তুই যখন ছুঁয়ে দিলি মন পর্ব-৩+৪

0
15

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: #নিতু_সরকার
পর্ব:৩

প্রবল ঝড় ওঠার আগে চারিদিকে যেমন পিন ড্রপ সাইলেন্স তৈরি হয়, অথবা হৈ চৈ ভরা ক্লাসরুমে শিক্ষক ঢুকলে মুহুর্তেই শান্ত হয়ে যায় চারিদিক। ঠিক তেমনি একটা কাটকাট হিম শীতল নীরবতার বেড়াজালে একেবারে হুট করেই জড়িয়ে গেল সমর আর রিদিমা উভয়ে। দুজনই যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো একে অপরকে দেখে।
মিসেস চিত্রা সমর আর রিদিমা কে ওভাবে কথা বলতে শুনে মনে মনে ভাবলেন বোধ হয় পূর্ব পরিচিত হবে দুজনে। তাই একে অপরকে বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে দেখে হেসে বললেন,
‘ ও মা, তোরা একে অপরকে চিনিস নাকি?’

ওই মুহূর্তে কিংকর্তব্য বিমূঢ় সমর মায়ের কথার কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারলো না। মিসেস চিত্রা বললেন,
‘ যাক গে ভালোই হয়েছে তোরা আগে থেকে পরিচিত। আয় তোকে আরেকবার পরিচয় করিয়ে দিই। এ হলো রিদিমা, দাদুভাইয়ের সেই ম্যাম। যার জন্য তোর ছেলে সকাল থেকে নাওয়া খাওয়া সব বন্ধ করে দিয়ে বসে আছে।”

“ ম্যাম …?”

অপাঙ্গ কোণে প্রবল বিস্ময়। খেই হারিয়ে গেছে ভাবনার। সমর যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না এই মেয়েই তার ছেলের সেই ম্যাম!!
ওদিকে রিদিমার ও যেন সেই একই অবস্থা। যে লোকটা তাকে মাত্র কিছুক্ষন আগে ঠগ বাজ মেয়ে বলে লোকজনের মাঝে অপমান করেছিল তার বাড়িতেই কি না এতক্ষণ বসে ছিল সে?

“ রিদিমা বলেছে কাল থেকে পড়াতে আসবে।”

‘ আ’ম সরি আন্টি! আমি সায়ন কে পড়াতে পারবো না।’

সমর যেন রোবটের মত ঘুরে তাকালো রিদিমার মুখের দিকে। উজ্জ্বল শ্যামাননে ঝলসে ওঠা আত্ম সম্মানের জ্বলন্ত তেজ টা যেন বড্ড বেশি চোখে লাগলো সমরের। বিকেলের ঘটনার রেশ ধরে যে মেয়েটার এই সিদ্ধান্ত বুঝতে অসুবিধা হলো না তার। ওদিকে মিসেস চিত্রা ভীষণ অবাক হলেন রিদিমার এমন কথায়। বিস্ময়ে হত বুদ্ধি হয়ে জিগ্গেস করলেন,
‘ ওমা সেকি! কেন?’

তেজদীপ্ত চোখের ভয়ঙ্কর চাহনি ছুঁড়ে সমরের দিকে তাকালো রিদিমা। তাচ্ছিল্যের উপহাস টুকু কণ্ঠে ঢেলে সে বলল,
‘ জানেন আন্টি, কিছু কিছু মানুষের মানুষ চেনার ক্ষমতা ভয়ংকর রকমের প্রশংসনীয়। আমি ভয় পাচ্ছি, পড়াতে এসে আবার চোর বদনাম নিয়ে বাড়ি ফিরতে না হয়! তবে এই মুহূর্তে আপনি চাইলে আমার ব্যাগ চেক করতে পারেন। আমি কিছু মনে করবো না।’

রিদিমার কথা গুলো শুনে মিসেস চিত্রা রীতিমত স্তব্ধ হয়ে গেলেন,
‘ রিদিমা! এসব তুমি কি বলছো মা।’

রিদিমা এবার তাচ্ছিল্য ভরা হাসলো। মাথাটা খানিক নিচু করে বলল,
‘ বেয়াদপি নেবেন না আন্টি, আমি যা বলছি ভেবেই বলছি। আপনারা চাইলে আমার ব্যাগ টা সত্যিই চেক করে দেখতে পারেন।’

রিদিমার কথার অর্থ মিসেস চিত্রার মাথার উপর দিয়ে গেল। কি হচ্ছে কি চলছে সব যেন তার বোঝার বাইরে। তিনি ছেলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
‘ বাবু কি হচ্ছে এসব?’

সমর ও ওই মুহূর্তে কি বলবে সহসা বুঝে উঠতে পারলো না। তবে তার এটুকু বুঝতে বাকি নেই বিকেলের সেই ঘটনার কারণে মেয়েটা ক্ষেপে একাকার হয়ে গেছে। ওদের মা ছেলের কথার মাঝে রিদিমা আর দাঁড়ালো না। ব্যাগ টা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলল,
‘ আন্টি আমি সত্যিই দুঃখিত সায়ন কে পড়াতে না পারার জন্য। আমার কোনো অযাচিত আচরণ যদি আপনার মনের কষ্টের কারণ হয় তাহলে আমাকে অবুঝ ভেবে ক্ষমা করে দেবেন। আসছি।’

বুলেটের মতো ক্ষিপ্র গতিতে কথাগুলো শেষ করে গট গট শব্দে হেঁটে বেরিয়ে এলো প্রচন্ড আত্মঅভিমানী মেয়েটা। আর সেদিকে ভীষণ রকম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো স্বচ্ছ চশমার আড়ালের ঢাকা এক জোড়া বাদামী মনির চোখ। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ন সময়ের এক সুবিশাল পথ প্রবঞ্চনা নামক এক বিষাক্ত কাঁটার আঘাতে জর্জরিত হয়ে কাটানোর পর নারী অস্তিত্বের প্রতি প্রগাঢ় ঘৃণা আর অবিশ্বাস জন্মেছে সমরের মনে। প্রিয় মানুষটার আঘাতে দগ্ধ হওয়া হৃদয়টা পুড়তে পুড়তে একসময় সেটা হয়ে গেছে অনুভূতি হীন, নিষ্প্রাণ! পাথর।
প্রিয় নারীর কাছ থেকে পাওয়া অবিশ্বাস গুলো তাকে এমন ভাবে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে, যে পরবর্তিতে সে আর পারেনি সেই ভঙ্গুর অবস্থা থেকে পূনরায় সেই আগের মতো হতে। ফলাফল স্বরূপ তার এই অব্যর্থ পরিবর্তন। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত যত নারীই তার নজরে পড়েছে প্রত্যেক কে সে মেপেছে সেই একই মাপকাঠি দিয়ে।
লোভী! স্বার্থপর! আর বিশ্বাসঘাতিনি ছাড়া আর কোনো প্রতিশব্দ তার অভিধানে অবশিষ্ট নেই কোনো নারীর জন্য। কিন্তু আজ যেন রিদিমার এমন প্রত্যাখ্যান প্রচন্ড ভাবে নাড়িয়ে দিয়ে রেখে গেল সমরের মনের গহীনে বিগত চার বছরের শ্রম দিয়ে গড়া শক্ত পোক্ত মজবুত নারী বিদ্বেষী ভিত টা।
তবে রিদিমার পক্ষ থেকে ধেয়ে আসা প্রবল আক্রোশ দেখে সমর খানিক বিস্মিত হলেও তার প্রস্তরীভুত মনে কোনো রকম অনুশোচনার অনুভূতি তৈরি হলো না। বরং রাগের পারদ স্বভাব সিদ্ধ ভাবে আরও বাড়লো গুণোত্তর হারে। তাইতো রিদিমা বেরিয়ে যেতেই কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলে উঠলো,
‘ তার মানে এই তারছেড়া মেয়েটা সায়নের ম্যাম? এই ড্রামাকুইন কে তুমি কোথা থেকে ধরে নিয়ে এসেছো বলোতো?”

মিসেস চিত্রা ছেলের প্রশ্নের জবাব দিলেন না। কারণ তিনি বোধ হয় বুঝে ফেলেছেন ঘটনাটা কী হতে পারে। নিশ্চয়ই তার ছেলেই এমন কোনো বাজে ব্যবহার করে রেখেছে যার জন্য মেয়েটা এভাবে চলে গেল। সমর মায়ের শুকনো মুখ দেখে আর কথা বাড়ালো না। সায়ন কে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে চলে গেল নিজের ঘরে।

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তপন বাবুর আসতে বেশ খানিক দেরি হয়ে গেল। ততক্ষণ পর্যন্ত আবাসনের গেটের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো রিদিমা। বিকেলের সেই অপমান টা মনে পড়লে এখনও মাথা থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত রি রি করে জ্বলে যাচ্ছে তার। জ্বিভের ডগা চুলকে যাচ্ছে আরেকটু কথা শোনানোর জন্য।

রিদিমা মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে ঘড়ির টাইম টা দেখে নিচ্ছিল বারে বারে। ঘড়ির কাঁটা বর্তমানে রাত নটা পঁয়তাল্লিশ এর ঘরে। সামনের সড়ক পুরো পুরি ফাঁকা। মাঝে মাঝে দু একটা চার চাকার গাড়ি হুশ হুশ শব্দ তুলে ছুটে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে পৌরসভার স্ট্রিট লাইট গুলো জ্বলছে। সব কিছুতে ছড়িয়ে পড়েছে মৃদু লালচে আলোর প্রলেপ। বৃষ্টি এখনও থামেনি। ফিস ফিস করে পড়ছে। গেটের সঙ্গে লাগোয়া পার্কিং এ একটা চেয়ার পেতে বসে আছে দারোয়ান। তার সূক্ষ্ম দৃষ্টি রিদিমার মেয়েলি দেহের ভাঁজে ভাঁজে।

পাঁচ তলার ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সমর। যেখানে রিদিমা দাঁড়িয়ে অপেক্ষায়মান। তার নজরটাও গেঁথে ঠিক সেদিকে। যতোই সে নারী বিদ্বেষী হোক এতো রাতে একটা মেয়েকে এভাবে একাকী দুর্যোগের মধ্যে নিরাপত্তা বিহীন ভাবে রাস্তায় ফেলে রাখতে পারে নি তার অনুভূতিহীন পাষাণ মন। তাইতো রুমের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল অন্ধকারময় ব্যালকনিতে। বলতে গেলে অদৃশ্য নিরাপত্তার অন্তর্জালে ঘিরে রেখেছিল বিকেলের সেই ঝগড়ুটে অপরিচিতা কে। এমন সময় তার চোখ পড়লো গেটে এসে দাঁড়ানো এক বাইকের উপর। তাতে বসে একজন রেইনকোট পরা ভদ্রলোক। রিদিমা মাথায় ওড়না তুলে ব্যস্ত পায়ে লোকটার বাইকে উঠে বসলো। অতঃপর তার মিনিট খানেক বাদে চলে গেল ফাঁকা রাস্তার বুক চিরে। রিদিমাদের গাড়িটা চোখের আড়াল হতেই আস্তে ধীরে ঘরে ঢুকলো সেই পাষাণ মানব।
_____

পরদিন সকাল। সমর যথারীতি নিজের ব্যক্তিগত জিমে শরীর চর্চা সেরে একেবারে শাওয়ার শেষ করে ঢুকলো বসার ঘরে। আজ মায়ের মুখ খানা একদম গম্ভীর। টু শব্দ টা ও করছে না মনের ভুলে। সমর চুমকির দিকে তাকালো। খুবই ধীর কণ্ঠে বলল,
‘ মার কি হয়েছে রে! সকাল থেকে দেখছি একদম চুপ!’

চুমকি ঈষদুষ্ণ লেবুজলের গ্লাস টা এগিয়ে দিয়ে তার মতো করেই ছোট গলায় জবাব দিলো,
‘ মা তো গত কাল রাত থেকেই কারো সাথে কথা বলছে না। আমার মনে হয় ওই ম্যাম কে নিয়ে যা হলো না কাল তার জন্যই এমন ভাবে গুম ধরে আছে।’

সমর মাথা দুলিয়ে সম্মত হলো। তার ব্যাপার টা বোঝা হয়ে গেছে। তাই আর মাকে বেশি ঘাটালো না। নিজের মতো কাজ গুছিয়ে একটু পরে রওনা হলো নিজের অফিসের উদ্দেশ্যে।

অফিস টাইম আর স্কুল কলেজের টাইম প্রায় এক হওয়ায় সকাল নটা থেকে দশটা পর্যন্ত সময় টুকু বাস ট্রেন অটো এরকম সব পাবলিক ট্রান্সপোর্ট গুলোতে চড়তে গেলে যেন কাল ঘাম ছুটে যায়। তাতে যদি হয় আষাঢ় মাস, তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই। পঁচা গুমোট ধরা গরমের সাথে প্যাঁচ পেঁচে ঘাম ফ্রী। সেই সাথে যদি হয় দম বন্ধ করা ভিড়, নাও হলো এবার ষোলো কলা পূর্ণ!!

ভিড় বাসে ঠেলা খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত কলেজের গেটে এসে বাস দাঁড়াতেই হুড়মুড় করে নামতে থাকলো কলেজ পড়ুয়াদের দল। সেই জনজয়ারে ভেসে রিদিমা ও নামলো বহু কষ্ট করে। ঘামে তার পুরো শরীর ভিজে চুপচুপ করছে। পরনের লাল রঙের ঘের ওয়ালা লংস্কার্ট টার যা তা অবস্থা। ঊর্ধাঙ্গের সাদা টপস্ টা সেটে গেছে গায়ের সাথে। গলায় আবদ্ধ রামধনু রংয়ের স্কার্ফ টা কে ঢিলে করতে করতে রিদিমা কলেজের ভেতরে ঢুকলো। তৎক্ষণাৎ দেখা হয়ে গেল তার বন্ধু মহলের সাথে। সীমা অভিষেক রিনি জবা আর কপিল ওরা সবাই মিলে কলেজের শ্রদ্ধেয় প্রতিষ্ঠাতার পাদদেশে দাঁড়িয়ে। ওকে দেখতেই ওরা হাত নেড়ে কাছে ডাকলো। রিদিমা তাদের নিকট পৌঁছতেই সবকটার মুখাবয়বে অদ্ভুত এক অভিব্যাক্তি দেখতে পেল। রিদিমা ইশারায় জানতে চাইলো,
“ তোরা সবাই এখানে কী করছিস? ক্লাসে যাবি না?
‘ আজ আমরা কলেজ বাংক করছি!’

অভিষেকের কথায় রিদিমা অবাক হয়ে বলল,
‘ কেন?’

জবাবে সীমা রিদিমার হাত চেপে ধরলো খপ করে। চোখে মুখে তার অদ্ভুত চাহনি! আনন জুড়ে কেমন যেন লাজের লালচে আভা। সে বড়ো ইতঃস্তত করে জানালো,
‘ রিদিমা! তোকে না একটা কথা জানানো হয় নি।’
‘ কি কথা?’
‘ বাবা না আমার জন্য পাত্র দেখেছে। আজ তার সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা উত্তরপাড়ায়।’
‘ আচ্ছা বুঝলাম!’
‘ আমি একা যেতে খুব ভয় পাচ্ছি রে। তাই তোরাও চল না প্লীজ।’

রিদিমা ভ্রূ কুঁচকে সীমার হাত টা ঝট করে ছাড়িয়ে নিলো। চোখ পাকিয়ে বলল,
‘ পাগল হয়েছিস? তোর প্রাইভেট টাইমে আমরা কেন থাকবো আশ্চর্য?”

সীমা অসহায় চোখে তাকিয়ে আবারো ওর হাতটা চেপে ধরলো।
‘ প্লীজ বান্ধবী আমার, ওভাবে বলিস না। তোরা আসেপাশে থাকলে আমি সাহস পাবো। তাছাড়া ওই লোকটা যদি আমার সাথে কিছু খারাপ করার চেষ্টা করে তাহলে তোরা আমাকে প্রটেকশন দিতে পারবি। চল না প্লীজ।”

রিদিমা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো সীমার দিকে।
‘ তুই না নাচে ডিপ্লোমা করতে চাইছিলি!!’

সীমা রিদিমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকালো। চোখে মুখে তার এক নিদারুণ ব্যথার ছাপ।
‘ বাবা মা মানছে না রে! আমি অনেক বার বলেছি আমার স্বপ্ন নিয়ে। ওদের বক্তব্য যা স্বপ্ন সব শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে যেন পূরণ করি!’
‘ তাদের সন্তানের স্বপ্ন তাদের কাছেই যেখানে মূল্যহীন সেখানে পরের কি ঠেকা পড়েছে নাকি তোর স্বপ্ন তারা পূরন করবে!!’

রিদিমার গতকালকের সেই ভাঁটা পড়া রাগটা আবারও চড়চড় করে চড়ে বসলো মস্তিষ্কে। কেন আমাদের সমাজ টা এমন? কেন আমাদের বাবা মায়েরা মেয়েদের ইচ্ছে অনিচ্ছেকে কোনো মূল্য দেয় না! তাদের দুচোখ ভরা স্বপ্ন গুলোকে দু পায়ে নির্দয়ের মতো দলে মুচড়ে শেষ করে দেয়। কেন? আজ যদি সীমা মেয়ে না হয়ে ছেলে হতো তাহলে ঠিকই তার স্বপ্ন পূরণ করতে তারা তাদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতো। যতদিন পর্যন্ত সে তার লক্ষ্যে জয়ী না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত তার পাশে ভরসার আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। হাহ!!
আজ আবারো আরেকবার এই শিক্ষিত সমাজ কি নিখুঁত ভাবে নারী স্বাধীনতার গলা টিপে হত্যা করলো। আজ আবারো নিজের পরিবার নিজের বাবা মা দ্বারা লুণ্ঠিত হলো আরও একটা মেয়ের দু চোখ ভরা স্বপ্ন! তার অদেখা সুন্দর ভবিষ্যৎ।
___________

সময় টা দুপুর। রাগের চোট সামলে বান্ধবীর সেই হবু বরের সাথে সবাই মিলে দেখা করতে এসেছে উত্তর পাড়ার একটা রেস্টুরেন্টে। গেট পেরিয়ে ঢোকার মুহূর্তে অভিষেক বলল,
“ শোন, সবাই একসাথে গিয়ে হাজির হলে ব্যাপারটা কিন্তু খারাপ দেখাবে। তার চেয়ে বরং সীমা যাক রিদি কে নিয়ে। আমি আর কপিল একদিকে বসবো রিনি আর জবা বসুক আরেক দিকে।”

রিদিমা সাথে সাথে নাকচ করে দিয়ে বলল,
“ এই না না আমি না প্লীজ। আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কেউ ওর সাথে যা।”
“ তুই এভাবে বলতে পারলি রিদি। আমি আরও তোর ভরসা এলাম।”

বলেই গোমড়া মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল সীমা। রিদিমার বিরক্তি যেন তাতেই বাড়লো। এমনিতেই কাঠ ফাটা রোধে ওর ঘিলু গরম করে দিয়েছে। তার উপর একটা অপরিচিত ছেলের সামনে গিয়ে অকারণে হ্যাংলার মতো বসে থাকতে হবে ভেবেই গা জ্বলে যাচ্ছে ওর। সীমা আবারো ওর হাত টা চেপে ধরলো। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে বলল,
“ তুই তো জানিস আমি কতটা বোকা। লোকটার কথার যদি ঠিকঠাক জবাব দিতে না পারি তখন??”

রিদিমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো অসহায় চোখে তাকিয়ে। এই মেয়ে যে তাকে কিছুতেই ছাড়বে না ওর বোঝা হয়ে গেছে। থপ করে হাত দুটো জোড় করে কপালে তুলে বলল,
“ চলুন মা জননী। আপনাকে আপনার গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে আসি।”

বলেই ধুপধাপ পা ফেলে আগে আগে ঢুকে গেল ভেতরে। “এই দাঁড়া আসছি” বলে ব্যাগের স্ট্রিপ টা চেপে ধরে দৌড়ে ভেতরে ঢুকলো সীমা। ওদের যাওয়ার খানিক পর কপিল আর অভিষেক ঢুকলো ভেতরে। তার মিনিট পাঁচেক পর ঢুকলো রিনি আর জবা।

বিশাল বড় রেস্টুরেন্টের তিন তলা টা সম্পূর্ন শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। সেখানে ঢুকেই গা ছমছম করে উঠলো সীমা আর রিদিমার। এতো বড় রেস্টুরেন্ট তারা এর আগে কখনও দেখেনি। নিচের দুটো ফ্লোরে এসি থাকলেও ততোটা সুসজ্জিত নয়। থার্ড ফ্লোরের এই বিশাল এলাকা জুড়ে বানানো এলিট ক্লাসের কক্ষ টা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানে সাধারণ মানুষের আসার ক্ষমতা সামর্থ নেই। ঘর টা কেমন ডার্ক ওয়েব সিরিজের ভিলেনদের বাড়ির অন্দরমহলের মতো শান্ত আর বিলাসিতায় ভরপুর। সীমা ভয়ে ইতিমধ্যে রিদিমার হাত চেপে ধরেছে। এরই মধ্যে ওর ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠলো। সীমা ফোন বার করে নম্বর টা দেখে বলল,
“ ওই লোকটা কল করেছে।”

রিদিমা ইশারায় বোঝালো ফোনটা রিসিভ করতে। সীমা করলো। ওপাশ থেকে একটা পুরুষ মানুষের গলা ভেসে এলো…
“ সীমন্তিনি আপনি কী পৌঁছে গেছেন?”
সীমা আমতা আমতা করে বলল,
“ হ..হ্যাঁ। এই মাত্র পৌছালাম।”
“ ঠিক আছে আপনি বসুন আমি পাঁচ মিনিটে ঢুকছি।”
সীমা ফোন টা কেটে আহত সুরে বলল,
“ পাঁচ মিনিট বসতে বলল। চ গিয়ে বসি।”

রিদিমা আর সীমা মিডিলের একটা টেবিলে গিয়ে বসলো। সাথে সাথে একজন সাদা পোশাক পরা স্টাফ এসে দাঁড়ালো ওদের পাশে।
“ গুড নুন ম্যাম, আমাদের রেস্টুরেন্টে আসার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে আপনাদেরকে আন্তরিক অভিনন্দন। বলুন, কী ধরনের খাবার খেতে পছন্দ করবেন? ফাস্ট ফুড এথেনিক ওর কন্টিনেন্টাল?”

এসব খাবারের নাম শুনে চোখ কপালে উঠলো সীমার। এগুলো কি ধরনের খাবার তা মনে মনে ভাবতেই মাথা ধরে এলো রিদিমার। ওদিকে ওয়েটার বলেই চলেছে,
“ চাইনিজ, কোরিয়ান, থাই, ইটালিয়ান, মেক্সিকান ক্র্যাব, প্রন….”

রিদিমা বিরক্তিতে কিড়মিড়িয়ে বলে উঠলো,
“ একগ্লাস জল। হবে?”

লোকটা থতমত খেয়ে গেল রিদিমার কথায়। মিনিট খানেক চুপ থেকে মাথা নেড়ে বলল,
“ হ্যাঁ অবশ্যই। আনছি।”

ওয়েটার জলের বদলে ঠান্ডা লেবু পুদিনার শরবত দিয়ে চুপ চাপ চলে গেল। সীমা গ্লাস টা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলল,
“ দেখলি জলের বদলে শরবত ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। এবার এটার বিল কে দেবে শুনি?”
“ সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। ওটা না হয় আমিই বুঝে নেবো।”

হঠাৎ পুরুষ কন্ঠ শুনে সীমা আর রিদিমা ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঠিক তখনই চোখের সামনে এসে দাঁড়ালো এক সুঠাম দেহী সুদর্শন যুবক। ক্যাজুয়াল ইন করা শার্টে বেশ মানানসই সাজ। চোখে রোদ চশমা। সীমা আবারো রিদিমার হাত টা চেপে ধরলো উত্তেজনায়। লোকটা বসতে বসতে বলল,
“ আপনারা বসুন প্লীজ।”

ওরা বসলো। লোকটা চোখ থেকে চশমা টা খুলে বলল,
“ হায়! আমি রঙ্গন। আপনিই সীমন্তিনী রাইট!”

বলেই তাকালো সীমার দিকে। ফর্সা টুকটুকে সীমা ততক্ষণে আবারো লাল হয়ে উঠেছে লাজের কারণে। হাত পায়ের কাঁপাকাঁপির চোটে ঠিক করে বসতেও পারছে না বেচারী। সীমা কোনোমতে মাথা নেড়ে সায় জানালো। রঙ্গন বোধ হয় ওর অস্বস্তি বুঝতে পেরে বলল,
“ সীমন্থিনী আপনার বোধ হয় পিপাসা পেয়েছে। প্লীজ শরবত টা খেয়ে নিন।”

সীমা দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে শরবত টা খেয়ে নিল। আহ্! ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত টা খাওয়ার পর ওর মনে হলো সত্যিই ওর অনেক জোর পিপাসা পেয়েছে। রিদিমা তখনও চুপ চাপ মাথা নিচু করে বসে। বান্ধবীর হবু বর যাকে দেখার ওর বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই। লোকটা আসতেই সেই যে একবার তাকিয়ে ছিল তারপর আর চোখ তুলে দেখেনি।

“ সরি রে লেইট হয়ে গেল।”
বলেই সেখানে হন্তদন্ত হয়ে সেখানে ঢুকলো সমর। রঙ্গন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো বেচারা। বন্ধু কে দেখে হাসি মুখে উঠে দাঁড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো।

“ যাক তাহলে এলি অবশেষে। আমি ভেবেছিলাম তুই আসবি না। এনি ওয়ে, আয় পরিচয় করিয়ে দিই ইনি সীমন্তিনি আর উনি হলেন ওনার বান্ধবী।”

সমর দৃষ্টি ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই থম মেরে গেল সাথে সাথে। রঙ্গনের হবু ফিয়ন্সের পাশে বসে আছে কালকের সেই অপ্রত্যাশিত ভাবে পরিচয় হওয়া ঝগড়ুটে অপরিচিতা এবং ছেলের না হওয়া ম্যাম ও।

ওদিকে রিদিমার অবস্থাও তথৈবচ। যে লোকটা তাকে ভরা বাজারের গিজগিজে ভিড়ের মাঝে ঠগ বাজ মেয়ে বলে অপমান করেছিল সেই লোকটা আবারো তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে…। কি জ্বালা!
রাগে দুঃখে বিরক্তিতে রিদিমার মনে হলো এক্ষুনি গঙ্গা সাগরে ঝাঁপ দিতে। কিন্তু সে নিরুপায়। ঝাঁপ দিয়ে লাভ নেই। কারণ সাঁতার জানে না। এই মুহূর্তে আরও একবার নতুন করে মরে যেতে ইচ্ছে হলো সাঁতার না পারার দুঃখে। গা কিড়মিড়িয়ে ওঠা অস্বস্তি টুকু কোনো মতে সামলে মনে মনে বলে উঠলো,
” এই লোকের কি আর যাবার জায়গা নেই বাল। যেখানেই যাই সেখানেই পেছন পেছন চলে আসে।”

চলবে….

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: #নিতু_সরকার
পর্ব:৪

“ তোদের প্রাইভেট কথার মধ্যে আমার কী কাজ। তার চেয়ে বরং তোরা কথা বল। আমি এদিকটায় বসছি।”

রঙ্গনের পাশে না বসে খানিক দূরের একটা ফাঁকা সোফায় গিয়ে গা এলিয়ে বসলো সমর। রঙ্গন সমর কে আর ঘাটাল না। ও যে এসেছে এই অনেক। কি দরকার পাগল কে নাড়ানোর! তার চাইতে বরং নিজের মতো না হয় থাক। নয়তো দেখা যাবে কিছু শুনে হুট করেই মেজাজ গরম হবে। আর তারপর উল্টো পাল্টা কথা শুনিয়ে দিয়ে নিজের মতো বেরিয়ে যাবে। রঙ্গন সীমার দিকে এবার মনোযোগ দিয়ে তাকালো। মা তাহলে ঠিকই বলেছিল। মেয়েটা আসলেই ভীতু। তবে পাক্কা সুন্দরী। একেবারে চোখে লেগে থাকার মতো সুন্দর। রঙ্গন মনে মনে হাসলো। মায়ের চয়েস আছে বলতে হবে। বিয়ে করতে রাজি হচ্ছি না দেখে এমন একটা মেয়ে চয়েস করলো যাকে দেখে না কথাটা যাতে উচ্চারণ করতে না পারি। রঙ্গন সীমার নত করে রাখা লাজুক মুখটা দেখে বলল,
“ সীমন্থিনী, আর ইউ ওকে?”

সীমা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেও ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে এলো ভয়ে। রঙ্গন পাশে বসা রিদিমা কে ঈশারা করে দেখিয়ে বলল,
“ উনি কে, মানে আপনার বোন না কি..”
“ বেস্ট ফ্রেন্ড।”
“ ওহ্!”

রঙ্গন রিদিমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“ হায়, আমি রঙ্গন।”

রিদিমা একমনে ফোন স্ক্রল করছিল। সীমা পা দিয়ে খোঁচা দিতেই সামনে তাকিয়ে খানিক টা অপ্রস্তুত হয়ে হাসলো। স্মিত হেসে বলল,
“ মাফ করবেন, আমি আসলে খেয়াল করিনি।”

তারপর বাড়িয়ে রাখা হাত টার দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলল,
“ নমস্কার, আমি রিদিমা! রিদিমা সেন।”

রঙ্গন হাত টা সরিয়ে নিয়ে রিদিমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে ফেলল। কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকতেই চোখে মুখে বিস্ময় ছড়িয়ে বলল,
“ আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি মনে হচ্ছে! ভীষণ চেনা চেনা লাগছে আপনাকে!”

রঙ্গন কে প্রথম দেখায় রিদিমার নিজেরও কেমন যেন চেনা চেনা লেগে ছিল। তবে কনফিউশনটা মুহূর্তেই কেটে গেছিল ওই অভদ্র লোকের দেখা পেয়ে। যাইহোক, সেকথা তো আর বলা যাবে না। তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে কেবলই ঠোঁট ছড়িয়ে হাসলো সে। বোকা বোকা এক ধরনের হাসি থাকে না এটা হলো সেই ধরনের হাসি। যে টা হাসতে গিয়ে এতো বিরক্ত লাগলো রিদিমার। ঠিক তখনই ওকে ওই চরম বিড়ম্বনা থেকে বাঁচাতে সামনে এসে দাঁড়ালো একজন ওয়েটার। রঙ্গন সাথে সাথে ব্যস্ত হলো খাবার অর্ডার করতে। মিনিট পাঁচেক পর ওয়েটার অর্ডার গুলো লিখে নিয়ে চলে গেলে রঙ্গন এবার সীমার দিকে তাকালো। মেয়েটার ঠোঁটের কোণে ভেসে ওঠা সূক্ষ্ম লাজের রেখা টুকু দেখে বলল,
“ তারপর সীমন্তিনী, বলুন পড়াশুনো বাদে আপনার আর কি কি পছন্দ?”

সীমা লজ্জায় ভয়ে এতোটাই আঁকড়ে ছিল যে রঙ্গনের প্রশ্নের জবাবে তেমন কিছুই বলে উঠতে পারলো না। ওদিকে রিদিমা চুপ করে বসে নিজের মতো করে ফোন টিপছিল দেখে টেবিলের নিচ দিয়ে আবারো হামলা চালালো সীমা। পূনরায় পায়ে গুতো খেয়ে আবারো লাফিয়ে উঠলো রিদিমা। পরস্পর পরস্পরের সাথে চোখাচুখি হতেই সীমা বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে ইশারায় বলল,
“ প্লীজ বন্ধু, আমার হয়ে তুই জবাব টা দিয়ে দে। দেখ না উনি কেমন করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি।”

রিদিমা দাঁত কিড়মিড় করে সীমার দিকে তাকালো। চোখের ইশারায় সেও জানালো,
“ পাগল হয়েছিস। উনি তোর সাথে কথা বলতে এসেছেন। তোর হবু বর উনি। এসবের মধ্যে আমাকে কেন জড়াচ্ছিস ?”

সীমা তাও নাছোড়বান্দা। করুণ চোখের চাহনি ছুঁড়ে মন প্রাণ উজাড় করে বোঝাতে চাইলো,
“ বোঝার চেষ্টা কর বান্ধবী। আমি এর আগে কক্ষনো কারো সাথে এভাবে কথা বলিনি। ভীষণ আন ইজি ফিল করছি। প্লীজ, এ বারের মতো ম্যানেজ করে দে। আর কোনোদিন তোকে জ্বালাতন করবো না। প্রমিজ!”

ওদের চোখে চোখে কথার বলার মাঝে সমর গলা খাঁকারি দিলো। সাথে সাথে নড়ে চড়ে বসলো সীমা। রঙ্গনের চোখে চোখ পড়তেই খানিক লজ্জিত ও হলো মেয়েটা। রিদিমা ও লজ্জায় চুপ করে বসে রইলো। ঠিক তখনই কানে ভেসে এলো কিছু শব্দের ধার,

“ আমার মনে হয় তোদের দুজনের একটু প্রাইভেসি নিয়ে কথা বলা উচিত। বিয়ের আগে উভয়ের মতামত স্পষ্ট হওয়া জরুরি। আফটার অল সংসারটা তোরা করবি।কোনো থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার নয়।”

সমরের ঠোঁট কাটা কথা গুলো শুনে লজ্জায় হাঁসফাঁস করে উঠলো রঙ্গন। যদিও সে আসলেই একটু প্রাইভেসি চাচ্ছিল মনে মনে। তবে রিদিমা থাকায় তাদের ততটাও অসুবিধা হচ্ছিল না। ওদিকে কথা গুলো যে ওকেই মিন করে বলা হয়েছে সেটা বুঝতে আর বাকি রইলো না রিদিমার। অসভ্য লোকটা তাকে ইন্ডাইরেক্টলি এদের মাঝখান থেকে উঠে যেতে বলছে। আবারো সবার সামনে এভাবে অপমান করায় রিদিমার মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। থমথমে চোখ মুখ জুড়ে চেপে বসলো মানহানির রক্তিম আভা।
মনটা যেন সহসাই চিৎকার করে বলে উঠলো, যা রিদিমা যা! ছুটে গিয়ে পা থেকে জুতো খুলে বসিয়ে দে বসিয়ে দে কয়েক ঘা ওই অসভ্য ম্যানার লেস লোকটার গালে। কিন্তু আফসোস পারলো না। রাগ আর অপমানের তিতকুটে শ্লেষ টুকু ঢোক চিপে গিলে নিয়ে ফট করে উঠে দাঁড়ালো। মুখে স্বচ্ছ হাসি টেনে সীমা কে বলল,
“ তোরা কথা বল, আমি এক্ষুনি আসছি।”

সীমা রিদিমার হাত টেনে ধরলো। থমথমে চোখে তাকিয়ে বলল,
“ কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
“ আরে বাবা ভয় পাচ্ছিস কেন? দূরে কোথাও যাচ্ছি না। আসে পাশেই থাকবো আমি। তুই ডাক দিলেই চলে আসবো।”
“ না তুই কোথাও যাবি না।”
রিদিমা হাত ছাড়িয়ে বলল,
“ পাগলামী করিস না সীমা।”
“ ওর কথা বাদ দিন তো। আমাদের আসলেই সমস্যা হচ্ছে না রিদিমা।”
রিদিমা রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে স্বচ্ছ হাসলো। মোবাইল আর ব্যাগ টা টেনে নিয়ে বলল,
“ কিন্তু আমার হচ্ছে।”

বলেই কাঁধে ব্যাগটা তুলে বেরিয়ে চলে গেল মেয়েটা। রিদিমা কে বেরিয়ে যেতে দেখে রঙ্গনের এতো খারাপ লাগলো। সেই সাথে সমরের উপর বিরক্তও হলো খুব। দিনের পর দিন ছেলেটা কেমন যেন রসকষ হীন উগ্র হয়ে যাচ্ছে। মুখের ভাষা মাধুর্যতা হারিয়ে হয়ে উঠেছে কর্কশ। রঙ্গন রিদিমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এককালে কত হাসি খুশি ছিল ছেলেটা। ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি ছিল যার সর্বক্ষণের সঙ্গী। অথচ কালের বিবর্তনে দেখো আজ তার কি করুণ পরিণতি।

ইতিমধ্যে কেটে গেছে প্রায় চল্লিশ মিনিট সময়। রঙ্গন আর সীমার আলাপ ও তখন শেষের পথে। বান্ধবী কে অপমানিত হয়ে চলে যেতে দেখে সীমা এতক্ষণ ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বসে ছিল। কিন্তু যেই লাঞ্চ এসে হাজির হলো সেই ও উঠে দাঁড়ালো।
“ কি হলো?”
সীমা কাঁধে ব্যাগ টা তুলে নিয়ে বলল,
“ আই অ্যাম সরি রঙ্গন বাবু আমার পক্ষে এখানে থাকা আর সম্ভব হবে না।”
“ কেন?”
“ এই মাত্র মনে পড়লো আমার ইমারজেন্সি কাজ আছে চলি।”
“ ওয়েট। দাঁড়ান, আমি আপনাকে লাঞ্চ না করে কিছুতেই যেতে দেবো না।”
“ আপনি বুঝতে পারছেন না রঙ্গন বাবু।”
“ আমি সব বুঝেছি। তবুও আপনাকে আর আপনার বান্ধবী কে না খাইয়ে আমি কিছুতেই যেতে দেবো না। এনি ওয়ে, আপনার বান্ধবী কে ডাকুন। বলুন আমাদের প্রাইভেট আলাপ শেষ হয়ে গেছে।”

সীমা সাথে সাথে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কল লাগালো রিদিমার নম্বরে। বেশ কয়েকবার রিং হতেই রিদিমা ফোন টা তুলে বলল,
“ সীমা আমি বাসে আছি রে।”
“ কিহ্! বাসে?
“ হ্যাঁ রে, শরীর খারাপ লাগছিল খুব।”
সীমা ভালো করেই জানে কেন রিদিমা চলে গেছে। মেয়েটা বরাবরই একটু আত্মসম্মানি। সম্মানে আঘাত লাগলে সে আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ায় না। এই কারণেই তো এতক্ষণ ও চিন্তায় ছটফট করছিল। তবুও মিছে রাগ দেখিয়ে বলল,
“ দিস ইজ নট ফেয়ার। তুই আমাকে এভাবে একা ফেলে চলে যেতে পারলি?”
রিদিমা ফুস করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। ছোট ছোট শব্দের ভাঁজে অপমানের ঝাঁঝ টুকু মিশিয়ে বলল,
“ বোকার মতো কথা বলিস না সীমা। তুই জানিস আমি কেন চলে এসেছি।”
রিদিমা আর কিছুই বলল না। তবে যা বোঝার সীমা বোধ হয় বুঝে নিলো। তাই আর কথা না বাড়িয়ে কেটে দিলো ফোনটা। অতঃপর সেটা টেবিলে রেখে উদাস নয়নে তাকিয়ে রইলো জানালার বাদামি রঙের কাঁচের দিকে। রঙ্গন সীমার মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটার উদাসী মুখটা দেখে কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল,
“ সীমন্তিনী, ইজ এভরিথিং অলরাইট? আপনার বান্ধবী কখন আসবে?”
“ ও বাড়ি চলে গেছে।”
“ হোয়াট?”
রঙ্গন হতবাক হয়ে গেল রিদিমা বাড়ি ফিরে গেছে শুনে। ওদিকে রিদিমার চলে যাওয়ার কথা শুনে চমকে উঠলো সমর। ওদের কে একটু প্রাইভেসি দিতে বলেছিল বলে মেয়েটা যে এভাবে চলে যাবে সে আসলেই ভাবতে পারে নি।

“ সেকি কেন?”
সীমা রঙ্গনের দিকে কেমন করে যেন তাকালো। গলার সুরে বিষাদ মিশিয়ে বলল,
“ রিদিমার ভীষণ আত্মসম্মান বোধ। কেউ ওর সম্মানে আঘাত করে কথা বললে ও একদমই সেটা মেনে নিতে পারে না।”
রঙ্গন সাথে সাথে তাকালো সমরের দিকে। সমরের ও কানে গেল সীমার বলা কথা গুলো। তার কথাতেই যে মেয়েটা রাগ করে বাড়ি চলে গেছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রঙ্গনের সাথে চোখাচোখি হতেই দেখলো সে থমথমে মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সমর ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখিয়ে আবারো ঘাড় এলিয়ে দিলো সোফাতে। অথচ কেউ জানতেও পারলো না কঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী মেয়েটার আত্ম সম্মান বোধ টা তার কয়েক বছরের মরচে ধরা নারী বিদ্বেষী ভীতের গোড়া নাড়িয়ে দিয়েছে।

চলবে….