#তুমি_অজান্তেই_বেঁধেছ_হৃদয়
#পর্ব_২৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
অনুর জেদের কাছে বরাবরের মতোই বাড়ির সকলকে আবার হার মানতে হয়েছে। অবশ্য একটা শেষ চেষ্টা সবাই করেছে। স্নিগ্ধাকে পাঠিয়েছিল অনুকে মানানোর জন্য। কিন্তু অনু ওর নিজের সিদ্ধান্তে এতটাই অটল এবং দৃঢ় ছিল যে, স্নিগ্ধার ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেইলও কাজে লাগেনি।
রায়ানের মন মেজাজ ভালো নেই। অনুর এরকম হুটহাট সিদ্ধান্ত ওর একদম পছন্দ হয় না। কিন্তু অনু সে তো মহারানি, তাকে কিছু বলা যায় না। সে যা করবে সব ঠিক। আর রায়ান করলেই যত সমস্যা। এই পিচ্চি মেয়েটা কেমন যেন হঠাৎ করেই বড়ো করে হয়ে গেছে। আজকাল রায়ানকেও ওর সাথে কথা বলার জন্য দুবার ভাবতে হয়। চঞ্চল, পাগলাটে মেয়েটা এখন একদম ম্যাচিউর হয়ে গেছে। বড়োদের মতো কথা বলে, বড়োদের মতো আচরণ করে।
হিয়া মন খারাপ করে জিজ্ঞেস করল,
“এখন কী হবে?”
রায়ান কোনো জবাব দিল না। পিংকি বলল,
“আর কী হবে? অনু চলে যাবে হোস্টেলে।”
“প্ল্যান করলাম কী আমরা, আর হচ্ছেটা কী!” বলল মাসুদ।
পিংকি বলল,
“এসব প্ল্যান করাই উচিত হয়নি। এরচেয়ে ভালো ছিল অনুকে বুঝিয়ে বলা। জেলাস ফিল করাতে চেয়ে উলটো এখন ভুল বুঝল।”
হিয়া বলল,
“চলো আমরা সবাই অনুকে সত্যিটা বলে দেই।”
এই পর্যায়ে রায়ান বলল,
“না।”
সবাই অবাক হয়ে সমস্বরে বলল,
“কেন?”
“ওকে এখন যা-ই বলা হোক না কেন, ও শুনবে না। কারো কথা বিশ্বাসও করবে না।”
অন্তর বলল,
“তাহলে কী করবি?”
“এখন কিছুই করব না। ও রাগের মাথায় আছে। রাগ কমুক। পরে বুঝিয়ে বলব সব।”
মাসুদ বলল,
“নিজেদের মধ্যে ঝামেলা না রাখাই ভালো। আর আমার মনে হয়, এখনই সময় নিজেকে ক্লিয়ার করার। পরে আবার দেরি না হয়ে যায়!”
.
শাপলা শুয়ে শুয়ে ফোন গেইম খেলছিল এবং আড়দৃষ্টিতে অনুকে দেখছিল। অনু একটা উপন্যাস পড়ছে। শাপলা গলা খাঁকারি দিয়ে ডাকল,
“আপু?”
অনু বই থেকে মুখ না তুলেই বলল,
“বলো।”
“তুমি কি সত্যিই আগামীকাল আমার সাথে হোস্টেলে চলে যাবে?”
“হ্যাঁ।”
“এই সিদ্ধান্ত রাগ করে নিয়েছ তাই না?”
“না।”
“আমার তো মনে হয়…”
শাপলার কথা শেষ হওয়ার আগেই স্নিগ্ধা এলো রুমে। ব্যস্ত হয়ে বলল,
“দুজনে জলদি রেডি হয়ে নাও তো।”
“কেন?” জানতে চাইল অনু।
“এয়ারপোর্টে যাব। ভাইয়া চলে যাচ্ছে আজ। রাতেই ফ্লাইট।”
“আমরা কেন রেডি হবো?”
“কারণ তোমরা আমার সাথে যাবে।”
“আমার ভালো লাগছে না ভাবি। আমি যাব না। ভাইয়াকে নিয়ে যাও।”
“তোমার ভাইয়া বাসায় নেই। জুঁই এক্সামের পড়া পড়ছে। তাই মা বলেছে তোমাকে আর শাপলাকে নিয়ে যেতে।”
শাপলা আনন্দিত হয়ে বলল,
“দারুণ! আমি কখনো এয়ারপোর্টের ভেতর যাইনি জানো? আজ যাওয়া হবে।”
অনু বলল,
“ঠিক আছে। তুমি যাও ভাবির সাথে।”
“তুমি না গেলে আমি যাই কীভাবে?”
“আমার শরীরটা ভালো লাগছে না, শাপলা।”
স্নিগ্ধা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বলল,
“এ কী ধরনের কথা অনু? আমি এত করে অনুরোধ করছি তাও রাখবে না? ঠিক আছে, যেতে হবে না কারো। আমি একাই যেতে পারব।”
স্নিগ্ধা রাগ ও মন খারাপ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। শাপলা অনুকে বলল,
“ভাবি কষ্ট পেয়েছে। একটু সাথে গেলে কী এমন হবে?”
অনু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“ঠিক আছে, রেডি হও।”
অনু শুধু ড্রেসটা চেঞ্জ করেছে। তার একদমই যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কিন্তু উপায়ও নেই। ভাবির মন রাখার জন্যই যেতে হচ্ছে। অনু যাচ্ছে বলে, স্নিগ্ধা সত্যিই ভীষণ খুশি হয়েছে।
তিনজন যখন বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল, তখন রায়ান ওর কলিগদের নিয়ে বাহির থেকে বাসায় ফিরছিল। গেইটে সবার দেখা হয়ে গেল। রায়ান ভাই স্নিগ্ধাকে জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় যাচ্ছেন ভাবি?”
“এয়ারপোর্টে যাচ্ছি ভাইয়া। আমার ভাইয়ের ফ্লাইট আজ রাতে।”
স্নিগ্ধার সাথে অনুও যাচ্ছে স্নিগ্ধকে সী অফ করতে, এটা শোনার পর থেকেই রায়ানের মুখ পাংশুটে হয়ে গেছে। সে কড়া দৃষ্টিতে অনুকে দেখলেও, অনু তাকায়নি। রায়ানের অস্তিত্ব তার সামনেই আছে বলে মনে হয় না। রায়ান কোনোভাবে নিজেকে সংযত করে হাসিমুখে বলল,
“ঠিক আছে। সাবধানে যাবেন ভাবি।”
রায়ান অস্বস্তিতে ম’রে যাচ্ছিল। দুই আঙুলের একটা মেয়ে কীভাবে তাকে জ্বা’লি’য়ে, পুড়িয়ে মারছে।
.
.
অনুরা এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখল স্নিগ্ধ, ওর বাবা-মা এবং কিছু বন্ধুরা ওদের আগেই চলে এসেছে। স্নিগ্ধার সাথে অনুকে দেখে স্নিগ্ধ ভীষণ অবাক হয়েছে। অনু এসেই একদম চুপচাপ আছে। সবার সাথে কথাবার্তা বলা শেষ হলে স্নিগ্ধ এসে অনুর পাশে বসল। আজ আর কোনো দুষ্টুমির রেশ নেই তার কণ্ঠে। বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“আমি ভাবতে পারিনি, আপনি আসবেন আজ।”
অনুও স্বাভাবিক থেকে বলল,
“বড়ো চাচি আসতে বলেছে তাই।”
“ভীষণ খুশি হয়েছি।”
“কেন?”
“এইযে অন্তত বিদায় দিতে এসেছেন।”
অনু মৃদু মেকি হাসি দিল। স্নিগ্ধ বলল,
“এই কয়দিন হয়তো অনেক জ্বালিয়েছি। মনে রাগ পুষে রাখবেন না। পারলে ক্ষমা করে দিবেন।”
“না, না কী বলছেন এসব! সাবধানে যাবেন, ভালো থাকবেন। নিজের যত্ন নেবেন।”
স্নিগ্ধ হাসল। ওর চোখে-মুখে কষ্টের চাপা ছাপ ফুটে উঠেছে। অনুর ভীষণ মায়া লাগছে। বাবা-মা, পরিবার সবাইকে ছেড়ে দূরে থাকার কষ্ট কিছুটা হলেও সে নিজেও বোঝে। তাও তো সে বাবা-মাকে চাইলেই কাছ থেকে দেখতে পারে। স্নিগ্ধ তো বিদেশে থাকার জন্য তাও পারে না।
স্নিগ্ধ হেসেই বলল,
“আপনি অনেক ভালো, অনু।”
অনু এই কথায় কী জবাব দেবে বুঝতে পারল না। মৃদু হাসল শুধু। স্নিগ্ধও ঘড়িতে সময় দেখে উঠে দাঁড়াল। তার ফ্লাইটের সময় হয়ে গিয়েছে। ওর বাবা-মা তখনো কাঁদছিল। যাওয়ার সময় স্নিগ্ধর চোখও টলমল করছিল। ছেলে মানুষরা যে কেন সহজে সবার সামনে কাঁদতে পারে না!
_____________
পরেরদিন সকালে একেবারে রেডি হয়েই নিচে খেতে নেমেছে অনু। সবাই মুখ ভার করে রেখেছে। অনুর সিদ্ধান্তে কেউ খুশি নয় বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু অনুর কিছু করার নেই। সবাই তাও শেষ একবার চেষ্টা করেছে অনুকে বোঝানোর কিন্তু লাভ হয়নি।
অনু খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবার থেকে বিদায় নিয়ে নিল। রোমিওকে কোলে নিয়ে আর কান্না আটকে রাখতে পারেনি। ভীষণ খারাপ লাগছে। রোমিওর চোখও টলমল করছে। অবুঝ, অবলা প্রাণীটাও হয়তো বুঝতে পেরেছে, অনু আবারও তাকে ছেড়ে দূরে চলে যাবে। রোমিওকে বাবার কোলে দিয়ে অনু শাপলাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। ড্রাইভিং সিটে রায়ান ভাই বসে আছে। অনুর প্রতিক্রিয়ার কোনো পরিবর্তন হয়নি এতে। পুরো রাস্তাতেও তিনজন একদম চুপচাপ ছিল। রায়ান ভাইকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, ভীষণ রেগে আছে সে।
হোস্টেলের সামনে এসে গাড়ি থামাল রায়ান ভাই। অনু এবং শাপলার সাথে নিজেও গাড়ি থেকে নামল। অনু শাপলাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলে পেছন থেকে রায়ান ভাই ডাক দিল,
“অনু?”
অনু দাঁড়িয়েছে। শাপলা ওদের কথা বলার স্পেস দিয়ে চলে যাচ্ছে ভেতরে। রায়ান ভাই এগিয়ে এলো কাছে। রাশভারী কণ্ঠে বলল,
“সবসময় এত জেদ করা ভালো নয়।”
“আমি তো আপনার সঙ্গে কোনো জেদ করিনি।”
“করেছিস নাকি করিসনি তা আমার থেকেও তুই ভালো করে জানিস। তুইও অবুঝ না, আমিও না।”
“ভালো।”
“এতদিন তোকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখন থেকে আর বোঝাব না।”
অনুর বুকটা কেঁপে উঠল। তবুও স্বাভাবিক থেকে বলল,
“আচ্ছা।”
“খুব শীঘ্রই আবার তোকে বাড়ি ফিরতে হবে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য। রেডি থাকিস।”
“ওহ। হিয়া আপুর সাথে তাহলে বিয়েটা দ্রুতই হচ্ছে?”
রায়ান ভাই অন্য দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। অনুর কপালের ওপর পড়ে থাকা ছোটো চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলল,
“খুব দ্রুতই তুই আমার বউ হচ্ছিস।”
অনু সবিস্ময়ে বলল,
“মানে!”
রায়ান ভাই রহস্যজনক হাসি দিয়ে গানের সুরে বলল,
“হুট করে ফিরে এসে, লুট করে নিয়ে যাব
তুই ছাড়া কেউ বউ হবে না,
আমার এই ভালোবাসা কেন তুই বুঝিস না?”
চলবে…
#তুমি_অজান্তেই_বেঁধেছ_হৃদয়
#পর্ব_২৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
রায়ান আছে এখন মহা মুসিবতে। নিজের বিয়ের কথা নিজেই কী করে বাড়িতে বলবে সে বুঝতে পারছে না। লাজ-শরমের মাথা খেয়ে তো আর দুম করেই বাবাকে বলা যায় না,
‘আব্বু, আমি বিয়ে করব।’
তাও আবার কাকে? অনুকে! বাড়িতে তো বজ্রপাত শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু যে করেই হোক বাড়িতে বলতে হবে। ঐদিকে মহারানি খুব উড়ছেন! তাকে এবার মনের খাঁচায় বন্দি করার সময় চলে এসেছে। এখন শুধু সাহস করে বাবাকে একবার বলতে পারলেই হলো। কিন্তু কী করে যে বলবে! দুদিন পার হয়ে গেছে। অনেকবার খাবার টেবিলে বলার চেষ্টা করেছে। একাও বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
রায়ান উঠানে বসে একা একা অনেক কিছু ভাবছিল। তখন রোমিও এসে রায়ানের পা ঘেঁষে বসল। রায়ান মুচকি হেসে রোমিওকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“রোমিও, খুব টেনশনে আছি বুঝলি! তোর মালকিনকে এবার বউ করেই ফেলব। কিন্তু বাড়িতে কী করে যে বলি!”
রোমিও দাদা-দাদির ঘরের দিকে তাকিয়ে ঘেউঘেউ করতে লাগল। রায়ান ভ্রু কুঁচকে দরজার দিকে তাকিয়েই হেসে ফেলল। রোমিওকে আদর করে বলল,
“থ্যাঙ্কিউ সো মাচ রোমিও। আইডিয়া পেয়ে গেছি। দাদাকে বলব!”
রোমিওকে কোল থেকে নামিয়ে রায়ান দাদার ঘরের দরজায় নক করল। ভেতর থেকে জবাব এলো,
“দরজা খোলাই আছে।”
রায়ান ভেতরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী অবস্থা দাদু?”
“রায়ান নাকি! আয় আয় ভেতরে আয়। বোস।”
দাদি পান খাচ্ছেন বসে বসে। দাদা একটা নিউজপেপার পড়ার চেষ্টা করছিলেন। এখন আর চোখের তেমন পাওয়ার নেই। লেখা স্পষ্ট দেখেন না চশমা দিয়েও। তবুও মনের প্রয়াস আর পুরনো অভ্যাস বলে ছাড়তে পারেন না।
রায়ান দাদার পায়ের কাছে বসে জিজ্ঞেস করল,
“বিরক্ত করলাম তোমাদের?”
“না রে! কী যে বলিস। তুই এসেছিস, খুশি হয়েছি।”
“দাদু, একটা কথা বলব।”
“বল না। অনুমতি নেওয়ার কী আছে?”
“ভয় করছে একটু।”
“আমার কাছে আবার কীসের ভয়?”
“ঠিক ভয় না, লজ্জা করছে আরকি!”
দাদা হেসে বললেন,
“ব্যাপার কী দাদুভাই? আমাদের রায়ান তো লজ্জা পাওয়ার মতো ছেলে নয়। তার তো রাগ, জেদ দেখেই অভ্যস্ত আমরা।”
রায়ান দাদার পা টিপতে টিপতে বলল,
“আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি।”
দাদা, দাদি দুজনেই চমকে তাকালেন। দাদি বিস্ময় নিয়ে বললেন,
“ভালোবাসিস! তুই? কাকে?”
“এভাবে কেন বলছ দাদি? আমি কি কাউকে ভালোবাসতে পারি না?”
“এতদিন তো তা-ই মনে করতাম। তোর তো রসকষ কিচ্ছু নাই ভেতরে। পুরা শরীরটা ভরা খালি রাগ।”
রায়ান মুখ থম মেরে বসে আছে। দাদা জিজ্ঞেস করলেন,
“মেয়েটা কে?”
রায়ান চোখ বুজে সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেলল,
“অনিন্দিতা!”
দাদা অবাক হয়ে বললেন,
“অনিন্দিতা?”
“অনু।”
“আমাদের অনু?” দাদার চোখে-মুখে এখনো বিস্ময়।
রায়ান মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“হুম।”
দাদা-দাদি দুজনই দুজনের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। দাদি বললেন,
“কীভাবে কী? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”
দাদা বললেন,
“অনুও কি তোকে ভালোবাসে?”
“হ্যাঁ। কিন্তু ম্যাডাম আমার ওপর রেগে আছে। এখন জিজ্ঞেস করলে, স্বীকার করবে না। কিন্তু একসময় ঠিকই পারত না শুধু আমার জন্য ম’রে যেতে। একদিন একটু কথা শুনিয়েছিলাম বলে খুব আত্মসম্মানে লেগেছে তার। সেই হতে তার ভাব বেড়েছে। আমাকে এখন দেখতেই পারে না। ও কি পড়াশোনার জন্য বাড়ি ছেড়েছে ভেবেছ? ছেড়েছে আমার জন্য। আমার ওপর রাগ করে।”
দাদা বারবার শুধু অবাকই হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলেন,
“এখন তাহলে তুই কী চাচ্ছিস?”
“অনুকে বিয়ে করতে চাই।”
একটু থেমে ফের দাদুর হাত ধরে বলল,
“প্লিজ না কোরো না! তুমিই এখন আমার শেষ ভরসা। তুমিই পারবে বাড়ির সবাইকে এবং অনুকে রাজি করাতে।”
“অনু যদি তোকে বিয়ে করতে না চায়, তাহলে তো জোর করা যাবে না দাদুভাই।”
“অনু আমাকে এখনো ভালোবাসে দাদু। বিশ্বাস করো। শুধু আমার ওপর একটু রেগে আছে। ওর সব রাগ, অভিমান আমি ভেঙে দেবো। ওকে মানিয়ে নেব। ওর সাথে আলাদা করে কথা বললেই বুঝতে পারবে, আমাকে ভালোবাসে কিনা। অনুর সাবজেক্ট তাও পরে দাদু, আসল তো আমাদের পরিবার। বাবা-মাকে কিন্তু তোমারই বলতে হবে এবং রাজি করাতে হবে। কীভাবে কী করবে আমি জানিনা কিছু। আমি শুধু অনুকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে চাই।”
দাদা দীর্ঘশ্বাস নিলেন। পরক্ষণে হেসে বললেন,
“ঠিক আছে, আমি দেখছি। তুই যে অনুকে ভালোবাসিস, বিয়ে করতে চাস আমি খুশি হয়েছি ভীষণ।”
.
.
অনু অন্যমনস্ক হয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। তার সামনে খোলা বই। মন পড়াতে নেই। মাথার ভেতর শুধু রায়ান ভাইয়ের কথা ঘুরছে। শাপলা ক্লাস শেষ করে আসার পর থেকেই অনুকে এভাবে বসে থাকতে দেখছে। সে এসে অনুর বিছানায় বসে ডাকল,
“আপু?”
অনু ভড়কে গিয়ে বলল,
“হ্যাঁ! তুমি? বলো।”
“কী হয়েছে তোমার? ঠিক আছো তুমি?”
“হ্যাঁ। কিছু বলবে?”
“সেই কখন থেকে কী ভাবছো তুমি?”
“কিছু না তো! কখন এলে তুমি?”
“কখন এসেছি তুমি তাও টের পাওনি? রায়ান ভাইয়াকে নিয়ে ভাবছ?”
অনু চুপ করে আছে। শাপলা বলল,
“আপু, অনেক তো হলো রাগ-অভিমান। এবার ভাইয়াকে ক্ষমা করে দাও না! ভাইয়া তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।”
অনু এবারও কোনো জবাব দিল না। চুপ করেই রইল।
______
রিয়াদ অফিস থেকে এসে ফ্যানের নিচে বসেছে। ওকে আসতে দেখেই স্নিগ্ধা রান্নাঘরে গিয়ে ঠান্ডা পানি দিয়ে লেবুর শরবত বানিয়ে এনেছে। এখনো ওদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা গড়ে ওঠেনি। স্নিগ্ধাও কোনো রকম জোর করেনি। একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে বলা যায়। রিয়াদ অফিসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্নিগ্ধার সাথে আলোচনা করে। পরামর্শ নেয়। স্নিগ্ধাও আনন্দিত রিয়াদের সাথে কাজ নিয়ে কথা বলতে পেরে।
স্নিগ্ধা শরবত এনে রিয়াদের হাতে দিল। রিয়াদ হাসি দিয়ে গ্লাসটি নিয়ে বলল,
“থ্যাঙ্কিউ। এটার খুব দরকার ছিল।”
“ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।”
বলে স্নিগ্ধা রিয়াদের শার্টের বোতাম খুলতে লাগল। রিয়াদ অস্বস্তিতে গাট হয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। এরপর স্নিগ্ধার হাত ধরে বলল,
“কী করছ?”
স্নিগ্ধা হেসে বলল,
“কিছু করছি না। শার্ট পুরোটা খুলবও না ডোন্ট ওয়্যারি। জাস্ট টপ দুটো বোতাম খুলে দিচ্ছি। যাতে বাতাস লাগে। আপনার মনে কি অন্য কিছু ঘুরছে নাকি হু?”
রিয়াদ হেসে ফেলল। স্নিগ্ধার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“ইট’স ওকে, লাগবে না। আমি পারব।”
স্নিগ্ধাও হেসে বলল,
“ঠিক আছে। আপনি তাহলে একেবারে ফ্রেস হয়ে নিন। আমি নিচে যাচ্ছি।”
“আচ্ছা।”
.
রাতে সবাই খেতে বসেছে একসাথে। রায়ান বসেছে দাদার পাশে। বারবার চোখের ইশারায় প্রসঙ্গ তুলতে বলছে। দাদা গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীরকণ্ঠে বললেন,
“রমিজ, রিয়াদের তো বিয়ে গেছে আলহামদুলিল্লাহ্। এখন রায়ানের বিয়ে নিয়ে কি কিছু ভেবেছিস?”
রমিজ চৌধুরী রায়ানের দিকে একবার তাকালেন। তরকারি দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বললেন,
“আমি আর কী ভাবব? ছেলে বড়ো হয়েছে। বিয়ে তো দিতেই হবে।”
“এমন গা ছাড়াভাবে কথা বললে কি হবে? দায়িত্ব নিয়ে তো বিয়ে দিতে হবে।”
জোবেদা বেগম বললেন,
“বাবা, আপনি মেয়ে দেখেন। রায়ানের বিয়েটাও তাহলে আমরা দিয়ে দেই। মেয়ে দেখতে দেখতেই তো বছর পেরিয়ে যায়। আপনাদের নাতিদের তো আবার সহজে মেয়ে পছন্দ হয় না।”
ছোটো চাচি বললেন,
“স্নিগ্ধার আছে নাকি পরিচিত কেউ?”
দাদা দ্রুত তখন বললেন,
“কী আশ্চর্য! বাইরে মেয়ে খোঁজার কী দরকার? মেয়ে তো আমাদের ঘরেই আছে।”
সবাই এবার বিস্ময় নিয়ে তাকালেন। রমিজ চৌধুরী বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,
“মেয়ে আমাদের ঘরেই আছে মানে? কার কথা বলছ?”
“আমাদের অনুর কথা।”
এবার কারোরই আর বিস্ময়ের শেষ রইল না। রায়ান মনে মনে দোয়া পড়ছে। আলমগীর চৌধুরী চোখ দুটো গোলগোল করে তাকিয়ে আছেন। দাদা বললেন,
“কীরে? তুই এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? মেয়ের বিয়ে দিবি না নাকি?”
আলমগীর চৌধুরী আমতা আমতা করে বললেন,
“না, তা নয়! কিন্তু এত তাড়াতাড়ি অনুর বিয়ে দেবো?”
“তো বিয়ে দিয়ে কি মেয়ে তুই অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিবি নাকি? তোর মেয়ে তোর চোখের সামনেই থাকবে সবসময়। নিজেদের মধ্যে থাকবে। ভালো থাকবে। আর রায়ানকে তো তুই চিনিসই। সবাই চেনে। অনুকেও আমরা সবাই চিনি। সমস্যা কী তাহলে?”
তাহমিনা চৌধুরী বললেন,
“শুধু আমরা বললেই তো হবে না, বাবা। আগে তো ওদের মতামত নিতে হবে।”
“অবশ্যই। মতামত নাও। রায়ান আমার কথা শুনবে, অনুও শুনবে আমার বিশ্বাস আছে। তাও তোরা কথা বলে দেখ। আগে তোদের ভাই ভাইয়ের মধ্যে কোনো দ্বিমত আছে নাকি ঐটা বল।”
রমিজ চৌধুরী বললেন,
“অনুকে নিয়ে তো আমার কোনোকালেই কোনো সমস্যা নেই, বাবা। ছোটো থেকে তো বড়ো করলাম আদর-যত্ন দিয়ে। ও আমার ছেলের বউ হলে আমার খুশির শেষ থাকবে না।”
দাদা আলমগীর চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তোর সমস্যা আছে রায়ানকে নিয়ে?”
“না, না বাবা। রায়ানের মতো ছেলে হয় না। রায়ান অনুকে ভালো রাখবে আমি জানি। কিন্তু অনু? ওর মতামত ছাড়া তো আমি আগাতে পারব না। ও যা চাইবে তাই হবে। ও যদি রাজি হয় তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই।”
“ঠিক আছে। কালকেই তাহলে অনুকে বাসায় নিয়ে আসো। সরাসরি কথা বলো।
আর রায়ান, তোর তো আপত্তি নেই অনুকে বিয়ে করতে?”
রায়ান মাথা নত করে বলল,
“তোমরা যা ভালো বুঝবে তাই করো। আমার কোনো সমস্যা নেই।”
“ঠিক আছে। কালকে তাহলে অনু আসুক। বাকি কথা আমরা কাল একসাথে বসে বলব।”
_______
পরেরদিন সকালে আয়ান, স্নিগ্ধা আর জুঁইকে নিয়ে অনুকে আনার জন্য ওর হোস্টেলে গেল রায়ান। গতকাল রাতেই আলমগীর চৌধুরী ফোন করে আসার কথা বলেছিলেন। কিন্তু অনু না করে দিয়েছে। সে আসতে পারবে না। এরপর এতবার ফোন করেছে কিন্তু লাভ হয়নি। পরে ফোনও অফ করে রেখেছিল অনু।
স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করল,
“ভেতরে যাব?”
রায়ান হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলল,
“না। ওকে ডাকলেও আসবে না। একটু পরই ওর ক্লাস শুরু হবে। বের হবে এখনই।”
স্নিগ্ধা বুঝতে পারছে না, রায়ান কী করতে চলেছে। রায়ান আয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর বোন যদি যেতে না চায়, জোর করে নিয়ে যেতে পারবি না?”
“তোমার বউ তুমি কীভাবে নেবে নাও। তোমার ব্যাপার। আমি কেন জোর করব? আমি কেন খারাপ হবো শুনি? পরে রাগ করে আমার সাথেই কথা বলবে না।”
রায়ান হাসল। হেসে বলল,
“ঐযে আসছে।”
সবাই তাকিয়ে দেখে অনু গেইট দিয়ে বের হচ্ছে। হঠাৎ করে ওদেরকে দেখে অনু অবাক হলো না। নিশ্চয়ই নিয়ে যেতে এসেছে। তাই অনু ওদের সাথে কথা বলতেও এগিয়ে এলো না। অন্য সাইড দিয়ে ভার্সিটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। রায়ান প্রায় এক প্রকার দৌঁড় দিয়েই এগিয়ে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
“সমস্যা কী?”
“কোনো সমস্যা নেই।”
“এতগুলো মানুষ তোর জন্য এসেছে। তুই এভাবে চলে যাচ্ছিস কেন?”
“আমি আপনাদের সাথে যাব না তাই। আর আমার ক্লাস শুরু হবে এখনই। যেতে হবে।”
“দুদিন ক্লাস না করলে কিছু হবে না। বাসায় চল।”
“না।”
“যাবি না?”
“না।”
রায়ান একবার সবার দিকে তাকাল। বলল,
“যেতে তো তোকে হবেই। আমায় বিয়ে না করলে তোর শান্তি নেই।”
এরপর আচমকা অনুকে কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটতে লাগল। অনু হকচকিয়ে গেলেও পরে নামার জন্য অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছে। রায়ানের পিঠেও কি’ল, ঘু’ষি দিচ্ছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
চলবে…