীতল কণ্ঠে বললেন,
“ ছিঃ মা ওসব বলতে নেই। আসলে আমারই দোষ। খালি আজেবাজে ভাবনা গুলো মাথার ভেতর উঁকি দেয় সব সময়। যাগ্গে বাদ দাও। সকালে তো কিছুই খেলে না। এখন একটু কিছু নিয়ে আসি।”

রিদিমা স্মিত হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই মিসেস চিত্রা চুমকি কে ডাকতে ডাকতে কক্ষের বাইরে চলে গেলেন। রিদিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে তাকালো। সাথে সাথে মনটা উপচে পড়লো মমতায়। ছোট্ট সায়ন কোল বালিশ টাকে দুহাতে জড়িয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছো। কি যে আদুরে লাগছে তাকে দেখতে। রিদিমা আলতো করে হাত বুলালো সায়নের ফুরফুরে চুল গুলো তে। তারপর হঠাৎ কি যেন একটু মনে করে ঝুঁকে ঠোঁট ছোঁয়ালো তার নরম গালে। তাতে সামান্য একটু নড়ে উঠে আবারো ঘুমে তলিয়ে গেল বাচ্চাটা। রিদিমা ঘুমন্ত সায়নের দিকে তাকিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। সহসা ঝুপ করে চোখের পাতায় ভেসে উঠলো অতীতের ফেলে আসা স্মৃতি গুলো। এভাবেই তো বাবা তাকে মাঝে মধ্যে ঘুম পাড়াতো। কখনও মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো আবার কখনও বা পিঠে চাপড় দিতো মৃদু লয়ে। রিদিমা আস্তে ধীরে চোখ বুজে নিলো। বুকে হাত চেপে হাহাকারে চিৎকার করে ওঠা হৃদয় টাকে বোঝাতে চাইলো একদিন সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। একটু খানি ধৈর্য ধর রিদিমা! ব্যস আর একটু খানি ধৈর্য! রিদিমার মন তা মানলো বোধ হয়। তাইতো আবারো বাঁধ ভাঙা অশ্রুরা নেমে এলো দুচোখের সীমানা ভাসিয়ে।
ঠিক তখনই দরজার পাশ থেকে একটা ছায়া মূর্তি নিঃশব্দে সরে গেল। মেয়েটা জানতেও পারলো না কেউ একজন সেই তখন থেকে দাঁড়িয়ে তার বলা কথা গুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছে।
______

ইতিমধ্যে মাঝ খান থেকে কেঁটে গিয়েছে আরও দুটো একঘেঁয়ে দিন। দুটো দিনের ব্যবধানে রিদিমা আজ বেশ কিছুটা সুস্থ। গতকাল বিকেলে রিনি জবা ওরা এসেছিল। অনেকক্ষন ছিল ওরা। অনেক অনেক ভাবে ওকে বুঝিয়েছে। সেই সাথে গল্প ও হয়েছে অনেক। আজ আবার সীমা আর রঙ্গন এসেছিল। ছিল বেশ ঘন্টা খানেক মতো। অনেক গল্প করেছে দুই বান্ধবী মিলে। তবে রঙ্গন দা বেস্ট। এটা ওটা বলে এতো হাসিয়েছে সেই থেকে মনটা বেশ একটু ফুরফুরে লাগছে রিদিমার।

তখন সবে সন্ধ্যা গড়িয়েছে। রিদিমা সায়নকে নিয়ে এটা সেটা করছিল আর ওর মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনছিল। ঠিক তখনই চুমকি এলো ঘরে। ওকে ডেকে বলল,
“ বৌমনি, তোমাকে দাদাভাই ডেকেছে।”

হঠাৎ বৌমনি ডাকটা শুনে কেমন যেন চমকে উঠলো রিদিমা। গায়ের মধ্যে কাটা দিয়ে উঠলো শিরশির করে। ও বলল,
“ এক্ষুনি!”
“ হ্যাঁ।”

রিদিমা উঠে দাঁড়ালো। শাড়ির আঁচল টেনে নিজেকে পরিপাটি করে বলল,
“ আমি তো ওনার রুম চিনি না।”
“ এসো আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।”

বলে চুমকি আগে আগে হাঁটতে শুরু করলো। সমরের এপার্টমেন্ট টা বিশাল। প্রায় দু হাজার স্কয়ার ফিট নিয়ে। তাও আবার ডুপ্লেক্স। নিচে দুটো বড় বেড রুম সহ বিশাল কিচেন ওয়াশরুম ডাইনিং ড্রয়িং আর ঠাকুর ঘর। উপর তলা রিদিমা দেখেনি। আজই প্রথম যাচ্ছে সে চুমকির সাথে। সিঁড়ি বেয়ে চুমকির পেছন পেছন দোতলায় পৌঁছতেই এক বিরাট ধাক্কা খেল রিদিমা। এ যেন স্বপ্নের জগত তার চারিপাশ ঘিরে। কি বিশাল এক বসার ঘর। চারিদিক কাঁচের দেওয়ালে ঘেরা। বড় বড় কার্টন গুলো আলতো করে ঢেকে রেখেছে তাদের নিজের আড়ালে। সামনেই এল আকৃতির বিশাল সাদা রঙের সোফা। দেওয়াল জুড়ে জায়েন্ট স্ক্রিন। বড় একটা কাঁচের টি টেবিলে শোভা পাচ্ছে সাদা রঙের অর্কিড। ব্যালকনিতে ছোট ছোট অনেক গুলো টব ঝোলানো। তাতে নাম না জানা লতানো গাছ। সেসব দেখতে দেখতে রিদিমা একটা রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। চুমকি ইশারায় জানালো এটা সমরের রুমের দরজা। রিদিমা বলল,
“ তুমি ডাকো।”

চুমকি ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে বলল,
“ না না। দাদাভাই তোমাকে ডেকেছে তুমিই যাও। আমি গেলে রাগ করবে। তাছাড়া এমনিতেও যার তার এখানে আসা বারণ।”

বলেই সে পালিয়ে গেল। রিদিমা কি করবে ভেবে ছোট করে নক করলো দরজায়। ঠিক তখনই দরজার পাল্লা খুলে ডেকে উঠলো সমর,
“ ভেতরে আসুন।”

হঠাৎ ভারী কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলো রিদিমা। মুখ তুলে সমরের দিকে তাকাতেই আচমকা লজ্জায় পেট মুচড়ে উঠলো তার। সহসা পা দুটোও কাঁপলো সমান তালে। সমর এতক্ষণ রিদিমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। মেয়েটা কে অমন অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবারো বলল,
“ কি হলো আসুন।”

রিদিমা নিজেকে সামলে জড়তায় ভরা পা ফেলে সে ঘরে ঢুকলো। সমর সামনের সোফা দেখিয়ে বলল,
“ বসুন।”

রিদিমা সোফায় গিয়ে জড়সড় হয়ে বসতেই সমর বলল,
“ আপনার শরীর কেমন আছে এখন?”

রিদিমা মুখে কিছু না বললেও মাথা নেড়ে জানালো সে আপাতত ভালো আছে। সমর প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে ছিল সামনে। রিমলেস চশমার ফাঁক দিয়ে নজর গেঁথে ছিল মেয়েটার দিকে। সে ওভাবে তাকিয়ে থেকেই বলল,
“ গুড! আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করবো। প্লীজ সবিস্তারে জানাবেন।”

রিদিমা এতক্ষণ নতমুখে বসে ছিল। এমন কথায় এবার চোখ তুলে তাকালো। সমর বলল,
“ আমার জানা মতে বিয়ের পাত্র সেদিনের ওই বখাটে ছেলেটাই ছিল তাইতো?”

রিদিমা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। সমর তা দেখে বলল,
“ আশ্চর্য! এতো বড় একটা স্ক্যান্ডাল হয়ে যাবার পরও আপনার পরিবার রাজি হলো কীভাবে ওই বাস্টার্ড টার সাথে আপনার বিয়ে দিতে?”

লজ্জায় ঘৃণায় আবারো মাথা নিচু করে নিলো রিদিমা। তার মৌনতায় যেন হাজারও আক্ষেপ ঝরে ঝরে পড়ছিল ঝুরঝুরে বালির মতো। এখানে সম্পূর্ণ দোষ তার পরিবারের নয়। দোষ তারও আছে। সেই মানুষ চিনতে ভুল করেছে। অভিনয় কে সত্যি ভেবে নিজেকে শেষ করে দিয়েছে একেবারে। বেশ অনেক্ষণ পর রিদিমা নিজেকে ধাতস্ত করলো। তারপর এক এক করে সব ঘটনা খুলে বলল। যেদিন প্রথম তৃপ্তীশ এর সাথে দেখা হয়েছিল সেদিন থেকে শুরু করে বিয়ের দিন পর্যন্ত এ টু জেড সব কিছু।

সবটা শুনে চুপ করে দাঁড়িয়েই রইলো সমর। তার বোঝা হয়ে গেছে। ওই স্কাউন্ড্রেল টা এতোদিন ধরে নাটক করেছে যাতে এভাবে প্রতিশোধ নিতে পারে।
রিদিমা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“ আর কিছু জানার আছে আপনার?”

সমর মাথা নেড়ে জানালো,
“ নাহ্!”
“ আমি কি এবার জেতে পারি?”

রিদিমার প্রশ্নে সমর ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক পল। তারপর নরম গলায় বলল,
“ এটা আপনারও রুম। থাকবেন নাকি চলে যাবেন আপনার ইচ্ছে।”
____

প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার আনন্দে সারা রাত জেগে দুমসে পার্টি করেছে তৃপ্তীশ। ভোরের দিকে কোনোমতে বাড়ি ফিরে গা এলিয়ে দিয়েছিল বিছানায়। সেই তখন থেকে সে ঘুম। ইচ্ছে ছিল একেবারে সন্ধ্যায় ওঠার। কিন্তু তা আর হলো না। দুপুরের পর পর মায়ের হাঁক ডাকে শেষ মেশ উঠতেই হলো তাকে। বিরক্তি নিয়ে আরমোড়া ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসতেই বাড়িতে পুলিশ দেখে বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল সে। বসার ঘরের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল মা বোনের ভীত সন্ত্রস্ত চেহারা। বাবা টাও কেমন যেন থমথমে মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সে মায়ের কাছে জানতে চাইলো,
“ কি হয়েছে মা? বাড়িতে পুলিশ এসেছে কেন?”

মিসেস রিতা ছেলের কাছে এসে দাঁড়ালেন। কাঁপা গলায় ফিস ফিস করে বলল,
“ বাবু রে সর্বনাশ হয়ে গেছে।”

তৃপ্তীশ অবুঝের মতো করে বলল,
“ সর্বনাশ হয়ে গেছে মানে, কি হয়েছে!”
“ আমি বলছি।”

মিসেস রিতা কে থামিয়ে ওসি সঞ্জয় সিং সামনে এগিয়ে এলো। অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট দেখিয়ে বলল,
“ ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট মিস্টার তৃপ্তীশ রায়।”

বিস্ময়ে প্রবল ধাক্কা খেয়ে তৃপ্তীশ বলে উঠলো,
“ হোয়াট। কি করেছি আমি?”
“ বিয়ের নাম করে প্রতারণা করার অপরাধে IPC সেকসন 420 এর আন্ডারে আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।”

‘বিয়ের নামে প্রতারনা’ কথাটা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো তৃপ্তীশ। এতো বড় অপবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলল,
“ মিথ্যে কথা।
অফিসার, বিশ্বাস করুন আমি মোটেও কারো সাথে প্রতারণা করিনি। আপনিই বলুন একটা চরিত্রহীন মেয়েকে বিয়ে করতে না চাওয়া কি কোনো ধরনের প্রতারণার আওতায় পড়ে?”

সঞ্জয় সিং তৃপ্তীশ এর হাতে হ্যান্ডকাফ পরাতে পরাতে বলল,
“ সেটা বিচার করার আমি কেউ নই মিস্টার। সেটা তো কোর্ট বিচার করবে।”

নিজের হাতে হাতকড়া দেখে তিলমিলিয়ে উঠলো তৃপ্তীশ।
“ একি! আমাকে হাতকড়া পরাচ্ছেন কেন? আমি যে অপরাধী সেটা তো এখনও প্রমাণ হয় নি।”
“ হয়নি তো কি হয়েছে। তদন্ত চলছে। আশা করি খুব তাড়াতাড়ি প্রমাণও হয়ে যাবে।”

বলেই তৃপ্তীশ কে ঘাড় ধরে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বাড়ি থেকে বের করলো ওসি সাহেব। তারপর তাকে ঠেলতে ঠেলতে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল থানার উদ্দেশ্যে। ওদিকে পাড়ায় পুলিশ ঢুকতে দেখে গোটা এলাকা ভেঙে পড়েছে তৃপ্তীশ দের বাড়ির চারিপাশে। ফিসফাস ফুসফাস গুঞ্জন চলছে সকলের মুখে মুখে। গত দুদিন আগে বিয়ে করতে গিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তা মোটামুটি সবারই জানা। তবে আজকের ঘটনা ছিল অনভিপ্রেত। বিয়ের আসর ছেড়ে পাত্র পক্ষ কে বিয়ে ভাঙতে অনেককেই দেখেছে সকলে। কিন্তু সেই অপরাধে বাড়ি বয়ে পুলিশ আসতে এই প্রথম দেখছে সকলে। কৌতূহল তো হবারই কথা স্বাভাবিক। ছেলেকে নিয়ে পুলিশের গাড়িটা বেরিয়ে যেতেই মিসেস রিতা হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। হাত পা ছুঁড়ে আহাজারি করতে করতে বললেন,
“ ওগো, তুমি আমার ছেলেটা কে বাঁচাও। নয়তো ওর জীবন টা শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে যাবে।
ও রমা, জামাই কে শিগগির একটা ফোন কর। বল যেন তাড়াতাড়ি আসে এখানে। তোর ভাইকে যে ভাবে হোক ছাড়িয়ে আনতে হবে।”

চলবে.…