তুমিময় মোহ পর্ব-০৬

0
48

তুমিময়_মোহ [৬]

রাধিকার প্রত্যেকটা কথা জোহানকে বিক্ষিপ্তভাবে রাগানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। সামাইরার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসেই কথাগুলো শুনেছে সে। রাগে-ক্ষোভে চলন্তগাড়িতে বসেই কাঁচে সজোরে হাত ঘুষি দেয়। ড্রাইভার ভয়ে দ্রুত গাড়ি ব্রেক কষলো। পেছনে ফিরে জোহানের র’ক্তা’ক্ত হাত দেখে ঘাবড়ে নেমে দরজা খুলে হাতের ছোট ছোট কাঁচ গুলো বের করতে লাগলো। গাড়ির ভেতরেই ফাস্ট এড বক্স থাকায় দ্রুত র’ক্ত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। জোহান রাগে চোয়াল শক্ত করে দৃষ্টি নত রেখে বসে ছিল। ড্রাইভার হাতের ব্যান্ডেজ শেষে কাঁচ কোনোমতে পরিষ্কার করে আবার গাড়ি চালাতে আরম্ভ করল। তার বক্ষে এতটাই ভয় জেঁকে বসেছে যে জোহানের উদ্দেশ্যে মুখ খোলার সাহস তার হয়নি। কয়েক মিনিট বাদে বাড়িতে প্রবেশ করে। ড্রইংরুমে মা এবং ভাবির প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। তাঁদের গুরুত্ব না দিয়ে উপরে চলে এলো। একটুপর কাপড় পরিবর্তন করে বের হলো তাঁদের কিছু না বলেই। জোহানের হঠাৎ এরূপ গুরুতর ক্ষোভের বিষয়টি তাঁদের অদ্ভুত লাগে। এড়িয়ে যাওয়ার মতোও না। সে এবার একাই ড্রাইভ করে সেই বাড়িতে এলো। আজ রাতে এখানেই থাকবে সামাইরার সাথে। তবে আলাদা রুমে। একা সামাইরাকে রাখতে তার মন সায় দিচ্ছিলো না।
সামাইরাকে ডিস্টার্ব না করে পাশের রুমে বিশ্রাম নিচ্ছে সে। রাতে এক সময় দেখা করে নিবে আপাতত রাগের মাত্রা কমানো উচিত বলে মনে করে।
হোস্টেলে ফিরে রাধিকা খেয়ে শুয়ে পড়ে। তখন আহিলের টেক্সট আসলো। মুচকি হাসি ফুটে তার ঠোঁটে। সেও আহিলকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। বেশ কিছুক্ষণ চ্যাটিং করার পর নিদ্রায় কাবু হয়।
রাত রাবোটার সময় জোহান দরজার তালা খুলে সামাইরার রুমে এলো। লাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে ছিল সামাইরা। একা রুমে কিঞ্চিৎ ভয় করছিল বিধায় লাইট জ্বালিয়ে রেখে শুয়েছে। ঘুমে কাতর সে। এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। জোহান পাখার পাওয়ার কমিয়ে দেয়। সামাইরাকে সোজা ভাবে শুইয়ে গায়ে ওড়না জড়িয়ে দেয়। কয়েক মিনিট একভাবে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ একদিন দেখায় এত মায়া, এত ভালোবাসা তার উপর কিভাবে ভর করল জানা নেই। তবে তাকে খুব ভালোবাসে সে। এই মেয়েটার মনে ছেলেদের উপর যেই অনীহা তৈরী হয়েছে, তা কি আদৌও ধ্বংস করতে সক্ষম হবে সে? মনে মনে এসব ভেবে জোহান উঠে দাঁড়ালো। দরজা লাগিয়ে নিজের রুমে এসে দেখলো বাবার কল। ফের কল ব্যাক করল।
‘কোথায় আছো? বাসায় আসছো না কেন?’
‘এক বন্ধুর বাড়ি আছি সকালে আসবো।’
‘এক বলতে কার বাড়ি? সবাইকেই তো কল দিলাম। তুমি তো কারো বাড়ি নেই।’
এটা শুনেই জোহান রেগে গেল। গমগমে গলায় বলল,
‘আমায় নিয়ে এত টেনশন কেন করছো? এখনো শিশু নই আমি।’
‘শিশুর চেয়ে কম কিছু ভাবীনা তোমায়। এমন কী কাজ করছো বাহিরে, বলে যেতে পারলে না?’ তিনিও ঈষৎ রাগে শুধালো।
‘আব্বু তর্ক কোরো না। আমি ঘুমাবো?’
‘শোনো, খেয়ে ঘুমিয়ো। আর সকালে যেন তোমাকে বাড়িতে দেখি আমি ঘুম থেকে উঠার পূর্বে। কাল মিটিং আছে।’
‘ওকে।’ বলেই কল রেখে দিলো জোহান। কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। সব বন্ধুদের কাছে কল দিয়ে তার বিষয়ে জানতে চাওয়াটা আব্বুর বাড়াবাড়ি লাগছে, আবার সন্দেহের বীজ রোপণ করেছে বন্ধুের মাঝে।
সে দ্রুত আহিলকে কল দিলো। এত রাতে কল পেয়ে আহিল দ্রুত রিসিভ করল,
‘এনি প্রবলেম?’
‘আব্বু কল দিয়েছিল তোকে?’
‘নাতো।’ কিঞ্চিৎ অবাক হয়েই বলল।
‘আব্বুর আন্দাজে কথা বলার অভ্যােস গেল না।’ বিরক্ত হয়ে বলল।
আহিল হেসে জানতে চাইলো,
‘আবার কি বলেছে?’
‘সে নাকি তোদের কাছে কল দিয়ে আমি কোথায় আছি জানতে চেয়েছে।’
‘এরপর?’
‘আমি নাকি তোদের কারে বাড়িতে নেই। অন্য কোথাও আছি।’
আহিল ঠোঁটের হাসি চওড়া করে ফের বলল,
‘এজন্য আমায় কল দিয়ে শিওর হয়ে নিলি। ওয়েট আমারও প্রশ্ন তুই কার বাড়িতে আছিস?’
‘সামাইরার অপজিট রুমে আছি।’
‘দ্যাট’স গ্রেট!’
আর কথা না বাড়িয়ে ফোন রাখলো জোহান। হাতের পানে এক ঝলক তাকিয়ে খাটের কোণায় হেলান দিলো।

সকাল সকাল জোহানকে খাবার দিতে দেখে সামাইরা একটু অবাক হলো। তবে কিছু বলে না। তার নজর পড়ে ব্যান্ডেজ করা হাতের উপর।
দ্বিধাবোধ নিয়ে জানতে চায়,
‘হাতে কি হয়েছে?’
জোহান গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
‘কিছু না।’
‘সচক্ষে দেখা জিনিসকে অস্বীকার এবং মিথ্যে বলা পাপ নয় কি?’
প্রশ্ন ছুঁড়লো মৃদু কণ্ঠে সামাইরা। এরও সঠিকভাবে উত্তর দিলো না জোহান। সামাইরা হতাশ হলো। জোহান দরজা লক করে বেরিয়ে এলো বাহিরে। চলে এলো সেখান থেকেই সোজা বাড়িতে।
রাধিকাকে বারের সামনে নামিয়ে দিলো আহিল। রাতেই বলে রেখেছিল ইমরান এখানে আসে মদ্যপান করতে। এজন্য তার প্লান মোতাবেক রাধিকাকে এখানে ছেড়েছে। রাধিকা এই প্রথম বারে এলো। ইতস্তত বোধ নিয়ে ভেতরে এসে চারদিক তাকিয়ে ইমরানকে খুঁজছে। কোণার এক টেবিলের বসে মদ খাচ্ছিল। রাধিকা বুকে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেল। চেয়ার টেনে বসতে বসতে ইমরানের উদ্দেশ্যে বলল,
‘কেমন আছেন দুলাভাই?’
কিঞ্চিৎ ঝাপসা চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে রাধিকাকে দেখলো। তার চাহনিতে স্পষ্ট কামনা বাসনার ছাপ। আপাদমস্তক মেপে সে বলল,
‘রাধিকা তুমি এখানে?’
‘এক ফ্রেন্ড এখানে আসতে বলেছে। এজন্য এসেছি। এসে দেখি আপনি উপস্থিত আগে থেকেই। তাই কথা বলতে আসলাম।’ স্বাভাবিক ভাবে কথাগুলো গুছিয়ে পেশ করল রাধিকা। ইমরান মদের বোতল পাশে চাপিয়ে বলল,
‘মাথায় সামাইরার চাপ থাকায় সকাল সকাল বারে এসেছি। মাত্র কয়েক গ্লাস খেয়েছি।’ কিছুটা নেশারু কণ্ঠে বলল।
‘এগুলো ছেড়ে চলুন একত্রে সামাইরাকে খুঁজে বের করি। একা তো আর সম্ভব নয় আমার পক্ষে।’
‘তোমার কথায় জোর আছে। চলো, এসব বাদ এখন।’ বলেই ঝিমুনি পায়ে কাউন্টারে এসে বিল দিয়ে বের হলো রাধিকাকে সঙ্গে নিয়ে।
পানির বোতল কিনে চোখেমুখে ঝাপটা দিয়ে নেশারঝোঁক কিছুটা কাঁটালো। টেক্সিতে চড়ে বের হলো সামাইরাকে খুঁজতে।
‘প্রথম কোথায় যাওয়া যায় বলো রাধিকা।’
‘আমি ওর প্রিয় কয়েকটা স্থান চিনি। সেখানে যাই চলেন।’
‘চলো।’
সামাইরার পরিচিত কয়েকটি স্থানে যেয়ে ফিরে এসে রমনাপার্কে বসলো দু’জন। দূর থেকে আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকবার ইমরারের ভাইব্রেশন হয়েছে ফোনে। বোঝাই যাচ্ছে তাকে বার বার কেউ কল দিচ্ছে। তবে সে ইচ্ছে করেই রিসিভ করছে না। লাস্ট বার দেবার পর ইমরান রাধিকার থেকে একটু দূরে এসে রিসিভ করল।
‘এত বার কল দেবার কারণ কি, রাবিশ!’ তেজি কণ্ঠে শুধালো সে।
‘আমি প্রেগন্যান্ট জানা স্বত্বেও বাংলাদেশে ফিরে একটি বারও যোগাযোগ করলে না। হোয়াই ইমরান?’
‘রাখ তোর প্রেগন্যান্ট! আমায় কল দিয়ে ডিস্টার্ব করবি না। যখন মন চাইবে তখন কল দিবো। ফের কল দিয়েছিস তো মে রে ফেলবো।’ কর্কশ গলায় কথাগুলো বলেই ফোন কেটে দিলো। এগিয়ে এসে রাধিকার পাশে বসলো। লালসার দৃষ্টিতে চেয়ে নরম স্বরে বলল,
‘হিন্দুধর্মে মেলামেশা সম্পর্কে বিস্তারিত বলো তো রাধিকা।’
ভ্রুকুটি করে তাকালো রাধিকা। ইমরান টপিক পাল্টে বলল,
‘আমি জানতে চাইছি তোমরাও প্রেম করো। সেই ক্ষেত্রে দূরত্ব মেইনটেইন করে চলো নাকি কোনো বাঁধা বিপত্তি থাকে না সম্পর্কে।’
‘আপনাদের মুসলিম জাতির প্রেম ও আমাদের প্রেমে কোনো পার্থক্য নেই। সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার আমরা বাঙালি। আমার জানা মতে আবেগের বশে মেলামেশা বেশি হয়ে যায়, যেটা একদমই ঠিক নয়।’
‘নিশ্চয় সামাইরা বলেছে এগুলো তোমায়?’ হালকা বিরক্ত ভাব নিয়ে বলল।
‘হ্যাঁ, ও বলেছে।’
ইমরান বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল,
‘কালকে বাকি স্থানগুলোতে খুঁজবো। আপাতত হোস্টেলে যাও তুমি।’
‘আচ্ছা ভাইয়া।’
বলেই ইমরান তাকে টেক্সিতে উঠিয়ে দিলো। স্থান ফাঁকা হতেই আহিল বের হলো বড়ো গাছের পেছন থেকে। সেখানের একটি বেঞ্চের উল্টোদিক মুখ করে বসে তাঁদের ফলো করছিল। সবই শুনেছে সে।
.
.
চলবে?

®সুমাইয়া মনি