#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
পর্ব:২৮
সমরের খুড়তুতো দুই বোন অবনী আর লাবনী বড় পিসির ছেলে সোমেন আর তার বউ তিশা আচমকা পরদিন বিকেলে হাজির। দরজার ওপাশে প্রিয় জেম্মা কে দেখে অবনী লাবনী দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার বুকে। খুশির জোয়ারে ভেসে চিৎকার করে বলে উঠলো,
“ জেম্মা সারপ্রাইজ।”
এদিকে তাদের এই আচমকা আগমনে চিত্রা দেবী বিস্ময়ে অস্থির। চিন্তার ভিড়ে চুপসে গেলেন মনে মনে। সমরের হুট করে হওয়া বিয়ের খবরটা এখনও কাউকে জানানো হয় নি। আর না কারো ধারনায় ছিল এমন কিছু ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা গুলো। বিচ্ছেদের পর বরাবরই দ্বিতীয়বার নিজেকে সুযোগ দিতে নারাজ ছিল সমর। যার কারণে দূরত্ব তৈরি করে রেখেছিল এই সমস্ত বিষয় গুলো থেকে। তাই এই মুহূর্তে রিদিমাকে কিভাবে পরিচয় করাবেন সেই চিন্তায় ভার হয়ে এলো মন। তখনই লাবনী বলল,
“ ও জেম্মা। অমন চুপ করে আছো কেন?
আমরা এসেছি দেখে তুমি খুশি হও নি বুঝি!”
মনের মাঝে চলতে থাকা ইতঃস্তত ভাব খানা নকল হাসির আড়ালে লুকিয়ে মিসেস চিত্রা বললেন,
“ কে বলল আমি খুশি হই নি। খুব খুশি হয়েছি এতগুলো দিন পর আমার বাচ্চাগুলো কে দেখে। কিন্তু তোরা যে আসবি সেটা আমাকে আগে জানাবি না!”
“ আগে জানালে সেটা কি সারপ্রাইজ হতো বলো। এই যে তুমি চমকে গেলে। তোমার এই চমকে যাওয়া মুখটা দেখবো বলেই তো আগে থেকে কিছু না জানিয়েই চলে এসেছি আমরা।”
বলেই লাবনী টুকুশ করে একটা চুমু খেল মিসেস চিত্রার নরম গালে। মিসেস চিত্রা আদুরে হাতের মোলায়েম পরশ বুলিয়ে গাল টিপে বললেন,
“ বুঝেছি। এবার আপনারা ভেতরে আসুন মা জননীরা। আরে তিশা, তুমি দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন। এসো এসো ভেতরে এসো।”
“ কেমন আছেন বড় মামী!”
বলে তিশা স্মিত হেসে ভেতরে ঢুকে মিসেস চিত্রা কে প্রণাম করতেই তিনি তাকে আটকে দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ থাক মা, বেঁচে থাকো সুখে থাকো স্বামী সোহাগী হও। সেই বিয়ের সময় দেখেছিলাম তোমায়। তাও তো প্রায় বছর হতে চলল।”
“ হ্যাঁ তো, সেই জন্যই তো আমরা ছুটি পেতেই প্ল্যান করে চলে এলাম তোমাদের সারপ্রাইজ দেবো বলে। তা তোমার সেই রগচটা তারকাটা ছ্যাকা খাওয়া ছেলে টা কোথায়? ওর সাথে আমার সেই লেবেলের বোঝাপড়া আছে।”
বলতে বলতে সোমেন এগিয়ে এসে একহাতে জড়িয়ে ধরলো মিসেস চিত্রা কে। মিসেস চিত্রা তাকেও মমতাময় আদরে ভরিয়ে দিলেন। তারপর কান টেনে ধরে বললেন,
“ বদমাইশ, আমার শান্ত নিরীহ ছেলেটার পেছনে লাগা ছাড়া তোর আর কোনো কাজ নেই না?”
“ আহ্ বড় মামী লাগছে তো।”
মিসেস চিত্রা কান ছেড়ে দিতেই সোমেন ঠোঁট বাঁকিয়ে তেরছা হেসে বলল,
“ পাত্রী ঠিক করে এসেছি তোমার রসকষহীন বেয়াড়া ছেলের জন্য। অনেক হয়েছে সন্ন্যাস জীবন। ওকে এবার বিয়ে না দিয়ে কিছুতেই ছাড়ছি না বুঝেছো।”
“ ও জেম্মা উনি কে?”
লাবনীর প্রশ্নে মিসেস চিত্রা সহ সবাই পেছন ঘুরে তাকালো। দেখলো সিঁদুরে লাল রঙের সুতির শাড়ি পরে এলোকেশী এক লাস্যময়ী শ্যামাঙ্গিণী দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা দূরে। যার চেহারা দিয়ে ঠিকরে বেরোচ্ছে সৌন্দর্যের ধার। মুখশ্রী তে জ্বলজ্বল করছে সধবার রক্তিম চিহ্ন গুলো। সবাই যেন ঘোরের মাঝে আটকে গেল রিদিমাকে দেখে। ওকে দেখে মিসেস চিত্রা স্মিত হাসলেন। অতঃপর, সকলকে চমকে দিয়ে বলেই ফেললেন সেই অমোঘ সত্যিটা যেটা নিয়ে চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন এতক্ষণ ধরে। তিনি খুব সাবলীল ভঙ্গিতে বললেন,
“ ও রিদিমা। আমার সমরের বউ। আয় তোদের সবার সাথে ওর পরিচয় করিয়ে দিই।”
_________
বেলা গড়িয়ে গেছে।
সন্ধ্যার ঘুটঘুটে অন্ধকার একটু একটু করে গ্রাস করছিল রক্তিম আকাশের বুক। পাখিরা উড়ে চলেছে ডানা ঝাপটে। ত্রস্ত গতিতে। যেন নিকষ আঁধারে গোটা পৃথিবী তলিয়ে যেতে দেখে তাদের হৃদয়ে জেগে উঠেছে নীড়ে ফেরার অদম্য তাগিদ। সমরের গাড়িটা তখন জি টি রোড ধরে ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে। স্পিডো মিটারে গতি মাপার কাটা একশোর ঘর ছুঁয়েছে অনায়াসে। তার বর্তমান গন্তব্য দুর্গাপুর। পাশে বসে তার পিএ সুজয়। ছেলেটা অল্প বয়সী। তবে বেশ কর্মঠ। সুজয় ল্যাপটপে মেল চেক করতে করতে বলল,
“ স্যার, বাংলাদেশী বায়ার্স দের মধ্যে রাজশাহীর মাহামুদ গ্রুপ আমাদের কন্ডিশনের রিপ্লাই দিয়েছে।”
“ গুড! কি বলছে ওরা?”
“ ওদের বক্তব্য আমাদের সব কন্ডিশনে ওরা রাজি বাট পেমেন্ট ওরা মাল পৌঁছনোর পর করবে বলছে।”
“ ওকে, ওদের বলো সেভেন্টি পার্সেন্ট এডভ্যান্স পে না করা পর্যন্ত আমরা মাল পাঠাবো না। এটা রুল। সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।”
“ ওকে স্যার।”
এরই মধ্যে শব্দ করে ফোনটা বেজে উঠলো। সদ্য আসা ফোন কলটা দেখে সুজয় বলল,
“ স্যার বাসী বাবু ফোন করছেন।”
“ ওনাকে বলো আমরা ওন দ্যা ওয়ে আছি। ঘন্টা দুয়েক এর মধ্যে পৌঁছে যাবো।”
“ ওকে স্যার।”
আজ একটা গুরুত্বপুর্ন মিটিংয়ে যোগ দিতেই সমরের দুর্গাপুরে যাওয়া। গত দুই বছর আগে হোন্ডা মোটরস এর বিরাট কন্ট্রাক্ট সাইন করেছিল ওরা নয়জন পার্টনার মিলে। দুর্গাপুরে সেই মোটর গাড়িরই ইঞ্জিন সহ অন্যান্য দেহাংশ তৈরির বিশাল কারখানা রয়েছে যার মালিকানাস্বত্ব তাদের নয়জন পার্টনারের অধীনে। সেখান থেকেই মোটর বাইক গুলো তাদের নিজস্ব শোরুমে আসে। তারপর কোম্পানির হয়ে সেল হয় দেশে বিদেশে। অন্যান্য পার্টনারদের মতো সমরেরও শিলিগুড়ি কৃষনগর মধ্যমগ্রাম আর শিয়ালদহ এর মতো জনবহুল শহরে চারখানা বিশাল বিশাল শোরুম আছে। যেখানে হোন্ডা কোম্পানির মোটর সাইকেল স্কুটি সহ বাইসাইকেল এবং এদের খুচরো পার্টস সেল করা হয়। আজ তারই এক গুরুত্বপুর্ন মিটিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কয়েকজন দেশীয় বায়ার্স এর সাথে হোন্ডা কোম্পানির মার্কেটিং অফিসার ইনচার্জ ও থাকবেন সেই মিটিং এ। যেখানে প্রত্যেক টা পার্টনারের উপস্থিতি প্রয়োজনীয় সাথে বাধ্যতা মূলকও। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে একসময় সমরের গাড়ি পৌঁছলো কাঙ্ক্ষিত সেই বিলাসবহুল পাঁচতারা রিসোর্টে। গাড়ি পার্কিং এ রেখে রিসেপশন থেকে চাবি বুঝে নিয়ে সমর আর সুজয় উভয়েই চলে গেল নিজেদের রুমে। রাত দশটায় মিটিং। আপাতত একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক।
______
গোটা বসার ঘর জুড়ে তখন গা শিউরে ওঠা শুনশান নীরবতা। ভীষণ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে চার জোড়া পলকবিহীন চোখ। অবনী লাবনী সোমেন আর তিশা, প্রত্যেকে যেন নিথর নিষ্প্রাণ। হতভম্ব হয়ে বাক হারিয়ে বোবার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে প্রত্যেকে। মিসেস চিত্রা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“ সবই তো শুনলি তোরা। এবার বল, বিয়েটা যে নাটকীয়তার মধ্যে দিয়ে হলো, ঘটনাটা কিভাবে সবাই কে জনে জনে জানাতাম আমি? তাই তো এ কদিনে বিয়ের খবরটা কাউকে বলা হয়ে ওঠেনি।”
সোমেন এবার মুখ খুলল। ঠোঁটে চাপা হাসি হেসে বলল,
“ যাই বলো বড় মামী, যা হয়েছে একদমই ঠিক হয়েছে হারামী টার সাথে। ব্যাটা সন্ন্যাস নেবে ভেবেছিল। কিন্তু ভাগ্য ওকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঠিকই একটা বউ জুটিয়ে দিলো।”
লাবনী অবনীর মুখেও হাসি ফুটলো সহসা। অবনী একগাল হেসে বলল,
“ ইস্, কি যে ভালো লাগছে ঘটনাটা শুনে। কিন্তু জানো জেম্মা আমার না খুব আফসোস হচ্ছে। ধুর! আমি কেন থাকলাম না সেই সময়। তাহলে দাদাভাইয়ের বিয়েটা লাইভ দেখতে পেতাম।”
লাবনী বোনের মাথায় থাবা মেরে বলল,
“ অ্যাহ এলেন আমার লাইভ দর্শক। বলি তোর মাথায় কি গোবর পোরা নাকি! সেই মুহূর্তটা ভাবলেই তো গায়ে কাটা দিচ্ছে আমার। ইস্, না জানি বৌদিভাই কে সেসময় কতোটা নৃশংস ভাবে অপমান হতে হয়েছিল। তবে দাদাভাইয়ের সিদ্ধান্তে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। অ্যাট লিস্ট তার রংহীন শূন্য জীবনে কেউ তো এলো। এবার দেখো, দাদাভাই ঠিক আগের মতো হাসি খুশি হয়ে যাবে।”
তিশা উঠে দাঁড়ালো। মুখে স্বচ্ছ হেসে বলল,
“ তোমরা গল্প করো। ততক্ষণে আমি আমার ছোট জায়ের সাথে একটু পরিচিত হয়ে আসি। আফটার অল উই আর সিস্টার – ইন- ল।”
তিশা চিত্রা দেবীর ঘরে ঢুকতেই সোমেন বলল,
“ শোনো বড় মামী, তোমাকে একটা কথা বলি। একদিক দিয়ে ধরতে গেলে তোমরা কিন্তু ঠিকই করেছো বিয়ের ব্যাপার টা কাউকে আগেভাগে না জানিয়ে। সত্যি বলতে কে কোন ভাবে ব্যাপারটা নেবে সেটা বলা তো যায় না। তবে তাতে নতুন বৌমার সম্মান নষ্ট হতো ছাড়া বাড়তো না। তাই বলছি কি বিষয়টা নিয়ে একদম স্বাভাবিক থাকো। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলো দুই বাড়ির সম্মতিতে বিয়েটা হয়েছে। তোমরা প্রয়োজন মনে করোনি তাই কাউকে জানাওনি ব্যস। যেহেতু এটা সমরের দ্বিতীয় বিয়ে তাই আশা করি কেউ এনিয়ে অযথা প্রশ্ন করার সাহস দেখাবে না।”
মিসেস চিত্রা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। যাক তাহলে শেষ পর্যন্ত সব কিছু সামাল দিতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে।
_______
দশটা বাজতেই পাঁচতারা হোটেলের কাঙ্খিত সেই মিটিং হলে হাজির হলো সবাই। সব মিলিয়ে সেখানে জনা তিরিশেক লোকের উপস্থিতি। বাসী বাবু যিনি ফোন করেছিলেন তিনি হলেন মিটিং এর উপস্থাপক। বিশাল আয়োজন করেছেন গেট টুগেদারের জন্য। সমর আর সুজয় সেখানে পৌঁছতেই নাকে ভেসে এলো শিক কাবাব এর তীব্র সুঘ্রাণ। সেই সাথে সুন্দর পোশাকে হাতে ট্রে নিয়ে হাজির হলো দুজন অল্প বয়সী মেয়ে ওয়েটার। ট্রে তে জ্বলজ্বল করছে লাল পানীয়। লিপস্টিকে রাঙানো ঠোঁটে মিষ্টি হেসে এগিয়ে দিলো তা তাদের দিকে। সমর সেসবে পাত্তা না দিয়ে গটগট শব্দে এগিয়ে গেলো পার্টনারদের দিকে। ঠিক তখনই মাইকে ঘোষণা হলো এক বিশেষ বার্তা। পার্টির মুহূর্ত টাকে আরও উজ্জীবিত আরও প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য এককালীন সিরিয়াল জগতের স্বল্প পরিচিত মুখ কে আনা হয়েছে। যার রূপের ঝলকানিতে আট থেকে আশি সকল বয়সের পুরুষের বুকে কাপন তুলতে বাধ্য। পার্টির অ্যাংকর ঘোষনা করে লাইট অফ করে দিতেই বক্সে ব্যগ্রাউন্ড মিউজিক টা বেজে উঠলো।
…ভিগি ভিগি পলকে মেরি উদাস
তেরে লিয়ে
হা জাগি জাগি শোয়ী না মে সারি রাত
তেরে লিয়ে
আঁখিয়া বিছাই মাইনে তেরে লিয়ে
দুনিয়া ভুলাই মাইনে তেরে লিয়ে
ঝুমু দিবানা বনকে তেরে লিয়ে
ওয়াদা হায় মেরা মেই হু তেরে লিয়ে
হোনা কভি টু যুদা……”
ঝম ঝম করে লাইট গুলো জ্বলে উঠলো গোটা হল ঘর জুড়ে। সেই সাথে সবার চোখের কামুক দৃষ্টি গিয়ে আটকালো অর্ধ খোলা কামাতুর পোশাক জড়ানো নাচতে থাকা লাস্যময়ী সুন্দরীর আঁকাবাকা ফিগারের দিকে। সমর দুই হাত পকেটে গুঁজে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। পাশ থেকে বাসী বাবুকে একজন বললো,
“ এই মরা টা কে আনতে গেলেন কেন বাসী বাবু? বর্তমানে তো সৌমিততৃষা নামের মেয়েটা খুবই ফেমাস। টাকা বেশি লাগলেও অ্যাট লিস্ট ওকেই নিয়ে আসতে পারতেন।”
বাসী বাবু তরলে ঠোঁট ডুবিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বলল,
“ সৌমিতৃষা একঘন্টায় আড়াইলাখ চার্জ করে। তার সাথে আবার তার প্রটেকশন চার্জ আলাদা। সেখানে পঞ্চাশ হাজারে এটাকে পেয়ে গেলাম। সেই সাথে চাইলে এক্সট্রা সার্ভিস ও দেবে। তবে সেক্ষেত্রে আলাদা ভাবে মাল্লু গুনতে হবে এই আর কি!”
বলেই চোখ টিপলেন তিনি। এবার বাসী বাবুর সাথে সেই হাসিতে আরও কয়েকজনের হাসি যুক্ত হলো। সমর চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। দাঁতে দাঁত চেপে একদিকে যেমন মধুপ্রিয়ার নাচ দেখতে লাগলো অন্যদিকে সহ্য করতে লাগলো পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ গুলোর তাচ্ছিল্যের হাসি।
চলবে….
#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
২৯.
রাত তখন ১২:২৫।
চার তলার টেরিসে থাকা হল ঘরটিতে তখন মিউজিকের উচ্চ শব্দের জোয়ার নামলেও তার থেকে মাত্র হাত কয়েক দুরত্বে থাকা স্বচ্ছ কাঁচের দেওয়ালের ওপাশে অবস্থিত সুইমিং পুলের চারিপাশে মিশমিশে অন্ধকার আর নিরবিচ্ছিন্ন ছমছমে নীরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মাথার উপর ছাতার মতো কৃষ্ণবর্ণ উন্মুক্ত আকাশ। গোটা টেরিস জুড়ে টবে লাগানো ছোট ছোট ঝাউ গাছের ডালে ডালে মরিচ বাতি গুলো লাল নীল হলুদ বেগুনি আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলো আঁধারিতে ছেয়ে এক স্বপ্নালু ঘোর। যেন এই নিবিড় তমসার মাঝে এক টুকরো শীতল প্রশান্তির অবগাহন।
আকাশের বুকে আজ তারারা বিলীন। চাঁদের অস্তিত্ব চাপা পড়েছে পুরোট বজ্রেনাদের আড়ালে। ঝড়ের আগমন আসীন। বিদীর্ণ নিস্তব্ধতা ভেদ করে মাঝে মাঝে শীতল দমকা হাওয়ার তোড় আছড়ে পড়ছে সবদিকে। সেই হাওয়াতে গা ভাসিয়ে টলটলে জলে ভরা পুলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সমর। দুই আঙ্গুলের ফাঁকে সিগারেট টা জ্বলছে। মাঝে মাঝে তা থেকে ঘোলাটে ধোঁয়া টুকু শুষে নিচ্ছে মানুষটার তৃষ্ণার্ত অধর। সেই যে এগারোটার দিকে হল ঘরের আমোদ প্রমোদ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল সমর। সেই থেকে এই পর্যন্ত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে এখানে।
“ আরে মিস্টার দত্ত, ওদিকে এতো আনন্দ উল্লাস ছেড়ে একাকী এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছেন যে!”
পরিচিত কন্ঠের আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘোরালো মানুষটা। টলমলে পায়ে ঢুলতে ঢুলতে বাসী বাবু হেঁটে এসে দাঁড়ালো তার পাশে। হাতে লালচে তরল ভরা স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাস। হুইস্কির ভোটকা গন্ধ ভেসে আসছে তা থেকে। লোকটা গ্লাসে চুমুক দিয়ে নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে বলল,
“ বললেন না তো, এই নির্জন সুইমিং পুলের ধারে একা একা কি করছেন?”
“ এমনিই দাঁড়িয়ে আছি। আসলে ভালো লাগছে পরিবেশ টা। তাছাড়া ওসব নাচ গান কোলাহল আমার বরাবরই অপছন্দের।”
বাসী বাবু বিস্ময়কর চাহনি ছুঁড়ে তাকালো সমরের দিকে। বলল,
“ বলেন কি, নাচ গান ফূর্তি ড্রিংকস এসব তো সেই অনাদি কাল থেকে পুরুষ মানুষের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকা প্রধান চাহিদা। একঘেঁয়ে সংসার জীবন থেকে মুক্তি পাবার ছোট্ট অবলম্বন মাত্র। আর আপনি বলছেন এসব আপনার পছন্দ নয়! সত্যি! ভীষণ আশ্চর্য হলাম জেনে।”
বাসী বাবুর কথা শুনে চমৎকার হাসলো সমর। সে কথার জবাব না দিয়ে সিগারেট টেনে গেল একমনে। বাসী বাবু আবারো গ্লাসে চুমুক দিলো। নেশায় এঁটে আসা ভারী গলায় ডাকলো,
“ দত্ত বাবু!”
“ হুম্!”
“ কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?”
“ বলুন!”
বাসী বাবু গ্লাসের তলানিতে থাকা তরল টুকু এক চুমুকে সাবাড় করে বলল,
“ আপনি না বড্ড ব্যাক ডেটেট পার্সন।”
“ আচ্ছা তাই নাকি!”
“ সে আর বলতে! কেবল তিরিশের কোঠায় বয়স আপনার। তাতে করে সিঙ্গেল। বউয়ের ঝক্কি ঝামেলা নেই। কোথায় এই বয়সে মৌজ মস্তিতে মেতে থাকবেন তানা.. পানসে নিরামিষ হয়ে থাকেন সব সময়।”
সমর সিগারেটে সুখটান দিয়ে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“ রিয়েলি! গলা অব্দি মদ গিলে মেয়েছেলে নিয়ে ফূর্তি করি না বলে আমি পানসে, নিরামিষ! হাসালেন বটে বাসী বাবু। আর তাছাড়া আপনাকে কে বলল আমি সিঙ্গেল? জ্বলজ্যান্ত আস্ত একটা বউ আছে আমার ঘরে বুঝেছেন।”
সমরের বিয়ের খবর শুনে নেশা কেটে গেল বাসী বাবুর। বিস্ময়ে আঁতকে উঠে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বলল,
“ সেকি, আপনি বিয়ে করলেন কবে?”
সমর মুচকি হেসে বলল,
“ এক সপ্তাহ হলো।”
“ কংগ্রাচুলেশন দত্ত বাবু।”
বলেই সমর কে দুহাতে জাপটে জড়িয়ে ধরলো বাসী বাবু। সেকেন্ড কয়েক পর ছেড়ে দিয়ে হেসে বলল,
“ আমি খুব খুশি হয়েছি আপনার বিয়ের খরব শুনে। তা পার্টি কবে দিচ্ছেন?”
“ দেবো খুব শীঘ্রি। এনি ওয়ে, রাত তো অনেক হলো। এবার কি যাওয়ার অনুমতি পেতে পারি। বড্ড ক্লান্তি লাগছে। মাথাটাও ধরেছে বেশ।”
বাসী বাবু মাথা নেড়ে বলল,
“ না না মশাই, এতো তাড়াতাড়ি তো ছাড়ছি না আপনাকে। খাওয়ানোর ভয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করেছেন তার বিনিময়ে সামান্য ড্রিংকস তো করতেই হবে আমার সাথে। চলুন চলুন।”
বাসী বাবু শুনলো না। জোর করে সমরের হাত পেঁচিয়ে ধরে টলমল পায়ে পৌঁছলো সেই হল ঘরে। তখন সবে মাত্র নাচের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। মধুপ্রিয়া নাচ শেষে ঘেমে নেয়ে একাকার। নিরাবরণ মেদহীন উদর গড়িয়ে ঘাম নামছে দরদর করে। ফর্সা ধবধবে মসৃন পিঠ গলাও চিকচিক করছিল ঘামে। নাভির গর্তে গাঁথা পিয়ার্সিং রিং টা নড়ে নড়ে উঠছিল ঘন নিঃশ্বাসের তালে তালে। দেখতে ভীষণ কামুকি লাগছিল তাকে। ঘর ভরা পুরুষ গুলো যেন তাদের চোখের ক্ষুধার্ত দৃষ্টি দিয়েই গিলে খাচ্ছিল তার অর্ধনগ্ন শরীর টা কে। মধুপ্রিয়া মাথা নুইয়ে সবাই কে ধন্যবাদ জানিয়ে স্টেজ থেকে নেমে এলো। একজন ওয়েটার তার দিকে জুসের গ্লাস এগিয়ে দিতেই সেটা নিয়ে গলা ভেজাল সে। অতঃপর একটু দম ছাড়তেই একজন পুরুষ পেছন থেকে ওর লতানো কোমর জরিয়ে ধরলো আচমকা। সাথে সাথে মেয়েটা ভয়ে আঁতকে উঠল। ব্যালেন্স হারিয়ে হাত ফসকে ফ্লোরে ছিটকে পড়লো জুসের গ্লাস টা। সহসাই কাঁচ ভাঙার তীক্ষ্ণ শব্দে সকলের দৃষ্টি ঘুরে গেল সেদিকে। পরক্ষনেই সকলের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল সামনের দৃশ্য দেখে। হোন্ডা কোম্পানির সেই মার্কেটিং অফিসার ইনচার্জ, অবাঙালি মালটা সোমরস গিলে মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। তাই তো চোখের সামনে এমন লাস্যময়ী সুন্দরী দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারে নি বেচারা। দুহাতের শক্ত আলিঙ্গনে মধুপ্রিয়া আটকে মুখ চেপে ধরেছে গলায়। মধুপ্রিয়া এমন অনাহূত স্পর্শে লাফিয়ে উঠে নিজেকে ছাড়িয়ে চিৎকার করে উঠলো,
“ হোয়াট দ্যা হেল! কোন সাহসে আপনি আমার গায়ে হাত দিচ্ছেন?”
লোকটা দমলো না বরং আবারো ওর কোমর চেপে ধরে অশ্লীল ইঙ্গিত ছুঁড়ে বলল,
“ আয় হায়, মেরি জান। একবার মেরে পাস তো আজা। জরা ডিল কা পিয়াস বুঝালু।”
বলে আবারো গলার ভাঁজে মুখ গুজে দিতেই ভয়ে অস্বস্থিতে ছটফটিয়ে উঠলো মধুপ্রিয়া। এবারও গায়ের জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো লোকটাকে। তারপর কাল বিলম্ব না করে ঠাস্ করে চড় কষিয়ে দিলো গালে। তাতেই যেন হুশ হারালো লোকটা।
“ ইউ ব্লাডি হোর।
শালী স্লাট কহিকি। মেরেকো মারা। আজ তোর দেমাগ একদম ভেঙে দিবে হামি। রুক শালী।”
বলে অকথ্য ভাষায় গালা গালি দিতে দিতে মধুপ্রিয়ার দিকে হাত বাড়াতেই একটা শক্ত হাতের বাঁধায় বিরত হয় সে আক্রমণ। লোকটা ক্ষ্যাপা চোখে সামনের লোকটার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে আওড়ায়,
“ মিস্টার দত্ত।”
সমর মধুপ্রিয়া কে আড়াল করে লোকটার দিকে ছুঁড়ে দেয় নমনীয় বানীর ঝংকার,
“ রিল্যাক্স মিস্টার আহুজা। জাস্ট রিল্যাক্স!” এসব মারামারি আপনার মতো মানুষের শোভা পায় না।”
লোকটা বোধ হয় দমে গেল সে কথায়। রক্তিম চোখে মধুপ্রিয়ার দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলে ওঠে,
“ রিল্যাক্স! হাউ কুড আই? ইউ নো দিস বিচ স্ল্যাপট মি ইনফ্রন্ট অফ এভরিওয়ান।”
সমর ঘাড় ঘুরিয়ে এক নজর মধুপ্রিয়া কে দেখলো। তারপর হেসে বলল,
“ মিস্টার অহুজা। ডোন্ট মাইন্ড, আপনি একটা মেয়েকে তার পারমিশন ছাড়া টাচ করলে সে তো এমন রিয়াকশন দেবেই তাই না। সো, ফরগেট ইট।”
লোকটা সমরের কথা শুনে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই বাঁধ সাধলো বাসী বাবু।
“ আরে স্যার, বাদ দিন তো এসব। আমি আপনার জন্য এর থেকেও ভালো সারপ্রাইজ প্ল্যান করে রেখেছি। চলুন গিয়ে দেখবেন।”
বলেই একপ্রকার জোর করে ঠেলে ঠুলে লোকটাকে নিয়ে গেল সেখান থেকে। সমর আর দাঁড়ালো না। সুজয় কে চোখের ইশারায় আসতে বলে গট গট করে পা ফেলে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।
___
রাতের খাবার খাওয়া শেষে এখন ঘুমানোর পালা। প্রতিবার যখন অবনি আর লাবনী আসে তখন হয় মিসেস চিত্রার সাথে ঘুমোয় কিম্বা দোতলার গেস্ট রুমে। তবে আজ চিত্র ভিন্ন। দোতলার গেস্ট রুম ইতিমধ্যে সোমেনের দখলে। মিসেস চিত্রার ঘরে সায়ন আর তিনি। চুমকি নিজের ঘরে। ফাঁকা আছে কেবল সমরের মাস্টার বেডরুম টা। মিসেস চিত্রা দোনোমনায় ভুগে রিদিমা সমেত অবনী আর লাবনী কে সেই ঘরেই শুতে বললেন। রিদিমা একরাশ জড়তা মিশিয়ে সেই ঘরে পা রাখতেই গোটা শরীর জমে গেল তার এক লহমায়। ঘরটার ভেতরটা ম ম করছে সমরের গায়ের পুরুষালি ঘ্রাণে। ভরাট কন্ঠে বলা কথাগুলোর মৃদু অনুরণন টাও যেন ভেসে আসছে কানে। রিদিমা আস্তে ধীরে বিছানায় উঠে বসলো। লাবনী আর অবনী ওর দু পাশে দু বোন শুয়ে পড়লো। অবনী রুমটার চারিদিকে নজর বুলিয়ে হঠাৎ করে বলল,
“ আচ্ছা বৌদিভাই কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি?”
রিদিমা আস্তে করে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। অবনী একহাতে মাথায় ভর দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে বলল,
“ আমার দাদাভাই কে তোমার কেমন লাগে?”
লাবনী বোনের কথায় ধমকে উঠলো।
“ এই বেয়াদপ মেয়ে, এটা কেমন ধরনের প্রশ্ন।”
“ তুই থাম তো। আমি এমন কোনো বাজে প্রশ্ন করিনি। জাস্ট বৌদি ভাইয়ের মনের কথা জানতে চাচ্ছি। বলোনা বৌদি ভাই, একজন মানুষ হিসেবে আমার দাদাভাইকে তোমার কেমন লাগে?”
রিদিমা হাসলো। দুহাতে হাঁটু জড়িয়ে বলল,
“ সত্যি বলবো নাকি মিথ্যে?”
“ মিথ্যে কেন শুনবো। সত্যি টাই বলো।”
রিদিমা হাঁটুতে থুতনি রেখে সরল গলায় বলল,
“ আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ টা মোটেও প্রীতিকর ছিল না। একটা বাজে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাদের পরিচয় হয়। তখন আমি ওনাকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম মানুষ ভাবতাম। বদরাগী কটুভাষী আর ম্যানারলেস। যে কিনা মেয়েদের সম্মান দিতে জানে না। তারপর ঘটনা চক্রে আমাদের পর পর সাক্ষাৎ হতেই থাকে। আস্তে ধীরে পরিস্থিতির সাথে বদলাতে থাকে আমার দৃষ্টিভঙ্গি। তবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যদি উনার কথা ভাবি, তাহলে বলবো পৃথিবীর অন্যতম সেরা মানুষটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যার সাথে কারও তুলনা করা চলে না।”
লাবনী মুগ্ধ হয়ে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো রিদিমার দিকে। ঠিক তখনই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো তিশা। মুখ লটকে বলল,
“ দিস ইজ নট ফেয়ার হ্যাঁ। আমাকে একা ফেলে তিনজনে মনের সুখে গল্প করছো। আমি কিন্তু খুব রেগে যাবো বলে দিলাম।”
অবনী সামান্য সরে তিশাকে জায়গা করে দিয়ে বলল,
“ আরে রিল্যাক্স বৌ মনি আমরা এখনও গল্প শুরুই করিনি। ও তো শুধু বৌদি ভাই দাদাভাই কে নিয়ে কি ভাবে তাই বলছিল আমাদের।”
তিশা রিদিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ এই রিদিমা শুনলাম নাকি তোমাদের এখনও ফুলশয্যা হয়নি?”
রিদিমা এই প্রশ্নে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। তিশা তা দেখে বলল,
“ এই মেয়ে শহরে থেকেও তোমার এতো লজ্জা কেন গো। আজকাল গ্রামের বাচ্চা বাচ্চা মেয়ে গুলোও এর থেকে ভয়ংকর কথায় লজ্জা পায় না।”
লাবনী মুচকি হেসে রিদিমার লাজে রাঙা গালটা টিপে দিয়ে বলল,
“ ওরে আমার লজ্জাবতী বৌদি ভাই রে, চিন্তা করো না কেমন। আমরা এসে গেছি না। যাওয়ার আগে তোমাদের ফুলশয্যা কমপ্লিট করিয়ে তারপরই বাড়ি ফিরবো।”
রিদিমা আর বসে থাকতে পারলো না। লজ্জায় অস্বস্তিতে জুবুথুবু হয়ে দ্রুত নেমে দাঁড়ালো বিছানা থেকে। বুক কাঁপছে তার বেসামাল হয়ে। রিদিমা শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুজলো। অতঃপর আসছি বলেই এক ছুটে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ওদিকে রিদিমার যাওয়া দেখে তিশা আর অবনী খুব হাসলো। লাবনী ও হাসলো সামান্য। মাথার তলায় পিলো টা টেনে নিয়ে মনে মনে বলল,
“ যাক তাহলে, শেষ পর্যন্ত দাদাভাইয়ের জীবনে সেই মানুষটা এলো যার কাছে দাদাভাই পৃথিবীর সবচেয়ে দামী মানুষ।”
______
সমর সবে মাত্র নিজের রুমে এসে গা এলিয়ে দিলো ডিভানে। ক্লান্তি লাগছে খুব। অথচ মনের মাঝে উগরে আসছে ক্ষয়ে যাওয়া অনুভূতির তিক্ত স্বাদ। যাতে মিশে আছে একরাশ ক্ষোভ আর অপরিসীম ঘৃণা। সমর পকেট হাতড়ে মোবাইল টা বার করলো। পাসওয়ার্ড টাইপ করে লক খুলতেই ভেসে উঠলো এক অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেরকের পাঠানো ক্ষুদে বার্তা,
“ আপনি কি পৌঁছে গেছেন?
গেলে জানাবেন প্লীজ।”
মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা শব্দ। অথচ সমরের মনের সব ক্লান্তি ভাসিয়ে নিয়ে গেল ভালোলাগার ঢেউয়ে। কিছুক্ষন আগের বিশ্রী ঘটনা গুলো মুহূর্তে ভুলে সমরের হৃদ গহীনে ভেসে উঠলো এক লাজুক নারী অবয়ব। যার চোখের পাতায় শরমের শিশীর কনা লেপ্টে থাকে অহর্নিশ। যার অদম্য আত্ম সম্মান বোধ তার পাহাড় সমান আত্ম অহমিকাকে কে নাড়িয়ে দিয়েছিল এক লহমায়। দীর্ঘ দিন ধরে নারীদের প্রতি তৈরী হওয়া ঘৃণার প্রাচীরে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছিল। সেই মেয়েটা আজ তার অর্ধাঙ্গিনী। সমর মুচকি হাসলো। বার্তার জবাবে ক্ষুদ্র বার্তা সেও পাঠালো,
“ চিন্তা করো না শ্যামলতা, আমি ভালো ভাবে পৌঁছে গেছি। যতোটা সম্ভব কাল দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসার চেষ্টা করবো।”
বার্তা টা পাঠিয়ে সমর আবারো ঘাড় এলিয়ে দিলো ডিভানের উপরে। ঠিক তখনই ডোর বেল বেজে উঠলো। সমর চোখ তুলে তাকালো। ভাবলো বোধ হয় সুজয় এসেছে। একটা ক্লান্তি মাখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। তবে নব মুচড়ে দরজা খুলতেই চমকে উঠলো সমর। ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো সামনের মানুষটার দিকে। ওদিকে চোখে মুখে এক চিলতে ক্ষীণ আশার আলো ছড়িয়ে জোয়ারের ঢেউয়ের মতো সমরের বুকে আছড়ে পড়লো প্রিয়া। কান্না ভেজা কণ্ঠে একরাশ আবেগ মিশিয়ে বলে উঠলো,
“ আমি জানতাম, তোমার হৃদয়ে আজও শুধু আমার নাম লেখা। তুমি আজও আমাকে সেই আগের মতোই ভালোবাসো। তাই আমি আজ থেকে নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করেছি ওই নাম আমি কিছুতেই মুছতে দেবো না তোমার হৃদয় থেকে।”
চলবে….
#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
পর্ব: ৩০
কিছুক্ষন আগের ঘটনা,
সমর কে এই শেঠদের পার্টি তে দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেছিল মধুপ্রিয়া। কারণ তার জানামতে এখানে যারা যারা এসেছে তারা প্রত্যেকেই বলতে গেলে এক একটা টাকার কুমির। ডানে বায়ে যেদিকে যায় সেদিকেই তারা দুহাতে টাকা ছড়ায়। তাই তাদের মাঝে নিম্ন মধ্যবিত্তের গন্ডিতে কোনোমতে শ্বাস ফেলে জীবন কাটানো মানুষটা যেন অপ্রত্যাশিত কেউ একজনই ছিল প্রিয়ার কাছে। ডিভোর্স হওয়ার পর বিগত চার বছর তারা একেবারেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল পরস্পর পরস্পরের থেকে। বলতে গেলে সেই চায়নি পুরনোকে নিজের সোনালী বর্তমানের ধারেপাশে রাখতে। কিন্তু হঠাৎ করে যেন সেদিন সব কিছু বদলে গেল।
কিছু দিন আগে এক চলচ্চিত্র প্রযোজকের পার্টিতে দেখা হয়েছিল মানুষটার সঙ্গে তার। চমকে উঠেছিল মানুষটার দামী বেশভূষা চলন বলন আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব দেখে। সেদিন লোক মারফত জানতে পেরেছিল মানুষটার বর্তমান অবস্থা তথা অর্থনৈতিক সচ্ছলতার কথা। জেনেছিল ব্যবসার উন্নতির কথাও। সেই সাথে দেখতে পেয়েছিল বিশাল এক দামী গাড়ি নিয়ে মানুষটা বেরিয়ে যাচ্ছে পার্টি শেষ করে। তখনও বুঝে উঠতে পারে নি মানুষটা মাত্র কয়েক বছরে এতো টাকার মালিক হয়ে গেছে। যা সে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না কোনো দিন।
সমর বেরিয়ে যেতেই আশেপাশের লোকগুলো থেকে সমরের ব্যাপারে খোঁজ নিলো প্রিয়া। তারপর সব কিছু জানতেই মাথায় যেন আস্ত একটা আকাশ ভেঙে পড়ার জোগাড় হলো তার। অত্যাশচর্যের চমকে বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো এক কোনায় চুপটি করে। যে মানুষটা কে সে ত্যাগ করেছিল শুধুমাত্র অর্থের কারণে। আজ তার এতো উন্নতি! এতো প্রাচুর্য! এতো ক্ষমতা!
প্রিয়া যেন খেই হারিয়ে ফেলেছিল ক্ষণে ক্ষণে। আক্ষেপের চোরাবালিতে একটু একটু করে ধ্বসে যাচ্ছিল শুধু। মনে মনে নিজেকেই যেন প্রশ্ন বিদ্ধ করে নিজের কাজের ফিরিস্তি গাইছিল সে…
“ মানুষটাকে সেদিন ছেড়ে দিয়ে যে বড্ড ভুল হয়ে গেছে রে তোর প্রিয়া। নেম ফেম জীবনে সব কিছু এনে দিলেও সে সেই মুহূর্তের একাকীত্ব দূর করতে পারে না যে মুহূর্ত টায় মানুষের মন আপন কাউকে খোঁজে। আর না পারে দিন শেষে সেই একমুঠো স্বার্থহীন ভালোবাসা এনে দিতে যখন একাকিত্বে বিষিয়ে থাকা মনটা যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে ওঠে। তাই এবার সেই হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার মানুষটাকে যে ফিরে পেতেই হবে তোকে। তা সে যেভাবেই হোক না কেন।”
প্রিয়া নিজেকে ধাতস্থ করে বেশ অনেক্ষণ ধরে। অতঃপর ছুটে চলে যায় সমরের জন্য বরাদ্দকৃত লাক্সারিয়াস প্রাইভেট রুমে।
(বর্তমান)
প্রিয়ার ওভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণে টাল সামলাতে পারল না সমর। ফলত পিছিয়ে গেল কয়েকপা। সেই সাথে দরজার নব টাও আলগা হলো হাতের মুঠো থেকে। অটোলক দরজাটা বাঁধাহীন হতেই ঠাস্ করে আটকে গেল শব্দ করে। সমর নিজেকে সামলে ওঠার আগেই শুনতে পায় মধুপ্রিয়ার আবেগ মাথা করুণ কণ্ঠস্বর….
“ আমি জানতাম,
তোমার হৃদয়ে আজও শুধু আমার নাম লেখা। তুমি আজও আমাকে সেই আগের মতোই ভালোবাসো। তাই আমি আজ থেকে নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করেছি ওই নাম আমি কিছুতেই মুছতে দেবো না তোমার হৃদয় থেকে।”
সমর এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রেগেমেগে ধমকে উঠলো,
“ হোয়াট দ্যা হেল ইস দিস! হু আর ইউ?”
মধুপ্রিয়া যেন বিস্ময়ে আকাশ থেকে পড়লো। তথাকথিত কথার আঘাত সয়ে স্তম্ভিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“ হু আর ইউ মানে! তুমি কি আমাকে চিনতে পারছো না সমর। আমি! আমি তোমার মধু তোমার প্রেম তোমার ভালোবাসা, তোমার…”
“ ভালোবাসা!! দ্যা বেস্ট জোক অফ দ্যা ইয়ার!”
বলেই ফিক করে হেসে ফেলল সমর। অতঃপর জঘন্য চাহনি ছুঁড়ে বলল,
“ আপনার মতো একজন ব্র্যান্ডেড স্লাট কখনই আমার কেউ ছিল না ম্যাডাম। না অতীতে আর না বর্তমানে। ”
সমরের মুখে আজ প্রথমবার নিজের সম্বন্ধে এতবড় একটা বাজে কথা শুনে চমকে উঠলো মধুপ্রিয়া। মনে হলো যেন আচমকাই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়েছে মস্তিষ্কে। সাথে সাথে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে উচ্চ শব্দে স্বর তুলে চেঁচিয়ে উঠলো সে,
“ সমর!! তুমি আমাকে এভাবে বলতে পারলে?”
সমর ঠোঁট বাঁকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হেসে ফেলল,
“ কেন? আমি কি ভুল কিছু বললাম মিস্ মধুপ্রিয়া দে?”
মধুপ্রিয়া থমকে দাঁড়িয়ে রইলো সমরের গা জ্বালানো তাচ্ছিল্যের ওই শুষ্ক হাসি দেখে। চোখের কোণ ঘেঁষে গড়িয়ে নামলো ফোঁটায় ফোঁটায় তপ্ত বিন্দু। সমর তা দেখেও পাত্তা দিলো না মোটেও।
“ তাছাড়া এতো রাতে এভাবে হাফ নে কেট সেজে নিশ্চয়ই কোনো ভদ্র বাড়ির মহিলারা পুরুষের মনোরঞ্জন করতে ঘুরে বেড়ায় না।”
“ তুমি জানো এটা আমার পেশা।”
“ হ্যাঁ তো, আমি তো সেটাই তো বললাম। এটাই আপনার পেশা।”
বলেই আপাদমস্তক নজর বুলালো ঘৃণায়। সেই নজরের আঁচে যেন ঝলসে গেল মধুপ্রিয়ার অন্তর। সাথে সাথে প্রতিবাদী কণ্ঠে ফুঁসে উঠলো মেয়েটা,
“ স্টপ ইট সমর। জাস্ট স্টপ ইট।”
“ করবো, তার আগে বের হোন এখান থেকে।
বলেই আঙুল তুলে ইশারায় দরজা দেখালো সে।
“ আপনার কারণে আমার সম্মানে যদি বিন্দু মাত্রও দাগ লাগে তাহলে কিন্তু আমি মোটেও বরদাস্ত করবো না।”
সাথে সাথে দুহাতে মুখ চেপে হুহু করে কেঁদে উঠলো প্রিয়া। হাত দুটো জড়ো করে ভিক্ষে চাওয়ার মতো করে বলল,
“ শুধু মাত্র একটা বার, জাস্ট একটা বার নিজের ভুলগুলো শুধরে নেয়ার সুযোগ কি আমায় দেবে না সমর। আমি মানছি আমি ভুল করেছি। না না ভুল নয় অপরাধ করেছি আমি। তবুও, তবুও জাস্ট একটা বার সুযোগ দাও। আমি কথা দিচ্ছি, এবার যদি কোনো ভুল করি তখন না হয়..!”
সমর এরই মধ্যে পূনরায় নিজেকে ঢেকে নিলো সেই চিরাচরিত কঠিন আবরণের মোড়কে। হাত দুটো দুপকেটে ঢুকিয়ে ঠাড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাট কাট গলায় বলল,
“ সুযোগ তো আপন জন কে দেওয়া হয়। অপরিচিত কে নয়।”
“ আমি তোমার অপরিচিত??”
বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে জানতে চাইলো প্রীয়া। সমর ওভাবে দাঁড়িয়েই বলল,
“ অবশ্যই, কোনো সন্দেহ আছে?”
প্রিয়া যেন নিজেকে আর সামলাতে পারলো না এবার। ছুটে এসে আবারো জড়িয়ে ধরতে চাইলো সামনের মানুষটাকে। কিন্তু সফল হলো না। সমর তার আগেই পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো। রক্ত চক্ষু মেলে বজ্রনাদের ন্যায় গর্জে উঠে বলল,
“ খবরদার, ওই নোংরা হাতের এক বিন্দু স্পর্শও যেন আমার গায়ে না লাগে।”
সমরের প্রত্যাখ্যানে মেজাজ হারালো প্রিয়া। সেও সমান তালে গর্জে উঠলো,
“ আমি তোমার বিবাহিত স্ত্রী সমর। তুমি আমার সাথে এমন ভাবে কথা বলতে পারো না।”
এবার শব্দ করেই হেসে ফেলল সমর,
“ কি বললেন, বিবাহিত স্ত্রী? উফ্, আজকাল দেখছি আপনার ব্যবসার সাথে সাথে স্মৃতির ও অবনতি ঘটেছে। হাসালেন ম্যাডাম, সত্যিই হাসালেন। যাইহোক, সমস্যা নেই। আমিই মনে করিয়ে দিচ্ছি। আজ থেকে তিন বছর নয় মাস আগে আমাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। তাও কোর্টের নির্দেশে। বর্তমানে আপনার আর আমার মধ্যে বিন্দু মাত্রও সম্পর্ক নেই। সো, আপনি যেমন আমার কাছে অপরিচিত তেমনি আমিও আপনার কাছে। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার!! এবার আসতে পারেন।”
মধুপ্রিয়া এক পাও নড়লো না। বরং আবারো গিলে নিলো সমরের বিষে ভরা উপেক্ষা টুকু। আবারও কন্ঠে কথা সাজালো, আবারো বুকে আশা বেঁধে অনুনয় করে বলল,
“ ডিভোর্স হয়েছে তাতে কি! তাই বলে কি আবারো আমরা এক হতে পারবো না এমন টা তো নয় তাই না। চলো না সমর আমরা পুরোনো সব কিছু ভুলে আমাদের সন্তান কে নিয়ে আবারো নতুন করে শুরু করি।”
সমর ঘাড় কাত করে গভীর চোখে তাকালো। ভ্রু জোড়া ধনুকের মতো কুঁচকে বলল,
“ সেটা তো আর সম্ভব নয় ম্যাডাম।”
“ কে বলেছে সম্ভব নয়। আমরা চাইলেই সম্ভব। তাছাড়া…”
প্রিয়ার কথা মাঝ পথেই ধমকে থামিয়ে দিলো সমর। উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
“ আহ্! সম্ভব নয় আমি বললাম তো। তারপর তো আর কোনো কথা থাকতে পারে না।”
“ কেন সম্ভব নয়!”
উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইল প্রিয়া। যেন এই মুহূর্তে কারণ টা না জানতে পারলে দম আটকে যাবে বুকের ভেতরে। সমর কয়েক সেকেন্ডের বিরতি নিয়ে প্রিয়ার অস্থির মুখটা দেখে নিলো ভালো করে। অতঃপর তার গাত্রদাহ আরেকটু বাড়িয়ে বলল,
“ কারণ আমি বিবাহিত। ধর্মে বলে ঘরে স্ত্রী থাকতে দ্বিতীয় নারীর দিকে তাকানো পাপ। আর আমি পাপী হতে চাই না। সো ইউ গেটলস্ট নাও।”
“ কিহ….!”
কথাটা শোনা মাত্রই আঁতকে উঠলো প্রিয়া। যেন কিছুতেই বিশ্বাস হলো না কথাটা। দুঃখে ব্যথিত করুণ হাসি হেসে বলল,
“ আমি বিশ্বাস করি না। আমি জানি তুমি মিথ্যে বলছো যাতে আমি তোমার কাছে না আসি।”
সমর ঘুরে দাঁড়ালো। আগের মতোই বিদ্রুপ হেসে বলল,
“ না করলে নাই। কাউকে বিশ্বাস করানোর দায়বদ্ধতা আমার নেই।”
প্রিয়া কান্না গিলে বলল,
“ ঠিক আছে মেনে নিলাম যাও।”
অশ্রু ভেজা গাল দুটো মুছে নিয়ে বলল,
“ তোমার বউয়ের ছবি টা দেখাও, দেখি সে কেমন?”
“ নেভার। আমি আমার বউ কে যার তার সামনে প্রেজেন্ট করি না।”
প্রিয়া এবার খিলখিল করে হাসলো।
“ কেন? সে কি আমার থেকেও বেশি সুন্দরী নাকি যে লোকে নজর দিয়ে দেবে।”
সমর প্রিয়ার হাসির আড়ালে লুকোনো তাচ্ছিল্য টুকু দেখে মনে মনে জ্বলে উঠলো। নিজেকে সামলে কথার ভাঁজে বিদ্রুপ মিশিয়ে বলল,
“ অ্যাবসুলুটলি ইয়েস! আমার শ্যমলতা অসামান্য সুন্দরী। বলতে গেলে এই পৃথিবীর অন্যতম সেরা সুন্দরীদের একজন সে। কারণ তার সৌন্দর্য শুধু গতরের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়, তার সৌন্দর্য মিশে তার তীব্র আত্ম সম্মান বোধে। তার সৌন্দর্য মিশে তার লাজুক হাসি তে। তার সৌন্দর্য মিশে তার মিষ্টি কথায়। তার সৌন্দর্য মিশে তার সত্যবাদিতায়। সত্যি বলতে তার সৌন্দর্যের গভীরতা আমি এখনও ঠিক করে মেপে উঠতে পারি নি। তবে একটা কথা না বললেই নয়। আমি আসলেই ভাগ্যবান পুরুষ। নয়তো এমন একজনকে জীবনের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম সময়ে পাওয়া… শুধু মাত্র ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া সম্ভব নয়।”
প্রিয়া পাথরের মতো দাঁড়িয়ে সমরের এক একটা কথা শুনে গেল মনোযোগ দিয়ে। বিস্মিত নয়নে চেয়ে ফিস ফিস করে বলে উঠলো,
“ বাব্বা এতো ভালোবাসা!”
সমর এবার কড়া গলায় বলে উঠলো,
“ ইনাফ ইজ ইনাফ নাউ। ইফ ইউ ডোন্ট গো, আই’উইল কল দ্যা সিকিউরিটি ! সো ডোন্ট ফোর্স মি টু ডু দ্যাট।”
প্রিয়া আর দাঁড়ালো না সেখানে। আস্তে ধীরে ক্লান্ত পায়ে বেরিয়ে গেল দরজা খুলে। সমর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো আপদ বিদায় নিয়েছে দেখে। সে আর এক মুহূর্তও দেরি করলো না। তাড়াতাড়ি দরজা লক করে আবারো পিঠ এলিয়ে দিলো ডিভানে। ভোর হতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। সকাল হলেই এখান থেকে পালাবে সে। ছুটে চলে যাবে নিজের সেই চিরাচরিত চেনা নীড়ে। যেখানে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে জাগে আজকাল অন্তরে।
****
সকাল হতে না হতেই এবাড়িতে ধুম লেগেছে রান্না বান্নার। অবনী আর লাবনী মিসেস চিত্রার সাথে মিলে গোপন আলোচনায় ব্যস্ত। তাতে প্রধান উপদেষ্টার পদে আসীন হয়েছে সোমেন নিজে। আলোচনার মূল বিষয় বস্তু দুটো। এক সমরের ফুলশয্যার আয়োজন। আর দ্বিতীয় সমরের বৃদ্ধা ঠাকুরমা সহ আত্মীয় স্বজনদের বিয়ে সর্ম্পকে অবগত করানো। সোমেন প্ল্যান বানিয়ে বলল,
“ বুঝলে বড়মামী, অতো ভনিতা না করে সবাই কে সরাসরিই বলে দেওয়াই ভালো। এই নাও ফোন। আমি আগে মায়ের নম্বর তুলে দিচ্ছি। তাকে জানাও আগে। বাকি টা আমি সামলে নেবো।”
মিসেস চিত্রা তাই করলেন। সোমেনের কথা মতো বড় ননদকে ফোন করে জানাতেই তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। কিন্তু কষ্ট পেলেন না তাদের কে না জানিয়ে ছেলে বিয়ে দেওয়ায়। বরং ছেলেটা সংসার মুখী হয়েছে শুনে তাতেই যেন খুশিতে আত্মহারা তিনি। মিসেস চিত্রা একে একে সব আত্মীয়দের একই ভাবে বিয়ের কথা জানালেন। সবার কাছ থেকে পজিটিভ ফিডব্যাক পেয়ে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল তার। লাবনী আর অবনী কে দেখে খুশি মনে বললেন,
“ তোরা তাহলে কি প্ল্যান করেছিস বলে ফ্যাল এবার।”
লাবনী বেশ গুছিয়ে বলল,
“ আজ দাদাভাই বাড়ি ফিরলে ভাবছি সন্ধ্যায় শপিং করতে বেরোব। বুঝলে জেম্মা ভাত কাপড় আর ফুলশয্যার অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুর লিস্ট বানাতে হবে।”
মিসেস চিত্রা হাসি মুখে সম্মতি জানিয়ে বললেন,
“ ঠিক আছে। তোরা যা ভালো বুঝিস কর। তবে ওদের এক না করা পর্যন্ত মনে শান্তি পাচ্ছি না আমি।”
অবনী হেসে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো মিসেস চিত্রা কে। গালে মিষ্টি চুমু খেয়ে বলল,
“ আরে জেম্মা ডোন্ট ফিকর, জব লাবনী অ্যান্ড অবনী ইজ হিয়ার।”
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই বাড়ি ফিরে এলো সমর। কলিং বেলটা বাজার সাথে সাথে দরজা খুলতেই সেই মিষ্টি মুখের খোঁজে সমরের তৃষ্ণার্ত নজর ছড়িয়ে পড়লো সামনে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটা কে দেখতে পেল না। ঠিক তখনই দরজার সামনে হঠাৎ কেউ মুখ বাড়িয়ে ভাউ করে উঠলো। সমর চমকে তাকাতেই খিল খিল করে হেসে উঠলো অবনী।
চলবে.…