#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: #নিতু_সরকার
পর্ব:১৩
ঝড়ের গতিতে কোনো মতে ছুটে এলো রিদিমা। সময় টা রাত। তাই বিল্ডিং এর ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই। রিদিমা তবুও অনেক কষ্টে দাঁড়িয়ে রইলো গেটের পাশে। তপন বাবু মেয়ের কল পেয়ে আস্তে ধীরে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে এলেন। রিদিমা বাবা কে দেখে ছুটে এগিয়ে গেল। অস্থির কণ্ঠে শুধাল,
“ বাবা, মাহ্..!”
তপন বাবু মেয়ের অশ্রুসিক্ত পরিশ্রান্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ আপাতত ঠিক আছে তোমার মা। কাল সকালেই ডিসচার্জ। চলো, এখন বাড়িতে যাওয়া যাক।এখানে থেকে আর লাভ নেই।”
রিদিমা আর কথা বাড়ালো না। বাবার সাথে রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। ভাঙাচোরা কদমে।
রাতের কোলাহলহীন সড়কে অটো চলছে শা শা গতিতে। দূরে দাঁড়ানো ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চকচক করছে চতুর্দিক। অটোর খোলা পাশ গুলো দিয়ে হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে রাশি রাশি শীতল বাতাস। সেই বাতাসে দোল খেয়ে উড়ছে রিদিমার বিনুনি খুলে বেরিয়ে আসা কয়েকগোছা চুল।
“ বাবা!”
“ হুম্!”
“ মায়ের এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী তাই না।”
আকর্ন নিস্তব্ধতার পূরট দেওয়াল ভেদ করে রিদিমার ভারী কথাগুলো তপন বাবুর হৃদপিন্ডে বিঁধে গেল। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে তৎক্ষণাৎ কোনো মন্তব্য করলেন না। শুধু একটা হাত মেয়ের মাথায় রেখে বললেন,
“ এ বিষয়ে বাড়ি ফিরে কথা বলি মা!”
রিদিমা মাথা নেড়ে চুপ হয়ে গেল বাবার কথায়। কিন্তু চুপ রইলো না তার নয়ন জোড়া। আঁধারের আড়াল পেয়ে চুপিসারে তারা ভেসেই চলল বাঁধ ভাঙা কান্নায়। হাসপাতালে আসার পথে সুতপা মাসীর ফোন এসেছিল। কল রিসিভ করার পর যা মুখে এসেছে তাই শুনিয়েছে সে। তার কথার প্রতিটা ভাঁজে ছিল তার প্রতি অশেষ ক্রোধের অভিক্ষেপ। রিদিমা সইতে পারছে না সে সব কথা।
প্রায় চল্লিশ মিনিট পর তারা বাড়িতে পৌঁছলেন। তপন বাবু গেলেন নিজের রুমে রিদিমা নিজের। মিনিট পনের কাটতে না কাটতেই কলিং বেলটা বেজে উঠলো। তপন বাবু তখন সদ্য স্নান সেরে বেরিয়েছেন ওয়াশরুম থেকে। এতরাতে কলিং বেলের আওয়াজ শুনে এগিয়ে এসে দরজা খুললেন। তনু আর জামাই দীপ্ত কে দেখে অবাক হয়ে বললেন,
“ আরে দীপ্ত তনু তোমরা?”
“ সুনু কোথায় বাবা?”
তপন বাবুর বুক টা ধুক করে উঠলো পরমার ঝাঁঝালো গলা শুনে। বড় মেয়ে জামাই যে এতো রাতে কেন এসেছে সেটা তার ভালো করে বোঝা হয়ে গেছে। তবুও তিনি বললেন,
“ থাক না মা। এতো রাতে এসব নিয়ে কথা বাড়াতে আর ভালো লাগছে না।”
“ ভালো লাগছে না বললে তো চলবে না বাবা। ওকে তো বুঝতে হবে ওর অন্যায় টা কোথায়? সুনু, এই সুনু বেরিয়ে আয় বলছি।”
রিদিমা তখন সদ্য স্নান করে বেরিয়েছে। মাথায় গামছা পেঁচানো। দিদির কর্কশ কন্ঠের ডাক শুনে তড়িঘড়ি বেরিয়ে এলো বাইরে। পরমা ওকে দেখা মাত্রই বলা কওয়া বাদে তেড়ে এসে ঠাস্ করে চড় মারলো গালে।
“ আহ্ তনু! হচ্ছেটা কি এসব। আমি বললাম না এতো রাতে অশান্তি করতে ইচ্ছে করছে না।”
তপন বাবু ছুটে এসে আগলে নিলেন রিদি কে। তনু বাবার কথা কানে তুলল না। যারপরনাই রেগে আগুন হয়ে বলে উঠলো,
“ শুধু মাত্র তোর কারণে আজ মায়ের এই অবস্থা। তোর কারণে আমার শ্বশুড় বাড়িতে অশান্তি চলছে। মাসীমণি কেও অপমানিত হতে হয়েছে তোর কারণে। খুব বড় হাত হয়ে গেছে তোর তাই না। কত বড় সাহস হলে তৃপ্তীশ কে চড় মারিস কলেজের ছেলেমেয়েদের সামনে।”
রিদিমা গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। দিদির কথা শেষ হতেই মুখ তুলল ও।
“ তোরা আমার চড় মারাটাই দেখলি। আর ঐ লোকটা যে সবার সামনে আমার হাত ধরে টানাটানি করছিল সেটা দেখলি না।”
“ সে তো এমনি এমনি টানতে যায় নি। তুই তাকে বাধ্য করেছিস এসব করতে। সে তো চেয়েছিল তোর সাথে বসে আলোচনা করতে। সে সুযোগ কি দিয়েছিলি তুই? দিসনি।
শোন সুনু, তুই হয়তো নিজেকে ঐশ্বর্য রাই কিম্বা আলিয়া ভাট ভাবছিস। তাই তো তৃপ্তীশ এর এতো এতো কেয়ার তোর ভালো লাগছে না। আমি তোকে সত্যি টা বলছি শোন। তুই মোটেও নিজেকে যা ভাবিস তা নোস। একটা কালো নন কোয়ালিফায়েড মেয়ে হয়ে নিজেকে নিয়ে এতো অহংকার কিসের তোর?”
তপন বাবু বড় মেয়ের কথায় অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন। পরমা না থেমে বলেই গেল…
“ তোর জন্য কোনো টাটা বিড়ালা আদানি আম্বানী দের ঘর থেকে সম্বন্ধ আসবে না। যার কারণে তোর এতো অহমিকা।”
“ ব্যস অনেক হয়েছে। এবার থামো বলছি। ও যখন বলেছে তৃপ্তীশ এর সাথে বিয়ে করতে চায় না মানে এই সম্বন্ধ টা কিছুতেই আগাবে না। অনেক রাত হয়েছে। হয় তুমি বাড়ি যাও নয়তো তোমার ঘরে যাও।”
পরমা বাবার দিকে তাকালো। চোখ ভর্তি আগুন আর বুক ভর্তি উত্তাপ নিয়ে বলল,
“ আমাকে তুমি তাড়িয়ে দিচ্ছ বাবা।”
তপন বাবু চোখ বুজে অসহায় শ্বাস ফেললেন। মেয়েটার ব্যবহারে আজ তিনি সত্যিই স্তম্ভিত। যাকে নিয়ে তিনি এতোদিন গর্ব বোধ করতেন আজ তা যেন ধুলোয় মিশে গেল। ছোট বোনের গায়ে হাত তোলা তাকে আজে বাজে কথা শোনানো। এসব ই কি শিখিয়ে ছিলেন তিনি এতো গুলো বছর ধরে!
তপন বাবু নিঃস দৃষ্টিতে জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে বললেন,
“ আমাকে ক্ষমা কর বাবা। আজ পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে আমি চেয়েও তোমার আদর যত্ন করতে পারছি না।”
দীপ্ত তপন বাবুর কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। ঝট করে হাত দুটো ধরে বলল,
“ আরে না না, আমি কিচ্ছু মনে করিনি বাবা। আসলে কি বলুন তো, তৃপ্তীশ এর গায়ে হাত তোলা নিয়ে রিতা আন্টি খুব বাজে কথা শুনিয়েছে বাবা মা পিসিমা এমনকি তনু কেও পর্যন্ত।”
রিদিমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ রিদি তুমি তোমার দিদির কথায় কিছু মনে করো না বোন। আসলে সবাই সবার ঝাল ওর উপর দিয়ে মেটাচ্ছে তো তাই ওর এই অবস্থা।”
দীপ্ত আর কথা বাড়ালো না। পরমা কে নিয়ে বেরিয়ে গেল তখনই। সেদিন গোটা রাত রিদিমা দুই চোখের পাতা এক করতে পারলো না। নোনা জলের ভিড় বারেবারে এসে ব্যাকুল করে তুলল তাকে। তপন বাবু খাবার গরম করে মেয়ে কে ডাকলেন। কিন্তু রিদিমা উঠলো না। পরদিন সকাল সাড়ে বারোটার সময় মনিকা কে বাড়িতে আনা হলো। তার সাথে এলো পরমা সুতপা আর তপন বাবু। রিদিমাও অবশ্য গেছিল কিন্তু তাকে হাসপাতালের গেট থেকেই বাড়িতে ফিরে আসতে হয়েছে সুতপা আর পরমার দাঁত খিঁচুনি শুনে। মনিকা বাড়িতে ফিরে আসার পর থেকে একদম চুপ হয়ে রইলো। একটা কথাও বলল না কারো সঙ্গে। না পরমার সাথে আর না দিদি সুতপার সাথে। রিদিমা অনেক বার মায়ের কাছে আসার চেষ্টা করলো কিন্তু অন্তর দ্বন্দ্ব আর অপরাধ বোধের বেড়াজালে আটকে দরজা থেকেই ফিরে গেল বারংবার।
মাঝখানে কেটে গিয়েছে প্রায় দশ দশটা দিন। রিদিমার পড়াতে যাওয়া বন্ধ করতে হয়েছে মায়ের অসুস্থতার কারণে। কলেজ যাওয়া ও বন্ধ এ কটা দিন। তখন বিকেল। কলিং বেলের আওয়াজ শুনে রিদিমা এসে দরজা খুলতেই চমকে উঠলো সীমা আর ওর মা বাবা কে দেখে।
“ আমি আপনার মতো ভাগ্যবতী নই দিদিভাই। কুসন্তান পেটে ধরেছিলাম তাই তো আমার এই অবস্থা।”
চায়ের ট্রে টা রাখতে গিয়ে হাত থেমে গেল রিদিমার। সীমার বাবা মা থমথমে দৃষ্টিতে তাকালেন রিদির দিকে। মনিকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“ খুব ভালো লাগলো আপনার মেয়ের বিয়ের খবর শুনে। কিন্তু এই অসুস্থ শরীর নিয়ে বোধ হয় আমার যাওয়া হবে না। তবে মেয়ে চাইলে যেতে পারে। আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই।”
সীমার মা বিয়ের কার্ড টা মনিকার হাতে দিয়ে বললেন,
“ এভাবে বললে তো চলবে না দিদিভাই। আপনাকে তো বিয়ের দুদিন আগেই পৌঁছতে হবে আমাদের বাড়িতে। মনে নেই পরমার বিয়েতে আপনি জোর করে আমাকে নিয়ে এসেছিলেন।”
রথীন বাবু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
“ তবে যাই বলেন বৌদি জামাই কিন্তু আমাদের খুব ভালো। মেয়েটা কে পাওয়ার জন্য যা যা করলো কি আর বলবো। তাই তো রেজিস্ট্রার বদলে একবারে চার হাত এক করে দিচ্ছি। আপনি আসবো না বললে তো চলবে না।”
মনিকা মনের কষ্ট বুকে চেপে আবারো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন,
“ চেষ্টা করবো।”
রাতের নিস্তব্ধ তারবিহীন অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিদিমা। দুই চোখের কার্নিশ ভিজিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রাশি রাশি তপ্ত নোনা জল। সেদিনের পর থেকে আজ কতগুলো দিন হয়ে গেছে মা তার সাথে কথা বলে না। আর না রাগ দেখায় ওর পরে। কথা বলতে গেলে এড়িয়ে যায়। উত্তর দেয় না কিছু জিজ্ঞেস করলে। তার ছোঁয়া রান্না তার দেওয়া জল এমন কি তার এগিয়ে দেওয়া ঔষধ গুলোও প্রত্যাখ্যান করে নির্বিকারে। আর কতবার ঠিক আর কতবার ক্ষমা চাইলে মা মা তাকে ক্ষমা করে দেবে সে জানে না। মায়ের এই নীরবতা তাকে যে প্রতিটা মুহূর্ত কি ভীষণ পীড়ায় জ্বালিয়ে মারছে তাকি মনিকা জানে? হয়তো জানে। সেই জন্যই বোধ তার এই অভিনব শাস্তির আয়োজন। আগামী কাল সীমার বিয়ে। আজই তার ওদের বাড়িতে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিকেলে মাসীমণি এলে মা তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে কতো গুলো এমন এমন বাজে কথা বলল যা শোনার পর যাওয়ার আগ্রহটাই চলে গেল। রিদিমা অনেক অনেক ভাবলো। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলো সে এই অশান্তির অবসান ঘটাবে। আর যে এসব সহ্য করা যাচ্ছে না।
চলবে….
#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে নিতু সরকার
পর্ব:১৪
“ বাবা! ”
“ হুম্!”
“ আমার কিছু বলার ছিল তোমায়!”
তুলতুলে আলোয় উদ্ভাসিত নরম রোদের তাপে ভেজা কোমল এক সকাল। চিকচিক করছে গাছের ডালে সদ্য গজানো কচি কচি পাতা গুলো। গত কয়েকদিনের চামড়া পোড়া গরমকে ছুটি দিয়ে ভোরের দিকে ঝিরিঝিরি বর্ষণে আজ সিক্ত হয়েছিল ধরণী। তাইতো বাতাসের আলতো ছোঁয়ায় এতো আবেগ, এতো স্নিগ্ধতা। বসার ঘরের সোফায় বসে ছিলেন তপন বাবু। হাতে চায়ের কাপের সাথে দৈনন্দিন খবরের কাগজ। নাকের ডগায় চশমা। মেয়ের ডাকে মুখ তুলে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,
“ আয় মা বোস।”
রিদিমা বাবার পাশে চুপটি করে বসলো। বড় করে শ্বাস টেনে নিজেকে যেন অগ্রিম যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে নিলো। তপন বাবু পেপার টা ভাঁজ করে টেবিলে রাখলেন। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হতাশার শ্বাস ফেললেন। কি সুন্দর মেয়েটা তার। এই শ্যামলা নিখুঁত মুখটায় কতো যে মায়া তা যদি কেউ একটু বুঝতো তাহলে এতগুলো দিন ধরে মেয়েটার উপর কেউ রাগ করে থাকতেই পারতো না। কিন্তু আফসোস…! তিনি আলগোছে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ কি হয়েছে আমার মামনির?”
“ কিছু না।”
“ মন খারাপ!”
“ কিছুটা!”
“ আজ না তোমার বান্ধবীর বিয়ে। যাও গিয়ে আনন্দ করে এসো মন ভালো হয়ে যাবে।”
রিদিমা একথার জবাবে কিছু মুহূর্ত নীরব রইলো। মনের মধ্যে ভাবনা গুলো অসংলগ্ন হয়ে এদিক ওদিক ঘুরছে। সেগুলোকে যতোটা পারলো কুড়িয়ে কাছিয়ে গুছিয়ে নিয়ে তাকালো বাবার দিকে..
“ বাবা!”
“ হুম্!”
“ আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
“ কেমন সিদ্ধান্ত।”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে সে বলল,
“ আমি তৃপ্তীশ কে বিয়ে করবো।”
তপন বাবু চমকালেন না। তিনি জানতেন মেয়ের সিদ্ধান্ত কি হতে চলেছে..
“ হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত!”
“ হঠাৎ নয় বাবা। ভেবেই বলছি।”
তপন বাবু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন অপলক দৃষ্টিতে। কতো যে কষ্ট চেপে সিদ্ধান্ত টা নেওয়া তা মেয়েটার মুখের আদল দেখলে বোঝা যাচ্ছে। তপন বাবু মেয়ের হাতে হাত রাখলেন। ভরসা জড়ানো শীতল কণ্ঠে বললেন,
“ তোমার মা খারাপ নয় মামনি শুধু একটু ওভার পোসেসিভ। তার ধারণা সে যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই মঙ্গলজনক হবে তার সন্তানের জন্য।”
“ আমি জানি বাবা।”
“ গুড। শোনো মামনি এসব নিয়ে বেশি চিন্তা করার দরকার নেই বুঝেছো। মায়ের মনটা হার্ট হয়েছে, কিছুদিন সময় গেলে দেখবে এক সময় ঠিক ও হয়ে যাবে। বুঝতেই তো পারছো কয়েকদিন আগে কেমন অসুস্থ হয়ে পড়লো তাই জোর করে কিছু বলতেও পারছি না তাকে।”
“ আমি বুঝি বাবা।”
“ তাহলে আর কি, যাও বন্ধুর বিয়ে এনজয় করে এসো। এ বিষয়ে না হয় আমরা পরেই আলোচনা করবো।”
রিদিমা মাথা নাড়ালো। অতঃপর চলে গেল নিজের ঘরে। তপন বাবু আনমনে মেয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বাড়িতে এক অদৃশ্য ঠান্ডা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে মনিকা মেয়েটার সাথে। যে যুদ্ধের অস্ত্র আবেগ। এই আবেগের প্রগাঢ় বন্ধনেই তো আবদ্ধ থাকে মা আর সন্তানের সম্পর্ক। তাইতো কোনো সন্তানই মায়ের উপেক্ষা মেনে নিতে পারে না। মেয়েটাও পারেনি। তপন বাবু হতাশার শ্বাস ফেললেন। কোথাও যেন তিনি জানতেন মেয়েটা ভাঙ্গবেই। আজ সেটাই হলো। মেয়েটা ভেঙে গেল। মায়ের জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত মেয়েটার আত্ম অহমিকার মাথা নত হলো।
*
সীমার বাড়িতে রিদিমা যখন পৌঁছলো তখন বেলা প্রায় সাড়ে দশটা। সীমা ওকে দেখে গাল ফুলিয়ে বসে রইলো নিজের ঘরে। রিনি জবা গত কাল সকালেই চলে এসেছে। সকাল সাড়ে ছয়টায় ঢুকেছে অভিষেক আর কপিল। হাতে হাতে কাজ সামাল দিচ্ছে রথীন বাবুর সাথে।
“ এভাবে রাগ করিস না বান্ধবী। জানিসই তো মায়ের শরীর টা কতোটা খারাপ।”
সীমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো রিদিমা। সীমা আর রাগ ধরে রাখতে পারলো না। তবুও অভিমানী সুরে বলল,
“ তবুও কাল সন্ধ্যায় আসার চেষ্টা টুকু তো করতেই পারতিস।”
রিদিমা ওর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ও যে কাল আসতে গিয়েও আসতে পারে নি মায়ের অমন নোংরা কথা গুলো শুনে সে কথা আর বলতে পারলো না। সীমার কাজিনরা ততক্ষণে হৈ হৈ করে ঢুকলো ঘরে। সবার চোখে মুখে উচ্ছ্বাস। আনন্দের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে সবার মাঝে। সীমার মামী এসে তাড়া দিয়ে গেলেন। জানালেন যেহেতু সন্ধ্যার লগ্নে বিয়ে তাই ঘন্টা খানেকের মধ্যেই বরের বাড়ির লোকজন গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে হাজির হবেন। তাড়াতাড়ি যেন সীমা কে সাজিয়ে গুছিয়ে রেডি করে ফেলা হয়। এ খবরে সীমা কে নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। রিনি জবা ও মেতে উঠলো তাদের সাথে।
বিকেলের মরা রোদে চকচক করছে পরিবেশ। আলতো ভাসা মেঘে আকাশের মুখ টা অল্প অল্প ভার হয়ে আছে। বাতাসে উড়ছে এক স্নিগ্ধ বিকেলের সোদা সোদা গন্ধ। বিয়ে বাড়ির যাবতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে কমিউনিটি হলে।
গায়ে হলুদের পর্ব শেষে সীমাকে পাঠানো হয়েছে পার্লারে বধূ সাজে প্রস্তুত হবার জন্য। বাকিরাও যে যার মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছে। রিদিমা হলের ব্যালকনিতে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক তখনই জবা আর রিনি ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। রিদিমা তাকাতেই রিনি বলল,
“ তোকে না একটা জিনিস দেখানো হয় নি।”
“ কি জিনিস?”
“ দাঁড়া দেখাচ্ছি।”
বলেই ফোন টা খুলে একটা ভিডিও ওন করলো। একটা মারামারির চলমান ভিডিও। রিদিমা প্রথম দফায় কিছু বুঝতে না পারলেও ভালো করে লক্ষ্য করতেই চমকে উঠলো। জবা চোখের চশমা টা ঠিক করে বলল,
“ আসলে তুই আন্টি কে নিয়ে ব্যস্ত ছিলিস তো তাই আর পাঠাই নি তোকে।”
তৃপ্তীশ আর সমর কে ওভাবে মারামারি করতে দেখে অবাকের শীর্ষে রিদিমা। বিস্ময়ের তোপে চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে যেন। সে কাঁপা গলায় বলল,
“ এটা কবের ঘটনা।”
“ সেদিনেরই। তুই তৃপ্তীশ কে চড় টা মেরে বেরিয়ে আসার পর ওই লোকটার সাথে মারামারি লেগে যায়।”
“ কিন্তু কেন? সমর বাবুর সাথে তৃপ্তীশ এর আবার কিসের শত্রুতা।”
“ জানি না। তবে যারা ভিডিও টা করেছে তারাই বলছিল উনি নাকি তৃপ্তীশ কে মেরে শাসিয়েছে যাতে আর তোর পেছনে আর না লাগে।”
“ ওহ্ মাই গড!” ..বলেই কপালে হাত রাখলো রিদিমা।
সন্ধ্যার আধাঁর একটু একটু করে ঘনিয়ে আসতেই গোটা বাড়িটা ঝলমলিয়ে উঠলো আলোর বন্যায়। বিয়ে বাড়ির পরিবেশ মেতে উঠলো শ্রুতি মধুর প্রেমের সঙ্গীতের আয়োজনে। সকলে সেজে গুছে প্রস্তুত। ঠিক তখনই খবর পাওয়া গেল বর আসছে। সাথে সাথে বেজে উঠলো সানাই। ভিড় জমে উঠলো প্রবেশ দ্বারে। সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো জামাই বরণের উদ্দেশ্যে। গেট ধরা জামাই বরণ সব কিছুর পরিসমাপ্তি ঘটলো একঝাঁক শ্যালিকা দের কথা কাটাকাটি আর হাসি আনন্দের মধ্যে দিয়ে। তাদের মধ্যে রিদিমা নিজেকে জড়ালো না। চুপ করে বসে রইলো লজ্জার ললিমায় ঘিরে থাকা বধূ সাজে সজ্জিত বান্ধবীর পাশে। গেট থেকে ছাড় পেতেই রঙ্গন বর বেশে প্রবেশ করলো কমিউনিটি সেন্টারের ভেতরে। সাথে এলো ওর অফিসের কিছু কলিগ আর বন্ধু বান্ধবের দল সমেত আত্মীয় স্বজনেরা। বাকি সব বরযাত্রীর সাথে মিসেস চিত্রাও একহাতে নাতি কে ধরে ধীর পায়ে হেঁটে এলেন বউ দেখার জন্য। রিদিমা তাকে দেখে মিষ্টি হেসে উঠে এলো কাছে।
“ আন্টি?”
মিসেস চিত্রা রিদিমাকে হঠাৎ করে দেখে চমকে উঠলেন যেন। পরক্ষণে নিজেকে সামলে বললেন,
“ আরে রিদিমা, তুমি এখানে?”
রিদিমা হেসে বলল,
“ কনে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমি না থাকলে চলে! এনি ওয়ে আপনার শরীর কেমন আছে এখন?”
“ এই তো চলে যাচ্ছে কোনরকম, এই বয়সে বাতের ব্যথা নিয়ে আর কতো ভালো থাকা যায়। যাই হোক বাদ দাও ওসব। এবার বলো তোমার মা কেমন আছেন এখন?”
“ মা এখন ভালো আছে। আন্টি চলুন আমরা বাইরে গিয়ে বসি।”
রিদিমা সায়নের ছোট্ট হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে এলো। মিসেস চিত্রাও এলেন পেছন পেছন। রিদিমা মিসেস চিত্রা কে নিয়ে বাইরে সারি বেঁধে পাতানো চেয়ার গুলোতে গিয়ে বসলো। তারপর শুরু হলো তাদের কথপোকথন। কিন্তু কথার মাঝে রিদিমা আড় চোখে একজনকে মনে মনে খুঁজে গেল। কিন্তু মানুষের ভিড়ে হারিয়ে সেই কাঙ্ক্ষিত মুখটার দর্শন পাওয়া হলো না।
মিসেস চিত্রা বরাবরই মিষ্ট ভাষী মানুষ। পছন্দের কাউকে কে পেলে তো আর কথাই নেই। গল্পের ঝুড়ি খুলে বসেন তার সাথে। রিদিমাকে পেয়ে নাতির নামে এক প্রস্থ অভিযোগের পসরা সাজিয়ে বসলেন..
“ জানো রিদিমা তোমার ছাত্র না আজকাল ভীষণ দুষ্টু হয়েছে। আমার একটা কথাও শুনতে চায় না। পড়াশুনাও করে না একদম।”
রিদিমা সায়ন কে কোলে নিয়ে বসে ছিল। ওর ফোলা গালটা একটু টেনে দিয়ে আদুরে গলায় বলল,
“ এ মা তাই নাকি সায়ন! ঠাম্মি কি বলছে এসব। তুমি কি সত্যি সত্যিই কথা শোনো না তার কথা!”
সায়ন ম্যামের কাছে ধরা পড়ে গিয়ে মুখ গোজ করে বসে আছে। সেই সাথে কচলে চলেছে দুহাতের তালু। মুখের ভাব এমন যেন কেঁদে ফেলবে এক্ষুনি। রিদিমা সায়নের ছোট্ট গালে পর পর কয়েকটা হামি খেয়ে বলল,
“ না না আন্টি আপনার নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে। সায়ন এমন করতেই পারে না। তাই না সায়ন!”
সায়ন ওভাবে বসেই আস্তে ধীরে মাথা দোলালো। বোঝালো আসলেই তার ঠাম্মির ভুল হচ্ছে কোথাও। রিদিমা আর মিসেস চিত্রা সায়নের হাবভাব দেখে হেসে উঠলো খিলখিলিয়ে। সায়ন ও হাসলো ওদের হাসি দেখে। কুচি কুচি দাঁতের মিষ্টি মিষ্টি নজরকাড়া হাসি। ঠিক সেই মুহূর্তে সমর এসে দাঁড়ালো তাদের সামনে। মুখটা গম্ভীর করে। বেখেয়ালে রিদিমার চোখ দুটো তার দিকে পড়তেই চমকে উঠলো মেয়েটা। সাথে সাথে চোখে ভাসলো সেই দুপুরে দেখা ভিডিওর দৃশ্যটা। সেই সাথে মনে পড়লো সেদিন সকালের ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনা গুলো। মানুষটা গম্ভীর রাগী ঠোঁট কাটা ত্যাড়া। অথচ তাকে ওই আকস্মিক বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে কি যত্ন করেই না আগলে নিয়েছিল নিজের বুকের মাঝে।
রিদিমা ফট করে চোখ বুজে নিলো। সহসা কোথা থেকে যেন এক রাশ লজ্জা এসে জড়িয়ে নিলো তাকে। লোকটার সামনে সেদিন ও কেমন হ্যাংলার মতো করে কেঁদে ছিল ইস্। ভাবতেই রিদিমা যেন আরও গুটিয়ে গেল শরমে।
“ কেমন আছেন মিস্ রিদিমা?”
সমরের ডাকে মেয়েটা চোখ তুলে তাকালো। সাথে সাথে চোখে পড়লো মানুষটার অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন চওড়া মুখের আদল। চোখের ভাষায় ভাসতে থাকা একরাশ জিজ্ঞাসা। রিদিমা আজ কেন জানি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো লোকটাকে। সাদা ফরমাল প্যান্টের সাথে একটা শ্যাওলা রঙের পাঞ্জাবি পরা লোকটার গায়ে। বাম হাতে সিলভার রঙের ঘড়ি। ডান হাতের কব্জিতে চকচক করছে সোনার ব্রেসলেট আর বরাবরের মতো চোখে সেই রিমলেস চশমা। জ লাইনে উদ্ভাসিত গাম্ভীর্যের দৃঢ় কঠিন ছাপ। সমর রিদিমাকে অমন স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে দেখে গলা খাকারি দিতেই সাথে সাথে হুশে ফিরে এলো রিদিমা। আবারো আরেকদফা লজ্জায় পড়ে হাঁসফাঁস করে উঠলো মেয়েটা। কিন্তু সেই বিবৃত ভাব তার বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কারণ ততক্ষণে গোটা কমিউনিটি সেন্টার জুড়ে হৈ চৈ পড়ে গেছে। রিদিমা সমর মিসেস চিত্রা সেদিকে তাকাতেই পাশ থেকে একজন মহিলা বলে উঠলো,
“ শুনেছেন দিদি, নাকি কুসুমকাটা সিরিয়ালের নায়িকা মধুপ্রিয়া দে এসেছে।”
চলবে…