তুই যখন ছুঁয়ে দিলি মন পর্ব-১১+১২

0
15

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: #নিতু_সরকার
পর্ব: ১১

রিদিমা কাঁদছে। আর তার পাশে বসে তাকে সঙ্গ দিচ্ছে গোমড়া মুখো মানুষটা। ভাবা যায়! সামনেই পাঁকা সড়ক। সেখান দিয়ে অবিরাম গতিতে ছুটে চলেছে ছুটন্ত গাড়ি গুলো। সমর দুই হাঁটুর উপর দুহাতের কনুই তুলে বসে আছে নীরবে। চিন্তায় ডুবে তার ডিম্বাকৃতি মুখমন্ডল। ভ্রুর মাঝে চওড়া ভাঁজ।

প্রায় মিনিট দশেক পর রিদিমার কান্না কমে এলো। আস্তে ধীরে ফিরে এলো স্বাভাবিক অবস্থায়। কিন্তু তখনও ফুঁপিয়ে চলল হেঁচকি তুলে তুলে। সমর সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পকেট থেকে রুমাল টা বার করে মুখের সামনে ধরতেই লজ্জায় গুটিয়ে গেল রিদিমা। মেয়েটা হাত বাড়িয়ে রুমাল টা নিলো অতঃপর আবারো মুখ লুকালো ব্যাগের আড়ালে। সেই সাথে বিরক্ত হলো নিজের ব্যবহারে।ছিঃ ছিঃ!
শেষমেষ কি এক কান্ড করে বসলো সে। ইস্! না জানি কতো খারাপ ভাবছে তাকে এই লোকটা।

কেটে গেল আরও বেশ অনেক টা সময়। উভয়ের মাঝে চলছিল পিন পতন নীরবতা। সেই নীরবতা কে ভেঙে সমরই কথা পাড়লো,
“ মিস্ রিদিমা, আপনি ঠিক আছেন এখন?”

রিদিমা ওভাবেই আলতো করে মাথা দোলালো। সমর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“ গুড, এবার কিন্তু আমাদের উঠতে হবে।
আসলে আধ ঘণ্টার মধ্যেই একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে আমার।”

রিদিমা ব্যাগের আড়াল থেকে মুখ তুলে তাকালো। পাশে বসা মানুষটার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বলল,
“ সরি মিস্টার দত্ত। অ্যান্ড থ্যাংকস ফর দিস হসপিটালিটি। আজ আপনি না থাকলে আমি হয়তো…”
“ ইটস ওকে মিস্ রিদিমা। এতটুকুর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিতে হবে না। এনি ওয়ে, আমরা কি এখন উঠতে পারি?”

রিদিমা আর কথা বাড়ালো না। সমর ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে। রিদিমা উঠে দাঁড়াতেই সমর বলল,
“ বলুন কোথায় যাবেন। আমি ছেড়ে দিয়ে আসছি।”

রিদিমা মাথা নেড়ে সাথে সাথে অসম্মত হলো।
“ না না তার দরকার নেই মিস্টার দত্ত। আমি নিজেই…!”

ওর কথা শেষ হতে দিলো না সমর। তার আগেই তাকে মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“ জানি আপনি পারবেন। কিন্তু আজ নয় প্লীজ। আপনি যে মেন্টালি আনস্টেবল দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে।”

রিদিমা আর কথা বাড়ালো না। আসলেই গা কাঁপছে ওর। সেই সাথে মাথাও ধরেছে প্রচণ্ড। সমর ওকে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসালো। নিজেও উঠে বসলো ড্রাইভারের সিটে। পূনরায় গাড়ি স্টার্ট করতেই রিদিমা বলল,
“ আপনি আমাকে সামনের বাস স্ট্যান্ডে ছেড়ে দিন। আমি ওখান থেকে কলেজে চলে যাবো।”

সমর শুনলো কিন্তু প্রত্যুত্তরে জবাব দিলো না। রিদিমা জানালায় মাথা ঠেকিয়ে উদাস নয়নে বাইরে তাকিয়ে রইলো। সমর মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামালো। রিদিমা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই বলল,
“ জাস্ট দুমিনিট অপেক্ষা করুন আমি এক্ষুনি আসছি।”

বলেই বেরিয়ে গেল। রিদিমা বসে রইলো চুপটি করে। ঠিক সেই মুহূর্তে ফোন টা বেজে উঠলো। ব্যাগের চেন খুলে ফোনটা বার করতেই রাগে বিরক্তিতে মেজাজ হারালো রিদিমা। ফোনের স্ক্রিনের উপর জ্বলজ্বল করছে সেই ব্যক্তির নাম যার কারণে আজ তার এই দুর্দশা। ‘তৃপ্তীশ’!!
রিদিমা ফোন রিসিভ করল না। কেটে দিলো। হয়তো নিঃশব্দে জবাব দিলো সে কথা বলতে ইচ্ছুক নয় এই মুহূর্তে। কিন্তু কিছু বেহায়ারা বোধ চরম মাত্রায় নির্লজ্জ হয়। তৃপ্তীশ ও তাই। সমস্ত উপেক্ষা অপমান লজ্জা শরম ত্যাগ দিয়ে অনর্গল ফোন করতে লাগলো রিদিমার কাছে। শেষমেষ বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করল রিদিমা। ভেতরের দাবানল সামলে দাঁত চেপে বলল,
“ আপনি এত নির্লজ্জ কেন বলুন তো তৃপ্তীশ। বার বার ফোন কাটছি মানে তো এটাই দাঁড়ায় আমি কথা বলতে চাচ্ছি না আপনার সাথে।”

মায়ের ফোন পেয়ে এমনিতেই উত্তপ্ত ছিল তৃপ্তীশ। রাগের পারদ যেন আরো বাড়লো রিদিমার করা অপমানে। মেজাজের ভারসাম্য টা আর বোধ হয় রক্ষা করা সম্ভব হলো বেচারার পক্ষে….
“ ডোন্ট ক্রস ইয়োর লিমিট রিদিমা। ওর আই উইল…”
“ আই অলরেডি ডান মিস্টার তৃপ্তীশ। আপনার যা করার করে নিন। আমি আপনাকে কিছুতেই বিয়ে করবো না।”

ব্যস! এটুকু বলেই কল কাটলো রিদিমা। অতঃপর ফোন টা সুইচড অফ করে রেখে দিলো ব্যাগে। বিরক্তি আর অস্বস্তি তে যেন মন মাথা জেঁকে ধরেছে। শিরা উপশিরায় বয়ে চলেছে যন্ত্রণার স্রোত। কোন কুক্ষণে যে এই লোকটার সাথে দেখা হয়েছিল ওর ভাবতেই গা জ্বলে যাচ্ছে রাগে। বড় মাসীর ছেলে অভয়ের বিয়েতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল এই তৃপ্তীশ এর সাথে। অভয়ের বন্ধু হয় তৃপ্তীশ। আবার দুর্ভাগ্য বশত তৃপ্তীশ এর মা রিতা হলেন তনুর পিসি শাশুড়ির নিজের বড় জা। বলতে গেলে সব দিক থেকেই আত্মীয়তা। সম্বন্ধ টা সরাসরি তনুর পিসি শাশুড়ি আর শ্বশুরের তরফ থেকে এলেও ঘটকালিটা করেছিল বড় মাসী সুতপা। সে জানে বাবা মায়ের পক্ষে এই সম্বন্ধ অস্বীকার করা একপ্রকার দুঃসাধ্য বলা যায়। কারণ এখানে যেমন বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়ির সম্মান জড়িয়ে আছে। ঠিক তেমনি জড়িয়ে আছে মায়ের বাপের বাড়ির সম্মান। এই সম্বন্ধ অস্বীকার করলে সব দিক থেকেই সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে।
কিন্তু তাই বলে নিজের অস্তিত্ব সংকটে ফেলে এই অস্বস্তির জীবন কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারবে না সে। ওহ্ গড! বলেই অস্থির রিদিমা সিটে ঘাড় এলিয়ে চোখ বুজে নিলো। সমরের আগমন হলো ঠিক তখনই। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে একটা প্যাকেট আর জলের বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ এই নিন।”

রিদিমা প্রথমত কিছু বুঝতে না পেরে প্যাকেট আর বোতল টা ধরলো। সমর ডোর লক করে এক পাতা প্যারাসিটামল বাড়িয়ে ধরলো সামনে।
“ কি এটা!”

রিদিমা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল। সমর রিদিমার হাতে পাতা টা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“ যে হারে কেঁদেছেন তাতে আমি নিশ্চিত খুব তাড়াতাড়ি আপনার মাথা ব্যাথা শুরু হবে। তাই এটা নিয়ে এলাম। ওই প্যাকেটে সামান্য একটু খাবার আছে। অসুস্থ হওয়ার আগে ওটা খেয়ে ওষুধ টা খেয়ে নিন। আমি চাই না শরীর খারাপের বাহানা দিয়ে বিকেলের পড়ানো টা আপনি কোনোভাবে মিস করুন।”

রিদিমা অবাক হবে না কি মেজাজ হারাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। তবে লোকটার কথার ভাঁজে লুকোনো অস্পষ্ট কেয়ার টা বেশ করে বুঝতে পারলো সে। রিদিমা এই প্রথম অন্য রকম দৃষ্টিতে তাকালো সমরের দিকে। দেখলো ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজের মতো করে ড্রাইভ করছে লোকটা। আজ চোখে রিমলেস চশমার বদলে ডার্ক ব্লু শেডের মোটা ফ্রেমের চশমা পরা। বরাবরের মতোই বেশ সুদর্শন লাগছে তাকে। রিদিমা হাতের ব্যাগটার দিকে তাকালো। বেশ গরম ভাপ অনুভূত হচ্ছে হাতে। মনে মনে কেন জানি হাসলো রিদিমা। হাসিটা তাচ্ছিল্যের।
লোকটা ঘাড় ত্যাড়া ঠোঁট কাটা জঘন্য তার বাচন ভঙ্গিমা। তবুও নিঃসন্দেহে একজন ভালো মনের মানুষ। কি সুন্দর না বলতেই বুঝে গেল তার মানসিক শারীরিক অবস্থা। অথচ তার আপন মানুষ গুলো….
অন্তরের গহীন হতে একটা বিষাক্ত দীর্ঘশ্বাস নিঃশব্দে ঝরে পড়লো রিদিমার। তাই আর দেরি না করে চুপ করে প্যাকেট টা খুলল। দেখলো ভেতরে একটা টাটকা ভেজ বার্গার রাখা। মেয়েটা নীরবে ওটা শেষ করলো। তারপর ওষুধ খেয়ে মাথা এলিয়ে দিলো সিটে।

*
আজ সকাল হতে না হতেই রঙ্গন মাকে নিয়ে সীমার বাড়িতে হাজির। মেয়েটা তখন সদ্য চান সেরে বেরিয়েছে। মাথায় গামছা পেঁচিয়ে রাখা। পরনে বাড়ির একটা সাধারণ সুতি নাইটি। এমন হুট করে হবু জামাই আর তার মাকে কে আসতে দেখে সীমার বাবা রথীন বাবু রীতিমত অবাক। তিনি ব্যস্ত হলেন নানাবিধ আয়োজন করতে। কিন্তু রঙ্গন বাঁধা দিলো।

“ আঙ্কেল আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি আর মা আসলে আপনার সাথে একটু দরকারি কথা বলতে এসেছি।

রথীন বাবু মনে মনে ভড়কালেন। কণ্ঠে বিস্ময় ঢেলে বললেন,
“ কি দরকারি কথা?”
“ আসলে দাদা আমরা বিয়েটা আর একটু আগিয়ে আনতে চাইছি। মানে এই সপ্তাহের মধ্যেই যদি রেজিস্ট্রি ম্যারেজ টা যদি হয়ে যেত…!”

রথীন বাবু মনে মনে খুশি হলেও সেটা চেপে বললেন,
“ বুঝলাম দিদিভাই, কিন্তু বিয়েটা এগিয়ে আনার কারণ টা যদি একটু জানাতেন।”
“ কারণ টা সীমন্তিনী আঙ্কেল।”

রঙ্গন এর কথা শুনে রথীন বাবু সহ বাড়ির সকলে চমকে উঠলো। ওদিকে পর্দার আড়ালে দাঁড়ানো সীমাও অবাক হলো সে কথায়। সে মানে? সে আবার কি করলো এর মধ্যে?

“ ঠিক বুঝলাম না বাবা। সীমা মানে! কি করেছে মেয়েটা।”

মিসেস দীপা হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। রঙ্গন একটা জোর নিঃশ্বাস টেনে বলল,
“ আমি চাই না সীমন্তিনীর ড্যান্সার হওয়ার স্বপ্ন টা কোনো ভাবে অপূর্ণ রয়ে যাক। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে আমার নামে লিখে নিতে চাইছি যাতে ওর প্রতিটা স্বপ্ন আমি নিজ দায়িত্বে পূরণ করতে পারি।”

হতবাক সীমা হতবাক তার বাড়ির লোক। যে মেয়েটার স্বপ্ন টাকে নিয়ে কেউ কোনোদিন ভাবে নি। আর না কেউ দাম দিতে চেয়েছে। সেই স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব আজ একজন পর কেউ নিলো। বিস্ময় আর লজ্জায় মুখ লুকালো সবাই।

সীমা দু পা পিছিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। ওর হাত পা কাঁপছে খুব করে। খুশিতে নাকি অজানা অনুভূতির আন্দোলনে মেয়েটা জানে না। শুধু বুঝতে পারলো ওর বুক কাঁপছে। সেই কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ছে শরীরে প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেই সাথে ভালোলাগার এক নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে মানুষটার ব্যাপারে। সীমা দুহাতে মুখ ঢাকলো। সেই সাথে লাজুক হাসলো ও। এই প্রথমবার ওর মনে হলো ওর লজ্জা লাগছে। নিজেকে নতুন বউ নতুন বউ ফিল হচ্ছে।

ওদিকে বসার ঘরে তখন পিন পতন নীরবতা। রথীন বাবু পরিবেশ স্বাভাবিক করতে গলা ঝাড়লেন। অতঃপর নীরবতা ভেঙে বললেন,
“ বাহ্ সে তো উত্তম প্রস্তাব। ঠিক আছে তাহলে। এই সপ্তাহের মধ্যেই হবে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ। কই গো সৌরভের মা। তাড়াতাড়ি মিষ্টি নিয়ে এসো। এমন একটা সুখবর, মিষ্টি মুখ না করলে চলে বলো।”

রঙ্গন সোফায় হেলান দিয়ে ফোনটা বার করলো। অতঃপর নিঃশব্দে লিখে গেল হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কিছু কথা। ফোনে মেসেজ টোন বাজতেই সীমা স্ক্রিনে চোখ রাখলো। রঙ্গন এর মেসেজ দেখে লক খুলতেই চোখে পড়লো লেখাটা….

“ আপনার সমস্ত ভালো লাগা মন্দ লাগা গুলো আজ থেকে বৈধ ভাবে আমার করার অভিযান শুরু করে দিলাম সীমন্তিনী। মনে রাখবেন দিন শেষে আপনি শুধু এই রঙ্গন এর। তার কাছে হোক আপনার সব কিছুর সমর্পণ।”

**
কলেজের গেটে যখন সমরের গাড়িটা পৌঁছালো তখন প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। রিদিমা ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেটের আসতেই কোথা থেকে যেন ছুটে এলো তৃপ্তীশ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রিদিমার হাত চেপে চোখ মুখ লাল করে বলল,
“ তোমার দেখছি অনেক সাহস বেড়েছে আজকাল। সব বিষয়ে ছাড় দিচ্ছি বলে কি ধরে নিয়েছ তোমার সমস্ত অবাধ্যতা গুলো খুব সহজে মেনে নেবো আমি!”

তৃপ্তীশ এর সাহস দেখে রীতিমত হতবাক রিদিমা। কত্ত বড় বুকের পাটা দেখো তাকে পাবলিক প্লেসে এভাবে স্পর্শ করার সাহস দেখায়। অবিশ্বাস্য!!
রিদিমা আগুন চোখে তাকিয়ে গর্জে উঠলো…
“ হাউ ডেয়র ইউ মিস্টার তৃপ্তীশ। কোন সাহসে আপনি আমার হাত ধরেছেন শুনি। হাত ছাড়ুন। ছাড়ুন বলছি আমার হাত।”

তৃপ্তীশ রিদিমার হাত ছাড়লো না। বরং আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“ ছাড়বো না কি করবে তুমি হুম্! চিৎকার করবে। নাকি লোক ডাকবে। করো চিৎকার, ডাকো লোক। মনে রেখো বদনাম টা কিন্তু শেষমেশ তোমারই হবে। কারণ আমার পক্ষে তোমার গোটা পরিবার দাঁড়িয়ে বাট তোমার পক্ষে কিন্তু কেউ না বুঝেছ।”

তৃপ্তীশ এর হুমকি শুনে রিদিমার রাগে যেন মূর্ছা যাওয়ার জোগাড়। রোষানলের উত্তপ্তায় মেজাজ হারায় মেয়েটা। হিতাহিত জ্ঞান মুহূর্তে ভুলে যায়। কিসের মাসী! কিসের দিদি! সব সম্পর্ক গুলো ধোঁয়াটে হয়ে আসে এক মুহূর্তের মাঝে।
অতঃপর নিমিষেই সব কিছু ভুলে ঠাস্ করে চড় মেরে দেয় তৃপ্তীশ এর গালে।

চলবে….

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে #নিতু_সরকার
পর্ব:১২

“ কি হচ্ছে কি এখানে? রিদিমা! আর ইউ ওকে?”

সমরের ভরাট কন্ঠটা কানে ভেসে আসতেই রিদিমা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। ততক্ষণে চড় খেয়ে হাত ঢিলে হয়ে গেছে তৃপ্তীশ এর। স্তব্ধ চাহনিতে তার রাশি রাশি বিস্ময়। রিদিমা ঢিল পেতেই হাত টা ছাড়িয়ে নিলো এক টানে। মুখের উপর আঙুল তুলে ঝাঁঝাল গলায় শাসালো,
“ ফারদার যদি আমার সাথে এমন বেয়াদপি করার চেষ্টা করেছেন তবে নেক্সট টাইম থাপ্পড় নয় জুতোর বাড়ি পড়বে আপনার গালে।”

রিদিমা আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। আর না সমরের দিকে তাকালো। চারিদিকে ছেলেমেয়েদের ভিড় জমে উঠতে দেখে লজ্জা পেয়ে সোজা ছুটে চলে গেল কলেজের ভেতরে। ওদিকে সমরও হতবাক। বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো রিদিমার ছুটে যাওয়ার পানে। কিন্তু পর মুহূর্তে কিছুক্ষন আগের ঘটনা মনে পড়লো। রিদিমাকে গেটে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে হঠাৎ চোখে ভাসলো তৃপ্তীশ এর ছুটে এসে রিদিমার হাত চেপে ধরার দৃশ্য। ব্যস, গাড়ি ওখানেই থামিয়ে রাস্তা পার করে এপাশে আসতে আসতেই রিদিমার থাপ্পড় দেয়া শেষ।

আজকাল স্কুল কলেজে কিম্বা বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে পাতি রোমিও দের জ্বালায় অতিষ্ট মেয়েরা। তাদের ঝুড়ি ভরা ভালোবাসা একসেপ্ট না করলেই চলে হিংসাত্মক আক্রমণ। কখনও অ্যাসিড কান্ড আবার কখনও কিডন্যাপ করে রেপ অথবা অন্য কিছু। তৃপ্তীশকে সেরকমই একজন পাতি বখাটে মনে করে সমরের মাথায় রাগ চড়ে গেল। এমনিতেও আজ মেয়েটার যে দশা ও নিজ চোখে দেখেছে তাতে ধারণা করে ফেলল হয়তো এই ছেলেটার এমন পেছনে লাগার কারণেই রিদিমার এমন দুর্বিষহ মানসিক অবস্থা।

সমরের ধারণা ভুল হোক আর ঠিক, তৃপ্তীশই যে মেইন কালপ্রিট এটা কিন্তু মিথ্যে নয়। সমর রাগী চোখে তৃপ্তীশ এর দিকে তাকালো। নিচের ঠোঁট কামড়ে আঙুল নাচিয়ে শাসালো,
“ খবরদার। নেক্সট টাইম যেন তোকে রিদিমার আসেপাশে না দেখি। নাহলে তোর মতো পাতি মাস্তান কে চৌদ্দ শিকের গারদে পুরতে আমার দুই মিনিট ও লাগবে না।”

তখনও গালে হাত তৃপ্তীশ এর। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে ঘুরছে তার মস্তিষ্ক। বিশ্বাস ই হচ্ছে না, সামান্য হাত ধরার কারণে এভাবে তাকে সবার সামনে রিদিমা চড় মেরেছে। রিদিমার চড়ের রেশে যখন ডুবে ছেলেটা ঠিক তখনই এক অপরিচিত লোকের শাসানি শুনে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল তৃপ্তীশ। এমনিতেই রিদিমার চড়ের কারণে রাগে ফুঁসছিল সে তাতে করে তাকে এমন থ্রেড দিয়ে পাতি মাস্তান বলায় গায়ে লেগে গেল ভীষণ। রেগে মেগে একাকার হয়ে সমরের কলার চেপে ধরলো তৃপ্তীশ।রাগে খেই হারিয়ে মুখে যা আসলো তাই বলে গেল অনর্গল।
“ শু য়োরের বাচ্চা, আমাকে চৌদ্দ শিকের গারদে পুরতে চাস। দেখি তোর কতবড় বুকের পাটা।”

ভদ্দর লোকের যতো সম্মান কলারে। নিজের কলারে তৃপ্তীশ এর হাত টা দেখে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো অবস্থা সমরের। কিন্তু সবার সামনে সেই রাগ প্রকাশ করা ঠিক নয় ভেবে শীতল কণ্ঠে বলল,
“ কলার ছাড়।”
“ ছাড়বো না। কি করবি!”

সমর কালো সানগ্লাসের ফাঁক দিয়ে চোখ কুঁচকে তাকালো। শিরা উপশিরায় ছুটে বেড়ানো রাগের চরম উদগীরণ টুকু জোর করে গিলে নিয়ে আবারো বলল শীতল গলায়..
“ ভালোভাবে বলছি কলার টা ছাড়।”

তৃপ্তীশ তখন পাগলা হয়ে গেছে। ক্ষ্যাপা কুত্তার মতো তার আচরণ। দুই দুবার বোঝানোর পরও সে ছাড়তে চাইলো না বরং খিস্তি দিয়ে গেল জঘন্য জঘন্য। ব্যস, আর কি লাগে সমর বাবাজির রাগের বিস্ফোরণ হতে! এমনিতেই রাগী মানুষ তিনি। তার উপর আবার সহ্য ক্ষমতাও কম।
দাঁতে দাঁত চেপে সমর প্রথমে তৃপ্তিশের হাতের মুঠো থেকে কলার টা ছাড়ালো তারপর কষিয়ে দিলো চোয়াল ভাঙা এক থাপ্পড় যেখানে একটু খানি আগেই রিদিমা তার নরম হাতের ছাপ বসিয়ে গেছে। চড় টা খাওয়ার সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো তৃপ্তীশ, চার হাত পা চারদিকে ছড়িয়ে। জড়ো হওয়া ভিড়ের মাঝে হুট করেই ভাটা পড়লো চাপা উত্তেজনার ঢেউ। সমর কলার টা ঠিক করতে করতে দুপা হেঁটে এলো। হাঁটু ভাঁজ করে তৃপ্তীশ এর সামনে ঝুঁকে বসলো। বিদ্রুপ করে বলল,
“ এই জন্যই তোকে বার বার ওয়ার্নিং দিচ্ছিলাম। কিন্তু তুই শুনলি না। যাগ্গে সে সব, তোকে দেখে আমার মোটেও বখাটে মনে হচ্ছে না। ভদ্র ঘরের ছেলে বলেই মনে হচ্ছে। কেন শুধু শুধু রাস্তাঘাটে মেয়েদের টিজ করে বেরাচ্ছিস বলতো। সেই সাথে শুধু শুধু মার ও খাচ্ছিস যার তার হাতে।
শোন, তোকে একটা সিক্রেট বলি। মেয়েরা আজকাল প্রেম ভালোবাসায় পটে না। মেয়েরা পটে মানি তে। পকেটে যার যতো বেশি মানি মেয়েরা ততো দৌড়ায় ও তার কাছে বুঝেছিস। যা বাড়ি যাহ্।”

তৃপ্তীশ এর কাঁধে চাপড় দিয়ে উঠে দাঁড়ালো সমর। অতঃপর সামনে জমায়েত ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ দ্যা শো ইজ ফিনিশড গাইজ। প্লীজ ক্র্যারি অন।”

সমরের হাতের ইশারায় লোকজন ভিড় কমাতে শুরু করতেই ধুপ ধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল সে। ওদিকে তৃপ্তীশ যেন পাথর হয়ে গেছে। একদিকে রিদিমার করা অপমান অন্যদিকে সমরের তীব্র আঘাত মাথা নষ্ট করে দিয়েছে। তৃপ্তীশ থুক করে একদলা ধুলো মাখা থুতু ফেলল। থু এর সাথে বেরিয়ে এলো হালকা লালা মিশ্রিত রক্ত।তৃপ্তীশ আস্তে ধীরে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ালো আসেপাশের মানুষের তেরছা নজর আর বাজে কথা শুনতে শুনতে। তৃপ্তীশ দাঁতে দাঁত চাপলো। রাগে রক্তিম চোখ জোড়া বুজে নিয়ে মনে মনে বলে উঠলো,
“ কাজ টা তুমি মোটেও ঠিক করলে না রিদিমা। মোটেও ঠিক করলে না।”

*
রিদিমা আজ আর ক্লাসে গেল না। সোজা গিয়ে বসলো ক্যান্টিনে। ঠিক পনেরো মিনিট পর হুড়মুড় করে ছুটে এলো রিনি আর জবা। তাদের পেছন পেছন এলো অভিষেক আর কপিল। সকলের দৃষ্টিতে অস্থিরতা। চোখে মুখ চিন্তায় উদ্বিগ্ন। রিদিমা টেবিলের উপর দুহাত তুলে মুঠো পাকিয়ে তার উপর কপাল ঠেকিয়ে বসে ছিল চোখ বুজে। আজ সকাল থেকে যা কিছু ঘটেছে তার সাথে সে সব কিছুই ঘুরছিল মাথার মধ্যে। রিনি রিদিমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে পাশের চেয়ার টা টেনে বসলো। কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলল,
“ রিদি এই রিদি। কি হয়েছে রে? সবাই কি সব বলছে তোর নামে? কাকে চড় মেরেছিস?”

রিদিমা রিনির করা একটাও প্রশ্নের জবাব দিলো না। আসলে দেবার মতো অবস্থা নেই তার। তাই বসে রইলো ওভাবেই। রিনি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো অভিষেক। চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলে রিদির মাথায় হাত রেখে বলল,
“ এই রিদি তাকা আমার দিকে।”

রিদিমা তবুও তাকালো না। পড়ে রইলো ওভাবেই। অভিষেক আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ থাক তাহলে। যদি আমাদের কে তোর সমস্যা গুলো বলতে কোনো আপত্তি থাকে তাহলে আর বলতে হবে না। তবুও বলবো, আমরা সবাই তোর বন্ধু। তোর আত্মার সাথী। তোর সাথে যেমন আনন্দ ভাগ করতে জানি তেমনি তোর কষ্ট টাও ভাগ করে নিতে পারবো রে। একটা বার বিশ্বাস করে দেখ।”

রিদিমা আর পারলো না ওভাবে থাকতে। মনটা ভেঙ্গেচুরে এলো একেবারে। হা করে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে তাকালো আস্তে ধীরে। ও মুখ তুলে তাকাতেই সবাই চমকে উঠলো ওর জমাট বাঁধা রক্তলাল চোখ জোড়া দেখে। রিদিমা মুখ চেপে আবারো ফুঁপিয়ে উঠলো। কপিল বুঝলো মেয়েটা হাইপার হয়ে আছে চিন্তায় ভাবনায়। সাথে সাথে ছুটে গিয়ে ক্যান্টিনের ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জুস নিয়ে জোর করে খাওয়ালো ওকে। বেশ কিছুক্ষণ পর রিদিমা আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এলো। তারপর বেশ সময় নিয়ে বিগত মাস দুই ধরে ঘটে চলা কাহিনীর মোটামুটি যতোটা পারা যায় সব টা জানালো খুলে সবাই কে। এমনকি আজকের ঘটনাটাও। সবাই শুনে হতাশার শ্বাস ফেলল। সাথে বিরক্ত ও হলো খুব। এই তৃপ্তীশ নামের উটকো ঝামেলা সম্পর্কে প্রায় কম বেশি সবারই জানা। মাঝে সাজেই কল আসতো রিদিমার ফোনে। মেয়েটা কখনও রিসিভ করতো কখনও কেটে দিতো বিরক্ত হয়ে। কিন্তু তাই বলে যে ঘটনা টা এই পর্যায়ে চলে যাবে কেউ আন্দাজ করতে পারে নি। হঠাৎ ব্যাগ পিঠে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো কপিল।
“ ধুর বা*ল! এই ভাবে মুড অফ ভাল্লাগছে না।”
“ তো, কি করতে চাচ্ছিস।”

রিনির কথার উত্তরে কপিল বলল,
“ চ সবাই মিলে আল্লু অর্জুনের পুষ্পা 2 মুভিটা দেখে আসি। শুনলাম নাকি হেব্বি অ্যাকশন।”

রিনি সাথে সাথে রাজি হলো। ওর অনেক দিনের ইচ্ছে মুভিটা দেখার। জবা ও খুশি। কিন্তু রিদিমা রাজি হলো না। উদাস নয়নে দূরে তাকিয়ে বলল,
“ তোরা যা। আমি যাবো না।”

অভিষেক বুঝলো রিদিমার মনের অবস্থা। কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ এভাবে মন খারাপ করে বসে থাকলে এমনিতেই অসুস্থ হয়ে পড়বি। ভুলে যাস না সামনেই কিন্তু ইয়ার ফাইনাল। এই মুহূর্তে মন মেজাজ ভালো রাখা খুবই প্রয়োজন। এই কারণেই বলছি চহ, সবাই মিলে মজা করে আসি।”

রিদিমা তাও আগ্রহ দেখালো না দেখে রিনি আর জবা দুজনে পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরলো। ঠোঁট উল্টে কাচুমাচু মুখ করে বলল,
“ চল না বান্ধবী। প্লীজ! আমার কতো দিনের ইচ্ছে মুভিটা দেখার।”

অগত্যা শেষ মেষ রাজি হতেই হলো রিদিমাকে। ওরা কলেজ থেকে বেরোনোর সময় সীমা কে কল করলো। সীমা ফোন রিসিভ করে জানালো ও মুভি দেখতে যাবে না। ওর নাকি কি একটা কাজ আছে বাড়িতে। ওরা আর দেরি না করে পাঁচ জনেই বেড়িয়ে পড়লো। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হাসাহাসি আড্ডায় মেতে উঠলো। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে কিছুক্ষন আগের তিক্ততা ভুলে গেল রিদিমা। আসলে বন্ধুরা এমনই হয়। মন ভালো করার মেডিসিন। যাদের কাছে থাকলে পৃথিবীর সমস্ত সমস্যার সমাধান সম্ভব।

*
বিশাল কাঁচের দেওয়াল ঘেঁসে আর্টিফিসিয়াল লতানো গাছ টা উঠে গেছে এঁকেবেঁকে। পাশেই ছোট ছোট কয়েকটা পটে মানি প্ল্যান্টের পট বসানো। দুপুরের ভষ্ম করা রোদের তাপ টা কাঁচ ফুঁড়ে ভেতরে ঢুকতে না পারলেও তার ক্ষীণ কিরণ আলোকিত করে রেখেছে গোটা কক্ষ। এসির শীতল হওয়ায় গোটা কেবিনে যেন অসময়ের বসন্ত নেমেছে আরামদায়ক উষ্ণতার অনুভূতিতে। আজকের মিটিং টা সমর কে ক্যান্সেল করতে হয়েছে সকালের ওই ঘটনার পর। মেজাজ টা দারুন ভাবে চটে ছিল তার। মিটিং এ বসলেও ঠিক করে কনসেন্ট্রেট করতে পারতো কি না সন্দেহ ছিল সে বিষয়ে। তাই ক্লায়েন্ট দের কাছে মিটিং টা বিকেলে মানে আফটার লাঞ্চ ব্রেকের পর করার অফার রেখেছে। তারা ও রাজি হয়েছে তাতে।

আজ হঠাৎ বহু দিন পর সমরের ভাবনায় ঠাঁই পেয়েছে আস্ত এক নারী অস্তিত্ব। যার কান্না গুলো এখনও বেসুরো ভায়োলিনের মতো বেজে চলেছে তার মনের আনাচে কানাচে। রিদিমা, চরিত্র টা বড্ড শক্ত পোক্ত। বড্ড তেজ মেয়েটার চোখে। কোনো কিছুতে দমে না যাওয়া যার সহজাত স্বভাব আজ সেই মেয়েটাকে এতোটা ভঙ্গুর দেখার পর থেকে মনটা বড় অস্থির হয়ে গেছে সমরের। পকেটে দুহাত গুঁজে নিশ্চল চোখে সমর বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। কাঁচের দোয়ালের স্বচ্ছতা ভেদ করে চোখে ভাসছে রৌদ্র ক্লান্ত দুপুরের এক জ্বলজ্বলে প্রেক্ষাপট। সেই সাথে মনের ক্যানভাসে ভাসছে এক জোড়া জ্বলন্ত চোখে নেমে আসা অবিরাম শ্রাবণ ধারা।

“ কি ভাবছিস এতো মনোযোগী হয়ে?”

আচমকা রঙ্গন এর কন্ঠ শুনে চমকে উঠলো সমর।
“ আরে তুই! কখন এলি?”
“ এলাম তো বেশ কয়েক মিনিট। আগে বল তুই কোন ভাবনায় ডুবে ছিলি?”
“ নাথিং ইম্পর্ট্যান্ট। বাদ দে।”
বলেই চেয়ার টেনে বসে গা এলিয়ে দিলো সমর।
“ কি ব্যাপার আজ অফিস যাসনি?”
“ না রে একটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করার জন্য বাড়িতেই ছিলাম।”
বলেই টেবিলের সামনের চেয়ার টা টেনে বসলো রঙ্গন। সমর অন্যমনস্ক হয়ে পেপার ওয়েট টা ঘুরাচ্ছিল। রঙ্গন সেদিকে লক্ষ্য করে বলল,
“ তোর কি মন খারাপ?”
“ হুহ! না তো!”
“ তাহলে আজ কাজ কাম বাদ দিয়ে অন্য ভাবনায় মত্ত.. ব্যাপার টা ঠিক হজম হচ্ছে না। ঘটনা টা কি বলতো? প্রিয়ার কল টল এসে ছিল নাকি?”

হাত থামিয়ে ফিক করে হেসে ফেললো সমর। ঠোঁট বাঁকানো কেমন যেন তাচ্ছিল্যের শুষ্ক হাসি। চোখের চাহনিতে ভয়ংকর ঘৃণার উদ্বেগ তুলে বলল,
“ এ আর নতুন কি! সেতো প্রায়ই আসতেই থাকে।”

রঙ্গন সমরের চাহনি দেখে আস্তে ধীরে মেপে মেপে বলল,
“ আরেকবার কি ভেবে দেখা যায় না?”
“ কোন বিষয়ে?”
“ তোর আর প্রিয়ার বিষয়ে। দেখ এটা ভুলে গেলে কিন্তু চলবে না তোদের মাঝে বর্তমানে সায়ন ও আছে। তোরা তোদের মতো নিজেদের জীবন কাটালেও বেচারা ওই টুকু বাচ্চা টা সাফার করছে শেষ পর্যন্ত।”

সমর চেয়ার ছেড়ে ছুটে দাঁড়ালো। রঙ্গন তাতে কেঁপে উঠলো খানিক টা। সমর ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস টেনে নিজেকে সামলে বলল,
“ একটা পাঁচ মাসের দুধের সন্তান কে ফেলে যে মা চলে যেতে পারে তার ফিরে না আসাই ভালো। কারণ আমার বাচ্চাটা বিগত চার বছরে নিজের মতো করে বাঁচতে শিখে গেছে। আশা করি তার এই মুহূর্তে আর কাউকে প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে ওই মহিলা কে তো না ই।”

*
সারাদিনের ঘোরাঘুরি শেষে রিদিমা মিতালী কে কল করলো। বর্তমানে পাঁচটার বেশি বাজে। সিনেমা দেখে শপিং মল ঘুরে বেরোতে বেরোতে এই সময়। মিতালী ফোন তুলতেই বলল,
“ আজ আর যেতে পারলাম না মিতালী দি। আসলে মাত্রই ক্লাস শেষ হলো।”

মিতালী স্বচ্ছ হেসে জানালো,
“ আরে না না ঠিক আছে। তোমার সামনে পরীক্ষা। সময় না পেলে আসার দরকার নেই।”

রিদিমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।
“ আচ্ছা মিতালী দি আমি না হয় কাল সকালে অংকুশ কে পড়িয়ে দেবো। ওকে তুমি ঘুম থেকে তুলে রেডি করে রেখো।”

মিতালী ঠিক আছে বলে কল কাটলো। রিদিমা বন্ধুদের থেকে বিদায় নিয়ে বাস ধরলো বাড়ি ফেরার। তার আগে যাবে সায়ন কে পড়াতে।

*
সায়ন কে পড়িয়ে প্রায় আট টা নাগাত বাড়ি ঢুকলো রিদিমা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে হাজার বার মা কালীর নাম জপ করলো। তারপর বুকে ফুঁ দিয়ে কলিং বেলটা বাজালো। কিন্তু কেউ দরজা খুলল না। রিদিমা এবার পর পর দুবার কলিং বেলটা বাজালো। তাও কেউ দরজা খুলল না দেখে ফোন বার করে কল করলো মায়ের নম্বরে। কিন্তু তাকে হতাশ করে দিয়ে ফোন টা বন্ধ শোনালো। এবার রিদিমা বাবা কে কল করলো। লম্বা রিংটোন বাজার একদম শেষ মুহূর্তে এসে ফোন রিসিভ করলেন তপন বাবু। রিদিমা বেশ রাগ নিয়ে বলল,
“ কতক্ষন ধরে বেল বাজাচ্ছি। শুনতে পাচ্ছো না তোমরা।”

ওপাশ থেকে তপন বাবু সহসা কিছু বলতে পারলেন না। তবুও বেশ সময় নিয়ে রয়ে সয়ে বললেন,
“ আমরা বাড়িতে নেই মা।”

রিদিমার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো চিন্তার। সে শুধালো..
“ কতক্ষন লাগবে তোমাদের ফিরতে?”
“ আজ হয়তো ফেরা হবে না।”
“ কেন?”

তপন বাবু টেনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ধরা গলায় বললেন,
“ তোমার মা হসপিটালে। মাইনর কার্ডিয়াক অ্যাটাক হয়েছে মনির।”

চলবে….