তুই যখন ছুঁয়ে দিলি মন পর্ব-৯+১০

0
14

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
#নিতু_সরকার
পর্ব:৯
জনরা : রোম্যান্টিক সমকালীন

“ মা দেখেছো ওই মেয়ের কতো বড় সাহস। এখনও বিয়ে হয় নি তাতেই তার এই তেজ। বিয়ের পর কি হবে ভাবতে পারছো!”

রমার কথার প্রত্যুত্তরে মিসেস রিতা জবাব দিলো না। মুখ টা ভার করে ভাবলো অনেক কিছু। তৃপ্তীশ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ মা দেখো এই মুহূর্তে এতো কিছু আগাম চিন্তা না করাই ভালো। আমার মনে হয় আমরা একটু বেশিই প্রেশার দিয়ে ফেলছি ওকে।”

ছেলের কথায় মিসেস রিতার নজর ঘুরে গেল বিস্ময়ে। ছেলেটার বদল তার চোখে আটকালো। কিন্তু তাৎক্ষণিক কিছুই বলতে পারলো না। রমা মুখ বাঁকালো। তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“ সেকি রে ভাই, তুই তো দেখছি বিয়ের আগেই বউয়ের গোলাম হয়ে গেছিস। তা কতো টাকায় বেঁচলি নিজেকে!”
“ দিদি, এবার কিন্তু একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে।”
“ বেশি টা আমি না তুই করছিস। ওই মেয়ের সাহস হয় কি করে মায়ের কথা অমান্য করে ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়ানোর।”
“ তুই অত শত নিয়ে না ভেবে নিজের চরকায় তেল দে। আমি আর মা আছি এসব নিয়ে ভাবার জন্য।”
“ হ্যাঁ সে তো দেখতেই পাচ্ছি।”
“ তুই…..”

“ আহ্ থামবি তোরা!”
মিসেস রিতার এক ধমকে তৃপ্তীশ থেমে গেলেও রমা থামলো না। সে মুখ বাঁকিয়ে তৃপ্তীশ এর দিকে আড় চোখে তাকিয়ে গলার ঝাঁঝ তুলে বলল,
“ ভাবিস না বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতে চলে গিয়েছি বলে এবাড়িতে আমার কোনো দাম নেই। এবাড়িতে আমার দাপট পাঁচ বছর আগে যেমন ছিল পাঁচ বছর পরও ঠিক তেমনই আছে বুঝেছিস।”

মিসেস রিতা মেয়ের দিকে কড়া চোখে শাসালেন। ধমক দিয়ে বললেন,
“ রমা, বক বক না করে ঘরে যা। দেখ জামাই বাবার কিছু লাগবে কিনা।”.

রমা মুখ ভার করে উঠে দাঁড়ালো। তারপর হন হন করে হেঁটে চলে গেল ঘরে। জামাই ষষ্ঠী উপলক্ষে বাপের বাড়িতে এসেছে সে। কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল ভায়ের বিয়ের ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর নেওয়া। ভাই টা তার বড্ড বোকা। বন্ধুর বিয়ে খেতে গিয়ে মেয়ে পছন্দ করে চলে এসেছে। মিসেস রিতা ছেলের দিকে তাকালেন। ভার কণ্ঠে বললেন ,
“ শুধুমাত্র এইকটা দিন। বিয়ের পর কিন্তু এসমস্ত একদম বরদাস্ত করবো না বলে দিলাম।”
তৃপ্তীশ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। অতঃপর, মায়ের হাত দুটো ধরে বলল,
“ তুমি একদম চিন্তা করো না মা। একটা বার শুধু বিয়ে টা হতে দাও। ওর সমস্ত তেজ ভেঙে গুঁড়িয়ে তোমার পায়ের নিচে যদি না বসিয়ে রেখেছি তো আমারও নাম তৃপ্তীশ না।”
মিসেস রিতা মনে মনে খুশি হলেন ছেলের কথা শুনে। তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন,
“ থাক হয়েছে। এখন যা আমি ঘুমুতে যাবো।”

*
আজ হাঁফ কলেজ করে বাস স্ট্যান্ডে হাজির হয়েছে সকলে। উদ্দেশ্য চ্যাটার্জী স্যারের বাড়িতে যাওয়া। জবা আর রিনির হাতে বড় বড় দুটো ফুলের বুকে আর রিদিমার হাতে ফলের ডালা। সীমার হাত খালি দেখে রিদিমা নিজের ব্যাগ টা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বিরক্ত হয়ে বলল,
“ ধুর, একটা অটো ডাকতে এতো সময় লাগে নাকি!”
“ জানিস ই তো ছেলেদের আঠারো মাসে বছর। দেখ গিয়ে কারো সাথে গল্প করতে শুরু করেছে হয়তো।”

জবার কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়লো রিনি।
“ ঠিক বলেছিস। আমার বাবাও এমনটা করে। যে কাজেই পাঠাও না কেন সে কাজেই লেট। শেষে খোঁজ নিলে জানা যায় তিনি কারো সাথে গল্প করতে গিয়ে দেরি করে ফেলেছেন।”

রিদিমা জিন্সের পকেট থেকে ফোন টা বার করে অভিষেকের নম্বরে কল লাগালো। কিন্তু বার বার রিং বেজে কেটে গেলেও ফোন তুলল না ছেলেটা। অগত্যা বিরক্ত হয়ে বলল,
“ চল তো সামনে এগিয়ে দেখি। কোথায় গেল ওরা।”
“ এই রোদের মধ্যে!!”

বলেই নাক সিটকে উঠলো বাকি তিনজন। রিদিমা হতাশার শ্বাস ফেলে বলল,
“ বেশি ন্যাকামি করিস নাতো। বিকেল সাড়ে তিনটে বাজে। এই সময় রোদের তেজ থাকে!”

বলেই ছাউনির নিচ থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে রাস্তায় হাঁটা ধরলো রিদিমা। বাকি তিনজন একে অপরের মুখ দেখে বেরিয়ে এলো মেয়েটার পিছু পিছু। তবে বেশিদূর হাঁটতে হলো না। তখনই সেখানে অটো নিয়ে হাজির হলো অভিষেক আর কপিল। রিনি ওদের কে দেখে রাগে বিরক্তিতে খিটমিটিয়ে উঠলো,
“ এক অটো রিক্সা ডেকে আনতে কারো আধ ঘন্টা সময় লাগে তোদের না দেখলে বিশ্বাসই হতো না।”
“ করিস না বিশ্বাস। তুই বিশ্বাস না করলে আমাদের কিছু এসে যায় না। সামান্য আধ ঘন্টা দাঁড়িয়ে ওনার কষ্টে গা জ্বলে যাচ্ছে। ওদিকে আমরা যে এই রোদের মধ্যে সেই চৌমাথায় মোড় থেকে অটো ডেকে নিয়ে এলাম তার বেলা।”

অভিষেকের ক্যাটকেটে কথায় রিনি গাল ফুলালেও আর একটা কথাও বাড়ালো না। আসলেই তো! ওরা এতক্ষণ ছায়ায় বসে রেস্ট নিলেও বেচারা ছেলে দুটো অনেক কষ্ট করেছে। চৌমাথার মোড় কলেজ থেকে নয় নয় করে তাও প্রায় হাফ কিলোমিটার দূরে। এতো টা দূর গিয়ে অটো ডেকে আনা টা যাইতাই ব্যাপার ও না। রিদিমা ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ এখানে অটো পাস নি।”
“ না রে। আসলে ছুটির টাইমের আগে এরা কলেজ মোড়ে আসে না।”

ওহ্ বলে রিদিমা সবাই কে তাড়া দিলো উঠে পড়ার জন্য। বড় অটো হওয়ায় ছয় জন আগে পিছে করে আরামসে বসে পড়লো। তারপর ধুলো উড়িয়ে রওনা হলো স্যারের বাড়ির পথে।

*
বাড়ির কলিং বেল টা বাজতেই বিরক্তিতে দাঁত খিচলো তুলি। সবে মাত্র চোখ মেয়েটা ঘুমোতেই চোখ লেগে এসেছিল ওর। কিন্তু বিধি বাম। হেমন্ত তুলির বিরক্ত চেহারা দেখে বলল,
“ তুমি শোও আমি দেখছি।”
বলেই ক্রাচ টা বগল দাবা আস্তে আস্তে ওঠার চেষ্টা করলো। তুলি আর শুয়ে থাকতে পারলো না। কপাল থেকে হাত সরিয়ে উঠতে উঠতে বলল,
“ তুমি বসো। ব্যালেন্স হড়কে পড়ে গেলে আবার আরেক সমস্যা হবে।”

হেমন্ত উঠতে গিয়েও আর উঠলো না। তুলি নাইটির উপর একটা ওড়না চাপিয়ে চলে গেল বাইরে। দরজা খুলতেই চমকে উঠলো কয়েকটা অপরিচিত মুখ দেখে। রিদিমা রিনি জবা সীমা অভিষেক আর কপিল। ওরা স্যারের মিসেস কে আগে কখনও দেখে নি। তবে সোসালমিডিয়ার বদৌলতে তুলি তাদের মুখ চেনা। তাই সকলে হাত জোড় করে সমবেত ভাবে প্রণাম জানালো। অভিষেক বলল,
“ নমস্কার ম্যাডাম। আমরা স্যারের স্টুডেন্ট। আমি অভিষেক আর ওরা আমার বন্ধু। স্যার আছেন বাড়িতে।”

তুলি কিছু বলতে যাবে তার আগেই হেমন্তের গলা ভেসে এলো,
“ আরে তোমরা। এসো এসো ভেতরে এসো।”

স্ক্র্যাচে ভর দিয়ে দাঁড়ানো স্যারকে দেখে সকলেরই মুখ শুকিয়ে গেল কষ্টে। আহ্ হা রে, কি হাসিখুশি ছটফটে মানুষটা আজ পঙ্গু হয়ে গেছে। তুলি রিদিমা সহ ওদের সবাইকে ডেকে ড্রয়িং রুমে বসালো। রিদিমা রিনি আর জবা ওরা ফুল আর ফলের ডালা স্যারের সামনে রেখে চুপ চাপ গিয়ে বসলো সোফায়। হেমন্ত প্লাস্টার করা পা টা কাচের টি টেবিলে তুলে সোফায় বসলো কোনরকমে। তুলি কে ডেকে বলল,
“ ওদের জন্য একটু ঠান্ডা শরবতের ব্যাবস্থা করো।”

তুলি মাথা নেড়ে চলে গেল রান্না ঘরে। রিনি স্যারের দিকে তাকিয়ে ছিল এক নজরে। প্লাস্টার করা পা টা দেখছিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সেদিকে এক পলক তাকিয়ে হেমন্ত বলল,
“ তো তোমাদের পড়াশুনা কেমন চলছে বলো।”
“ ওই চলছে স্যার। আপনি নেই তাই ক্লাস করতে ভালো লাগে না।”

জবার কথায় হেমন্ত হাসলো।
“ এসব কথা বললে তো চলবে না মামনি। সামনে তোমাদের ইয়ার ফাইনাল। পড়াশুনা তো করতেই হবে।”
“স্যার আপনি কবে সুস্থ হবেন?”

সীমার কথায় মুখটা মুখটা ছোট হয়ে গেল হেমন্তের। ও পায়ের প্লাস্টার টা দেখে বলল,
“ এটা আশাকরি সামনের মাসে কাটা হবে। তবে প্লাস্টার কাটার সঙ্গে সঙ্গেই স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারবো না। আমার সুস্থ হতে হতে তোমাদের এক্সাম শেষ হয়ে যাবে বাবু।”

রিদিমা রিনি জবা সীমা সবার মুখটা কালো হয়ে এলো আর স্যারের ক্লাস করা হবে না ভেবে। হেমন্ত ওদের অন্ধকার মুখ টা দেখে প্রসঙ্গ বদল করলো। অভিষেকের পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,
“ তো অভি বাবু, গ্র্যাজুয়েশন তো শেষ প্রায়। এর পরের প্ল্যান কি হুম্?”

অভিষেক মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকে বলল,
“ স্যার বিসিএস এর জন্য ভর্তি হয়েছি।”
“ বাহ্ খুব ভালো। আর কপিল তোর খবর কি?”

কপিল একসপ্তাহের শেভ না দাড়ি চুলকে বলল,
“ স্যার ওসব পড়াশুনো আর আমার দ্বারা হবে বলে মনে হয় না। তাই ভাবছি, পরীক্ষা শেষ হলেই বাবার ব্যবসায় ঢুকবো।”
“ সেটাও ভালো ডিসিশন। অ্যাট লিস্ট বসে না থেকে উপার্জনের পথে অগ্রসর হওয়া উচিৎ। যেহেতু ভবিষ্যতে একটা আস্ত পরিবার সামলানোর দায়িত্ব যেহেতু নিতে হবে। কি ঠিক বলিনি!”
“ একদম ঠিক বলেছেন স্যার। উপার্জন না করলে হবে। ভবিষ্যতে বউ টেকাতে হবে না!”

বলেই মুখ চেপে হেসে ফেলল জবা। জবার কথা শুনে বাকিরা ও হেসে উঠলো শব্দ করে। কপিল জবার দিকে কটমট করে তাকালো। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল,
“ শেষ পর্যন্ত সেই তো গিয়ে কাকুর গলায় ঝুলবি তাই আমার বউ টিকবে কি টিকবে না ওসব নিয়ে তোর ভাবতে হবে না।”
“ কি বললি তুই…!”

আসন্য ঝগড়ার পরিস্থিতি বুঝে হেমন্ত ওদের থামালো। হাত উচু করে বলল,
“ হয়েছে হয়েছে। থামো তোমরা।”

ওরা থামতেই হেমন্ত হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এর পর নজর ঘুরিয়ে সীমার দিকে তাকালো। সবার মতো তাকেও জিজ্ঞেস বলল,
“ তো সীমন্তিনী তোমার কি প্ল্যান এক্সামের পরে।”

কপিল সেই মুহূর্তে মাড়ির গজদাঁত গুলো বার করে হেসে উঠলো। সীমার দিকে তাকিয়ে রসিয়ে রসিয়ে বলল,
“ স্যার বললাম না ওদের গন্তব্য ওই কাকু পর্যন্ত।”

হেমন্ত অবাক হয়ে বলল,
“ মানে!”
“ মানে হলো গিয়ে স্যার, মামনির বাড়ির লোক ইতিমধ্যেই ওর জন্য কাকু খুঁজে দিয়েছে। এক্সামের পরেই ও আমাদের সবার কাকিমা হয়ে যাবে। তারপর আর কি, পড়াশুনা সব কিছু ডকে তুলে কাকুর প্রাইভেট অফিস সামলাবে।”
“ কপিল, এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে।”
“ থাম তুই।”

জবার কথায় পাত্তা দিলো না কপিল। মুখ ভেটকে গা এলিয়ে দিলো সোফাতে। হেমন্ত সীমার দিকে তাকালো। মেয়েটার অবসাদে ডোবা মুখটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ বিয়েটা অপরিহার্য সীমন্তিনী। যেহেতু এর সাথে আমাদের বাড়ির সবার একটা ইমোশন জড়িয়ে থাকে। সেখানে আমরা চাইলেও কিছুই করতে পারি না। সুতরাং তুমি মন খারাপ করো না বাবু।”

সীমা স্যারের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। হেমন্ত এবার রিদিমার দিকে তাকালো। ভ্রূ উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ তো রিদিমা, তোমারও কি বিয়ের প্ল্যান আছে নাকি…”

“ টিং টং!”
কলিং বেলটা হঠাৎ বেজে ওঠায় হেমন্তের কথায় বাঁধা পড়ে গেল। ঠিক তখনই ট্রে ভর্তি ঠান্ডা শরবত নিয়ে হাজির হলো তুলি। আবারো কলিং বেলটা বেজে উঠলো। তুলি শরবতের গ্লাস ভর্তি ট্রে টা টি টেবিলে রেখে ছুটে গেল দরজায়। তুলি দরজা খুলতেই চমকে বলে উঠলো,
“ ওমা পিসি তুমিই। এ যে মেঘ না চাইতেই জল। এসো এসো। কই আমার গুড্ডু বাবা টা। পিপির কোলে এসো দেখি।”

বলেই হাত বাড়িয়ে সায়ন কে তুলে নিলো কোলে। তখনই মিসেস চিত্রার পেছন থেকে উঁকি দিলো রঙ্গন। মিষ্টির বড় বড় দুটো প্যাকেট হাতে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“ কি রে তুলি, পিসি আর ভাইপো কে পেয়ে আমাকে ভুলে গেলি নাকি ।”

তুলির অবাক চোখে রঙ্গনের দিকে তাকালো। তারপর মুচকি হেসে বলল,
“ তোমাকে ভুলবো তাই আবার হয় না কি। আফটার অল আমার ফার্স্ট ক্রাস বলে কথা।”

বলেই চোখ টিপ মারলো। রঙ্গন তুলির দুষ্টুমি ধরতে পেরে ওর কান মলে দিয়ে বলল,
“ ফার্স্ট ক্রাস তাই না। চল, আজকে তোর সব সিক্রেট হেমন্তের সামনে ফাঁস করবো।”

তুলি রঙ্গনের হাত থেকে কান ছাড়িয়ে হাসতে হাসতে বলল,
“ সে বলো গে। আমিও বলে দেবো তুমিই সেই মানুষ যে তার বউয়ের প্রেমপত্র পড়ে জবাবে চ্যালা কাঠ দিয়ে পিটিয়ে ছিলে।”

মিসেস চিত্রা ছেলেমেয়েদের দুষ্টুমি দেখে মনে মনে খুব হাসলেন। ওদের থামাতে গলা ঝেড়ে বললেন,
“ আমাদের কি দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখবি নাকি ভেতরেও নিয়ে যাবি।”
“ ওহ্ সরি সরি! এসো এসো ভেতরে এসো।”

ওরা ভেতরে ঢুকতেই রঙ্গন হেমন্তের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এলো। আসেপাশে না তাকিয়েই গলা উঁচিয়ে বলল,
“ হেমন্ত, এখন কেমন আছিস ভাই।”

হেমন্ত রঙ্গনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
“ আরে রঙ্গন, আয় আয় বোস। শরীরের কথা আর শুনতে চাস না ভাই। এমন পঙ্গুত্ব কারই বা ভালো লাগে বল?”

রঙ্গন আফসোসের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নেড়ে বলল,
“ হুম্, আসলেই।”
“ স্যার আমরা আজ আসি।”
বলে রিদিমা অভিষেক ওরা উঠে দাঁড়াতেই রঙ্গন পেছন ঘুরে দাঁড়ালো। সাথে সাথে চোখের সামনে সীমা কে দাঁড়ানো দেখে বলে উঠলো,
“ আরে সীমন্তিনী আপনিই?”

রঙ্গন অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। ওদিকে এই মুহুর্তে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে রঙ্গন কে দেখে হতভম্ব সীমা হুট করে ধেয়ে আসা প্রশ্নের জবাবই দিতে পারলো না। রঙ্গন এদিক ওদিক তাকিয়ে সবাই কে দেখে আবারো একই প্রশ্ন করলো। কিন্তু এবার ও চুপ করে রইলো মেয়েটা।

“ তুই চিনিস নাকি ওকে।”

হেমন্তের কথায় রঙ্গন বলল,
“ হুম্, চিনি তো। কি ঠিক বলিনি সীমন্তিনী।”

রঙ্গনের রহস্য কথায় হেমন্তের মনে সন্দেহ হলো। সাথে সাথে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো বন্ধুর মুখের দিকে।

“ হেমন্ত কেমন আছো বাবা।”
মিসেস চিত্রার কথায় সবাই ধ্যান ভেঙে তাকাতেই সায়ন ছুটে এসে জরিয়ে ধরলো রিদি কে। ছোট ছোট দুহাতে জাপটে ধরে তোতলা ভাষায় বলল,
“ জানো ম্যাম আমি না আচকে ফোল খানা বাড এঁকেচি। একটা আমাল একটা তাম্মিল একটা তোমাল আর একটা পাপাল। সবাল একতা কলে বাড। ভালো কলেছি না বলো।”

চলবে…

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে #নিতু_সরকার
পর্ব: ১০

১০)
“ আমি কাকু!!”
কথাটা আউড়ে থ হয়ে বসে রইলো রঙ্গন। হেমন্ত ঠোঁট চেপে হাসলেও তুলির দম ফাটা হাসিতে ফেটে পড়লো বসার ঘর।
“ থামবি তুই!”

রঙ্গনের ধমকে কাজ না হলেও সমরের চোখ রাঙানিতে কাজ হলো শেষমেশ।

“ আজকালকার দিনে দশ বছরের এজ গ্যাপ টা কিন্তু একটা বিশাল বড় ম্যাটার। তাছাড়া এই বয়সী মেয়েরা সব সময় ফ্যান্টাসিতে ভোগে। মনে মনে নিজের পাশে কমবয়সী হ্যান্ডসাম সুপুরুষ ছেলেদের কে কল্পনা করে।”

রঙ্গন বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ আই অ্যাম জাস্ট থার্টি ওয়ান ইয়ার।”
“ উহু, থার্টি টু। গতমাসে পা দিয়েছিস।”

রঙ্গন কটমট চোখে তাকালো সমরের দিকে। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সমর ঠোঁট বাঁকিয়ে তেরছা হাসলো।
“ বুড়ো হচ্ছিস স্বীকার করে নে। আজ সঠিক বয়সে বিয়ে করলে আমার সায়নের বয়সী ছেলেপুলে থাকতো তোর।”

মনের কষ্টে গুঙিয়ে উঠলো রঙ্গন। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বুজে নিলো চোখ। ডান হাত টা ভাঁজ করে রাখলো কপালে। হেমন্ত একটু অবাক হলো রঙ্গনের অবস্থা দেখে। ওদিকে সমর রেগেমেগে একশা..

“ আচ্ছা জ্বালাতন তো। আমি বুঝে উঠতে পারছি না তুই ওই বাচ্চা মেয়েটার মধ্যে কি এমন দেখলি যে পুরোই মজনু হয়ে বসে আছিস।”

রঙ্গন চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে বলল,
“ তুই হলি গিয়ে রসকষহীন মানুষ। তোর পক্ষ ওসব বোঝা সম্ভব না।”
“ ঠিক বলেছিস। বয়সের সাথে সাথে রস কমে গেছে। তাই ওসব ফালতু জিনিস বোঝার চেষ্টাও করি না।”
“ ওহ্ তোরা থামবি!”

হেমন্তের ধমকে চুপ হলো দুজন। রঙ্গন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসলো। হেমন্তের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,
“ ভাই আমার অবস্থা দেখে কি বুঝতে পারছিস না আমি মরে যাচ্ছি।”
“ সে তো পারছি।”
“ তাহলে বাঁচা।”
“ কিভাবে?”
“ সীমন্তিনীর ব্যাপারে সব কিছু জানিয়ে।”
“ মানে!”

রঙ্গন এবার সিরিয়াস হয়ে তাকালো। চোখে মুখে দৃঢ় প্রত্যয় ফুটিয়ে বলল,
“ আমি ওর ব্যাপারে সব কিছু জানতে চাই। ইচ অ্যান্ড এভরিথিং। একজন বিসিএস অফিসারের প্রতি ওর কিসের এত অনীহা সেটা না জানা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না আমি।”

*
রাত তখন প্রায় দশটা। হঠাৎই রিদিমার ফোনটা বেজে উঠলো। ইয়ার ফাইনাল এক্সাম এর মাত্র মাস দুয়েক বাকি। এখন থেকেই প্রস্তুতি না নিলে সিলেবাস শেষ হবে না তার। রিদিমা ফোনের আওয়াজ শুনে বইয়ের তলা থেকে বার করে দেখলো আন নোন নম্বর থেকে কল এসেছে। এতো রাতে অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছে দেখে রিসিভ করতে ইচ্ছে না করলেও কি মনে করে যেন শেষমেশ ধরলো ফোন টা। হ্যালো বলে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করতেই ওপাশ থেকে ভারী কণ্ঠ ভেসে এলো কানে…
“ হ্যালো! মিস্ রিদিমা! আমি রঙ্গন বলছি।”

প্রথম দফায় চমকে গেলেও রঙ্গনের নাম শুনে চিনতে পারলো সে। রঙ্গন খুবই ভদ্রতার সাথে বলল,
“ প্রথমেই মাফ চাইছি এতো রাতে ফোন করার জন্য। আমি কি আপনার সাথে কয়েক মিনিট কথা বলতে পারি।”

রিদিমা দোনোমনায় ভুগে গড় রাজি হয়ে বলল,
“ উম্, ঠিক আছে বলুন।”
“ থ্যাংক ইউ ম্যাডাম। আসলে আপনার বান্ধবী সীমন্তিনীর ব্যাপারে কিছু জানতে চাইছিলাম আর কি?”

রিদিমা আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিল লোকটার কল করার কারণ। তাই জড়তাহীন বলল,
“ বলুন কি জানতে চান।”
“ সীমন্তিনীর লাইফে কি কেউ আছে মানে বয়ফ্রেন্ড আর কি!”
“ এমনটা মনে হওয়ার কারণ!”

রঙ্গন বেশ অস্বস্তি নিয়ে বলল,
“ প্লীজ ডোন্ট মাইন্ড ম্যাডাম, প্রশ্নটা ভীষণ ব্যক্তিগত ছিল। আসলে যতবারই আমাদের কথা হয়েছে আমি খেয়াল করেছি সীমন্তিনী খুবই জড়তায় ভোগেন। ঠিক মতো মনের কথা প্রকাশ করতে চান না। আমি তাই বুঝতে পারছি না আসলে আমাকে নিয়ে ওনার সমস্যাটা কোথায়! এজ গ্যাপ নাকি পছন্দের ভিন্নতা। যদি উনার লাইফে আগে থেকেই কেউ থেকে থাকে তাহলে আমি নির্দ্বিধায় সরে যাবো।”

রঙ্গনের সোজাসাপ্টা কথা গুলো বেশ মনে ধরলো রিদিমার। বুঝলো লোকটা সীমার ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস। মেয়েটার রুপের নেশায় পাগল হয়ে নয় মনের খোঁজ জেনে তবেই আপন করতে চায়। রিদিমা বেশ দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“ বুঝেছি। আপনি সীমার মনের খোঁজ জানতে চান তাইতো। তাহলে বলে দিচ্ছি আপনার মত অনুযায়ী সন্দেহজনক কারণ দুটো সম্পূর্ণই ভিত্তি হীন। ওর নাতো এজ গ্যাপ নিয়ে কোনো সমস্যা আর না কোনো পছন্দের মানুষ ওর জীবনে আছে।”

রঙ্গন যেন এই কথাটুকুই শোনার অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। রিদিমার কথা শোনা মাত্রই বুকে আটকে রাখা দমটা ছেড়ে তৃপ্তির শ্বাস টানলো শেষমেষ। ফোন যেহেতু লাউড করা তাই পাশে বসা সমর ও শুনলো রিদিমার কথা গুলো। রঙ্গন তবুও উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ তাহলে সমস্যা টা কোথায় সীমন্তিনীর? কেন এত নীরবতা মেয়েটার মনের ভেতরে?”
“ চোখের সামনে কারো স্বপ্ন যদি ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তাহলে সে কষ্ট পাবে না তো কি আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচবে বলুন তো।”
“ মানে?”

রঙ্গন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো। সমরের দৃষ্টিতেও জিজ্ঞাসা চিহ্ন ঝুলে। রিদিমা জানালো,
“ ভারত নাট্যম, সীমার স্বপ্ন, ওর প্রথম ভালোবাসা। ছোটবেলা থেকেই মেয়েটার ওই একটাই স্বপ্ন। একদিন ও ভারতবর্ষের নামকরা নৃত্য শিল্পী হবে। বিশ্বের তাবড় তাবড় শিল্পীদের সাথে ওর নাম লেখা হবে। বংশের নাম উজ্জ্বল করবে। ব্যস! এতটুকুই। কিন্তু ওর বাবা মা জোর করে ওর নাচের ক্লাস বন্ধ করিয়ে দিয়েছেন। আর বলেছেন ওসব নাচ ফাচ ভুলে গিয়ে স্বামীর সাথে সুখে শান্তিতে ঘর সংস্বার করতে।”

রিদিমা থামলো। ওর যা বলার বলা হয়ে গেছে। ওদিকে রঙ্গন ও চুপ। ওর যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে। রঙ্গন এর পর আর কথা বাড়ায় নি। ধন্যবাদ জানিয়ে ফোনটা কেটে দিলো। তবে সমরের মনে আবারও এক নতুন অভিজ্ঞতা আঁচড় কেটে গেল। সব মেয়েরা প্রিয়ার মতো হয় না কোনো কোনো মেয়ে সীমন্তিনীর মতো ও হয়। যাদের কাছে অর্থের প্রাচুর্যতা নয় স্বপ্ন দামী হয়।

*
আস্ত একটা সূর্যের সাথে মনোরম এক সকাল। মনিকা রান্না ঘরে তখন ব্যাস্ত হাতে ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছেন। তপন বাবু বসে আছেন পেপারে চোখ রেখে। তখনই কলিং বেলটা বেজে উঠলো শব্দ করে। তিনি ওখান থেকেই গলা হাঁকালেন,
“ সুনু দরজা টা খোল তো।”

রিদিমা কলেজ যাবে বলে ব্যাগ গোছাচ্ছিল। মায়ের গলা শুনে পা চালিয়ে এসে দরজাটা খুলল। হঠাৎ বড় মাসি কে দরজায় দাঁড়ানো দেখে মুখ টা গুমোট হয়ে গেল রিদিমার। তবুও সৌজন্য হেসে বলল,
“ ভালো আছো মাসিমনি?”

সুতপা রিদিমার কথা শুনে কেমন যেন তেরছা চোখে তাকালো। তারপর সর বলে ঢুকে গেল ভেতরে। মনিকা হাত মুছতে মুছতে বাইরে বেরিয়ে এসে দিদি কে দেখে আপ্লুত হয়ে গেলেন। মুখে ঝরা হাসি নিয়ে বললেন,
“ ওমা বড়দি তুমি, তা আজকে হঠাৎ এতো সকালে এলে যে?’
“ তোর মেয়ের জন্য সম্বন্ধ এনে ভুল করেছি যে তাই তো ক্ষমা চাইতে এলাম তোদের কাছে!”

মনিকা হতবাক হয়ে গেলেন দিদির কথায়। ওদিকে তপন বাবু ও চমকে উঠলেন এমন ধারা কথা শুনে। রিদিমা বুঝলো এসব সেদিনের ক্যালমা। তৃপ্তীশ আর তার মায়ের ঝাল মেটাতে এসেছে এই মহিলা। সুতপা ফুটন্ত জলের মতো ফুটে উঠে বললেন,
“ তোর মেয়ে যে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে সে খবর কি শুনেছিস?”

মনিকা হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকাতেই রিদিমা দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে। সুতপা গলায় তেজ ঢেলে বললেন,
“ মেয়ে জন্ম দিয়েছিস নাকি কোনো দেশের প্রধান মন্ত্রী শুনি, তার গলায় এতো তেজ!”
“ মাসিমনি, অযথা এক পক্ষের কথা শুনে বিচার করা টা কিন্তু ঠিক নয় কিন্তু। সেদিন তৃপ্তীশের কারণেই…

ঠাস্ করে বাম গালে চড় মারলেন মনিকা। রিদিমা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। আজ আবারো তার কথা না শুনে গায়ে হাত তুলল মনিকা। তপন বাবু দ্রুত রিদিমা কে নিজের বুকে টেনে নিলেন। স্ত্রীর দিকে গরম চোখে তাকিয়ে ধমকে উঠলেন,
“ মনি…! তোমাকে বারণ করেছি না আমার মেয়ের গায়ে হাত তুলবে না তুমি।”

“ দাও, আরও আসকারা দাও। আসকারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে রাখো। আর সেই সুযোগে মাথায় উঠে তাণ্ডব চালাক এই মেয়ে।”

কথা গুলো বলতে বলতে গলা ধরে এলো মনিকার। আঁচলে মুখ চেপে ধপ করে বসে পড়লেন সোফাতে। তপন বাবু মেয়ের লাল হয়ে যাওয়া গাল টায় হাত বুলালেন। পাঁচ আঙুলের দাগ দেখে বুঝলেন ভালো জোরেই লেগেছে চড় টা। রিদিমার অশ্রু সিক্ত চোখ দুটো মুছে দিয়ে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“ মা, ও মা তাকাও আমার দিকে।”

বাবার আদুরে ডাকে রিদিমা চোখের জল ছেড়ে দিলো। তপন বাবু আরও যত্নে আগলে নিলেন মেয়েকে নিজের বুকে। রিদিমা ফোঁপাতে লাগলো জোরে জোরে শ্বাস ছেড়ে ছেড়ে…
“ বাবা, বিশ্বাস করো আমি ওকে ওসব বলতে চাই নি। কিন্তু বাধ্য হয়ে বলেছি। আমি সেদিন সায়ন কে পড়াচ্ছিলাম। সেই মুহূর্তে তৃপ্তীশ ফোন করে অনেক উল্টোপাল্টা কথা শোনাতে থাকে। আমি বিরক্ত হয়ে বারবার ফোন কাটলেও ও কল ব্যাক করে নোংরা বিহেব করতে থাকে। তাই আমি রেগে গিয়ে…”

রিদিমা ভেজা গাল দুটো মুছে নিয়ে বাবার দিকে তাকালো। দরদ ভরা কণ্ঠে আকুতি মিশিয়ে বলল,
“ বাবা তুমি না সেদিন বলেছিলে তৃপ্তীশ এর কোনো দোষ পেলে তুমি আমাকে ওর সাথে বিয়ে করতে জোর করবে না। তাহলে শোন, ওর দোষ হলো ও আমাকে বোঝে না। আর না বুঝতে চায়। ও চায় আমি ওর আর ওর মায়ের হুকুম মতো চলি। ওদের হুকুমে উঠি ওদের হুকুমে বসি। মোদ্দা কথা আমি ওদের হাতের পুতুল হয়ে থাকি এটাই ওদের মনস্কামনা।
কিন্তু বাবা, আমি তো এমন একজনকে নিজের জীবন সঙ্গী হিসেবে চাই নি যে আমাকে বন্দী করে রাখতে চায়। আমাকে কাঠের পুতুল বানিয়ে নাচাতে চায়। আমি তো এমন একজনকে জীবন সঙ্গী হিসেবে চেয়ে এসেছি যে আমাকে সম্মান করবে আমাকে স্পেস দেবে আমাকে উড়তে দেবে বিনা বাঁধায়।”

“ তোর মেয়ে পাগল হয়ে গেছে রে মনি। এখনও সময় আছে ডাক্তার দেখা।”
তাচ্ছিল্যের সুরে কথা গুলো বললেন সুতপা।
“ কি আর বলবো, এতো বড় একটা বাজে ব্যবহার করার পরও তৃপ্তীশ এখনও তোর মেয়েকেই বিয়ে করতে চায়। ওর মা এসেছিল কাল। বলল রেজিস্ট্রি বিয়েটা তারা খুব শীঘ্রই সেরে ফেলতে চান। পারলে এই সপ্তাহের মধ্যেই। তারপর না হয় সময় সুযোগ বুঝে…!”

“ অসম্ভব!! আমি এই বিয়ে করবো না।”

রিদিমার চোখ দিয়ে যেন রক্ত ছুটে যাচ্ছে। কিছুতেই যেন নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না সে। সুতপা বোনের দিকে তাকালো। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“ অনেক হয়েছে মনি। আমি আর তোর মেয়ের ব্যাপারে নেই। আসলে ভূল টা আমারই। আমারই বোঝা উচিত ছিল তোর মেয়ে হলো গিয়ে রানী ভিক্টোরিয়া। তার তো চয়েস অন্যরকম হবেই। যাইহোক, আসি রে। ভালো থাকিস।”

সুতপা বেরিয়ে গেলেন ধুপধাপ শব্দ করে পা ফেলে। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে ফোন লাগলেন তৃপ্তীশ এর মায়ের নাম্বারে। ওদিকে মনিকা রাগে রক্তিম চোখে তাকালেন মেয়ের দিকে। থর থর করে কাপছে তার শরীর। মনিকা কান্নায় বুজে যাওয়া কণ্ঠে আওড়ালেন,
“ নে! শান্তি পেয়েছিস তো। বাবা মায়ের সম্মান নষ্ট করে পেয়েছিস তো শান্তি। এই প্রতিদান দিলি তুই আমার ভালোবাসার।”

মনিকা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন আবেগ সামলাতে না পেরে। তপন বাবু দৌড়ে ছুটে এলেন স্ত্রীর কাছে। দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন,
“ মনি প্লীজ শান্ত হও। কি পাগলামো শুরু করেছ বলোতো তোমরা ।”

মনিকা স্বামীর কথা শুনে একটুও শান্ত হলেন না। বরং হিংস্র বাঘিনীর মতো খামচে ধরলেন তার হাত।

“ অ্যাই আজ তুমি সত্যি করে বলো তো এই মেয়ে কার।”
“ মনিকা কি বলছো তুমি এসব?”
“ সত্যি বলছি আমি। কেন জানি আজ সন্দেহ হচ্ছে ও আমার সন্তান নয়। যদি ও আমার সন্তান হতো। তাহলে কক্ষনো এমন একটা কথা দিদিকে মুখের উপর শোনাতে পারতো না।”

তপন বাবু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। রিদিমা কে চোখের ইশারায় সরে যেতে বলে বললেন,
“ তুমি কেন বুঝতে পারছো না মনি, সুনু এখন বড় হয়েছে। ওর একটা নিজস্ব পছন্দ নিজস্ব মতামত আছে নিজের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে।”
“ কই তনু তো এমন করেনি। ও তো আমাদের পছন্দ করা ছেলে কে সানন্দে মেনে নিয়েছিল। তাহলে এই মেয়ের বেলায় এতো সমস্যা কোথায়!”

তপন বাবু কপাল চেপে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হতাশ গলায় নরম হয়ে বললেন,
“ মনিইই ….! তনু আর সুনু ওরা দুজন বোন বলে কি দুজনের মেন্টালিটিও এক হবে এমন কোনো কথা আছে না কি? তনু আর সুনু আলাদা। তাই দুজনের পছন্দ চিন্তা ভাবনা মতামত সব কিছু আলাদাই হবে।”

“ কিন্তু তৃপ্তীশ কে আমার ছেলে হিসেবে খুব পছন্দ হয়েছিল।”
বলেই চোখ মুছলেন মনিকা।
“ তুমি চিন্তা করো না। তৃপ্তীশ যদি আমার মেয়ের কপালে লেখা থাকে তাহলে ওর সাথেই বিয়ে টা হবে। তবে মেয়ের অমতে নয়।”

**
মায়ের একঘেঁয়ে বকাবকি আর অশান্তি সহ্য করতে না পেরে সময়ের অনেক আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল রিদিমা। আজও সেদিনের মতো একরাশ কষ্ট আর অসহনীয় মানসিক অস্থিরতা নিয়ে হাঁটছিল রাস্তার ধার ঘেঁষে। মেয়েটার ওই একটাই সমস্যা। অতিরিক্ত কষ্টেও মুখ ফোটে না। যার দরুন নিজের ভেতরেই গুমরে গুমরে মরতে থাকে অহর্নিশ। রিদিমা বেখেয়ালে হাঁটছিল। বার বার চোখের সামনে ভাসছিল মায়ের সেই চড় মারার দৃশ্য। হৃদয়ের গহীন থেকে ঝরে ঝরে পড়ছিল অদৃশ্য আঘাতে ঝরা রুধীর বিন্দু গুলো। ঠিক তখনই আচমকা ক্র্য..চ করে ব্রেক কষার শব্দ হলো। সহসা ধ্যান রিদিমার। চোখের সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যু কে ধেয়ে আসতে দেখে ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে রাস্তার উপরে উল্টে পড়লো মেয়েটা।

“ হোয়াট দ্যা হেল….! শালার মরার জন্য কি সবাই কে আমার গাড়ির সামনেই আসতে হয়!!”

দ্রুত হাতে ব্রেক চেপে বিরক্তি ঝাড়লো সমর। ততক্ষণে আবারো সেদিনের মতো ছোটখাটো ভিড় জড়ো হয়েছে রিদিমার চারিদিকে। সমর না চাইতেও বেরিয়ে এলো বাইরে। ভিড় ঠেলে গাড়ির সামনে আসতেই বিস্ময়ে ঠিকরে এলো চোখ।

“ মিস্ রিদিমা…! ওহ্ মাই গড!”

সমস্ত বিরক্তি হাওয়ায় ভাসিয়ে ছুটে এলো সমর। কাল বিলম্ব না করে টেনে তুলল মেয়েটা কে। চোখে মুখ কুঁচকে বলে উঠলো,
“ রিদিমা, আপনি ঠিক আছেন!”

পরিচিত কন্ঠের আওয়াজ শুনে রিদিমার ধ্যান ফিরে এলেও আতঙ্ক কাটলো না। ওর সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগলো থরথর করে। সমর মেয়েটার অবস্থা বেগতিক দেখে ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসালো। আশ্চর্যের বিষয় হলো রিদিমা আজ আর সেদিনের মতো একবারও বাজে ব্যবহার করলো না।

ব্যস্ত সড়কের ওপর দিয়ে ছুটছে গাড়ি। সেই সাথে ছুটে চলেছে চারপাশের দৃশ্য। সমর দক্ষ হাতে ড্রাইভ করছে আর আর চোখে বারবার দেখছে রিদিমা কে। গাড়িতে ওঠার পর থেকেই চুপচাপ বসে আছে মেয়েটা। নজর উইন্ডোর বাইরে। আজকের রিদিমাকে দেখে পুরোনো রিদিমার সাথে একদমই মেলাতে পারলো না সমর। আগের রিদিমা জ্বলন্ত অঙ্গার। কি আগুন তার চাহনিতে। কন্ঠে প্রখর তেজ।
কিন্তু আজকের এই রিদিমা বড্ড শান্ত। যেন এক খন্ড গুমোট বাঁধা মেঘ। একটু খানি উষ্ণতা পেলেই ঝরে পড়বে রাশি রাশি বৃষ্টি হয়ে।

“ মিস্ রিদিমা, আর ইউ আপসেট?”

সমর গাড়ির স্টিয়ারিং হুইল টা ঘোরাতে ঘোরাতেই প্রশ্ন করল। রিদিমা আড় চোখে এক পলক সমরের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বোঝালো না সে আপসেট নয়।

“ তাহলে এভাবে রাস্তার উপর দিয়ে বেখেয়ালি হয়ে হাঁটছিলেন কেন?”

রিদিমা চোখ জোড়া শক্ত করে বুজে নিয়ে হঠাৎ বলে উঠলো,
“ গাড়ি থামান প্লীজ!”
“ হোয়াট!”
“ প্লীজ গাড়ি থামান!”

হঠাৎ রিদিমার কি হলো বুঝে এলো না সমরের। সে একটা ফার্মা কোম্পানির অফিসের গেটের সামনে গাড়ি টা থামালো। রিদিমা সাথে সাথে গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করলো পাগলের মতো করে। সমর খানিক আশ্চর্য হয়ে গাড়ির লক টা খুলে দিতেই রিদিমা বেরিয়ে গেল গাড়ি থেকে। তারপর হাঁটতে লাগলো এলোমেলো পায়ে। ব্যাপার টা ঠিক সুবিধার মনে হলো না সমরের। তাই সেদিকে তাকিয়ে সেও হুট করে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। বড় বড় পা ফেলে ছুটে গিয়ে টেনে ধরলো রিদিমার হাত। ঠিক তখনই হুস্ করে পাশ কাটিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল একটা বড় মাল লোডেড ট্রাক।

“ মিস্ রিদিমা!”
বলেই একটানে নিজের বুকে জরিয়ে নিলো সমর। রিদিমা যেন এবার আর নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারলো না। হুহু করে কেঁদে উঠলো ফেলল মন মস্তিষ্কের অসহনীয় চাপে। রিদিমা মেয়েটার কান্না দেখে বিস্মিত ছেলেটা যেন খেই হারিয়ে ফেলল। সাথে সাথে দু হাতে আগলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রাস্তার ধারে থম মেরে।

চলবে…