তুমি অজান্তেই বেঁধেছ হৃদয় পর্ব-০৪

0
2

#তুমি_অজান্তেই_বেঁধেছ_হৃদয়
#পর্ব_৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________
অনু ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিচে নামল। তাহমিনা বেগম ওর জন্য নাস্তা নিয়ে বসে আছেন। সবারই নাস্তা করা শেষ। শুধু তার নবাবজাদি মেয়েরই নাস্তা হয়নি এখনো। ভার্সিটিতে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে উঠবে ঘুম থেকে। এরপর নাকে-মুখে কোনো রকম খেয়েই দৌঁড় দেবে ক্লাস করার জন্য।

অনু আজ নাস্তা না করেই চলে যাচ্ছিল। তাহমিনা বেগম পিছু ডেকে জোর করে চেয়ারে বসালেন। অনু ব্যস্ত হয়ে বলল,

“এমনিই দেরি হয়ে গেছে, মা। এখন নাস্তা করতে গেলে আরো বেশি দেরি হয়ে যাবে।”

“হলে হোক। আরো আগে ঘুম থেকে উঠতে পারিস না?”

অনুকে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন তাহমিনা বেগম। সূর্য এসে পাশে চেয়ার টেনে বসল। অনুকে খোঁচা মেরে বলল,

“কী করে আগে উঠবে, মামি? আপু তো ঘুমায়ই কত রাত করে!”

অনুর মুখে খাবার বলে কিছু বলতে পারল না। অবশ্য চোখ রাঙানি দিয়েছে। তাহমিনা বেগম মেয়েকে বললেন,

“রাতে এত জোরে গান গাস কেন? তোর ভাইয়ারা সবাই কাজ করে আসে। তোর জন্য ঘুমাতেও পারে না ঠিকমতো।”

অনু বেশ অবাক হয়ে তাকাল মায়ের দিকে। জিজ্ঞেস করল,

“তোমাকে কেউ বিচার দিয়েছে নাকি?”

“বিচার দেওয়ার কী আছে? নিচের রুম থেকে তো আমি নিজেই তোর গানের গলা শুনেছি।”

সূর্য বলল,

“রায়ান ভাইয়া যে সকালে নাস্তা করার সময় নালিশ করল সেটা বলছ না কেন, মামি?”

তাহমিনা বেগম সূর্যকে ধমক দিয়ে বললেন,

“তুই চুপ কর।”

অনুর এত মন খারাপ হলো! মুহূর্তেই মুখটা অমাবস্যার অন্ধকারে ছেয়ে গেল। খাবার আর নামছে না গলা দিয়ে। ক্লাসেও যেতে ইচ্ছে করছে না। এই ছোটো একটা কারণেও রায়ান। ভাই মায়ের কাছে নালিশ করল? এতটাই বিরক্ত তিনি অনুর ওপর? অথচ অনু কিনা রায়ান ভাইয়ের উদ্দেশেই গলা ছেড়ে গানটি গেয়েছিল! বুক ভরে শ্বাস নিয়ে পানি পান করল অনু। তড়িঘড়ি করে উঠে বলল,

“যাই মা।”

“এইটুকু শেষ করে যা?”

“উঁহুম! পেট ভরে গেছে।”

কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে অনু বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। ক্লাস করার ইচ্ছে নেই আর। কিন্তু ভার্সিটিতে যাবে। বান্ধবীদের সাথে সময় কাটাবে। তাই প্রথম ক্লাসটা মিস দিলেও সমস্যা নেই। তাড়া নেই বলে রিকশাও নিল না। হাঁটছে সে নিরবে। হঠাৎ খেয়াল করল পাশে সূর্যও হাঁটছে। অনিচ্ছাকৃত অনু প্রশ্ন করল,

“কোথায় যাচ্ছিস?”

“তোমাকে এগিয়ে দিতে।”

“কেন? আমি কি বাচ্চা নাকি? ভুলে যাস না, আমি তোর থেকেও এক বছরের বড়ো।”

সূর্য বিরক্ত হয়ে বলল,

“বারবার বয়স মনে করিয়ে দেওয়ার কী আছে আমি বুঝি না!”

অনু জবাব দিল না। সূর্যও কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল,

“তোমার কি মন খারাপ?”

“মন খারাপ হবে কেন?”

“এইযে রায়ান ভাইয়া তোমার নামে নালিশ দিয়েছে বলে?”

“নালিশ দেওয়ার সময় কি তুই ছিলি?”

“হ্যাঁ।”

“কী বলেছিল রায়ান ভাই?”

“তোমার জোরে গান গাওয়ার জন্য সে ঠিকঠাক কাজ করতে পারছিল না। রাতে যেন এত জোরে গান না গাও সেটাই বলেছে।”

অনু মন খারাপ করে বলল,

“ওহ।”

সূর্য ওর মন ভালো করার জন্য পকেট থেকে তিনটা চকোলেট বের করে দিল। অনু চকোলেট পেয়ে হেসে ফেলল। বলল,

“তুই আসলে এতটাও খারাপ না!”

“হুম জানি তো আমি! শুধু তুমিই আমাকে বোঝো না।”

অনু হাঁটছে আর চকোলেট খাচ্ছে। সূর্য ওর দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। আজ বেশ ভালোই রোদ উঠেছে। অনুর মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। তবুও কত স্নিগ্ধ লাগছে অনুকে। সূর্য বলল,

“তুমি কিন্তু খুব সুন্দর গান গাও। আমার তো গতকাল রাতে ভীষণ ভালো লাগছিল তোমার গান শুনতে। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল বলে আর রুমে যাইনি।”

“যাক! তোর তাহলে ম্যানার্স আছে।”

“তুমি যে আমাকে কী ভাবো!”

“বাঁদর ভাবি।”

“আর কী ভাবো?”

“আর কী ভাবব?”

“তুমি জানো।”

অনু একটু কী জানি ভাবল। পরক্ষণে সূর্যর গাল টেনে হেসে বলল,

“আর আমার ছোটো ভাই ভাবি।”

সূর্যর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আর হাঁটতে ইচ্ছে করছে না ওর। সে থেমে গিয়ে বলল,

“পা ব্যথা করছে।”

“বাড়িতে চলে যা।”

“তোমাকে রিকশা ঠিক করে দেবো?”

“দে।”

সূর্য অনুকে একটা রিকশা ঠিক করে দিয়ে নিজে অন্য রিকশা করে বাড়িতে ফিরল। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল আর একটা বছর বয়স ওর বেশি হলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত?
.
.
ভার্সিটি থেকে আসার সময়ও অনু হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরে। কারণ আসার সময় ওরা অনেকগুলো বান্ধবী একসাথে আসে গল্প করতে করতে। বাড়ির কাছে বাজারে দোকানগুলোর সামনে দিয়ে আসার সময় একটা কুকুরের বাচ্চা অনুর পিছু নেয়। অনু এখন একা। ওর বাসা-ই সবার শেষে। কুকুর, বিড়াল তার এমনি ভীষণ পছন্দ। কিন্তু ভয় লাগে যদি কামড় দেয়? অনু দৌঁড় দিতে গিয়েও থেমে যায়। ভয়ে ভয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বাচ্চা কুকুরটিও ওর দিকে তাকিয়ে আছে। বাচ্চাটা অনেক কিউট আর গুলুমুলু। প্রথমে অনু ভয় পেলেও দৌঁড় দেয় না। আস্তে আস্তে হাঁটছে। বাচ্চাটাও পিছু পিছু হাঁটছে। অনু একটা দোকানের সামনে এসে বাচ্চা কুকুরটিকে রুটি কিনে দিল। রুটি পেয়ে কুকুরটি ভীষণ খুশি। লেজ নাড়িয়ে অনুর চারপাশে কিছুক্ষণ ঘুরপাক খেল। এরপর রুটিটা খেল। ওর এমন কান্ড দেখে অনু হেসে ফেলে।

অনু বাড়িতে আসার সময় বাচ্চাটিও সাথে সাথে আসে। বাড়ির কিছুটা দূর থেকে অনু ওকে পাঠিয়ে দিল। অদ্ভুত বিষয় কুকুরটি যেন ওর ভাষা বুঝতে পেরেছে। লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে আবার ফিরে গেছে সে। সকালে অনুর মন খারাপ ছিল। ভার্সিটিতে গিয়ে বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দিয়ে, ফুচকা-চটপটি খেয়ে মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। এখন এই বাচ্চা কুকুরটির জন্য তার মন আরো ভালো হয়ে গেছে। সে খুশি মনে বাড়িতে ঢুকে দেখে উঠানে পেতে রাখা জলচৌকিতে পা ঝুলিয়ে শুয়ে আছে রায়ান ভাই। চোখের ওপর একটা হাত রাখা। অন্য হাত পেটের ওপর। লোকটা এখানে কেন ঘুমাচ্ছে? ঘুমাচ্ছে নাকি এমনিই শুয়ে আছে? সকালের কথা মনে পড়তেই সকল কৌতুহল উবে গিয়ে অভিমান এসে মনে ভর করল। চুপচাপ উপরে যাওয়ার সময় রায়ান চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে তাকাল। অনুকে দেখে বলল,

“এক গ্লাস পানি দে তো।”

অনুর একটু রাগও হলো না। বিরক্তও হলো না সে। ব্যাগটা চেয়ারের ওপর রেখে পানি আনতে গেল। পানি এনে দেখে রায়ান ভাই আবারও আগের মতো করে শুয়ে আছে। সে এসে গলা খাঁকারি দিয়ে ডাকল,

“রায়ান ভাই, আপনার পানি।”

শোয়া থেকে উঠে বসল রায়ান। পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানিটুকু পান করল। গ্লাসটা পুনরায় অনুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চুপচাপ ওপরে চলে গেল। হা করে তাকিয়ে আছে অনু। এমন কেন এই মানুষটা? আর একটা বাড়তি কথাও কি বলা যায় না? হনহন করে অনুও নিজের রুমে চলে গেল।

_____

ক্লাস শেষ করে এসে দুপুরে একটু ঘুমিয়েছিল অনু। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ছাদে গেল হাঁটতে। অনেকগুলো শাড়ি শুকাতে দেওয়া। শাড়িগুলো ওর মায়ের। একটা শাড়ি অনুর খুব পছন্দ হয়েছে। সে শাড়িটা তুলে নিয়ে টি-শার্টের ওপরেই পেঁচিয়ে কোনো রকম পরে নিল। এরপর আঁচল ধরে একা একাই ছাদের মাঝখানে ঘুরতে লাগল। হাওয়ায় তার চুলও উড়ছে, শাড়ির আঁচলও উড়ছে।

“চরকির মতো এমন ঘুরছিস কেন? ভূতে ধরেছে?”

ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অনু থমকে গেল। রায়ান ভাইকে দেখে আরেকটু ভয় পেল। লজ্জাও লাগছে একটু। কখনো ভালো করে শাড়ি পরে সামনে যেতে পারল না, অথচ আজ উলটা-পালটা পাগলের মতো শাড়ি পরেছে; আর আজই রায়ান ভাইকে সামনে চলে আসতে হলো। রায়ান ভাই অবশ্য অনুর দিকে বিশেষ লক্ষ্য দিল না। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“নিচে যা।”

অনু সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল,

“কেন?”

“কাজ আছে।”

“কী কাজ?”

“তোকে কেন বলব?”

“আচ্ছা বলতে হবে না। কিন্তু আমি ছাদে থাকলে কী সমস্যা? আমি আপনাকে বিরক্ত করব না।”

রায়ান আর কিছু বলল না। অনু ছাদে পায়চারি করতে করতে দেখতে পেল, রায়ান পকেট থেকে সিগারেট আর ম্যাচ বের করেছে। এর আগেও অনু অনেকবার রায়ান ভাইকে সিগারেট খেতে দেখেছে। তবে লুকিয়ে। এভাবে সম্মুখে কখনো দেখেনি। রায়ান ভাইও ওদের সামনে কখনো সিগারেট খায়নি। আজ খাচ্ছে। অনুর রাগ দেখানোর সাহস নেই। কিন্তু সে সাহস সঞ্চয় করে অন্য উপায়ে বলল,

“আপনি সিগারেট খাচ্ছেন?”

“না, বাঁশগাছ চিবুচ্ছি!”

অনু ভ্রু কুঞ্চন করে বিড়বিড় করল কিছুক্ষণ। রায়ান মনের সুখে সিগারেট খাচ্ছে। অনু বলল,

“সিগারেট তো খায় খারাপ মানুষ।”

“তোকে কে বলল আমি ভালো মানুষ? আমিও খারাপ মানুষই।”

“মিথ্যা কথা। আপনি ভালো মানুষ। তাই আপনি আর সিগারেট খাবেন না।”

“হুকুম দিচ্ছিস?”

“না, অনুরোধ করছি।”

“তোর অনুরোধ রাখতে পারছি না বলে দুঃখিত। এখন নিচে যা।”

“সবসময় আপনি এরকম তাড়িয়ে দেন কেন আমাকে?”

রায়ান নিশ্চুপ। সে জবাব না দিয়ে ছাদে হাঁটছে আর সিগারেট খাচ্ছে। অনুও ওর পেছনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

“এখন কথা বলছেন না কেন?”

“নিচে যা, অনু। মেজাজ খারাপ করিস না।”

“আপনার শুধু আমার ওপরেই মেজাজ খারাপ হয়। আমি যা করি, যা বলি তাতেই বিরক্ত হোন আপনি। একটু গান গেয়েছি বলে এরজন্যও আপনি মায়ের কাছে নালিশ করেছেন। কখনো কথা বলতে এলেও দূরদূর করে তাড়িয়ে দেন। কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেন না। এখনো চুপ করে আছেন। কেন?”

একসাথে এতগুলো কথা বলে অনু নিজেই ভড়কে গেল। আজ তার ওপর কী ভর করেছে? রায়ান ক্ষিপ্ত হয়ে সিগারেটটা ফেলে পা দিয়ে পিষে অনুর কাছে এগিয়ে এলো। অনুর দুই হাত পেছনে নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে জিজ্ঞেস করল,

“কী জানতে চাস তুই?”

চলবে…