তুই যখন ছুঁয়ে দিলি মন পর্ব-১৭+১৮

0
15

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
কলমে: নিতু সরকার
পর্ব:১৭

বিয়ের পর এতগুলো বছর ধরে মনিকার গোয়ার্তুমি দেখে তপন বাবু বিশ্বাস করতেন তার এই রাগ টা বুঝি কেবল মাত্র তারই উপর। কিন্তু আজ বুঝতে পারলেন এটা রাগ নয়। এটা তার জেদ যার আগে মনিকা অন্ধ। তপন বাবু রাগে গজগজ করতে করতে ফেটে পড়লেন সবার উপর। মানলেননা স্ত্রীর শারীরিক অসুস্থতা আর সম্পর্কের সীমায় আবদ্ধ বেড়াজাল। হাত থেকে বাজারের ব্যাগ টা আছাড় মেরে মেঝেতে ফেলে চিৎকার করে উঠলেন অগ্নিশর্মা দৃষ্টিতে চেয়ে…

“ সকাল সকাল আবার নাটক শুরু হয়েছে বাড়িতে। আমি যখন বলেছি এই বিয়ে হবে মানে হবেই না। ওই ছেলের সাথে বিয়ে না হলে আমার মেয়ে পচে যাবে না।”

আচমকা শান্ত শিষ্ট তপন কে আজ হঠাৎ এভাবে মেজাজ হারিয়ে গর্জন করে উঠতে দেখে চমকে উঠলেন সুতপা। মনের ভেতর ভয় গুলো কেমন করে যেন হামাগুড়ি কাটলো। বিগত সাতাশ বছরের চেনা মানুষটার এমন অচেনা রুপ দেখে মনিকাও হকচকিয়ে উঠলো। রিদিমা ও চমকে উঠে ভীতু চোখে তাকালো বাবার দিকে। তপন বাবু আগুন চোখে তাকিয়ে গটগট করে এগিয়ে এলেন। তাকে দেখে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সবাই। তপন বাবু স্ত্রীর স্তম্ভিত মুখটা এক পলক দেখে নিয়ে সুতপার দিকে তাকালেন। রাগ সামলে নরম সুরে বললেন,
“ মাফ করবেন দিদি।
আমি আমার মেয়েকে এই মুহূর্তে বিয়ে দেবো না এবং এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত। তাই আমি চাইছি না এ বিষয় নিয়ে আর কোনো আলোচনা হোক।”

সুতপা হঠাৎ করে কি বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। তপন বাবুর করা সূক্ষ্ম অপমান টা বেশ গভীর ভাবে আঁচড় কাটলো তার স্বভিমানে। তবুও নিজের অবস্থান জাহির করতে স্মিত হেসে বললেন,
“ আহ্ রে তুমি তো দেখছি এবার আমাকেই ভিলেন করতে চাইছো। আমি কখন বললাম তৃপ্তীশ এর সাথে তোমার মেয়ের বিয়ে দেবার পরিকল্পনা নিয়ে এখানে এসেছি আমি? পাগল! এতটাও দুর্দিন আসেনি আমার বুঝেছো। তোমার মেয়ে তুমি বিয়ে দেবে না কি আইবুড়ো বানাবে তোমার ব্যাপার।
যাই হোক, বোনটা আমার অসুস্থ তাই দেখতে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে আসার পর মনে হচ্ছে না আসলেই ভালো হতো। অন্তত এভাবে অপমানিত হতে হতো না।”

কাঁধে ব্যাগটা তুলে নিয়ে মনিকার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
যাগ্গে, আসি রে মনি। ভালো থাকিস। সময় সুযোগ পেলে দেখা করতে আসিস এই অভাগী দিদি টার সাথে। মনে রাখিস, আমাকে তোরা যতোই অপমান করিস না কেন আমার বাড়ির দরজা তোদের জন্য সারাজীবন খোলা থাকবে।”

সুতপা চলে গেল। পেছনে জ্বেলে গেল এক আকাশ সমান অশান্তির আগুন। মনিকা দিদির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক দৃষ্টিতে। যে দৃষ্টির আড়ালে উপচে পড়ছে রাশি রাশি ক্রোধ আর অপমানের অনিয়ন্ত্রিত তরঙ্গচ্ছাস। তপন বাবু মেয়ের মাথায় ভরসার হাত রাখলেন। আদুরে গলায় বললেন,
“ যাও মা, গিয়ে মন দিয়ে পড়তে বসো। এবার থেকে আর কেউ তোমাকে জ্বালাতন করতে আসবে না। আর না তোমাকে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কাউকে বিয়ে করতে হবে। সব সময় মনে রাখবে, বাবা ইজ অলয়েজ দেয়ার ফর ইউ মামনি।”

রিদিমার কি যে কান্না পেল তা যেন বলার বাইরে। আজ এতগুলো দিন ধরে সে যেন এইটুকু ভরসার অপেক্ষাতেই ছিল। আজ বাবার কাছে সেটুকু পেয়ে তার মনে হলো সে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। তাইতো মেয়েটা ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো বাবার ওই স্বস্তি ভরা বুকে। ডুকরে কেঁদে জানান দিলো তার হৃদ গহীনে লুকিয়ে রাখা অজস্র যাতনাময় আর্তনাদ। মনিকা বাবা মেয়ের মিলনমেলা দেখে অস্বস্তিতে ফেটে পড়লো। মুখে কিছু না বললেও তার আচরণে বোঝা যাচ্ছিল সবটা। এক অপ্রকাশিত ক্ষোভ জ্বলজ্বল করছিল তার চোখে মুখে।

সেদিনের পর কেটে গিয়েছে প্রায় গোটা একটা মাস। সেদিন তপন বাবুর সেই হুমকি ধামকির পর থেকে কেউ আর তৃপ্তীশ এর বিষয় নিয়ে আর কোনো কথা তোলে নি বাড়িতে। বাবার কাছে ছাড় পাওয়ার পর থেকে রিদিমা ভীষণ খুশি। দ্বিগুণ উৎসাহে পড়াশুনা শুরু করেছে মন দিয়ে। সামনে পরীক্ষা অথচ বিগত কয়েক দিনের বাজে পরিস্থিতির কারণে একদমই পড়ায় মন বসাতে পারে নি বেচারী ।

আজ ১৭ই জুন, শেষ পরীক্ষা টা দিয়ে হল থেকে বেরিয়েই ছয় বন্ধু মিলে রেস্টুরেন্ট গেছিল। সেখান থেকে বেরোতেই ঝরঝর করে ঝরে পড়লো অঝোর ধারায় বৃষ্টি। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছয়টা বাজে। কিছুক্ষন আগে সীমার বর এসেছিল তাকে নিতে। রিনি আর জবাও মিনিট পাঁচেক আগে অটো নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। অভিষেক আর কপিল ওরা তো আরও ফাস্ট। বদমাশ দুটো সিগারেট খাওয়ার নাম করে সেই যে বেরিয়ে গেল আর আসেনি এদিকে। উল্টো দিকে বাড়ি হওয়ায় সেই দশ মিনিট ধরে রিদিমা বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে।

রিদিমা হাত ঘড়িতে সময় দেখছিল আর বাসের অপেক্ষা করছিল বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে। ঠিক তখনই ওর ফোনটা শব্দ করে বেজে উঠলো। ব্যাগ হাতড়ে বের করতেই দেখলো অপরিচিত নম্বর। কিছুটা দোনোমনায় ভুগে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটা মেয়েলি কন্ঠস্বর,
“ হ্যালো, আমি গ্রিন লাইফ নার্সিংহোম থেকে বলছি। আপনি কি তপন কুমার কুন্ডুর বাড়ির লোক কথা বলছেন?”

নার্সিং হোমের কথা শুনে যতোটা না অবাক হয়েছিল রিদিমা তার চেয়ে বেশি ভয় পেল হঠাৎ বাবার টা নাম শুনে। ও তড়িঘড়ি করে বলল,
“ হ্যাঁ আমি ওনার মেয়ে বলছি। কি হয়েছে বাবার?”
“ পেশেন্টের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।”
“ কিহ্!”
“ একটু তাড়াতাড়ি এখানে আসবেন প্লীজ। ওনাকে ইমারজেন্সি ওটি তে নিতে হবে। বাড়ির লোকের সাইন দরকার।”

ব্যাস এটুকু কথাই যেন যথেষ্ট ছিল রিদিমাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলার জন্য। বাবার অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা শোনা মাত্রই রিদিমার চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে এলো ক্ষণিকের জন্য। হাত পা সহ গোটা শরীর কেঁপে পড়ে যেতে নিলো মেয়েটা। রিদিমা ধপ করে বাস স্ট্যান্ডের বেঞ্চে বসে পড়লো। কোনোমতে নিজেকে সামলে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করল,
“ আআআআমার বাবা ঠিক আছে তো?”

ওপাশ থেকে জানালো,
“ পেশেন্টের মাথা ফেটেছে। ব্লিডিং হয়েছে প্রচুর। বডিতে ইনজুরিও অনেক। ডাক্তার বাবু দেখছেন। তবে টেষ্ট না করা পর্যন্ত এখনই বলা যাচ্ছে না ঠিক কতটা কি ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে। আপনারা প্লীজ দ্রুত হাসপাতালে আসার ব্যবস্থা করুন।”

কথা শেষ হতেই টুক টুক করে কল কেটে গেল ওপাশ থেকে। রিদিমা তখনও স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো ওভাবেই। সারা শরীর তার কাঁপছে থরথর করে। দু চোখ ঢেলে বেরিয়ে আসছে বাঁধ ভাঙা কান্নার বেগ। সব কিছু তো ঠিক ছিল। হঠাৎ করে এ কি হয়ে গেল! রিদিমা মুখ চেপে হুহু করে কেঁদে উঠলো। এই বাবা টা যে তার একমাত্র ভালোবাসার মানুষ। তার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে কি করবে সে? ভাবতেই বুকটা যেন মোচড় দিয়ে উঠলো মেয়েটার। রিদিমা কোনোমতে দিদিকে ফোন করে খবর টা দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো। বৃষ্টির বেগ তখনও কমেনি। ভিজিয়ে দিচ্ছে গোটা শরীর। ওই অবস্থায় অনেকক্ষণের চেষ্টায় হাত উঁচিয়ে একটা চলন্ত অটো রিক্সা দাঁড় করালো সে। অতঃপর ছুটে চলল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন রাত আটটা। নার্সিংহোমের করিডোর তখন ভর্তি গমগমে ভিড়ে। পরমা তার হাসব্যান্ড দীপ্ত আর তার শ্বশুর শাশুড়িকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে এসেছে বাবার অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে।সামনেই চেয়ারে বসে মনিকা হেঁচকি তুলে কাঁদছে বেয়ানের কাঁধে মাথা রেখে। পরমাও ওড়নায় মুখ চেপে কেঁদে চলেছে। মাত্রই সুতপা আর তার হাসব্যান্ড রমেশ দৌড়ে ঢুকলো ছেলে অভয় কে সাথে নিয়ে। বোন কে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠে ছুটে গেল তাকে ভরসা দিতে। ওদিকে রিদিমা শান্ত প্রতিমার ন্যায় কিছুটা দূরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। মুখটা রক্তিম, চোখের তারায় নির্লিপ্ত নির্জীবতা। অথচ ভেতর টা তার গুড়িয়ে যাচ্ছে ভয়ংকর দুশ্চিন্তার দুর্নিবার তান্ডবের আঘাতে। তার সবচেয়ে ভরসাযোগ্য স্থান টা যে আজ ক্ষ তবিক্ষত! র ক্তাক্ত! যাকে হারিয়ে ফেললে যে তার অস্তিত্ব টাও শেষ হয়ে যাবে একেবারে।

অ্যাক্সিডেন্ট কেস হওয়ায় পুলিশ এসেছে। দীপ্তর পাশে দাঁড়িয়ে ভীষণ এক চেনা মুখ, তৃপ্তীশ। হাসপাতাল মারফত জানা গেল রাস্তার কিছু মানুষ সহ সেই নিয়ে এসেছে তপন বাবুকে এখানে। এমনকি থানায় ডায়েরি টাও সেই করেছে। যতদূর জানা গেছে, অফিস থেকে ফেরার পথে বাইপাসের মোড়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় নাকি দুর্ভাগ্যক্রমে এক ছুটন্ত বাইকের সামনে এসে পড়েন তপন বাবু। তাতেই ঘটে যায় বিপত্তি। গাড়ির গতি এতো বেশি ছিল যে বাইকারোহী তাকে উড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে যায় ঘটনাস্থল থেকে। ঘটনা টা ঘটার সাথেসাথে যারপরনাই লোকজন জড়ো হয়। তাদের মধ্যে তৃপ্তীশ ও ছিল। সেই নিজ দায়িত্বে তপন বাবুকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। পুরো ঘটনা টা শোনা মাত্রই ছুটে গিয়ে তার সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ালেন মনিকা। চোখে মুখে তার অসামান্য কৃতজ্ঞতা ঢেলে অনুনয়ের সুরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“ তোমাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেবো বাবা, আমি সত্যিই জানি না। আজ যদি তুমি সেখানে না থাকতে তাহলে যে কি হতে পারতো ভেবেই ভয়ে কেঁপে উঠছি আমি। আজ আমার সিঁথির সিঁদুর রক্ষা করার জন্য তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ বাবা।”

তৃপ্তীশ স্বাভাবিক হেসে জানালো,
“ ধন্যবাদ দিতে হবে না আন্টি। আমি যা করেছি একজন মানুষ হিসেবেই করেছি। আঙ্কেলের জায়গায় অন্য কেউ থাকলে তার জন্যও একই কাজ করতাম।”

তবুও মনিকার কান্না থামে না। চোখের জলে ভাসে তার বুক। সুতপা বোন কে টেনে চেয়ারে বসালো। প্রায় দশটার দিকে তপন বাবুকে বেডে দেওয়া হলো। মাথায় প্যাঁচানো সাদা ব্যান্ডেজ। ডান পায়ে প্লাস্টার। ডান হাতটাও ব্যান্ডেজে মুড়িয়ে গলায় ঝোলানো। নাকে লাগানো অক্সিজেন মাস্ক।
ডাক্তার জানালেন বুকে আঘাত লাগলেও পাঁজরের হাড় ভাঙেনি। তবে বেশ কিছুদিন স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হবে তার। মাথার আঘাত গুরুতর নয়। যা ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে তা হাতে আর পায়ে। যেভাবে হাড় ভেঙেছে তাতে এই বয়সে সেরে উঠতে বেশ দেরি হবে। স্বাভাবিক ভাবে হাঁটাচলা করা টাও বোধহয় আর সেভাবে হবে না।
ডাক্তারের কথা শুনে স্তম্ভিত সকলে। রিদিমা যেন আরও খানিক গুটিয়ে গেল নিজের মাঝে। ওদিকে পরমা কে জড়িয়ে ধরে মনিকার চোখে তখন অশ্রুর ঢল। দেখতে দেখতে হুট করেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো তার কাঁধে। শেষ মেশ তাকেও ভর্তি করা হলো।

রাত টা সবার পার হলো ভয়ানক উৎকণ্ঠা আর চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে। সকাল হতে না হতেই রিদিমা আর পরমা হাজির হলো নার্সিংহোমে। জানা গেল তপন বাবুর শেষ রাতে জ্ঞান ফিরেছে। আর মনিকা ও বেশ সুস্থ বর্তমানে। দুই বোন আগে মেল ওয়ার্ডে বাবার সাথে দেখা করতে গেল। বাবা কে দেখে সেকি কান্না দুজনের। দীপ্ত হিমশিম খেল দুবোন কে সামাল দিতে। তপন বাবু বহু কষ্টে বাম হাত উঠিয়ে মেয়েদের মাথায় বুলিয়ে দিলেন। ইশারায় জানালেন শান্ত হতে। রিদিমা পরমা শান্ত হতেই তপন বাবু এদিক ওদিক নজর ফেললেন। বহু কষ্টে জানতে চাইলেন,
“ মনি কোথায়?”

পরমা মুখ লুকিয়ে চোখের জল ছেড়ে দিলো মায়ের কথা শুনে। অথচ অসুস্থ মানুষটাকে কিছুতেই জানাতে পারলো না তার সহধর্মিণীর অসুস্থতার কথা। দীপ্ত পরিস্থিতি বুঝে রয়ে সয়ে আমতা আমতা করে বলল,
“ আসলে মা আপনার এই অবস্থা দেখে একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আর কি! তবে চিন্তার কোন কারণ নেই। উনি বর্তমানে সুস্থ আছেন। আশাকরি বিকেলে আসতে পারবেন।”

তপন বাবু সিলিং এর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মনে পড়তে লাগলো গতকাল সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া সেই ভয়ংকর মুহূর্তের স্মৃতি টুকু। কি বিভীষিকাময় ছিল সেই ক্ষণ। উফ্! এ যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর দর্শন। ভাবলেই যেন আবারো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।

“ আঙ্কেল এখন কেমন লাগছে।”

হঠাৎ কণ্ঠ টা শুনে চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলেন তপন বাবু। তৃপ্তীশ ছেলেটা দাঁড়িয়ে তার সামনে। তন্মধ্যে সুতপা ঢুকলেন সেখানে। রিদিমা সরে দাঁড়াতেই তিনি তপন বাবুর সামনে রাখা টুল টায় বসলেন ভারী শরীর টা নিয়ে। অতঃপর, ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক তৃপ্তীশ কে দেখে বললেন,
“ তপন, কাল তোমার অ্যাক্সিডেন্টের পর তৃপ্তীশ তোমাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে।”

তপন বাবু চমকে উঠলেন। সেই সাথে তার মনে পড়লো গত কাল রাতের সেই আবছা পরিচিত মুখ। যে ভিড় ঠেলে ছুটে এসেছিল। আঙ্কেল আঙ্কেল বলে কোলে তুলে নিয়েছিল। তাকে নিয়ে এসেছিল হাসপাতালে। তপন বাবু চোখ দুটো বন্ধ করে নিলেন। এই মুহূর্তে ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। ছেলেটাকে না জানি কত খারাপ ভেবে ছিলেন। অথচ সেই কিনা তাকে বাঁচালো। বেশ কয়েক মিনিট নীরবতার পর তপন বাবু চোখ খুলে তাকালেন তৃপ্তীশ এর দিকে। তারপর বাম হাত টা তুলে কাছে ডাকলেন। তৃপ্তীশ বিনা সংকোচে এগিয়ে এলো। তপন বাবু হুট করে তার হাত ধরে ক্ষীণ সুরে বললেন,
“ ধন্যবাদ।”

দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে সপ্তাহ খানেক সময়। তপন বাবুকে ডিসচার্জ করিয়ে বর্তমানে বাড়িতে আনা হয়েছে। অসুস্থ মানুষ কে দেখতে বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের আনাগোনা চলছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু সেই সেদিন হাসপাতালে দেখা হওয়ার পর আর আসেনি তৃপ্তীশ। রিদিমা কেন যেন মনে মনে ভীষণ অস্থির। হয়তো অপরাধ বোধের অস্বস্তি টা তাকে পাগল করে দিচ্ছে। আসলে সেদিনের ওই ব্যবহারের পর একটা সরি অন্তত প্রাপ্য ছিল তৃপ্তীশ এর। কিন্তু রিদিমা বলেনি। নিজের আত্ম অহমিকার মাঝে সে এতটাই ডুবে গেছিল যে ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটা তার চিন্তা তেই আসেনি। কিন্তু আজ কেন যেন ভীষণ আফসোস হচ্ছে। মনে হচ্ছে ভুল টা তারই ছিল। নিজের জেদে অটল থাকতে ভালো মানুষটাকে শুধু শুধু বদনাম করলো। রিদিমার মনে আছে, হাসপাতালে তৃপ্তীশ যতক্ষণ ছিল একবারও ওর দিকে তাকায় নি। একবারও নিজ ইচ্ছেয় সামনে আসেনি। যদি কখনও ভুল করে সামনা সামনি এসেছে তখনই ঘাড় ঘুরিয়ে চলে গেছে সেখান থেকে।

নির্জন ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে হতাশার চাপা শ্বাস ফেলল রিদিমা। যে লোকটার সাথে ও এতো এতো দুর্ব্যবহার করলো সেই লোকটাই কি না শেষ পর্যন্ত তার বাবাকে বাঁচালো! এই এতো এতো অস্বস্তি আর অনুশোচনার গ্লানি সে এখন সইবে কেমন করে?

চলবে….

#তুই_যখন_ছুঁয়ে_দিলি_মন
লেখিকা: নিতু সরকার
পর্ব: ১৮

উদীয়মান ঊষার সোনামুখ খানা নীলাম্বরের বুকে উদ্ভাসিত হতেই ঝাঁক ঝাঁক বিহঙ্গের দল পাখা ঝাপটে জানালো অন্তরের সাদর সম্ভাষণ। বাতাসের আর্দ্র স্পর্শে ফুলের ঘ্রাণ মিশে পরিবেশে ছড়ালো সতেজতা। বৃষ্টি ভেজা ভোরের শীতলতার মাঝে এ যেন এক অনন্য প্রাপ্তি। যাকে ছোঁয়ার অপেক্ষায় কতশত ভাঙা মন।

আজকাল ঘুমের বড় অভাব কাজল কালো নয়ন দুটিতে। কখনও তারা রাতজাগা পাখি কখনও আবার ভোরের কুয়াশা হয়ে জেগে ওঠে প্রতিদিন। জীবনটা বড় হেঁয়ালি। বেখেয়ালি তার চলার ধরণ। প্রতিটা বাঁকে যেন নতুন নতুন চমকের আড়ম্বর।

ছয়তলায় ফ্ল্যাটের খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়া। খোলা চুল গুলো ক্রমাগত দুলছে মৃদু মন্দ হওয়ায়। হাতের মুঠোয় চেপে ধরা মুঠোফোন। স্ক্রিনের উপর জ্বলজ্বল করছে একজোড়া প্রেমিক যুগলের হাস্যোজ্জ্বল মুখ। চোখের ভাষায় তাদের তীব্র প্রেমের আলিঙ্গন। মুঠো মুঠো সুখ উড়ছে যেন তাদের চারিপাশ ঘিরে।

প্রিয়া ছবিটাকে মন দেখে আর বুক ভরে উগরে আসা দীর্ঘশ্বাস গুলোকে উড়িয়ে দেয় নীরবে। কি ছিল না তার জীবনে! স্বামী সংসার সন্তান সুখ। অথচ উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে শেষ করে দিলো। বিলাসিতার লোভ গ্রাস করে নিল তার সবটুকু কে। টাকা পয়সা নেম ফেমের লোভ আর স্বেচ্ছাচারিতার মাঝে এমন ভাবে বুঁদ হয়ে গেল, যার নেশায় আসক্ত হয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ গুলো কে। স্বামী তো দূর অস্ত আজ নিজের সন্তান ও তাকে চেনে না। জানেও না সে তার জন্মদাত্রী মা।

যে বিলাসিতা আর বৈভবের জীবন কে বেছে নিয়ে সে সব কিছু ত্যাগ করে এসেছিল তারাও আজ বিদায় নেওয়ার মুখে। সিরিয়ালের দুনিয়ায় মানুষ সব সময় নতুন মুখ চায়। প্রযোজক দের চাহিদা জাগে নতুন নতুন মুখে। সে আজ প্রাক্তনী। তাই মুখ্য চরিত্রে বেমানান। তাছাড়া প্রযোজক থেকে শুরু করে ইনভেস্টারদের বিছানায় শুয়ে তাদের তুষ্ট করতে না পারায় কাজ মেলাও দুষ্কর। প্রিয়া আর কিছুই ভাবতে পারে না। তার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে আসে। জীবন টা কে তুচ্ছ মনে হয়। চারপাশে ঘুরপাক খায় জীবনের থমকে যাওয়া ছন্দ গুলো। ইচ্ছে করে চিৎকার করে বলতে,
“ আমি আমার ভুল গুলো বুঝতে পেরেছি প্রিয়। এবার অন্তত শেষ বারের মতো ক্ষমা করে তোমার কাছে ফিরিয়ে নাও তোমার কাজল লতা কে।”

*
“ হ্যাঁ রে মা, তৃপ্তীশ ছেলেটা তো আর দেখা করতে এলো না।”

বাবার কথায় নড়েচড়ে উঠলো রিদিমা। মনের মাঝে চমকে ওঠার বহর। সে তাড়াহুড়ো করে স্যুপের বাটিটা একপাশে রাখলো। আজকাল বাবাকে সে নিজের হাতে বিকেলের স্যুপ টা খাওয়ায় ইদানিং। তাছাড়া তার আরও যে সব যাবতীয় কাজ গুলো আছে সেই গুছিয়ে দেয়। তপন বাবু স্যুপ টুকু শেষ করে মুখ মুছে বললেন,
“ আজকাল রাস্তা ঘাটে প্রতিদিন যেভাবে মানুষ দুর্ঘটনার স্বীকার হচ্ছে তা আর নাই বলি।
ছেলেটা সেদিন যেভাবে সাহায্য করলো তা সত্যিই অভাবনীয়। সত্যি বলতে ওর জায়গায় বোধ হয় অন্য কেউ থাকলে বিগত দিনের ঘটনার জের ধরে সাহায্য করা তো দূর হয়তো ফিরেও তাকাতো না।”
“ হুম্!”
রিদিমার দায়সারা উত্তর। আসলে ও অপেক্ষা করছে বাবার পরবর্তী কথা শোনার। তপন বাবু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
“ আমাদের সেদিন আসলেই ভুল হয়েছে। ছেলেটা কতো আশা নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো। অথচ আমরা..!”
কথাটা শেষ হয়েও যেন হলোনা শেষ। রিদিমা মুখটা আড়াল করে চোখ খিঁচে ধরলো অস্বস্তিতে। বুকটা কামড়ে উঠলো ছলকে ওঠা বিদ্রুপে। চিন্তা ভাবনারা সব শূন্য হয়ে এলো তক্ষনি। এতো এতো আত্মগ্লানির চাপে দম বন্ধ হয়ে এলো রিদিমার। তপন বাবু আস্তে ধীরে বললেন তখন,
“ হ্যা রে মা, আমার ফোনটা একটু এনে দিতে পারবি। ছেলেটাকে কল করে একটু দেখা করতে বলতাম। আসলে সেদিন তো ভালো করে ধন্যবাদ টুকুও বলতে পারি নি তাই!”

ইতিমধ্যে ঘরে ঢুকলেন মনিকা। চোখে মুখে তার জ্বলজ্বলে প্রশান্তি। স্বামীর কথা শুনে যে বড্ড খুশি হয়েছেন বোঝাই যাচ্ছে। কথার মাঝে ফোরং কেটে বললেন,
“ একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ তুমি।
বিগত দিনে যাই হোক না কেন সব ভুলে সে যে তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছে এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। তাই তাকে সম্মান করা যেমন আমাদের প্রধান কর্তব্য। সেই সাথে তার কাছে ক্ষমা চাওয়া ও।”

কথাটা মনিকা মেয়ের দিকে আড় চোখের ধারালো দৃষ্টি ছুঁড়ে বললেন। রিদিমা যেন হাড়ে হাড়ে বুঝলো মায়ের কথার ভাঁজে লুকোনো অর্থটা। সহসা দৃষ্টি জোড়া তার মিইয়ে এলো লজ্জায়। হাঁসফাঁস করা বুকের মাঝে জড়িয়ে এলো নিঃশ্বাস।

ওদিকে আজ আর কোনো রকম প্রতিবাদ না করে নিঃশব্দে মনিকার কথা গুলো মেনে নিলেন তপন বাবু। বন্ধ চোখের উপর হাত তুলে চুপ করে বসে রইলেন খাটে হেলান দিয়ে। আত্মগ্লানির অস্বস্তি গুলো যে তাকেও কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাকে প্রতিনিয়ত। এই সত্যিটা তিনি চাইলেও অস্বীকার করতে পারবেন না। মনিকা একপেশে হেসে এঁটো বাসন গুলো নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মা বেরিয়ে যেতেই রিদিমা আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আসলে সে নিজেও অবগত এ বিষয়ে। বিগত দিন গুলোতে অনেক ভেবেছেও বিষয় টা কে নিয়ে। কিন্তু সমস্যা টা হলো কোথা থেকে শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে।

তপন বাবুর ফোন পেয়ে পরদিন বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে তৃপ্তীশ এলো। সাথে করে নিয়ে এলো একগাদা ফল মিষ্টি জুস। প্রায় ঘন্টা খানেক সময় ছিল সে। সুতপা পরমার শ্বশুর শাশুড়ি এমনকি তার পিসি শাশুড়িও এসেছিলেন সেই সময়। সবাই অনেক হাসাহাসি আড্ডা দিয়ে রাত আট টা নাগাত বাড়ি ফিরে যায়। বাড়িতে যতক্ষণ আত্মীয় স্বজন ছিল রিদিমা তাদের আপ্যায়ন করে গেছে নিঃশব্দে। একটা বারও তৃপ্তীশ এর সাথে আলাদা ভাবে কথা বলার সুযোগ মেলেনি।

তখন রাত প্রায় দশটার কাছাকাছি হবে। স্বল্প আলোয় রুদ্ধদ্বার ঘরে ফোন হাতে নিয়ে বসে ছিল রিদিমা। মনের মাঝে তার একরাশ অস্থিরতা। চোখ দুটো গেঁথে ছিল স্ক্রিনে। সেখানে ফোনের ফ্লাশ লাইটে চকচক করছে তৃপ্তীশ এর ফোন নম্বর যেটা সে খানিক আগেই ব্লক লিষ্ট থেকে ওপেন করেছে। রিদিমা প্রথমে ভাবলো কল করবে। কিন্তু কি যেন একটা ভেবে মেসেজ অপশনে ক্লিক করলো। তারপর গোটা গোটা অক্ষরে লিখলো,
“ হাই তৃপ্তীশ, আপনি কি এখন ফাঁকা আছেন? মানে দু মিনিট সময় হবে কি কথা বলার জন্য?”

মেসেজ টা পাঠিয়ে থম মেরে বসে রইলো রিদিমা। দেখতে দেখতে পার হলো এক দুই তিন করে পনেরোটা মিনিট। তার পর ওপাশ থেকে হঠাৎ স্ক্রিন ভাসিয়ে ছোট্ট করে জবাব এলো,
“ হ্যাঁ! ”

রিদিমা এতক্ষণ কতো শত কথা মনের মাঝে গুছিয়ে রেখেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা শব্দও কেন জানি লিখতে পারলো না মেয়েটা। আসলে লিখে মনের ভাব প্রকাশ করাটা তার কাছে এই মুহূর্তে সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ মনে হলো। মনে হলো সে বোধ হয় এভাবে লিখে মনের কথা ভালো ভাবে বোঝাতে পারবে না। কিন্তু প্রত্যুত্তরে জবাব যে দিতেই হবে ভেবে লিখলো,
“ আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার বাবাকে বাঁচানোর জন্য।”
ওপাশ থেকে উত্তর এলো,
“ ইউ ওয়েলকাম। তবে না বললেও চলতো। কারণ ওটা আপনার বাবা মা অলরেডি অনেক বার জানিয়ে দিয়েছেন।”

তৃপ্তীশ এর আপনি করে বলাটা বেশ গায়ে লাগলো রিদিমার। ভ্রূ জোড়া কুঁচকে গেল বিস্ময়ে। তার মানে লোকটা তাকে একেবারে অপরিচিতের তালিকায় ফেলে দিয়েছে। রিদিমা তবুও লিখলো,
“ বাবা মা জানাতেই পারে। তবে আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়াটা আমার কর্তব্য ছিল।”

লেখাটা পড়ে ওপাশ থেকে জবাব এলো,
“ আপনি কি শুধু ধন্যবাদ দিতেই আমার নম্বর টা ব্লক লিষ্ট থেকে বের করেছেন।”

রিদিমা এ পর্যায়ে বেশ ইতঃস্তত করে উঠলো।লিখলো,
“ নানা! আসলে আমার কিছু জরুরী কথা ছিল আপনার সাথে।”
“ বলুন !”
“ এভাবে নয়। আমি আসলে সামনা সামনি বলতে চাইছি আর কি। আচ্ছা, আমরা কি একবার দেখা করতে পারি মানে যদি আপনার আপত্তি না থাকে তো।”

মেসেজ টা পাঠানোর পর বেশ কিছুক্ষণ কোনো রকম সাড়া এলো না ওপাশ থেকে। রিদিমা হতাশ হয়ে মাথা ঠেকালো জানালার গ্রিলে। মনে মনে ভাবলো, লোকটাকে সে যে পরিমাণ অপদস্ত করেছে তাতে তার সাথে যে দেখা করতে চাইবে না এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তাকে আশ্চর্য চকিত করে তখনই ফোনে নতুন বার্তা এলো।
“ ঠিক আছে। বলুন কোথায় দেখা করতে চান।”
রিদিমা এতক্ষণের চাপা পড়া নিঃশ্বাস টা ছেড়ে সময় সহ ঠিকানা টা পাঠিয়ে দিলো।

পরদিন সন্ধ্যা। ‘গোল্ডেন সান’ নামের একটা মোটামুটি মানের রেস্টুরেন্টে কর্ণারের টেবিলে মুখোমুখি বসেছে রিদিমা আর তৃপ্তীশ। উভয়ের মাঝে এক প্রস্থ নীরবতা ছেয়ে। রিদিমা সেই কখন থেকে রেস্টুরেন্টের কাঁচের দেওয়ালের ওপাশের দৃশ্যে মগ্ন হয়ে রয়েছে। সেই নীরবতার জাল ছিন্ন করে তৃপ্তীশই আলোচনার শুরুটা করলো। বেশ শব্দ করে গলা ঝেড়ে বলল,
“ তো কিছু বলবেন বলছিলেন রিদিমা।”

রিদিমা যেন এই মুহূর্তের জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। তৃপ্তীশ এর কথায় লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে গুছিয়ে বলল,
“ আসলে সেদিনের অভদ্রতার জন্য আই অ্যাম রিয়েলি ভেরি ভেরি সরি। আমার ওই দিন ওভাবে পাবলিক প্লেসে আপনার গায়ে হাত তোলা টা উচিত হয় নি।”

রিদিমা কথা গুলো বলেই মাথা নিচু করে বসে রইলো। ওদিকে তৃপ্তীশ তাকিয়ে রইলো কাটারির ন্যায় ধারালো দৃষ্টি তে। প্রায় মিনিট দুয়েকের নীরবতা শেষে তৃপ্তীশ কথা বলল।
“ ডোন্ট সে সরি রিদিমা। তুমি সেদিন কোনো ভুল করনি। ভুলটা আমি করেছিলাম। ওভাবে সবার সামনে তোমার হাত ধরে টানাটানি করেছিলাম যেটা আসলেই অন্যায় ছিল। আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করা কোনো অন্যায় নয়।”

তৃপ্তীশ এর কথা গুলো শুনে রিদিমা বিস্ময়ে থমকে গেল। হঠাৎ আপনি থেকে তুমি তে কথা বলায় চমকালোও ভীষণ। তৃপ্তীশ আবার বলল,
“ তাই নিজেকে দোষী ভাবা টা বন্ধ করো। এনি ওয়ে কি খাবে বলো।”

আজ প্রথম বার রিদিমার মনে হলো ছেলেটা একটুও খারাপ নয়। বরং অনেক ভালো। ওই শুধু শুধু তাকে অন্য রকম দৃষ্টিভঙ্গিতে জাস্টিফাই করে গেছে। তৃপ্তীশ এর মধ্যে ওয়েটার কে ডেকে কফির সাথে ফিস ফিঙ্গার আর চিকেন নাগেট অর্ডার করলো। তারা দিয়েও গেল দ্রুত। রিদিমা ভীষণ লজ্জা নিয়ে কোনরকমে খেল তা। তৃপ্তীশ বিল মিটিয়ে আসার সময় ওর জন্য কোণ আইসক্রিম এনে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল ,
“ আমার ভীষণ ইচ্ছে ছিল কোনো একদিন আমরা দুজন একসাথে ঘুরতে বেরোবো। অপরিচিত হয়ে নয় স্বামী স্ত্রীর পরিচয়ে। তুমি আমার কাছে আইসক্রিম খাওয়ার বায়না ধরবে আর আমি এভাবেই তোমার জন্য ভালোবেসে আইসক্রিম এনে দেবো।
কিন্তু আফসোস সেই ইচ্ছেটা আমার কোনোদিনই পূরণ হবে না।”

রিদিমার বুকের ভেতর টা কেমন করে যেন দুমড়ে গেল তৃপ্তীশ এর কথাটা শুনে। আইসক্রিম ধরা হাত টা যেন নিজে থেকেই কেঁপে উঠলো থরথর করে। তৃপ্তীশ আর দাঁড়ালো না সেখানে। সে হেলমেট টা হাতে তুলে বেরিয়ে গেল রেস্টুরেন্ট এর দরজা ঠেলে বাইরে। রিদিমা তার প্রস্থান দেখেও পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর তৃপ্তীশ এর বাইক এসে দাঁড়ালো রিদিমা দের বাড়ির গেটের সামনে। রিদিমা ওড়না সামলে নামলো গাড়ি থেকে। তৃপ্তীশ হেলমেট টা খুলে কেমন করে যেন হাসলো। বলল,
“ ভালো থেকো রিদিমা। আমি আর কখনই তোমার সামনে ভালোবাসার ভিক্ষে নিয়ে আসবো না। কারণ ফ্যামিলি থেকে মেয়ে দেখা হয়েছে। তাদের সবার পছন্দ করা শেষ। শুধু আমার মতামত দেওয়া বাকি। ভাবছি আজ হ্যাঁ বলে দেবো। আসি।”

কথাটা শোনা মাত্রই রিদিমার অবচেতন মনে কেমন করে যেন ভাঙন শুরু হলো। না চাইতেও বুকের ভেতরে শুরু হলো ভয়াবহ তোলপাড়। মনে হলো, সে যেন খুব শীঘ্রি ভীষণ দামী কিছু হারিয়ে ফেলতে চলেছে। তৃপ্তীশ বাইকে স্টার্ট দিলো। মাথায় হেলমেট টা চড়িয়ে বলল,
“ আসি। গুড বাই।”

এক্সলারেটরে চাপ দিতেই বাইক যেই ছুটতে শুরু করলো রিদিমা হঠাৎ পেছন থেকে ডেকে উঠলো তৃপ্তীশ বলে। মিররে রিদিমার হাত তুলে তাকে ডাকতে দেখে তৃপ্তীশ গাড়ি থামালো যেই ওমনি রিদিমা দৌড়ে ছুটে এলো কাছে। চোখে মুখে অস্থিরতা ছড়িয়ে বলল,
“ তৃপ্তীশ, আমরা কি আরেকবার সব কিছু শুরু থেকে শুরু করতে পারি না?”

চলবে….