তুমিময় বসন্ত পর্ব-২৩

0
511

#তুমিময়_বসন্ত
২৩.
#writer_Mousumi_Akter

ভরা বৈশাখের কয়েকদিন অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে অথচ এখনো বৃষ্টির ছিটাফোঁটা দেখা যায় নি।বৈশাখ তার নিয়ম ভেঙে অভিমান করে বসে আছে।কিছু অভিমান বড়ই ভয়ংকর হয়।বৈশাখের অভিমান কতটা ভয়ঙ্কর হবে সেটা আন্দাজ করা যাচ্ছেনা।কাল বৈশাখির তান্ডব নিয়ে নৃত্য করবে কিনা অনুমান ও করা যাচ্ছেনা।তবে আকাশে জোয়ারে মেঘের ছড়াছড়ি।মাঝে মাঝে মেঘ দেখা যাচ্ছে মেঘে সূর্য ঢেকে যাচ্ছে অথচ বৃষ্টির দেখা নেই।আবার ও মেঘ কেটে ভয়ানক উত্তপ্ত সূর্য প্রকৃতির বুকে উত্তাপ ছড়াচ্ছে।পানির অভাবে আম ফুলে আসা মুকুল গুলো সব ঝরে ঝরে পড়ে যাচ্ছে।প্রকৃতির পানির প্রয়োজন,পিপাষায় ছটফট করছে।পাতাহীন কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল ফুল গুলো পানি পেলে বোধহয় আরোও সতেজ আর প্রাণবন্ত হয়ে ফুটতো।আজ বোধহয় বৃষ্টি হবেই। ভীষণ কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছে নীল আকাশ।কিছুক্ষণের মাঝেই সন্ধ্যা নামবে।আয়াস বাসায় নেই সে অফিসে আছে।এক্ষুণি হয়তো চলে আসবে।অয়ন বাসায় ই আছে।সে বাসায় থাকলেও বা কি না থাকলেও বা কি।বোঝায় যায় না যে বাসায় কেউ আছে।বরাবর শান্তশিষ্ট নম্র ভদ্র ছেলে অয়ন।খুব বেশী হাসাহাসি,লাফালাফি,অতিরিক্ত গল্প কোনটায় সে করেনা।চুপচুপ বই পড়া ই তার একমাত্র কাজ।বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে সে।দেখতে দেখতে প্রচন্ড বাতাস শুরু হলো।চারদিক লন্ডভন্ড শুরু হলো। বাতাসের গতিবেগ অনেক বেশী।ছাদে কাপড় আনতে যাওয়ার আগেই আমার ওড়না একটা উড়ে নিচে পড়ে গেলো।কিন্তু যেভাবে বৃষ্টি শুরু হয়েছে ওড়না আর আনতে যাওয়ার ও উপায় নেই।অয়ন, আয়াস, আরহী, আমি সবার কাপড় তুলে ঘরে নিয়ে এলাম।আরহী জানালা গুলো লাগিয়ে দিচ্ছে।

অয়ন আমাকে শান্ত কন্ঠে ডেকে বললো,

‘ভাবি এক কাপ চা হবে?তুমি ফ্রি থাকলে দাও।চাপ নিও না,আমার যে চা লাগবেই এমন ব্যাপার নাহ।’

অয়নের কথাবার্তা সব সময় অমায়িক।সে সব সময় চেষ্টা করে আমি যেনো কাজ করতে গিয়ে কষ্ট না পাই।আমি অয়ন কে এ ঘর থেকে ডেকে বললাম,

‘এভাবে বলছো কেনো অয়ন?চা বানাতে আমার অতটাও কষ্ট হবেনা বুঝলে। যতদিন না তোমার বউ আসছে আমি তোমাকে চা বানিয়ে খাওয়াবো।’

আরহী বেশ মজার সুরে আমাকে বললো,

‘মুগ্ধ সারাজীবন ই তোর হাতের চা খেতে হবে তোর দেবরের।বিকজ উনি তো বিয়েই করবেন না।’

আরহী কথাটা অয়ন কে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো।আমিও অয়ন কে শুনিয়ে শুনিয়ে বললাম,

‘আরে করবে করবে।সময় হোক,যখন ই মনের মতো মেয়ে পাবে ঠিক ই করবে।’

আরহী আবার ও অয়নের ঘরের দিকে মুখ করে বললো,

‘এই দুনিয়ায় এত মেয়ের মাঝে আজ ও যার কাউকে পছন্দ হলোনা তার আবার পছন্দ হবে।এসব ভাবাটাও বিলাসিতা রে মুগ্ধ।’

আমি চা বানানো শেষ করে বললাম,

‘দাঁড়া আমি অয়ন কে চা দিয়ে আসি।’

আরহী চায়ের কাপটা আমার হাত থেকে নিয়ে বললো,

‘আরে আমাকে দে আমি দিয়ে আসি।দেখ না কি করি।’

‘কি করবি?’

‘তুই ছাদে কাপড় আনতে গেলিনা।আমি তোর দেবরের ঘরের জানালা লাগাতে গেছিলাম।ওমা সে আমাকে দেখেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।তোর দেবর ভেবেছে এই ওয়েদার এ আমি তার সাথে রোমান্স করতে গিয়েছিলাম।বেচারা ভয়েই পালিয়েছে।তোর দেবর মেয়ে দেখলে ভয় পায় মুগ্ধ।’

‘তাহলে বোঝ কত ভদ্র।’

‘বিয়ের পর আবার এত ভদ্রতা থাকবেনা বুঝলি।’

‘কেনো থাকবেনা?’

‘আছে আছে কারণ আছে। ‘

আরহী দুই কাপ চা ছোট একটা ট্রে তে করে নিয়ে অয়নের ঘরে গিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে বললো,

‘আসবো?’

আয়ন আরহী কে দেখে দ্রুত গায়ে গেঞ্জি পরতে পরতে হচকচিয়ে বললো,

‘আ-আপনি?’

‘আপনার জন্য চা নিয়ে এলাম।’

‘নক করে আসবেন না?’

‘আসার আগে তো জিজ্ঞেস করলাম আসবো কিনা?’

‘জিজ্ঞেস করে তো এক মিনিট ও লেট করেন নি।জিজ্ঞেস করেই ঢুকে পড়েছেন।’

‘আমি জানি এটা কোনো মহিলার রুম নয় বা এটা কোনো সদ্য বিবাহিত কাপলদের ঘর নয়।তাই আর অনুমতির প্রয়োজন পড়েনি।’

অয়ন এবার মৌন আছে।কারণ সে আয়াসের মতো কথা বাড়ানোর পাত্র নয়।

আরহী চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘খান।’

অয়ন চা মুখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো আরহীর দিকে।চা তার গলার নিচে দিয়ে নামছেনা।

আরহীর নিজের জন্য নেওয়া কাপ থেকে চা খেতে খেতে বললো,

‘কি হলো অয়ন ভাইয়া চা গিলছেন না যে।আপনার মুখে আটকে গিয়েছে মনে হচ্ছে।’

অয়ন খুব কষ্টের সাথে মুখে নেওয়া চা টুকু গিলে বললো,

‘কে বানিয়েছে চা?’

‘কেনো আপনার ভাবি?’

অয়ন খুব অবাক হয়ে সন্দিহান দৃষ্টিতে কপাল কুচকে বললো,

‘ভাবি ভাবিয়েছে?’

‘ভাবি ছাড়া কে বানাবে আপনার কি বউ আছে।এমন ভাবে মুখ শিটকিয়ে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছে গেলেন যেনো আপনার বউ বানিয়েছে?’

অয়ন আবার ও মৌন আছে তবে সে বেশ বিরক্ত।চায়ের কাপ টা খুব জোরেই টি-টেবিলে রাখলো।

‘আরহী বললো,কি ব্যাপার খাচ্ছেন না যে চিনি কম হয়েছে তাইনা?আরেক টু দেই চিনি।’

‘না ঠিক আছে লাগবে না।’

আরহী অয়নের পাশে থাকা বইটা হাতে নিয়ে বললো,

‘দেখি কি বই পড়ছেন।ওহ বাবা রোমান্টিক উপন্যাস এত হুমায়ুন আহমেদ এর বই পড়েন অথচ নিজে এতটা আনরোমান্টিক। এত বই পড়ে রোমান্স শিখে কি করবেন।আপনি তো আর বিয়ে করবেন না।’

‘হু মেয়ে মানুষ ভয় পায়।’

‘কেনো মেয়ে মানুষ কি করেছে আপনার।’

‘আপনি কি করেছিলেন সেটাই ভাবুন।’

‘ওইটা একটু দুষ্টামি করেছিলাম।’

অয়ন এবার আমাকে নরম সুরে ডাকলো,

‘ভাবি।’

আমি অয়নের ডাকের ই অপেক্ষা করছিলাম।অয়ন ডাকতেই কাছে গিয়ে বললাম,

‘হ্যাঁ বলো অয়ন।’

‘তুমি কি চিনির পরিবর্তে লবন দিয়েছো চায়ে।’

‘কই নাতো,আমি নিজেও খেয়েছি চিনি ঠিক ই ছিলো।’

‘তাহলে আমার টায় হয়তো ভুলে লবন দিয়ে দিয়েছো।তাও অনেক খানিক বেশী।’

আমি আরহীর দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘কি ব্যাপার অয়নের চায়ে চিনির পরিবর্তে লবন কিভাবে গেলো আরহী?’

‘উনার ভাল্লাগেনা রোগ আছে মুগ্ধ।ভাল্লাগেনা রোগে আক্রান্ত উনি। একটু লবন দিলে যদি ভালো লাগে আমি সে চেষ্টায় করলাম।’

অয়ন বিরক্ত হয়ে আরহীর দিকে তাকিয়ে বললো,

‘আমার চায়ের পিপাসায় এভাবে জল না ঢাললেও পারতেন।বৃষ্টি, বইপড়া আর চা এদ মাঝে যে কানেকশন আছে আপনি বুঝবেন না।’

‘ছোটদের যারা আপনি আপনি করে তারা খুব সাহিত্যবিদ হয় তাইনা?’

‘অপরিচিত কাউকে তুমি বলাটা বোধহয় আপনার অভ্যাস।বাট আমার না।আর আপনি যে ইচড়ে পাকা কে বলবে আমার ছোট।’

‘এখনো আমরা অপরিচিত আছি।এক ছাদের নিচে থাকছি,খাচ্ছি,ঘুমোচ্ছি,গোসল করছি তবুও অপরিচিত।’

‘মাফ চাই আপা এইভাবে বাইরে কোথাও বলিয়েন না মানুষ অন্য কিছু ভাববে।আমার একটা সম্মান আছে।’

প্রচন্ড হাসাহাসিতে যখন তিনজন গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম।ঠিক তখন ই কলিং বেল এর সাউন্ড হলো।আমি সিওর ছিলাম আয়াস এসে গিয়েছে।দরজা খুলতেই দেখি কুসুম ভাবি।নিরাশ হলাম খুব।আমার মুখ দেখে কুসুম ভাবি বললো,

‘মন খারাপের কিচ্ছু নেই ভাবি।নিচে ভাইয়া অপেক্ষা করছে। একটা ছাতা নিয়ে যেতে বলেছে।আমাকে নিচ থেকে ডেকে বললো।’

কুসুম ভাবির সামনেই হেসে দিলাম আমি।রুমে এসে ছাতা টা নিয়েই মাথার উপর দিয়ে দৌড় দিলাম।ছাতার উপর বৃষ্টির নৃত্য ভীষণ ভালো লাগছে।রিনি ঝিনি বৃষ্টির বাজনা বেজেই চলেছে।বাসার সামনের গেটে ইউনিফর্ম পরে কাক ভেজা ভিজে দাঁড়িয়ে আছে আয়াস।নিঁখুত সুন্দর আধিকারী মানুষ হলো আয়াস।যাকে যে কোনো সিসুয়েশন এ দেখে চোখ ফেরানো যাবেনা।এই ভেজা মানুষ টাকেও ভীষণ সুন্দর লাগছে।আয়াসের চোখ মুখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।আয়াসের কাছে গিয়ে বললাম,

‘ভিজেই তো গিয়েছেন এটুকুর জন্য ছাতা আনতে বলার কি প্রয়োজন ছিলো।’

আয়াসের ঠোঁটে মৃদু হাসি।আয়াস আমার হাতে এক গুচ্ছ ভেজা রজনীগন্ধা আর লাল টকটকে তাজা গোলাপ দিয়ে বললো,

‘ আগে এগুলো ধরো তো বউ।’

আয়াসের দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘এইগুলা কি?’

‘বছরের প্রথম বৃষ্টির শুভেচ্ছা বউ।’

‘টাকা খরচ করে এত ফুল কেনার কি প্রয়োজন ছিলো।মুখে বললেই তো হতো।’

‘না মুখে বললে একটুও হতোনা।বউ এর মুখের হাসির থেকে কি টাকা বড় হলো।সারাদিন অফিস আর কাজ নিয়ে পড়ে থাকি সপ্তাহে অন্তত দুই একদিন তো আমাকে প্রেমিক হতে হবে।ঠিক প্রেমিকের মতো প্রেমিক।বউ যেনো কখনো আফসোস করতে না পারে আমার থেকে অন্য কোনো ছেলে লাভিং বেশী।’

‘তো সেটাও বুঝলাম বাট বাসায় গিয়েও তো আমাকে ফুল দিতে পারতেন।’

‘পারতাম বাট অনুভূতি টা এখনের মতো হতোনা।এইযে তুমি ছাতা মাথায় ছুটে এলে বৃষ্টির মাঝে।আর এই বৃষ্টির মাঝে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে এক গুচ্ছ ভেজা গোলাপ দেওয়ার অনুভূতি আলাদা বুঝলে মুগ্ধপরী।’

‘আমি তো কোনো ফুল টুল আনিনি কি দিয়ে উইশ করবো।’

‘আমি যে এত সময় রোমান্টিক কথা বলছিলাম।এতক্ষণ তো জড়িয়ে ধরে এসে উইশ করে দিতে পারতে।’

‘আপনার সব সময় ফাইজলামি।’

‘তোমাকে অন্য কারনেও ডেকেছি।’

‘কি কারণ।’

‘দুজনে ভিজতে।’

‘তাহলে ছাতা আনতে বললেন কেনো?’

‘তোমার মাথায় বৃষ্টি লাগলে তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে। আমি খালি মাথায় তুমি ছাতা মাথায় ওয়াও দারুণ হবেনা সিন টা।এরই মাঝে বজ্রপাত হবে তুমি ছুটে এসে শক্তপোক্ত ভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরবে।আহা কি দারূন ফিলিংস হবে ভালবাসার।’

আয়াসের বলা কথা গুলো অনুভব করেই ভীষণ ভালো লাগছে আমার।আমি ছাতার নিচেই আছি আর আয়াস খোলা মাথায় দুজনে হাঁটছি।হাঁটুর উপর পর্যন্ত ভিজে গিয়েছে বৃষ্টির পানিতে।আয়াস আমার হাত কোমল ভাবে চেপে ধরে রেখেছে। চারদিকে ঝুম বৃষ্টি। এটা বৃষ্টি নাকি দুজন মানব-মানবীর কাছে আসার গল্প।খুব চাচ্ছি বিদ্যুৎ চমকাক আকাশে।এই বিদ্যুৎ আর কেনো চমকায় না।বিদুৎ চমকালে সেই বাহানায় ভয়ের অজুহাতের বাহানায় না হয় তাকে জড়িয়ে ধরবো।আমার চোখ আকাশের পানে চেয়ে আছে চাতক পাখির মতো।অপেক্ষা করছে আকাশের বুকে লাল বাতির।এরই মাঝে আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো তবে সেটা চমকে যাওয়ার মতো নয়।খুব সাধারণ বিদ্যুৎ চমকানো যাকে বলে।কোনো শব্দ ও নেই।আকাশের বিদ্যুৎ চমকানো দেখে আকাশ কে মনে মনে একপৃথিবী সমান ধন্যবাদ দিয়ে ঠোঁটে প্রেম বর্ষনের হাসি নিয়ে ছাতা টা দূরে ফেলে দিয়ে আয়াস কে জড়িয়ে ধরলাম।চারদিকে কেউ নেই আছে শুধু ঝুম বৃষ্টি আমি আর আয়াস।

চলবে?