তুই যখন ছুঁয়ে দিলি মন পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
14

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
পর্ব:২৫

শূন্যতার মাঝে অকস্মাৎ ভারী শব্দের আবির্ভাব হলে যেমন সব কিছু মুহূর্তের জন্য থমকে যায়, চিরায়ত পরিস্থিতির রুপ বদলায় এক লহমায়। ঠিক তেমনি করেই যেন অদৃশ্য বজ্রাঘাত হানলো উপস্থিত সকালের মাঝে সমরের তাচ্ছিল্য ব্যঞ্জন শব্দ গুচ্ছে। তপন বাবু থেকে শুরু করে মনিকা সুতপা সকলেরই মুখ আনত হলো লজ্জায়। ভবিতব্য তামাশার সূচনা যে হয়ে গেছে ইতিমধ্যে বোধ হয় তাদের বোধ হলো এই ক্ষণে।
সমর সেসবে গুরুত্ব দিলো না। এক বাহুতে রিদিমাকে আগলে নিয়ে দাঁড়ালো সেই লেডি আফিসারের সামনে। গাম্ভীর্যে মোড়ানো দৃঢ় কন্ঠে আওড়াল,
“ ম্যাডাম, ওসি সাহেব কোথায়? ওনাকে ডাকুন প্লীজ।”

লেডি অফিসার এতক্ষণ অবাক চোখে সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তির অভিব্যক্তি দেখে যাচ্ছিল মুগ্ধ নয়নে। বার বার প্রশ্ন জাগছিল মনে, আজকাল বুঝি এমন স্বামীও হয়। যে কিনা মাত্র দুদিনের বিয়ে করা সহধর্মিণীর সম্মান রক্ষায় এভাবে লড়াই করছে। ভাবনায় ডুবে বেখেয়ালে জেগে উঠেছিল তার এক রমণী হৃদয়ের অপ্রকাশিত আক্ষেপ। ইস্, তার স্বামীও যদি এমন টা হতো, তাহলে হয়তো ঘরে ফিরে দুদণ্ড শান্তি পেত মনে। বুক চিরে অকস্মাৎ এক ভারী বেদনাতুর দীর্ঘশ্বাস বাতাসে বিলীন হলো নিঃশব্দে।
অফিসার কিছু বলবেন তার আগেই তপন বাবু কথা বলে উঠলেন,
“ আমাদেরকে এখানে কেন ডাকা হয়েছে ম্যাডাম। ঘন্টা খানেক হয়ে গেল অথচ কেউ কিচ্ছু বলছেন না।”
লেডি অফিসার তার ভাবনায় সমাপ্তি টেনে তপন বাবুর দিকে তাকালো। ভরসা দায়ক আশ্বস্ত কণ্ঠে জানালো,
“ সব কিছু জানতে পারবেন। আরেকটু ধৈর্য ধরে বসুন প্লীজ।”
বলেই লেডি অফিসার ঘাড় বাঁকিয়ে কাউকে ডেকে উঠলো,
“ মন্ডল বাবু এনাদের জন্য একটু চায়ের ব্যবস্থা করুন তো। আসলেই অনেকক্ষন ধরে বসে আছেন।”

এরই মধ্যে বেশ হন্তদন্ত হয়ে সেখানে ঢুকলো ওসি সঞ্জয় সিং। সমরের সামনে এসে সহাস্য চিত্তে হাত এগিয়ে দিলো করমর্দনের উদ্দেশ্যে। সমর তাতে সম্মত হয়ে হাত মেলাতেই ওসি বলল,
“ স্যার, আপনার আশঙ্কাই ঠিক। কনভিক্ট অর্থাৎ মিস্টার তৃপ্তীশ রায়ই সমস্ত ঘটনার মূল চক্রি।”

তপন বাবু বসা থেকে এবার উঠে দাঁড়ালেন ক্রাচে ভর দিয়ে। বিস্ময়ের বিমূর্তায় হতভম্ব তার চোখ মুখ। তিনি সভয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“ স্যার, দয়া করে একটু পরিষ্কার করে বলবেন আসলে হচ্ছে টাকি। মানে আমরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না আপনারা কি বলছেন আর কেনই বা আমাদেরকে এভাবে ডাকা হয়েছে এখানে!”

অফিসার তপন বাবুর দিকে বেশ উত্তাপ নিয়ে তাকালো। কন্ঠে কমনীয়তার বদলে বিদ্রুপ ঢেলে বলল,
“ আপনাদের হবু এক্স জামাই মহাশয় তৃপ্তীশ কে নিয়ে কথা হচ্ছে বুঝেছেন। বিয়ের দিন সবার সামনে যে ছবি গুলো দেখানো হয়েছিল ওগুলো নকল ছবি ছিল। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সি অর্থাৎ এ আই দিয়ে বানানো। মিসেস রিদিমাকে জড়িয়ে ডেলিবারেটলি আপনাদের হেনস্থা করার জন্য এটা করা হয়েছিল। যাতে বিগত দিনে আপনাদের কাছ থেকে পাওয়া এক একটা অপমানের চূড়ান্ত প্রতিশোধ নিতে পারে।”

ওসি সাহেবের কথা গুলো যেন ভয়ানক ভূমিকম্পের মতো বিস্ফোরণ ঘটালো রুমের ভেতরে। বিস্ময়ের শীর্ষে উঠে থ হয়ে গেলেন তপন বাবু সহ উপস্থিত সকলে। গোটা ঘরের পরিবেশে মুহূর্তে নামলো এক দুর্বোধ্য অসাড় নীরবতা। প্রতিটা মানুষের নিঃশ্বাসে ঝরে পড়ল অন্তর দহনের পোড়া দীর্ঘশ্বাস।

ওদিকে তৃপ্তীশ এর বাড়ির সকলে রীতিমত অবাক। বিস্ময়ে হতভম্ব তাদের মুখ মন্ডল। নন্দন বাবু চমকের আড়ম্বরে জমে গেলেন পুরোদস্তুর। ছেলে যে তার এমন ক্রিমিনাল মাইন্ডেড তিনি যেন নিজের কানকে বিশ্বাসই করে উঠতে পারলেন না।
এদিকে মিসেস রিতার মুখে যেন ঘোর অমানিশা নেমেছে। ভয়ে আতঙ্কে আটকে আসছে হৃদ যন্ত্রের রোমন্থন। সব কিছু যে এভাবে ফাঁস হয়ে যাবে মহিলা আসলে ভেবে উঠতে পারেন নি। আদতে এসব নিয়ে যে কখনও পুলিশ কেস হবে সে বিষয়ে বিন্দু মাত্র ধারণা ছিল না তার। যদি আগে থেকে জানতেন তাহলে থোড়াই ছেলের পরিকল্পনায় সাথ দিতেন! আর না তাকে এগোতে দিতেন এমন বিপদের মুখোমুখি হতে।

ওসি সঞ্জয় সিং আরও বললেন,
“ তাছাড়া আমরা আশঙ্কা করছি আপনার অ্যাক্সিডেন্ট টাও হয়তো প্রী প্ল্যান্ড ছিল। ভাড়াটে বাইকার দিয়ে ইনসিডেন্ট টা ঘটানো হয়েছিল। তবে এখনই নিশ্চিত করে বলতে পারছি না সেটা। তদন্ত চলছে। আশা করি খুব তাড়াতাড়ি সত্যিটা বেরিয়ে আসবে সবার সামনে।”

ছেলে যে তার পুরোপুরি ফেঁসে গিয়েছে এতে আর কোনো দ্বিমত নেই নন্দন বাবুর মনে। তিনি রক্তিম চোখে এক পলক স্ত্রীর দিকে তাকালেন তারপর ধুপ ধাপ শব্দ যোগে পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন বাইরে। মিসেস রিতা এবার অসহায় দৃষ্টিতে মেয়ে জামাইয়ের মুখের দিকে তাকালো শেষ সাহায্যের আশায়। রমার স্বামী সৌভিক সেই দৃষ্টি কে একটুও পাত্তা দিলো না। একেই এসব কান্ডের জেরে তার মান সম্মান নষ্ট হয়েছে। তার উপর আবার ক্রিমিনাল কেস। ধনে মানে সব ধরে টান পড়বে এবারে। সৌভিক রমার দিকে রোষ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে রাগী কণ্ঠে বলল,
“ এসব কীর্তিকলাপে তোমার কোনো রকম অংশীদারিত্ব নেই তো?”

রমা ভয়ে ঘন ঘন মাথা নাড়ালো। বোঝাতে চাইলো সে একেবারে নির্দোষ। সৌভিক তা দেখে পূনরায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল,
“ না হলেই ভালো। তবুও যদি কখনও জানতে পারি এই ঘটনার সাথে তোমার তিল মাত্র যোগ সংযোগ ছিল তাহলে মনে রেখো চিরদিনের জন্য তোমাকে নির্বাসন দিতে দ্বিতীয় বার ভাববো না আমি।”

বলে সেও প্রস্থান নিলো সেখান থেকে। রমা দিক দিশা না পেয়ে স্বামীর পেছন পেছন ছুটলো। পেছনে যে মা দাঁড়িয়ে অসহায় হয়ে সেদিকে তাকালো ও না একবারও। রমা খুব বুদ্ধিমতি। আর যাই হোক বাপের বাড়ির টান টেনে নিজের সংসার নষ্ট করার মতো মেয়ে সে নয়। তাছাড়া যা কিছু করেছে মা ভাই মিলে করেছে। তাতে তার কোনো দোষ নেই। তাহলে কেন সে তার দায়ভার নেবে! রমা মায়ের কাতর আর্তি উপেক্ষা করে চলে গেল। ধীরে ধীরে নিঃসঙ্গ হয়ে একাকী দাঁড়িয়ে রইলো মিসেস রিতা। স্বামী মেয়ে জামাই সবাই কে এভাবে চলে যেতে দেখে মিসেস রিতার বুক ভেঙে এলো কষ্টে। আঁচলের মুড়োয় চোখ থেকে ছলকে পড়া অশ্রু টুকু মুছে সেও ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।

মনিকা আজ নির্বাক। মেয়ের সামনে দাঁড়ানোর মুখ আজ আর তার নেই। দিনের পর দিন মেয়ের উপর করা এক একটা মানসিক অত্যাচারের কথা তার মননে ভেসে আসছে। নিজের বলা এক একটা নোংরা কথা কানে ঝংকার তুলে বাজছে আজ। আর তাতেই গ্লানিতে বুঝে আসছে গলার স্বর। মনে পড়ে যাচ্ছে মেয়েটার বিদায় মুহূর্তে বলা সেই বেদনায় জড়ানো ব্যাথাতুর কথা গুলো,
“ ভেবে বলছো তো মা! দেখো, আবার সত্যি টা বেরিয়ে এলে আফসোস করো না যেন।”

হ্যাঁ আজ আফসোস হচ্ছে তার। সেই সাথে জেগে উঠেছে নিজের প্রতি অসহনীয় খেদ। কেন সে সেদিন মেয়েটা কে একটা বার বিশ্বাস করে নি। কেন তার মিথ্যে রাগ জেদ সন্তানের চোখের জলের ঊর্ধ্বে চলে গেল। কেন? কেন? কেন?

তপন বাবু ও স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মাথা নত করে। তার বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে কষ্টে। মন টা কাঁদছে অনুশোচনায়। ইস্, সেদিন কেন মেয়েটা কে তিনি এতো টা অবিশ্বাস করলেন? কেন একটা বার মেয়ের প্রতি সামান্য তম আস্থা রাখলেন না। মাথায় হাত রেখে বললেন না, মারে! আর কেউ থাক না থাক তোর এই বুড়ো বাপ তোর পাশে আছে। আর আমৃত্যু থাকবে। তপন বাবুর গাল বেয়ে দুফোঁটা বিষাক্ত যন্ত্রণা গড়িয়ে পড়ল চোখের জলে মিশে।

রিদিমা এতক্ষণ অশ্রু সিক্ত চোখে পাথরের মতো তাকিয়ে ছিল বাবা মায়ের মুখের দিকে। এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছিল তাদের চেহারার পরিবর্তন। অনুতাপের দহনে পোড়া অভিব্যক্তির নিঃসরণ। শেষমেষ সে জয়ী হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে সে কোনো দোষ করেনি। আর না কোনো অন্যায় কখনও করেছিল।

তপন বাবু আস্তে ধীরে নত মুখটা তুলে তাকাতেই থমকে গেলেন যেন। একজোড়া অভিযোগে সিক্ত মায়াময় আঁখি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকেই যে তাকিয়ে আছে। চোখের ভাষায় জানাচ্ছে তার আকুল আবেদন। বাবা, সেদিন তুমি আমায় বিশ্বাস করলে না! অথচ দেখো আমি কিন্তু নির্দোষ ছিলাম।
প্রশ্নটা মস্তিষ্কে জেগে উঠতেই হৃদয়ের গভীরে থাকা অপরাধী পিতৃ মনটা হঠাৎ করেই ডুকরে উঠলো। বুকের পাঁজরে শুরু হলো অদ্ভুত এক বিষাক্ত যন্ত্রণা। তিনি এক পা দু পা করে এগিয়ে আসতে চাইলেন মেয়ের কাছে। মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে শান্ত করতে চাইলেন অশান্ত অতৃপ্ত মন। কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। সাথে সাথে উপেক্ষার আঁধারে নিমজ্জিত হলো সবটুক। রিদিমা সাথে সাথে মুখ ফিরিয়ে সমরের দিকে তাকালো। ব্যতিব্যস্ত হয়ে ম্লান কন্ঠে বলে উঠলো,
“ আমরা বাড়ি কখন ফিরবো। আমার এখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না।”

মেয়েটার কথার ভাঁজে লুকোনো প্রগাঢ় কষ্ট টা কে বোধ হয় খুব করে বুঝতে পারলো সমর। তাইতো চোখের ভাষায় আশ্বস্থ করে ওসি সঞ্জয় সিং কে বলল,
“ ওয়েল অফিসার আমাদের কি আর কোনো প্রয়োজন আছে এখানে!”
“ না স্যার, আপাতত আপনাদের আর কোনো প্রয়োজন নেই এখানে। তবে আগামীতে হয়তো ম্যাডামকে নিয়ে আপনাকে কোর্টে আসতে হতে পারে।”

সমর ওসির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো করমর্দনের উদ্দেশ্যে। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“ থ্যাংক ইউ সো মাচ অফিসার। আপনার হেল্প ছাড়া এতো বড় একটা সত্যি কখনই সামনে আসতো না। ইউ উইল ডিজার্ভ আ গ্রেট থ্যাঙ্কস অফিসার।”

করমর্দনের জবাবে ওসি হেসে বললো,
“ ইটস ওকে স্যার। এখানে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছুই নেই। এটা আমাদের ডিউটি।”

সমর মাথা নেড়ে সায় জানালো। অতঃপর সবার সামনে দিয়ে রিদিমার এক হাত মুঠোয় পুরে পুরোদস্তুর মাথা উঁচু করে বেরিয়ে এলো থানা থেকে।

চলবে…

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
পর্ব:২৬

আচ্ছা, মানুষ প্রেমে কখন পড়ে বলুন তো?
প্রশ্নটা যতোটা সহজ আর প্রাঞ্জল; জবাব টা কিন্তু ততোটাই কঠিন আর দুষ্প্রাপ্য। আজ বোধ হয় সেই ধোঁয়াশায় মোড়ানো জটিল পথের পথিক হয়েছে রিদিমা। তার নরম মনের কাঁচা অঙ্গনে আস্তে ধীরে একটু একটু করে ছাপ বসিয়ে অগ্রসর হচ্ছে সেই আপাদমস্তক রহস্যে ঘেরা মানুষটা। যার সাথে তার কখনও দুটো মনের কথা হয় নি। আর না হয়েছে কোনো সাবলীল আলাপন।
এই যে, এই মুহূর্তে কি অবলীলায় সীমাহীন আধিকারের সাথে হাত টা তার মুঠোয় পুরে হাঁটছে সে। যেন অবুঝ শিশুটি ও। ছেড়ে দিলে হারিয়ে যেতে পারে কোথাও। রিদিমা অবাক নয়নে ওই মুঠো বন্দী হাত টা দেখে গেল অবিরল। বিস্ময় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে তার অন্তর মহলের দুয়ার জুড়ে। অথচ হৃদয়ের গহীনে ঝংকার তুলে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মুগ্ধতার সুরেলা ঐকতান।

“ রিদিমা গাড়িতে উঠুন।”

খরখরে এক পুরুষালি স্বরের ডাকে রিদিমার ধ্যান ভঙ্গ হলো। সে চমকে তাকাতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো সাদা রঙের সেই টয়োটা গাড়ির সামনে। যার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে সমর। এতক্ষণে জ্ঞান হলো রিদিমার। সে যে বেখেয়ালে ডুবে কখন এখানে পৌঁছেছে নিজেই ঠাহর করতে পারে নি। ততক্ষণে সমর পূনরায় তার কথা আওড়ালও।

“ রিদিমা! গাড়িতে উঠুন। বাড়ি যাচ্ছি আমরা।”

রিদিমা চমক ভেঙে মাথা নাড়লো। তারপর উঠে বসলো গাড়িতে। অনেক্ষণ হলো গাড়ি চলছে। রিদিমা সিটে হেলান দিয়ে অপলক চোখে তাকিয়ে দেখছে জানালার ওপারে ছুটে চলা দৃশ্য গুলো। ছুটছে মাঠ ছুটছে মানুষ ছুটছে অজানা প্রান্তর। কিন্তু রিদিমা শান্ত। অভিব্যক্তি হীন তার মুখমন্ডল।
সমর এতক্ষণ গাড়ি চালানোর ফাঁকে মাঝে মাঝে পাশে বসা রমণীর দিকে নজর বোলাচ্ছিল। সেই সাথে জহুরী চোখে মেপে নিচ্ছিল মলিন মুখটায় উপচে পড়া বিষাদের ভার। বেশ অনেক্ষণ পর গাড়ি থামালো সমর। রিদিমা অচেনা আশপাশ দেখে ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“ আমরা কোথায় এসেছি। এই জায়গা তো আমাদের এলাকার নয়।”
“ ঠিক ধরেছেন। আমরা এখন শহরের বাইরে আছি। বলতে পারেন কান্ট্রি সাইড এলাকা। সামনে একটা নদী আছে। আপনার না অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। তাই ভাবলাম একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। ফ্রেশ লাগবে।”

সমরের কথা শুনে রিদিমা যেন আরেক দফা চমকালো। মন গহীনের অন্তরালে আবারো যেন বেজে উঠলো সেই মুগ্ধতার সুর। বিস্ময়ের দমকে শ্বাস প্রশ্বাস আটকে গেল পাঁজরের ভাঁজে।
সমর রিদিমাকে নিয়ে হাঁটছে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কলকলে জলধারা। নদীর পাড় ঘেঁষে প্রেমে মত্ত কতো শত জুটির মেলা।
সমর একটু ফাঁকায় গিয়ে দাঁড়ালো। রিদিমাকে চোখের ইশারায় পাশে দাঁড়াতে বলল। রিদিমা দাঁড়াতেই সমরের নজর গিয়ে আটকালো বহমান সলিলে। বেশ কিছুক্ষণের বিরতি নিয়ে বলল,
“ আসলে কিছু দরকারী কথা বলতেই আপনাকে এখানে নিয়ে আসা। আপনি কমফোর্ট ফিল করলেই শুরু করবো।”

রিদিমা এতক্ষণে বুঝলো এখানে আসার আসল কারণ। ও মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই সমর বলতে শুরু করলো,
“ আসলে বিগত দিনে যে পরিস্থিতিতে আমাদের বিয়ে টা হলো সেটা নিয়ে এই মুহূর্তে আর কিছু বলার নেই আমার। তবে..

বলেই নজর ঘোরালো সমর। চশমার স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ ভেদ করে ঠিকরে আসা তার নিরেট দৃষ্টি জোড়া গাঁথলো মেয়েটার গোল গোল চোখের বিস্ময় ভরা চাহনিতে। তার পর বলল,
“ আপনি চাইলে এই অসম সম্পর্কের ইতি এখানেই টানতে পারেন। আই হ্যাভ নো প্রবলেম।”

রিদিমা কিছুক্ষন চুপ করে রইলো কথাটা শুনে। তারপর রয়ে সয়ে বলল,
“ আপনি বুঝি এসব বলতেই এখানে নিয়ে এসেছেন।”

সমরের প্যাচাল বিহীন সহজ জবাব,
“ কেন! কথাটা গুরুত্বপুর্ন নয় কি?
আপনি বাচ্চা একটা মেয়ে। তার উপর আনকোরা। তাই আপনার জীবনের স্বপ্ন পুরুষটাও আনকোরাই হওয়া উচিত। আর সেখানে আমি, ডিভোর্সী, ভাঙাচোরা একজন মানুষ। তাতে আবার এক বাচ্চার বাবা। সম্পর্কটা ভীষণ খাপছাড়া। তাই সেই কারণেই বলছি আপনি চাইলে..
“ আমি সম্পর্কের ইতি টানতে পারি তাইতো!”
“ হুম্।”

রিদিমা এতক্ষণ নতমুখে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সে মাথা তুলে সমরের দিকে তাকালো।
“ কিন্তু আপনি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছেন সমর বাবু, এই সম্পর্কের ইতি টানতে গেলে আপনার আমাকে ডিভোর্স দিতে হবে। তখন কিন্তু আমিও আর আনকোরা থাকবো না। কারণ ডিভোর্সি হওয়ার তকমা টা তখন আমার গায়েও লেগে যাবে। আর তারপর যদি কোনো আনকোড়া পুরুষ আমার স্বপ্নের দায়ভার নিতে রাজি না হয় তখন আমি কি করবো?”

কথার পাল্টা যুক্তিতে সমর যেন মুহূর্তেই ধরাশায়ী হলো। অযাচিত চিন্তার ভার মস্তিষ্কে আঘাত করতেই সাথে সাথে কপাল জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো দুশ্চিন্তার গাঢ় ভাঁজ। রিদিমা তা দেখে বলল,
“ দেখুন সমর বাবু, আমি ভাগ্যে বিশ্বাসী। সেদিন যা কিছু ঘটে ছিল সেটা চক্রান্ত হলেও আপনার আমার বিয়ে টা ভাগ্যে লেখা ছিল বলেই হয়তো হয়েছে। আর তাই আমি এই বিয়ে টা মানি।”

সমর ভ্রূ জোড়া কুঁচকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে। কি অবিচল কণ্ঠে কত ভারী ভারী কথাগুলো যে বলল মেয়েটার কি সে বিষয়ে ধারণা আছে? সমর ভাবনায় ডুবে গেল।
রিদিমা যেন আজ মন খোলা আকাশ হয়েছে। সে তার বুকে জমা নীরদ গুলো ঝেড়ে ফেলার প্রয়াসে তৎপর হলো।

“ কোন মেয়ে তার ভবিষ্যত জীবন সঙ্গী নিয়ে কি স্বপ্ন দেখে সেটা আমি জানি না। তবে আমি চিরকাল এমন একজন মানুষ কে সঙ্গী হিসেবে পেতে চেয়েছি যে আমায় কখনও কোনো কিছুর জন্য জাস্টিফাই করবে না। আমার পাশে শুধু ছায়া হয়ে নয় বরং ভরসা হয়ে দাঁড়াবে। আমার সুখের সাথে দুঃখের সাথী হবে। যার হাত ধরলে আমার নিজেকে সব সময় সেফ মনে হবে, নির্ভার লাগবে এমন একজনকেই পেতে চেয়েছি সঙ্গী হিসেবে। তাতে সে ডিভোর্সী নাকি এক সন্তানের পিতা এসব নিয়ে আমার কিছু আসে যায় না। বিগত কয়েক দিনের বিপদ সংকুল সময়টাতে আমার স্বপ্ন পুরুষের গুণে গুণান্বিত মানুষটাকে সর্বক্ষণ আমার পাশেই পেয়েছি আমি।
এবার আপনি বলুন আমার এখন কি করা উচিত!
তাকে ছেড়ে চলে যাওয়া নাকি তাকে আঁকড়ে ধরে বাকি জীবনটা উপভোগ করা।”

সমরের দিকে ফ্যাল ফেলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রিদিমা। যেন উত্তর টা তার এই মুহূর্তে লাগবেই লাগবে। এদিকে কথা গুলোর ভাঁজে লুকোনো অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে একটু সময় লাগলো সমরের। সে আচমকাই হেসে ফেললো। হাসি যদিও খুবই অল্প তবুও চোখে লাগার মতো। একদম স্বচ্ছ। রিদিমা আবারো বোধ হয় মুগ্ধ হলো সেই হাসিতে। সমর ঠোঁটের ভাঁজে ঠোঁট চেপে কিছুক্ষন হাসার পর হঠাৎ মাথা নেড়ে বলল,
“ ওয়েল, সর্ম্পক টা যেহেতু আগাচ্ছে তাহলে তোমাকে তুমি করেই ডাকলাম কি বলো মিসেস ওয়াইফ।”

রিদিমা এ কথার প্রত্যুত্তর করলো না। শুধু মাথা নত করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। ওর কেন যেন হঠাৎ খুব করে লজ্জা বোধ হচ্ছে। তল পেটের মধ্যে খানটায় গোল গোল করে মোচড় দিচ্ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি ওর খুব জোর টয়লেট পেয়ে যাবে। ইস্, লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে কিভাবে বলতে পারলো ও কথা গুলো!

সমর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল রিদিমার মুখের দিকে। মেয়েটার লাজে রাঙা মুখ খানা দেখে বেশ ভালো লাগছে ওর। কেন যেন আজ বহুদিন পর বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে মেয়েটার হাত টা মুঠোয় পুরে এই নদীর পাড় ধরে ছোট ছোট পায়ে হাঁটতে। সমর ইচ্ছে টাকে অপূর্ণ রাখলো না। সে সত্যিই রিদিমার ডান হাত টা মুঠোয় পুরে নিলো। মেয়েলি ত্বকের কোমলতা টুকু স্পর্শে শুষে নিয়ে গাঢ় গলায় বলল,
“ চলো বাড়ি ফেরা যাক।”
_______

তখন প্রায় সন্ধ্যে নেমেছে। গাছ গাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে তখনও দেখা যাচ্ছে বিলীন হওয়া আলোর অবশিষ্টাংশ টুকু। সমরের গাড়িটা সেই মুহূর্তে পৌঁছালো তাদের আবাসনের সামনে। হাঁটা টা আর তাদের হয়ে ওঠেনি। মিসেস চিত্রার দরকারী কল পেয়ে ছুটে আসতে হয়েছে।

সমর রিদিমা কে নিয়ে যখন ফ্ল্যাটে ধুকলো বসার ঘরে একঝাঁক সদ্য পরিচিত মুখ দেখে থমকে গেল একেবারে। তপন বাবু মনিকা সুতপা সুতপার স্বামী দীপ্ত পরমা আরও বেশ কয়েক টা অপরিচিত মুখ। রিদিমা বাবা মা কে দেখে অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো। ঠিক তখনই মনিকা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে।

“ মা রে! আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি। তোকে ভুল বুঝেছি। তোর মতামতের গুরুত্ব না দিয়ে অপরাধ করেছি। জানি আমার এই অপরাধের কোনো ক্ষমা হয় না। তবুও, তোর এই অসুস্থ মা টা কে শেষ বারের মতো ক্ষমা করে দে মা।”

রিদিমা অনড়। পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মনিকার এই আহাজারি তে যেন একটুও টলে গেল না সে। আসলে সেই বিয়ের দিনের স্মৃতি গুলো মনে পরছে খুব করে। সেও তো ঠিক এভাবেই আর্তনাদ করেছিল। হাতে পায়ে ধরে ছিল সবার। কেউ তাকে বিশ্বাস করে নি। কেউ না।

তন্মধ্যে খুঁড়িয়ে হেঁটে এলেন তপন বাবু। মেয়ের মুখে নরম হাত ছুঁইয়ে প্রগাঢ় কণ্ঠে বলতে চাইলেন
“ মা রে.. আমাকে কি শেষ বারের মতো ক্ষমা ..

রিদিমা সে কথা শেষ হবার আগেই জোর গলায় ডেকে উঠলো,
“ চুমকি দি!”

চুমকি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে ডাকে সাড়া দিলো,
“ হ্যাঁ বৌ মনি বলো।”

রিদিমা নিজেকে সামলে একটা দৃশ্যমান দূরত্ব তৈরি করলো যেন। তারপর বলল,
“ বাড়িতে অতিথি এসেছে। চলো আমরা জল খাবার রেডি করি।”

তারপর মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ আপনারা চা নেবেন না কি কফি!”

ঘরে উপস্থিত সকলে যেন চমকে উঠলো রিদিমার বরফের ন্যায় শীতল ব্যবহারে। মিসেস চিত্রা কি বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। সমর একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সেও মুহূর্তেই চমকালো রিদিমার বলা কথা গুলো শুনে। মেয়েটার প্রখর আত্ম সম্মান বোধ তাকে আগেই অবাক করেছিল। আজ আবারো অবাক হলো তার অভিমানের গাঢ়ত্ব দেখে।
তপন বাবু মাথা নুয়ে সরে দাঁড়ালেন পাশে। মনিকারও বুঝতে বাকি নেই ক্ষমা চাওয়ার সীমা ছাড়িয়ে গেছে তার করা অন্যায় গুলো। রিদিমা গটগট শব্দে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। চুমকি ও সবার মুখ চাওয়া চাওয়ি করে ছুটলো রিদিমার পিছু পিছু। তপন বাবু আর মনিকা তখনও দাঁড়িয়ে, ওভাবেই। মাথা নুইয়ে।

বসার ঘরের পরিবেশ তখন থমথমে। এক একজনের নিঃশ্বাস ফেলার আওয়াজ টাও যেন গোনা যাচ্ছে হাতে। ঠিক তখনই ছোট্ট সায়নের কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেল। বেচারা সদ্য ঘুম থেকে উঠে অন্ধকার ঘর দেখে ভয় পেয়ে গেছে। মিসেস চিত্রা তড়িঘড়ি সোফা থেকে উঠতে নিতেই দেখতে পেলেন রিদিমা দৌড়চ্ছে। সমর সহ প্রত্যেক কে অবাক করে দিয়ে আধ ভাঙা ঘুমে ক্রন্দন রত বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে আদর করতে করতে বেরিয়ে এলো বাইরে। ব্যস্ত গলায় চুমকি কে খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব দিয়ে সায়ন কে আদর করতে করতে আবারো চলে গেল ঘরে। মনিকা তপন বাবু সহ উপস্থিত সবার বুঝতে আর বাকি রইলো না রিদিমার সাথে কথা বলা আর সম্ভব না। তপন বাবু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তিনি জানেন, অভিমানী মেয়েটা তার এতো সহজে ক্ষমা করবে না। তিনি মুখ তুলে সমরের দিকে তাকালেন। ছেলেটাকে সেদিন অভদ্র মনে হলেও আজ তাকে দেখে মোটেও তেমন টা মনে হলো না। বরং একজন নিপাট ভদ্রলোক হওয়ার পাশাপাশি একজন প্রকৃত দায়িত্ববান স্বামী বলেই মনে হলো। তপন বাবু মনে মনে স্বগতোক্তি করলেন,
“ যাক, ঈশ্বর যা করেন তা মঙ্গলের জন্যই করেন।”

সমর পরিস্থিতি সামাল দিতে সবার দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলল,
“ আপনারা প্লীজ কেউ খারাপ ভাববেন না রিদিমা কে। আসলে ওর প্রতি আপনাদের অবিশ্বাস ওর মনে প্রবল আঘাত করেছে। ওকে একটু সময় দিন। ঠিক হয়ে যাবে।”

আরও আরেক দফা মুগ্ধ হলেন তপন বাবু সমরের অমায়িক ব্যবহারে। সত্যি এমন একটা ছেলে তো তিনি চেরাগ হাতে নিয়ে খুঁজলেও হয়তো পেতেন না কোথাও। তিনি ক্রাচে ভর দিয়ে সমরের কাছে এসে দাঁড়ালেন। সমরের এক হাত মুঠোয় ভরে বিনয়ী কণ্ঠে বললেন,
“ সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি তোমার কাছেও ক্ষমা চাইছি বাবা। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। সেদিন এতো বড় একটা বিপদের মাঝে যেখানে আমাদের সবার দাঁড়ানোর কথা ছিল মেয়েটার পাশে। সেখানে তুমি আর তোমার পরিবার দাঁড়িয়ে ছিলে। ভাবতেই নিজের প্রতি ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছে।”

বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
“ যাইহোক, আমরা কেউ কিচ্ছু মনে করিনি মেয়েটার ব্যবহারে। আসলে সত্যি বলতে আমরা ওর সাথে যা কিছু করেছি তার কাছে এই টুকু উপেক্ষা ভীষণই নগন্য। তোমার কাছে এই মুহূর্তে বাবা হিসেবে আমার শুধু এই টুকুই অনুরোধ। পারলে এভাবেই আমার মেয়েটার পাশে সারা জীবন ভরসা হয়ে থেকো যেমনটা আজ ছিলে। আসি, ভালো থেকো তোমরা।”

তপন বাবু হাঁটা দিলেন দরজার দিকে। পেছন পেছন নত মুখে বেরিয়ে এলো সকলে। তবে পরমার চোখ আটকে রইলো সমর আর তার বৈভবে মোড়ানো প্রাচুর্যতে। মানতেই হবে বোনটা তার ভাগ্যবতী। না হলে কি আর হঠাৎ করে এমন সম্পদশালী সুপুরুষ বর হুট করে জোটে!

সেদিনের রাত টা কাটলো খুব শীতল ভাবে। রিদিমা যেন মৌনতার প্রতীক হয়ে রয়ে গেল ঘরের এক কোণে। সমর নিজেও আর ঘাটালো তাকে। মাকে ও বারণ করে দিলো রিদিমা কে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা না করতে। কারণ সময় নিয়ে মেয়েটার আঘাত গুলো মেরামত করতে হবে। নয়তো সব কিছু ঠিক হবার বদলে আরও বিগড়ে যাবে।
_____

রিদিমার মন খারাপের কৃষ্ণ পয়োধর গুলো যেন হঠাৎ করেই কর্পূরের মতো উবে গেল সকাল সায়নের মামনি ডাক শুনে। সায়ন একদম রেডি। আজ তার স্কুলে অ্যাডমিশন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে নেচে বেড়াচ্ছে গোটা বাড়িতে। সমর রেডি হয়ে নিচে নামতেই আজও অবাক হলো আরেক দফায়। রিদিমা আর সায়ন দুজনে একসাথে রেডি হয়ে বসে আছে সোফায়। মিসেস চিত্রা বসে তাদের পাশে। সমর সকলের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ রেডি তোমরা?”
“ হ্যাঁ, ওরা রেডি।”
সমর শার্টের হাতা ভাঁজ করছিল। মায়ের কথার জবাবে বলল,
“ কেন তুমি যাবে না।”
“ আমি আর যেয়ে কি করবো শুধু শুধু। তোরা দুজনই যথেষ্ট দাদুভাই এর জন্য। তাছাড়া অ্যাডমিশন টেস্টে এতো মানুষ গিয়ে ভিড় বাড়িয়ে লাভ কি!”
“ ধুর এটা কোনো কথা। সায়নের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ মানুষ টা হলে তুমি। সেই তুমিই যদি আজকের দিনে ওর পাশে না থাকো তাহলে কি করে হয়?”
মিসেস চিত্রা ছেলের কথা শুনে প্রশস্ত হাসলেন। বললেন,
“ আমি থাকি বা না থাকি আমার আশীর্বাদ সব সময় আমার দাদুভাই এর সাথে থাকবে বুঝেছিস। তাছাড়া কাল থেকে আমার হাঁটু ব্যাথা টা জব্বর বেড়েছে। পা ফেলে হাঁটতেই পারছি না। তাই বলছি তোরা যা। আমাকে আর এর মধ্যে টানাটানি করিস না।”

সমর আর কথা বাড়ালো না। আসলেই বিগত কয়েক টা বছর ধরে বাতের ব্যথায় মিসেস চিত্রা যে পরিমাণ কষ্ট পায় তা ওর নিজের চোখে দেখা। সিজন চেঞ্জ হবার সময় এটা এতো বাড়াবাড়ি করে যে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। সমর আর কথা বাড়ালো না। রিদিমা আর সায়ন কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। লিফ্ট এ উঠে জিরো প্রেস করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। দেখলো ছেলেটা তার রিদিমার হাত ধরে বাবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ বহু দিন পর এক মিঠে অনুভূতি সমরের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। নিজেকে যেন পরিপূর্ণ মনে হলো এই ক্ষণে। বউ ছেলে নিয়ে ভরা সংসার তার। আর কি চাই এ জীবনে।

চলবে…

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
পর্ব:২৭

তপ্ত আঁচের গনগনে তাপে পোড়া মরচে ধরা সকাল। মেঘের আড়ালে তাতিয়ে ওঠা রোদের স্বল্প আলো ছড়িয়েছে চারদিকে। তাইতো সকাল সকাল ভ্যাপসা উষ্ণতায় জেরবার হয়ে সকলের যা তা অবস্থা।

মিষ্টি কমলাটে গোলাপী রঙের আরাম দায়ক সুতি হ্যান্ডলুম এর শাড়ি গায়ে জড়িয়ে পার্কিং এর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল রিদিমা। মাথার চুল গুলো খামচে ধরা একটা মাঝারি আকৃতির ক্যাচার ক্লিপের সাথে। সিঁথির অগ্রভাগে জ্বলজ্বলে রক্তিম সিঁদুর আর ঘন ভ্রূ দ্বয়ের মাঝে এক রত্তি লালিমা। টানা টানা কাজল বিহীন দুটোর বিবশ দৃষ্টি মেলে ধরা কিছুটা দুরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা সেই গম্ভীর মানবটার উপর। যে কিনা ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তির সাথে দরকারি আলাপে ব্যস্ত। সায়ন দাঁড়িয়ে আছে সমরের ডান হাতটা ধরে।
ঠিক তখনই পেছন থেকে একটা সুপরিচিত কণ্ঠের ডাক শুনে পেছন ঘুরে তাকালো রিদিমা। মিতালী “ আরে রিদিমা” বলে এগিয়ে আসছে তারই দিকে। হাতাবিহীন সরু বর্ডারের স্ট্রাপ দেওয়া সাদা ব্লাউজের সাথে ডিপ সবুজ রঙের পাতলা হাঁফ সিল্কের শাড়ী পড়েছে আজ সে। আঁচলটা এক হাতে নিবদ্ধ অপর হাতে ধরা অঙ্কনের ছোট্ট হাতটা। উন্মুক্ত পেলব ফর্সা কাঁধের উপর ছড়িয়ে পড়েছে মিতালীর সদ্য রিবন্ডিং করা চকচকে চুল গুলো। ঠোঁটে লেগে টুকটুকে লালের ছোঁয়া।

মিতালী হেঁটে এসে একদম রিদিমার পাশে এসে দাঁড়ালো। মুখে ঝুরঝুরে উন্মুক্ত হাসি এঁটে ভ্রূ নাচিয়ে শুধোলো,
“ কি ব্যপার? নিউলি কাপল মিলে কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?”

রিদিমা খানিক অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো মিতালীর এমন কথার টোনে। লাজের একপ্রস্ত শীতল শিহরণে কেঁপে উঠে মৃদু হেসে বলল,
“ আজ সায়নের অ্যাডমিশন। ওখানেই যাচ্ছি।”

মিতালী অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
“ ও মা তাই নাকি! তা কোন স্কুলে অ্যাডমিশন নিচ্ছে শুনি?”

রিদিমা মনে করার চেষ্টা করে বলল,
“ হলি চাইল্ড স্কুল!”( কাল্পনিক)
মিতালী স্বচ্ছ হেসে বলল,
“ আরে বাহ্, আমার অঙ্কন কেও তো ওখানেই ভর্তি করাচ্ছি।”
তারপর ঝরা হেসে বলল,
“ ভালই হলো বলো। দুজনে একসাথে বাচ্চাদের আনা নেওয়া করতে পারবো। যেতে আসতে বোর হতে হবে না আর। এনি ওয়ে, একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম!”

কথাটা মিতালী মুখ নামিয়ে চাপা সুরে রিদিমার কানে কানে অনেক টা ফিস ফিসিয়ে বলল। রিদিমা এতক্ষণ মিতালীর কথা গুলো খোস মেজাজে শুনলেও শেষের কথায় কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল। না চাইতেও একটা শীতল আতঙ্ক মেশানো অস্বস্তির রেশ ছুঁয়ে গেল মেয়েটার উচাটন মনের অলিতে গলিতে। মন টা কেন যেন ডেকে বলে উঠলো, এই মহিলা তোকে ভালো কিছু জিজ্ঞেস করবে না। তবুও রিদিমা জিজ্ঞেস করলো,
“ কি কথা?”
মিতালী ঠোঁটে দুষ্টু হেসে ওভাবেই বলল,
“ এই সত্যি করে বলো তো, তোমাদের মধ্যে ওসব হয়ে গেছে?”
অবাক রিদিমা বোকার মতো জিজ্ঞেস করলো,
“ কোন সব?”
মিতালী ওকে কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“ ইস্ ন্যাকামো করো না তো! এমন ভাব করছো যেন ইন্টিমেসির ব্যাপারটা জানোই না।”

বিদ্যুৎ পৃষ্ট হলে যেমন শক লাগে শরীরে ঠিক তেমনি করেই শক খেল রিদিমা মিতালীর এ হেন রুচিহীন প্রশ্নে। হুট করে বুকের ভেতর জুড়ে দুদ্দাড় গতিতে লাগামহীন হয়ে ছুটতে শুরু করলো অন্তঃকরণ। মিতালী তার কথার জের টেনে বলতেই থাকলো,
“ আসলে সেদিন ওই পরিস্থিতিতে যেভাবে তোমাদের বিয়েটা হলো আর কি! আমি তো ভেবেছিলাম সমর বাবু তোমায় মেনে নিতে একটু হলেও সময় নেবেন। কিন্তু কাল নদীর পাড়ে যখন তোমাদের হাত ধরে হাঁটতে দেখলাম, বিশ্বাস করো তখন থেকেই প্রশ্ন টা বড্ড জ্বালাচ্ছে আমাকে।”

রিদিমার মিতালীর কথা গুলো শুনে এতো রাগ হলো তা যেন ভাষায় প্রকাশ করার বাইরে। এসমস্ত মহিলা গুলোর কাজই হলো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। লোকের পার্সোনাল ব্যাপারে নাক গলিয়ে নিজের নোংরা মনের সুখ চরিতার্থ করা। জিহ্বার আগায় বাজে কিছু গালি চলে এলেও রিদিমা মোটেও তার বহিঃপ্রকাশ করলো না। বরং মিতালীর চকচকে লোভাতুর দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে ঢং করে লাজুক হাসলো। নিজেও ওর মতো ফিস ফিস করে চাপা কণ্ঠে বলে উঠলো,
“ কি যে বলোনা তুমি মিতালী দি, ছিঃ। এসব কথা কি মুখে বলা যায়।”
বাম চোখটা টিপে দিয়ে বলল,
“ ভাবে বুঝে নিতে হয়!”

তন্মধ্যে সমর তার কথার ইতি টেনে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে পার্কিং থেকে। রিদিমার সামনে গাড়ি থামিয়ে সামনের দরজা খুলে দিতেই আসছি বলে একগাল হেসে গাড়িতে উঠে বসলো রিদিমা। সায়ন এতক্ষণ অঙ্কনের সাথে ছুটোছুটি খেলছিল। ও দৌড়ে এসে উঠে বসলো রিদিমার কোলে। দরজা লক হতেই সাই সাই করে তীরের গতিতে চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল সাদা রঙের টয়োটা গাড়িটা। আর তাতেই সহসা গা পিত্তি জ্বলে উঠলো মিতালীর। কেন যেন রিদিমার মুখে লেগে থাকা ওই সোনালী রোদের ন্যায় চকচকে লাজুক হাসি টা ওর একটুও ভালো লাগেনি। কিন্তু কেন লাগেনি তা মিতালী জানে না।
___________

তখন সময় টা বিকেল। ছয় তলার সেই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সেদিনের মতো আজকেও বাইরের প্রকৃতি দেখছিল রিদিমা। তবে আজ তার চোখ মুখ ভীষন উজ্জ্বল। কোনো রকম বিষন্নতার প্রলেপ সেখানে মিশে নেই। রিদিমার চোখের ফিকে দৃষ্টি গেঁথে ছিল আকাশের বুকে ওই দূর নিরালায়। যেখানে কয়েকটা চিল উড়ছিল নিশ্চিন্তে, যাদের নিরেট চোখের ক্ষুরধার দৃষ্টি গেঁথে ছিল সেই সমস্ত স্থানে যেখানে অনায়াসে খাবারের টাটকা সন্ধান মেলে।

আজ স্কুলে গিয়ে দারুন লেগেছে রিদিমার। কিছু নতুন অভিজ্ঞতাও হয়েছে সকলের সাথে মিশে। নিজেকে কেন যেন আজ সত্যি সত্যিই সায়নের মা বলে মনে হচ্ছিল বারে বারে। স্কুলের অন্যান্য বাচ্চাদের মায়েরা যখন নিজেদের বাচ্চাদের নিয়ে গল্প করছিল বেশ ভালো লাগছিল শুনতে। ও যদিও সায়নের ব্যাপারে বিশেষ কিছু বলতে পারে নি। তবুও বেশ লাগছিল সব কিছু মিলিয়ে।

ও ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানার দিকে তাকালো। সায়নকে কোল বালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো তার কাছে। সায়নের আদুরে গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। হঠাৎ রিদিমার মনে পড়লো গত কালকের কথা। সমর বলেছিল উনি ডিভোর্সী। রিদিমার স্মৃতিতে ভেসে উঠলো কয়েকমাস আগের কথা। সমর নিজ মুখে বলেছিল সায়নের মা মারা গেছে। হুট করেই বুকের ভেতর টা কেমন যেন করে উঠলো রিদিমার। মনের আনাচে কানাচে অজস্র প্রশ্ন কিলবিল করে উঠলো জবাবের তাগিদে।
আচ্ছা, সায়নের মা যদি মারা তাহলে সমর কাকে ডিভোর্স দিলো? সায়নের মা আর সমরের আগের ওয়াইফ কি একই মানুষ না কি আলাদা কেউ? আচ্ছা, সায়ন সমরের নিজের সন্তান তো নাকি অন্য কারো? যদি নিজের সন্তান হয় তাহলে কি ও সমরের তৃতীয় নম্বর বউ?
এমন হাজারটা প্রশ্ন ভাবতে ভাবতে মাথা ধরে এলো রিদিমার। ইচ্ছে হলো এই রহস্যের সমাধান করতে। কি করবে ভাবতেই মনে পড়লো মিসেস চিত্রার কথা। কিন্তু সেখানেও বাঁধা। কিছুক্ষন আগেই সমর তাকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছে। কখন ফিরবে জানা নেই। রিদিমা কিছু একটা ভেবে পা বাড়ায় ড্রয়িং রুমের দিকে। যেখানে টিভিতে সিরিয়ালে মত্ত হয়েছে চুমকি। চুমকি কে দেখে মুখ টা চকচক করে ওঠে রিদিমার। এই বাড়ির অনেক পুরনো কাজের মানুষ সে। নিশ্চয়ই সমরের অতীত সম্পর্কে তার সব জানা। রিদিমা এগিয়ে এলো চুমকির কাছে। তারপাশে বসতেই সে বলল,
“ কিছু লাগবে বৌ মনি?”

রিদিমা হেসে মাথা নেড়ে বলল,
“ ভালো লাগছে না তাই ভাবলাম তোমার সাথে একটু গল্প করি।”

গল্প করার কথা শুনে চুমকি টিভি অফ করে দিলো। রিদিমা তা দেখে বলল,
“ চা খাবে চুমকি দি?”

চুমকি হেসে মাথা নাড়তেই রিদিমা বলল,
“ তুমি বসো আমি নিয়ে আসছি।”

চুমকি ইতঃস্তত করে বলল,
“ আরে না না বৌ মনি তুমি বসো আমি নিয়ে আসছি।”

বলেই চুমকি চলে গেল রান্না ঘরে। রিদিমাও এলো তার পিছু পিছু। চুমকি পাত্রে চায়ের জল বসিয়ে গ্যাস জ্বালাতেই রিদিমা চিনির কৌটো টা এগিয়ে দিলো।
“ আচ্ছা, চুমকি দি তুমি কতো বছর ধরে এখানে আছো?”

চুমকি আনমনে উত্তর দিলো,
“ তা প্রায় বছর তিনেক হবে।”

রিদিমা মনে মনে কিছু একটা হিসেব কষে বলল,
“ আচ্ছা, চুমকি দি তুমি সায়নের মা কে কখনও দেখেছো?”

রিদিমার হঠাৎ করা প্রশ্নে থমকে গেল চুমকি। কিছুক্ষন চুপ চাপ রিদিমার দিকে তাকিয়ে রইলো ফ্যাল ফ্যাল করে। রিদিমা তা দেখে বলল,
“ না মানে আসলে সেদিন সমর বাবু বলেছিলেন সায়নের মা মারা গেছে। তাই..!”

চুমকি ওকে থামিয়ে চাপা সুরে বলল,
“ না গো বৌ মনি সায়নের মা মারা যায় নি। উনি বেঁচে আছে। তবে শুনেছি সায়নের যখন মাত্র ছয় মাস বয়স তখন দাদাভাইয়ের সাথে ডিভোর্স হয়ে যায়।”
রিদিমা অবাক হয়ে বলল,
“ সেকি কেন?”
“ তাতো জানি না।”

রিদিমা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে চায়ের পাত্রে ফুটন্ত জলের দিকে। মনের মধ্যে তখন অন্য রকম প্রশ্নের ঝড়। কি এমন হয়েছিল যে এত সুন্দর স্বামী সন্তান সংসার থাকতে তাকে ডিভোর্স নিতে হলো? চুমকি ঠিক তখনই বলল,
“ শোনো বৌ মনি, এবাড়িতে সায়নের মা কে নিয়ে আলোচনা করা মানা। সমর দাদাভাই একদমই পছন্দ করে না এসব। তাই তোমাকে যে আমি এসব কথা বলেছি ভুলেও যেন বলো না কিন্তু।”

রিদিমা আস্তে করে মাথা দোলালো। কিন্তু তবে মাথার ভেতর জটলা পাকিয়ে থাকা প্রশ্ন গুলো যেন বার বার নাড়া দিয়ে বলল,
“ আচ্ছা একজন নারী কখন তার সাধের সংসার ছেড়ে চলে যায়?”
মনটা তখন খুবই সন্তর্পনে জবাব দিলো,
“ পুরুষের অবহেলায় আর অত্যাচারে।”

রিদিয়া হঠাৎ শিউরে উঠলো। মন জমিনের কাঁচা ভূঁইয়ে রোপণ হলো একঝাঁক ভীতি মেশানো সন্দেহের বীজ। তবুও কোথাও যেন ক্ষীণ আওয়াজ তুলে দিশেহারা হৃদয় টা বলে উঠলো,
“ না না এ সন্দেহ মিথ্যা। তুই মিথ্যের জালে ফেঁসে ভুল ভাল ভাবছিস তাকে নিয়ে। যে মানুষটাকে বিগত কয়েক দিন তোর পাশে ভরসার প্রাচীর হয়ে দাঁড়াতে দেখলি সেটাই তার আসল পরিচয়।”

রিদিমা আড়ালে বুকে হাত চেপে মনে মনে আওড়ায়,
“ হে ঈশ্বর, তাই যেন হয়।
নিজের অজান্তেই মানুষটার প্রতি এক অব্যক্ত প্রণয়ানুভূতি জন্ম নিয়েছে আমার হৃদয় জমিনের ক্ষুদ্র অংশ জুড়ে। সে গুলো যেন অকালে ঝরে না যায়। অপাঙক্তেয় হয়ে রয়ে না যায় এক অনাহুত সত্যের ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে।”

চলবে….

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
পর্ব: (বর্ধিতাংশ)

আধাঁরের মায়াজালে মোড়ানো এক ঘোলাটে চাদরের আড়ালে রাত্রি নেমেছে ধরায়। আজ মেঘের দেখা নেই। তাইতো একঝাঁক জোনাকির মতো আলো ছড়িয়ে চিকচিক করছে তারকা খচিত কৃষ্ণ মন্ডল। চতুর্দশীর চাঁদের লালচে আলোয় ভেসে যাচ্ছে ধরিত্রী। পূবালী বাতাসের ছোঁয়ায় স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে যেন।

ডাক্তারের চেম্বার শেষে দরকারি কিছু কেনাকাটা সেরে মা ছেলে মিলে ফিরছিল বাড়িতে। রাত এখন প্রায় নটার কাছাকাছি। মিসেস চিত্রা অনেকক্ষন ধরে উসখুস করছিলেন। কিছু বলতে চাইছিলেন ছেলেকে। কিন্তু সময় আর পরিস্থিতির অসামঞ্জস্যতার কারণে বলা আর হয়ে ওঠে নি তার। তাবে এই মুহূর্তে একটু ফুরসৎ পেয়ে সেই সুযোগ টা কাজে লাগলেন।

সমর তখন একমনে ড্রাইভ করছে। মিসেস চিত্রা ছেলের গম্ভীর মুখটা এক নজরে দেখে বলেই ফেললেন মনের অন্তরালে চেপে রাখা কথাটা,
“ তাহলে শেষ মেশ কি সিধান্ত নিলি?”

হাতের মুঠোয় স্টিয়ারিং সামলে মায়ের দিকে তাকালো সমর। ভ্রূ কুঁচকে জানতে চাইলো,
“ কোন বিষয়ে?”

মিসেস চিত্রা ভনিতা করলেন না। বরং সরাসরিই বললেন,
“ দেখ বাবু, তোরা দুজনেই যখন মন থেকে বিয়েটা মেনে নিয়েছিস তখন অযথা এই দূরত্ব ভীষণ দৃষ্টি কটু দেখায়। তুই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস আমি তোকে কি বলতে চাইছি।”

সমর মায়ের কথা শুনে চুপ করে রইলো। মিসেস চিত্রা ছেলের মৌনতা দেখে বিরক্ত হয়ে বললেন,
“ কি হলো, কিছু তো বল।”

সমর এবারেও চুপ রইলো। মিসেস চিত্রা এবার বেশ কঠিন স্বরে বললেন,
“ তোর আব ভাব দেখে মনে হচ্ছে প্রিয়া কে বোধ হয় আজও ভুলতে পারিস নি।”

সমর মায়ের কথা শুনে হঠাৎ ব্রেক কষলো পথের মাঝে। মিসেস চিত্রা ভয় পেয়ে সামনে তাকাতেই দেখলেন তারা একদম তাদের আবাসনের গেটে দাঁড়িয়ে আছেন। দারোয়ান গেট ঠেলে খুলছে আস্তে আস্তে। সমর মায়ের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
“ তোমাকে কতবার না বলেছি ওর নাম আমার সামনে উচ্চারণ করবে না। তবুও কেন সব কথার জের ধরে ওকেই টেনে আনতে হয় তোমার।”
“ তো কি করবো বল। বিয়েটা হয়েছে আজ সপ্তাহ হতে চলল অথচ মেয়েটা এখনও আমার ঘরে। যেখানে ওর তোর ঘরে থাকার কথা ছিল। মানছি বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে হয় নি কিন্তু তাই বলে তাকে এভাবে অপমান করবি তুই! একটা মেয়ের স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা শখ এভাবে নষ্ট করে দিবি। আচ্ছা তুই বল, আমরা বিয়ের পর ওকে নিয়ে কোন রিচুয়াল টা করেছি? যেখানে নতুন বউ বাড়িতে এলে কতো রকম অনুষ্ঠান করতে হয়। তাকে আত্মীয় দের সাথে পরিচয় করিয়ে সসম্মানে পরিবারের সদস্য করে নিতে হয়। আমরা কি দিয়েছি তাকে? সামান্য সম্মান টুকু পর্যন্ত তাকে দিয়েছি এ কয়দিনে বলতো তুই! ওর মনে কি এসব নিয়ে খারাপ ভাবনা আসবে না! নিজেকে কি এর পর উদ্বৃত্ত ভাবতে শুরু করবে না! বলতো তুই? তাছাড়া তোর অতীত সম্পর্কে মেয়েটা কিছুই জানে না। সেসব জানাতে হবে না তাকে?”

সমর মায়ের কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ মা আমি তোমার সব কথা বুঝেছি। কিন্তু তুমি বুঝতে পারছো না যে আমাদের উভয়েরই এই মুহূর্তে সময় প্রয়োজন। বিশেষ করে রিদিমার। আর কিছুদিন যাক। পরিস্থিতি আরেকটু স্বাভাবিক হোক তারপর ভেবে চিন্তে আস্তে ধীরে এগোবো।”
“ যা ভালো বুঝিস কর গে। আমি আর এ বিষয়ে কোনো কথা বলবো না।”

বলেই মিসেস চিত্রা গাড়ি থেকে নেমে হন হন করে হেঁটে চলে গেলেন লিফ্ট এর কাছে। সমর ওখানেই সিটে মাথা এলিয়ে দিলো চোখ বুজে। বুকের ভেতর অসহ্য দহন। মানসিক ক্লান্তিতে পাঁজর ভেঙে দীর্ঘশ্বাস গুলো বেরিয়ে আসছে নাসারন্ধ্র গলিয়ে।
আসলেই বিগত কয়েক দিনে যা কিছু ঘটে গেল তাতে সত্যিই এই ব্যাপার টা ওর মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিল। আসলেই রিদিমাকে ওর প্রাপ্য সম্মান টুকু বুঝিয়ে দিতে হবে। নয়তো পরবর্তিতে ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে।

কোলিং বেলের শব্দ টা কানে ভেসে আসতেই দরজা খুলতে গেল রিদিমা। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে ছুটে এলো সায়ন। ও দরজা খুলে সামনে ঠাম্মা কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠোঁট চেপে বলল,
“ পাপা কুতায় ঠাম্মা?”
“ নিচে আছে। এক্ষুনি আসবে।”

সায়ন ইতিউতি চেয়ে বলল,
“ আমার চলকেট কই?”
“ এই যে আমার কাছে!”

সমরের আওয়াজ শুনে বাবার কাছে ছুটে গেল সায়ন। সমর ছেলেকে কোলে তুলে চুমু খেয়ে বলল,
“ ঘুম থেকে কখন উঠেছো?”
“ অনেক্ষণ পরে।”
“ ওটা আগে হবে বাবা।”
“ হ্যাঁ তো আগে উতেচি। এবার এ আমার চলকেট দাউ।”

সমর হেসে বলল,
“ আগে পাপার গালে চুমু খাও।”

সায়ন টুকুস করে চুমু খেয়ে হাত পেতে বলল,
“ ইবার দাউ।”

সমর হেসে পকেট থেকে একটা ডেয়ারি মিল্ক বার করে সায়নের হাতে দিয়ে বলল,
“ এক্ষুনি পুরো টা খাবে না কিন্তু ঠিক আছে।”

সায়ন মাথা নেড়ে আচ্ছা বলে লাফিয়ে নেমে ছুটে এলো রিদিমার কাছে। চকলেট টা বাড়িয়ে ধরে বলল,
“ ও মামুনি এটা খুলে দাউ না।”

রিদিমা চকলেট টা নিয়ে পাশে সরে দাঁড়াতেই মিসেস চিত্রা ঘরে ঢুকে গেলেন। সমর হাতের শপিং ব্যাগ গুলো নিয়ে ঘরে ঢুকে গলা ছেড়ে ডাকলো,
“ চুমকি! ব্যাগ গুলো নিয়ে যা তো।”

চুমকি ছুটে এসে ব্যাগ গুলো নিয়ে চলে যেতেই সমর রিদিমার দিকে তাকালো। ওমনি সাথে সাথে চোখাচুখি হলো দুজনের। রিদিমা লজ্জায় জড়তায় আরক্ত হয়ে মাথা নুইয়ে নিতেই শুনতে পেল সমরের ক্লান্তি ভেজা নরম কন্ঠের আবদার..
“ কড়া করে এক কাপ কফি হবে প্লীজ ?”

রিদিমা চট করে মাথা তুলে তাকালো সমরের দিকে। সমর খুবই ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“ ভীষণ মাথা ধরেছে।”

রিদিমা আর দাঁড়ালো না সেখানে। মাথা নেড়ে দরজা লক করে ছুটলো রান্না ঘরে।
_____

“ আসতে পারি!”
সদ্য স্নান সেরে সোফায় গা এলিয়ে দিতেই মিষ্টি রিনরিনে কন্ঠটা কানে ভেসে এলো সমরের। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট টা অ্যাসট্রে তে নিভিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে। রিদিমা আস্তে ধীরে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করেই খুক খুক করে কেশে উঠলো।

সমর তাড়াতাড়ি করে উঠে গিয়ে ব্যালকনি এটাচড থাই গ্লাসের দরজাটা খুলে দিয়ে বলল,
“ এখানে এসো। এদিকে হাওয়া বেশি।”

রিদিমা মুখ তুলে গম্ভীর মানুষটা কে এক নজর দেখে হেঁটে গেল সেদিকে। কফির মগ টা সমরের দিকে বাড়িতে দিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেল রাতের শহরের দৃশ্য। সাত তলার উপর থেকে নিচের শহরটা ঝিকমিক করছে আলোয় আলোয়। চারিপাশে উঁচু উঁচু বিল্ডিং দিয়ে ঘেরা। মাঝখানে একটা বড় সুইমিং পুল। পুলের পাশ ঘেঁষে ছোটখাট সবুজায়ন। পুলের চারিদিকে বিশালাকার বাতি স্তম্ভের সমাহার। তারই চকচকে আলোয় হীরের মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে পুলের টলটলে জল। রিদিমা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। কি অপরূপ নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য। যেন স্বপ্নের ঘোরে কোনো এক অচিন পুরে চলে এসেছে ও।

সমর দরজায় দাঁড়িয়ে কফিটা খেতে খেতে রিদিমার দিকে তাকিয়ে ছিল। মেয়েটার চোখে মুখে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে ওঠা মুগ্ধতা গুলো যেন এই রাতের আঁধারেও চিকচিক করছে। সমরের মনে মনে কথা সাজিয়ে নিয়ে বলল,
“রিদিমা তোমার সাথে কিছু দরকারী কথা ছিল।”

রিদিমা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই সমর ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। একহাতে কফির মগ আরেক হাত পকেটে গুঁজে দৃষ্টি গাঁথলো ওই দূরের সুইমিং পুলের জলে।

“ আমাদের সম্পর্ক টা শুরু হওয়ার আগে কিছু বিষয় ক্লিয়ার করা যাক। যেহেতু আমি তোমার পাস্ট সম্পর্কে সব কিছু জানি তাই তোমারও অধিকার আছে আমার পাস্ট সর্ম্পকে সব কিছু জানার। আমার পাস্ট লাইফ সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করতে পারো রিদিমা। আমি চাই না সম্পর্ক শুরু হওয়ার পর ভবিষ্যতে এনিয়ে আমাদের মধ্যে কখনও অশান্তি হোক।”

রিদিমা ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে রিন রিনিয়ে বলল,
“ আসলে কোথা থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। আপনি শুরু থেকেই বলুন না হয়।”

সমর কফির কাপটা সেন্টার টেবিলে রেখে আবারো এসে দাঁড়ালো রিদিমার পাশে। প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকা একজোড়া উৎসুক চোখের দিকে এক নজর তাকিয়ে বলতে আরম্ভ করলো,
“ সুদূর জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতা এসে তখন সদ্য মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি আমি আর রঙ্গন। হোস্টেলে র ্যাগড হবার ভয়ে বাবা মা বাড়ি ভাড়া করে দিয়েছিল। তিনতলার উপরে একটা ছোট্ট দুই কামরার ফ্ল্যাটে থাকতাম আমরা। সেবাড়িতে ভাড়াটিয়া ছিল প্রিয়া আর তার মা। মারাত্মক সুন্দরী সেই সাথে ভীষণ রকম স্মার্ট। আমি প্রথম দেখাতেই কিভাবে যেন ওর প্রেমে পড়ে গেছিলাম। যাই হোক, প্রিয়া থার্ড ইয়ারে পড়তো। প্রায় সমবয়সী হাওয়ার দরুন আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে খুব বেশি দেরি লাগে নি।”

বলেই সমর আবারো চোখ ভাসালো সেই আলোয় ঘেরা সুইমিং পুলের জলে। রিদিমা তখনও নির্বাক শ্রোতা হয়ে তাকিয়ে। প্রহর গুনছে মানুষটার অতীতে কাটিয়ে আসা সেই ইতিহাস শোনার অপেক্ষায়। তবে কোথাও যেন একটা ক্ষীণ যন্ত্রণা মৃদু লয়ে সুর তুলে বেজে চলেছে বুকের গহীনে। মানুষটা কাউকে কখনও ভালোবেসেছিল ভাবতেই অন্তঃপুরে রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে অজানা ঈর্ষায়। সমর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো বলতে শুরু করলো,

“ মাত্র দুমাসের মধ্যেই আমরা বিশ্রী ভাবে একে অপরের প্রেমে পড়ে গেছিলাম। ক্লাস বাংক করে ঘুরতে যাওয়া, সিনেমা দেখতে যাওয়া, রাত জেগে ফোনালাপ, এরকম আরও অনেক কিছু। নতুন নতুন প্রেমে পড়লে যা হয় আর কি! যাইহোক, বাবা মায়ের ভীষণ ভদ্র ছেলেটা প্রেমের চক্করে পড়ে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই একেবারে বখে গেলাম। ফলত প্রথম বছরেই ফেল করে বসলাম ভীষণ বাজে নম্বর পেয়ে। বাবা তো রেজাল্ট দেখে রেগে বোম। ততদিনে আমাদের প্রেমের খবর সবার কানে কানে। এমনিতেই কলকাতায় রেখে পড়াশুনা করাতে তার ঘোর আপত্তি ছিল। তার উপর প্রেম করতে গিয়ে রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় আমাকে আর রাখতেই চাইল না সেখানে। পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে নিয়ে গেল বাড়িতে। তার একই কথা অনেক হয়েছে পড়াশুনা। যা শেখার দরকার ছিল অনেক শিখে গিয়েছ। এবার কাজকর্ম শেখো যাতে ভবিষ্যতে অর্থ উপার্জন করতে পারো।

তো বাবার ইচ্ছে মতো আমাকে কাজ শেখার জন্য জোর করে বসিয়ে দেওয়া হলো আমাদের পারিবারিক ব্যবসায়। সেই সাথে কড়া হুমকি মিললো যাতে প্রিয়ার সাথে সমস্ত রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ প্রিয়া ছিল ডিভোর্সী মায়ের সন্তান। বাবা নেই। ফ্যামিলি বলতেও কেউ নেই। বংশ পরিচয়হীন একটা মেয়ের সাথে আমার এই প্রেমের সম্পর্ক মেনে নিতে পারলো না বাবা আর আমার গোটা পরিবার।

কিন্তু এই বাঁধা আমাকে প্রিয়ার থেকে দূরে সরাবার পরিবর্তে আরও কাছে নিয়ে গেল। আমরা সবার চোখের আড়ালে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করে ফেললাম। ভেবেছিলাম একমাত্র ছেলে আমি। বিয়ে করে ফেললে নিশ্চয়ই বাবা আমাদের ফেলে দিতে পারবে না। কিন্তু আমার ধারণা কে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বাবা আমাকে ত্যাজ্য ঘোষণা করলো। তার পর শুরু হলো শূন্য হাতে আমাদের বিবাহিত জীবন।”

বলেই সমর চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। ওদিকে রিদিমার যে আর তর সইছে না। মন টা খুব করে আঁকুপাঁকু করছে পরবর্তী কাহিনী শোনার জন্য। রিদিমা খুব করে বলতে চাইলো, তারপর!! কিন্তু বলা হলো না। তার আগেই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। সমর রিদিমা উভয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই আবারো আওয়াজ হলো নতুন মাত্রা ছড়িয়ে।
“ আমি দেখছি”
বলে লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই চুমকির দেখা মিলল। ততক্ষণে রিদিমা ও ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে। সমর গম্ভীর মুখে চুমকির দিকে তাকাতেই বেচারী ভয় পেয়ে মিনমিনিয়ে বলল,
“ মা খেতে ডাকছে দাদাভাই। ওদিকে সোনাই ও খাবে বলে জ্বালাতন করছে।”

সমর মোবাইলে সময় দেখে নিয়ে বলল,
“ ঠিক আছে। তুই যা আমরা আসছি।”

সমর দরজা আটকে আলমারীর সামনে এসে দাঁড়ালো। নব ঘুরিয়ে কপাট খুলে একটা প্যাকেট বের করে এগিয়ে দিলো রিদিমার দিকে। রিদিমা প্যাকেট টা হাতে নিয়ে বলল,
“ কি এটা?”
“ মোবাইল ফোন।”

রিদিমা অবাক চোখে তাকালো সমরের দিকে। সমর বলল,
“ আম সরি, এটা আগেই দেওয়া উচিত ছিলো আমার। কিন্তু…! যাইহোক,
আমি সিম সেট করে আমার মায়ের চুমকির সবার নম্বর সেভ করে দিয়েছি। তোমার পরিচিত নম্বর গুলো লগ ইন করে সেট করে নিও।”

রিদিমা অবাক চোখে তাকিয়েই রইলো সমরের দিকে। মানুষটার অতীত জানার পর থেকে ক্ষীণ যন্ত্রণায় যেমন অবশ হয়ে আসছে বুকের একটা পাশ জুড়ে। ঠিক তেমনই মানুষটার যত্নআত্তি আরেক পাশে নতুন করে প্রেমে পড়ার সুর বাজাচ্ছে ঝংকার তুলে। সমর কপাট আটকে ঘুরে দাঁড়ালো।
“ চলো যাওয়া যাক।”
বলে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে প্রশ্ন করল,
“ তোমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি রিদিমা? পড়তে চাও নাকি..”
“ মাস্টার্স করার ইচ্ছে ছিল আমার।”
মন মরা হয়ে বিবশ কণ্ঠে জবাব দিলো রিদিমা। সমর থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ ইচ্ছে ছিল মানে! এখন নেই?”
রিদিমা চকিত চাহনি ছুঁড়ে বলল,
“ না না! মানে আছে।”
“ গুড। তোমার রেজাল্ট দিতে আর কতো দেরি?”
“ মে বি এমাসেই বেরোবে হয়তো। আর নাহলে নেক্সট মাসের ফার্স্ট উইক।”
“ ওকে। তোমার যেখানে পছন্দ ভর্তি হয়ে যাবে। পড়াশুনায় হেলাফেলা করবে না। আসলে আমি মাস্টার্স করতে পারি নি তো। তাই সেই আক্ষেপ আমার আজও বুকে বাজে।”
বলেই পা বাড়ালো সামনে।
রিদিমা থমকে দাঁড়িয়ে এক ধ্যানে সমরের চলে যাওয়া দেখলো। অন্তঃকরণ জুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো শেষের কথাটা,
“ সেই আক্ষেপ আমার আজও বুকে বাজে।”

চলবে….

কাল আবার নতুন পর্ব আসবে।