#তুমিময়_আসক্তি_২
#আলো_ইসলাম(লেখিকা)
“২৬”
–সত্যি তুমি বড় নিষ্ঠুর, নির্লজ্জ, জঘন্য মেয়েমানুষ। যার মধ্যে নেই কোনো মায়াদয়া। একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের কপাল পোড়াতে কিভাবে পারো? তোমার জন্য আমি আমার স্বামী হারিয়েছি, আমার রুদ্রটা তার বাবাকে হারিয়েছে। মিথ্যা ছলনা করে আমার ছেলেটার জীবন নষ্ট করে দিয়েছো। এখন আবার ওর সুখের সংসারে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করেছো। তোমার কখনো ভালো হবে না দেখো। যে অন্যায় তুমি করেছো তার জন্য প্রতিটা মুহূর্তে অনুশোচনায় ভুগবে। ধুকে ধুকে মরবে তুমি আর এটা একটা মায়ের অভিশাপ, একজন স্ত্রীর অভিশাপ। রত্না চৌধুরী কথাটা বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তার স্বামী এই পৃথিবী ত্যাগ করেছে সত্যি মানতে পারছেন না তিনি।
কেঁদো না মা। তোমার চোখের কান্না দেখে কারো অনুশোচনা নয় বরং আনন্দই হবে। কারণ এটাই তো চেয়েছিলো সে। তাই চোখের পানি ফেলো না। তোমার মুখে আমি হাসি দেখতে চাই মা। সব সময় হাসবে তুমি যাতে করে ওদের দেখে গায়ে জ্বালা ধরে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে বলে রুদ্র রোজার দিকে তাকিয়ে। রোজার মধ্যে কোনো অনুশোচনা বা কোনো অপরাধবোধ নেই আর না আছে কোনো ভাবান্তর। সাবলীল ভাবে দাঁড়িয়ে আছে সে।
– আমার নিজেরই খুব খারাপ লাগছে জানো রোজা! যে আমি তোমার মতো নিচ – জঘন্য মেয়েকে ভালোবেসে ছিলাম। তার জন্য পাগলামি করেছি। পরিবার, বা নিজের কথা ভাবিনি। তোমাকে নিয়েই মত্ত ছিলাম আমি। কিন্তু আমার সে ভালোবাসা যে পুরোটাই মিথ্যা দ্বারা পরিপূর্ণ ছিলো বুঝতে পারিনি। করুণা হচ্ছে খুব। সত্যি আমি বোকা, ষ্টুপিড একটা। তবে আমি এটা ভেবে আনন্দ পাচ্ছি! বলতো পারো স্বস্তি পাচ্ছি যে তুমি সরে গেছো আমার জীবন থেকে। উপর আল্লাহ তোমাকে সরিয়ে দিয়েছে আমার জীবন থেকে। নয়তো আমি তোমাতে আরো আসক্ত হয়ে যেতাম। তোমার সাথে মিশে যেতাম। আর তখন যদি আমাকে ফেলে আসতে তাহলে হয়তো আমার মৃ/ত্যু একমাত্র রাস্তা হতো। আমি এদিক থেকে তোমার কাছে কৃতজ্ঞ যে তুমি আমাকে ছেড়ে এসেছো। নয়তো আমি দোলার মতো মেয়েকে জীবনে পেতামই না। ওর মতো নিষ্পাপ একটা মানুষ আমার জীবনে আসার সুযোগ পেতো না তুমি থাকলে। রুদ্র মলিন কন্ঠে বলে কথা গুলো।
— সব কিছুর যেমন শুরু থাকে! তেমন তার শেষও হয়। তোর পাপের দিন শেষ আজ। যে অন্যায় করেছিস তুই এতদিন। এখন তার শাস্তি ভোগ করার পালা। ক্রোধান্বিত হয়ে বলে রাজ।
– ওদের কথোপকথন শেষ হতেই পুলিশ এসে উপস্থাপন হয় সেখানে। পুলিশ দেখে সামির, রোজা চমকে উঠে। পালানোর কোনো রকম সুযোগ তারা পাইনা। রুদ্র ওদেরসহ প্রমাণ তুলে দেয় পুলিশের হাতে। তানিয়া ওর মায়ের লা/শ ধরে কান্না করছে। দোলা আর আশা তানিয়াকে সামলানোর চেষ্টা করে।
– কেঁদো না তানিয়া। ফুপি যে আমাদের সাথে এমন কাজ করবে সত্যি কল্পনা করিনি। উনি তো আমাদের নিজস্ব মানুষ ছিলো বলো।।যদি উনার সম্পত্তির দরকার হতো সেটা উনাকে বলতে পারতেন। আমার বিশ্বাস উনি কখনোই না করতেন না। দোলা বলে আফসোস নিয়ে।
– আসলে কি জানো ভাবি! লোভ। লোভই মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। তেমন আমার মাকেও তার লোভ, উচ্চাকাঙ্খা শেষ করে দিয়েছে। তার ভেতরের মনষত্ব, ন্যায়-অন্যায় সব লোপ পেয়েছে। যার ফল-স্বরুপ আমার মা আজ এইভাবে মাটিতে লুটিয়ে আছে। কিন্তু আমার কি হবে? মা কেনো একবার আমার কথাটা ভাবলো না। আমি তো কখনো বিলাসিতা চাইনি। একটা ভালো সুন্দর পরিবারই চেয়েছি সব সময়। তাহলে মা কেনো বুঝলো না সেটা তানিয়া হাউমাউ করে কেঁদে উঠে কথাগুলো বলে। রত্না চৌধুরী এগিয়ে এসে তানিয়াকে আগলে নেয় নিজের কাছে। সবার মধ্যে চাপা কষ্ট বিদ্যমান। চোখের মধ্যে টলমল পানি। পুলিশ জেসমিন চৌধুরীকে নিয়ে যায় তার আগে একজন পুলিশ অফিসার রুদ্রর সামনে দাঁড়িয়ে বলে ধন্যবাদ মিস্টার চৌধুরী। আপনারা আজ কতবড় উপকার করলেন বলে বোঝাতে পারবো না। এরা যে শুধু ঠক প্রতারক তাই নয়। নারীপাচারকারীর মতো জঘন্য কাজের সাথে লিপ্ত। শুধুমাত্র তথ্য প্রমাণের অভাবে এদের ধারেকাছে আসতে পারিনি আমরা। গতরাতে বেশ কিছু মেয়েদের পাচার করা হয়। সে-সময় আমাদের পুলিশ বাহিনি তাদের আটক করে সাথে যারা এই কাজে জড়িত তাদেরও আটক করা হয়। আর তাদের মধ্যে থেকেই একজন এদের নাম বলেছে। এর আগে অনেকবার আমরা ধরতে পেরেছি কিন্তু তারা কখনোই মুখ খুলেনি এদের ব্যাপারে। এমন ভাবে ট্রেনিং দেওয়া ছিলো ওদের। ওরা নিজে নিজেই জীবন দিতো তাও এদের নাম প্রকাশ করেনি। কিন্তু গতদিন যাদের ধরা হয় তাদের মধ্যে থেকে একজন জান বাঁচানোর জন্য এদের নাম বলেছে আজ। সবার মধ্যে ঘৃণার পরিমাণটা যেনো বেড়ে যায় ওদের প্রতি। এতটা জঘন্য খারাপ মানুষ ভাবতেও যেনো শরীরে কাটা দিয়ে উঠে। রোজা আর সামির মাথা নিচু করে আছে৷ এতখনে তারা দমে যায় একটু হলেও।
– আশা করি ওদের যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করবেন রুদ্র বলে কঠোর গলায়।
জ্বি অবশ্যই। এই বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন আপনি। এখন আসি বলে পুলিশ চলে যায় ওদের নিয়ে। রুদ্র দোলার কাছে গিয়ে হাত ধরে বলে তুমি ঠিক আছো দোলা। ওরা তোমার সাথে কিছু করেনি তো? তোমাকে এতো পাকামি কে করতে বলেছে শুনি। যদি কোনো ক্ষতি করে দিতো তোমার তাহলে কি হতো? রুদ্রকে আবারও চিন্তিত দেখায় এতখন বাদে।
– আমি ঠিক আছি রুদ্র৷ চিন্তা করবেন না। এরপর দোলা কিছুক্ষণ দমে থেকে বলে সব প্রমাণ পেয়ে গেছেন নিশ্চয়। আমি যে নির্দোষ এটা তো প্রমানিত এখন মলিন কন্ঠে বলে । রুদ্র মাথা নুয়ে ফেলে। আবারও তার মধ্যে দীর্ঘশ্বাস একটা।
– দোলা তাড়াতাড়ি চল আমার সাথে। মামা তোর জন্য অপেক্ষা করছে। ওদের কথার মাঝে সজল বলে উঠে ব্যস্ত হয়ে। দোলা ভ্রু কুচকে উত্তেজিত চাহনি রেখে বলে বাবা অপেক্ষা করছে মানে? কোথায় বাবা?
– সজল সব খুলে বললে দোলা ভেঙে পড়ে। রাশেদ মিয়ার কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে।
– আমাকে জলদি বাবার কাছে নিয়ে চলো ভাইয়া। তোমরা আমাকে এতখন বলোনি কেনো?
– আঙ্কেল ঠিক আছেন ভাবি। তুমি চিন্তা করো না। বাবা আছেন সেখানে। আমরা আঙ্কেলকে দেখে তবেই এখানে এসেছি তানিয়া বলে।
– আমি বাবার কাছে যাবো। প্লিজ আমাকে নিয়ে চলো তোমরা। রুদ্র সজলকে বলে দোলাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। রুদ্র বাকিদের নিয়ে আসছে। দোলা, আশা আর সজল বেরিয়ে যায় সেখানে থেকে।
– থ্যাংকস ইয়ার। তোর জন্য সব কিছু এত সহজে হলো। আমি না সত্যি কল্পনাও করিনি রোজা এতটা ডেঞ্জারাস হয়ে উঠেছিলো। ওর মধ্যে প্রতিশোধের নেশা এতটা প্রখর।
– আমার সাথে আবার ফর্মালিটি করা হচ্ছে৷ আমি কি তোদের পর কেউ মুখটা ভাড় করে বলে রাজ৷ রুদ্র ফিক করে হেসে দেয় সাথে রত্না চৌধুরী আর তানিয়াও।
– আসলে রাজই তখন বুদ্ধিটা দেয়। রুদ্র মাথা গরম করে বেরিয়ে আসতে চাইলে রাজ বাধা দেয়। সত্যি যদি দোলা রোজার কাছে থাকে। তাহলে এত সহজে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যাবে না। যার জন্য রাজ বলে রুদ্রর লোকদের কাজে লাগাতে। তবে ওদের কল্পনাতেও ছিলো না এইগুলো। কেঁচো খুঁজতে যে কেউটে বেরিয়ে আসবে ভাবিনি ওরা।
— কেটে যায় দুদিন! রাশেদ মিয়া এখন মোটামুটি সুস্থ আছে। তাকে সকালের দিকেই বাড়ি নিয়ে আসা হয়েছে। সবাই এখন দোলাদের বাড়িতেই আছে। এই দুদিন দোলা বাবার সাথে হসপিটালেই থেকেছে। অনেক ধকল গেছে তার উপর দিয়ে। তারপরও কাউকে কিছু বুঝতে দেয়না সে। বাবার মায়ের সেবা করতে পারা সে-তো বড়ই ভাগ্যের ব্যাপার। সেখানে দোলা তার মাকে হারিয়েছে অনেক আগেই। বাবাই একমাত্র ভরসা তার।
— দোলার বাড়িতে সবাই থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে-বসে আছে। রুদ্র মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে অপরাধীর ন্যায়। সবাই যেনো একটা শকের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। দোলা স্বাভাবিক ভাবে আছে।
– এইসব কি বলছিস তুই দোলা মা। এমন সিদ্ধান্ত নিস না তুই দোলা। আমার ছেলেটা এবার সত্যি সত্যি শেষ হয়ে যাবে রত্না চৌধুরী বলেন কাঁদো কাঁদো কন্ঠে। দোলা একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে তাহলে যে আমার নিজের প্রতি অবিচার করা হবে মা। আমি মানছি তোমার ছেলে যেটা করেছে আমার সাথে তার জন্য সম্পুর্ণ দায়ী নয়৷ কিন্তু একবারে নির্দোষও বলা যায় না। উনি ঠকে গিয়েছেন একটা নারীর থেকে। তার মানে এই নয় যে একজন নারীর দায় সবাই বহন করবে। উনার সাথে যা কিছু হয়েছে তাতে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বাস করাটা কষ্টসাধ্য জানি। কিন্তু বিশ্বাস ছাড়া যে কিছু হয়না এটাও তো উনার বোঝা দরকার ছিলো।
– ভাবি! যা হওয়ার তো হয়েছে। প্লিজ তুমি ব্রোকে মাফ করে দাও৷ আমরা সবাই একসাথে থাকতে চাই। আমি তো মাকে হারালাম এখন যদি তুমিও দূরে সরে আসো তাহলে আমি কি নিয়ে থাকবো বলতে পারো? মামি কিভাবে থাকবে তোমাকে ছাড়া। অসহায় কন্ঠস্বর তানিয়া।
– আমি তোমায় বলেছিলাম তানিয়া! আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবো। সব সত্যি সামনে নিয়ে আসবো। আর সেদিন যদি জানতে পারি আমি নির্দোষ। কোনো প্রকার দোষ আমার ছিলো না তারপরও আমি অত্যাচারের শিকার হয়েছি সেদিন আমি দূরে সরে আসবো সব কিছু থেকে। আজ সে- সময় এসে গেছে তানিয়া। তোমার ভাইয়া কখনোই বিশ্বাস করতে পারেনি আমায়। হ্যাঁ মানছি উনার ভালোবাসায় কোনো কমতি ছিলো না। কিন্তু ভালোবাসা নামক যে অত্যাচার হয়েছে আমার উপর সেটা আমি মানতে পারিনি আর না এখন পারছি। উনি আমাকে জোর করে বিয়ে করেছেন এতে আমার কোনো অভিযোগ নেই এখন। কারণ উনার ভালোবাসা উনার অতীত সেসব মিটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু দিনের পর দিন যে অত্যাচার হয়েছে আমার উপর। আমাকে যে আমার পরিবারের থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে৷ আমার বাবা ভাই চাইলেও আমার কাছে যেতে পারিনি। আর এই সব কিছু উনার জন্য। আমি সেদিন গুলো মুছতে চাইনা আর না পারছি। আমার সাথে করা অন্যায় গুলো আমি ভুলতে পারছি না৷ যেখানে কোনো দোষ না করে এতটা শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে সেখানে সব কিছু মেনে নেওয়া মানে নিজের সাথে বেইমানি করা। নিজ আত্মার সাথে বেইমানি করা।
– আমি বলছি না উনাকে একবারে ছেড়ে চলে আসবো আমি বা আসতে চাই৷ তবে যতদিন আমার মনে হবে আমার সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি আমি উনাকে দিতে পেরেছি। আমার ভেতরটা শান্ত হতে পেরেছে ততদিন আমি উনার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাইনা।
– দোলা আরেকবার ভেবে দেখলে হতো না বোন। আমি জানি তুমি কতটা খারাপ সময় পার করেছো। তোমার সাথে কি কি হয়েছে। কিন্তু রুদ্র কেনো এমন করেছে সবই তো জানো। ও যে ভুল করেছে এটা তো স্বীকার করেছে। তাহলে কেনো পারছো না মাফ করে দিতে। সব কিছু ভুলে যাওনা করুণ কন্ঠে বলে রাজ।
–ভাইয়া প্লিজ আমাকে জোর করবেন না। আমি পারছি না নিজেকে বোঝাতে৷ উনি এক নারীর কাছে ঠকেছেন মানে এই নয় সবাই তার শাস্তি পাবে। উনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করতেন। আমাকে সব কিছু বলতেন তাহলে আজ হয়তো এইদিনটা আমাদের দেখতে হতো না। আর না আমাকে এত কষ্ট এতো অত্যাচার সহ্য করতে হতো। কিন্তু উনি… দোলা থেমে যায়। রুদ্রর দিকে ঘৃণিত দৃষ্টি আজ আবারও।
– তুমি আমার থেকে দূরে থাকতে চাও তাই তো? আমাকে শাস্তি দিতে চাও। ওকে ফাইন!৷ তুমি দাও শাস্তি আমায়। আমার থেকে দূরে দূরে থাকো সমস্যা নাই। তবে সেটা তো তুমি আমার বাড়ি থেকেও করতে পারো দোলা। তোমাকে থাকতে হবে না আমার সাথে। আমি তোমার আলাদা ঘর সব কিছু ব্যবস্থা করে দেবো৷ তুমি শুধু আমার চোখের সামনে থাকবে। আমি তোমাকে প্রতিদিন দুচোখ ভরে দেখতে চাই। সাথে এটাও দেখতে চাই আমার সন্তান কিভাবে একটু একটু করে বেড়ে উঠে তোমার মধ্যে। আমাকে এইগুলো থেকে বঞ্চিত করো না দোলা। তুমি আমার সাথে কথা বলোনা। আমাকে অবহেলা করো কিন্তু এত বড় শাস্তি দিও না। রুদ্রর মধ্যে তোলপাড় অবস্থা। চাপা আর্তনাদ, অসহায়ত্ব।
— কাছে থেকে ইগ্নোর করা সহজ কথা নয় রুদ্র। মায়া বলে একটা শব্দ আছে। আর এই শব্দটা এতটাই কঠিন একটা শব্দ যে মানুষের জীবনকে সাঁজিয়ে দেয় আর শেষ করেও দেয়। কাছে থেকে আপনাকে উপেক্ষা করার সাধ্যি আমার নেই। আমার স্বামীকে ইগ্নোর করতে পারবো না আমি।।তাহলে যে উপরে যিনি আছেন তিনি আমার প্রতি নারাজ হবেন। তাছাড়া মানুষ তো আমি সাথে একটা মনও আছে। কাছে থেকে মায়ায় ডুবে যেতে সময় লাগবে না। যেটা আমি একদম চাইনা। আর রইলো আপনার সন্তানের কথা। এটা যেমন আমার সন্তান তেমন আপনারও সন্তান। ওর প্রতি আমার যতটুকু অধিকার ঠিক ততটুকু অধিকার আপনারও।। ওর কোনো ব্যাপারে আমি আপনাকে কখনোই বাধা দেবো না। ওর জন্য আপনি উন্মুক্ত সব সময়। আর একটা কথা যেদিন এই সন্তান পৃথিবীতে আসবে সেদিন আমি ওকে আপনার হাতে তুলে দেবো। বিশ্বাস করুন আমি একটুও কার্পণ্য করবো না ওর বিষয়ে। কারণ আমি জানি ও আমার থেকেও আপনার কাছে ভালো থাকবে। একটা সন্তানের জন্য যে আকুতি, যে মায়া মহব্বত থাকে সে সব কিছু আমি দেখেছি আপনার মধ্যে। তাই দয়া করে আপনারা কেউ আমাকে জোর করবেন না আর কোনো বিষয়ে। আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাবেন আপনারা সবাই। আর আপনি! আমি এতটুকু আশা তো রাখতেই পারি আপনার উপর। আপনি নিশ্চয় আমার মতামতকে প্রাধান্য দেবেন রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলে দোলা।
রুদ্র আহত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে দোলার দিকে। চোখের মধ্যে আসতে চাওয়া অশ্রু গুলো যথাসাধ্য লোকানোর চেষ্টা করে বলে আমি তোমার মতামত তোমার চাওয়াকে সম্মান করি দোলা। আমি যে অন্যায় করেছি তার জন্য মাফ সত্যি দুর-সাধ্য। আর আমি যদি এরপরও মাফ চাই তোমার কাছে সেটাও হবে আমার আরেকটা অপরাধ। আমি তোমাকে কখনো ভালো রাখতে পারিনি এটা যেমন সত্য তেমন তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা ছিলো এটাও সত্য। যাই হোক তুমি যখন চাওনা আমার সাথে থাকতে ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য। যেদিন তোমার মনে হবে আমার কাছে ফিরে যাওয়া দরকার সেদিনটার জন্য আমি অপেক্ষা করবো।তার আগে আমি কখনো তোমার সামনে আসবো না কথা দিলাম। রুদ্র বেরিয়ে যায় কথাগুলো বলে। সবাই হতভম্ব হয়ে আছে। রুদ্র যেতেই দোলার চোখ বেয়ে এক ফোটা পানি নিচে পড়ে।
– বাবা! আমার সিদ্ধান্তে তোমার কোনো আপত্তি নেই তো? তোমার বাধা নেই তো আমাকে নিয়ে? তোমার কি আলাদা ভাবে কিছু বলার আছে এখানে। যদি থেকে থাকে বলতে পারো জিজ্ঞাসু দৃষ্টি রেখে বলে দোলা।
– আমি আর কি বলবো দোলা ‘মা। তোর জীবন তুই ভালো মন্দ সবটা বুঝিস৷ এছাড়া তোর মতামত তোর সিদ্ধান্তের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। কিন্তু মা আরেকবার ভেবে দেখলে হতো না। একটা অন্যায় হয়ে গেছে সেটা তো… বাবা প্লিজ। আমাকে এইগুলো করতে বলো না তুমি। আমাকে আর দুর্বল করে দিও না আমি নিজের মতো থাকতে চাই। আমার ভেতরের আত্মাকে আমি প্রশান্তি দিতে চাই। নয়তো সারাজীবন ছোট হয়ে থাকবো আমি আমার নিজের কাছে। দোলাও আর দাঁড়ায় না সেখানে ঘরে চলে যায় কান্না করতে করতে। সবাই মনোক্ষুণ্ণ হয়ে সেখানেই বসে থাকে৷ হতাশা, দুঃখ গ্রাস করে সবাইকে।।সব ঠিক হয়েও আবার এলোমেলো হয়ে গেলো। দুজন মানুষ কাছাকাছি এসেও দূরে সরে গেলো পুনরায়।
চলবে….
– ❌❌কপি করা নিষেধ ❌ ভুলক্রুটি ক্ষমা করবেন।
#তুমিময়_আসক্তি_২
#আলো_ইসলাম (লেখিকা)
“২৭”
— কেটে যায় দুইমাস। এই দুই মাস রুদ্র বা দোলা কারো দেখা হয়নি। কিন্তু রুদ্রর পরিবারের সাথে প্রতিদিনই যোগাযোগ করা হয় দোলার। তানিয়া, রত্না চৌধুরী, তানভীর আহমেদ সবার সাথে কথা হয়৷ এমনকি তারা এসে এসে দেখে গেছে দোলাকে। কিন্তু দোলা একবারের জন্যও যায়নি রুদ্রর বাড়ি। আজ আশা আর রাজের বিয়ে৷ রাজ আর আশা দুজন দুজনকে প্রথম থেকেই পছন্দ করতো। এটা যখন সবাই জানতে পারে তখন সেটা বিয়েতে পরিণত দেয়। রাজের বাবা-মা নেই। অনেক আগেই মা/রা গেছেন তারা। রাজ তার চাচা-চাচির সাথে থাকতো। কিন্তু রাজের চাচিও গত হয়েছেন কয়েকবছর আগে। এখন মা হিসেবে সব দায়িত্ব রত্না চৌধুরীরই। রাজ দেখতে শুনতে ভালো, নিজস্ব ব্যবস্থা সব মিলিয়ে আশার পরিবার সন্তুষ্ট। তাই আর কোনো রকম আপত্তি জানাননি তারা।
– দুদিন বেশ হাসি আনন্দ! জমজমাট ভাবে কেটেছে। গায়ে হলুদ, মিষ্টি মুখ সব মিলিয়ে বেশ ভালো সময় যায়। দোলা দুদিন আগেই চলে এসেছে আশার বাড়ি। সাথে সজল ও রোকনও আছে। যেহেতু তারা কনে পক্ষ তাই এখানেই অবস্থান করছে। তানিয়া একসাথে দুটো বিয়ে উপভোগ করছে৷ কখনো রাজের বিয়ের উৎসব তো কখনো আশার বিয়েতে। একদিকে ভাইয়া আরেক দিকে ফ্রেন্ডের বিয়ে দুটোই যেনো ইঞ্জয় করছে খুব। রাজের বিয়েটা রুদ্রর বাড়ি থেকেই আয়োজন করা হয়। এই দুদিনে সজল আর তানিয়ার বেশ ভাব জমে উঠে। দেখামাত্র তারা দুজন দুজনকে একটা করে মুচকি হাসি উপহার দিয়ে গেছে প্রতিবারই। হয়তোবা ভালো লাগাও শুরু হয়ে গেছে দুজনের মধ্যে।
— আশাকে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। লাল টকটকে বেনারসি শাড়ি, ভারী গহনার ভার সাথে গাঢ় মেকাপের প্রলেপ। দোলাও আজ লাল শাড়ি পড়েছে। কারণটা আশা। আশার আবদারে লাল শাড়ি পড়ে দোলা। তাছাড়া দোলার লাল রং একদমই পছন্দ না(আমারও)। অনেক সুন্দর লাগছে দোলাকে লাল শাড়িতে
বর আসার অপেক্ষা এখন। হৈচৈ হট্টগোল বিয়ে বাড়ি জাঁকজমকপূর্ণ। বাচ্চাদের দৌড়ঝাপ বড়দের ছোটাছুটি সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ বিয়ে বাড়ি একটা। ব্যস্ত সময় যাচ্ছে সবার। বর যাত্রী আসবে তার আয়োজন চলছে। দোলার মধ্যে যেনো অস্থিরতা ভাব একটা। কারো জন্য দীর্ঘ প্রতিক্ষা৷ এই দুই-মাস রুদ্রকে না দেখতে পেয়ে দোলা যেনো মিস করতে শুরু করে। অপেক্ষা করছে রুদ্রকে একটিবার দুচোখ ভরে দেখার। রুদ্র আজ আসবে এই আশায় প্রতিক্ষীত দোলা। আচ্ছা উনি সত্যি আজ আসবেন তো? নিজের মধ্যেই প্রশ্নটা আওড়াই দোলা। নাহ আসবেন উনি! উনার সবচেয়ে কাছের বন্ধুর বিয়েতে আসবে না এটা কি কখনো হয়। এইসব ভাবনায় মশগুল দোলা। কি রে এতো কি ভাবছিস শুনি? আশার কথায় ভাবনাচ্যুত হয় দোলার। মুখে মিষ্টি একটা হাসি নিয়ে বলে তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে রে আশা। দোলার কথায় লাজুক হাসে আশা। এরপর আশাও মুচকি হেসে বলে লাল শাড়িতে দারুণ মানিয়েছে তোকে৷
– আচ্ছা বরযাত্রী কখন আসবে? হুট করে বলে উঠে দোলা। আশা ভ্রু কুচকে তাকায়৷ ওর তাকানো দেখে দোলা চকচকিয়ে উঠে বলে না মানে তানিয়া এখনো আসলো না৷ বর না আসলে তো সেও আসবে না। আশা দীর্ঘশ্বাস রেখে বলে মিস করছি তানিয়াটা কে। এরই মধ্যে পুরো বাড়ি জুড়ে একটি শব্দে মুখরিত হয়ে উঠে। বর এসেছে বর এসেছে। সবাই যেনো নতুন করে ব্যস্ততার রঙে রঙ্গিন হয়। ছোট বড় সবাই বর দেখতে ছুটে। বরযাত্রীদের বসতে দেওয়া তাদের জন্য খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা এইসবে সবাই নতুনভাবে মেতে উঠে।
– আশার বুকের মধ্যে ধক করে উঠে কথাটা কর্ণপাত হতেই৷ দোলার মধ্যে আলোড়ন ফেলে দেয়। বর এসেছে কথাটা শুনে সে নড়েচড়ে বসে। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা দেখার অপেক্ষার অবসান হয় যেনো। আশার আশেপাশে থাকা আত্মীয় বা মেয়েরা ছুটে যায় বর দেখার জন্য। আশা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে আরো৷ নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নিয়ে বসে।
– তুই বস আমি আসছি কথাটা বলে দোলা বেরিয়ে আসতে চাইলে আশা হাত চেপে ধরে দোলার। কৌতুহলী হয়ে বলে কোথায় যাচ্ছিস? দোলা হাসার চেষ্টা করে বলে বর সাঁজে রাজ ভাইয়াকে কেমন লাগছে দেখে আসি।
– রাজকে দেখার জন্য ছুটছিস নাকি অন্য কাউকে দোলা? চমকে উঠে দোলা আশার কথায়। ঘাবড়ে যাওয়া চোখে তাকিয়ে আমতাআমতা করে বলে কা-কাকে দেখার জন্য যাবো আবার? আমি তো রাজ ভাইয়াকে দেখতেই যাচ্ছি। নিজেকে শক্ত করে প্রকাশ করার চেষ্টা।
– তুই কেনো মিথ্যা বলছিস দোলা। আমি তোকে জানি তোকে বুঝি৷ তুই যে রুদ্র ভাইয়ার জন্য যাচ্ছিস এটা আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারছি৷ আমি তোর বেস্ট ফ্রেন্ড দোলা। সেই ছোট থেকে তোকে দেখছি আমি। তোকে চিনতে আমার অবশিষ্ট নেই।
– কি যা-তা বকছিস আশা তুই? এমন কিছুই না৷ আমি তো জাস্ট.. তুমি রুদ্র ভাইয়াকে মিস করছিস এবং তুই ভালো নেই রুদ্র ভাইয়াকে ছাড়া। তুই যে রুদ্র ভাইয়াকে ভালোবাসিস এটা কখনোই লুকাতে পারবি না তুই। দোলা অবাক চোখে তাকায় আশার দিকে।
– তুই যেমন ভালো নেই তেমন রুদ্র ভাইয়াও ভালো নেই তোকে ছাড়া। কেনো এমন করছিস দোলা। সবটা ঠিকঠাক করে নে-না৷ দেখ সবাই চাই তোরা একসাথে থাক আবার। সবার মধ্যে একটা হতাশার ছাপ তোদের জন্য। তুই কিন্তু চাইলেই সবটা মিটমাট করে নিতে পারিস৷ ভাইয়া তো অনুতপ্ত তার কাজের জন্য তাহলে কেনো এমন শাস্তি দিচ্ছিস৷
– চুপ কর আশা৷ দয়া করে এই ব্যাপারে আর কোনো কথা বলিস না। জীবনটা আমার তাই আমাকেই বুঝতে দে সব কিছু। আশা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে একটা দোলার কথায়৷ এর মাঝে তানিয়া উপস্থিত হয় সেখানে। তানিয়া সাদা শাড়ি পড়েছে আজ। তানিয়াকে দেখে দোলা একটা হাসি রাখে৷ আশাও মুচকি হাসে। তানিয়া মুখের হাসিটা গাঢ় করে বলে কি অবস্থা কনের?
– তোমাকে তো শুভ্র পরী লাগছে তানিয়া। হেসে বলে দোলা। আচ্ছা! আর তোমরা যে লাল পরী হয়ে আছো এটা বলো। ভাবি তোমাকে কিন্তু দারুণ লাগছে লাল শাড়িতে৷ তানিয়ার কথায় আশা মুখটা মলিন করে বলে শুধু দোলাকেই ভালো লাগছে আর আমি? ওর কথায় তানিয় আর দোলা ফিক করে হেসে উঠে।
– তুমি আজকে সবচেয়ে সুন্দরী হয়ে আছো। বিয়ের কনে বলে কথা৷ আশা লজ্জায় নুয়ে পড়ে যেনো। আচ্ছা তোমরা কথা বলো আমি আসছি একটু বলে দোলা বেরিয়ে আসে ঘর থেকে । কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে।
– রাজকে তার আসনে বসানো হয়েছে৷ কিছুক্ষণ পর আশাকেও নিয়ে আসা হবে। দোলা দূর থেকে রুদ্রকে খুঁজছে৷ কিন্তু রুদ্রকে কোথাও দেখা যায়। রাজ আর তার কিছু বন্ধুরা কথা বলছে আর হাসাহাসি করছে৷ রাজ যেনো শুধুমাত্র দায়িত্ব পালনে মুখে হাসিটা বজায় রেখেছে। তার হাসির মধ্যে শুভ্রতা নেই আছে শুধুই মলিনতা। কিন্তু কেনো?
– উনি কি তাহলে আসেনি? দেখতে পাচ্ছি না কেনো?
পরোক্ষে হকচকিয়ে উঠে দোলা! কি হয়েছে আমার? আমি উনাকে নিয়ে এতো ভাবছি কেনো? আমার তো উনাকে নিয়ে ভাবার কথা নয়। তাহলে কেনো হচ্ছে এমন আমার সাথে। না না এমন ভেঙে পড়লে চলবে না৷ আমি কারো জন্য অপেক্ষা করবো না। নিজেকে নিজেই বোঝায় দোলা। নিজের কাছেও যেনো ধরা দিতে চাইনা সে৷
– ব্রোকে খুঁজছো ভাবি? হঠাৎ তানিয়ার এমন কথায় পিলে- চমকে পিছে তাকায় দোলা।
– ব্রো আসেনি ভাবি। আমরা অনেকবার বলেছি রাজ ভাইয়া অনেক রিকুয়েষ্ট করে কিন্তু লাভ হয়নি। ব্রো তোমাকে কথা দিয়েছে তোমার সামনে আসবে না তুমি না বলা পর্যন্ত! তাই সে আজ বিয়েতেও আসেনি।।কারণ ব্রো জানে এখানে আসলে তোমার মুখোমুখি হতে হবে৷ ব্রো দুর্বল হয়ে যাব তোমাকে দেখে। নিজেলে সামলাতে পারবে না। তাই সবচেয়ে কাছের বন্ধু তার বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়েটাও আসেনা সে। রাজ ভাইয়াকে দেখো ভাবি! আজকের দিনেও পুরোপুরি খুশি না মানুষটা৷ কারণ তার প্রিয় বন্ধুটাই কাছে নেই। আজকের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন তার প্রিয় বন্ধুটাকে বাদেই কাটাতে হচ্ছে।
– তানিয়ার কথায় দোলা আশাহত হয়। নতুন করে ভেঙে পড়ে আবারও। অপেক্ষার অবসান এইভাবে হবে ভাবেনি দোলা। চোখের মধ্যে পানি, নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা তার। চাপা আর্তনাদ হৃদয় জুড়ে।
— সুষ্ঠুভাবে বিয়েটা সম্পন্ন হয়ে যায়। পুরোটা সময় দোলা চুপচাপ আর মনোক্ষুণ্ণ হয়ে ছিলো। কোনো কিছুই যেনো ভালো লাগছিলো না। তবে রুদ্রর প্রতি তার অনুরাগের জন্ম হয় নতুন করে। রুদ্রর এমন বিহেভ এই সিদ্ধান্ত নতুন করে অভিমানের সৃষ্টি করে দোলার মধ্যে। অভিমান বড়ই প্রকট। রাগের কিনারা থাকলেও অভিমান যেনো শক্ত ভীত ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
—————————————————–
– প্রায় ১৬টা বছর অতিবাহিত হওয়ার পর!!
– বদলে গেছে সময় সেই সাথে বদলে গেছে অনেক কিছু৷ সময়ের হাত ধরে পরিবর্তীত সব কিছু। প্রকৃতি তার নতুন রুপে সেজে উঠেছে। শহর গুলো তাদের চাকচিক্যের ভীড়ে পুনরায় রঙ বদলাচ্ছে। সবাই এখন যে-যার মতো ব্যস্ত ঘর সংসার নিয়ে। পরিবার, কাছের মানুষগুলোর খেয়াল রাখা এইভাবে চলছে বেশ দিনগুলো। সময়ের হাত ধরে পরিবর্তন এসেছে দোলার মধ্যেও। চোখে গোল ফেমের চশমা জুড়ে গেছে, মাতৃত্ববোধ, আর দায়িত্বের ভার সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ একজন নারীতে গড়ে উঠেছে৷ রাশেদ মিয়া দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন বছর দুই আগে৷ রোকন, দোলা আর তার মেয়ে রোদ এই নিয়ে বেশ চলছে দোলার সংসার । দোলা সজলের অফিসে চাকরি করে। সজল নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য ছোটোখাটো একটা ব্যবস্থা শুরু করেছিলো। যেটা আজ বৃহৎ আকার নিয়েছে। সফল ব্যবসায়ীদের মধ্যে সে একজন হয়ে নাম লিখিয়েছে। দোলা সজলের অফিসের ম্যানেজার পোস্টে আছে। তার কাজের দক্ষতায় আজ এতদুর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।
— মা! হঠাৎ চেনা কন্ঠস্বর পেতেই দোলা চমকে উঠে। সামনে তাকাতেই রাদের হাসিমুখ দেখতে পাই। দোলা সবে একটা ফাইল নিয়ে বসেছে চেক দেওয়ার জন্য। সময়টা দুপুরের পর। দোলা লাঞ্চ সেরে ফাইল নিয়ে বসে আর তখনই আগমন হয় রাদের৷
– রাদ মা তুই? চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে দোলা রাদকে। এতদিন পর মায়ের ছোঁয়া পেয়ে রাদও যেনো আপ্লুত হয়ে যায়। মায়ের সংস্পর্শ পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠে।
– তোমাকে অনেক মিস করছিলাম মা তাই চলে আসলাম। দোলা রাদকে ছেড়ে দিয়ে ভালো ভাবে দেখে বলে তুই আজও স্কুল থেকে এসেছিস রাদ? তোকে না কতবার বারণ করেছি এইভাবে আসবি না তুই। তোর আমার কাছে আসার হলে আমাকে বলতি নয়তো বাবাকে বলতিস৷ পাঠিয়ে দিতো গাড়ি করে। এইভাবে না বলে হুটহাট আসাটা ঠিক বল তুই? দোলার কথায় রাদ যেনো আনন্দ পাই৷ তাই মুখের হাসিটা গাঢ় করে বলে তুমি কি খুশি হওনি আমাকে দেখে৷ আমি যে তোমাকে মিস করছিলাম এটা দেখবে না। মুখটা এবার ফ্যাকাসে করে কিউট একটা ফেস ধরে বলে রাদ। দোলা আর মুখটা গম্ভীর করে রাখতে পারে না৷ হেসে উঠে বলে আচ্ছা যা হয়েছে হয়েছে। টিফিন খেয়েছিস তুই? মায়ের কথায় চমকে উঠে রাদ৷ ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আমতাআমতা করে বলে আসলে মা ইয়ে মানে! রাদের এই আমতাআমতা দেখে দোলা যা বোঝার বুঝে যায়।
– এবার আমি তোমায় খুব করে বকবো রাদ। আমি বলেছি তোমাকে এইভাবে আসবে না আমার কাছে৷ আর এসেছে ভালো কথা টিফিন খেয়ে তবে আসবে। কতটা সময় চলে গেছে খেয়াল আছে আর তুমি এখনো টিফিন খাওনি। রাদ বুঝতে পারছে দোলা প্রচন্ড রেগে গেছে এবার। কারণ দোলা যখনই রেগে যায় তখনই তুমি করে বলে।
– টিফিন খেতে গেলে তো দেরি হয়ে যেতো তোমার কাছে আসতে৷ তাছাড়া টিফিন পিরিয়ড শেষ হলে আমাকে কি আর বের হতে দেবে স্কুল থেকে। অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে রাদ। দোলা কিছুক্ষণ রাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে অনেক কথা হয়েছে এবার এসো খেয়ে নেবে। তোমাকে নিয়ে সত্যি আর পারিনা৷ দোলার কথায় রাদ খুশিতে উত্তেজিত হয়ে বলে আমি না ঠিক এই জন্য আরো খাইনি! কারণ আমি জানি তোমার কাছে আসলে তুমি আমায় খায়ে দেবে রাদের কথায় দোলা এবার সত্যি হেসে দেয়। এরপর রাদকে নিয়ে অফিসের ক্যানটিনে চলে যায়।
– বিদেশী ক্লায়েন্টের সাথে বড় একটা ডিল হচ্ছে রুদ্রর কোম্পানির। আর তারই মিটিং চলছে। রুদ্রর মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি বরং তার মধ্যে গাম্ভীরতার নতুনত্ব এসেছে। তবে রুদ্রর মধ্যে এখন দুটো মানুষ বাস করে। পরিবার, মেয়ের কাছে খুবই স্বাভাবিক আর সেনসিটিভ একটা মানুষ। কিন্তু বাইরে হার্ডলেস, গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ যেটা বরাবর সবাই জানে। রুদ্র সেই আগের মতোই আছে। তার এটিটুড তার মধ্যেকার যে এক্টিভিটি ছিলো সেটা আজও অক্ষত।
– বাবা” মিটিং চলাকালে রোদ ঢুকে পড়ে মিটিং কনফারেন্স রুমে। রোদকে দেখে রুদ্রর মুখে হাসি ফুটে৷ সবাই তো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রোদের দিকে। রাজের মুখে হাসি ফুটে রোদকে দেখে।
– রোদ মামনী এখানে মিটিং চলছে তুমি বাইরে এসো প্লিজ রুদ্রর পিএ বলে রোদকে। এতখন তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করেছিলো রোদকে এখানে আসা থেকে আটকাতে। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়৷ রুদ্রর মেয়ে যে রুদ্রর মতোই জেদি হবে এটাই স্বাভাবিক।
– ওহ আঙ্কেল তুমি যাও তো। আমি বাবার সাথে দেখা করতে এসেছি দেখা করে চলে যাবো। রুদ্র তার পিএ-এর দিকে তাকালে তিনি মাথা নিচু করে বলে স্যার আমি অনেক চেষ্টা করেছি রোদ মামনীকে আটকানোর কিন্তু সে আমার কোনো কথায় শুনেনি। এখানে চলে এসেছে।
– কে বলেছে তোমায় ওকে আটকাতে? রুদ্রর গম্ভীর কথায় ঘাবড়ে যায় তার পিএ।
– না মানে স্যার! আপনি তো বলেছিলেন মিটিং চলাকালীন কেউ যেনো ডিস্টার্ব না করে আপনাকে।
– কেউ মানে অন্য কেউ সেটা আমার মেয়েরা নয়। তোমাকে না বলেছি আমার মেয়েদের কখনো বারণ করবে না আমার কাছে আসতে আমি যেখানেই থাকি।
– সরি স্যার রুদ্রর কথায় আরো মাথা নুয়ে ফেলে।
” শাট আপ এন্ড গো নাউ। রুদ্রর কথায় পিএ চলে যায়।
– রোদের মুখের হাসিটা চওড়া হয়ে আসে আরো। সোজা গিয়ে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে। রুদ্র ও মেয়েকে সাদরে আগলে নেই।
– এটা কি করছেন মিস্টার চৌধুরী। এখানে অনেক বড় একটা ডিল হচ্ছে। কত গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে আর আপনি!
– বাকিটা রাজ সামলে নেবে। আপনারা ওর সাথেই সবটা ঠিক করে ফেলুন৷ রাজ মিটিংটা তুই এটেন্ড কর বলে রুদ্র রোদকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। সবাই যেনো হতভম্ব রুদ্রর কাজে। রাজ দাঁড়িয়ে যায়। এরপর মুচকি হেসে বলে কিছু মনে করবেন না৷ আসলে রুদ্র ওর মেয়েদের অনেক ভালোবাসে। সব কিছুর থেকে ইমপোর্টেন্ট ওর মেয়েরা ওর কাছে তাই কোনো কিছুর সাথে কম্প্রোমাইজ করে না ওদের। এবার মিটিং শুরু করা যাক তবে? রাজের কথায় সবাই একটা বড় নিশ্বাস ত্যাগ করে মিটিং-য়ে মনোযোগী হয়।
বাকিটা পরের পর্বে!!
চলবে….