#তুমি_অজান্তেই_বেঁধেছ_হৃদয়
#পর্ব_২৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
আকাশে মেঘ করেছে। রক্তিম মেঘ। বাতাস নেই, বৃষ্টি আসার সম্ভাবনাও কম। বাড়িতে গান-বাজনা হচ্ছে। সবাই ব্যস্ত। কিন্তু আনন্দটা ঠিক হচ্ছে না। না হওয়ার বিশেষ কারণও আছে। রায়ান এবং অনুর গায়ে হলুদ আজ। যতটা আগ্রহ নিয়ে সবাই ওদের বিয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল ততটাই আগ্রহে ভাঁটা পড়েছে সবার। সকাল থেকেই অনুর জ্বর। ভীষণ জ্বর। মাথা সোজা রেখে বসে থাকার উপায় নেই। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে অথচ গতকাল রাতেও মেয়েটা দিব্যি সুস্থ ছিল। এমতাবস্থায় রায়ান সবাইকে জানাল, বিয়ে পেছানোর কথা। আগে অনুর সুস্থতা, পরে বিয়ে। বাড়ির সকলে রাজিও হয়েছিল। কিন্তু বেঁকে বসেছে অনু নিজেই। বিয়ের এতসব আয়োজন, টাকা শুধুমাত্র তার জন্য নষ্ট হোক সে চায় না। ওর জেদের জন্যই আজ গায়ে হলুদ হচ্ছে। রায়ান খুবই অস্থির অনুকে নিয়ে। মনে হচ্ছে সে নিজেই অসুস্থ। ডাক্তার ডাকা হয়েছে, ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে, মাথায় পানি ও জলপট্টি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জ্বর নামার কোনো নামই নেই। একদম পোঁটলাপুটলি নিয়ে এসে তবেই বসেছে যেন।
রায়ান এবং অনু বসে আছে পাশাপাশি। একই বাড়ির ছেলে-মেয়ে, একই জায়গায় বিয়ে। কনে বিদায়ের কান্নাকাটিও হবে বলে মনে হয় না। বিদায় নিয়ে আর অনু যাবে কোথায়? এই বাড়িতেই তো থাকতে হবে। অনুর গায়ে হলুদ শাড়ি, গায়ে কাচা ফুলের গহনা। মুখে বিন্দুমাত্র সাজগোজ নেই। মুখ চেপে বসে আছে চুপচাপ। রায়ান অনুর হাত ধরল। সাথে সাথে মুখটা শুকিয়ে আমশি হয়ে গেল। শরীরে এত জ্বর, তাপে মনে হচ্ছে হাত পু’ড়ে যাবে রায়ানের। না জানি অনুর কত কষ্ট হচ্ছে!
“তুই কেন জেদ করলি, অনু?”
অনু স্মিত হেসে বলল,
“কখন জেদ করলাম?”
“আজ গায়ে হলুদটা না হলে কি হতো না?”
“না, হতো না। আপনার মতলব কী? আপনার হিয়াকে বউ করার ইচ্ছে আছে নাকি?”
রায়ান ধমকের সুরে বলল,
“এক থা’প্প’ড় দেবো, একদম আমার বুকে এসে পড়বি। খালি বাজে কথা!”
অনু হেসে বলল,
“তা বেশ তো! দিন থা’প্প’ড়, আপনার বুকে গিয়ে না হয় পড়লাম একটু।”
“তুই খুব বাড় বেড়েছিস।”
“হ্যাঁ, একটু একটু বেড়েছি। আপনার বউ হবো বলে কথা।”
রায়ান রাগ দেখাতে গিয়েও পারে না। অনুর শুকনো মুখটা দেখলেই মায়া হচ্ছে। সে কিছুটা শক্ত করে অনুর হাত চেপে ধরে বলল,
“তোর খুব কষ্ট হচ্ছে না রে?”
“উঁহু! খুব না। একটু। আপনি পাশে আছেন বলে সেটুকুও উপলব্ধি হচ্ছে না।”
রায়ান ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমাকে ভালোবাসিস?”
“আপনার কী মনে হয়?”
“তোকে জিজ্ঞেস করেছি।”
“ভালো না বাসলে বিয়ে কেন করছি? আপনি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছেন, আপনার আগে আমিই আপনাকে ভালোবেসেছিলাম।”
“ভুলিনি।”
“আর তাছাড়া এত তাড়াহুড়ো করে বিয়ে কেন করছি বলুন তো? কেন গায়ে হলুদ পেছাইনি?”
“কেন?”
“বলা তো যায় না, যদি এর মাঝেই ম’রে যাই?”
রায়ান ভাই ধমকে উঠল ফের।
“তোর বাজে কথা বন্ধ করবি না?”
ধমক খেয়েও অনু হেসে বলল,
“আচ্ছা সরি।”
.
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো একটু সাদামাটাভাবেই। আয়োজনের কোনো কমতি ছিল না কিন্তু উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল। অনু অসুস্থ বিধায় কেউই খুব একটা আনন্দ করতে পারেনি। রাতে সবাই ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়েছে। স্নিগ্ধা শাশুড়ি এবং চাচি শাশুড়িদের সাথে হাতে হাতে সব কাজ শেষ করে একেবারে রুমে ফিরেছে। রিয়াদ তখনো ঘুমায়নি। একটা বই পড়ছিল। রুমের দরজা আটকিয়ে স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করল,
“আপনি এখনো ঘুমাননি কেন?”
রিয়াদ বই থেকে মুখ তুলে বলল,
“এইতো বই পড়ছিলাম।”
“সারাদিন এত কাজ করেও আপনার বই পড়ার এনার্জি আছে?”
রিয়াদ স্মিত হেসে বলল,
“আছে।”
“ঠিক আছে। আর পড়তে হবে না। ঘুমান এখন।”
“তোমার সব কাজ শেষ?”
“হ্যাঁ। লাইট বন্ধ করব?”
“করো।”
“আপনি আগে শুয়ে পড়ুন।”
রিয়াদ বই বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। স্নিগ্ধা লাইট নিভিয়ে পাশে শুয়ে বলল,
“একটা জিনিস কি খেয়াল করেছেন?”
“কী?”
“রায়ান ভাই কিন্তু অনুকে ভীষণ ভালোবাসে।”
রিয়াদ চুপ করে আছে। স্নিগ্ধা নিজেই বলল,
“রায়ান ভাইয়ের চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, তিনি অনুকে কতটা ভালোবাসেন। অনুর অসুস্থতায় তিনিই সবচেয়ে বেশি কাতর। মেজো চাচ্চু যতটা অস্থির অনুকে নিয়ে, রায়ান ভাইও ততটাই যেন অস্থির। প্রতিটা মেয়েই আসলে এমন জীবনসঙ্গী চায়, যে তাকে তার বাবার মতোন আগলে রাখবে, ভালোবাসবে। সেদিক থেকে হিসাব করলে কিন্তু আমাদের অনু খুব ভাগ্যবতী বলা যায়।”
রিয়াদ মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনল। যদিও স্নিগ্ধা রায়ানের ভালোবাসার বর্ণনা করছিল, কিন্তু কোথাও যেন একটা চাপা আফসোস। না পাওয়ার আক্ষেপ। অনু যদি ভাগ্যবতী হয় তাহলে সেই একই ভাগ্যবতী হওয়ার দাবিদার স্নিগ্ধা নিজেও। কিন্তু রিয়াদের থেকে সে ভালোবাসা তো পায়নি। এই পর্যায়ে এসে রিয়াদের নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে। সে অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকতে গিয়ে বর্তমানকে নষ্ট করছে, তার সারাজীবনের সঙ্গীকে কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু তবুও স্নিগ্ধার মধ্যে কোনো অভিযোগ করার প্রয়াস নেই। সে সর্বদা স্বাভাবিক থাকে, হাসি-খুশি থাকে, বাড়ির সবার খুব খেয়াল রাখে। কে জানে তার এই অপরাধবোধ থেকেই হয়তো সে তার এক হাত স্নিগ্ধার গায়ের ওপর রাখল। কাছে আসার চেষ্টা করল। স্নিগ্ধা অবাক হলো প্রথমে, পরক্ষণে মৃদু হেসে রিয়াদের হাতটা সরিয়ে দিল। এরপর রিয়াদের দিকে মুখ করে শুয়ে বলল,
“আমার কথা শুনে আপনি আমাকে দয়া করুন এবং দয়া থেকে আমার কাছে এসে আমাকে আপন করে নিন এমনটা আমি চাই না। আমি চাই আমাকে আপনি ভালোবেসেই কাছে টেনে নিন। অল্প ভালোবাসা হলেও চলবে। তবে সেটা ভালোবাসা হতে হবে, করুণা নয়। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। গুড নাইট।”
.
অনুর রুমে সবুজ রঙের ডিম লাইট জ্বলছে। বারান্দায়ও লাইট জ্বালানো। বিয়ে বাড়ি বলে এমনিতেই আলোর ঝলকানি বেশি। রুমের দরজা আজকে লক করা হয়নি। মায়ের নিষেধ। যদি কোনো দরকার হয় যেন ছুটে আসতে পারে। যদিও সাথে শাপলা রয়েছে। কিন্তু মেয়েটার ঘুম ভীষণ গভীর। একবার ঘুমিয়ে পড়লে আর হুঁশ থাকে না। এইযে এখনো অনুকে জড়িয়ে ধরে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। এসব জড়াজড়ি করে ঘুমানো অনুর একদম পছন্দ নয়। সে মা ছাড়া কাউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে পারে না, কখনো চেষ্টাও করেনি। ওর গায়ে হাত রাখলেও ঘুম হয় না। এইযে এখনো হচ্ছে না। আবার শাপলাকে সরিয়েও দিচ্ছে না। মেয়েটার প্রতি কেমন যেন অদৃশ্য মায়া এবং ভালোবাসা জন্মে গেছে অনুর। পরিবারে অবহেলিত বলে নাকি শাপলা নিজ গুণেই অনুর মনে জায়গা করে নিয়েছে অনু তা জানে না।
অনু শুয়ে শুয়ে দেখতে পাচ্ছে, ভিড়িয়ে রাখা দরজার আড়াল থেকে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। সেই একজনটা কে অনু তা জানে। রায়ান ভাই। না ঘুমিয়ে সে এখানে কেন ঘুরঘুর করছে?
অনু বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করল। লাইটের আলো চোখে বিঁধে। ফোনের আলোতেও মাথাটা ঘুরে উঠল। ব্রাইটনেস একদম কমানো। তবুও চোখে লাগছে। কোনোরকম চোখ কুঁচকে টেক্সট দিল,
“রুমে আসুন।”
এক মিনিটের মাথাতেই রায়ান ভাই রুমে এসে হাজির। যেন সে এতক্ষণ এখানে ছিলই না এমন ভান ধরে বলল,
“কীরে হঠাৎ ডাকলি যে? কোনো সমস্যা? শরীর খারাপ করছে?”
অনুর নির্লিপ্ত জবাব,
“বসুন।”
রায়ান ভাই চেয়ার টেনে এনে বসল। অনু বলল,
“ওখানে না। আরো কাছে। আমার মাথার কাছে বসুন।”
রায়ান ভাই এক পলক তাকিয়ে থেকে অনুর মাথার কাছে বসল। অনু বলল,
“মাথায় হাত বুলিয়ে দিন।”
রায়ান ভাই অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গিয়ে কপালে স্পর্শ লাগল। আঁতকে উঠে বলল,
“এখনো তো শরীরে অনেক জ্বর! শাপলা তোকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে কীভাবে? ওর গরম লাগছে না?”
অনু হেসে বলল,
“ও ঘুমিয়ে গেলে ওর হুঁশ থাকে না। আর শরীর গরম লাগলেই বা কী? আগামীকাল তো আমাদের বিয়ে। আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবেন না?”
রায়ান ভাই থতমত খেয়ে গেছে। জ্বরের ঘোরে মেয়েটা কীসব আবোল-তাবোল বকছে! অনু ফের বলল,
“চুপ করে আছেন কেন? উত্তর দিন।”
“তোর এখন ঘুমানো উচিত, অনু। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, তুই ঘুমানোর চেষ্টা কর।”
“এড়িয়ে যাচ্ছেন? ঠিক আছে ব্যাপার না। আচ্ছা বলুন, এতক্ষণ রুমের সামনে ঘুরঘুর করছিলেন কেন?”
রায়ান ভাই ধরা খেয়ে বলল,
“কী যা তা বলছিস! আমি কেন দরজার সামনে ঘুরঘুর করতে যাব?”
“কেন ঘুরঘুর করবেন তা তো আর আমি জানি না। আপনি জানেন।”
“জ্বরে তোর মাথা গেছে।”
“মাথা আমার ঠিকই আছে। আর মাথা যদি গিয়ে থাকে তাহলে জ্বরে যায়নি, আপনাকে ভালোবেসে গিয়েছে।”
রায়ান ভাই চুপ করে আছে। অনু বলল,
“আমাকে নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমি ঠিক আছি একদম। বাইরে এভাবে ঘুরঘুর না করলেও চলবে।”
রায়ান ভাই দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলল,
“তোকে তো ঠিক থাকতেই হবে অনু। এখনো আমাদের একসাথে অনেকটা পথচলা বাকি।”
অনু ভাবনার মাঝে অনুরোধ করে বসল,
“আমাকে একটা গান শোনাবেন?”
“এখন? এই রাতের বেলা?”
“হ্যাঁ। অনুরোধ করলাম।”
“শাপলা আছে।”
“ও শুনবে না।”
“পাশের রুমে শুনবে।”
“শুনবে না। সফ্ট কোনো গান গাইলেই তো হয়। আর কেউ শুনলে শুনুক। আমি ভয় পাই নাকি? রাত পোহালেই তো আমাদের বিয়ে। আমার বর আমাকে গান গেয়ে শোনাচ্ছে এতে কার কী আসে যায়?”
রায়ান ভাই হেসে ফেলল। আদুরে কণ্ঠে বলল,
“ঠিক আছে। গান শোনাচ্ছি।”
রায়ান ভাই আবেগ মিশিয়ে গাইতে লাগল,
“হৃদয় উজাড় করে একটা জনম
করে যাব তোমারই প্রার্থনা,
যতক্ষণ থাকবে দেহে প্রাণ
তোমায় ছেড়ে কখনো দূরে যাব না।
নিশিদিন এই মনের ভেতর
করি তোমারই আরাধনা,
নিশিদিন এই মনের ভেতর
করি তোমারি আরাধনা।”
গান শেষ হলে অনু খুশি হয়ে বলল,
“থ্যাঙ্কিউ।”
“এবার শান্তি হয়েছে? এখন ঘুমো।”
অনু রায়ান ভাইয়ের একটা হাত নিয়ে গালের সাথে ঠেকিয়ে বলল,
“রায়ান ভাই, আমি যদি সত্যিই ম’রে যাই আপনি কী করবেন?”
চলবে…
#তুমি_অজান্তেই_বেঁধেছ_হৃদয়
#পর্ব_২৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
সকাল থেকে তুমুল বৃষ্টি। বাড়ির মানুষজন চিন্তায় পড়ে গেল, এমতাবস্থায় বিয়ে কীভাবে সম্পন্ন হবে? তারওপর অনুটা অসুস্থ। কোনোভাবেই তো আর বৃষ্টির পানি গায়ে লাগানো যাবে না। কিন্তু আকস্মিকভাবে দেখা গেল, সকালে অনুর জ্বর নেমে গেছে। আগের মতো শরীরও দুর্বল লাগছে না। অনেকটাই প্রাণোচ্ছল লাগছে ওকে। কিন্তু তবুও বাড়ির মানুষজন রিস্ক নিলেন না। সাজগোজ থেকে শুরু করে বিয়েও পড়ানো হলো বাড়ির ভেতর। শুধু মেহমানদের খাওয়ানো হয়েছে বাহিরে। যদিও অল্প সময়ে তেমন ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। অনেকে আবার বৃষ্টির জন্য দাওয়াতে আসেওনি। রিসিপশনে বড়ো করে আয়োজন করবেন বলে সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন রমিজ চৌধুরী।
অনু একাই বসে আছে রায়ানের রুমে। সেই যে সবাই ওকে রেখে চলে গেল, এখনো কারো আসার নাম নেই। বাইরে এখনো কী প্রচণ্ড বৃষ্টি! ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে অনুর। পুরো রুমে চোখ বুলাল। কী সুন্দর পরিপাটি করে গোছানো সব। তার রুমের গোছানোর কাজ সে নিজেই করে। অনু নিজে মেয়ে হয়েও বোধ হয় এতটা গোছানো স্বভাবের নয়। মুচকি হাসল অনু। একসময় এই রুমে ঢুকতেও ভয় পেত সে। আর এখন রায়ান ভাইয়ের সাথে সেও এই রুমের অংশিদার। কত মায়া, কত আশা আর কত স্বপ্ন জড়িয়ে আছে। সে কল্পনাও করতে পারেনি তার স্বপ্ন একদিন সত্যি হয়ে যাবে। রায়ান ভাই ওর হয়ে যাবে, ও’কে ভালোবাসবে, চোখে হারাবে। মাঝে মাঝে আল্লাহ্ না চাইতেও অনেক কিছু দিয়ে দেন। এই যেমন অনুকে এখন দিচ্ছেন দুহাত ভরে।
অনু মনে মনে হেসে বিছানায় হালকা কাৎ হতেই রুমে ঢুকল রায়ান ভাই। দরজা লাগিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“ঘুমিয়ে পড়েছিস?”
“না। এমনিই শুয়েছিলাম একটু।” অনুর নির্লিপ্ত জবাব।
“শরীর খারাপ করছে? তাহলে ঘুমিয়ে পড়।”
“ঘুমিয়ে যাব?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
রায়ান ভাই বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে যেন একটু থমকাল। ঘুমাবে কেন এর আবার উত্তর কী হতে পারে?
“আমি ঘুমিয়ে গেলে আপনি কী করবেন?”
অনুর পালটা প্রশ্নে রায়ান ভাই হকচকিয়ে বলল,
“কী করব আমি? ঘুমাব।”
“ঘুমাবেন নাকি অন্য কারো কাছে যাবেন?”
“ছি! কীসব বাজে কথা।”
“কাছে আসেন।”
“কী?”
“কী কী করেন কেন? বললাম কাছে আসতে।”
“ফ্রেশ হয়ে আসি? এখনো বিয়ের পাঞ্জাবি পরে আছি।”
“আচ্ছা।”
রায়ান ভাই ঠান্ডার মধ্যেও গোসল করে বের হল। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল,
“ঘুমিয়ে পড়েছিস?”
অনুর কোনো সাড়াশব্দ নেই। রায়ান ভাই খাটে বসে, অনুর মুখের দিকে ঝুঁকে তাকাল। বোঘোরে ঘুমুচ্ছে অনু। রায়ান ভাই কপালে হাত রেখে দেখল, জ্বর এখনো আছে কিনা। জ্বর নেই দেখে স্বস্তির নিস্তার নিল। মুচকি হেসে অনুর কপালে চুমু খেল। এরপর অনুকে বুকে নিয়ে নিজেও শান্তিতে ঘুম দিল। কত কাহিনি, ঝামেলার পর অনুকে নিজের করে পেয়েছে সে।
.
বিয়ের দিন যেরকম তুমুল বৃষ্টি হয়েছিল, পরেরদিন ঠিক ততটাই প্রখর রোদ উঠল। এক হিসেবে ভালোই হয়েছে। রিসিপশনের অনুষ্ঠানটা এখন ভালোমতো করা যাবে। অনুও এখন সুস্থ।
ঘুম থেকে উঠে অনু উঠানে গেল। রোমিও ওকে দেখে দৌঁড়ে এসে কোলে উঠেছে। অসুস্থতা ও বিয়ের ঝামেলায় রোমিওকে সেভাবে সময়ই দিতে পারেনি অনু। ওকে কোলে নিয়ে আদর করছিল, তখন চাচিরা এসে তাড়া দিলেন দ্রুত নাস্তা করার জন্য। একটুপরই পার্লারে সাজতে যেতে হবে।
সূর্য এসে পাশে দাঁড়াল মুখ গোমড়া করে। সে অনেক চেষ্টা করে স্বাভাবিক থাকার। কিন্তু অনুকে দেখলেই তার সেই চেষ্টায় ভাঁটা পড়ে। বুকটা খাঁখাঁ করে। শূন্য লাগে নিজেকে। কেন যে সে অনুর প্রেমে পড়তে গিয়েছিল আজও বোঝে না। অনু কখনোই তার হওয়ার ছিল না। নানা, মামারা কেউ সম্পর্কের বিয়ে পছন্দ করেন না। তারওপর অনু ওর থেকে বয়সে বড়ো। কখনো বাড়িতে মুখ ফুটে অনুকে বিয়ে করার কথা বলার সাহসও হতো না। আর অনুকে বললে তো গালে থা’প্প’ড় পড়ত শিওর! সব হিসাব করতে গেলে অনুকে পাওয়ার ইচ্ছে আকাশ-কুসুম ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তবুও বোকা মন। বুঝতে চায় না।
“কীরে? কিছু বলবি?” সূর্যর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল অনু।
“না, তোমায় দেখছি। জ্বর কমেছে?”
“হ্যাঁ।”
“জ্বর হলে আমরা কাবু হয়ে যাই, আর তুমি সুন্দর হয়ে গেছ ব্যাপারটা কী?”
“সবই দুলাভাইয়ের ভালোবাসার জাদু।”
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে বলল শাপলা। সূর্য বিরক্ত হলো। চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
“তোমাকে এসব কথা কে বলতে বলেছে? বলবে না এসব। আমার ভালো লাগে না।”
অনু ধমক দিয়ে বলল,
“থা’প্প’ড় দেবো সূর্য। বেয়াদবের মতো কথা বলছিস কেন? শাপলা তোর বয়সে বড়ো। আমি যেমন তোর বড়ো বোন, শাপলাও তেমন।”
সূর্য তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বলল,
“নিকুচি করেছি বড়ো বোনের! আমার কোনো বড়ো বোন নেই।”
এরপর রাগ দেখিয়ে হনহন করে ওপরে চলে গেল। অনু হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে। শাপলা হাসছে মুচকি মুচকি। অনু বলল,
“ওর কথায় কিছু মনে কোরো না।”
শাপলা হাসতে হাসতে বলল,
“ধুর! ওর কথায় আমি কী মনে করতে যাব? আমার তো ওকে রাগিয়ে দিয়ে মজা লাগছে। তোমাকে ও পছন্দ করে, তুমি বোঝো না?”
অনু সতর্ক হয়ে বলল,
“চুপ! বাড়ির কেউ জানলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে একদম।”
এরপর একটু চুপ থেকে বলল,
“আমি সবই বুঝি। কিন্তু সব কিছুকে সব সময় পাত্তা দিতে নেই। কিছু জিনিস বুঝেও এড়িয়ে যাওয়া ভালো।”
.
লিলি খালা চা নিয়ে গেলেন রিয়াদের রুমে। রিয়াদ আলমারি থেকে শার্ট বের করছিল রিসিপশনে পরার জন্য।
“তোমার চা।”
রিয়াদ ফিরে লিলি খালাকে দেখে বলল,
“স্নিগ্ধা কোথায়? ওকে না বললাম চা দিয়ে যেতে?”
“স্নিগ্ধা ব্যস্ত আছে।”
“ওকে আসতে বলো। দরকার আছে।”
“আচ্ছা।”
লিলি খালার থেকে জরুরি তলব পেয়ে স্নিগ্ধা ছুটে এলো, জরুরি কোনো দরকার আছে ভেবে। অথচ রিয়াদ স্নিগ্ধার ঘনিষ্ঠ হতে চায়, কাছাকাছি থাকতে চায়, দূরত্ব মিটিয়ে নিতে চায়। তাই তার নানান অজুহাত এবং বাহানা। কিন্তু ইন্ট্রোভার্ট এবং লাজুক স্বভাবের হওয়ায় সরাসরি বলতেও পারে না। স্নিগ্ধাও যেন কেমন অন্ধ সেজে থাকে মনে হয়। না হলে কেন সে রিয়াদের চোখের ভাষা বোঝে না?
“ডেকেছেন আমায়?”
রিয়াদ গম্ভীর হয়ে বলল,
“হুম। তোমার কাছে চা চেয়েছি। তুমি লিলি খালাকে দিয়ে কেন পাঠিয়েছ?”
“চাচিদের সাথে একটু কাজ করছিলাম।”
“তুমি কি আমাকে এড়িয়ে চলছ?”
স্নিগ্ধা অবাক হয়ে বলল,
“এড়িয়ে চলব কেন?”
“জানি না।”
দুজনই চুপ করে আছে। স্নিগ্ধা রিয়াদের ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করছে। হঠাৎ করে কী হলো লোকটার? এদিকে রিয়াদ নিজে পছন্দ করে স্নিগ্ধার জন্য একটা শাড়ি এনেছে। কিন্তু কীভাবে দেবে বুঝতে পারছে না। লজ্জা লাগছে আবার সংকোচও হচ্ছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে স্নিগ্ধা বলল,
“কিছু কি বলবেন? লাগবে কিছু?”
“তোমার মনে হয় খুব তাড়া আছে। আচ্ছা আর সময় নষ্ট করব না।”
“ভুল বুঝছেন আমায়।”
“আলমারির দ্বিতীয় কেবিনেটে একটা শাড়ি আছে তোমার জন্য। জানি, রায়ানের বিয়ে উপলক্ষে তোমার জন্য শপিং করা হয়েছে। তাই জোর করব না। ইচ্ছে হলে পরতে পারো। আর না হলে নেই। আমি কিছু মনে করব না।”
রিয়াদ আর অপেক্ষা করল না। দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার হার্টবিট দ্রুত চলছে। এরকম হতো যখন সে মায়ার সাথে নতুন সম্পর্কে ছিল। ভয় লাগত, নার্ভাস হয়ে পড়ত। গুছিয়ে কথা বলতে পারত না। এসব দেখে মায়া ঠোঁট টিপে হাসতো খুব। স্নিগ্ধা অবশ্য হাসেনি। হয়তো হাসার সুযোগটাই পায়নি। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল রিয়াদের দিকে।
রিয়াদ রুম থেকে চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল স্নিগ্ধা। এরপর সে আলমারি খুলে কাঁপ কাঁপা হাতে শাড়ির প্যাকেটটি বের করল। শাড়িটি বুকে নিয়ে সে হাঁপুস নয়নে কাঁদছে। আনন্দের কান্না। রিয়াদ বিয়ের পর হতে অনেক কিছুই স্নিগ্ধাকে কিনে দিয়েছে। তবে সেসব ছিল শুধু দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে। কিন্তু স্নিগ্ধা জানে, আজ এই শাড়ি দায়িত্ব, কর্তব্য থেকে নয়, ভালোলাগা থেকে, ভালোবাসা থেকে নিয়ে এসেছে।
.
.
কিছুদিন আগেই লম্বা ছুটি কাটিয়েছে বলে রায়ানের এক্স কলিগরা ওর বিয়েতে আসতে পারেনি। কিন্তু রিসিপশনে এসেছে। সবাই অনুকে ভাবি, ভাবি ডেকে একদম পাগল করে ফেলেছে। হিয়াকে দেখলেই অনুর অনেক কিছু মনে পড়ে যায়। যদিও সেসব অভিনয় ছিল, তবুও অনুর ভীষণ রাগ হয়, হিংসা হয়। এইযে রিসিপশনে এসে রায়ান ভাইয়ের সঙ্গে হেসে হেসে ছবি তুলেছে, গল্প করেছে অনুর একদম ভালো লাগছে না। যদিও সে মুখে কিছুই বলেনি। কিন্তু মুখ ভার করে রেখেছে। আর কেউ না বুঝলেও রায়ান ভাই বুঝেছে। বউদের জেলাসি ভিন্ন রকম সুন্দর হয়।
অন্যদিকে আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু থেকে সব মেহমানদের আপ্যায়ন করা নিয়ে ব্যস্ত রিয়াদ। কিন্তু তার মন পড়ে আছে স্নিগ্ধার কাছে। ওর দেওয়া নীল শাড়িটা পরেছে স্নিগ্ধা। কী যে সুন্দর লাগছে! চোখ ফেরাতে পারছিল না রিয়াদ। কিন্তু না ফিরিয়েও উপায় নেই। তার অনেক দায়িত্ব এখন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বউকে একটু দুচোখ ভরে দেখার ফুরসত হচ্ছে না। এখন রাতের অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই। কিন্তু বাড়িতে ফিরে যদি স্নিগ্ধা শাড়ি খুলে ফেলে? আচ্ছা সমস্যা নেই। প্রয়োজনে সে লাজ-শরমের মাথা খেয়ে অনুরোধ করবে আবার শাড়ি পরার জন্য।
অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে বাড়ি ফিরে যা ভেবেছিল তা-ই হলো। স্নিগ্ধা শাড়ি চেঞ্জ করে ফেলেছে। স্নিগ্ধার ভীষণ মন খারাপ। যতটা আনন্দ নিয়ে শাড়িটা পরেছিল ততটাই এখন মন খারাপ তার। রিয়াদ সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল। স্নিগ্ধা অবুঝ নয়। ব্যস্ততা বোঝে। এ নিয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই। অভিমান শুধু এই জন্যই যে, রিয়াদ একটাবার মুখ ফুটে কিছু বললও না। প্রসংশাও করল না।
মন খারাপ করে স্নিগ্ধা যখন রুমে এলো, রিয়াদ তখন ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল। স্নিগ্ধা কোনো কথা বলল না। চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। রিয়াদ কী করবে বুঝতে পারছে না। স্নিগ্ধা কি কোনো কারণে ওর ওপর রেগে আছে?
রিয়াদ সাহস সঞ্চয় করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“তুমি কি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছ?”
স্নিগ্ধা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলল,
“কেন? আপনার কিছু লাগবে?”
“হ্যাঁ।”
“কী?”
রিয়াদ ফট করে বলে ফেলল,
“তোমাকে।”
স্নিগ্ধা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“কী?”
রিয়াদ এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসল স্নিগ্ধার পাশে। লাজলজ্জা ভুলে গিয়ে, দূরত্বের দেয়াল ভেঙে ফেলে স্নিগ্ধার হাত ধরে বলল,
“বউ, শাড়িটা আরেকবার পরো না? তোমাকে একটু চোখ ভরে দেখি।”
স্নিগ্ধা আনন্দে ও লজ্জায় জবাব দিতে পারল না। ঝাঁপিয়ে পড়ল রিয়াদের বুকে।
অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফেরার পর অনু চুপচাপ একদম। ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়েছিল। মায়ের জোরাজুরিতে অল্প একটু খেয়েছে। রায়ান রুমে আসার পরও কথা বলেনি। মনে মনে হাসে রায়ান। ফ্রেশ হয়ে পাশে বসল। এরপর অনুর পাশেই শুয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে?”
অনু নিশ্চুপ।
“কী হয়েছে? শরীর খারাপ?”
অনু মনে মনে বলল,
“মাথা খারাপ!”
“কথা বলছিস না কেন?”
“ঘুম পাচ্ছে।”
“ঘুম পেলে ঘুমাবি। তাকিয়ে আছিস কেন?”
“আমার ইচ্ছে।”
“তাকিয়ে তাকিয়ে ঘুমাবি?”
অনু বিরক্ত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল। জিজ্ঞেস করল,
“জ্বালাচ্ছেন কেন?”
রায়ানও উঠে বসে বলল,
“জ্বালাচ্ছি নাকি?”
“তাহলে কী করছেন?”
রায়ান ভাই এ কথার জবাব না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে বলল,
“আমার মনে হয় সুগার লো হয়ে গেছে!”
অনু মেজাজ দেখিয়ে বলল,
“তো আমি কী করব?”
“তুই কী করবি মানে? তুই না করলে কে করবে? তুই-ই তো সব করবি। তুই কি ভুলে যাচ্ছিস আমি তোর স্বামী?”
অনু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
“না, ভুলিনি। মেডিসিন আনব?”
“উঁহু! চুমু খা। তাহলেই হবে।”
চলবে…