#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
(৩৪)
নিউজ ফিডের স্ক্রিন জুড়ে এক জোড়া যুগল বন্দী ছবি দেখে ঈর্ষায় পাগল পাগল অবস্থা মধুপ্রিয়ার। সমর নিজের হাতে খাবার তুলে অন্য একটা মেয়েকে এতো যত্ন নিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে। যেটা দেখা মাত্রই রক্তে আগুন ধরে গেছে তার। প্রিয়া রিদিমার ছবিটা জুম ইন করে ভালো করে দেখলো। তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“ তাহলে এই হলো তোমার শ্যামলতা। আমি আরও ভাবলাম কি না জানি ডানা কাটা পরী ধরে বিয়ে করেছো। এই মেয়ে তো আমার নখেরও যোগ্য না। কালি পেঁচি একটা।”
প্রিয়া লাবনীর আইডি তে পোস্ট করা সব কটা ছবি ভালো করে দেখতে লাগলো। দেখতে দেখতে একটা ছবিতে গিয়ে তার চোখ আটকে গেল। রিদিমা সায়ন কে কোলে বসিয়ে নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। আর সমর তার পাশে বসে আছে জলের গ্লাস হাতে নিয়ে। কি সুন্দর ছবিটা। দেখেই বোঝা যায় সুখী একটা পরিবার। প্রিয়ার নজর হঠাৎ ছোট্ট সায়নের ওই গোলগাল আদুরে মুখটার দিকে পড়লো। আর তাতেই যেন মোচড় দিয়ে উঠলো বুকটা। ইস্, এটা তার সন্তান। নয়টা মাস যাকে সে গর্ভে ধরেছিল। নিজের শরীরের রক্ত মাংস দিয়ে একটু একটু করে বড় করেছিল। তারপর কতো যন্ত্রণা কত কষ্ট সয়ে জন্ম দিয়েছিল এই একরত্তি প্রাণটাকে। আর আজ হঠাৎ করেই ওই মেয়েটা তার মা হয়ে গেল!!
প্রিয়ার গাল বেয়ে আচমকাই দু ফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়লো। হুট করে মনে হলো সে বড্ড একা। তার আসেপাশে কেউ নেই। কেউ তার আপন নয়। সবাই পর। সবাই স্বার্থপর। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই অতিরিক্ত উত্তেজনায় হাঁসফাঁস করে উঠলো প্রিয়া। তার হঠাৎ মনে হলো এক ভয়ংকর অন্ধকার আস্তে আস্তে গ্রাস করছে তাকে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে সে সেই মিশমিশে আধাঁরের আড়ালে। প্রিয়া বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলালো। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট কৌটো বের করে টেবিলের উপর সাদা গুড়ো ঢাললো। অতঃপর কাজের রোল বানিয়ে তা টেনে নিলো এক নিঃশ্বাসে।
কিছুক্ষন ঝিম ধরা যন্ত্রণা রক্তে মিশে যেতেই মস্তিষ্ক শান্ত হয়ে এলো। আস্তে ধীরে রক্তিম চোখ জোড়া উন্মুক্ত করে আচমকাই হেসে উঠলো প্রিয়া। সে হাসির মাঝে কি ছিল কে জানে গোটা ঘরের আসবাব গুলো ঝন ঝন করে কেঁপে উঠলো যেন। প্রিয়া হাসতে হাসতে একসময় চুপ হয়ে গেল। মুখটা আঁধার বানিয়ে সমরের ছবির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ তুমি আমাকে এভাবে ভুলে যেতে পারো না সমর। আমি তোমাকে কিছুতেই আমাকে ভুলে যেতে দেবো না। তাতে যদি আমার খুন ও করা লাগে তাহলে তাই সই।”
____
কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে আসা ভোরের নরম আলো চোখে মুখে পড়তেই ঘুম ভাঙলো রিদিমার। ঘুমের রেশ কেটে মস্তিষ্ক সচল হতেই গাঢ় লজ্জায় শিউরে উঠলো মেয়েটা। আচমকা স্বীয় অবস্থা মনে পড়তেই তড়িঘড়ি করে চেষ্টা চালালো কমফোর্টারের তলায় নিজেকে আড়াল করার। আলতো করে ঘাড় ঘুরাতেই চোখ আটকালো সমরের আনবৃত ফর্সা পিঠে। যেখানে তার দেওয়া নখের আঁচড় গুলোয় কেমন রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। রিদিমা আরেক দফা লজ্জায় শিউরে উঠলো। অধর কোণে স্মিত হাসি ফুটিয়ে ভাবতে লাগলো গত কাল রাতের ঘটনা।
তখন প্রায় মাঝ রাত। রিদিমার খোঁপা থেকে খোলা সেই বেলি ফুলের গাজরা থেকে সুঘ্রাণ ছড়িয়ে গোটা ঘর ম ম করছিল। এদিকে সমরের বাহুর মাঝে আটকে রিদিমার তখন তথৈবচ অবস্থা। কাঁপা কাঁপির চোটে বেচারীর জ্বর আসার জোগাড়। বড় বড় নিঃশ্বাস গুলো যেন বুকের ভেতর থেকে সুনামির মতো আছড়ে আছড়ে পড়ছে। সমর জেগেই ছিল। রিদিমার অবস্থা দেখে ওকে টেনেটুনে আরেকটু কাছে নিয়ে এলো। দুহাতে জাপটে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে আবারো সেই আগের মতো কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিসিয়ে বলল,
“ শ্যামলতা, এতো কাঁপছ কেন? তোমার কি খুব শীত করছে?”
রিদিমা সে প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না। প্রত্যুত্তরে শুধু বড় বড় নিঃশ্বাস টানে বুকের ভেতর। সমর ওর অবস্থা দেখে ফিক করে হেসে ফেললো। গালে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
“ অ্যাম সরি ওয়াইফি। তোমার এই ভয়ানক অসুস্থতা দূর করতে এই মুহূর্তে চিকিৎসা প্রয়োজন। তাই কিছুক্ষণ আগের দেওয়া কথা আর রাখতে পারলাম না আমি।”
রিদিমার কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক জোড়া তপ্ত অধর ওর অধরোষ্ঠে চেপে বসেছিল। আর তারপর যা কিছু ঘটেছিল সব টুকু ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত! অনভিপ্রেত! আর অচিন্তনীয়।
সেসব কথা ভাবতেই গাল জোড়ায় উষ্ণতা ছেয়ে গেল রিদিমার। লজ্জায় হাঁসফাঁস অবস্থা টুকু কোনোমতে সামলে মেঝেতে ফেলা শাড়িটা তুলে সারা গায়ে জড়ালো। তারপর এক ছুটে দৌড়ে পালালো ওয়াশরুমের ভেতরে। ওদিকে রিদিমার পায়ের শব্দে ঘুম ভাঙলো সমরের। সে পেছন ঘুরে ছুটন্ত রিদিমাকে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। ঘাড়ের নিচে হাত রেখে আনমনে বলে উঠলো,
“ কাঠবিড়ালি একটা।”
_______
দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে আরও কয়েকটা দিন। লাবনীরা চলে গিয়েছে দুদিন হলো। আজ সায়নের স্কুলের প্রথমদিন। সকাল সাড়ে আটটা থেকে স্কুল শুরু। রিদিমা তড়িঘড়ি সায়ন কে রেডি করিয়ে ব্রেকফাস্ট করাচ্ছিল তখন সমর রেডি হয়ে নিচে নেমে এলো। শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে বলল,
“ তোমরা রেডি।”
সায়ন দুধে ভেজা কর্নফ্লেক্স গিলে নিয়ে বলল,
“ পাপা দেকো আমি নুতুন ড্রেস পলেচি।”
সমর হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“ বাহ্ খুব সুন্দর লাগছে তো আমার পাপা কে।”
সায়ন খুশিতে গদগদ হয়ে আবারো খাবারে মন দিলো। সমর টেবিলের উপর থেকে কফির মগ টা নিতে গিয়ে রিদিমার দিকে তাকালো। চোখাচুখি হতেই সাথে সাথে লজ্জায় অধোবদন হলো মেয়েটা। কিন্তু সমর সে সবে পাত্তা না দিয়ে চোখ ভরে তাকে দেখলো। আজ গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি পড়েছে মেয়েটা। চোখে কাজল ও দিয়েছে। চুল গুলো পেঁচিয়ে আটকে রেখেছে ক্ল্যাচার ক্লিপ দিয়ে। সমর স্ক্যানারের মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। দেখতে দেখতে নজর গেল গলার ভাঁজের নিচে। সমরের তীক্ষ্ণ নজর সেখানেই থেমে গেল। গতকাল রাতের প্রবল আদরের ক্ষুদ্র ক্ষত চিহ্ন জ্বলজ্বল করছে ওখানে। সমর ভ্রূ কুঁচকে কিছু একটা ভাবলো। তারপর চুলের ক্ল্যাচার টা একটানে খুলে বলল,
“ ভেজা চুল বাঁধার দরকার নেই।”
রিদিমা অবাক চোখে তাকাতেই সমর মগ টা টেবিলে রেখে বলল,
“ আমি গাড়ি বের করছি। তোমরা এসো।”
_____
স্কুলের সামনে গাড়ি এসে থামতেই সায়ন কে নিয়ে নেমে এলো রিদিমা। সমর ও বেরিয়ে এলো গাড়ি লক করে। ছেলেকে কোলে তুলে গালে চুমু খেয়ে বলল,
“ তুমি কি ভয় পাচ্ছো পাপা।”
সায়ন মুখটা ভার করে মাথা দোলালো।
“ ইত্তু পাচ্ছি।”
রিদিমা হাত বাড়িয়ে সায়ন কে কোলে তুলে নিলো । গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“ আমাদের সায়ন তো ব্রেভ বয়। তাই একদম ভয় পাবে না ঠিক আছে। আর তাছাড়া আমি তো এখানেই থাকবো সোনা। তোমার যখনই মন খারাপ লাগবে মিস কে বললেই সে আমার কাছে নিয়ে আসবে।”
সায়ন খুশিতে দুপাশে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। সমর আর রিদিমা সায়ন কে নিয়ে স্কুলের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে ওকে আন্টি দের হাতে তুলে দিয়ে এলো। ছুটি বারোটায়। সমর হাত ঘড়িতে সময় দেখলো। সাড়ে তিন ঘণ্টা পর ছুটি।
“ এই রোদের মধ্যে এখানে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না।”
রিদিমা খোলা চুল গুলো আবারো গুটিয়ে খোঁপা বাঁধছিল। সমর ওর হাত থামিয়ে দিল।
“ বললাম না চুল গুলো বাঁধার দরকার নেই।”
সমরের বারণ করা দেখে অবাক হলো রিদিমা। রোদের তাপে গরমে বিরক্ত হয়ে বলল,
“ কিন্তু গরম লাগছে আমার।”
সমর চুল গুলো কে খুলে ডান কাঁধে ছড়িয়ে দিতে দিতে সরু চোখে তাকালো। কানের কাছে মুখ এনে ভরাট কন্ঠে বলল,
“ মেঘকন্যা, স্বামীর সোহাগ সবাইকে দেখাতে হয় না। লোকের কু নজর লেগে যায়।”
রিদিমা সমরের কথার মানে তখনই বুঝতে না পারলেও মিনিট খানেক পর বুঝতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল একেবারে। সাথে সাথে শাড়ির আঁচলটা টেনে গা ঢাকতে ঢাকতে বলল,
“ আমি ওয়েটিং রুমে যাচ্ছি। আপনি অফিস চলে যান।”
সমর হাসলো। তারপর বেরিয়ে গেল ওখান থেকে। আর এসব দৃশ্য খানিক দূরে দাঁড়িয়ে চুপ করে দেখে গেল কালো গগলসে ঢাকা দুটো চোখ। মাস্কের আড়ালে ঢাকা মুখের আদলে ফুটে উঠেছে রাগের জ্বলন্ত বিভীষিকা। সমর চলে যেতেই সেও স্কুল প্রেমিসেসের বাইরে থাকা ওয়েটিং রুমে ঢুকলো। রিদিমার কাছে এসে বলল,
“ হায় রিদিমা, আমি প্রিয়া। সায়নের মা। সমরের এক্স ওয়াইফ।”
চলবে….
#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
(৩৫)
“ হায় রিদিমা, আমি প্রিয়া। সায়নের মা। সমরের এক্স ওয়াইফ।”
কথাটা শুনে রিদিমা চমকে উঠে সামনে তাকাতেই দেখলো তার সামনে মাস্ক গগলস আর ক্যাপ মাথায় পরা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে লং লেডিস শার্ট আর ডেনিম জিন্স। পায়ে সাদা কেটস্। মেয়েটা মাস্কের আড়ালে মুখটা ঢেকে রেখেই বলল,
“ আমরা কি দু মিনিট কথা বলতে পারি। প্লীজ।”
সমরের এক্স ওয়াইফ কথাটা শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল রিদিমা। অজানা এক ভয়ের শিহরণে কেঁপে উঠলো হৃদয়ের অন্তঃস্থল। তাই প্রিয়ার পরবর্তী কথাটা শুনে ঠিক কি করবে বুঝে ওঠার আগেই কোথা থেকে হাজির হলো মিতালী। ‘ হেই, রিদিমা’ বলে ছুটে এসে গলা জড়িয়ে ধরলো। ‘ কতদিন পর দেখা হলো বলো’ বলে ছাড়লো তাকে। রিদিমা মিতালী কে দেখে খানিক বিরক্ত হলেও মুখে স্বচ্ছ হাসি ফুটিয়ে বলল,
“ ভালো আছো মিতালী দি।”
মিতালী দুষ্টু হেসে বলল,
“ আমার কথা বাদ দাও আগে তোমার কথা বলো। তা তোমাদের বিবাহিত জীবন কেমন কাটছে, হুম্!”
বলেই ভ্রূ জোড়া বার কয়েক নাচালো সে। রিদিমা সেই আগের মতোই হেসে জবাব দিলো,
“ যেমন কাটার কথা ঠিক তেমনই কাটছে গো। একদম ঠিক ঠাক।”
মিতালী মনের মত জবাব না পেলেও রিদিমার স্মার্ট উত্তরে মুখ ভরে হাসলো। তারপর হুট করে ওর হাত টেনে বলল,
“ এই চলো তোমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।”
রিদিমা নিজেকে আটকানোর আগেই মিতালীর সাথে যেতে হলো অগত্যা। মিতালী ওকে নিয়ে বেশ কয়েকজন মহিলার সাথে পরিচয় করালো। ওদের বাচ্চারাও সায়নের সাথেই এবার ভর্তি হয়েছে। ওদের মধ্যে একজন বলল,
“ এই তোমার নম্বর টা দাও তো আমাদের গ্রুপে অ্যাড করে নিই। ফ্রী টাইমে আড্ডা দেওয়া যাবে।”
মিতালী নিজেও বলল,
“ হ্যা রিদিমা তোমার নতুন নম্বরটা তো আমার কাছেও নেই। দাও দাও। তাড়াতাড়ি দাও।”
রিদিমা সবাই কে নিজের নম্বর দিতে দিতে একবার পেছন ঘুরে তাকালো। দেখলো মেয়েটা ওয়েটিং রুমের একপাশে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। বারবার হাতের কব্জিতে নজর বুলচ্ছে আর বিরক্ত ভঙ্গিতে ঘড়ি দেখছে। রিদিমা দ্রুত কথা শেষ করে বিদায় নিয়ে এসে দাঁড়ালো প্রিয়ার সামনে। প্রিয়ার মাস্ক এ ঢাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ এক্সকিউজ মি! কি বলছিলেন একটুখানি আগে?”
প্রিয়া রিদিমার দিকে তাকিয়ে মাস্কের আড়ালেই হাসলো। বলল,
“ আমি সমরের প্রাক্তন স্ত্রী, আর সায়নের মা মধুপ্রিয়া দে।”
মধুপ্রিয়া নামটা শুনে রিদিমা অবাক চোখে তাকালো। অতঃপর চোখে কাঠিন্য আর কণ্ঠে দৃঢ়তা এঁটে বলল,
“ আপনি যে মিস্টার দত্তের প্রাক্তন স্ত্রী তার প্রমাণ কি?”
রিদিমার কথায় ফিক করে হাসলো প্রিয়া। তার হাসি দেখতে না পেলেও নিঃশ্বাসের শব্দ টা ঠিকই শুনতে পেল রিদিমা।
“ ভেরি স্মার্ট গার্ল। দাঁড়াও দেখাচ্ছি।”
বলেই ফোন ঘেঁটে একটা ছবি বার করে তুলে ধরলো রিদিমার সামনে। বলল,
“ নাও দেখো। আমি আর সমর। এটা আমাদের বিয়ের পর ঘুরতে গিয়ে তোলা হয়েছিল।”
ছবিটার দিকে তাকাতেই রিদিমার বুক টা কেমন যেন ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠলো। মানুষটা একটা মেয়েকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। আর মেয়েটা তার হাত দুটো দুহাতে জড়িয়ে ঠিক বুকের মাঝে যেখানে হৃদয় থাকে ঠিক সেখানে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চিন্তে। রিদিমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো অজান্তেই। ও মেয়েটা কে একবারও দেখলো না। ওর নজর আটকে রইলো সমরের মুখে লেগে থাকা ওই তৃপ্তির হাসি আর দুহাতের শক্ত বাঁধনে। তাহলে মানুষটা এই মহিলাকে একদিন এতোটা ভালোবাসতো! রিদিমা চোখের জ্বলুনি কমাতে অন্যদিকে তাকালো। প্রিয়া ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে বলল,
“ হলো তো বিশ্বাস। এখনও কি সন্দেহ নাকি আরও প্রমাণ লাগবে?”
রিদিমা নিজেকে চট করে সামলে নিয়ে কড়া গলায় বলল,
“ কি চাই আপনার?”
“ একটু খানি সময়।”
“ যদি না দিই!”
“ আই রিকোয়েস্ট ইউ প্লীজ!”
রিদিমা আর না করতে পারলো না। কিছুক্ষণ মনে মনে ভাবনা চিন্তা করে বলল,
“ ওকে তবে মাত্র দু মিনিট।”
প্রিয়া আবারো মাস্কের আড়ালে হাসলো। বলল,
“ আমার পাবলিক প্লেসে সমস্যা আছে। ওই ওদিকে আমার গাড়ি পার্কিং করা আছে। যদি তোমার সমস্যা না হয় তাহলে ওখানে বসে কথা বলি।”
ভ্রূ কুঁচকে রিদিমা সন্দেহের চোখে তাকাতেই প্রিয়া বলল,
“ প্লীজ ভয় পেও না। সরি তোমাকে তুমি করেই ডাকলাম। আসলে তুমি আমার থেকে অনেক ছোট তো!”
“ ইটস ওকে। কিন্তু আমি আপনার মুখ না দেখে কি করে বিশ্বাস করি ছবির মানুষটা আপনিই।”
প্রিয়া এদিক ওদিক তাকিয়ে মুখের মাস্ক নামিয়ে চোখের গগলস টা সামান্য উপরে তুলতেই চমকে উঠলো রিদিমা। বুকের ভেতর দামামা বেজে উঠলো টিভির পর্দায় দেখা এক কালের অভিনেত্রী কে দেখে। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যেই আবারো নিজেকে আড়ালে ঢেকে প্রিয়া বলল,
“ এবার তো যেতে আর অসুবিধা নেই তাই না!”
রিদিমা উত্তর দিলো না। শুধু প্রিয়ার পেছন পেছন হেঁটে চলল।
গমগমে এসির শীতল হাওয়ায় বসে চোখ মুখের আড়াল খুলে ফেলল প্রিয়া। রিদিমা চোখের সামনে এক লাস্যময়ী সুন্দরী কে দেখে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো। কি তার রূপ কি তার মাখন ঢালা গায়ের রঙ, উফ্। সমর ঠিকই বলেছিল। প্রিয়া আসলেই সুন্দরী। অপরিসীম মায়ায় ঘেরা একটা মুখ। প্রিয়া রিদিমার থমকে থাকা দৃষ্টির দিকে তাকালো। তবে সেদিন ছবিতে যা দেখেছিল ঠিক তার উল্টোটা দেখে ভেতরে ভেতরে জ্বলে উঠলো একেবারে। মেয়েটা শ্যামলা তবে নিখাদ সৌন্দর্যের দাবি রাখে অনায়াসে। কি বড় বড় চোখ, তাতে বাঁকানো ঘন পল্লবের ভার। ঘন কালো ভ্রূ জোড়া যেন এক দেখায় নজর কেড়ে নেয়। পাতলা ঠোঁট টিকালো নাক সব টুকু যেন তুলির টানে আঁকা। প্রিয়া নিজের অন্দরে জমা ঈর্ষা টুকু সামলে বলল,
“ তুমি খুব সুন্দর।”
“ হুম্??”
রিদিমাকে চমকে উঠতে দেখে প্রিয়া একই কথা আবারো বলল। রিদিমা নিজেকে সামলে বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ আমি কিন্তু আপনাকে মাত্র দু মিনিট দিয়েছি। অযথা ফালতু কথা না বলে যা বলতে ডেকে নিয়ে এসেছেন সেটা বলুন।”
“ এতো ব্যস্ত হচ্ছো কেন?”
প্রিয়া হেসেই বলল। রিদিমা তাতে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“ আশ্চর্য, ব্যস্ত হবো না তো কি আনন্দ করবো। আমার বাচ্চাটা আজ প্রথমবার স্কুলে এসেছে। যদি কান্না করে তখন! ওদিকে আমায় খুঁজবে না!”
আমার বাচ্চাটা শুনে প্রিয়ার মুখটা সাথে সাথে চুপসে গেল। বুকের ভেতর টা ঝাঁঝিয়ে উঠলো চেনা সেই আফসোসের উত্তাপে। যে সন্তান কে সে জন্ম দিয়েছিল আজ তাকে নিজের বলে দাবি করার অধিকার টুকুও তার নেই। বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসটা প্রিয়া রিদিমার আড়ালেই লুকিয়ে ফেলল। অতঃপর চোখের দৃষ্টি নিচে নামিয়ে বলল,
“ সরি! আমি সেটা মিন করে বলিনি। আসলেই ভুল টা আমার।”
“ যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন প্লীজ!”
রিদিমার বিরক্তি দেখে প্রিয়া আর দেরি করলো না। মাথা নেড়ে বলল,
“ রিদিমা, দেখো আমি জানি আমি যে কথাটা বলবো সেটা ভীষণ অযৌক্তিক কিন্তু আমি বড্ড অসহায় হয়েই ছুটে এসেছি তোমার কাছে।”
রিদিমা এবার ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। প্রিয়া খপ করে ওর হাত দুটো ধরে বলল,
“ রিদিমা প্লীজ আমাকে একবার সায়নের সাথে দেখা করতে দেবে! আজ প্রায় চার বছর হয়ে গেছে আমি আমার সন্তান কে দেখি না। সমর কে বহুবার রিকোয়েস্ট করেছি কিন্তু ও আমার কোনো কথাই শোনে নি। তাই বড্ড নিরুপায় হয়েই তোমার কাছে ছুটে এসেছি। প্লীজ না করো না।”
রিদিমা ত্বরিত হাত টান দিয়ে বলল,
“ অসম্ভব! আমি পারবো না। তাছাড়া সমর বাবু যেখানে নিজেই এবিষয়ে সম্মতি দেন নি সেখানে আমি তো জাস্ট থার্ড পারসন।”
রিদিমার কথায় প্রিয়া একেবারে কেঁদে মেদে একশা হয়ে গেল। আবারো তার শীর্ণ হাত টা দুহাতের মুঠোয় পুরে বলল,
“ প্লীজ রিদিমা, এই অসহায় মা টাকে এভাবে ফিরিয়ে দিও না। মানছি আমি অনেক খারাপ। আমি কখনও মায়ের দায়িত্ব পালন করিনি। কিন্তু তবুও! তবুও যে দিন শেষে আমি একজন মা। শুধু মাত্র একটা বার আমার ছেলেটাকে চোখের দেখা দেখতে চাই। একটু বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে তার উষ্ণতা টুকু অনুভব করতে চাই। তার ওই সরল নিষ্পাপ মুখটা এই আঁজলায় ভরে চোখের তৃষ্ণা মেটাতে চাই। শুধু একবার রিদিমা শুধু একবার। আমি প্রমিস করছি আজকের পর তোমার কাছে এই আবদার নিয়ে আর কোনোদিন আসবো না। প্লীজ রিদিমা প্লীজ!!”
রিদিমা প্রিয়ার কান্না আর তার আকুল আকুতি গুলো দেখে গেল নির্বাক চোখে চেয়ে। সত্যি বলতে ওর মনটা হঠাৎ নরম হয়ে গেছে প্রিয়ার ছটফটানি দেখে। আসলেই তো, একজন মা যতোই পাষাণ হোক দিন শেষে সে একজন মাই। রিদিমা সেই মুহূর্তে কথা দিতে পারলো না। আমি পরে জানানো বলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল গাড়ির ভেতর থেকে। দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে এগারোটার ঘর পার করতেই সমর এসে হাজির হলো। রিদিমা সে সময় ওয়েটিং রুমে মিতালী দের সাথে বসে। ওরা গল্পে মশগুল হলেও সে নির্বিকার। ভাবনার জগত জুড়ে কেবল প্রিয়া আর সমরের সেই ঘনিষ্ঠ সময় গুলো ঘুরছে যখন তারা একসাথে ছিল। সমর দূর থেকে রিদিমাকে দেখে ফোন করতেই রিদিমার চমক ভাঙলো। সমরের ফোন দেখে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো প্রিয় মানুষটার ভরাট কন্ঠস্বর…
“ মেঘকন্যা তাড়াতাড়ি এদিকে আসুন আপনার স্বামী আপনার অপেক্ষায় এই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে।’
সমরের মিষ্টি কথায় রিদিমার ঠোঁটে আলগোছে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। মনের মধ্যে জমে ওঠা কষ্ট গুলো যেন মুক্ত আকাশে ফানুসের মতো উড়াল দিলো কয়েক মিনিটের ব্যবধানে। চোখের কোনে উপচে আসা খুশির জোয়ার টুকু সামলে কোনো মতে বলল,
“ অপেক্ষা করুন, আসছি !”
রিদিমা কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তাকে টেনে গাড়ির ভেতর গিয়ে বসলো সমর। এসির বাতাসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে রিদিমার দিকে একটা কোণ আইসক্রিম এগিয়ে দিলো। রিদিমা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
“ এটা কি?”
“ ললিপপ”
রিদিমা ভ্রূ কুঁচকে তাকাতেই সমর টিস্যু দিয়ে ঠোঁটের উপর জমা ঘাম মুছে দিতে দিতে বলল,
“ এভাবে তাকানোর কিছুই হয় নি। বউয়ের টেক কেয়ার করা স্বামিদের প্রধান দায়িত্ব। তাছাড়া বউটা আমার নেহাত বাচ্চা তাই আইসক্রিম টা তার প্রাপ্য ছিল বলেই এনেছি বুঝেছো। নাও এবার খাও।”
আচ্ছা মানুষ কি রোজ রোজ একটা মানুষের প্রেমে পড়তে পারে? পারে হয়তো। এই যে রিদিমা আজ এই মুহূর্তে আবারো একবার সামনে বসা মানুষটার প্রেমে পড়ে গেল। ভুলে গেল কিছুক্ষন আগে দেখা সেই ছবিটার কথা যেখানে মানুষটার মুখে অন্যরকম দীপ্তি ছিল প্রাক্তন নারীকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে। লাজের উষ্ণতায় উত্তপ্ত রিদিমা মুখ লুকিয়ে হাসলো। তারপর গাড়ির ডেস্কে রাখা ঠান্ডা জলের বোতল টা খুলে দুঢোক জল খেয়ে নিজেকে শান্ত করে বলল,
“ ঠিক আছে। তবে আমি এটা একা খাবো না। আমার সাথে আপনাকেও খেতে হবে কিন্তু।”
সমর মাথার উপর হাত তুলে গা এলিয়ে বসে ছিল সিটে। রিদিমার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“ বিগত কয়েক দিনে এতো এতো আদর করলাম অথচ তোমার আপনি আজ্ঞে ডাকটা এখনও বন্ধ করতে পারলাম না তাই না।”
রিদিমার যেন মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো সমরের কথা শুনে। ইস্, মানুষটা এতো অসভ্য কেন! লিমিট লেস ঠোঁট কাটা একটা। রিদিমা লজ্জায় হাঁসফাঁস করতে করতে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
“ আপনি ভীষণ খারাপ।”
সমর চোখ জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
“ আবার! এবার আপনি আজ্ঞে করলে কিন্তু এই গাড়ির মধ্যেই শুরু হয়ে যাবো।”
রিদিমা চমকে উঠে তাকাতেই সমর দুষ্টু হেসে ফেললো,
“ কি! দেবো না কি পানিশমেন্ট।”
রিদিমা ঘন ঘন মাথা নাড়ালো। সমর ফিক করে হেসে বলল,
“ গুড!”
ছেলে আর বউকে নিয়ে সমর যখন বাড়িতে পৌঁছলো তখন বসার ঘরে তপন বাবু আর মনিকা বসে। তাদের কে দেখে মনে মনে খুব চমকালো সে। তবে তার বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশ না দেখিয়ে হাসি মুখেই বলল,
“ আরে আপনারা, ভালো আছেন।”
বলেই পায়ে ছুঁয়ে প্রণাম করলো। তপন বাবু মনিকা ইতঃস্তত হয়ে সমরের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে মেয়ের দিকে তাকালো। অথচ রিদিমা বাবা মায়ের দিকে একবারও না তাকিয়ে গট গট করে হেঁটে চলে গেল দোতলায় সায়ন কে কোলে করে নিয়ে। তপন বাবু আর মনিকা মেয়ের ব্যবহারে প্রচন্ড কষ্ট পেলেও মুখ বুজে বসে রইলেন। তারা জানেন তাদের মেয়ের এই অভিমান এতো সহজে ভাঙার নয়।
চলবে…..
#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
( ৩৬ এর প্রথমাংশ)
“ অভিমানিনীর অভিমান কমেছে?”
তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে প্রায়। সায়ন কে ঘুম পাড়িয়ে তার পাশে চুপ করে শুয়ে ছিল রিদিমা। চোখ দুটো ভিজে অভিমানের অশ্রুতে। সেই যে তখন বাবা মা কে উপেক্ষা করে তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে দোতলায় উঠে এসেছিল তারপর আর নিচে নামে নি মেয়েটা। সমর খাবারের ট্রে টা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কথাটা বলতেই রিদিমা তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। সমর ট্রে টা খানিক দূরত্বে থাকা টি টেবিলে রেখে হেঁটে এলো রিদিমার কাছে। মেয়েটা কে হাঁটু জড়িয়ে বসে থাকতে দেখে পাশে বসে বলল,
“ আর কত অভিমান করে থাকবে রিদিমা। এতে যেমন তুমি কষ্ট পাচ্ছো ঠিক তেমনই ওনারাও কষ্ট পাচ্ছেন।”
রিদিমা সমরের কথা গুলো চুপ করে শুনলো কিন্তু জবাবে তেমন কিছু বলল না। সমর রিদিমার দিকে গভীর চোখে তাকালো। চশমার স্বচ্ছ কাঁচের আড়ালে ঢাকা চোখ দুটো যেন নিমেষেই বুঝে নিলো মেয়েটার মনের ভেতর জমে থাকা অসহ্য চাপা দহন। সমর আরেকটু কাছে এলো। রিদিমার গা ঘেঁষে বসে চুলের ভাঁজে আঙুল ডোবালো। ভেজা চুল গুলোকে আলতো আলতো করে পিঠে ছড়িয়ে দিতে দিতে বলল,
“ ভুল তো মানুষ মাত্রেই হয় তাই না!
কিন্তু তাই বলে এতো অভিমান জমিয়ে রাখতে হয় বলো। তাছাড়া ওনারা তোমার বাবা মা। আর বাবা মায়ের উপর এতো অভিমান করতে নেই।”
রিদিমা ছলছল চোখে তাকালো সমরের দিকে। জোরে নাক টেনে বলল,
“ আর এই একই ভুল যদি আমি করতাম তখন? তখন কি তারা আমাকে ক্ষমা করে দিতো? দিতো না। বরং আমার সাথে সমস্ত সম্পর্ক কেটে দিয়ে আজীবনের জন্য আমাকে নির্বাসিন দিয়ে দিতো। যেমন টা বিয়ের দিন করেছিল।”
একটু দম নিয়ে বলল,
“ তাহলে সেই একই অপরাধে অপরাধী হয়ে তারা কেন এত তাড়াতাড়ি ক্ষমা পাবে বলুন!!”
সমর বুঝলো রিদিমার মনের সীমাহীন গভীরে ঢুকে এই অভিমানের যন্ত্রণা টা। বহুদিন ধরে একটু একটু করে জমে আজ পাহাড়ের আকার ধারণ করেছে। কখনও মায়ের অবহেলায় আবার কখনও বোনের কিম্বা মাসির তিরস্কারে। তবে তার সহ্যের সীমা সেদিন ছাড়িয়ে গেছে যেদিন বাবার কাছে অঢেল ঘৃণা আর অবিশ্বাস পেয়েছে। সমর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। রিদিমার মনের গহীনে জমা এই অভিমানের পরত এতটাই শক্তশালী যা এতো সহজে এতো দ্রুত মিটে যাবার নয়। সমর রিদিমাকে আরেকটু কাছে টেনে খুব আলতো স্পর্শে চুলে আঙুল চালাতে লাগলো। মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে বিছানার হেড বোর্ডে পিঠ এলিয়ে দিয়ে গাঢ় ভরাট কন্ঠে আওড়াল,
“ আচ্ছা তুমি কি বরাবরই এমন অভিমানী নাকি ইদানিং কালে হয়েছো।”
রিদিমা সমরের কথার মানে বুঝতে না পেরে বুক থেকে মুখ তুলে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন বোধক চাহনি ছুঁড়ে বলল,
“ মানে?”
“ মানে আমি যে রাগিণী রিদিমাকে বিয়ের আগে দেখেছিলাম সেই রিদিমার সাথে এই রিদিমার তো কোনো মিল ই খুঁজে পাই না আজকাল। বাপরে বাপ! সে কি রাগ ছিল তার কথায়! কি জ্বলন্ত তেজ ছিল তার চোখে। আর এই রিদিমাকে দেখ, আবেগের শীতল জলে ভেসে যাওয়া শান্ত এক নদী।”
রিদিমা সমরের বুক থেকে সরে পাশে গিয়ে বসলো। লাজুক চোখে আনত হয়ে হাঁটুতে আবারো গাল ঠেকিয়ে বলল,
“ এটা আমার দোষ নয়। আসলে আমি ছোট বেলা থেকে এমনই। অল্প আঘাতেই ভীষণ কষ্ট পাই।
জানেন, কেউ যদি আমার সাথে খারাপ আচরণ করে তাহলে আমার ভীষণ খারাপ লাগে। মনটা আয়নার কাঁচের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। আবার কেউ যদি আমার সাথে একটু ভালো আচরন করে তাহলে আমি ভীষণ খুশি হই।
কেউ আমাকে একটু ভালোবাসলে একটু যত্ন করলে আমিও আমার সবটা উজাড় করে তাকে ভালোবাসার চেষ্টা করি। তার যত্ন নিতে নিজের সবটুকু নিঃশেষ করে দিই নির্দ্বিধায়।
বলতে পারেন আমি আসলে একটু বোকা অনেক টা আবেগী আর ভীষণ অভিমানী।”
সমর মন্ত্রমুগ্ধের মতো করে রিদিমার কথা গুলো শুনছিল। কি সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলে মেয়েটা! কি কোমলতা কি আদুরে ভাব তার বলার ভঙ্গিমায় মিশে। সমরের এই প্রথমবার মনে হলো সে বোধ হয় মেয়েটার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। এতো মিষ্টি করে অভিমান করে কেউ! সমর হাত বাড়িয়ে রিদিমার গালে হাত বুলালো। নরম গলায় বলল,
“ অনেক বেলা হয়েছে চলো খাবে এসো।”
“ আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“ কেন?”
“ এমনি।”
সমর আগের মতোই রিদিমার নরম গালে আঙুল ঘষতে ঘষতে বলল,
“ কিন্তু আমি তো দেখতে পাচ্ছি তোমার ক্ষিদে পেয়েছে।”
“ সত্যি বলছি আমার একদম খেতে ইচ্ছে করছে না।
রিদিমা ঠোঁট মুচড়ে বললেও সে কথা শুনলো না সমর। তাকে টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে টিটেবিলের কাছে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ অভিমান অভিমানের জায়গায় খাবার খাবারের জায়গায়। অভিমান করে খাবার খাবে না এটা কিন্তু চলবে না।”
অগত্যা রিদিমাকে খেতে বসতেই হলো। রিদিমা ভাত মাখতে মাখতে জিজ্ঞেস করল,
“ এই শুনুন না!”
সমর পাশে বসে ফোন ঘাটছিল। ঘাড় বাঁকিয়ে আড় চোখে তাকিয়ে বলল,
“ আবার আপনি আজ্ঞে।”
রিদিমা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ আচ্ছা ! এই শোনো না!”
“ হুম্ বলো না!”
“ উফ্!”
রিদিমার বিরক্তি হওয়া দেখে ফিক করে হেসে ফেললো সমর। তারপর সিরিয়াস হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
“ আচ্ছা বলো।”
“ বলছি বাবা মা কখন গেছে?”
“ কিছুক্ষন আগে।”
রিদিমা পরের প্রশ্নটা করতে গিয়ে বেশ অস্বস্তিতে পড়লো। সমর বোধ হয় বুঝতে পারলো সেটা। সে নিজেই বলল,
“ চিন্তা করো না। এবাড়িতে ওনাদের কোনো অযত্ন হয় নি। আর ভবিষ্যতেও কোনোদিন হবে না।”
রিদিমা কৃতজ্ঞতার চোখে তাকালো সমরের কথা গুলো শুনে। যদিও চুমকির কাছে শুনেছিল মিসেস চিত্রা ওনাদের যেতে দেন নি। জোর করে রেখে দিয়েছেন। সেই সাথে গল্প গুজবের দারুন এক আসর পেতে বসেছেন বসার ঘরে। রিদিমা মনে মনে স্বগতোক্তি করে।
ইস্! এই পরিবারটা এতো ভালো কেন?
রিদিমার আজকাল সব সময় নিজেকে ভাগ্যবতী বলে মনে হয়। হায়! এতো সুখ লেখা ছিল বুঝি তার কপালে!! রিদিমা খুশি মনে ভাতের গাল মুখে পুরে খেতে থাকে ধীরে ধীরে। খাবার খাওয়ার মাঝে হঠাৎ সকালের কথা মনে পড়ে যায়। সাথে সাথে বুকটা টনটনিয়ে ওঠে সমর আর মধুপ্রিয়ার সেই যুগল বন্দী ছবিটা মনে করে। সাথে সাথে রিদিমার গলায় খাবার আটকে যায়। শ্বাসনালীতে তরকারির ঝাল গিয়ে কাশতে থাকে অনবরত।
সমর ফোনের মাঝে ডুবেছিল। রিদিমার কাশি দেখে সাথে সাথে জল খাওয়ালো। বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করতে করতে বলল,
“ রিল্যাক্স রিদিমা, আস্তে ধীরে নিঃশ্বাস ছাড়ো।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসে রিদিমার তবে খাওয়া টা আর এগোয় না। সে খাবে না দেখে সমর ও আর চাপাচাপি করলো না। খাবারের ট্রে না একপাশে রেখে বলল,
“ ঠিক আছে। যাও হাত মুখ ধুয়ে এসো।”
প্রায় মিনিট পাঁচেক হলো বিছানায় পিঠ এলিয়েছে সমর। রিদিমা বিছানার অপর পাশে এসে বসলো। এসির শীতল হাওয়ায় কম্বলের ভেতরে ছোট্ট সায়ন টা হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে দেখে তার মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“ এই শুনছেন?”
“ আবার!”
“ সরি অভ্যেস হয়ে গেছে। এই শোনো না!”
সমর ওভাবেই চোখ বুজে বলল,
“ বলো শুনছি।”
রিদিমা খানিক ইতঃস্তত করে বলল,
“ সেই গল্পটা তো আর বললে না আমাকে।”
“ কোন গল্প?”
“ তোমার আর প্রিয়ার বিবাহিত জীবনের গল্প।”
সমর ফট করে চোখ খুলে তাকালো। রিদিমার সাথে চোখাচুখি হতেই ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“ শুনলে সহ্য করতে পারবে তো?”
“ মানে?”
“ মানেটা হলো আমাদের দুজনের অনেক অনেক রোম্যান্টিক ঘটনা আছে অতীতে। শুনলে আবার কষ্ট পাবে না তো তাই জিজ্ঞেস করছিলাম আর কি?”
সমর আর প্রিয়ার রোম্যান্টিক মুহূর্তের কথা শোনার সাথে সাথে আবারো রিদিমার চোখে সেই ছবিটা চকচক করে ভেসে উঠলো। হৃদয়ের গহীনে হুট করে ঝংকার তুলে কি যে তাণ্ডব বয়ে গেল তা যেন ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য। সমর রিদিমার পাংশুটে মুখটা দেখে ফিক করে হেসে ফেললো। শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,
“ রিল্যাক্স! এতো দুখী হওয়ার কিছু হয় নি। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এসব রোমান্টিসিজম কমন ব্যাপার।”
“ আমি শুনবো।”
সমর চমকে তাকালো। পাশের ল্যাম্প শেড টেবিলে রাখা চশমা টা চোখে পরে বলল,
“ ওকে, আমার কাছে এসো।”
রিদিমা সায়ন কে টপকে সমরের কাছে একদম গা ঘেঁষে বসলো। সমর বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বলতে আরম্ভ করলো,
“ বাবার সিদ্ধান্তের উপর এক প্রকার জেদ খাটিয়েই প্রিয়া আর আমি বিয়েটা করেছিলাম। প্রিয়ার মা রঙ্গন আর কয়েকজন কাছের বন্ধুরা মিলে আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছিল। প্রথমে রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে বিয়ে তারপর কালীঘাটের মায়ের মন্দিরে গিয়ে মালা বদল করে সিঁদুর দান। ব্যস!
ভেবেছিলাম, যেহেতু আমি মা বাবার একমাত্র ছেলে তাছাড়াও গোটা পরিবারের একমাত্র ওয়ারিশ। তাই বিয়েটা হয়ে গেলে বাবা আর না মেনে থাকতে পারবে না। হয়তো একটু আধটু রাগ দেখাবে তারপর ঠিকই মেনে নেবে। কিন্তু হলো তার ঠিক উল্টোটা। আমার আজও মনে আছে বাবার সেদিনের সেই রূঢ় ব্যবহার। সেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবার মুহূর্ত গুলো।”
বলেই সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো সমর। রিদিমা সমরের গা ঘেঁষে হাঁটু জড়িয়ে বসে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে পরবর্তী কাহিনী শোনার আশায়। কয়েক মুহূর্তের স্মৃতি চারণ শেষে সমর আবারো বলতে আরম্ভ করলো,
“ বিয়ে হবার এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও বাড়ি থেকে কোনো রকম আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে প্রিয়ার মা বলল আমাদের একবার বাড়িতে যাওয়া উচিত। বাবা মায়ের অমতে যেহেতু বিয়েটা হয়েছে তাই তাদের রাগ অভিমান হওয়াটা স্বাভাবিক। আমি আর প্রিয়া তার দিন দুয়েক পর রওনা হলাম আমার বাড়ির উদ্দেশ্যে ।
সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল! রাত প্রায় নটার সময় বাস এসে পৌঁছল স্ট্যান্ডে। বাস থেকে নামতে নামতেই আমি আর প্রিয়া ভিজে একশা হয়ে গেলাম। তারপর একটা রিক্সা নিয়ে রওনা হলাম বাড়ির পথে। রাত সাড়ে নটা। বাড়ির গেটে এসে রিক্সা দাঁড়ালো। আমি ভাড়া মিটিয়ে প্রিয়া কে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে কলিং বেল বাজালাম।
চলবে….
#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
৩৬( দ্বিতীয় অংশ)
আমাদের বরাবরই যৌথ ফ্যামিলি ছিল। দাদু ঠাম্মা বাবা ছোটকা মা কাকিয়া আদরের ছোট ছোট দুটো বোন লাবনী আর অবনী আর তাদের একমাত্র বড় দাদা আমি। আমার দুজন পিসি তাদেরও বিয়ে হয়েছিল পাশের গ্রামে। আচার উৎসবের আয়োজনে তারা সব সময় হাজির হতো একডাকে। পিসিরা পিসতুতো ভাই বোনরা সবাই যখন একসাথে হতাম কি যে আনন্দ উল্লাস হতো তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব না। এতটাই সুখ ভরা সচ্ছল পরিবার ছিল আমাদের। এতটাই আনন্দ মুখর বাতায়ন ছিল এককালে। তারপর একসময় হঠাৎ ব্যবসায় লস হয়ে হার্ট এ্যাটাক করে দাদুভাই মারা গেল। সবাই ভাবলো এবার বুঝি দুই ভাইয়ের হাড়ি আলাদা হবে। সংসার আলাদা হবে। ব্যাবসা বাণিজ্য ও আলাদা আলাদা হয়ে যাবে। কিন্তু বাবা আর ছোটকা সেটা হতে দিলো না। দুই ভাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই ব্যবসার হাল তুলে নিলো নিজেদের কাঁধে। যদিও মৃত্যুর আগে দাদুভাই তার সব কিছু তার ছেলেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়েছিলেন। তারপর দুই ভাইয়ের যৌথ উদ্যোগে আমাদের ব্যবসা যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল। সামান্য একটা ছোট গুমটি ঘর থেকে ধীরে ধীরে সেটা হয়ে উঠলো বড় হোলসেল দোকান।
বাবা বরাবরই চাইতো আমি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ব্যবসার হাল ধরি। দরকার হলে বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে অন্য ব্যবসা শুরু করি। কিন্তু আমার চোখে তখন অন্য রকম নেশা। কলকাতার মতো এত বড় শহরের বড় ইউনিভার্সিটি তে পড়ার রঙিন স্বপ্ন দেখছি দিনরাত। তাই বাবাকে সরাসরি জানালাম ওসব ব্যবসা ট্যাপসা এই মুহূর্তে আমার দ্বারা হবে না। কারণ আমি আরও পড়তে চাই। বাবা রাগারাগি করলেও রাজি হয়েছিল শেষমেশ। কিন্তু পড়তে এসে এভাবে প্রেমের ফাঁদে পা দেবো সেটা বাবা কল্পনাও করতে পারেনি। তার উপর আবার পালিয়ে গিয়ে প্রিয়া কে বিয়ে করেছিলাম বলে বাবার যে আমার প্রতি সীমাহীন ঘৃণা জন্ম নিয়েছিল তা আমি বুঝতেই পারিনি। তাই সেদিন রাতে প্রিয়া কে নিয়ে ভিজতে ভিজতে যখন বাড়িতে পৌঁছলাম সেদিন মা দরজা খুলে বাইরেই আমাদের থামিয়ে দিয়েছিল। আর তার থেকে আসা প্রথম প্রশ্নটা ছিল,
“ দাঁড়াও! কার অনুমতিতে এই বাড়িতে ঢোকার সাহস দেখিয়েছ তুমি?”
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে মিন মিন করে বলেছিলাম,
“ মা আমি প্রিয়া কে বিয়ে করেছি। এই যে তোমাদের বৌমা।”
মা সাথে সাথে রাগী চোখে তাকিয়ে হুংকার ছুড়ে বলেছিল,
“ খবরদার, তোমার ওই নোংরা মুখ দিয়ে কক্ষনো আমাকে মা বলে ডাকবে না। আর বৌমা কাকে বলছো? কি ভেবেছো তুমি! যাকে তাকে ধরে এনে বাড়িতে নিয়ে হাজির হলেই তোমার চৌদ্দ গুষ্টি তাকে মেনে নেবে? তাই সরাসরিই বলছি যেখান থেকে এসেছো সেখানেই ফিরে যাও। যেদিন তুমি এবাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়ে ওই মেয়ের হাত ধরেছো সেদিনই তোমাকে ত্যাগ করেছি আমরা।”
আমি মায়ের এই রাগের কারণ জানতাম। আর এটাও জানতাম সে আমার উপর মাত্রাতিরিক্ত অভিমানের করেছে বলেই সে এমন আচরণ করছে। আমি ছুটে গিয়ে মা কে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। অনেক অনেক বার ক্ষমা চাইলাম। বললাম,
“ ভুল হয়ে গেছে এবারের জন্য অন্তত মাফ করে দাও।”
ঠিক সেই মুহূর্তে ঘর থেকে বাবা তর্জন গর্জন করে ছুটে এলো। এক মুহূর্তও দেরি না করে ঘাড়ের ঘেঁটি ধরে বের করে দিলো বাইরে। না আমার একটা কথা শুনলো আর না একটা বার বোঝার চেষ্টা করলো আমরা এই রাতের বেলায় যাবো কোথায়?
আসলে বাবা চিরকালই প্রচন্ড রাগী আর জেদি। তাই তার সাথে আমার সেভাবে কোনোদিনও সখ্যতা গড়ে ওঠে নি। যতটুকু না বললে নয় সেটুকুই কথা হতো আমাদের মাঝে। বলতে পারো আনুষ্ঠানিকতার সম্পর্ক ছিল আমাদের। ওনার অতিরিক্ত রাগ জেদ তেজ সবটাই ছিল আমাদের বাপ ছেলের মধ্যের দূরত্বের কারণ।
কিন্তু ছোটকা আলাদা ছিল। আমি ছিলাম তার খুব ন্যাওটা। তার সাথে ছিল আমার গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বলতে গেলে একপাতে এক ভাতে খাওয়া দাওয়া টাইপ সম্পর্ক। কিন্তু কলকাতায় পড়তে আসার সুবাদে সেই সম্পর্কও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল একসময়। কথা হতো না। হলেও ওই কোনরকম কেমন আছিস ভালো আছিস ওই পর্যন্তই হতো। আমার কলকাতা পড়তে আসার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ছোটকার। কারণ সেই বাবাকে রাজি করিয়েছিল। আসলে বাবা সবার কথা ফেলে দিলেও তার কথা ফেলতে পারতো না। কারণ ছোটকা এমন সুন্দর করে যুক্তি দিয়ে বোঝাতো যা ফেলা বাবার পক্ষে সম্ভব হতো না। সেই আমি যখন কলকাতায় পড়তে এসে এসবে জড়িয়ে ছিলাম। আমার এই অধঃপতনের কাহিনী শুনেছিল মনে মনে ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল ছোটকা। অথচ আমি বোকা তখন নিজের দুনিয়ায় এতটাই মগ্ন ছিলাম যে আশেপাশের মানুষের কষ্ট গুলো চোখের সামনে দেখেও অনুধাবন করতে পারি নি। তো যাইহোক, ছোটকা আমাদের সেই রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলো পরিচিত হোটেলে। তারপর বাবাকে খুব করে বোঝালো যাতে আমাকে আর প্রিয়া কে মেনে নেয়। তাছাড়া ভুল যখন করেই ফেলেছি তখন সেটাকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে লোক হাসিয়ে কি লাভ। তার চেয়ে বরং মেনে নেওয়া ভালো। তাতে ছেলে ও হাতের মুঠোয় থাকবে আর তার সাথে ছেলের বউ ও। বাবা দোনোমনা করেও শেষ মেষ মেনে নিলো ছোটকার কথা। বাবা আমাদের মেনে নিলো। তবে সেই মেনে নেওয়ায় ও বাবার শর্ত ছিল। শর্ত গুলো ছিল ঠিক এরকম,
১) আমাকে সেদিনের পর থেকে বাবার দোকানে বসতে হবে তবে মালিকের ছেলে হিসেবে নয় কর্মচারী হিসেবে।
২) আমার বউয়ের সমস্ত ভরণ পোষণ আমাকেই টানতে হবে। এখানে পরিবার থেকে কেউ আমাকে একবিন্দুও সাহায্য করবে না।
৩) উনার কথা অনুযায়ী আমাকে উনার সমস্ত আদেশ পালন করতে হবে তাও বিনা প্রশ্নে।
এবং
৪) প্রিয়া কে বাড়ির বউয়ের মতো সব রকমের দায়দায়িত্ব পালন করতে হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্না বান্না থেকে শুরু করে সমস্ত ঘরের কাজে মা কাকিয়াকে সাহায্য করতে হবে। সবার সাথে সম্মান পূর্বক কথা বলতে হবে। কারও সাথে ঝগড়া করা যাবে না। মুখে মুখে তর্ক করা যাবে না। উড়নচণ্ডীর মতো এদিক সেদিক বিনা অনুমতিতে যাওয়া যাবে না। জিন্স আর সব আধুনিক পোষাক আশাক একদমই পরা যাবে না। সব সময় শাড়ি পরতে হবে। আর ভাসুর শ্বশুর কিম্বা বাইরের কোনো পুরুষ মানুষ দেখলেই মাথায় কাপড় তুলে ঘোমটা দিতে হবে। যাকে বলে পুরোপুরিই সংস্কারী গৃহ বধূ।
আমি জানতাম বাবার এসব শর্তের আসল কারণ কি? উনি আমার উপর মাত্রাতিরিক্ত রেগে থাকলেও কৌশলে আমাকে ব্যবসার কাজে লাগিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন জীবনে প্রেম নয় পয়সা বেশি দামী। আর ওদিকে প্রিয়ার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে ওর আসল মনোভাব বুঝতে চেয়েছিলেন। কারণ আমাদের এই যৌথ ফ্যামিলি তে যেকোন মেয়ের পক্ষে এতোটা চাপের মধ্যে টিকে থাকা সহজ ব্যাপার ছিল না। মূলত ওকে পরীক্ষা করার জন্যই যে এই শর্ত গুলো দেওয়া সেটা আমি পরে বুঝেছিলাম।
তো সেই শর্তে রাজি হয়ে দুদিন পর আমরা বাড়িতে ফিরলাম। প্রথম দিন থেকেই আমার গাধার খাটুনি শুরু হয়ে গেল। ওদিকে প্রিয়ার সঙ্গে শুরু হলো শর্ত অনুযায়ী সমস্ত আচরণ। বাবা আমাকে কলুর বলদের মত দোকানের কর্মচারী বানিয়ে খাটুনির কাজে লাগিয়ে দিল। বাড়িতে প্রিয়া কে। দেখতে দেখতে সময় যত কাটতে লাগলো কাজের চাপ যেন ততই বাড়তে থাকলো। হুট করে এত কাজের চাপ সামাল দিতে আমার যতোটা না কষ্ট হচ্ছিল তার চেয়ে দ্বিগুণ কষ্ট হচ্ছিল প্রিয়ার। ওর না ছিল ভোরে ওঠার অভ্যাস আর না ছিল ঘরের কাজ করার অভিজ্ঞতা কিম্বা রান্না বান্নার কাজ সামলানোর দক্ষতা। ফলত সব কাজেই শুধু ভুল আর ভুল। আর সেই ভুল গুলোকে কেন্দ্র করে শুনতে হচ্ছিল বকা ঝকা কড়া কথা। তাই নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই রাগারাগি হতে শুরু করলো আমাদের মাঝে।”
সমর হাসলো। বলল,
“ ভাবো একবার, যার বেলা এগারোটায় ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস ছিল তাকে উঠতে হতো ভোর সাড়ে পাঁচটায়। তা নিয়ে রাগ হবে না? ভীষণ রাগ হবারই কথা! ওই শীতের ভোরে উঠে চা বানানো টা রীতিমত যুদ্ধের মত ছিল সবার কাছে। অথচ দায়িত্ব টা মা ইচ্ছে করেই প্রিয়ার জিম্মায় সপে ছিল। কারণ ভোরেই আমাদের দোকানের জন্য মাল বোঝাই লরি আসতো বিভিন্ন জেলা থেকে। তাই প্রায় রোজই বাবা কাকাকে বেরোতে হতো গোডাউনের উদ্দেশ্যে। তাছাড়া রান্না বান্না ঘরের নানাবিধ কাজ সেসবও করতে হতো মা কাকিয়াদের সাথে হাত মিলিয়ে। যার কারণে আমাদের মধ্যে তিক্ততা যেন দিনের পর দিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল।”
সমর থামলো। তাকালো রিদিমার সরল নিষ্পাপ মুখটার দিকে। মেয়েটা হাঁটুর উপর থুতনী গেঁথে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে তাকে। সমর চোখ ঘুরিয়ে ফলস্ সিলিং এর দিকে তাকালো। বলল,
“ বারান্দায় চলো রিদিমা। আর শুতে ইচ্ছে করছে না। খোলা বাতাসের গন্ধ নিতে নিতে না হয় বাকি টুকু শেষ করি!”
রিদিমা মাথা টা দিদিকে কয়েকবার নাড়িয়ে সম্মত হলো। অতঃপর শাড়ির আঁচল টা গুছিয়ে হেঁটে গেল সমরের পিছু পিছু। বারান্দায় দুটো সুন্দর বেতের কাউচ রাখা। একটায় বসলো সমর। আরেকটায় রিদিমা। সমর পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট টা বার করতেই রিদিমার কপাল কুঁচকে গেল। সে বলল,
“ আপনি কি স্মোক করবেন এখন!!”
“ একটা খাই! না হলে এনার্জি পাচ্ছি না।”
বলেই সিগারেট টা কামড়ে ধরলো সমর। তারপর দুহাতের সাহায্যে দেশলাই জ্বেলে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“ তুমি কি জানো আজ কতগুলো বছর পর এতো কথা বলছি আমি। পাঁচ বছর। পুরো পাঁচ টা বছর পর আমি মন খুলে এতো কথা বলছি। অথচ তুমি কিছুতেই আমাকে তুমি তুমি করে ডাকতে পারছো না।”
বলেই কেমন করে যেন মুখটা করে রাখলো মানুষটা। ওদিকে সমরের প্রথম কথায় অবাক হলেও পরের কথায় রিদিমা হেসে ফেললো। আলতো করে লজ্জারুন হাসি হেসে বলল,
“ সরি অভ্যেস হয়ে গেছে। এবার থেকে মনে রাখবো। কিন্তু তারপরে কি হয়েছিল? প্লীজ বলো না!!”
সমর চোখের চশমার ফাঁক দিয়ে রিদিমার উচ্ছ্বাস দেখে ঠোঁট চেপে হাসলো। তারপর আবার বলতে আরম্ভ করলো,
“ কথায় আছে জোড়নে পরলে প্রেমের ভূত লেজ গুটিয়ে পালায়। প্রিয়ার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। আমি কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে ওকে যতো সময়ই দিতাম না কেন ওর অভিযোগের শেষ ছিল না। আমার সাথে কথা বলতো না। কাছে গেলে ছুঁতে দিতো না। সারাক্ষণ রাগারাগি অশান্তি ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকতো আমাদের মধ্যে। দেখতে দেখতে প্রায় মাস ছয়েক কেটে গেল। এরই মধ্যে একদিন অশান্তি তুঙ্গে উঠলো। ও রাগারাগি করে কলকাতায় ওর মায়ের কাছে ফিরে এলো। যাবার সময় বলে গেল ও আর কোনোদিন এই নরকে ফিরবে না। আমি ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়লাম। বাবা মায়ের সাথে এনিয়ে তুমুল অশান্তি করলাম। তারপর হুট করেই বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হলাম। বাবা মা এবং বাড়ির সমস্ত লোকজন তাদের ভুল বুঝতে পারল। আমাকে খুঁজে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। কথা দিলো এর পর থেকে আর কক্ষনো আমাদের সাথে কোনো রকম খারাপ আচরণ তারা করবে না। আমি ভীষণ খুশি হয়ে ওকে আনতে যাই। কিন্তু সেখানে ওদের না পেয়ে আমার মাথায় যেন বাজ পড়লো। আসেপাশে ওদের সর্ম্পকে খোঁজ করলে জানতে পারি ওরা সেই ভাড়া বাড়িটা নাকি অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। আমি প্রিয়া কে উন্মাদের মত করে খুঁজেছিলাম জানো। গোটা কলকাতা শহর চষে ফেলেছিলাম। কিন্তু ওদের পাই নি।
এভাবেই দেখতে দেখতে কেটে গেল প্রায় একটা বছর সময়। এর মধ্যে প্রিয়া আর আমার সাথে একদিনও কন্ট্যাক্ট করে নি। ফোন নম্বর টাও বদলে ফেলায় আমিও পারিনি ওর সাথে কোনো রকম কনট্যাক্ট করতে। আমি শোকে দুঃখে তখন প্রায় পাগলের দশা। না ঠিক মত খাই দাই না ঠিক মত কারো সাথে কথা বলি। শুধু পাগলের মতো ছুটে আসি কলকাতায় তাকে খুঁজে পাওয়ার আশায়। আমার ওই ভয়ংকর দিন গুলোতে সোমেন আর রঙ্গন সব সময় ছায়ার মতো পাশে ছিল। ওরা সব সময় আমাকে বোঝাতো, ভরসা দিতো, আগলে রাখতো। ঠিক সেই সময় টা থেকেই এই সিগারেট খাওয়ার নেশা টা অভ্যেসে পরিণত হলো। আমার দিনের পর দিন এই অধঃপতন দেখে বাবা মায়ের অবস্থা খুবই করুণ হয়ে গেছিল। বাবার রাগ তেজ জেদ ও যেন মাটিতে মিশে একাকার হয়ে গেছিল আমার এমন ভাঙা চোরা অবস্থা দেখে। সত্যি বলতে আমার ওই অবস্থার কারণে গোটা পরিবারের সুখ শান্তি সব কিছু এক নিমেষেই নষ্ট হয়ে গেছিল।”
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো শেষ করে সিগারেটে শেষ টান দিলো সমর। অতঃপর ওটা ছুঁড়ে ফেলল দূরে। আর ওদিকে সমরের প্রিয়ার প্রতি এত ভালোবাসা দেখে রিদিমার হৃদ গহীনে কি যে অসহ্য দহনের দাবানল জ্বলে উঠলো তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। সমর আবারো বলতে শুরু করলো,
“ তারপর হঠাৎ একদিন প্রিয়ার দেখা পেলাম। তাও আবার ইউ টিউবের এক ভিডিওতে। কোনো এক হিন্দি অ্যালবামের গানে অ্যাকটিং করছে। সেটা আবার ভালোই ভাইরাল হয়েছে নেট দুনিয়ার জগতে। আমার মাথা হ্যাং হয়ে গেল ওকে ওই রুপে দেখে। সেদিন থেকেই ওকে খোঁজা শুরু করলাম। প্রায় মাস খানেকের প্রচেষ্টায় পেয়েও গেলাম। ওকে পেয়ে আমার সেকি আনন্দ। ওকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত করে কেঁদে ফেলেছিলাম আমি। ওহ্, কতটা বোকা আর আবেগী ছিলাম সেসময় আমি ভাবলেই হাসি পায় এখন।”
বলেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে উঠলো সমর। রিদিমা সেই হাসিটাও দেখলো জ্বলন্ত অঙ্গার সম হৃদয় টাকে কোনো মতে সামলে নিয়ে।
“ কিন্তু আমার কান্নার কোনো প্রভাবই ওর উপর পড়েছিল না সেদিন। আমি ওর পায়ে পড়ে দিনের পর দিন কেঁদেছি। ওর কাছে হাজার হাজার বার ক্ষমা চেয়েছি এমন কি আমার বাবা মা এসেও ওর পায়ে ধরেছিল। কিন্তু ও ফিরে আসে নি। কিন্তু তারপরও আমি নাছোড়বান্দার মতো ওর পেছনে পড়ে ছিলাম। যাকে বলে জোকের মতো। ও শেষ মেশ বিরক্ত হয়ে আমাকে কড়া শর্ত দিলো। শর্ত অনুযায়ী ও আর কোনোদিন ওই নরকে ফিরবে না তবে আমি চাইলে ও আমার সাথে সম্পর্ক রাখবে। তবে সম্পর্কে থাকা অবস্থায় ওকে যেমন কোনো কাজে যেমন বাঁধা দেওয়া যাবে না ঠিক তেমনই ওকে দিয়ে কোনো কাজ জোর করে করানোও যাবে না। আর হ্যাঁ মাসে মাসে হাজার বিশেক টাকা করে সংসার খরচ পাঠাতে হবে। আমি এতটাই উন্মাদ ছিলাম যে কোনকিছু না ভেবেই ওর সেই শর্তে এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। কারণ সেদিন আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তাকে জীবনে ফিরে পাওয়া। তবে সেই ফিরে পাওয়ার মূল্য আমাকে নিদারুণ ভাবে দিতে হয়েছিল।”
বলেই উঠে দাঁড়ালো সমর। পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া অস্তারগের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অতঃপর গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“ আমি বাড়ি ফিরে নতুন উদ্যমে নেমে পড়লাম কাজে। বাড়িতে ওর শর্তের কথা চেপে গিয়ে ব্যবসার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলাম। বাবা মা ছোটকা কাকিয়া সবাই ভীষণ অবাক হয়ে গেল হুট করে আমার মাঝে পরিবর্তন দেখে। যদিও ওরা বুঝতে পেরেছিল আমার আর প্রিয়ার সম্পর্ক ঠিক হয়ে গেছে। তবুও ওরা অপরাধ বোধের কারণে একবারও বলার সাহস করে নি তাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার কথা বলতে। যাইহোক, আমি সপ্তাহের পাঁচদিন ব্যবসা সামলাতাম আর বাকি দুদিন থাকতাম কলকাতায় প্রিয়ার কাছে। শর্ত অনুযায়ী ওকে ওর মতো সমস্ত রকমের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিলো আমার পক্ষ থেকে। কিন্তু তবুও কেন যেন ওর ওই বাইরের ছেলেদের সাথে চিপকা চিপকি রাতের পর রাত বাইরে কাটানো এদিক সেদিক শুটিংয়ের জন্য চলে যাওয়া এগুলো একদমই সহ্য হতো না। আবার কিছু বলে বারণ করবো সেটাও পারতাম না। তাই কৌশল খাটিয়ে চেষ্টা করলাম ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধতে। কিন্তু ও বড্ড চালাক ছিল। হয় পিলস্ খেয়ে ফেলত আর নয়তো আমাকে থামিয়ে দিতো। এভাবেই চলতে চলতে একসময় আমি সফল হলাম। ওর শত বাঁধার পরও আমার অংশ এলো ওর মাঝে। কিন্তু ও বুঝতে পারার সাথে সাথে ওর ক্যারিয়ার আর শর্তের কথা মনে করিয়ে দিয়ে নিশবিবাদে এবরশন করিয়ে ফেলল। না আমার একটা কথা শুনলো না একটা বারণ। আমি সেদিন নিজের অংশ কে হারিয়ে যেমন ভেঙে পড়েছিলাম ঠিক তেমনি প্রথম বার ওর প্রতি আমার মনে তিক্ততা জন্মেছিল। তারপর কেটে গেল প্রায় আরও ছয় মাস। তখন ২০২০ এর শুরু। ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই কোরোনা ভাইরাস সম্পর্কে সবার মধ্যে চাপা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে একটু একটু করে। তার কয়েকদিন পর হুট করেই লক ডাইন হয়ে গেল। মানুষ হলো পুরোপুরি ঘর বন্ধ। আর গোটা পৃথিবী তখন কোভিড এর কবলে। সেই কোভিডে প্রথম দফায় হুট করে প্রিয়ার মা মারা গেলেন। ওর শরীরেও পাওয়া গেল পজেটিভ ভাইরাস। কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় এলাকার মানুষ এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়লো যে ওকে এলাকা থেকেই তাড়িয়ে দেওয়া হলো। সেই সময় আমি ওকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসি। সবাই ওকে খুবই আন্তরিকতার সাথে মেনে নেয়। তারপর শুরু হয় আমাদের সংসার জীবন। ধীরে ধীরে আমাদের আবার নতুন করে ভালোবাসা হয়। দ্বিগুণ ভালোবাসা দিয়ে ওকে জড়িয়ে নিই আমার বুকের ভেতরে। সদা সর্বদা সচেষ্ট থাকি যাতে আর কোনোদিন মেয়েটা কষ্ট না পায়। ওই লক ডাউন সবার জন্য দুঃসময় হলেও আমাদের জন্য ছিল অনাবিল সুখের মুহূর্ত। প্রিয়া সেই লক ডাউনের মধ্যেই আবার কনসিভ করে। তারপর ২০২১ সালের জানুয়ারি তে আমার সায়নের জন্ম হয়। ছেলে বউ নিয়ে আস্ত একটা পরিবার পেয়ে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। বাবা মা কাকা কাকিয়া আত্মীয় স্বজন সকলের মধ্যে তখন খুশির জোয়ার। কিন্তু কে জানত আমার সেই খুশির মেয়াদ মাত্র কয়েক মাসের ছিল। তখন আমার সায়নের বয়স মাত্র ছয় মাস। হঠাৎ একদিন প্রিয়া বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। যাবার সময় নিয়ে গেল মায়ের সতের ভরি সোনার গহনা আর পাঁচ লাখ টাকা নগদ ক্যাশ। আর আমার জন্য রেখে গেল একটা সাইন করা ডিভোর্স পেপার আর একটা চিঠি। যেখানে লেখা ছিল, সে আমার সাথে আর সংসার করতে ইচ্ছুক নয়। আর না এই বাচ্চা কাচ্চা মানুষ করতে। কারণ তার জীবনের লক্ষ্য আলাদা আর স্বপ্নও আলাদা। তাছাড়া সোনার গহনা আর পাঁচ লাখ টাকা ও আমার ছেলে জন্ম দেওয়ার বিনিময়ে নিয়ে গেছে। তাই সায়নের প্রতি আজকের পর থেকে ওর কোনো অধিকার আর নেই।”
বলেই কথার ইতি টানলো সমর। আর ওদিকে বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে এক নজরে তাকিয়ে রইলো রিদিমা। ওর নিজের মনেই প্রশ্ন জাগলো, আচ্ছা এমন মাও কি পৃথিবীতে হয়? যে কিনা তাকে এভাবে অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়?
চলবে….